আল-কায়েদা

আল-কায়েদা অথবা তানজিম কায়েদাতুল জিহাদ (আরবি: تنظيم قاعدة الجهاد ; রোমান: al-Qāʿida; অর্থ: বেস বা সেনা ঘাঁটি) হল সালাফি জিহাদবাদের নেতৃত্বে সংগঠিত একটি সুন্নি সর্ব-ইসলামবাদী বৈশ্বিক জিহাদি সংগঠন, যারা মুসলিম বিশ্বকে খিলাফত নামী একটি সুপার ন্যাশনাল ইসলামি রাষ্ট্রের অধীনে একত্র করার জন্য বিশ্বব্যাপী একটি ইসলামি বিপ্লবের নেতৃত্ব দিচ্ছে। দলটির সদস্যদের বেশিরভাগই আরবদের সমন্বয়ে গঠিত; তবে এটি অন্যান্য জাতির লোককেও অন্তর্ভুক্ত করে। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আল-কায়েদা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সামরিক ও বেসামরিক সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে: ১৯৯৮ সালের মার্কিন দূতাবাসে বোমা হামলা, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হামলা ও ২০০২ সালের বালি বোমা হামলা। সংগঠনটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা (ন্যাটো) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একটি জিহাদি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসাবে মনোনীত হয়েছে।

আল-কায়েদা
تنظيم قاعدة الجهاد
নেতাওসামা বিন লাদেন  (১৯৮৮–২০১১)
আয়মান আল-জাওয়াহিরি  (২০১১–২০২২)
সাইফ আল-আদেল (দে ফাক্তো, ২০২২–বর্তমান)
অপারেশনের তারিখ১৯৮৮–বর্তমান
গোষ্ঠী
তালিকা
সক্রিয়তার অঞ্চল
মতাদর্শ
আকার
তালিকা
মিত্র
তালিকা
বিপক্ষবিরোধী রাষ্ট্র:
তালিকা
খণ্ডযুদ্ধ ও যুদ্ধ
তালিকা
যার দ্বারা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসাবে মনোনীততালিকা দেখুন
আল-কায়েদা
১৯৯০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী আল কায়েদার হামলার চিত্র।

সংগঠনটি ১৯৮৮ সালে পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত একাধিক বৈঠকে প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে ড. আব্দুল্লাহ আজ্জাম, ওসামা বিন লাদেন, মুহাম্মদ আতেফ , আয়মান আল জাওয়াহিরি এবং সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের অন্যান্য প্রবীণ মুজাহিদিন উপস্থিত ছিলেন। মাকতাবাতুল খিদমাহ নেটওয়ার্কের উপর ভিত্তি করে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সদস্যরা জিহাদের একটি বৈশ্বিক প্লাটফর্ম হিসাবে কাজ করার জন্য আল-কায়েদা নামে একটি সংগঠন তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সোভিয়েত বিরোধী গ্রুপ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সোভিয়েত ইউনিয়ন বিরোধী ব্লগের সমর্থন পায়। আফগান যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধী গ্রুপগুলিকে ব্যাপক সমর্থন ও সহায়তা করে।

১৯৮৯ সালে সোভিয়েতদের প্রত্যাহারের পর ১৯৯০–৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকী সেনাদের বিপক্ষে সৌদি আরবের হয়ে লড়াই করার জন্যে উসামা বিন লাদেন সৌদি রাজাকে মুজাহিদদের সমর্থনের প্রস্তাব দেন। তার প্রস্তাব সৌদি সরকার প্রত্যাখ্যান করে এবং এর পরিবর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সাহায্য চায়। সৌদি আরবের ভূমিতে মার্কিন সেনাদের অবস্থান বিন লাদেন সৌদি রাজপরিবারের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতে প্ররোচিত করে। এই কাজটিকে তিনি তাকফির-যোগ্য ( ইসলাম থেকে ধর্মত্যাগী) বলে নিন্দা করেন। ১৯৯২–১৯৯৬ সময়কালে আল-কায়েদা ১৯৯৬ সালে বহিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত সুদানে সদর দফতর প্রতিষ্ঠা করে। এরপর তারা তালেবান শাসিত আফগানিস্তানে ঘাঁটি স্থানান্তরিত করে এবং পরবর্তীতে বিশ্বের অন্যান্য অংশে; প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বিস্তৃত হয়।

১৯৯৬ এবং ১৯৯৮ সালে বিন লাদেন মার্কিন সৈন্যদের সৌদি আরব ছেড়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে দুইটি ফতওয়া জারি করেছিলেন। আল-কায়েদা কেনিয়াতানজানিয়ায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে ১৯৯৮ সালে বোমা হামলা চালায় এবং এতে ২২৪ জন নিহত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান এবং সুদানে অবস্থিত আল কায়েদার বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে অপারেশন ইনফিনিট রিচ চালু করে সেই হামলার প্রতিশোধ নেয়। ২০০১ সালে আল-কায়েদা ১১ ই সেপ্টেম্বরের হামলা চালায়, যার ফলে প্রায় ৩,০০০ জনের প্রাণহানি ঘটে। এছাড়াও এতে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বাজারের ক্ষতি হয়। এই হামলার জবাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং স্বাধীন আফগানিস্তানে আক্রমণ করে ক্ষমতাসীন তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং আল কায়েদাকে ধ্বংস করতে বেসামরিক আফগান জনগণের ওপর ব্যাপক বোমা বর্ষণ শুরু করে। একটি রিপোর্ট মতে, মার্কিন জোটের বাহিনী আফগানিস্তানে বোমা হামলা করে প্রায় ৪৭ হাজার বেসামরিক লোক হত্যা করেছে। এছাড়া আফগান জাতীয় বাহিনী এবং তালেবানের লক্ষাধিক সেনাসদস্য নিহত হয়েছে।

২০০৩ সালে একটি মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট ইরাকে আক্রমণ করে আগ্রাসন চালিয়ে বার্থবাদী শাসনকে উৎখাত করে, যা আল-কায়েদার সাথে সম্পর্ক থাকার অভিযোগ তুলে ভুলভাবে অন্যায় আক্রমণ করা হয়। এরপরের বছর ২০০৪ সালে আল-কায়েদা তার ইরাকি আঞ্চলিক শাখা চালু করে। প্রায় এক দশক ধরে তাকে অনুসরণ করার পরে মার্কিন সামরিক বাহিনী ২০১১ সালের মে মাসে পাকিস্তানে বিন লাদেনকে হত্যা করে।

আল কায়েদার সদস্যরা বিশ্বাস করে যে, একটি ইহুদি- খ্রিস্টান জোট (যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে) ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে ইসলামকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছে। সালাফি জিহাদি হিসেবে আল-কায়েদার সদস্যরা বিশ্বাস করে যে, অ-যোদ্ধাদের হত্যা করা ধর্মীয়ভাবে অনুমোদিত। আল-কায়েদা মানবসৃষ্ট সংবিধান বা আইনের বিরোধিতা করে এবং সেগুলিকে একচেটিয়াভাবে একটি কঠোর শরিয়া (ইসলামী ধর্মীয় আইন, যা ঐশ্বরিক আইন হিসাবে বিবেচিত) দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চায়। কায়েদা বৈশিষ্ট্যগতভাবে আক্রমণ সংগঠিত করে; যেমন: আত্মঘাতী হামলা ও একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে একযোগে বোমা হামলা করা।

আল-কায়েদার ইরাক শাখা, যা পরে ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্টে রূপান্তরিত হয় এটি ইরাকি বিদ্রোহ চলাকালীন ইরাকি শিয়াদের বিরুদ্ধে অসংখ্য সাম্প্রদায়িক হামলার জন্য দায়ী ছিল।  আল-কায়েদা মতাদর্শীরা মুসলিম দেশগুলিতে সমস্ত বিদেশী ও ধর্মনিরপেক্ষ প্রভাবের হিংসাত্মক অপসারণের দাবি করে এবং তারা এদের দুর্নীতির বিচ্যুতি হিসাবে নিন্দা করে। ২০১১ সালে বিন লাদেনের মৃত্যুর পর আল কায়েদা তার হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল। উসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর ২০২২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই দলটির নেতৃত্বে ছিলেন মিশরীয় ইসলামপন্থী নেতা ডা. আয়মান আল-জাওয়াহিরি

২০২২ সালের ৩১ জুলাই আফগানিস্তানে মার্কিন ড্রোন হামলায় আয়মান আল-জাওয়াহিরি মৃত্যু বরণ করেন। তবে তালেবান সরকার আফগানিস্তানে আল কায়েদা প্রধান আয়মান আল-জাওয়াহিরির উপস্থিতির বিষয় অস্বীকার করেছিল। জাওয়াহিরির মুত্যুর পর তার দুই ঘনিষ্ঠ সাইফ আল আদেল ও আব্দুর রহমান আল মাগরেবির মধ্যে একজন আল কায়েদার সম্ভাব্য প্রধান নেতা নির্বাচিত হতে পারেন বলে ধারণা করা হয়। তবে স্বাভাবিকভাবে এটি বিশ্বাস করা হয় যে, সাইফ আল আদেলকে আল কায়েদার বর্তমান আমির নির্বাচিত করা হয়েছে।

সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি

নিম্নলিখিত দেশআন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক আল–কায়েদাকে একটি মনোনীত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। তালিকাটি বর্ধিত এবং সংশোধিত হতে পারে:

সাংগঠনিক কার্যক্রম

আল-কায়েদা শুধুমাত্র পরোক্ষভাবে তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। কায়েদার আইন দর্শনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীকরণের আহ্বান জানান হয় এবং মৃত্যুদন্ডের ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণের অনুমতি দেওয়া হয়। আল কায়েদার শীর্ষ নেতারা সংগঠনের আদর্শ ও নির্দেশক কৌশল সংজ্ঞায়িত করেছেন এবং একই সময়ে তাদের আওতাধীন মধ্য-স্তরের বিভিন্ন সংস্থাকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া বড় আকারের হামলা ও হত্যার আগে তাদের শীর্ষ ব্যবস্থাপনার সাথে পরামর্শ করতে বলা হয়।

শীর্ষ ব্যবস্থাপনার মধ্যে শুরা কাউন্সিলের পাশাপাশি সামরিক অভিযান, অর্থ ও তথ্য আদান-প্রদান সংক্রান্ত কমিটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আল-কায়েদা তথ্য কমিটির মাধ্যমে নিজের অধীনস্থ গ্রুপগুলির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার উপর বিশেষ জোর দিয়েছিল। তবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর আল-কায়েদার নেতৃত্ব বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলস্বরূপ নেতৃত্ব বিকেন্দ্রীভূত হয়েছে এবং আল-কায়েদার বেশ কয়েকটি গোষ্ঠী আঞ্চলিক হয়ে উঠেছে। এসব গোষ্ঠী এখন কার্যত স্বাধীনভাবে অপারেশন এবং সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে।

অনেক জিহাদি বিশেষজ্ঞ একথা বিশ্বাস করেন না যে, বিশ্বব্যাপী চলিত জিহাদি আন্দোলন প্রতিটি স্তরে আল কায়েদার নেতৃত্ব দ্বারা চালিত হয়। তবে আল কায়েদার মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক অঞ্চলেই এর আদলে একাধিক জিহাদি গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। যাহোক, বিন লাদেন তার মৃত্যুর আগে মুসলিম চরমপন্থীদের উপর যথেষ্ট মতাদর্শিক প্রভাব বজায় রেখেছিলেন। জিহাদি বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দেখান যে, এখন আল-কায়েদা বেশ কয়েকটি ভিন্ন আঞ্চলিক আন্দোলনে বিভক্ত হয়েছে এবং এই আঞ্চলিক গ্রুপগুলি একে অপরের সাথে খুব কমই সংযোগ বহন করে।

এই দৃষ্টিভঙ্গিটি ওসামা বিন লাদেনের ২০০১ সালের অক্টোবরে তাইসির আলৌনির সাথে সাক্ষাত্কারে দেওয়া বিবরণটিকে প্রতিফলিত করে:

এই (জিহাদ) ব্যাপারটি কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কিত নয় বা কেবল আল-কায়েদা সংস্থার বিষয়বস্তু নয়৷ আমরা একটি ইসলামি জাতির সন্তান; নবী মুহাম্মদ সা. এর নেতা; আমাদের প্রভু এক এবং সমস্ত সত্য বিশ্বাসী মুমিনীন ভাই ভাই। সুতরাং পরিস্থিতি মোটেই তেমন নয়, যেভাবে পশ্চিমারা এটিকে চিত্রিত করেছে ( একটি নির্দিষ্ট নামে; যেমন 'আল-কায়েদা)। এটি ( আল কায়েদা) আমাদের কাছ থেকে কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই জন্মলাভ করেছে। ভাই আবু উবাইদা যুবকদের দুষ্ট, অহংকারী, নৃশংস ও সন্ত্রাসী সোভিয়েত সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছিলেন... তাই এই জায়গাটিকে 'বেস' বলা হতো, যাকে আরবিতে আল-কায়েদা বলা হয়। একটি প্রশিক্ষণ বেস হিসাবে এই নাম প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। আমরা এই জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন নই। আমরা সবাই একই জাতির সন্তান এবং আমরা তার অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা সুদূর পূর্ব থেকে, ফিলিপাইন থেকে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, মৌরিতানিয়ায় ছড়িয়ে আছে ...আর তাই আমরা এই জাতির বিবেক নিয়ে আলোচনা করি

আল-কায়েদা 
একটি টাইপ ৫৬ রাইফেলে সজ্জিত সাহিলের একজন আল কায়েদা জিহাদি (২০১২)।

সহযোগী গোষ্ঠীসমূহ

আল-কায়েদার নিম্নলিখিত গোষ্ঠীগুলির সাথে সরাসরি সংযোগ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়:

নিম্নলিখিত গোষ্ঠীগুলিকে বর্তমানে আল-কায়েদার পরোক্ষ সহযোগী বলে মনে করা হয়:

আল-কায়েদার প্রাক্তন সহযোগী গোষ্ঠীগুলির নিম্নের গ্রুপগুলি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:

নেতৃত্ব

ওসামা বিন লাদেন (১৯৮৮– মে, ২০১১)

আল-কায়েদা 
ওসামা বিন লাদেন (বামে) ও আয়মান আল-জাওয়াহিরি (ডানে)। ২০০১ সালে উভয়ের একত্রে তোলা ছবি।

ওসামা বিন লাদেন ১৯৮৮ সালে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১১ সালের ১ মে মার্কিন বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত আল-কায়েদার প্রধান নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং আতিয়াহ আব্দুর রহমানকে ২০১১ সালের ২২ আগস্টে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দ্বিতীয় কমান্ডে ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। বিন লাদেনকে আল-কায়েদার সিনিয়র সদস্যদের নিয়ে গঠিত শুরা কাউন্সিল থেকে পরামর্শ দেওয়া হতো এবং সবার সম্মিলিত অভিমত নিয়েই ফায়সালা প্রদান করা হতো। শুরার দলটি ২০-৩০ জন সিনিয়র সদস্য নিয়ে গঠিত হয় বলে অনুমান করা হয়েছিল।

১১ মে, ২০১১ এর পর

আয়মান আল-জাওয়াহিরি আল–কায়েদার উপপ্রধান (নায়েবে আমির) ছিলেন এবং উসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর তিনিই আমিরের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। আল-জাওয়াহিরি সাইফ আল-আদেলের স্থলাভিষিক্ত হন, যিনি এর অন্তর্বর্তী কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

২০১২ সালের ৫ জুন পাকিস্তানি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ঘোষণা করেন যে, আতিয়াহ আব্দুর রহমানের দ্বিতীয় কমান্ডের কথিত উত্তরসূরী আবু ইয়াহিয়া আল-লিব্বি পাকিস্তানে নিহত হয়েছেন।

নাসির আল-উহাইশি নামে একজন সিনিয়র কমান্ডার ২০১৩ সালে আল কায়েদার সামগ্রিক সেকেন্ড ইন কমান্ড ও জেনারেল ম্যানেজার নির্বাচিত হয়েছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। ২০১৫ সালের জুন মাসে ইয়েমেনে মার্কিন বিমান হামলায় নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি আল কায়েদার আরব উপদ্বীপ শাখার (AQAP) এর নেতা ছিলেন। এরপর আবুল খায়ের আলমাসরি নামে আয়মান আল-জাওয়াহিরির ডেপুটি হিসাবে উহায়শির কথিত একজন উত্তরসূরি ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিরিয়ায় মার্কিন বিমান হামলায় নিহত হন। আল কায়েদার পরবর্তী অভিযুক্ত দুই নম্বর নেতা আব্দুল্লাহ আহমেদ আব্দুল্লাহ ইসরায়েলী এজেন্টদের হাতে নিহত হন। তার ছদ্মনাম ছিল আবু মুহাম্মদ মাসরি এবং তিনি ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে ইরানে নিহত হয়েছেন। তিনি কেনিয়াতানজানিয়ায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে ১৯৯৮ সালে সংঘটিত বোমা হামলায় জড়িত ছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়।

আল–কায়েদার নেটওয়ার্ক স্ক্র্যাচ থেকে ষড়যন্ত্রমূলক একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছিল, যা বেশ কিছু আঞ্চলিক নোডের নেতৃত্বের উপর আকৃষ্ট হয়েছিল। সংগঠনটি নিজেকে কয়েকটি কমিটিতে বিভক্ত করেছে, যার মধ্যে রয়েছে:

  • সামরিক কমিটি, যা অপারেটিভদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র অর্জন ও আক্রমণ পরিকল্পনার কাজ করে।
  • অর্থ/ব্যবসা কমিটি, যা হাওয়ালা ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার মাধ্যমে অপারেটিভদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের জন্য অর্থায়ন করে। সন্ত্রাসবাদী অর্থায়নের উত্স নির্মূল করার জন্য গঠিত মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রচেষ্টা ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পরপরই সবচেয়ে সফল হয়। এর আগে তাদের উৎস সম্পর্কে খুব কমই ধারাণা লাভ করা গিয়েছিল। আল-কায়েদা অনিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলির মাধ্যমে এখনো তাদের আর্থিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন: পাকিস্তানে ১,০০০ বা তার বেশি হাওয়ালাদার রয়েছে, যাদের মধ্যে কয়েকটি মার্কিন $১০ বিলিয়ন পর্যন্ত লেনদেন পরিচালনা করতে পারে। কমিটি নকল পাসপোর্ট সংগ্রহ করে আল-কায়েদা সদস্যদের অর্থ প্রদান করে এবং তাদের লাভে-চালিত ব্যবসার তত্ত্বাবধান করে। ৯/১১ কমিশনের একটি রিপোর্টে অনুমান করা হয় যে, আল-কায়েদার জন্য প্রতি বছর তার অপারেশন পরিচালনা করার জন্য বাৎসরিক প্রায় ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন হয়।
  • আইন কমিটি; এটি শরিয়া আইন পর্যালোচনা করে এবং এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়।
  • ইসলামিক স্টাডি বা ফতওয়াহ কমিটি; ধর্মীয় হুকুম জারি করার জন্য এটি গঠিত হয়েছে। যেমন: ১৯৯৮ সালে সমগ্র মুসলিমদের মার্কিন নাগরিকদের হত্যা করার বিষয়ে একটি ফতোয়া প্রদান।
  • মিডিয়া কমিটি; এর অধুনালুপ্ত সংবাদপত্র নাশরাত আল আখবার (ইংরেজি: Newscast) এই কমিটি পরিচালনা করত এবং কমিটিটি এখন জনসংযোগ পরিচালনা করে।
  • ২০০৫ সালে আল-কায়েদা তার ভিডিও ও অডিও উপকরণ সরবরাহ করার জন্য আস-সাহাব নামে একটি মিডিয়া প্রোডাকশন হাউস গঠন করে।

আল-জাওয়াহিরির পর (২০২২- বর্তমান)

২০২২ সালের ৩১ জুলাই আয়মান আল-জাওয়াহিরি আফগানিস্তানের কাবুলে একটি মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সদস্য রাষ্ট্রগুলির দেওয়া গোয়েন্দা তথ্যের উপর ভিত্তি করে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে উপসংহারে উঠেছিল যে, আল-কায়েদার ডি-ফ্যাক্টো নেতৃত্ব সাইফ আল-আদেলের কাছে চলে গিয়েছে, যিনি ইরানে অবস্থান করে সংগঠনের কাজ করছিলেন।

আদেল একজন প্রাক্তন মিশরীয় সেনা কর্মকর্তা, যিনি ১৯৯০-এর দশকে আল-কায়েদার শিবিরের একজন সামরিক প্রশিক্ষক হয়েছিলেন এবং মোগাদিশুর যুদ্ধে তার জড়িত থাকার জন্য পরিচিত ছিলেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, তারা আফগান তালেবান সরকারের রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার জন্যে সাবেক আমির আল জাওয়াহিরির মৃত্যু স্বীকার না করার পাশাপাশি সাইফ আল আদেলের নেতৃত্বকেও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করতে পারেনি। সেই সঙ্গে সাইফ আদেলের অবস্থানের কারণেও "ধর্মতাত্ত্বিক এবং অপারেশনাল" চ্যালেঞ্জের কারণে তা প্রকাশ্যে ঘোষিত হয়নি। আদেল বর্তমান ইরানে অবস্থান করছেন বলে সন্দেহ করা হয়।

কমান্ড কাঠামো

আল-কায়েদার বেশিরভাগ শীর্ষনেতা ও অপারেশনাল ডিরেক্টর ছিলেন প্রবীণ, যারা ১৯৮০ এর দশকের সময় আফগানিস্তানে সোভিয়েত আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। বিন লাদেন এবং তার ডেপুটি আয়মান আল-জাওয়াহিরি ছিলেন সেই সকল প্রসিদ্ধ নেতাদের অন্তর্ভুক্ত, যাদেরকে সংগঠনের অপারেশনাল কমান্ডার হিসেবে বিবেচনা করা হত। তবে তা সত্ত্বেও আল -কায়েদা একমাত্র আল-জাওয়াহিরি দ্বারা পরিচালিত হয় না। বেশ কয়েকটি অপারেশনাল গ্রুপ রয়েছে, যারা কোথাও আক্রমণের প্রস্তুতির পরিস্থিতিতে নেতৃত্বের সাথে পরামর্শ করে।

আল-কায়েদা সেন্ট্রাল (AQC) হল কায়েদার বিশেষজ্ঞ কমিটিগুলির সমষ্টি, যেসকল কমিটি আলাদা আলাদা কাজ ও উদ্দেশ্যের তত্ত্বাবধান করে এবং এর সদস্যপদ বেশিরভাগ মিশরীয় ইসলামপন্থী নেতাদের নিয়ে গঠিত হয়, যারা কমিউনিস্ট সোভিয়েত–বিরোধী আফগান জিহাদে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত হাজার বা শত শত ইসলামি ফিল্ড অপারেটিভ এবং কমান্ডার তাদের সহায়তা করছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তত্ত্বগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামগ্রিক প্রচার প্রচারণার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে থাকে। এছাড়া আঞ্চলিক কমান্ডারদের সামরিক কৌশল ও রাজনৈতিক কৌশলে স্বাধীন ক্ষমতা দেওয়া হয়। এই অভিনব উত্তরাধিকার তাদের পক্ষে বিস্তৃত পরিসরের আক্রমণ পরিচালনা করা সম্ভব করেছে। এমন না হলে আল কায়েদার পক্ষে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে হামলা পরিচালনা করা সম্ভব হতো না। কারণ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাথে সর্বদা যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয় না।

২০০৫ সালের ৭ই জুলাই লন্ডনে বোমা হামলার সাথে আল-কায়েদার সংযোগের সম্ভাবনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার স্যার ইয়ান ব্লেয়ার বলেছিলেন: আল-কায়েদা একটি সংগঠন নয়৷ আল কায়েদা হল অপারেশন পরিচালনা করার একটি উপায় ... আল–কায়েদা স্পষ্টতই এই হামলাকারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষমতা রাখে ...দক্ষতা প্রদান করার ক্ষমতা রাখে ... এবং আমি মনে করি যে, এখানে কি ঘটেছে। ২০০৫ সালের ১৩ আগস্ট ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইন্ডিপেনডেন্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, ৭ জন বোমারু আল-কায়েদার মাস্টারমাইন্ড থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করেছিল।

নাসের আল-বাহরি, যিনি ৯/১১ এর দৌড়ে চার বছর ওসামা বিন লাদেনের দেহরক্ষী ছিলেন–তিনি নিজের স্মৃতিকথায় সেসময়ে কীভাবে এ দলটি কাজ করেছিল তার একটি অত্যন্ত বিশদ বিবরণ লিখেছেন। বিবরণে আল-বাহরি আল কায়েদার আনুষ্ঠানিক প্রশাসনিক কাঠামো ও বিশাল অস্ত্রাগার সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। যাহোক, লেখক অ্যাডাম কার্টিস যুক্তি দিয়েছিলেন যে, একটি আনুষ্ঠানিক সংগঠন হিসাবে আল কায়েদার ধারণাটি মূলত একটি আমেরিকান আবিষ্কার। কার্টিস দাবি করেন যে, সংগঠনটির আলকায়েদা নামটি প্রথম জন সাধারণের নজরে আনা হয় ২০০১ সালে উসামা বিন লাদেন এবং ১৯৯৮ সালে পূর্ব আফ্রিকায় মার্কিন দূতাবাসে বোমা হামলার জন্য অভিযুক্ত চার ব্যক্তির বিচার করার সময়। কার্টিস লিখেছেন:

বাস্তবতা ছিল যে, বিন লাদেন ও আয়মান আল-জাওয়াহিরি নতুন কৌশল দ্বারা আকৃষ্ট ইসলামপন্থী জিহাদিদের একটি আলগা সংঘের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু কোনো সংগঠন ছিল না। এরা ছিল জিহাদি, যাদের বেশিরভাগ তাদের নিজস্ব অপারেশনের পরিকল্পনা করেছিল এবং অর্থ এবং সহায়তার জন্য লাদেনের দিকে তাকিয়ে ছিল। তিনি তাদের সেনাপতি ছিলেন না। এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, বিন লাদেন ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর পর্যন্ত একটি গোষ্ঠীর নাম বোঝাতে "আল-কায়েদা" শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, যখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এটি মার্কিনরা দিয়েছিল।

২০০১ সালের বিচারের সময় মার্কিন বিচার বিভাগকে এটি দেখাতে হয়েছিল যে, উসামা বিন লাদেন একটি অপরাধী সংগঠনের প্রধান নেতা ছিলেন। যাতে তার অনুপস্থিতিতে র‌্যাকেটিয়ার প্রভাবিত এবং দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা আইনের অধীনে অভিযুক্ত করা যায়। জামাল আল-ফাদলের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সংগঠনের নাম এবং তার কাঠামোর বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছিল। সাক্ষ্যে তিনি বলেছিলেন যে, তিনি গোষ্ঠীটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং বিন লাদেনের একজন প্রাক্তন কর্মচারী ছিলেন। আল-ফাদলের সাক্ষ্যের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল তার অসততার ইতিহাসের কারণে এবং মার্কিন সামরিক স্থাপনায় হামলার ষড়যন্ত্রে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরে তিনি একটি দরকষাকষি চুক্তির অংশ হিসাবে এ তথ্য প্রদান করেছিলেন। স্যাম শ্মিড্ট নামে একজন প্রতিরক্ষা অ্যাটর্নি বলেন, যিনি আল-ফাদলকে রক্ষা করেছিলেন:

আল-ফাদলের সাক্ষ্যের বাছাই করা অংশ এমন ছিল, যা আমি বিশ্বাস করি যে, তা মিথ্যা ছিল। আমি জানি যে, এই সংস্থাটি কী ছিল। তার একটি ঐক্যবদ্ধ চিত্র সম্পর্কে তিনি বেশ কয়েকটি নির্দিষ্ট সাক্ষ্যে মিথ্যা বলেছেন। তার সাক্ষ্য আল-কায়েদাকে একটি নতুন মাফিয়া বা নতুন কমিউনিস্ট বানিয়েছে। এটি তাদের একটি গোষ্ঠী হিসাবে শনাক্ত করার যোগ্য করে তুলেছে। তাই বিন লাদেনের করা যেকোনো কাজ বা বিবৃতির জন্য আল-কায়েদার সাথে যুক্ত যেকোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা সহজ করে তুলেছে।

মাঠ কর্মী

আল-কায়েদা 
১৯৯৭ সালে পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মীর আফগানিস্তানে ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন।

আল কায়েদার মোট কতজন ব্যক্তি যথাযথ সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং এর বিদ্রোহী বাহিনীকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম, তা অনেকাংশে অজানা। ২০১১ সালের মার্কিন অভিযানে বিন লাদেনের কম্পাউন্ড থেকে প্রাপ্ত নথিগুলি দেখায় যে, ২০০২ সালে আল-কায়েদার মূল সদস্য সংখ্যা ছিল ১৭০ এবং ২০০৬ সালে অনুমান করা হয়েছিল যে, আল-কায়েদার ৪০ টি দেশে কয়েক হাজার কমান্ডার রয়েছেন। তবে ২০০৯-এর হিসাব অনুযায়ী বিশ্বাস করা হয়েছিল যে, ২০০–৩০০ জনের বেশি সদস্য তখন সক্রিয় কমান্ডার ছিলেন না।

২০০৪ সালের বিবিসির ডকুমেন্টারি দ্য পাওয়ার অফ নাইটমেয়ারস অনুসারে, আল–কায়েদা এতটাই দুর্বল ও বিচ্ছিন্নভাবে একত্রে যুক্ত ছিল যে, বিন লাদেন এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের একটি ছোট চক্র ছাড়া এটির অস্তিত্ব ছিল বলা অত্যন্ত কঠিন বিষয়। সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে বিপুল সংখ্যক গ্রেপ্তার হওয়া সত্ত্বেও আল কায়েদা সদস্যদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাজাপ্রাপ্ত না হওয়াকে ডকুমেন্টারিটি আল-কায়েদার বর্ণনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি বিস্তৃত সত্তার অস্তিত্ব আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহের কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল-কায়েদার কমান্ডারদের পাশাপাশি এর গোপনীয় এজেন্টরা আজও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে আছে। এগুলি মূলত মার্কিন ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা পরিষেবা দ্বারা শিকার করা হয়।

বিদ্রোহী বাহিনী

লেখক রবার্ট ক্যাসিডির মতে আল কায়েদা ইরাকপাকিস্তানে বিদ্রোহীদের পাশাপাশি মোতায়েনকৃত দুটি পৃথক বাহিনী বজায় রাখে। প্রথম বাহিনীটি সোভিয়েত আফগান যুদ্ধে সংগঠিত, প্রশিক্ষিত ও বিদ্রোহী বাহিনী হিসাবে সজ্জিত ছিল, যার সংখ্যা প্রায় কয়েক হাজার। এই বাহিনীটি মূলত সৌদি আরব এবং ইয়েমেনের বিদেশী মুজাহিদদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল এবং এই যোদ্ধাদের অনেকেই বৈশ্বিক জিহাদের জন্য বসনিয়াসোমালিয়ায় যুদ্ধ করতে গিয়েছিল। আরেকটি দল হল, যারা পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে বসবাস করে এবং প্রাথমিক যুদ্ধ প্রশিক্ষণ পেয়েছে, যাদের সংখ্যা ২০০৬ সালে ১০,০০০ জন ছিল।

অন্য বিশ্লেষকরা আল-কায়েদার র‍্যাঙ্ক ও ফাইলটিকে এর প্রথম বছরের অপারেশনে প্রধানত আরব হিসাবে বর্ণনা করেছেন; কিন্তু ২০০৭ সালের হিসাব অনুযায়ী সংগঠনটিতে অন্যান্য জনগণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এটি অনুমান করা হয়েছে যে, আল কায়েদা সদস্যদের প্রায় ৬২ শতাংশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষা রয়েছে। ২০১১ সালে এবং পরের বছর মার্কিনরা উসামা ওসামা বিন লাদেন, সংগঠনের প্রধান প্রচারক আনোয়ার আল-আওলাকি এবং আবু ইয়াহিয়া আল - লিবির ডেপুটি কমান্ডারের সাথে সফলভাবে নিজেদের হিসাব নিষ্পত্তি করে। আশাবাদী কন্ঠগুলি ইতিমধ্যেই বলেছিল যে, এটিই আল-কায়েদার জন্য শেষ যুগ হয়ে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও এ সময় আরব বসন্ত অঞ্চলটিকে স্বাগত জানায়, যার সুফল আল-কায়েদার আঞ্চলিক বাহিনীতে আসে এবং আল কায়েদা ঘুরে দাড়ায়।

প্রায় দীর্ঘ ৭ বছর পর আল জাওয়াহিরি তর্কহীনভাবে সংগঠনের প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন এবং নিয়মতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার সাথে তার কৌশল বাস্তবায়ন করেন। আল কায়েদা এবং তৎসংশ্লিষ্ট সংগঠনের প্রতি অনুগত কয়েক হাজার সদস্য সফলভাবে স্থানীয় ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হয়েছিল এবং মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ এবং রাশিয়ায় নিজেদের শত্রুদের নির্মমভাবে আক্রমণ করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত কায়েদার দুই ডজনেরও অধিক "ফ্রাঞ্চাইজ-ভিত্তিক" মিত্র ছিল। কেবলমাত্র সিরিয়ায় আল কায়েদা জিহাদিদের সংখ্যা ২০,০০০ নির্ধারণ করা হয়েছিল এবং ইয়েমেনে তাদের ৪,০০০ প সোমালিয়ায় প্রায় ৭,০০০ সদস্য ছিল, যারা এখনো লড়াই করছে এবং সেখানে যুদ্ধ শেষ হয়নি।

২০০১ সালে আল কায়েদার প্রায় ২০টি কার্যকরী সেল এবং ৭০,০০০ বিদ্রোহী ষাটটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সাল নাগাদ এর কমান্ড এবং সহযোগী মিলিশিয়াদের অধীনে সক্রিয় সৈন্যের সংখ্যা প্রায় ২৫০,০০০-এ উন্নীত হয়েছে।

অর্থায়ন

আল কায়েদা সাধারণত আক্রমণের জন্য সদস্যদের তহবিল বিতরণ করে না এবং খুবই কম এই সব বিষয় তারে স্থানান্তর করে। ১৯৯০ এর দশকে অর্থায়ন আংশিকভাবে ওসামা বিন লাদেনের ব্যক্তিগত সম্পদ থেকে এসেছিল। এছাড়া আয়ের অন্যান্য উৎসের মধ্যে রয়েছে মুক্তিপণ, দখলীকৃত এলাকা থেকে প্রাপ্ত অর্থ, কুয়েত, সৌদি আরব এবং অন্যান্য উপসাগরীয় মুসলিম রাষ্ট্রের সমর্থকদের পাঠানো দান। ২০০৯ সালে উইকিলিকস দ্বারা প্রকাশিত অভ্যন্তরীণ মার্কিন সরকারের একটি কেবলে বলা হয় যে, "সৌদি আরব থেকে সম্প্রতি উদ্ভূত সন্ত্রাসী অর্থায়ন একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।"

আল কায়েদার প্রতি সৌদি আরবের সমর্থন সংক্রান্ত প্রাথমিক প্রমাণগুলির মধ্যে ছিল তথাকথিত গোল্ডেন চেইন, যা ২০০২ সালে বসনীয় পুলিশ সারাজেভোতে একটি অভিযানের সময় জব্দ করা হয় এবং তা আল কায়েদার প্রাথমিক তহবিলকারীদের তালিকায় গণ্য করা হয়। হস্তলিখিত সে তালিকাটি আল কায়েদার দলত্যাগী জামাল ফাদল কর্তৃক যাচাই করা হয়েছিল এবং এতে দাতা ও সুবিধাভোগী উভয়ের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল।

তালিকায় ওসামা বিন লাদেনের নাম সুবিধাভোগীদের মধ্যে সাতবার উপস্থিত হয়েছিল, যখন দাতাদের মধ্যে ২০ জনকে সৌদি আরবীয় এবং উপসাগরীয় ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য দাতাদের মধ্যে ছিলেন আদেল ব্যাটার্জি ও ওয়ায়েল হামজা জুলাইদান। এই ব্যাটার্জিকে ২০০২ সালে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ ট্রেজারি দ্বারা সন্ত্রাসের অর্থদাতা হিসাবে মনোনীত করা হয়েছিল। জুলাইদান আলকায়েদার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হিসাবে স্বীকৃত।

২০০২ সালে বসনিয়া অভিযানের সময় জব্দকৃত নথি ও সাংগঠনিক কাগজপত্রগুলি দেখায় যে আলকায়েদা বিশ্বজুড়ে তার কর্মীদের আর্থিক এবং বস্তুগত সহায়তা প্রদানের জন্য দাতব্য সংস্থাগুলি থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছিল। উল্লেখযোগ্যভাবে তারা এই কাজে সৌদি আরবি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন (IIRO) ও মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগ (MWL)–কে কাজে লাগিয়েছিল।

আল-কায়েদার ডেপুটি আয়মান আল জাওয়াহিরিসহ বিশ্বব্যাপী আল-কায়েদার সহযোগীদের সাথে IIRO-এর সম্পর্ক ছিল। জাওয়াহিরির ভাই আলবেনিয়াতে আইআইআরও-তে কাজ করতেন এবং আলকায়েদার পক্ষে সক্রিয়ভাবে বিনিয়োগ করেছিলেন। WWL –কে আলকায়েদার নেতাদের মাধ্যমে খোলাখুলিভাবে তিনটি দাতব্য সংস্থার মধ্যে একটি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, যাদের ওপর আল কায়েদা প্রাথমিকভাবে তহবিলের উৎসের জন্য নির্ভর করতো।

কাতারি সমর্থনের অভিযোগ

বেশ কয়েকজন কাতারি নাগরিকের বিরুদ্ধে আল- কায়েদাকে অর্থায়নের অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে আব্দুর রহমান নুয়াইমি নামে একজন কাতারি নাগরিক এবং একজন মানবাধিকার কর্মী যিনি সুইস-ভিত্তিক একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) আল কারামা প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৩ সালের ১৮ ই ডিসেম্বর মার্কিন ট্রেজারি আল কায়েদার সমর্থনে ভূমিকা পালন করার জন্য নুয়াইমিকে সন্ত্রাসী হিসাবে মনোনীত করে। মার্কিন ট্রেজারি বলেছিল যে, নুয়াইমি ইরাকে আল-কায়েদাকে উল্লেখযোগ্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করে এবং ইরাকে আল কায়েদা ও কাতারভিত্তিক দাতাদের মধ্যে তিনি একটি সূত্র হিসাবে কাজ করেছেন।

নুয়াইমির বিরুদ্ধে মাসিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ফান্ড সংগ্রহ করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। ইরাক-ভিত্তিক আল-কায়েদার সিনিয়র অফিসার ও কাতারি নাগরিকদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে তার ভূমিকার অংশ হিসাবে তিনি এ ফান্ড স্থানান্তর করেছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়। এছাড়া নুয়াইমি সিরিয়ায় আল কায়েদার শীর্ষ দূত আবু খালিদ আলসুরির সাথে সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগ অভিযুক্ত হয়েছেন, ২০১৩ সালে যিনি আল-কায়েদার কাছে $৬০০,০০০ স্থানান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিলেন।

নুয়াইমিকে আব্দুল ওয়াহহাব মোহাম্মদ আব্দর রহমান আল হুমাইকানি নামে একজন ইয়েমেনি রাজনীতিবিদ এবং আল কারামার প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের সাথে তহবিল সংগ্রহ সংক্রান্ত বিষয়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ২০১৩ সালে মার্কিন ট্রেজারি কর্তৃক বিশেষভাবে মনোনীত গ্লোবাল টেররিস্ট (SDGT) হিসাবে আল হুমাইকানিকে তালিকাভুক্ত করা হয়। মার্কিন কর্তৃপক্ষ দাবি করে যে, আল হুমায়কানি আল কায়েদার আরব উপদ্বীপ শাখার পক্ষে তহবিল সংগ্রহের জন্য আল কারামায় তার ভূমিকাকে কাজে লাগিয়েছেন।

আরব উপদ্বীপ শাখার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব নুয়াইমি ইয়েমেনভিত্তিক কায়েদার সহযোগীদের জন্য তহবিল প্রবাহকে সহজতর করেছেন বলেও জানা গিয়েছিল। হুমায়কানি দ্বারা পরিচালিত দাতব্য সংস্থায় তহবিল বিনিয়োগের জন্যও নুয়াইমির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। মার্কিন ট্রেজারি দ্বারা অনুমোদিত হওয়ার প্রায় দশ মাস পরে নুয়াইমিকে যুক্তরাজ্যে ব্যবসা করা থেকেও নিষেধ করা হয়েছিল।

অপর একজন কাতারি নাগরিক খলিফা মুহাম্মদ তুর্কি সুবাই, যিনি উপসাগরভিত্তিক আল কায়েদার একজন অর্থদাতা হিসাবে তার সক্রিয়তার জন্য ২০০৮ সালের ৫ জুন মার্কিন ট্রেজারি দ্বারা অনুমোদিত হয়। এছাড়া আল কায়েদার সিনিয়র নেতৃত্বকে আর্থিক ও বস্তুগত সহায়তা দেওয়ার অভিযোগে ২০০৮ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় সুবাইয়ের নাম যুক্ত করা হয়। সুবাই আল-কায়েদার রিক্রুটদের দক্ষিণ এশিয়া ভিত্তিক প্রশিক্ষণ শিবিরে নিয়ে যাওয়ার জন্যও অভিযুক্ত হয়েছেন। তিনি খালিদ শেখ মোহাম্মদকে আর্থিকভাবে সমর্থন করেছিলেন, যিনি একজন পাকিস্তানি নাগরিক এবং আল কায়েদার সিনিয়র অফিসার ছিলেন, যিনি ৯/১১ কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার মূল পরিকল্পনাকারী বলে মনে করা হয়।

কাতারিরা দেশের বৃহত্তম এনজিও কাতার চ্যারিটির মাধ্যমেও আল-কায়েদাকে সহায়তা প্রদান করে বলে অভিযোগ করা হয়। আল কায়েদার দলত্যাগী আল ফাদল কাতার চ্যারিটির একজন প্রাক্তন সদস্য ছিলেন এবং তিনি আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইউসুফ নামে একজন কাতারি লোক কাতার চ্যারিটির পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং তিনি আল কায়েদার সাথে যুক্ত ছিলেন। একই সাথে সেই ব্যক্তিটি ন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্টের সাথে যুক্ত ছিলেন, যেটি একটি রাজনৈতিক দল। ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে সুদানে আল কায়েদার আমির ওসামা বিন লাদেনকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলন।

অভিযোগ করা হয়েছিল যে, ১৯৯৩ সালে বিন লাদেন মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক সুন্নি দাতব্য সংস্থাগুলিকে বিদেশের আল কায়েদা অপারেটরদের আর্থিক সহায়তা দেয়ার কাজে ব্যবহার করছিলেন। একই নথি বিন লাদেনের অভিযোগেরও রিপোর্ট করে যে, মিশরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হোসনি মুবারকের ব্যর্থ হত্যা প্রচেষ্টা আল কায়েদার দাতব্য সংস্থাগুলিকে ১৯৯৫ সালের আগে তার অপারেটরদের সমর্থন করার জন্য তাদের সাথে আপোস করতে বাধ্য করে।

সিরিয়ায় আল কায়েদার সাবেক সহযোগী নুসরা ফ্রন্ট বা জাবহাতুন নুসরার মাধ্যমে কাতার আল কায়েদার উদ্যোগকে অর্থায়ন করে এবং তহবিল প্রাথমিকভাবে মুক্তিপণের জন্য অপহরণের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। কনসোর্টিয়াম এগেইনস্ট টেরোরিস্ট ফাইন্যান্স (সিএটিএফ) জানিয়েছিল যে, উপসাগরীয় দেশটি ২০১৩ সাল থেকে আন-নুসরাকে অর্থায়ন করেছে। ২০১৭ সালে আশশারক আল-আওসাত অনুমান করে যে, কাতার অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণের জন্য $২৫ মিলিয়ন বিতরণ করেছিল আল-নুসরার সমর্থনে। এছাড়াও কাতার আন-নুসরার পক্ষে তহবিল সংগ্রহের অভিযান শুরু করেছিল। আন-নুসরা তাদের উদ্দেশ্যে অনুদানের জন্যে একটি পছন্দনীয় মাধ্যমে হিসেবে কাতারের স্পন্সর প্রচারাভিযান স্বীকার করেছিল।

উদ্দেশ্য ও সামরিক কৌশল

আল–কায়েদার উদ্দেশ্য ধর্মীয় নাকি রাজনৈতিক সে ব্যাপারে মতবিরোধের মাঝে মার্ক সেডগউইক আল-কায়েদার কৌশলকে তাৎক্ষণিক মেয়াদে রাজনৈতিক হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং তাদের কার্যক্রম চূড়ান্ত লক্ষ্য সামনে রেখে তা হলো ধর্মীয়। ২০০৫ সালের ১১ মার্চ আল-কুদস আল-আরাবি সাইফ আল-আদেলের নথি "২০০০ সাল পর্যন্ত আল কায়েদার স্ট্র্যাটেজিতে" এর নির্যাস প্রকাশ করেন। লেখক আব্দুল বারী আতওয়ান উম্মাহকে সকল প্রকার নিপীড়ন থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তাদের পাঁচটি পর্যায় সমন্বিত এই কৌশলটি সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন:

  1. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের একটি মুসলিম দেশে আক্রমণ করার জন্য প্ররোচিত করা। এর জন্যে মার্কিন মাটিতে ব্যাপক আক্রমণ বা স্ট্রিং আক্রমণে পরিচালনা করা, যার ফলে সেখানে ব্যাপক বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটে এবং তারা নতুন করে কোনো অঞ্চল বা দেশ আক্রমণ করতে বাধ্য হয়। কারণ চারদিকে সমুদ্রঘেরা আমেরিকাকে তাদের মাটিতে হারানো খুবই কঠিন ব্যাপার।
  2. মুসলমানদের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রতিরোধে উদ্বুদ্ধ করা।
  3. প্রতিবেশী দেশগুলিতে সংঘাতকে প্রসারিত করা এবং এভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলানো।
  4. আল-কায়েদাকে একটি মতাদর্শে রূপান্তর করা এবং এর পরিচালনা নীতি এমনভাবে প্রণয়ন করা, যা সরাসরি কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন ছাড়াই অন্যান্য দেশে শিথিলভাবে ফ্র্যাঞ্চাইজ খুলতে পারে এবং এই ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলির বিরুদ্ধে আক্রমণ উসকে দেয়, যতক্ষণ না তারা সংঘাত থেকে প্রত্যাহার করে। ২০০৪ সালে মাদ্রিদ ট্রেন বোমা হামলার সাথে এমনটিই ঘটে; কিন্তু ২০০৫ সালের ৭ জুলাই লন্ডনে বোমা হামলার সাথে তা একই প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়নি।
  5. মার্কিন অর্থনীতি অবশেষে ২০২০ সালের মধ্যে ভেঙে পড়বে। কারণে একত্রে অনেক দেশে সামরিক অভিযান চালানোর একাধিক ব্যস্ততার চাপ অর্থনীতিতে পড়বে এবং এটি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পতনের দিকে নিয়ে যাবে। ফলে এটি বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলার দিকে পরিচালিত হবে। এটি আল-কায়েদার নেতৃত্বে একটি বিশ্বব্যাপী জিহাদের দিকে নিয়ে যাবে এবং তারপরে বিশ্বজুড়ে একটি ওয়াহাবি খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে।

আতওয়ান উল্লেখ করেছেন যে, পরিকল্পনাটি অবাস্তব হলেও এটি কার্যত আফগানে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে প্রতিফলিত এবং তা বিবেচনা করে বিষয়টি খুবই গভীর।"

জর্ডানীয় নাগরিক সাংবাদিক ও লেখক ফুয়াদ হুসেন বলেন যে, তিনি আল-জারকাউইয়ের সাথে কারাগারে সময় কাটিয়েছেন এবং তার মতে আল কায়েদার রণ কৌশল সাতটি পর্যায় নিয়ে গঠিত এবং এটি ২০২০ সালের আল কায়েদার কৌশলে বর্ণিত পরিকল্পনার অনুরূপ। নিম্নোক্ত পর্যায়গুলি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:

  1. "জাগরণ"; এই পর্বটি ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হওয়ার কথা ছিল। এই পর্বের লক্ষ্য হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি মুসলিম দেশে আক্রমণ করার জন্য উস্কানি দিয়ে এমন একটি বড় হামলা চালানো, যা মার্কিন মাটিতে অনেক বেসামরিক নাগরিক হত্যা করে এবং এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন কোনো অঞ্চল বা দেশে যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য হয়।
  2. "চোখ খোলা"; অর্থাৎ মুসলমানদের জিহাদের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলা। এই পর্বটি ২০০৩ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত স্থায়ী হওয়ার কথা ছিল এবং এই পর্বের লক্ষ্য ছিল, মুসলিম যুবকদের সংগঠনে নিয়োগ করে আল-কায়েদা গ্রুপটিকে একটি আন্দোলনে রূপান্তরিত করা। অন্যান্য দেশের ঘাঁটিগুলির জন্য আর্থিক এবং সামরিক সহায়তা জন্যে ইরাক সমস্ত অপারেশনের কেন্দ্র হয়ে উঠবে বলে তখন মনে করা হয়েছিল। তবে আল কায়েদার ইরাকি শাখা শক্তিশালী হওয়ার পর কেন্দ্র থেকে পৃথক হয়ে আইএস নাম ধারণ করে খোদ আল কায়েদার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করে।
  3. "জেগে ওঠা এবং সসম্পূর্ণরূপে দাড়িয়ে যাওয়া"; এই পর্ব ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত চলার কথা ছিল। এই পর্যায়ে আল-কায়েদা অতিরিক্ত হামলা চালানো এবং সিরিয়ার দিকে তাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে চেয়েছিল। হুসেন বিশ্বাস করতেন যে, আরব উপদ্বীপের অন্যান্য দেশগুলিও আল কায়েদার বিপদ সীমার মধ্যে রয়েছে।
  4. আরব উপদ্বীপের শাসকদের ক্ষয়িষ্ণু শক্তির কারণে আল-কায়েদা তাদের র্যাঙ্ক অঞ্চলগুলির মধ্যে স্থিতিশীলভাবে বৃদ্ধির আশা করেছিল। এই পর্বে আক্রমণের মূল লক্ষ্য, তেল সরবরাহকারী ও সাইবার সন্ত্রাসবাদের উপর হবে, যা মার্কিন অর্থনীতি এবং সামরিক অবকাঠামোকে লক্ষ্য করে পরিচালিত হবে।
  5. "একটি ইসলামী খেলাফতের ঘোষণা করা, যা ২০১৩ এবং ২০১৬ এর মধ্যে প্রক্ষিপ্ত হয়েছিল। এই পর্যায়ে আল-কায়েদা আশা করতে পারে যে, তাদের বিরুদ্ধে ইসরায়েল থেকে প্রতিরোধ ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে।
  6. "একটি ইসলামি সেনাবাহিনী ঘোষণা করা" এবং "বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে লড়াই", যাকে "চূড়ান্ত সংঘর্ষও" বলা হয়।
  7. "নির্ধারিত বিজয়"; এটি ২০২০ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল।

সাত পর্যায়ের এ কৌশল অনুসারে যুদ্ধটি দুই বছরেরও কম স্থায়ী হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। তবে এমন কিছুই ঘটেনি; বরং আল কায়েদা অস্তিত্বের সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। মূলত ২০১১ সালে বিন লাদেন নিহত হওয়ার পরপরই আল কায়েদার কার্যক্রম সীমিত হয়ে যায়। এরপর আইএস উদ্ভব হওয়ার পর এর সদস্য সংখ্যা কমতে থাকে এবং অনেক আঞ্চলিক জিহাদি গোষ্ঠী আল কায়েদার আনুগত্য ত্যাগ করে আইএসে যোগদান করে। সবশেষে আয়মান আল জাওয়াহিরির নেতৃত্বে এটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে ২০২২ সালে মার্কিন ড্রোন হামলায় তিনিও নিহত হন। এরপর সাইফ আল আদেলকে সংগঠনটির আমির করা হয়। সাইফ এখন পর্যন্ত কোনো বিবৃতি প্রদান করেননি এবং আল কায়েদার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো মন্তব্যও করেননি।

মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের চার্লস লিস্টার ও মার্কিন এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ক্যাথরিন জিমারম্যানের মতে, আল-কায়েদার নতুন মডেল হল "সম্প্রদায়কে সামাজিকীকরণ করা" ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের সমর্থনে অপারেশনের একটি বিস্তৃত আঞ্চলিক ভিত্তি তৈরি করা। এছাড়াও স্বাধীনভাবে আয় লাভ করে আর্থিক ভিত্তি মজবুত রাখা।

নামকরণ

সংগঠনটির আরবি নাম হল ‏القاعدة‎ (আল কায়েদা) যা একটি বিশেষ্য পদ এবং এর অর্থ হল 'ভিত্তি' বা 'বেস'। শুরুর 'আল' হল আরবি পদাশ্রিত নির্দেশক; তাই এর ইংরেজি অর্থ হয় "দ্য বেস/দ্য ফাউন্ডেশন"। আরবি ভাষায় আল-কায়েদা শব্দে চারটি সিলেবল আছে ( /alˈqaː.ʕi.da/ )। যাহোক, যেহেতু নামের দুটি আরবি ব্যঞ্জনবর্ণ ইংরেজিতে পাওয়া যায় না, তাই এ শব্দটির সাধারণ ও স্বাভাবিক ইংরেজি উচ্চারণের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। যেমন : /ælˈkdə/, /ælˈkdə//ˌælkɑːˈdə/ । আল-কায়েদার নাম আল-কায়েদা, আল-কায়দা বা আল-কাঈদা হিসাবেও প্রতিলিপি করা যেতে পারে।

'আল-কায়েদা'র মতবাদীয় ধারণাটি প্রথম ফিলিস্তিনি ইসলামপন্থী পণ্ডিত ও জিহাদি নেতা ডক্টর আবদুল্লাহ ইউসুফ আযযাম আল-জিহাদ নামে একটি ইসলামী ম্যাগাজিনের ১৯৮৮ সালের এপ্রিল সংখ্যায় বিশ্বের মুসলিম সমাজের মধ্যে ধর্মীয়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অগ্রগামীদের বর্ণনা করার জন্য তৈরি করেছিলেন, যারা বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত মুসলমানদের মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র জিহাদ চালায়। বিদেশী হানাদার ও তাদের মিত্র ধর্মনিরপেক্ষ সরকারগুলোকে উৎখাত করে সমগ্র ইসলামী বিশ্ব জুড়ে শরিয়া (ইসলামী আইন) প্রতিষ্ঠা করে এবং এভাবে অতীতের ইসলামী শক্তি পুনরুদ্ধার করে। এটি একটি খাঁটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে, যা মুসলিম সমাজের পরবর্তী প্রজন্মকে লালন-পালন করবে, যারা চিরকাল মুসলিম বিশ্বের আনাচে কানাচে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের সহযোগী সরকারগুলিকে আক্রমণ করবে। অসংখ্য ঐতিহাসিক মডেলকে আজাম তার আহ্বানের সফল উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন; ৭ম শতাব্দীর প্রথম দিকের মুসলিম বিজয় থেকে শুরু করে ১৯৮০–এর সাম্প্রতিক সোভিয়েত-বিরোধী আফগান জিহাদ পর্যন্ত। আজমের বিশ্ব-দর্শন অনুসারে:

"এখন এমন একটি রাষ্ট্র সম্পর্কে চিন্তা করার সময় এসেছে, যা (ইসলাম) ধর্মের প্রচার ও প্রসারের জন্যে একটি শক্ত ঘাঁটি হবে এবং জাহিলিয়াতের [ইসলাম-পূর্ব যুগের] জাহান্নাম থেকে মুসলিমদের রক্ষা করার জন্য একটি দুর্গ হবে।"

বিন লাদেন ২০০১ সালের অক্টোবরে আল জাজিরার সাংবাদিক তাইসির আল আউনির সাথে ভিডিও টেপ করা একটি সাক্ষাৎকারে শব্দটির উৎপত্তি ব্যাখ্যা করেছিলেন:

'আল-কায়েদা' নামটি বহুকাল আগে নিছক একটি সুযোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রয়াত ভাই আবু উবাইদাহ আল-বানশিরি রুশ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমাদের মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করেছিলেন। সেই ট্রেনিং ক্যাম্পকে আমরা আল-কায়েদা বলতাম। তখন থেকে নামটা রয়ে যায়।

এ যুক্তিও দেওয়া হয় যে, বেনিভোলেন্স ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সারাজেভো অফিস থেকে জব্দকৃত দুটি নথিপত্র প্রমাণ করে যে, এই নামটি কেবল মুজাহিদিন আন্দোলন দ্বারা এটি গৃহীত হয়নি এবং ১৯৮৮ সালের আগস্টে আল-কায়েদা নামে একটি গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই দুটি নথিতে একটি নতুন সামরিক গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠার জন্য অনুষ্ঠিত একটি সভার কার্যবিবরণী রয়েছে এবং সেখানে "আল-কায়েদা" শব্দটি রয়েছে।

প্রাক্তন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব রবিন কুক লিখেছেন যে, আল-কায়েদা শব্দটিকে "ডাটাবেস" হিসাবে অনুবাদ করা উচিত। কারণ এটি মূলত হাজার হাজার মুজাহিদ যোদ্ধাদের কম্পিউটার ফাইল উল্লেখ করেছিল, যারা রুশদের পরাজিত করার জন্যে সিআইএ-এর সাহায্যে নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েছিল। তবে ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে দলটি কায়দাতুল–জিহাদ (قاعدة الجهاد ) নাম ধারণ করে এবং তখন থেকে সংগঠনটির অফিশিয়াল নথিপত্র ও বিবৃতিতে এই নামটিই ব্যবহার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে শুরুতে তানজিম (تنظيم) শব্দ যোগ করে تنظيم قاعدة الجهاد উল্লেখ করা হয়।

qāʿidat al-jihād এর অর্থ হল "জিহাদের ভিত্তি"। দিয়া রাশওয়ানের মতে, এটি "আপাতদৃষ্টিতে মিশরের আল-জিহাদের বিদেশী শাখার একীকরণের ফলস্বরূপ, যার মূল নেতৃত্বে ছিলেন আয়মান আল–জাওয়াহিরি। বিন লাদেন আফগানিস্তানে ফিরে আসার সাথে সাথে তার নিয়ন্ত্রণে থাকা গ্রুপগুলির সমন্বয়ে ১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এটি গঠিত হতে পারে।"

মতাদর্শ

আল-কায়েদা 
সাইয়্যিদ কুতুব, একজন মিশরীয় ইসলামি পন্ডিত ও জিহাদি তাত্ত্বিক, যার লেখা আল-কায়েদাকে অনুপ্রাণিত করেছিল বলে ধারণা করা হয়।

আল-কায়েদার সশস্ত্র সালাফি আন্দোলন ও ইসলামী পুনরুজ্জীবন ইরানী বিপ্লব (১৯৭৮–৭৯) ও আফগান জিহাদের (১৯৭৯–১৯৮৯) পর ইসলামী আন্দোলনের উত্থানের সময় বিকশিত হয়েছিল। অনেক পণ্ডিত যুক্তি দিয়েছেন যে, ইসলামি লেখক এবং চিন্তাবিদ সাইয়্যেদ কুতুবের লেখা আল–কায়েদা সংগঠনকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দশকে কুতুব প্রচার করেছিলেন যে,শরিয়া আইন প্রচলিত না থাকার ফলে মুসলিম বিশ্ব বর্তমান শরয়ী অর্থে মুসলিম নেই। এটি এখন জাহিলিয়াহ নামে পরিচিত প্রাক-ইসলামি একটি যুগে ফিরে গেছে।

ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করার জন্য কুতুব যুক্তি দিয়েছিলেন যে, "সত্যিকারে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে শরিয়া বাস্তবায়ন করতে এবং মুসলিমবিশ্বকে যাবতীয় অমুসলিম প্রভাব থেকে মুক্ত করতে বিশ্বের সব ধার্মিক মুসলিমের অগ্রগামী হওয়া প্রয়োজন। কুতুবের দৃষ্টিতে ইসলামের শত্রুদের মধ্যে ইহুদিরা অন্তর্ভুক্ত, যারা ধর্মের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এবং সর্বদা ইসলামের বিরোধিতা করে। কুতুব বৃহত্তর জাহিলি সমাজ থেকে শুদ্ধ হয়ে একটি ধার্মিক ও ইসলামী নেতৃত্বের অধীনে নিজেদের সংগঠিত করার পর অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ পরিচালনার লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ার জন্য এই অগ্রযাত্রার কল্পনা করেছিলেন, যাকে তিনি নবীজি সা. এর নেতৃত্বাধীন মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রকে মুসলমানদের প্রাথমিক মডেল হিসেবে দেখেন এবং তার এ ধারণাটি আবদুল্লাহ আজ্জাম এবং উসামা বিন লাদেনের মতো অনেক ইসলামপন্থী ব্যক্তিত্বকে সরাসরি প্রভাবিত করে এবং অদূর ভবিষ্যতে কায়েদার মতো একটি সংগঠন তৈরিতে মূল যুক্তি হয়ে ওঠে। বিদ্যমান ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের পতন ঘটাতে তার কৌশলের রূপরেখা তুলে ধরে কুতুব ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারায় যুক্তি দেন:

"[এটি আবশ্যক যে] মুসলিম সম্প্রদায়ের অস্তিত্বে আসা, যারা বিশ্বাস করে যে, 'আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই ', যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে মানতে নিজেদের বাধ্য মনে করে না, যারা অন্য সমস্ত কর্তৃত্ব অস্বীকার করে এবং শরিয়ার বিপরীতে অন্য যেকোনো আইনের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে, যা তাদের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গঠিত হয়নি। . . . যুদ্ধক্ষেত্রে এই দৃঢ়সংকল্প নিয়ে আসা উচিত যে, এর (ইসলাম) কৌশল, সামাজিক সংগঠন এবং এর ব্যক্তিদের মধ্যে সম্পর্ক বিদ্যমান জাহিলি ব্যবস্থার চেয়ে আরো দৃঢ় ও শক্তিশালী হতে হবে"।

লাদেনের ঘনিষ্ঠ কলেজ বন্ধু মোহাম্মদ জামাল আল খলিফার বর্ণনা মতে:

ইসলাম অন্য যেকোনো ধর্ম থেকে আলাদা; এটি সামগ্রিক জীবন যাপনের একটা উপায়।আমি খলিফা ও বিন লাদেন বোঝার চেষ্টা করছিলাম যে, আমরা কিভাবে খাই; কাকে বিয়ে করি; কিভাবে কথা বলি এবং সে সম্পর্কে ইসলাম কী বলে। আমরা সাইয়্যেদ কুতুবকে পড়ি। তিনিই আমাদের প্রজন্মকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিলেন।

কুতুব আল কায়েদার দ্বিতীয় আমির আয়মান আল-জাওয়াহিরিকেও ব্যাপক প্রভাবিত করেছিলেন। জাওয়াহিরির চাচা এবং মাতার পরিবারের পিতৃপুরুষ মাহফুজ আজম ছিলেন কুতুবের ছাত্র, অভিভাবক, ব্যক্তিগত আইনজীবী এবং তার এস্টেটের একজন নির্বাহক। ফাঁসি কার্যকরের আগে কুতুবকে জীবিত দেখতে পাওয়া সবশেষ ব্যক্তিদের একজন ছিলেন আজম। জাওয়াহিরি তার কাজ Knights under the Prophet's Banner–এ সাইয়্যেদ কুতুবের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

কুতুব যুক্তি দিয়েছিলেন যে, অনেক মুসলমান প্রকৃত অর্থে মুসলমানই ছিলেন না। কিছু মুসলমান কুতুবের যুক্তি মতে ধর্মত্যাগী ছিলেন। এই কথিত ধর্মত্যাগীদের মধ্যে মুসলিম দেশগুলির নেতারা অন্তর্ভুক্ত ছিল, যারা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করেন। কারণ তারা শরিয়া আইন প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং মানব রচিত সংবিধান মাফিক রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তিনি আরো অভিযোগ করেন যে, পশ্চিমারা মুসলিম বিশ্বের কাছে একটি ক্রুসেডীয় চেতনা নিয়ে এসেছে। এটি ২০ শতকে ইউরোপে ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় সত্ত্বেও সম্ভবপর হয়েছে। কারণ তাদের প্রধান অন্তরায় হলো ইসলামমুসলমানরা। কুতুবের মতে, মুসলিম দেশগুলির প্রতি ইউরোপীয় এবং মার্কিনদের প্রদর্শিত বৈরী ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব, ইহুদিজায়নবাদের প্রতি তাদের সমর্থন ইত্যাদি সহস্রাব্দের যুদ্ধে ক্রুসেডের কারণে ঘৃণাকে প্রতিফলিত করে এবং রোমান বস্তুবাদীউপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জন্ম নেয়, যা বিশ্বকে আর্থিক দৃষ্টিতে দেখে।

গঠন

সোভিয়েতপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে আফগান জিহাদ সালাফিবাদী জিহাদি আন্দোলনকে আরও বিকশিত করেছিল, যা আল-কায়েদাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই সময়ে আল কায়েদা দক্ষিণ এশিয়ায় জিহাদ পুনরুজ্জীবনকারী সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ ব্রেলভীর (মৃ. ১৮৩১/১২৪৬ হি.) আদর্শকে গ্রহণ করে, যিনি ১৯ শতকের গোড়ার দিকে আফগানিস্তান এবং খাইবার-পাখতুনকোয়া সীমান্ত থেকে ব্রিটিশ ভারতের বিরুদ্ধে একটি জিহাদি এবং সংস্কারবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আল-কায়েদা সহজেই সাইয়েদ আহমদ শহীদের মতবাদ গ্রহণ করে। যেমন প্রাথমিক প্রজন্ম ( সালাফ) কর্তৃক পালিত বিশুদ্ধ ইসলামে ফিরে আসা, পশ্চিমা প্রভাবের প্রতি বিদ্বেষ ও ইসলামী রাজনৈতিক ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা। পাকিস্তানি সাংবাদিক হুসেইন হাক্কানির মতে,

"সাইয়েদ আহমেদের জিহাদি মতাদর্শের পুনরুজ্জীবন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ায় পরবর্তী ইসলামী জিহাদি আন্দোলনের নমুনা হয়ে ওঠে এবং এটি এই অঞ্চলে আল কায়েদা এবং তৎসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলির জিহাদি নেটওয়ার্কের প্রধান প্রভাবকরও বটে।"

উদ্দেশ্য

আল কায়েদার দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হলো মুসলিম বিশ্বকে খিলাফাহ (খিলাফত) নামে পরিচিত একটি সুপার-ন্যাশনাল ইসলামি রাষ্ট্রের অধীনে একত্র করা, যার নেতৃত্বে থাকবে আহলে বাইত (নবী পরিবার) থেকে একজন নির্বাচিত খলিফা এবং গোটা ইসলামি বিশ্বকে তিনি শরিয়া সমর্থিত আইন দ্বারা পরিচালনা করবেন। এর তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে রয়েছে: আরব উপদ্বীপ থেকে মার্কিন সৈন্যদের বিতাড়ন, এই অঞ্চলে মার্কিন-মিত্র সরকারগুলির পতন ঘটানোর জন্য সশস্ত্র জিহাদ চালানো ইত্যাদি।

১৯৮৮ সালে পেশোয়ারে একটি বিশেষ বৈঠকে জারি করা আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা সনদ " আল-কায়েদার কাঠামো ও সংবিধান " (Al-Qa'ida's Structure and Bylaws) এ বর্ণিত লক্ষ্য এবং কিছু সাধারণ নীতিগুলি নিম্নরূপ:

সাধারণ লক্ষ্য

১. ইসলামী বিশ্বে জিহাদ সম্পর্কে সচেতনতা প্রচার করা
২. প্রশিক্ষণ ও প্রকৃত যুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ইসলামী বিশ্বের যোদ্ধাদের প্রস্তুত ও সজ্জিত করা
৩. যতটা সম্ভব জিহাদি আন্দোলনের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করা
৪. একটি ঐক্যবদ্ধ আন্তর্জাতিক জিহাদ আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াসে সারা বিশ্বে জিহাদ আন্দোলনের সমন্বয় সাধন করা।

সাধারণ নীতি
১. সমস্ত বিশ্বাস ও কর্মে "কুরআন' ও "সুন্নাহর" ( যা 'শরিয়া নামে পরিচিত) প্রতি সম্পূর্ণ অঙ্গীকার। সেইসাথে জাতির আলেমদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী চলা, যারা এই ডোমেইনে কাজ করে।
২. আল্লাহর উদ্দেশ্যে লড়াই করা এবং সমাজ পরিবর্তনের এজেন্ডা হিসাবে জিহাদের প্রতি অঙ্গীকার। এর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া এবং যখনই আমরা সুযোগ পাব তখনই তার প্রয়োগ করা...।
৩. বিশ্বের অত্যাচারী শাসক, ধর্মনিরপেক্ষজাতীয়তাবাদী দলগুলোর প্রতি আমাদের অবস্থান হল, তাদের সঙ্গে মেলামেশা না করা; তাদের অসম্মান করা এবং তাদের চিরশত্রু হওয়া পর্যন্ত একমাত্র আল্লাহকে বিশ্বাস করা। আমরা তাদের সাথে অর্ধ-সমাধানে একমত হব না এবং তাদের সাথে আলোচনা বা তাদের সন্তুষ্ট করার কোনো উপায় আমাদের কাছে নেই।
৪. সত্যবাদী ইসলামী জিহাদি আন্দোলন এবং গোষ্ঠীগুলির সাথে আমাদের সম্পর্ক হল বিশ্বাস এবং বিশ্বাসের ছত্রছায়ায় সহযোগিতা করা এবং আমরা সর্বদা তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ এবং একীভূত হওয়ার চেষ্টা করব...
৫. আমরা ইসলামী আন্দোলনের সাথে মহব্বত ও ভালোবাসার সম্পর্ক বহন করব। যদিও তারা সরাসরি জিহাদের সাথে যুক্ত নয়...।
৬. আমরা সক্রিয় আলেমদের সাথে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সম্পর্ক বজায় রাখব...।
৭. আমরা আঞ্চলিক ধর্মান্ধদের প্রত্যাখ্যান করব এবং প্রয়োজনে ও সম্ভব হলে একটি ইসলামি দেশে জিহাদ চালিয়ে যাব।
৮. আমরা জিহাদে মুসলিম লোকদের ভূমিকার বিষয়ে চিন্তা করব এবং আমরা তাদের নিয়োগ করার চেষ্টা করব...।
৯. আমরা আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বজায় রাখব এবং আমাদের সম্পদ সুরক্ষিত করার জন্য অন্যের উপর নির্ভর করব না৷
১০. গোপনীয়তা আমাদের কাজের প্রধান উপাদান, যা প্রকাশ করার প্রয়োজন মনে হয় তা ছাড়া বাকি সবকিছু গোপন রাখার চেষ্টা করব।

১১. আফগানি জিহাদের সাথে আমাদের নীতি হল, আমাদের নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে জিহাদ ক্ষেত্রগুলিতে ইসলামি সংস্থাগুলির সাথে সমর্থন, পরামর্শ এবং সমন্বয় করা।"

— 

ইসলামি রাষ্ট্র তত্ত্ব

আল কায়েদার লক্ষ্য হল, আরব বিশ্বে একটি ইসলামী কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যা খিলাফতে রাশিদার আদলে গঠিত হবে এবং তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সংগঠিত আন্তর্জাতিক ইহুদি-খ্রিস্ট ক্রুসেডার জোটের বিরুদ্ধে একটি বৈশ্বিক জিহাদ করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং রাষ্ট্র তাদের "বহিরাগত শত্রু" হিসাবে দেখবে এবং তাদের বিরুদ্ধে সর্বদা লড়াই জারি রাখবে। আল কায়েদা মুসলিম বিশ্বের ধর্মনিরপেক্ষ সরকারগুলিকে "ধর্মত্যাগী ঘরোয়া শত্রু" হিসাবে বর্ণনা করে।

জিহাদের মাধ্যমে মুসলিম দেশগুলো থেকে বিদেশী প্রভাব ও ধর্মনিরপেক্ষ শাসকদের অপসারণ করা হলে; আল কায়েদা তার প্রস্তাবিত ইসলামি রাষ্ট্রের শাসক নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকে সমর্থন করতে পারে। এটি নেতৃত্ব পরিষদের ( শুরা ) প্রতিনিধিদের মাধ্যমে করা হবে, যারা শরিয়া (ইসলামী আইন) বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে। যাহোক, এটি এমন নির্বাচনের বিরোধিতা করে যা সংসদ প্রতিষ্ঠা করে এবং যা মুসলিম ও অমুসলিম বিধায়কদের নিজেদের পছন্দ মতো আইন তৈরিতে সহযোগিতা করার ক্ষমতা দেয়। তার বই নাইটস আন্ডার দ্য ব্যানার অব দ্য প্রফেটের দ্বিতীয় সংস্করণে আয়মান আল জাওয়াহিরি লিখেছেন:

"আমরা দাবি করি... সঠিক পথনির্দেশক খিলাফতের সরকারের, যা শরিয়া ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে; কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছার ভিত্তিতে নয়। উম্মাহ এর শাসক নির্বাচন করবে।...যদি তারা বিচ্যুত হয়, তাহলে উম্মাহ তাদের হিসাব করবে এবং তাদের অপসারণ করবে। উম্মাহ সেই সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং এর দিকনির্দেশ নির্ধারণে অংশগ্রহণ করবে।... খেলাফতি রাষ্ট্র সঠিক কাজের আদেশ দেয় এবং অন্যায়কে নিষেধ করে। মুসলিম ভূমিকে মুক্ত করতে এবং সমস্ত মানবতাকে সমস্ত অত্যাচার ও অজ্ঞতা থেকে মুক্ত করার জন্য জিহাদ নিয়োজিত হবে।"

অভিযোগ

আল কায়েদা মতাদর্শের একটি পুনরাবৃত্ত দর্শন হলো পশ্চিমাদের মিত্র স্বৈরাচারী এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী শাসনব্যবস্থার দ্বারা ইসলামী ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর সহিংস পরাধীনতার উপর চিরস্থায়ী অভিযোগ। আল-কায়েদা এই উত্তর-ঔপনিবেশিক সরকারগুলিকে নব্য-ঔপনিবেশিকতার অগ্রগতি এবং মুসলিম বিশ্বের উপর পশ্চিমা আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ডিজাইন করা পশ্চিমা অভিজাতদের নেতৃত্বের একটি ব্যবস্থা হিসাবে নিন্দা করে। আরব বিশ্বে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি তাদের অভিযোগের সবচেয়ে বড় বিষয়; বিশেষ করে ইসরায়েলকে তার শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করার জন্য আমেরিকাকে অভিযুক্ত করা হয় এবং বিশ্বাস করা হয় যে, মার্কিন সহযোগিতা ব্যতীত ইসরায়েল রাষ্ট্রের কোনো ভিত্তিই নেই। এছাড়া তাদের অসন্তোষের অন্যান্য উদ্বেগজনক বিষয়াবলীর মধ্যে রয়েছে: মিত্র শাসনকে সমর্থন করার জন্য ন্যাটো সেনাদের উপস্থিতি; কাশ্মীর, চেচনিয়া, আফগানিস্তান, সিরিয়া, শিনচিয়াং, ইরাক ইত্যাদি অঞ্চলে মুসলিমদের প্রতি অবিচার করা, ইসলামবিরোধী বিভিন্ন মতবাদ ও গোষ্ঠীকে মুসলিম বিশ্বে প্রচারের কাজে আর্থিক এবং লজিস্টিক সাহায্য প্রদান করা ইত্যাদি।

ধর্মীয় সামঞ্জস্যতা

আল কায়েদার ব্যাপারে প্রসিদ্ধ গবেষক ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাংবাদিক আব্দুল বারী আতওয়ান লিখেছেন:

যদিও আল কায়েদা নেতৃত্বের নিজস্ব ধর্মতাত্ত্বিক প্ল্যাটফর্মটি মূলত সালাফি; তবে সংগঠনের ছাতাটি বিভিন্ন চিন্তাধারা এবং রাজনৈতিক ঝোঁককে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যথেষ্ট প্রশস্ত। আল-কায়েদা তার সদস্য ও সমর্থকদের মধ্যে ওয়াহাবি, শাফিয়ি, মালিকি এবং হানাফি মাজহাবের মধ্যে গণনা করে। এমনকি এমন কিছু আল-কায়েদার সদস্য রয়েছে, যাদের বিশ্বাস এবং অনুশীলন সালাফিবাদের সাথে সরাসরি বিরোধপূর্ণ, যেমন: মুহাম্মদ ইউনুস খালিস, যিনি আফগান মুজাহিদদের অন্যতম নেতা। তিনি একজন রহস্যবাদী সুফি ছিলেন, যিনি সুফিদের মাজার পরিদর্শন করতেন এবং তাদের কাছে দোয়া চাইতেন, যা বিন লাদেনের ওয়াহাবি-সালাফী চিন্তাধারার প্রতি সম্পূর্ণ বিদ্বেষপূর্ণ অনুশীলন। এই প্যান-ইসলামি নীতির একমাত্র ব্যতিক্রম হল, শিয়া ইসলাম। আল-কায়েদা সর্বদা এটার বিরোধিতা করেছে বলে মনে হয়। কারণ তারা শিয়া ধর্মকে ধর্মদ্রোহী বলে মনে করে। ইরাকে তারা প্রকাশ্যে বদর ব্রিগেডদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছে। এখন এমনকি বেসামরিক শিয়া লোকদেরকে সহিংসতার জন্য বৈধ লক্ষ্য বলে মনে করা হয়।

বেসামরিক মানুষের উপর হামলা

আল কায়েদার ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর ইসলামি পণ্ডিতদের এর নিন্দার প্রতিক্রিয়ায় আল-কায়েদা যুদ্ধে অযোদ্ধা ও বেসামরিকদের হত্যার ন্যায্যতা প্রদান করে একটি সংক্ষিপ্ত লেখা প্রকাশ করেছিল, যার শিরোনাম ছিল: (হামলাকারী) নায়কদের শরয়ী অবস্থান সম্পর্কে কায়িদাতুল জিহাদের একটি বিবৃতি এবং নিউইয়র্কওয়াশিংটনে তাদের অপারেশনের বৈধতা। কুইন্টান উইক্টোরোভিজ ও জন কাল্টনারের মতো কয়েকজন সমালোচকের মতে, এটি "প্রায় যে কোনো কল্পনাপ্রসূত পরিস্থিতিতে বেসামরিক লোকদের হত্যার জন্য যথেষ্ট ধর্মতাত্ত্বিক যুক্তি প্রদান করে।"

এই ন্যায্যতার মধ্যে রয়েছে যে, আমেরিকা ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচলিত যুদ্ধে পশ্চিমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে; তাই আমেরিকার উপর আক্রমণ করা ইসলামের প্রতিরক্ষা সমতুল্য এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে সংঘটিত যেকোনো চুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে। তাদের চুক্তিগুলি হামলার মাধ্যমে লঙ্ঘন করা হবে। ট্র্যাক্ট অনুসারে, বেশ কয়েকটি শর্ত বেসামরিক লোকদের হত্যার অনুমতি দেয়, যার মধ্যে রয়েছে:

  • ইসলামের বিরুদ্ধে মার্কিন হামলার প্রতিশোধস্বরূপ, যা তারা বেসামরিক মুসলিম নারী, শিশুবৃদ্ধদের লক্ষ্য করে পরিচালনা করেছে/ করে;
  • যখন শত্রুর ঘাঁটি আক্রমণ করার সময় অযোদ্ধা ও যোদ্ধাদের মধ্যে পার্থক্য করা খুব কঠিন হয় অথবা অযোদ্ধারা শত্রু অঞ্চলে থাকে, তখন তাদের হত্যা করার অনুমতি দেওয়া হয়;
  • যারা "কাজে, কথায় ও মনে" শত্রুদের সহায়তা করে তারা হত্যার যোগ্য এবং এর মধ্যে সকল গণতান্ত্রিক দেশের সাধারণ জনগণ অন্তর্ভুক্ত। কারণ এ সকল দেশের বেসামরিক লোকেরা নির্বাচনে ভোট দিয়ে এমন নেতা নির্বাচিত করে, যা ইসলামের শত্রুদের ক্ষমতায় নিয়ে আসে;
  • ইসলামমুসলমানদের রক্ষার জন্য যুদ্ধে অযোদ্ধা লোকদের হত্যার প্রয়োজনীয়তা হলে ;
  • নবীজি সা. কে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, মুসলিম যোদ্ধারা তায়েফের বিরুদ্ধে গুলতি ব্যবহার করতে পারে, তখন তিনি ইতিবাচকভাবে উত্তর দিয়েছিলেন । তখন শত্রু যোদ্ধারা বেসামরিক জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে গিয়েছিল;
  • যদি নারী, শিশু এবং অন্যান্য সুরক্ষিত গোষ্ঠী শত্রুর জন্য মানব ঢাল হিসেবে কাজ করে;
  • যদি শত্রু একটি চুক্তি ভঙ্গ করে, তবে বেসামরিক লোকদের হত্যা অনুমোদিত।

আত্মঘাতী হামলা

আল কায়েদা নেতৃত্ব ও কায়েদাপন্থি–ধর্মীয়-তাত্ত্বিকেরা স্বাভাবিকভাবেই আত্মঘাতী হামলাকে বৈধ মনে করে। তবে মূলধারার ইসলামি পণ্ডিতরা আত্মঘাতী হামলাকে বৈধ করেন না। আলেমগণ এই ধরণের হামলাকে এই পদ্ধতিতে বৈধ বলেন যে , হামলাকারী নিজের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই শত্রু ঘাটিতে প্রবেশ করে শত্রুর ওপর অস্ত্র প্রয়োগ করবে অথবা আক্রমণকারী শত্রুপক্ষকে প্রতিরোধ করার কোনো উপায় না থাকলে শত্রুঘাটিতে প্রবেশ করে প্রথম নিজেকেই উড়িয়ে দিবে এবং এতে শত্রুপক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকবে ( এটি একান্ত নিরুপায় অবস্থানের উদাহরণ)। এসবের বাইরে বেসামরিক জনগণ অথবা কোনো ধর্মীয় উপসনালয়ে হামলা বা আত্মঘাতী হামলা করা কোনো অবস্থায় বৈধ নয়।

২০১৮ সালে পাকিস্তানের একদল আলেম আত্মঘাতী হামলা অবৈধ হওয়ার বিষয়ে একটি বই বের করেন। সে বইটি সরকারী মদদে পাকিস্তানের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়।

ইতিহাস

২০০৯ সালে দ্য গার্ডিয়ান আল কায়েদার বিকাশের পাঁচটি স্বতন্ত্র পর্যায় বর্ণনা করেছে: ১৯৮০-এর দশকের শেষভাগে এর শুরু; ১৯৯০১৯৯৬ সাল পর্যন্ত একটি "মরুভূমির" মত সময়কাল; ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত এটি তার ক্যারিয়ারের শীর্ষ সময়ে; ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত একটি নেটওয়ার্কিং সময়কাল এবং ২০০৫ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত এটির খণ্ডিতকরণের সময়কাল। উসমা বিন লাদেন আল কায়েদার সময়কালকে পাঁচটি স্তরে এবং আল কায়েদা ইন ইরাকের আমির আবু মুসয়াব আল জারকাবী একে সাতটি স্তরে বিন্যস্ত করেছেন।

আফগানিস্তানে জিহাদ

আল-কায়েদা 
১৯৮৫ সালে সোভিয়েত বাহিনী ও সোভিয়েত -সমর্থিত আফগান সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থায়নে এবং আইএসআই এর তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষিত আফগান মুজাহিদিন যোদ্ধারা ডুরান্ড লাইন সীমান্ত অতিক্রম করছে।

আল-কায়েদার উৎপত্তিস্থল আফগান সোভিয়েত যুদ্ধ (ডিসেম্বর, ১৯৭৯–ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৯) এবং তৎপরবর্তী সংঘটিত বেশ কিছু বৈশ্বিক বিপর্যয়কে মনে করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের যুদ্ধকে স্নায়ুযুদ্ধের নজরে দেখেছিল, যার একদিকে ছিল মার্কসবাদীরা ও অন্যদিকে স্থানীয় আফগান মুজাহিদরা । এই দৃষ্টিভঙ্গি অপারেশন সাইক্লোন নামে একটি সিআইএ প্রোগ্রামের দিকে পরিচালিত করে, যা পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির মাধ্যমে আফগান মুজাহিদিন শিবিরে তহবিল প্রেরণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। মার্কিন সরকার আফগান ইসলামি জিহাদিদের যথেষ্ট আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল বলে দাবি করা হয়। আফগানরা মার্কিনদের চেয়ে আরব বিশ্বের জনগণ থেকে অধিক সাহায্য পায়। মার্কিনরা এই যুদ্ধে কেবল স্নায়ুযুদ্ধের অংশ হিসেবে সাহায্য করেছিল বলে মুজাহিদরা দাবি করেন। তবে আরব বিশ্ব থেকে প্রাপ্ত অনুদান মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ও পাকিস্তানি গোয়েন্দাসংস্থা আইএসআই হয়ে মুজাহিদদের কাছে পৌঁছানো হতো। মুজাহিদিন নেতা এবং হিজব-ই-ইসলামির প্রতিষ্ঠাতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারকে সাহায্যের পরিমাণ ৬০০ মিলিয়নেরও বেশি ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে মার্কিনদের সমর্থন প্রত্যাহার করার পরে হেকমতিয়ার বিন লাদেনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন।

একই সময়ে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক আরব মুজাহিদিন আফগান মার্কসবাদী শাসনের বিরুদ্ধে জিহাদে যোগ দিয়েছিল, যা আন্তর্জাতিক মুসলিম সংস্থা বিশেষ করে মাকতাবাতুল খিদমাহ (MAK) কর্তৃকও সহায়তা করা হয় ( এটি সার্ভিস ব্যুরো নামেও পরিচিত )। মিশরীয় ইসলামপন্থী কামাল আল-সানানিরির ( মৃত্যু: ১৯৮১ ) সাথে সংযুক্ত মুসলিম ব্রাদারহুড নেটওয়ার্কগুলিও আফগান মুজাহিদিনের জন্য অর্থ সংগ্রহ এবং আরব যোদ্ধা নিয়োগে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। এই নেটওয়ার্কগুলির মধ্যে আফগান কমান্ডার আব্দুর রসুল সায়াফ, আব্দুল্লাহ ইউসুফ আজ্জাম, ফিলিস্তিনি ইসলামপন্থী পণ্ডিতজর্ডানীয় মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রধান ব্যক্তিত্বের সাথে সম্পৃক্ত মুজাহিদিন গ্রুপগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৮১ সালের দিকে মিশরীয় নিরাপত্তা কারাগারে সানানিরির আটক ও মৃত্যুর পর আবদুল্লাহ আজ্জাম আফগান আরব ও আফগান মুজাহিদদের মধ্যে প্রধান সালিসকারী হন।

আফগান জিহাদের উদ্দেশ্যে অস্ত্র ও সরবরাহের অংশ হিসেবে উসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানের মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিনিধি হিসেবে ইসলামপন্থী সংগঠন জামাতে ইসলামীর প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো হয়। এরপর পেশোয়ারে থাকাকালীন বিন লাদেন আব্দুল্লাহ আজ্জামের সাথে দেখা করেন এবং তারা দুজন মিলে যৌথভাবে ১৯৮৪ সালে মাকতাবাতুল খিদমাহ (MAK) প্রতিষ্ঠা করেন। এটি বিশ্বজুড়ে আফগান জিহাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ ও জনবল নিয়োগের লক্ষ্য নিয়ে গঠন করা হয়েছিল। [MAK] আফগান সীমান্তের কাছে পেশোয়ারে একটি গেস্ট হাউসের আয়োজন করে এবং আফগান যুদ্ধ ফ্রন্টের জন্যে বিদেশী রিক্রুটদের প্রস্তুত করার উদ্দেশে আধাসামরিক প্রশিক্ষণ শিবির নির্মাণের জন্য অর্থ সরবরাহ সংগ্রহ করে। মাককে সৌদি সরকার ও সৌদি ব্যবসায়ীসহ অন্য মুসলিমদের দ্বারা অর্থায়ন করা হয়েছিল। বিন লাদেনও মুজাহিদিনদের একজন প্রধান অর্থদাতা হয়ে ওঠেন। তিনি নিজের বহু অর্থ ব্যয় করেন এবং যুদ্ধ সম্পর্কে জনমতকে প্রভাবিত করার জন্য তার সংযোগ ব্যবহার করেন। সিরিয়ার মুসলিম ব্রাদারহুডের অনেক অসন্তুষ্ট সদস্যও; যেমন: আবু মুসাব আল-সুরিও এই ( মাকতাবাতুল খিদমাহ) নেটওয়ার্কে যোগ দিতে শুরু করে। কারণ ১৯৮২ সালে সিরিয়ায় ইসলামি বিদ্রোহের পর তাদের কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল।

আল-কায়েদা 
আফগান যুদ্ধের অন্যতম অবদানকারী নেতা ওমর আব্দুর রহমান।

১৯৮৫ সালের পর থেকে মাকতাবাতুল খিদমাহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার অফিসগুলিতে একটি নেটওয়ার্ক স্থাপন করতে শুরু করে, যার মূল কেন্দ্রস্থল ছিল ব্রুকলিনের আটলান্টিক অ্যাভিনিউতে ফারুক মসজিদের আল কিফাহ শরণার্থী কেন্দ্র। ব্রুকলিন কেন্দ্রের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন ডাবল এজেন্ট আলী মুহাম্মদ, যাকে এফবিআই'র বিশেষ এজেন্ট জ্যাক ক্লুনান বিন লাদেনের প্রথম প্রশিক্ষক বলে অভিহিত করেছিলেন। ব্লাইন্ড শেখ নামে পরিচিত ওমর আব্দুর রহমান আফগানিস্তানের মুজাহিদিনদের একজন নেতৃস্থানীয় নিয়োগকারী ছিলেন। আজ্জাম ও বিন লাদেন ১৯৮৭ সালে আফগানিস্তানে ক্যাম্প স্থাপন শুরু করেন।

মাকতাবাতুল খিদমাহ ( MAK) ও বিদেশী মুজাহিদিন স্বেচ্ছাসেবক বা আফগান আরবরা সোভিয়েত যুদ্ধে প্রধান ভূমিকা পালন করেননি বলে ধারণা করা হয়। কারণ ২৫০,০০০ আফগান মুজাহিদ সোভিয়েত এবং কমিউনিস্ট আফগান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এবং তখন অনুমান করা হয়েছিল যে, কোন একই সময়ে মাঠে দুই বা তিন হাজারের বেশি বিদেশী মুজাহিদিন ছিল না। তা সত্ত্বেও বিদেশী মুজাহিদ স্বেচ্ছাসেবকরা ৪৩টি দেশ থেকে এসেছেন এবং ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে আফগানিস্তানের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মোট বিদেশীদের সংখ্যা ৩৫,০০০ ছিল বলে জানা গিয়েছিল। উসামা বিন লাদেন বিদেশী মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ শিবির আয়োজনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে। মুহাম্মদ নজিবুল্লাহর কমিউনিস্ট আফগান সরকার এর পর আরো তিন বছর স্থায়ী হয় এবং ১৯৯২ সালে মুজাহিদরা এটিকে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত করে।

সম্প্রসারণ কার্যক্রম

আফগানিস্তানে সোভিয়েত সামরিক মিশনের শেষের দিকে কিছু বিদেশী মুজাহিদ ফিলিস্তিন ও কাশ্মীরের মতো বিশ্বের অন্যান্য অংশে ইসলামপন্থী সংগ্রামকেও অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করতে চেয়েছিল এবং তাদের সেই আকাঙ্খাগুলিকে আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি গোপনীয় এবং আন্তঃসম্পর্কিত সংস্থা গঠিত হয়েছিল। এর মধ্যে একটি সংগঠন ছিল, যা শেষ পর্যন্ত আল-কায়েদা নামে পরিচিত হবে। তবে গঠিত হওয়ার পর আল কায়েদার দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হতে দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়। সোভিয়েত আফগান যুদ্ধ শেষে বিন লাদেন ও অন্যান্য মুজাহিদরা নিজ নিজ মাতৃভূমিতে পাড়ি জমায় এবং বিন লাদেনও সৌদি আরবে ফিরে যান। উপসাগরীয় যুদ্ধের পর আল কায়েদা সংগঠিত হওয়া শুরু করে এবং বসনিয়ার যুদ্ধে এটি সশস্ত্র গোষ্ঠীতে পরিণত হয়।

গবেষণা পরামর্শ দেয় যে, ১৯৮৮ সালের ১১ই আগস্টে আল-কায়েদা গঠিত হয়েছিল, যখন আফগানিস্তানে মিশরীয় ইসলামি জিহাদের নেতা আবদুল্লাহ আজম এবং বিন লাদেনের মধ্যে একটি বৈঠক হয়েছিল। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময় ওসামা বিন লাদেনআবদুল্লাহ আজ্জাম ও অন্যান্য আরব স্বেচ্ছাসেবক মুজাহিদিন দ্বারা ১৯৮৮ সালে নেটওয়ার্কটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিন লাদেন নিজের অর্থ ইসলামি জিহাদি সংগঠনের দক্ষতার সাথে যুক্ত করার জন্য এবং সোভিয়েতরা আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারের পর অন্যত্র জিহাদি কাজ করার জন্য একটি চুক্তিতে পৌঁছেছিলেন। আফগানিস্তানে পবিত্র যুদ্ধে লড়াই করার পর গোষ্ঠীটির লক্ষ্য ছিল বিশ্বের অন্য অংশেও এই ধরনের অপারেশন সম্প্রসারিত করা; বিশেষ করে আফ্রিকার কিছু অংশে, আরব বিশ্বে এবং অন্যত্র ঘাঁটি স্থাপন করে যে সকল কাফির ইসলাম ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে মনে করা হয়, তাদের উপর ব্যাপক আক্রমণ চালানো।

বেশ কিছু নোট নির্দেশ করে যে, আল-কায়েদা ১৯৮৮ সালের ২০ আগস্টে একটি আনুষ্ঠানিক দলে পরিণত হয়। সদস্যতার জন্য প্রয়োজনীয়তার একটি তালিকা নিম্নোক্ত বিষয়গুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে: শোনার ক্ষমতা, ভাল আচরণ, আনুগত্য করা এবং একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তির অনুসরণ করার জন্য একটি অঙ্গীকার নামা ( বায়আত ) প্রদান করা। তার স্মৃতিকথায় উসামা বিন লাদেনের প্রাক্তন দেহরক্ষী নাসের আল বাহরি আল-কায়েদার প্রধানের প্রতি তার আনুগত্যের শপথ করার সময় বায়আত দেওয়ার অনুষ্ঠানের একমাত্র প্রকাশ্য উপলব্ধের বর্ণনা দিয়েছেন। রাইটের মতে দলটির আসল নাম জনসাধারণের উচ্চারণে ব্যবহার করা হয়নি। কারণ এটির অস্তিত্ব এখনও নিবিড় এবং গোপনীয় ছিল।

১৯৮৯ সালে আব্দুল্লাহ আজ্জাম নিহত হওয়ার পরে মাকতাবাতুল খিদমাহ (MAK) ভেঙে যায় এবং এরপর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মাকতাবা অনুসারী বিন লাদেনের নতুন সংগঠনে যোগ দেয়। ১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসে আলী মোহাম্মদ নামে উত্তর ক্যারোলিনার ফোর্ট ব্র্যাগে নিযুক্ত প্রাক্তন বিশেষবাহিনীর একজন সার্জেন্ট সামরিক চাকরি ছেড়ে ক্যালিফোর্নিয়া চলে যায়। তিনি আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান ভ্রমণ করেন এবং বিন লাদেনের পরিকল্পনার সাথে গভীরভাবে জড়িত হন। ১৯৯১ সালে সৌদি আরব থেকে নির্বাসিত হলে আলী মোহাম্মাদ বিন লাদেনকে সুদানে স্থানান্তরিত করতে সাহায্য করেছিলেন বলে জানা যায়।

উপসাগরীয় যুদ্ধ এবং মার্কিন শত্রুতার সূচনা

১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্য প্রত্যাহারের পর উসামা বিন লাদেন সৌদি আরবে ফিরে আসেন এবং পূর্বের স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করেন। ১৯৯০ সালের আগস্টে কুয়েতে ইরাকি আগ্রাসন সৌদি আরব এবং এর শাসক সৌদি রাজ পরিবারকে বেশ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান তেল ক্ষেত্রগুলি কুয়েতে ইরাকি বাহিনীর হামলার নাগালের মধ্যে ছিল এবং সর্ব-আরববাদের প্রতি সাদ্দামের আহ্বান সম্ভাব্য অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ সৃষ্টি করতে পারে এমন শঙ্কায় আরব উপদ্বীপের রাজ পরিবারগুলি সাদ্দাম হুাসাইন ও ইরাকি বাহিনীর প্রতিরোধে বিকল্প ব্যবস্থা খোঁজা শুরু করে।

আপাতদৃষ্টিতে ইরাকি সামরিক উপস্থিতির মুখে সৌদি আরবের নিজস্ব সংখ্যায় তেমন শক্তিশালী সেনাবাহিনী ছিল না। বিন লাদেন ইরাকি সেনাবাহিনীর হাত থেকে সৌদি আরবকে রক্ষা করার উদ্দেশে বাদশাহ ফাহদকে তার মুজাহিদদের সেবা গ্রহণ করার আহ্বান জানান। সৌদি রাজা বিন লাদেনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং এর পরিবর্তে মার্কিন এবং মিত্র বাহিনীকে সৌদি ভূখণ্ডে সেনা মোতায়েনের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

আরব ভূখণ্ড মার্কিন বাহিনী মোতায়েন বিন লাদেনকে ক্ষুব্ধ করেছিল। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, "দুটি মসজিদের পবিত্র ভূমির (মক্কামদিনা) মাটিকে এরা অপবিত্র করেছে এবং বিদেশী সৈন্যদের উপস্থিতিতে আরবের মর্যাদাও হানি হয়েছে। সৌদি বাদশাহ ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজ বিন লাদেনের মুজাহিদ সেনার প্রশিক্ষণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর আমেরিকান সৈন্যরা সৌদি ভূখণ্ডে প্রবেশের অনুমতি পায়। সৌদি আরবে আমেরিকান সৈন্যদের প্রবেশকে বিন লাদেন ইসলামের ওপর ক্রুসেডার আক্রমণ বলে নিন্দা করেন এবং তারা ইসলামের পবিত্র ভূমিকে অপবিত্র করেছে বলে প্রচারণা চালানো শুরু করেন।

তিনি জোর দেন যে, সম্পূর্ণ আরব উপদ্বীপ বিদেশী আক্রমণকারীদের দ্বারা অধিকৃত হয়েছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এতে জড়িত থাকার কারণে সৌদি সরকারকে বহিষ্কার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। মার্কিন সৈন্যদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য এবং তাদের বৈধতা প্রত্যাখ্যান করার কারণে সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলার পর তাকে নির্বাসিত করা হয় এবং তাকে সুদানে নির্বাসনে থাকতে বাধ্য করা হয়। এছাড়া বিন লাদেন তখন প্রবীণ ওয়াহাবি আলেমদেরও নিন্দা করেছিলেন; সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে গ্র্যান্ড মুফতি আবদ আল-আজিজ ইবনে বাজের উপর মার্কিন সৈন্যদের প্রবেশের অনুমতি দেয় এমন রায়ের জন্য কাফের বাহিনীর সাথে অংশীদারিত্বের অভিযোগ এনেছিলেন।

সুদান

প্রায় ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত আল কায়েদা ও এর আমির বিন লাদেন ইসলামি তাত্ত্বিক হাসান আল তুরাবির আমন্ত্রণে সুদানে নিজেদের অবস্থান খুঁজে নেয়। এই পদক্ষেপটি সুদানে একটি সফল ইসলামপন্থি অভ্যুত্থানের পর ঘটে, যা কর্নেল ওমর আল বশিরের নেতৃত্বে সংঘটিত এবং তিনি মুসলমানদের রাজনৈতিক মূল্যবোধকে পুনর্বিন্যাস করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তখন বিন লাদেন সুদান সরকারকে ব্যাপক সহায়তা করেন এবং বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ক্রয় বা স্থাপন করেন। সুদানের কৃষিব্যবস্থায় বিপ্লব আনয়ন করেন এবং সুদানের সড়ক মহাসড়কগুলির সংস্কার কার্যক্রম চালু করেন। সে সময় তিনি সুদানে কয়েকটি প্রশিক্ষণ শিবিরও স্থাপন করেন।

১৯৯৩ সালে বিন লাদেনের স্বাভাবিক জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট ঘটেছিল, যখন সৌদি আরব অসলো চুক্তির জন্য সমর্থন দেয়, যা ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শান্তির পথ নির্ধারণ করে। বিন লাদেন আরব বিশ্বের প্রতি এই একপাক্ষিক চুক্তি (তার মতে) বর্জনের আহ্বান জানান। কারণ চুক্তিতে ইসরাযেলের দখলদারিত্বের স্বীকৃতি ছিল এবং তাতে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। চুক্তির প্রতিক্রিয়ায় সৌদি আরবের রাজা ফাহাদের উপর বিন লাদেনের ক্রমাগত মৌখিক আক্রমণের কারণে বাদশাহ ফাহাদ বিন লাদেনের পাসপোর্ট জব্দ করতে ১৯৯৪ সালের ৫ মার্চ সুদানে একজন দূত পাঠান। বিন লাদেনের সৌদি নাগরিকত্বও বাতিল করা হয়। তার পরিবারকে বার্ষিক ৭ মিলিয়ন ডলার উপবৃত্তি কেটে দিতে রাজি করা হয়, যা তিনি পারিবারিক সম্পদ থেকে পেতেন এবং তার সমস্ত সৌদি সম্পদ জব্দ করা হয়। এরপর তার পরিবারও প্রকাশ্যে তাকে অস্বীকার করে। উসামা বিন লাদেন পরবর্তীতে পরিবারের সদস্যদের থেকে কতটা সমর্থন জোগাড় করতে পেরেছিলেন সেটা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে।

১৯৯৩ সালে তৎকালীন মিশরীয় প্রধানমন্ত্রী আতেফ সাদেকির জীবন নাশের একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টায় একজন তরুণী স্কুল ছাত্রীকে হত্যা করা হয়। মিশরীয় জনমত আল জিহাদের বোমা হামলার বিরুদ্ধে একজোট হয় এবং পুলিশ আল জিহাদের ২৮০ জন সদস্য গ্রেপ্তার করে। তাদের ৬ জনকে পরবর্তীতে মৃত্যুদণ্ড হয়। ১৯৯৫ সালের জুনে মিশরীয় রাষ্ট্রপতি মোবারককে হত্যার প্রচেষ্টার ফলে মিশরীয় ইসলামি জিহাদ (EIJ) এবং ১৯৯৬ সালের মে'তে বিন লাদেনকে সুদান থেকে বহিষ্কার করা হয়।

পাকিস্তানি–মার্কিন ব্যবসায়ী মনসুর ইজাজের মতে, সুদান সরকার ক্লিনটন প্রশাসনকে উসামা বিন লাদেন ও সুদানে অবস্থানরত আল-কায়েদা সদস্যদের বন্দী গ্রেফতার করার জন্য অনেক সুযোগ প্রদান করেছিল। তবে বিন লাদেনের কর্মতৎপরতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। ইজাজের দাবিগুলি অসংখ্য মিডিয়া ও সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল, যার মধ্যে একটি ছিল লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস এবং ওয়াশিংটন পোস্টে সুদানের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত টিমোথি এম কার্নির একটি লেখাসহ প্রকাশিত হয়। একই ধরনের অভিযোগ করেছেন ভ্যানিটি ফেয়ারের অবদানকারী সম্পাদক ডেভিড রোজ লসিং বিন লাদেন–এর লেখক রিচার্ড মিনিটার ওয়ার্ল্ডের সাথে ২০০৩ সালের নভেম্বর মাসের একটি সাক্ষাৎকারে।

৯/১১ কমিশনসহ বেশ কয়েকটি সূত্র ইজাজের দাবির বিরোধিতা করেছে, যা আংশিকভাবে উপসংহারে এসেছে:

সুদানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ফাতিহ এরওয়া দাবি করেন যে, সুদান বিন লাদিনকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তরের প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে ৯/১১ কমিশন এমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পায়নি। বিন লাদিনকে বহিষ্কার করার জন্য সুদানের ওপর চাপ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রদূত কার্নির প্রতি নির্দেশ ছিল। রাষ্ট্রদূত কার্নির সুদানের কাছ থেকে আরো কিছু চাওয়ার কোনো আইনি ভিত্তি ছিল না। যেহেতু এটি সেই সময়ের কথা, যখন তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।

আফগানিস্তানে আশ্রয়

১৯৯২ সালে আফগান কমিউনিস্ট শাসনের পতনের পর আফগানিস্তান কার্যকরভাবে প্রায় চার বছর ধরে শাসনমুক্ত ছিল এবং বিভিন্ন মুজাহিদিন দল ও গোষ্ঠী ক্রমাগত অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত ছিল। এ করুণ পরিস্থিতি তালেবানদের সংগঠিত হতে দেয়। তালেবান ইসলামি স্কুলের স্নাতকদের কাছ থেকেও সমর্থন অর্জন করে, যেগুলিকে মাদ্রাসা বলা হয়। আহমেদ রশিদের মতে তালেবানের শীর্ষ পাঁচ নেতা আকোরা খট্টকের ছোট শহর দারুল উলূম হাক্কানিয়ার স্নাতক ছিলেন। শহরটি পাকিস্তানের পেশোয়ারের কাছে অবস্থিত; তবে স্কুলটিতে বেশিরভাগ আফগান শরণার্থীরা পড়ে।

এই প্রতিষ্ঠানটি তার শিক্ষার মধ্যে সালাফি বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করে এবং এর বেশিরভাগ তহবিলই ধনী আরবদের ব্যক্তিগত দান ও অনুদান থেকে আসে বলে অভিযোগ করা হয়। তবে মাদরাসার কর্তৃপক্ষ ফিকহআকিদার ক্ষেত্রে হানাফি মাজহাব অনুসরণ করে বলে দাবি করে। তালেবান নেতাদের শীর্ষ ৪ জন নেতা কান্দাহারের একইভাবে অর্থায়িত ও প্রভাবিত একটি মাদরাসায় যোগ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। উসামা বিন লাদেনের পরিচিতি মাধ্যমগুলি এই স্কুলগুলিতে আরব বিশ্ব থেকে প্রাপ্ত অনুদান পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিত এবং ইসলামি ব্যাংকগুলি "অ্যারে" দাতব্য সংস্থায় অর্থ স্থানান্তর করতে ব্যবহৃত হত, যা আল-কায়েদার সামনের দল হিসাবে কাজ করেছিল।

অনেক মুজাহিদিন যারা পরবর্তীতে তালেবানে যোগ দিয়েছিলেন, তারা রুশ আক্রমণের সময় আফগান যুদ্ধবাজ নেতা মোহাম্মদ নবী মোহাম্মদীর হরকাত ই ইনকিলাবি গ্রুপের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। এই দলটি বেশিরভাগ আফগান আরব যোদ্ধাদের আনুগত্যও উপভোগ করেছিল।

দেশে চলমান অব্যাহত দুর্নীতি ও অনাচার ক্রমবর্ধমান এবং সুশৃঙ্খল তালেবান যোদ্ধাদের আফগানিস্তানের ভূখণ্ডের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করতে সক্ষম করে তোলে এবং এটি একটি ছিটমহল প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, যা আফগানিস্তান ইসলামি আমিরাত নামে পরিচিত ছিল। তবে ধীরে ধীরে তারা এলাকা প্রসারিত করে এবং ১৯৯৪ সালে তারা কান্দাহারের আঞ্চলিক কেন্দ্র দখল করে। এভাবে দ্রুত আঞ্চলিক লাভ করার পর তালেবানরা ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানী শহর কাবুল দখল করে এবং আফগানিস্তান ইসলামি আমিরাত গঠনের ঘোষণা দেয়।

১৯৯৬ সালে তালেবান-নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান আল-কায়েদার জন্য একটি নিখুঁত স্টেজিং গ্রাউন্ড প্রদান করে। আনুষ্ঠানিকভাবে একসাথে কাজ না করার সময়েও আল-কায়েদা তালেবানের সুরক্ষা উপভোগ করেছিল এবং এমন একটি দৃঢ় সিম্বিওটিক সম্পর্কের মধ্যে তালেবান শাসনকে সমর্থন করেছিল যে, অনেক পশ্চিমা পর্যবেক্ষক আফগানিস্তানের তালেবান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ইসলামি আমিরাতকে "বিশ্বের প্রথম সন্ত্রাসী-স্পন্সরড স্টেট" বলে অভিহিত করেছেন।

যাহোক, সেই সময় শুধুমাত্র পাকিস্তান, সৌদি আরবসংযুক্ত আরব আমিরাত তালেবান গঠিত সরকারকে আফগানিস্তানের বৈধ সরকার হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৯৬ সালে ওসামা বিন লাদেন আনুষ্ঠানিকভাবে দুই পবিত্র মসজিদের জমি দখলকারী আমেরিকানদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ঘোষণাপত্র " জারি করেন, যা সারা বিশ্বের মুসলিমদের মার্কিন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র গ্রহণের আহ্বান জানায়। ইংরেজি সাংবাদিক রবার্ট ফিস্কের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে উসামা বিন লাদেন আরব বিশ্বে অত্যাচারের সবচেয়ে বড় উৎস হিসেবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ইহুদিবাদের প্রতি এর সমর্থনের সমালোচনা করেন। তিনি মার্কিনদের মিত্র উপসাগরীয় রাজতন্ত্রের তীব্র নিন্দা করেছিলেন; বিশেষ করে সৌদি সরকার পবিত্র ভূমিকে পশ্চিমীকরণ, ইসলামি আইনে শিথিলতা প্রদর্শন বা প্রত্যাহার এবং মার্কিন, ব্রিটিশ ও ফরাসি সেনাদের আতিথ্যের জন্যে তাদের তীব্র নিন্দা ও সমালোচনা করেন।

উসামা বিন লাদেন জোর দেন যে, তিনি তার মুজাহিদ সৈন্যদের সহায়তায় সৌদি সরকারকে উৎখাত করার জন্য একটি সশস্ত্র বিদ্রোহে উস্কে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন এবং তাদের হটিয়ে গোটা আরব উপদ্বীপে একটি ইসলামি আমিরাত প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা সঠিকভাবে শরিয়া (ইসলামী আইন) সমর্থন করে। প্রশ্ন করা হলে তিনি পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে চেয়েছিলেন কিনা; বিন লাদেন উত্তর দিয়েছিলেন:

"এটি যুদ্ধের ঘোষণা নয়–এটি পরিস্থিতির একটি বাস্তব বর্ণনা। এর অর্থ পশ্চিমা এবং পশ্চিমা জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা নয়; তবে মার্কিন শাসনের বিরুদ্ধে ( এটি যুদ্ধ ঘোষণার শামিল), যা প্রতিটি মুসলমানের (যুদ্ধ) করা উচিত।"

১৯৯৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে বোমা হামলা করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে অপারেশন ইনফিনিট রিচের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের খোস্ত প্রদেশে আল কায়েদার একটি ঘাঁটিতে হামলা চালায় এবং আশেপাশের অঞ্চলে ব্যাপক বোমা বর্ষণ করে।

আফগানিস্তানে থাকাকালীন তালেবান সরকার আল-কায়েদাকে ০৫৫ ব্রিগেড প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেয় বলে জানা গিয়েছিল, যা তালেবানের সেনাবাহিনীর একটি অভিজাত উপাদান ছিল। ব্রিগেডের বেশিরভাগই ছিল বিদেশী, সোভিয়েত আক্রমণের সময়ের প্রবীণ যোদ্ধা এবং মুজাহিদদের আদর্শের অনুসারী। ২০০১ সালের নভেম্বর মাসের অপারেশন এন্ডুরিং ফ্রিডম তালেবান সরকারের পতন ঘটায় ; তখন ০৫৫ ব্রিগেডের অনেক যোদ্ধাকে বন্দী বা নিহত করা হয়েছিল এবং যারা বেঁচে ছিল তারা উসামা বিন লাদেনের সাথে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল বলে মনে করা হয়।

২০০৮ সালের শেষের দিকে কিছু সূত্র জানিয়েছিল যে, তালেবান আল কায়েদার সাথে অবশিষ্ট সব রকমের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে; তবে এ কথায় সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ঊর্ধ্বতন মার্কিন সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দাবি মতে, ২০০৯ সালের শুরুর দিকে আফগানিস্তানে আল-কায়েদার ১০০ জনের কম সদস্য অবশিষ্ট ছিল।

আল কায়েদার সামরিক প্রধান মোল্লা আসিম উমর আফগানিস্তানের মুসা কালা জেলায় ২৩ সেপ্টেম্বরের একটি যৌথ মার্কিন-আফগান কমান্ডো বিমান হামলার পর নিহত হন। খবরটি ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে আফগানের ন্যাশনাল ডিরেক্টরেট অফ সিকিউরিটি (এনডিএস) নিশ্চিত করেছিল।

২০২০ সালের ২৭শে মে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জাতিসংঘের বিশ্লেষণাত্মক সহায়তা এবং নিষেধাজ্ঞা পর্যবেক্ষণ দল বলেছিল যে, তালেবান-কায়েদা সম্পর্ক আজও শক্তিশালী রয়েছে এবং উপরন্তু, আল কায়েদা নিজেই স্বীকার করেছিল যে, তারা আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে কাজ করে।

২০২০ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয় যে, আল কায়েদা গোষ্ঠী এখনও আফগানিস্তানের বারোটি প্রদেশে সক্রিয় রয়েছে এবং এর নেতা আল-জাওয়াহিরি এখনও সে দেশে অবস্থান করছেন। জাতিসংঘের মনিটরিং টিম অনুমান করে যে, আফগানিস্তানে আল কায়েদার যোদ্ধার মোট সংখ্যা ছিল ৪০০ থেকে ৬০০ এর মধ্যে।

বৈশ্বিক (সালাফি) জিহাদের ডাক

১৯৯৫ সালের শেষের দিকে আল-কায়েদা বসনিয়ার প্রায় ৮০% অরাষ্ট্রীয় সশস্ত্র কোষের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। একই সময়ে আল-কায়েদার মতাদর্শীরা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক জিহাদি মুসলিমদের অনুসন্ধান করার নির্দেশ দেয়, যারা বিশ্বাস করে যে, আমেরিকা ও তার মিত্রদের সৈন্য ও স্বার্থের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী লড়াই করা উচিত। আল-কায়েদা তখন বিশ্বব্যাপী সালাফি জিহাদের "আক্রমণাত্মক পর্ব" খুলতে চেয়েছিল। ২০০৬ সালে বসনীয় ইসলামপন্থী যোদ্ধারা বিশ্বব্যাপী ইসলামবাদের সাথে একাত্মতার আহ্বান জানায় এবং কাশ্মীর ও ইরাকের বিদ্রোহীদের পাশাপাশি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য লড়াইকারী দলগুলিকে সমর্থন প্রদান করে। বিশ্বব্যাপী আল কায়েদার জিহাদের এই তত্ত্ব গ্লোবাল জিহাদ বা বৈশ্বিক জিহাদ নামে পরিচিত।

ফতোয়া

১৯৯৬ সালে আল কায়েদার নেতৃত্ব ইসলামি ভূমি বলে মনে করে এমন অঞ্চল থেকে বিদেশী সৈন্য ও স্বার্থকে বহিষ্কার ও বিতাড়িত করার জন্য জিহাদ ঘোষণা করে। বিন লাদেন একটি ফতোয়া জারি করেছেন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার আঞ্চলিক মিত্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের একটি প্রকাশ্য ঘোষণাপত্র ছিল এবং আল-কায়েদার সংস্থানগুলিকে বৃহৎ আকারের প্রচারমূলক হামলায় পুনরায় মনোযোগী করতে শুরু করে। উসামা বিন লাদেন এই ফতোয়ার পর বিশ্বব্যাপী আল কায়েদার হামলার পরিমাণ বেড়ে যেতে থাকে।

১৯৯৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিন লাদেন ও মিশরীয় ইসলামি জিহাদের একজন অন্যতম নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি অপর তিনজন ইসলামপন্থী নেতার সাথে স্বাক্ষর করে মুসলমানদের আমেরিকা ও তাদের মিত্রদের হত্যা করার আহ্বান জানিয়ে একটি ফতোয়া জারি করেন। ইহুদি এবং ক্রুসেডারদের (খ্রিস্টান) বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ওয়ার্ল্ড ইসলামিক ফ্রন্টের ব্যানারে তারা ঘোষণা করেছিলেন:

আমেরিকা ও তাদের মিত্রদের বেসামরিক ও সামরিক বাহিনীকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া প্রত্যেক মুসলমানের জন্য একটি স্বতন্ত্র কর্তব্য। যে কেউ যেকোনো দেশে এটি করতে পারে, যেখানে এটি করা সম্ভব হয়। আল-আকসা মসজিদ [জেরুজালেমে] ও মসজিদে হারামকে [মক্কায়] তাদের কবল থেকে মুক্ত করুন এবং তাদের বাহিনী যাতে পরাজিত হয় এবং কোনো মুসলমানকে হুমকি দিতে অক্ষম হয়ে সমস্ত ইসলামি ভূমি থেকে সরে চলে যায়। এটি সর্বশক্তিমান আল্লাহর বাণী অনুসারেই (হবে), 'এবং পৌত্তলিকদের সাথে সকলে মিলে যুদ্ধ করো; যেভাবে তারা সবাই মিলে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে [এবং] তাদের সাথে লড়াই করো, যতক্ষণ না আর কোনো অশান্তি বা অত্যাচার না হয় এবং আল্লাহর প্রতি ন্যায়বিচার ও বিশ্বাস প্রবল হয়।'

বিন লাদেন বা আল-জাওয়াহিরি কারোরই ফতোয়া জারি করার ঐতিহ্যগত ইসলামী পণ্ডিতসুলভ যোগ্যতা ছিল না। যাহোক, তারা সমসাময়িক উলামাদের কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যান করেছিল (যাদের তারা জাহিলিয়ার সমর্থক শাসকদের বেতনভুক্ত সেবক হিসাবে দেখেছিল) এবং এই দায়িত্ব নিজেদের উপর বর্তিয়ে নিয়েছিল। তবে মূলধারার ইসলামি পণ্ডিতরা তার এই ফতোয়াকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেননি।

ফিলিপাইন

আল-কায়েদা-সংশ্লিষ্ট জিহাদি রামজি ইউসুফ ১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি ফিলিপাইনে কাজ করেছিলেন এবং তখন তিনি আবু সায়াফ সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেন বলে জানা যায়। মার্কিন স্টেটস ডিপার্টমেন্টের প্যাটার্নস অফ গ্লোবাল টেররিজমের ২০০২ সংস্করণে আল-কায়েদার সাথে আবু সায়াফের যোগসূত্র উল্লেখ করা হয়েছে। আবু সায়াফ গোষ্ঠীটি ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়া উভয় দেশের পর্যটকদের অপহরণের একটি সিরিজের জন্য পরিচিত, যা তাদের মুক্তিপণের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করতে সাহায্য করে। আবু সায়াফের প্রধান নেতা আব্দুর রাজ্জাক আবু বকর জানজালানি সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে একজন প্রবীণ লড়াকুও ছিলেন। ২০১৪ সালের দিকে আবু সায়াফ ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার প্রকাশ করে এবং আল কায়েদা থেকে পৃথক হয়ে যায়।

ইরাক

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের কিছু দিন পরেই আবু মুসয়াব আল জারকাবি কথিতভাবেই শিয়াদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এর কারণ হিসেবে বলা হয় যে, আমেরিকা ও তার মিত্রদের ইরাক আক্রমণের পর শিয়ারা ইরাকি সুন্নিদের ওপর নির্যাতন চালায় এবং যুদ্ধে মার্কিনদের সৈন্যদের সার্বিক সাহায্য করে। শিয়া বিদ্বেষী সাদ্দাম হুসাইন শাসিত ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বভাবতই শিয়াদের মিত্র হিসেবে গ্রহণ করে। শিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার আল জারকাবি শিয়া মসজিদে বোমা হামলার দায় স্বীকার করে। একই মাসে ইরাকে আল-কায়েদার নামে দাবি করে প্রকাশিত একটি বিবৃতিকে ভুয়া বলে আল কায়েদার নেতা কর্তৃক প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।

২০০৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে আয়মান আল জাওয়াহিরি ইরাকি ইসলামিক স্টেটের পক্ষে বক্তব্য রাখেন; কিন্তু বেসামরিক লক্ষ্যবস্তু এবং নাগরিকদের বিরুদ্ধে করা আক্রমণ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখেন এবং এটিকে তিনি "পদে বিদ্যমান ভন্ড ও বিশ্বাসঘাতক" দ্বারা সংঘটিত বলে মনে করেন। "আয়মান আল-জাওয়াহিরির সাথে সাক্ষাৎকার" শিরোনামে ১ ঘন্টা ৩৭ মিনিট ব্যাপী একটি ভিডিওতে তিনি বলেন, বসরাতে ইরাকি বাহিনীর কাছে ব্রিটেনের নিরাপত্তা হস্তান্তর দেখায় যে, বিদ্রোহীরা দেশটিতে শীর্ষ স্থান অর্জন করছে, যা এখন আল কায়েদার "সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র" ও জিহাদের নেটওয়ার্কের দ্বিতীয় স্থান। ... ইরাক হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলির একটি...। ... বর্তমানে ইরাকে জিহাদ চমৎকারভাবে চলছে... আমি জানতে পেরেছি যে, যোদ্ধাদের সংখ্যা সেখানে বাড়ছে। এই অপরাধগুলি (বেসামরিক) করে এমন পদমর্যাদার ভণ্ড ও বিশ্বাসঘাতকরা, যারা আল কায়েদার বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সাথে নিজেদের মিত্র হওয়ার জন্য সুন্নি গোষ্ঠীগুলিকে উত্সাহিত করতে চায়...।

মার্কিন ও ইরাকি কর্মকর্তারা ইরাকে আল-কায়েদাকে ইরাকি শিয়া জনসংখ্যা ও সুন্নি আরবদের মধ্যে একটি পূর্ণমাত্রার গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত করার লক্ষ্যে প্রচেষ্টা করার জন্য অভিযুক্ত করেন। এটি বেসামরিক লক্ষ্যে হামলা, বেসামরিক গণহত্যা ও উচ্চ-প্রোফাইলসম্পন্ন ধর্মীয় লক্ষ্যগুলির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি উস্কানিমূলক আক্রমণের একটি সুসংগঠিত প্রচারণার মাধ্যমে এটি করা হয়েছিল। ২০০৩ সালে সংঘটিত ইমাম আলী মসজিদে বোমা হামলা, ২০০৪ সালের আশুরার দিনে কারবালা এবং নাজাফে বোমা হামলাসহ ২০০৬ সালে সামারার প্রথম আল-আসকারি মসজিদ বোমা হামলা, বাগদাদে একদিনে ভয়াবহ সিরিজ বোমা হামলা, যাতে কমপক্ষে ২১৫ জন নিহত হয়, ইত্যাদি ভয়াবহ হামলার মাধ্যমে শিয়া ও সুন্নি আরবদের মাঝে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়।

২০০৭ সালে দ্বিতীয় আল আসকারি মসজিদ বোমা হামলা ইরাকের শিয়া মিলিশিয়াদের প্রতিশোধমূলক আক্রমণের একটি ঢেউ উস্কে দেয়, যার ফলে গণহত্যা এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২০০৮ সালে ইরাকি আল-কায়েদাকে দায়ী করে সংঘটিত একটি সাম্প্রদায়িক বোমা হামলায় মার্চ মাসে কারবালার ইমাম হোসেন মাজারে কমপক্ষে ৪২ জন এবং জুনে বাগদাদে একটি বাস স্টপে কমপক্ষে ৫১ জন লোক নিহত হয়েছিল। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইরাকের উত্তরাধিকারী সংগঠন ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ট (আইএসআইএল) আল কায়েদার সাথে দীর্ঘ বিরোধের পর আল কায়েদার নেতৃত্ব প্রকাশ্যে ঘোষণা করে যে, তারা এ গোষ্ঠীর সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করছে। কারণ দলটি ইতিমধ্যেই বর্বরতার জন্য কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল এবং কায়েদার পক্ষে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।

সোমালিয়া ও ইয়েমেন

আল-কায়েদা 
২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সোমালিয়ার সামরিক পরিস্থিতি।
আল-কায়েদা 
ইয়েমেনের বর্তমান (নভেম্বর, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ) সামরিক পরিস্থিতি।

সোমালিয়ায় আল-কায়েদার এজেন্টরা তার সোমালি শাখার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিল এবং পরস্পরে সহযোগিতা করছিল, যে শাখা আল শাবাব গ্রুপ নামে অপারেশন পরিচালনা করে। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আল-শাবাব আনুষ্ঠানিকভাবে আল-কায়েদায় যোগদান করে এবং একটি ভিডিও বার্তায় আনুগত্য ঘোষণা করে। সোমালি আল কায়েদা আত্মঘাতী বোমারু প্রশিক্ষণের জন্য শিশুদের নিয়োগ করে এবং আমেরিকানদের বিরুদ্ধে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য তরুণদের নিয়োগ করেছিল বলে অভিযোগ করা হয়। তবে আল শাবাব পরিচালিত আত্মঘাতী হামলা ও অপারেশনগুলিতে শিশু বোমারুর প্রমাণ পাওয়া যায় না।

পাক–আফগান সীমান্ত থেকে উদ্ভূত হওয়া প্রথম বিশ্বে হামলার শতাংশ ২০০৭ থেকে হ্রাস পেয়েছিল। কারণ আল কায়েদা সোমালিয়া এবং ইয়েমেনে স্থানান্তরিত হয়েছিল এবং তারা আরব বিশ্বআফ্রিকায় মার্কিন স্বার্থে হামলার প্রতি মনোযোগী হয়েছিল। আল কায়েদার সিনিয়র নেতারা যে সময়ে পাক–আফগান সীমান্তের উপজাতীয় এলাকায় লুকিয়ে ছিল, তখন এর মধ্য-স্তরের নেতারা সোমালিয়া এবং ইয়েমেনে তৎপরতা বাড়ানো শুরু করে।

২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে সৌদি আরবের আল কায়েদার শাখা এর ইয়েমেনি শাখার সাথে একীভূত হয়ে আল-কায়েদা ইন দ্য অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা বা AQAP গঠন করে। ইয়েমেনে কেন্দ্রীভূত গোষ্ঠীটি দেশের দুর্বল ভঙ্গুর অর্থনীতি, জনসংখ্যা ও অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এবং দূর্নীতিপরায়ণতার সুবিধা নেয়। ২০০৯ সালের আগস্টে গ্রুপটি সৌদি রাজপরিবারের একজন সদস্যের বিরুদ্ধে একটি হত্যা চেষ্টা পরিচালনা করে। ইয়েমেনে গ্রুপের জিহাদি তৎপরতা বৃদ্ধি পেলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা ইয়েমেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহকে ইয়েমেনে আল-কায়েদার ক্রমবর্ধমান তৎপরতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার বিষয়টি নিশ্চিত করেন এবং অতিরিক্ত সাহায্য পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেন। ইরাকআফগানিস্তানের যুদ্ধগুলি সোমালিয়া এবং ইয়েমেন থেকে মার্কিন দৃষ্টি দূরে সরিয়ে রেখেছিল।

২০১১ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন প্রতিরক্ষাসচিব লিওন প্যানেটা বলেন যে, আল কায়েদার বিরুদ্ধে মার্কিনদের অভিযান এখন ইয়েমেন, সোমালিয়াউত্তর আফ্রিকা জুড়ে সক্রিয় তার মূল গোষ্ঠীসমূহের প্রতি মনোনিবেশ করছে। আল কায়েদা আরব উপদ্বীপ শাখা প্রথম ২০০৯ সালে উমর আব্দুল মুত্তালিব কর্তৃক পরিচালিত নর্থ ওয়েস্ট এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট 253–এ করা বোমা হামলার দায় স্বীকার করে। ২০১১ সালের ৩১ মার্চ আলকায়েদা আরব উপদ্বীপ শাখা (AQAP) ইয়েমেনে একটি আমিরাত ঘোষণা করে আবিয়ান গভর্নরেটের বেশিরভাগ এলাকা দখল করার পর। এরপরই আল কায়েদার ওপর মার্কিন বিমান ও ড্রোন হামলা ব্যাপকহারে বেড়ে যায়। আল কায়েদার দাবি, তাদের ঘোষিত আমিরাত বহাল আছে এবং সেখানে তাদের কাজি ও প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে।

২০১৫ সালের জুলাই মাসে ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির সাথে সাথে ৫০ বেসামরিক লোক নিহত হয়েছিল এবং প্রায় বিশ মিলিয়ন জরুরি সহায়তার প্রয়োজন হয়েছিল। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আল-কায়েদা বাহিনী ও সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী উভয়কেই একই যুদ্ধে হুথি বিদ্রোহীদের সাথে লড়াই করতে দেখা গিয়েছিল। ২০১৮ সালের আগস্টেে আল জাজিরা রিপোর্ট করে যে, "হুথি বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধরত একটি সামরিক জোট ইয়েমেনে আল-কায়েদার সাথে একটি গোপন চুক্তি করেছে এবং গ্রুপটির শত শত যোদ্ধাকে নিয়োগ করেছে। ... চুক্তি তৈরির প্রধান ব্যক্তিরা বলেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিল এবং ১৯৮৮ সালে ওসামা বিন লাদেন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সশস্ত্র গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে ড্রোন হামলা বন্ধ রাখা হয়"।

২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে আল কায়েদার আরব উপদ্বীপ শাখা ইয়েমনের উত্তরাঞ্চলীয় হুথি শিয়াদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে। ইন্টারনেটে পোস্ট করা একটি অডিও বার্তায় সংগঠনটির তৎকালীন ডেপুটি লিডার সাইদ আলী আল-শিহরি বলেন যে, আমরান, সা'দা ও জাওফে হুথি শিয়ারা তাদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী যুদ্ধের মুখোমুখি হবে এবং তিনি ইয়েমেনের সুন্নি মুসলিমদের আল কায়েদার সাথে থাকার আহ্বান জানান।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অপারেশন

১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কাউন্টার টেরোরিজম সেন্টারের ডিরেক্টর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে রিপোর্ট করেন যে, আল কায়েদা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং সে উদ্দেশ্যে দলটি বিমান ছিনতাই করার জন্য কর্মীদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে আল-কায়েদা দেশটির চারটি বিমান ছিনতাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আক্রমণ করে এবং ইচ্ছাকৃতভাবেই দুইটি বিমান উড়িয়ে নিউইয়র্ক সিটির ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার দুটি বিধ্বস্ত করে দেয়। তৃতীয় একটি বিমান ভার্জিনিয়ার আর্লিংটন কাউন্টিতে পেন্টাগনের পশ্চিম দিকে বিধ্বস্ত হয়। এটি দিয়ে মূলত মার্কিন সেনাবাহিনীর সদর দফতরে হামলা করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বিমানটি লক্ষ্যে পৌঁছার পূর্বেই বিধ্বস্ত হয়ে যায়। সবশেষে চতুর্থ একটি বিমান পেন্সিলভানিয়ার শ্যাঙ্কসভিলে একটি মাঠে বিধ্বস্ত হয়। এ বিমানটি দিয়ে মার্কিন হোয়াইট হাউজে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এই হামলায় মোট ২,৯৭৭ জন নিহত হয় এবং ৬,০০০ জনেরও অধিক আহত হয়। এতে সকল হামলাকারীরাও নিহত হয়।

আল-কায়েদা 
একটি বিশেষ বৈঠকে আল কায়েদার সিনিয়র নেতা আনোয়ার আল-আওলাকি

মার্কিন কর্মকর্তারা উল্লেখ করেন যে, আনোয়ার আল আওলাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক বার ভ্রমণ করেন। একজন প্রাক্তন এফবিআই–র এজেন্ট আওলাকিকে আল কায়েদার একজন সিনিয়র রিক্রুটার ও একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আওলাকির ধর্মোপদেশে ১১ই সেপ্টেম্বরের ছিনতাইকারীদের মধ্যে তিনজন ও ফোর্ট হুডের শুটার নিদাল হাসান অভিযুক্ত ছিলেন। মার্কিন গোয়েন্দারা ২০০৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০৯ সালের প্রথম দিকে নিদাল হাসান থেকে আল আওলাকির উদ্দেশ্যে প্রেরিত ইমেলগুলি আটকে দেয়। তার ওয়েবসাইটেও আল আওলাকি ফোর্ট হুড শুটিংয়ে হাসানের কাজের প্রশংসা করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মার্কিন কর্মকর্তা দাবি করেছেন, যে আল আওলাকি আমেরিকা ও আমাদের মিত্রদের বিরুদ্ধে হামলার ষড়যন্ত্রসহ ২০০২ সালের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে বেশ কয়েকটি গুরুতর জিহাদী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন বলে বিশ্বাস করার উপযুক্ত কারণ রয়েছে।

২০১০ সালের এপ্রিল মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আল আওলাকির লক্ষ্যবস্তু হত্যার অনুমোদন দেয় এবং এর ফলে আল-আওলাকি সিআইএ'র লক্ষ্য তালিকায় প্রথম মার্কিন নাগরিক হিসেবে স্থান পান। এর জন্য মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সম্মতি প্রয়োজন ছিল এবং কর্মকর্তারা যুক্তি দিয়েছিলেন যে, আক্রমণটি উপযুক্ত; কারণ এ ব্যক্তিটি মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি আসন্ন বিপদ সৃষ্টি করেছে৷

২০১০ সালের মে মাসে ফয়সাল শাহজাদ, যিনি ২০১০ সালে টাইমস স্কয়ারে গাড়ি বোমা হামলা প্রচেষ্টার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন, তিনি জিজ্ঞাসাবাদকারীদের বলেছিলেন যে, তিনি আওলাকি দ্বারা অনুপ্রাণিত হন এবং একটি সূত্র জানায় যে, শাহজাদ নেটের মাধ্যমে আল-আওলাকির সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। মার্কিন প্রতিনিধি জেন হার্ম্যান তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে এক নম্বর এবং ইনভেস্টর্স বিজনেসেস ডেইলি (Investor's Business Daily) তাকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তি বলে অভিহিত করেছিল।

২০১০ সালের জুলাইয়ে মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট তাকে বিশেষভাবে মনোনীত বৈশ্বিক জিহাদি ব্যক্তিদের তালিকায় যুক্ত করে এবং জাতিসংঘ তাকে কায়েদার সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ২০১০ সালের আগস্টে আল আওলাকির বাবা মার্কিন সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের সাথে মার্কিন সরকারের বিরুদ্ধে একটি মামলা শুরু করেন, যা আনোয়ার আল আওলাকিকে হত্যা করার আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে। ২০১০ সালের অক্টোবরে মার্কিন ও যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তারা আল-আওলাকিকে ২০১০ সালের কার্গো প্লেন বোমা চক্রান্তের সাথে যুক্ত করেছিলেন। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে আল-আওলাকি ইয়েমেনে একটি মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন। ২০১২ সালের ১৬ মার্চ ওসামা বিন লাদেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন বলে জানা যায়।

ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা

আল-কায়েদা 
পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনের কম্পাউন্ডের দৃশ্য, যেখানে তাকে ২০১১ সালের ১ মে হত্যা করা হয়েছিল।

২০১১ সালের ১ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিডিয়ায় ঘোষণা করেছিলেন যে, ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে একটি গোপন অভিযানে সরাসরি নির্দেশে কাজ করা "আমেরিকানদের একটি ছোট বাহিনী" দ্বারা নিহত হয়েছেন। ঘটনাটি ইসলামাবাদ থেকে ৫০ কিমি (৩১ মা) উত্তরে সংঘটিত হয়েছিল। মার্কিন কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে জয়েন্ট স্পেশাল অপারেশন কমান্ডের অধীনে ২০-২৫ ইউএস নেভি সিলের একটি ছোট দল দুইটি হেলিকপ্টার নিয়ে উসামা বিন লাদেনের কম্পাউন্ডে হামলা চালায়। বিন লাদেন ও তার সঙ্গীরা একটি গোলাগুলির লড়াইয়ের সময় নিহত হয়। ঘটনায় মার্কিন বাহিনী কোনো হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতির অভিজ্ঞতা লাভ করেনি। একজন মার্কিনসামরিক কর্মকর্তার মতে, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের অজান্তেই বা তাদের সম্মতি ছাড়া এই হামলা চালানো হয়েছিল। পাকিস্তানের কিছু লোক মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর অননুমোদিত অনুপ্রবেশে হতবাক হয় বলে জানা যায়।

ঘটনা স্থলটি কাকুলে পাকিস্তানি মিলিটারি একাডেমি থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত। এর সম্প্রচার ঘোষণায় প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেন যে, মার্কিন বাহিনী বেসামরিক হতাহত এড়াতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেছে। বিশদ বিবরণে শীঘ্রই প্রকাশিত হয়েছিল যে, বিন লাদেনের সাথে তিনজন পুরুষ এবং একজন মহিলাকে হত্যা করা হয়েছিল। যখন তাদের একজন পুরুষ যোদ্ধা মহিলাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছিল, তখন তাকে হত্যা করা হয়েছিল। বিন লাদেনের দেহের ডিএনএ তার আগে মৃত্যুবরণ করা বড় বোনের রেকর্ডে থাকা ডিএনএ নমুনার সাথে তুলনা করে লাদেনের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়।

মার্কিন সামরিক বাহিনী মৃতদেহটি উদ্ধার করে তাদের হেফাজতে রেখে দেয় যতক্ষণ না-একজন মার্কিন কর্মকর্তার মতে– ইসলামি ঐতিহ্য অনুযায়ী লাদেনের মৃতদেহ সমুদ্রে সমাহিত করা হয়। একজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন যে, বিশ্বের মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীর দেহাবশেষ গ্রহণ করতে ইচ্ছুক একটি দেশ খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে ভেবে তা সমুদ্রে সমাহিত করে দেওয়া হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর উসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর আমেরিকানদের জন্য "বিশ্বব্যাপী সতর্কতা" জারি করে এবং মার্কিন কূটনৈতিক সুবিধার ক্ষেত্রে সর্বত্র উচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছিল বলে একজন সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন। বিন লাদেনের মৃত্যু উদযাপন করার জন্য হোয়াইট হাউসের বাইরে এবং নিউ ইয়র্ক সিটির টাইমস স্কোয়ারে ভিড় জড়ো হয়েছিল।

সিরিয়া

আল-কায়েদা 
৯ এপ্রিল, ২০১৯ পর্যন্ত সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে সামরিক পরিস্থিতি।
  আন নুসরা ফ্রন্ট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত
আল-কায়েদা 
২০১২ সালের অক্টোবরে আলেপ্পোতে বোমা হামলার দৃশ্য, যার দায় আন নুসরা ফ্রন্ট স্বীকার করেছিল।

২০০৩ সালে সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি বাশার আল আসাদ একটি কুয়েতি সংবাদপত্রে দেয়া একটি সাক্ষাত্কারে তিনি প্রকাশ করেছিলেন যে, তিনি সন্দেহ করেছিলেন যে, আল-কায়েদার অস্তিত্ব রয়েছে। তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিল যে, আল-কায়েদা বলে কি সত্যই কোনো সত্তা বর্তমান আছে? এই নামে এটা কি আফগানিস্তানে ছিল...? এটা কি এখন বিদ্যমান আছে...? তিনি উসামা বিন লাদেন সম্পর্কে আরও মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, "[তিনি] ফোনে কথা বলতে পারেন না অথবা ইন্টারনেট ব্যবহারও করতে পারেন না, তাহলে তিনি বিশ্বের চার কোণে যোগাযোগ করতে পারেন? এটা অযৌক্তিক।"

২০০১ সালে বাশার আল আসাদের পদত্যাগ করার দাবিতে সংঘটিত ব্যাপক গণবিক্ষোভের পরপর আল-কায়েদা-সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী ও সুন্নি সহানুভূতিশীলরা শীঘ্রই আল-আসাদের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর যুদ্ধ বাহিনী গঠন করতে শুরু করে। তবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের আগে সিরিয়ায় আল-কায়েদার উপস্থিতি ছিল নগণ্য; কিন্তু গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এর বৃদ্ধি দ্রুত হয়। আন-নুসরা ফ্রন্টইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্টের মতো জিহাদি গোষ্ঠীগুলি অনেক বিদেশি মুজাহিদিনকে প্রশিক্ষণ এবং লড়াইয়ের জন্য নিয়োগ করে, যা ধীরে ধীরে একটি অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। আদর্শগতভাবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ আল-কায়েদার স্বার্থে কাজ করেছে কারণ এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ শিয়া সরকারের বিরুদ্ধে প্রধানত সুন্নিদের বিরোধিতা ছিল। আল-কায়েদা এবং অন্যান্য মৌলবাদী সুন্নি জিহাদি সংগঠনগুলি গৃহযুদ্ধে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে। এমনকি কখনো কখনো তারা সিরিয়ার মূলধারার বিরোধী দলকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন এবং সাহায্য করেছে।

২০১৪ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী আল-কায়েদা সিরিয়ায় আইএসআইএস ও এর কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়। যাহোক, ২০১৪-১৫ সালে আইএস ও আল-কায়েদা-সংযুক্ত আল-নুসরা ফ্রন্ট সিরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধে মাঝে মাঝে পরস্পরে সহযোগিতা করতে সক্ষম হয়েছিল।

আন নুসরা ফ্রন্ট ২০১৫–২০১৭ সাল পর্যন্ত আর্মি অফ কনকোয়েস্টের অংশ হিসাবে সৌদি আরব এবং তুরস্ক দ্বারা সমর্থিত ছিল এবং সে সময়ে তারা অনেক আক্রমণ ও বোমা হামলা চালায়, বেশির ভাগই সিরীয় সরকারের সাথে যুক্ত অথবা সমর্থনকারী লক্ষ্যগুলির বিরুদ্ধে চালানো হয়েছিল। তবে ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে রুশ বিমান হামলা আল-নুসরা ফ্রন্টের পাশাপাশি অন্যান্য ইসলামপন্থী ও সেকুলার বিদ্রোহী দলগুলির দখলে থাকা অবস্থানগুলিকেও লক্ষ্য করে চালানো হয়। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও আন নুসরার লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালায়।

২০১৬ সালের প্রথম দিকে আল কায়েদা ও আইএসের মাঝে সংঘর্ষ চলাকালীন আইএসআইএলের একজন নেতৃস্থানীয় মতাদর্শী আল-কায়েদাকে জিহাদ ও লড়াই অঙ্গনের ইহুদি হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।

ভারত

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আয়মান আল-জাওয়াহিরি ঘোষণা করেছিলেন যে, আল-কায়েদা ভারতে তাদের একটি ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠা করছে, যা তার শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ চালাবে; তার হারানো ভূমি স্বাধীন করবে এবং তার সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করে সেখানে খিলাফত ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টায় লড়াই চালিয়ে যাবে। আল-জাওয়াহিরি মায়ানমার এবং বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশগুলিতে আঞ্চলিক জিহাদের জন্য ভারতকে উর্বর সৈকত হিসাবে মনোনীত করেছিলেন। আল জাওয়াহিরির প্রেরিত সেই ভিডিওর অনুপ্রেরণা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। কারণ এটি মনে হয়েছিল যে, জিহাদি গোষ্ঠীটি আইএসআইএসের উঠতি বৈশিষ্ট্যের আলোকে নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে রাখতেই লড়াই করছে৷ আল কায়েদার নতুন শাখাটি কায়েদাতুল জিহাদ ফি শিবহিল কারাতিল হিন্দিয়া/আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা (AQIS) নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। তবে বেশ কয়েকটি ভারতীয় মুসলিম সংগঠনের নেতা আল জাওয়াহিরির ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন যে, তারা এর থেকে কোনো ভালো কিছুর আশা করেন না এবং এটিকে তারা ভারতের মুসলিম যুবকদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন।

২০১৪ সালে ভারতীয় নিউজ চ্যানেল জি নিউজ টিভি একটি রিপোর্ট করে যে, প্রাক্তন সিআইএ-এর বিশ্লেষক ও দক্ষিণ এশিয়ার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কর্মকর্তা ব্রুস রিডেল পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সকে (আইএসআই) ভারতে আল-কায়েদাকে সংগঠিত করতে এবং সহায়তা করার জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানকে সতর্ক করা উচিত যে, পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদীদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আল জাওয়াহিরি পাকিস্তানে তার গোপন আস্তানায় টেপটি তৈরি করেছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই এবং অনেক ভারতীয় সন্দেহ করে যে, আইএসআই তাকে গ্রেফতার থেকে বাঁচতে সাহায্য করছে। উপরন্তু পাকিস্তান সর্বদা এমন অভিযোগ অস্বীকার করে এবং আল কায়েদার বিস্তৃতির জন্য পরোক্ষভাবে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে দায়ী করে।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ২০২১ তালেবান আক্রমণের সাফল্যের পরে আল-কায়েদা তালেবানকে অভিনন্দন জানায় এবং কাশ্মীরকে ইসলামের শত্রুদের খপ্পর থেকে মুক্ত করার আহ্বান জানায়।

হামলা

আল-কায়েদা 
নাইরোবি, কেনিয়া : ৭ আগস্ট, ১৯৯৮।



দারুস সালাম, তানজানিয়া : ৭ আগস্ট, ১৯৯৮



এডেন, ইয়েমেন : ১২ অক্টোবর, ২০০০।



ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, ইউএস : ১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১।



পেন্টাগন, ইউএস : ১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১।



ইস্তাম্বুল, তুরস্ক : ১৫ ও ২০ নভেম্বর, ২০০৩।

এ পর্যন্ত আল-কায়েদা এবং তার সহযোগী গোষ্ঠীগুলি মোট ছয়টি বড় হামলা পরিচালনা করেছে, যার মধ্যে চারটি আমেরিকার বিরুদ্ধে চলমান তাদের জিহাদের অংশ হিসেবে। প্রতিটি হামলার ক্ষেত্রেই আল কায়েদার নেতৃত্ব কয়েক বছর আগেই আক্রমণের পরিকল্পনা করে রেখেছিল। অস্ত্র ও বিস্ফোরক চালানের ব্যবস্থা করেছিল এবং এর অন্তর্ভুক্ত নেটওয়ার্কগুলি ব্যবহার করে অপারেটিভদের নিরাপদ ঘর এবং মিথ্যা পরিচয় প্রদান করেছিল।

১৯৯১

প্রাক্তন আফগান রাজা মুহাম্মদ জহির শাহকে নির্বাসন থেকে ফিরে আসা এবং আফগানিস্তানে একটি সম্ভাব্য নতুন সরকারের প্রধান হতে বাধা দেয়ার জন্যে উসামা বিন লাদেন পাওলো হোসে ডি আলমেদা সান্তোস নামী ইসলামে ধর্মান্তরিত একজন পর্তুগিজ নয়া মুসলিমকে আফগান রাজা জহির শাহকে হত্যা করার নির্দেশ দেন এবং ১৯৯১ সালে সান্তোষ এই অপারেশন শুরু করে। ১৯৯১ সালের ৪ নভেম্বর সান্তোস একজন সাংবাদিক পরিচয়ে সাক্ষাতকার গ্রহণের উদ্দেশে রোমের রাজার ভিলায় প্রবেশ করেন এবং জহির শাহকে একটি ছুরি দিয়ে ছুরিকাঘাত করার চেষ্টা করেন। তবে রাজা বুক- পকেটে থাকা সিগারিলোর একটি টিন ব্লেডকে ডিফ্লেক্ট করে জীবন রক্ষা করে। পরবর্তীতে সান্তোসকে জহির শাহকে হত্যা চেষ্টা মামলায় ইতালিতে গ্রেপ্তার করা হয় এবং অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার পর তাকে ১০ বছরের জন্য জেল দেওয়া হয়।

১৯৯২

১৯৯২ সালের ২৯ ডিসেম্বর আল-কায়েদা ইয়েমেনের একটি হোটেলে বোমা হামলা করে। ইয়েমেনের এডেনে সেদিন দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। প্রথম টার্গেট ছিল মুভেনপিক হোটেল, যেখানে পশ্চিম থেকে পর্যটক ও কিছু মার্কিন সৈন্য অবস্থান করছিলেন এবং দ্বিতীয় টার্গেটটি ছিল গোল্ডমোহুর হোটেলের পার্কিং লট। ইয়েমেনে আল কায়েদার এটাই প্রথম এবং সফল হামলা ছিল।

আন্তর্জাতিক দুর্ভিক্ষ ত্রাণ প্রচেষ্টা অপারেশন রিস্টোর হোপে অংশ নিতে সোমালিয়ায় যাওয়ার পথে মার্কিন সৈন্যদের নির্মূল করার একটি প্রচেষ্টার অংশ ছিল এই বোমা হামলা। অভ্যন্তরীণভাবে আল-কায়েদা এ বোমা হামলাকে তাদের একটি বিজয় বলে মনে করেছিল, যা আমেরিকানদের ভীতি প্রদর্শন করেছিল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আক্রমণটি খুবই কম প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। কারণ হামলায় কোনো মার্কিন সৈন্য নিহত হয়নি। বরং যেই হোটেলটিতে বোমা হামলা হয়েছিল সেখানে কোনো সৈন্যই ছিল না। তবে বোমা হামলায় একজন অস্ট্রেলীয় পর্যটক এবং একজন ইয়েমেনি হোটেলকর্মী নিহত হয়েছিলেন। সেই সাথে আরো সাতজন গুরুতর আহত হয়েছিল, যাদের বেশিরভাগ ইয়েমেনি নাগরিক ছিল।

আল-কায়েদার সদস্য মামদুহ মাহমুদ সেলিম ইসলামি আইন অনুযায়ী এ হত্যাকাণ্ডকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য দুটি ফতোয়া প্রদান করেছিলেন বলে জানা যায়। সেলিম ইমাম ইবনে তাইমিয়া কর্তৃক প্রদানকৃত একটি বিখ্যাত ফতোয়া উল্লেখ করেছেন, যিনি ১৩শ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত ছিলেন এবং তাকে ওয়াহাবিরা অনেক মান্য করেন। ফতোয়াটি মঙ্গোল আক্রমণের সময় তিনি প্রদান করছিলেন, যা যেকোনো উপায়ে তাদের প্রতিরোধের অনুমোদন দেয়। ]

১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকে

আল-কায়েদা 
১৯৯৮ সালে নাইরোবিতে মার্কিন দূতাবাসে বোমা হামলা।

১৯৯৬ সালে উসামা বিন লাদেন ব্যক্তিগতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন, যখন রাষ্ট্রপতি এশিয়া-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক সহযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্যে ম্যানিলায় ছিলেন। যাহোক, গোয়েন্দা এজেন্টরা মোটরকেড চলে যাওয়ার আগেই একটি বার্তা আটকে দিতে সক্ষম হয় এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাকে সতর্ক করে দেয়। গোয়েন্দা এজেন্টরা পরে একটি ব্রিজের নিচে বসানো একটি বোমা আবিষ্কার করে।

১৯৯৮ সালের ৭ আগস্ট আল-কায়েদা পূর্ব আফ্রিকায় একটি মার্কিন দূতাবাসগুলিতে বোমা হামলা করে এবং এতে ১২ আমেরিকানসহ ২২৪ জনকে হত্যা করা হয়। এর প্রতিশোধ হিসেবে মার্কিন সামরিক বাহিনী কর্তৃক উৎক্ষেপিত গতিনিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্রের একটি ব্যারেজ আফগানিস্তানের খোস্তে আল-কায়েদার একটি ঘাঁটি ধ্বংস করে বলে দাবি করা হয় এবং হামলায় ব্যবহৃত নেটওয়ার্কের ক্ষমতা অক্ষত ছিল। ১৯৯৯ এবং ২০০০ সালের শেষের দিকে আল-কায়েদা সহস্রাব্দের সাথে মিলে যাওয়া উপলক্ষে একটি বড় পরিকল্পনা করে, যা আবু জুবায়দাহ দ্বারা পরিকল্পিত হয়েছিল এবং আবু কাতাদাও এতে সমানভাবে জড়িত ছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য লক্ষ্য ছিল, জর্ডানের খ্রিস্টানদের পবিত্র স্থানগুলিতে বোমা হামলা করা, আহমেদ রেসামের লস এঞ্জেলেস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বোমা হামলা ও ইউএসএস দ্য সুলিভানস (ডিডিজি-৬৮) এর বোমা হামলা।

২০০০ সালের ১২ অক্টোবর ইয়েমেনের আল-কায়েদা জিহাদিরা একটি আত্মঘাতী বোমা হামলায় ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসকারী ইউএসএস কোলে বোমা হামলা করে এবং এতে ১৭ মার্কিন সেনা নিহত হয় এবং সেই জাহাজটি উপকূলে থাকা অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমম হামলার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আল-কায়েদার কমান্ড কোর নিজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে হামলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে এবং তারা সফলও হয়। যার ফলে ১১ সেপ্টেম্বরের হামলা সংঘটিত হয়।

১১ সেপ্টেম্বরের হামলা

আল-কায়েদা 
১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পরের ঘটনা

২০০১ সালের ১১ ই সেপ্টেম্বর আমেরিকায় সংঘটিত আল-কায়েদার একটি হামলায় প্রায় ২,৯৯৬ জন নিহত হয়েছিল – তাদের মধ্যে ২,৫০৭ জন বেসামরিক, ৩৪৩ জন অগ্নিনির্বাপক কর্মী, ৭২ জন আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা, ৫৫ জন সামরিক কর্মী এবং তাদের সাথে ১৯ জন ছিনতাইকারীও অন্তর্ভুক্ত ছিল, যারা হামলা সফল করতে আত্মহত্যা করেছিলেন। দুটি বাণিজ্যিক বিমান ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ারের উদ্দেশে উড্ডয়ন করা হয়েছিল এবং সেগুলি টাওয়ারে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়, তৃতীয় একটি বিমান পেন্টাগন এবং চতুর্থটি মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল বা হোয়াইট হাউসকে লক্ষ্য করে উড্ডয়ন করা হয়েছিল।

তৃতীয় এবং চতুর্থটি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করতে ব্যর্থ হয় এবং সেই দুটি বিমান শ্যাঙ্কসভিলের কাছে স্ট্যনিক্রিক টাউনশিপের একটি মাঠে বিধ্বস্ত হয়েছিল। এই হামলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভীত নাড়িয়ে দেয়। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বরে পার্ল হারবারে জাপানি হামলার পর থেকে এটিই আমেরিকার মাটিতে সবচেয়ে মারাত্মক বিদেশী হামলা ছিল এবং আজ অবধি এটিই মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক হামলা হিসেবে রয়ে গেছে। এই হামলার ফলে বিশ্বে আমেরিকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হামলার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে।

বিন লাদেন, আল-জাওয়াহিরি ও অন্যান্যদের অধীনে থাকা ব্যক্তিদের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে জারি করা ১৯৯৮ সালের একটি ফতোয়া অনুযায়ী কাজ করে আলকায়েদা হামলাগুলি পরিচালনা করেছিল। গোয়েন্দা সংস্থাগুলি এ হামলার জন্য আলকায়েদার সামরিক কমান্ডার মুহাম্মদ আত্তা ও তার সহযোগীর নেতৃত্বে আত্মঘাতী স্কোয়াডগুলিকে আক্রমণের অপরাধী হিসেবে নির্দেশ করে এবং উসামা বিন লাদেন, আল-জাওয়াহিরি, খালিদ শেখ মোহাম্মদ ও হাম্বালিকে প্রধান পরিকল্পনাকারী এবং রাজনৈতিক ও সামরিক কমান্ডের অংশ হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করে তথ্য প্রচার করে।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পরে বিন লাদেন কর্তৃক জারি করা বার্তাগুলি তাদের আক্রমণগুলির প্রশংসা করে এবং কোনো সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে তাদের প্রেরণা ব্যাখ্যা করে। বিন লাদেন মূলধারার এবং ইসলামপন্থী উভয় ঘরাণার মুসলিমদের দ্বারা অনুভূত অভিযোগগুলি চিহ্নিত করে আক্রমণকে বৈধতা দেন এবং এই হামলাকে যথার্থ ও যৌক্তিক হিসেবে উল্লেখ করেন। তার সাধারণ যুক্তি ছিল যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে মুসলমানদের নিপীড়ন করছে।

উসামা বিন লাদেন জোর দিয়েছিলেন যে, আমেরিকা ফিলিস্তিন, চেচনিয়া, কাশ্মীরইরাকে মুসলমানদের হত্যা করছে এবং মুসলমানদের প্রতিশোধ আক্রমণ করার অধিকার" ধরে রাখা উচিত। তিনি আরও দাবি করেছিলেন যে, ১১ সেপ্টেম্বরের হামলাগুলি মানুষকে লক্ষ্য করে নয়; বরং মুসলিম নির্যাতনের সামরিক এবং অর্থনৈতিক শক্তির আইকন আমেরিকা লক্ষ্যবস্তু ছিল। যদিও তিনি সকাল বেলায় আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিলেন যখন উদ্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে বেশিরভাগ লোক উপস্থিত ছিলেন এবং এইভাবে আক্রমণের পরিকল্পনা করা মূলত মানুষের প্রাণহানির সর্বোচ্চ সংখ্যাকে লক্ষ্য করেই অনুমোদিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

পরবর্তীতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, আল কায়েদার এই হামলার মূল লক্ষ্য পূর্ব উপকূলে মার্কিন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে পারে। লক্ষ্যগুলি পরে আল-কায়েদা দ্বারা পরিবর্তিত হয়েছিল; কারণ আশঙ্কা করা হয়েছিল যে, এই ধরনের আক্রমণ "হাত থেকে বেরিয়ে যেতে পারে।

মার্কিন সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই নীতি

আল-কায়েদা 
আফগানিস্তানে দখলদার মার্কিন সেনা।

১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পরপর মার্কিন সরকার নড়ে ওঠে এবং ক্ষমতাসীন আফগান তালেবান সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে সশস্ত্র বাহিনীকে প্রস্তুত করতে শুরু করে। কারণ তারা বিশ্বাস করতো যে, আফগান তালেবান সরকার আল-কায়েদাকে আশ্রয় দিচ্ছে এবং আল কায়েদা আফগানিস্তানে অবস্থান করেই বিভিন্ন অঞ্চলে সশস্ত্র হামলা পরিচালনা করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র তালেবান নেতা মোল্লা ওমরকে বিন লাদেন এবং তার শীর্ষ সহযোগীদের বন্দী করে মার্কিনদের হাতে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানায়। কিন্তু আফগান তালেবান এতে অস্বীকৃতি জানায়। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালানোর প্রস্তুতি গ্রহণ করে । আফগানিস্তানে প্রবেশকারী প্রথম মার্কিনবাহিনী ছিল সিআইএ'র এলিট স্পেশাল অ্যাক্টিভিটিস ডিভিশনের (এসএডি) আধাসামরিক কর্মকর্তারা।

তালেবান উসামা বিন লাদেনের বিচারের জন্যে একটি নিরপেক্ষ দেশে হস্তান্তর করার প্রস্তাব দেয়, যদি মার্কিন হামলায় বিন লাদেন জড়িত থাকার প্রমাণ তারা দেয়। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডব্লিউ বুশ এই প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় বলেন যে, "আমরা জানি সে দোষী। তাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দাও"। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার তালেবান শাসনকে সতর্ক করে বলেন যে, "বিন লাদেনকে আত্মসমর্পণ করুন, অথবা ক্ষমতা সমর্পণ করুন"।

এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র রাষ্ট্রদের সাথে নিয়ে আফগানিস্তানে আক্রমণ করে এবং তালেবান সরকার বিরোধী উত্তর জোটের সাথে মিলে আফগান যুদ্ধের অংশ হিসাবে তালেবান সরকারকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়। মার্কিন বিশেষ বাহিনী এবং বিরোধী উত্তরজোটের স্থলবাহিনীর জন্য বিমান সহায়তার ফলে তালেবান ও আলকায়েদার অনেক প্রশিক্ষণ শিবির ধ্বংস হয়ে যায় এবং আল-কায়েদার অপারেটিং কাঠামোর বেশিরভাগ ব্যাহত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। আফগানিস্তানের তোরা বোরা এলাকায় তাদের আসল অবস্থান থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর অনেক আল-কায়েদা যোদ্ধা রুক্ষ গার্দেজ অঞ্চলে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছিল।

আল-কায়েদা 
২০০৩ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে গ্রেপ্তারের পর খালিদ শেখ মোহাম্মদ (পরিচয় নিশ্চিত করার জন্যে দাঁড়ি কামিয়ে দেওয়া হয়েছিল)।

২০০২ সালের প্রথম দিকে আল-কায়েদা অপারেশনাল ক্ষমতার উপর একটি গুরুতর আঘাতের সম্মুখীন হয় এবং তখন আফগান আক্রমণ সফল হয়েছে বলে মনে করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও আফগানিস্তানে উল্লেখযোগ্য তালেবান বিদ্রোহ রয়ে যায় এবং আস্তে আস্তে তাদের শক্তি পায়। অবশেষে ২০২১ সালে তালেবান সরকার পুনরায় কাবুলে অধিষ্ঠিত হয়। এটি ধারণা করা হয় যে, আল কায়েদার কারণেই যেহেতু তালেবান সরকারের পতন ঘটে, তাই ২০০২ সালের পর থেকে আলকায়েদা পুনরায় তালেবান যোদ্ধাদের সংঘবদ্ধ হতে সহযোগিতা করে।

এদিকে ১১ সেপ্টেম্বর হামলায় আল-কায়েদার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকার প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর একটি ভিডিও টেপ প্রকাশ করে, যেখানে তালেবান সরকার ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে বিন লাদেন আফগানিস্তানের কোথাও নিজের সহযোগীদের একটি ছোট দলের সাথে কথা বলছেন। যদিও এর সত্যতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। টেপটি নিশ্চিতভাবেই ১১ সেপ্টেম্বর হামলায় বিন লাদেন এবং আল-কায়েদাকে জড়িত করে এবং টেপটি অনেক টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারিত হয়েছিল, যার সাথে মার্কিন প্রতিরক্ষাদপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত ইংরেজি অনুবাদ যুক্ত ছিল।

২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ১১ই সেপ্টেম্বর হামলার তৃতীয় বার্ষিকীতে ৯/১১ কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে এই উপসংহারে পৌঁছয় যে, আক্রমণগুলি আল-কায়েদার অপারেটিভদের দ্বারা পরিকল্পিত হয়েছিল এবং তারাই তা বাস্তবায়িত করেছে। ২০০৮ সালের অক্টোবরে বিন লাদেন আল জাজিরার মাধ্যমে প্রকাশিত একটি ভিডিও টেপে হামলার দায় স্বীকার করতে হাজির হন। তিনি বলেন যে, ১৯৮২ সালে লেবাননের উচ্চভূমিতে ইসরায়েলি হামলার দ্বারা তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন: "আমি লেবাননের ধ্বংসপ্রাপ্ত সেই টাওয়ার ও ভবনের দিকে তাকিয়েছিলাম। তখনই আমার ব্যথিত মনে এই কথা ঢোকে যে, আমাদের অত্যাচারীকে শাস্তি দেওয়া উচিত এবং আমাদের মার্কিন টাওয়ারগুলি ধ্বংস করা উচিত, যাতে তারা আমরা যা পেয়েছি তার কিছুটা স্বাদ পায় এবং যাতে তারা আমাদের নারী ও শিশুদের হত্যা করা থেকে বিরত থাকে।"

২০০৪ সালের শেষের দিকে মার্কিন সরকার ঘোষণা করে যে, ২০০১ সাল থেকে আল-কায়েদার সবচেয়ে সিনিয়র ব্যক্তিত্বদের দুই-তৃতীয়াংশকে সিআইএ দ্বারা আটক করা হয়েছে এবং জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ব্যক্তি হলো আবু জুবায়দাহ, রামজি বিন আল-শিব ও আব্দুর রহিম আল–নাশিরি। এরা সকলেই ২০০২ সালে গ্রেফতার হয়। ২০০৩ সালে খালিদ শেখ মোহাম্মদ এবং ২০০৪ সালে সাইফুল ইসলাম আল মাসরি গ্রেফতার হন এবং মুহাম্মদ আতেফসহ আরও কয়েকজন নিহত হন। এক দশক যুদ্ধের পরও আল-কায়েদাকে দমন বা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার জন্য পশ্চিমাদের ব্যাপক সমালোচনা করা হয়েছিল। অনেকে মনে করেন, মার্কিনদের সেই কথিত সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে তাদেরই পরাজয় ঘটেছে, সেই সাথে বিপুল সৈন্য ও অর্থও হারিয়েছে।

কার্যক্রম

আল-কায়েদার তৎপরতার প্রধান দেশগুলি

আফ্রিকা

আল-কায়েদা 
আল কায়েদা ইসলামি মাগরিব শাখার (সাবেক জিএসপিসি ) অপারেশন এলাকা।

ইরিত্রিয়াসোমালিয়ার গৃহযুদ্ধে নিজস্ব দলগুলিকে সমর্থন করার সময় আফ্রিকায় আল-কায়েদার জড়িত থাকাকালীন উত্তর আফ্রিকায় বেশ কয়েকটি বোমা ও আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটেছে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিন লাদেন ও অন্য আল-কায়েদা নেতারা সুদানে অবস্থান করছিলেন। মূলত সেসময় আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে আল কায়েদার বিস্তৃতি ঘটে এবং তারা নিয়মিত অপারেশন পরিচালনা করতে থাকে।

সাহারার ইসলামপন্থী বিদ্রোহীরা নিজেদেরকে আল কায়েদার ইসলামি মাগরিব শাখা বলে দাবি করে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা সহিংসতার পরিমাণ অনেক বাড়িয়েছে। ফরাসি কর্মকর্তারা বলেন যে, আল-কায়েদার নেতৃত্বের সাথে বিদ্রোহীদের কোনো প্রকৃত যোগসূত্র নেই, তবে এটি বিতর্কিত। মনে করা হয় যে, উসামা বিন লাদেন ২০০৬ সালের শেষের দিকে এই গোষ্ঠীর নাম অনুমোদন করেন এবং তাদের সহিংসতা বাড়তে শুরু করার প্রায় এক বছর আগে বিদ্রোহীরা "আল কায়েদা ফ্র্যাঞ্চাইজি লেবেলটি গ্রহণ করেছিল"।

২০১৩ সালে মালিতে আনসারুদ্দীন উপদলকে আল- কায়েদার সহযোগী হিসাবেও রিপোর্ট করা হয়েছিল এবং তখন আনসারুদ্দীন উপদলটি আল কায়েদা ইসলামি মাগরিব শাখার সাথে নিজেদের জোট গঠন করেছিল এবং তখন থেকে তারা আল কায়েদার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাথে সমন্বয় করে হামলা পরিচালনা করে আসছে।

২০১১ সালে আল–কায়েদার উত্তর আফ্রিকীয় শাখা লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির নিন্দা করে এবং তারা গাদ্দাফি-বিরোধী বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে বিদ্রোহে অংশ নেয়।

লিবীয় গৃহযুদ্ধের পর গাদ্দাফির অপসারণ ও লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী সহিংসতার সময় আল-কায়েদার সাথে যুক্ত বিভিন্ন ইসলামপন্থী জিহাদি দল/গোষ্ঠী এ অঞ্চলে তাদের কার্যক্রম প্রসারিত করতে সক্ষম হয়। ২০১২ সালের বেনগাজি বোমা হামলায় ( যাতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জে. ক্রিস্টোফার স্টিভেনসসহ আরও তিনজন আমেরিকান নাগরিক নিহত হয়েছিল) সন্দেহ করা হয় যে, আল কায়েদার ইসলামি মাগরিব শাখার আনসার আল-শরিয়া এবং বেশ কয়েকটি জিহাদি নেটওয়ার্কের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল, যারা কায়েদার সহযোগী গ্রুপ হিসেবে পরিচিত। ১৯৯৮ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে হামলায় জড়িত থাকার সন্দেহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত আল-কায়েদার একজন সিনিয়র অপারেটর নাজিহ আবদুল হামেদ রুকাইকে ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর মার্কিন নৌবাহিনীর সিলস, এফবিআই এবং সিআইএ এজেন্টদের দ্বারা গ্রেফতার করা হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা মিত্ররা তখন থেকে উত্তর আফ্রিকাকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করে।

ইউরোপ

১১ সেপ্টেম্বরের হামলার আগে আল-কায়েদা বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় উপস্থিত ছিল এবং এর তৎকালীন সদস্যদের বেশিরভাগই বসনিয়া এবং হার্জেগোভিনা প্রজাতন্ত্রের বসনিয়ার মুসলিম আর্মির বিচ্ছিন্ন প্রবীণ সদস্যরা ছিলেন। ১৯৯৭ সালে আলকায়েদার তিনজন সদস্য মোস্টার গাড়ি বোমা হামলায় অংশগ্রহণ করে। অপারেটিভগুলি বসনিয়ার গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সৌদি আরবের তৎকালীন যুবরাজ বাদশাহ সালমান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার রিলিফের জন্য সৌদি হাই কমিশনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হারামাইন ফাউন্ডেশন নামে একটি সেবামূলক সংস্থা অর্থায়ন করেছিল বলে অভিযোগ করা হয়। তবে সংস্থাটি এবং সৌদি হাইকমিশন উভয়ই হামলায় নিজেদের সম্পৃক্তা অস্বীকার করে। পরবর্তীতে এই সংস্থাসহ অন্য আরো কয়েকটি সেবামূলক সংস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

৯/১১ হামলা এবং আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের আগেই আল-কায়েদার প্রশিক্ষণ শিবিরে নিয়োগপ্রাপ্ত পশ্চিমাদের আল-কায়েদার সামরিক শাখার মাধ্যমে খোঁজ করে নিয়োগ করা হয়েছিল। ভাষাগত দক্ষতা ও পশ্চিমা সংস্কৃতিসুলভ জ্ঞান সাধারণত ইউরোপ থেকে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে পাওয়া যেতো। যেমন: মোহাম্মদ আত্তা নামী একজন মিশরীয় নাগরিক প্রশিক্ষণের সময় জার্মানিতে অধ্যয়নরত ছিলেন। হামবুর্গ সেলের অন্যান্য সদস্যদের ক্ষেত্রেও এটি সাধারণ বিষয় ছিল। ওসামা বিন লাদেন ও মুহাম্মদ আতেফ পরে আত্তাকে ৯/১১ হামলায় বিমান ছিনতাইকারীদের প্রধান হিসেবে মনোনীত করেন এবং হামলার পর পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলি নির্ধারণ করে যে, ইউরোপে কর্মরত আল-কায়েদার সেলগুলি ছিনতাইকারীদের অর্থায়ন এবং আফগানিস্তানে অবস্থিত কায়েদার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগে সহায়তা করেছিল।

২০০৩ সালে জিহাদপন্থিরা ইস্তাম্বুলে ধারাবাহিক বোমা হামলা চালায় এবং এতে ৫৭ জন নিহত ও প্রায় সাত শতাধিক মানুষ আহত হয়। তুরস্ক কর্তৃপক্ষ এ হামলায় ৭৪ জনকে অভিযুক্ত করেছিল, যাদের কেউ কেউ পূর্বে বিন লাদেনের সাথে দেখা করেছিলেন। যদিও হামলায় অংশগ্রহণকারীরা আল-কায়েদার প্রতি বিশেষ নিয়মে আনুগত্যের অঙ্গীকার করতে অস্বীকার করেছিল, তবে তারা এর আশীর্বাদ ও সাহায্য চেয়েছিল।

২০০৯ সালে তানভীর হুসাইন, আসাদ সারোয়ার এবং আহমদ আব্দুল্লাহ আলি নামে তিন লন্ডনবাসী কানাডামার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গমনকারী সাতটি বিমানে কোমল পানীয়ের ছদ্মবেশে বোমা বিস্ফোরণের ষড়যন্ত্রের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন। এই অভিয়ান দুই শতাধিক কর্মকর্তা দ্বারা পরিচালিত হয়। ব্রিটিশ ও মার্কিন কর্মকর্তারা এই চক্রান্তের কথা জানিয়েছেন যে, অনেক দেশীয় ইউরোপীয় ইসলামি জঙ্গি চক্রান্তের বিপরীতে হামলাকারীরা আল-কায়েদার সাথে সরাসরি যুক্ত ছিল এবং পাকিস্তানে আল-কায়েদার সিনিয়র সদস্যদের মাধ্যমে তারা পরিচালিত ছিল।

২০১২ সালে রুশ ইন্টেলিজেন্স ইঙ্গিত দেয় যে, আল-কায়েদা "বন জিহাদের" আহ্বান জানিয়েছিল এবং "হাজার কাটার" কৌশলের অংশ হিসাবে বনে ব্যাপক দাবানল শুরু করেছিল। তবে পরবর্তীতে এই বিষয়টি প্রমাণিত করা যায়নি।

আরব বিশ্ব

আল-কায়েদা 
২০০০ সালের অক্টোবর মাসে হামলার পর ইউএসএস কোল।

১৯৯০ সালে ইয়েমেনের একীকরণের পরপর ওয়াহাবি নেটওয়ার্কগুলি দেশটিতে তাদের মতবাদী ধর্মপ্রচারক আলেমদের স্থানান্তর করতে শুরু করে। যদিও একথা অসম্ভাব্য যে, বিন লাদেন বা সৌদি আল-কায়েদা এতে সরাসরি জড়িত ছিল, তবে তারা যে ব্যক্তিগত সংযোগ তৈরি করেছিল তা পরবর্তী দশকে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইউএসএস কোল বোমা হামলায় তা ব্যবহৃত হয়। হামলার পর ইয়েমেনে আল-কায়েদা গ্রুপ নিয়ে উদ্বেগ বেড়ে যায়। ইয়েমেনপর গৃহযুদ্ধে আল কায়েদা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় এবং ইয়েমেনি ভূখণ্ডের একটি বড় অংশ দখলে নিয়ে সেখানে শরিয়া আইন কায়েম করতে সক্ষম হয়েছে। ইয়েমেনে সক্রিয় আল কায়েদা সমর্থিত গোষ্ঠীটি আল কায়েদার আরব উপদ্বীপ শাখা নামে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। ইয়েমেন ছাড়াও গ্রুপটি সৌদি আরবে ব্যাপক সক্রিয়। সৌদি আরব থেকে গ্রুপটি মূলত নতুন সদস্য সংগ্রহ করে তাদের অন্যান্য শাখায় নিয়োগ করে।

ইরাকে আল-কায়েদার সশস্ত্র বাহিনী আবু মুসাব আল-জারকাভির নেতৃত্বে জামাআত আল-তাওহিদ ওয়াল-জিহাদ নামে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাথে শিথিলভাবে যুক্ত ছিল। গ্রুপটি বিশেষত আত্মঘাতী অভিযানে বিশেষজ্ঞ এবং তারাই ইরাকে সুন্নি বিদ্রোহের "মূল চালক"। যদিও আল কায়েদার আওতাভুক্ত সদস্যরা সামগ্রিক বিদ্রোহে একটি ছোট ভূমিকা পালন করেছিল, তবে এ বিদ্রোহে তারা ব্যাপক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় এবং তারা মার্কিন বাহিনী ও তাদের সমর্থক শিয়া মিলিশিয়া বাহিনীগুলির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছিল এবং বিদ্রোহের প্রাথমিক বছরগুলিতে সংঘটিত সমস্ত আত্মঘাতী বোমা হামলার ৩০% থেকে ৪০% এর দাবি আবু মুসয়াব জারকাভির গ্রুপ কর্তৃক করা হয়েছিল। একটি প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, ইউসুফিয়ায় অবস্থিত কাকা যুদ্ধাস্ত্র কারখানায় প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধযান আল-কায়েদার হাতে চলে গিয়েছিল এবং সে সব অস্ত্র ব্যবহার করেই বিদ্রোহীরা সরকারি ও মার্কিন বাহিনীকে প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছিল।২০১০ সালের নভেম্বরে জিহাদি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক, যা সেসময় আল-কায়েদার ইরাকি শাখার সাথে সংযুক্ত ছিল, "সমস্ত ইরাকি খ্রিস্টানদের নির্মূল করার" হুমকি দিয়েছিল।

১৯৯০ এর দশকের শেষ পর্যন্ত কায়েদা ফিলিস্তিনিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেনি। তখন হামাস এবং ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের মতো বড় বড় স্থানীয় প্রতিরোধী দলগুলি আল-কায়েদার সাথে জোট গঠন করতে অস্বীকৃতি জানায় এই ভয়ে যে, আল-কায়েদা তাদের সদস্যদের নিজস্ব আঙ্গিকে অন্যত্র নিয়োগ করতে পারে এবং এতে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ ব্যাহত হতে পারে। তবে এটি সম্প্রতি পরিবর্তিতও হতে পারে। ইসরায়েলি নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলি বিশ্বাস করে যে, আল-কায়েদা অধিকৃত অঞ্চল থেকে অনেক অপারেটিভ ইসরায়েলে অনুপ্রবেশ করতে পেরেছে এবং তারা আক্রমণ করার সুযোগের অপেক্ষা করছে।

কাশ্মীর

বিন লাদেন এবং আয়মান আল-জাওয়াহিরি ভারতকে ইসলামি বিশ্বের বিরুদ্ধে কথিত ক্রুসেডার-জায়নবাদী-হিন্দু ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করেন এবং খ্রিস্টান ও ইহুদিদের মতো তাদেরও ইসলামের শত্রু হিসেবে গণ্য করেন। কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের ২০০৫ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, উসামা বিন লাদেন ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে সুদানে থাকাকালীনই কাশ্মীরের জিহাদের জন্য জিহাদিদের প্রশিক্ষণে জড়িত ছিলেন। ২০০১ সাল নাগাদ কাশ্মীরি জিহাদি গোষ্ঠী হরকাতুল মুজাহিদিন আল-কায়েদার বৈশ্বিক জোটের অংশ হয়ে ওঠে। জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (UNHCR) এর রিপোর্ট অনুসারে, আল-কায়েদা ১৯৯৯ সালে সংঘটিত কার্গিল যুদ্ধের সময় পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে (আজাদ কাশ্মীরগিলগিট-বালতিস্তানের কিছু অংশে) ঘাঁটি স্থাপন করেছিল বলে ধারণা করা হয়েছিল এবং সদস্যরা সেখানে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার নিরঙ্কুশ অনুমোদন নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল বলে অভিযোগ করা হয়েছিল।

কাশ্মীরে সক্রিয় অনেক জিহাদিকে তালেবান ও আল-কায়েদার মতো একই মাদ্রাসায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে এবং কাশ্মীরের জিহাদি গোষ্ঠী হরকাতুল মুজাহিদিনের নেতা ফজলুর রহমান খলিল আমেরিকা এবং তার মিত্রদের বিরুদ্ধে আল-কায়েদার ১৯৯৮ সালের জিহাদী ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারীদের একজন ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। লেটার টু আমেরিকান পিপলে ( ২০০২) বিন লাদেন লেখেন যে, তাঁর আমেরিকার সাথে লড়াই করার একটি অন্যতম কারণ ছিল কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের প্রতি আমেরিকার নিরঙ্কুশ সমর্থন।

২০০১ সালের নভেম্বরে কাঠমান্ডুর বিমানবন্দর থেকে একটি বিমান ছিনতাই করে নতুন দিল্লির একটি লক্ষ্যে হামলা করে তা বিধ্বস্ত করার পরিকল্লনা করেছিলেন। কিন্তু বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এর পূর্বেই খবর পেয়ে হাই অ্যালার্ট জারি করে এবং তার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ২০০২ সালে দিল্লি সফরকালীন মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব ডোনাল্ড রামসফেল্ড ভারত সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, আল-কায়েদা কাশ্মীরে সক্রিয় রয়েছে এবং সদস্যরা সেখানে জিহাদি কার্যক্রম পরিচালনা করছে; যদিও তার কাছে এ ব্যাপারে কোনো প্রমাণ বা দলিল ছিল না।

রামসফেল্ড ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে বাইরের জিহাদি সদস্যেদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর হাই-টেক গ্রাউন্ড সেন্সর নির্মাণের প্রস্তাব করেছিলেন। ২০০২ সালের একটি তদন্তে প্রমাণ প্রমাণিত হয় যে, আল কায়েদা এবং তার সহযোগীরা পাকিস্তানের আন্তঃসেবা গোয়েন্দা সংস্থার নিরঙ্কুশ অনুমোদন নিয়ে পাকিস্তান–শাসিত কাশ্মীরে নিজেদের সামরিক উন্নতি করছে। তবে পাকিস্তান ও তার গোয়েন্দা সংস্থা সর্বদাই এমন অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে এবং এসবকে ভারতীয় প্রোপাগান্ডা হিসেবে অভিহিতে করেছে।

২০০২ সালে স্পেশাল এয়ার সার্ভিস ও ডেল্টা ফোর্সের একটি বিশেষ দল ভারত–অধিকৃত কাশ্মীরে পাঠানো হয়েছিল, যখন বিন লাদেনকে কাশ্মীরি জিহাদি গোষ্ঠী হরকাতুল মুজাহিদিনের কর্তৃক আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল এবং দলটি ১৯৯৫ সালে পশ্চিমাঞ্চলে কাশ্মিরে আসা পর্যটকদের অপহরণের জন্য দায়ী ছিল বলে রিপোর্ট পাওয়ার পর তাদের খুঁজতে এই বিশেষ দলটি পাঠানো হয়েছিল। ব্রিটেনের সর্বোচ্চ র্যাংকিংপ্রাপ্ত আল-কায়েদা সদস্য রন্জিব আহমেদও এর আগে কাশ্মীরে হরকাতুল মুজাহিদিন গ্রুপের সাথে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এবং কাশ্মীরে বন্দী হওয়ার পর তিনি ভারতীয় কারাগারে সময় কাটিয়েছিলেন।

মার্কিন কর্মকর্তাগণ বিশ্বাস করেন যে, আল-কায়েদা ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত উসকে দেওয়ার জন্য কাশ্মীরে বেশ কয়েকটি হামলা সংগঠিত করতে সহায়তা করেছে। তাদের কৌশলটি এমন ছিল যে, পাকিস্তানকে নিজের সৈন্যদের ভারতীয় সীমান্ত থেকে না সরাতে বাধ্য করা এবং এর ফলে উত্তর ও পশ্চিম পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকা আল-কায়েদা উপাদানগুলির উপর চাপ কমে যাবে। ২০০৬ সালে আল-কায়েদা দাবি করেছিল যে, তারা কাশ্মীরে একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে ভারতীয় বাহিনীর জেনারেল এইচএস পানাগ দাবি করেন যে, সেনাবাহিনী ভারত- অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরে আল-কায়েদার উপস্থিতি থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছিল। পানাগ এর সাথে আরও যোগ করেন যে, পাকিস্তানে অবস্থিত কাশ্মীরি জিহাদি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বাজইশ-ই-মোহাম্মদের সঙ্গে আল-কায়েদার দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। এ কথা উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ওয়াজিরিস্তান আল কায়েদা এবং তালেবানের সমর্থনে ন্যাটোর বিরুদ্ধে লড়াইরত কাশ্মীরি জিহাদিদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। কাশ্মীরে মদিনার আর্মির লেখক এবং ২০০৪ সালে আর্থিক বিল্ডিং চক্রান্তে জড়িত থাকার জন্য দোষী সাব্যস্ত আল-কায়েদা অপারেটিভ ধীরেন বারোট কাশ্মীরের একটি জঙ্গি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে অস্ত্র ও বিস্ফোরক প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়।

কাশ্মীরি গোষ্ঠী জইশে মুহাম্মদের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মাসুদ আজহার বিন লাদেনের সাথে বেশ কয়েকবার সাক্ষাত করেছেন এবং তার কাছ থেকে তিনি তহবিল পেয়েছেন বলে মনে করা হয়। ২০০২ সালে জইশ-ই-মুহাম্মদ আল-কায়েদার সাথে একত্রিত হয়ে উসামা বিন লাদেনের নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত একটি বিশেষ অপারেশনে ড্যানিয়েল পার্লকে অপহরণ করে হত্যার আয়োজন করেছিল বলে উল্লেখ করা হয়। মার্কিন কাউন্টার টেররিজম বিশেষজ্ঞ ব্রুস রিডেলের মতে, ১৯৯৯ সালে কান্দাহারে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৮১৪ হাইজ্যাক করার সাথে আল-কায়েদা এবং তালেবান ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল। এরফলে মাওলানা মাসুদ আজহার এবং আহমেদ ওমর সাঈদ শেখকে ভারতীয় কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। ব্রুস রিডেল বলেন যে, এই ছিনতাইয়ে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশবন্ত সিং ১১ সেপ্টেম্বর হামলার 'ড্রেস রিহার্সাল' হিসেবে সঠিকভাবে বর্ণনা করেছিলেন।

মুক্তি পাওয়ার পর উসামা বিন লাদেন ব্যক্তিগতভাবে আজহারকে স্বাগত জানান এবং তার মুক্তির পর তার সম্মানে একটি জমকালো অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। আহমদ ওমর সাঈদ শেখ, যিনি ১৯৯৪ সালে ভারতে পশ্চিমা পর্যটকদের অপহরণে তার ভূমিকার জন্য কারাগারে ছিলেন, তিনি ড্যানিয়েল পার্লকে হত্যা করতে গিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে তাকে পাকিস্তানে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। আল-কায়েদার অপারেটিভ রশিদ রউফ, যিনি ২০০৬ সালের ট্রান্সআটলান্টিক বিমান চক্রান্তের অন্যতম অভিযুক্ত আসামী ছিলেন, তিনিও মাওলানা মাসুদ আজহারের সাথে বিবাহের মাধ্যমে সম্পর্কিত ছিলেন।

লস্করে তাইয়েবা নামে একটি কাশ্মীরি জিহাদি গোষ্ঠী, যা ২০০৯ সালের মুম্বাই হামলার পিছনে জড়িত ছিল বলে মনে করা হয়, এর সাথে পাকিস্তানে বসবাসকারী আল-কায়েদার সিনিয়র নেতাদের দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে বলেও জানা যায়। ২০০২ সালের শেষের দিকে ফয়সালাবাদের একটি সেফ হাউসে লস্কর-ই-তৈয়বার মাধ্যমে আশ্রয় নেওয়ার সময় আল-কায়েদার একজন শীর্ষ অপারেটিভ আবু জুবায়দাহ গ্রেপ্তার হন। এফবিআই বিশ্বাস করে যে, আল-কায়েদা এবং লস্কর দীর্ঘদিন ধরে সহাবস্থান করে হামলা পরিচালনা করে এবং সিআইএ বলেছে যে, আল-কায়েদা সর্বদা লস্করে তাইয়েবাকে অর্থায়ন করে। জিন-লুই ব্রুগুইয়ের ২০০৯ সালে রয়টার্সকে বলেছিলেন যে, লস্কর তৈয়বা এখন আর একটি পাকিস্তানী আন্দোলন নয়, যেখানে শুধুমাত্র একটি কাশ্মীর রাজনৈতিক অথবা সামরিক এজেন্ডা রয়েছে৷ লস্করে তৈয়বা এখন আল-কায়েদার সদস্য এবং তাদের নেতৃত্ব মেনে অপারেশন পরিচালনা করে।

২০০৮ সালে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে আমেরিকান বংশোদ্ভূত আল-কায়েদার সিনিয়র অপারেটিভ আদম ইয়াহিয়া গাদাহন বলেছিলেন যে, "কাশ্মীরের বিজয় বছরের পর বছর ধরে বিলম্বিত হয়েছে এই হস্তক্ষেপ থেকে যে, সেখানে জিহাদই একমাত্র মুক্তি পথ। তাই সেই ইসলামি ভূমির হিন্দু দখলদারদের বিরুদ্ধে জয়ের দিকে পা বাড়াও।"

২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে একটি মার্কিন ড্রোন হামলায় ইলিয়াস কাশ্মীরি নিহত হয়েছিলন বলে জানা গেছে, যিনি আল-কায়েদার সাথে যুক্ত একটি কাশ্মীরি জঙ্গি গোষ্ঠী হারকাতুল জিহাদ আল ইসলামি এর প্রধান ছিলেন। ব্রুস রিডেল তাকে একজন বিশিষ্ট আল-কায়েদার সদস্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন; অন্যরা তাকে আল-কায়েদার সামরিক অপারেশনের প্রধান হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ডেনিশ সংবাদপত্র জিল্যান্ড পোস্টেন, যে পত্রিকাটি জিল্যান্ডস পোস্টেন মোহাম্মদ কার্টুন বিতর্কের মূলকেন্দ্রে ছিল, তার বিরুদ্ধে সংঘটিত একটি চক্রান্তের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কাশ্মীরিকেও অভিযুক্ত করেছিল। মার্কিন কর্মকর্তারাও বিশ্বাস করেন যে, ইলিয়াস কাশ্মীরি সিআইএর বিরুদ্ধে ক্যাম্প চ্যাপম্যান হামলায় জড়িত ছিল। ২০১০ সালের জানুয়ারী মাসে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ব্রিটেন সরকারকে একটি ভারতীয় এয়ারলাইন্স বা এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমান হাইজ্যাক করে তা একটি ব্রিটিশ শহরে বিধ্বস্ত করা বিষয়ে আল-কায়েদার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করে। ভারতে গ্রেপ্তার হওয়া হারকাতুল জিহাদ আল ইসলামি একজন অপারেটর আমজাদ খাজাকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে এই তথ্য পাওয়া যায়।

২০১০ সালের জানুয়ারী মাসে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব রবার্ট গেটস পাকিস্তান সফরের সময় বলেছিলেন যে, আল-কায়েদা এ অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধে উস্কে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।

ইন্টারনেট

আল-কায়েদা ও এর উত্তরসূরীরা বর্ধিত আন্তর্জাতিক সতর্ক পরিবেশে নিজেদের সনাক্তকরণ এড়িয়ে চলতে অনলাইনে স্থানান্তরিত হয়েছে। গোষ্ঠীটির ইন্টারনেট ব্যবহার দিন দিন পরিশীলিত হয়েছে এবং অনলাইন ক্রিয়াকলাপগুলির সাথে অর্থায়ন, নিয়োগ, তথ্যপ্রচার ও সংগ্রহ, নেটওয়ার্কিং, সংহতি, প্রচার এবং নিজেদের বিভিন্ন প্রোগ্রাম ভাগ করে নেওয়াও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

আল কায়েদা ইরাক শাখার সাবেক আমির শেখ আবু আইয়ুব আল-মাসরি ইরাকে আল-কায়েদার নিয়মিত জিহাদি আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের সব রকমের কার্যকলাপ মহিমান্বিত করে ছোট ছোট ভিডিও প্রকাশ করতেন। উপরন্তু, আবু মুসয়াব যারকাউয়ির ( ইরাকী আল-কায়েদার প্রাক্তন নেতা) মৃত্যুর আগে এবং পরে উভয় সময়েই বিভিন্ন হামলার ভিডিও প্রকাশ করতেন। আবু মুসাব আত্মঘাতী হামলায় ব্যাপক পরিচিতি ছিল এবং তার নেতৃত্বাধীন ছাতা সংগঠনটি আল-কায়েদার ইরাকি শাখার অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং তা মুজাহিদিন শুরা কাউন্সিল নামে পরিচিত ছিল।

মাল্টিমিডিয়া বিষয়বস্তুর পরিসরের মধ্যে ছিল গেরিলা প্রশিক্ষণের ক্লিপ, হামলায় আক্রান্ত হতে চলেছে এমন শিকারদের স্থিরচিত্র, আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের প্রশংসাপত্র এবং ভিডিও, যা মসজিদের শৈলী সম্পন্ন প্রতিকৃতি এবং মিউজিক্যাল স্কোরের মাধ্যমে জিহাদে অংশগ্রহণকারীদের বিভিন্ন চিত্র ফুটিয়ে তোলে। আল কায়েদার সাথে যুক্ত একটি ওয়েবসাইট ইরাকে বন্দী হওয়ার আমেরিকান উদ্যোক্তা নিকবার্গের শিরচ্ছেদের একটি ভিডিও পোস্ট করেছে। পল জনসন, কিম সান-ইল ও মার্কিন সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্লসহ অন্যান্য বন্দী ব্যক্তির শিরশ্ছেদের ভিডিও ও ছবিগুলি প্রথমে জিহাদি ওয়েবসাইটগুলিতে পোস্ট করা হয়েছিল।

২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বিন লাদেন থেকে প্রাপ্ত এমন দাবিকৃত একটি অডিও বার্তা আল জাজিরাকে একটি অনুলিপি পাঠানোর পরিবর্তে সরাসরি একটি ওয়েবসাইটে পোস্ট করা হয়েছিল এবং এমনটি তিনি অতীতেও করেছিলেন। আল জাজিরা সরাসরি সৌদি রাজপরিবারের সমালোচনামূলক কিছু প্রকাশ করার সম্ভাবনাময় ঝুঁকির পরিবর্তে আল-কায়েদার প্রকাশিত ভিডিওগুলি পুনরায় প্রকাশ করার জন্য ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইটের দিকে ঝুঁকছে, যাতে তারা অসম্পাদিত অনেক ভিডিও সংগ্রহ করতে পারে। বিন লাদেন মূলত তার সকল ভিডিওতে সৌদি রাজপরিবারের দুর্নীতি ও কুশাসন নিয়ে আলোচনা করেন।

Alneda.com ও Jehad.net সম্ভবত আল-কায়েদার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট ছিল। অ্যালনেডা প্রাথমিকভাবে আমেরিকান জন মেসনার দ্বারা সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু অপারেটররা সাইটটিকে বিভিন্ন সার্ভারে স্থানান্তরিত করে এবং কৌশলগতভাবে বিষয়বস্তু স্থানান্তর করে প্রতিরোধ করেছিল।

মার্কিন সরকার একজন ব্রিটিশ তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, বাবর আহমদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে তার ইংরেজি ভাষার আল-কায়েদা ওয়েবসাইট যেমন Azzam.com পরিচালনার সাথে সম্পর্কিত। তাকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দেওয়া হয় বছরের জেল।

অনলাইন যোগাযোগব্যবস্থা

২০০৭ সালে আল-কায়েদা মুজাহেদিন সিক্রেটস নামে একটি সফটওয়ার প্রকাশ করেছিল, যা অনলাইনসেলুলার নেটওয়ার্কে যোগাযোগ করার জন্য ব্যবহৃত একটি এনক্রিপশন সফটওয়ার ছিল। ২০০৮ সালে মুজাহিদিন সিক্রেটস ২ নামে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল।

এভিয়েশন নেটওয়ার্ক

২০১০ সালের রয়টার্সের তথ্য অনুসারে, আল-কায়েদা "বেশ কয়েকটি বোয়িং ৭২৭ বিমান, টার্বোপ্রপস এবং এক্সিকিউটিভ জেটসহ একটি গোপন বিমান চলাচল নেটওয়ার্ক পরিচালনা করছে বলে মনে করা হয়েছিল। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি একটি রিপোর্টের ভিত্তিতে তৈরিকৃত গল্পে বর্ণনা করেছিল যে, আল-কায়েদা সম্ভবত দক্ষিণ আমেরিকা থেকে পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন অস্থিতিশীল দেশে মাদক এবং অস্ত্র পরিবহনের জন্য বিমান ব্যবহার করছে। একটি বোয়িং ৭২৭ দশ টন কার্গো বহন করতে পারে। সে মাদকগুলি শেষ পর্যন্ত বিতরণ ও বিক্রয়ের জন্য ইউরোপে পাচার করা হয়ে থাকে এবং অস্ত্রগুলি আফ্রিকা বা সম্ভাব্য অন্য কোথাও সংঘাতে ব্যবহৃত হতে পারে।

আল-কায়েদার সাথে জড়িত বন্দুকধারীরা মুক্তিপণের জন্য ইউরোপীয়দের ক্রমশ অপহরণ করছে। মাদক ও অস্ত্র বিক্রি এবং অপহরণ থেকে প্রাপ্ত মুনাফা জিহাদি তৎপরতায় অর্থায়ন করতে পারে বলে ধারণা করা হয়। তবে আল কায়েদাসহ অন্য জিহাদি গোষ্ঠীগুলি সর্বদাই মাদকদ্রব্য পাচারের বিষয়টি অস্বীকার করে।

সামরিক সংঘাতে জড়িত

নিম্নে সামরিক সংঘাতসমূহের একটি তালিকা রয়েছে, যেখানে আল-কায়েদা এবং এর সহযোগীরা সরাসরি সামরিকভাবে অংশ নিয়েছে।

সংঘাতের সূচনা দ্বন্দ্বের অবসান দ্বন্দ্ব মহাদেশ অবস্থান জড়িত শাখা
১৯৯১ চলমান সোমালি গৃহযুদ্ধ আফ্রিকা সোমালিয়া আল-শাবাব
১৯৯২ ১৯৯৬ আফগান গৃহযুদ্ধ (১৯৯২-১৯৯৬) এশিয়া আফগানিস্তান ইসলামি আমিরাত আল-কায়েদা কেন্দ্র
১৯৯২ চলমান ইয়েমেনে আল-কায়েদার বিদ্রোহ এশিয়া ইয়েমেন আরব উপদ্বীপ শাখা
১৯৯৬ ২০০১ আফগান গৃহযুদ্ধ (১৯৯৬-২০০১) এশিয়া আফগানিস্তান ইসলামি আমিরাত আল-কায়েদা কেন্দ্র
২০০১ ২০০১ আফগান যুদ্ধ (২০০১-২০২১) এশিয়া আফগানিস্তান আল-কায়েদা কেন্দ্র
২০০২ চলমান মাগরেবে বিদ্রোহ (২০০২-বর্তমান) আফ্রিকা আলজেরিয়া
চাদ
মালি
মৌরিতানিয়া
মরক্কো
নাইজার
তিউনিসিয়া
ইসলামি মাগরিব শাখা
২০০৩ ২০১১ ইরাক যুদ্ধ এশিয়া ইরাক আল-কায়েদা ইন ইরাক

ইসলামিক স্টেট অব ইরাক

২০০৪ চলমান উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তান যুদ্ধ এশিয়া পাকিস্তান আল-কায়েদা কেন্দ্র
২০০৯ ২০১৭ উত্তর ককেশাস বিদ্রোহ এশিয়া রাশিয়া ককেশাস আমিরাত
২০১১ চলমান সিরীয় গৃহযুদ্ধ এশিয়া সিরিয়া আন-নুসরা ফ্রন্ট
২০১৫ চলমান সৌদি আরবের নেতৃত্বে ইয়েমেনে হস্তক্ষেপ এশিয়া ইয়েমেন আল কায়েদা আরব উপদ্বীপ শাখা

সিআইএ সম্পৃক্তার অভিযোগ

বিশেষজ্ঞরা এই ধারণা নিয়ে বিতর্ক করেন, যে আল-কায়েদার চলমান অভিযানগুলি এর আগে আফগান মুজাহিদদের সাহায্য করার জন্য গঠিত আমেরিকান সিআইএ-এর অপারেশন সাইক্লোন প্রোগ্রামের একটি পরোক্ষ ফলাফল। ১৯৯৭ থেকে নিয়ে ২০০১ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী রবিন কুক লিখেছেন যে, আল-কায়েদা ও বিন লাদেন "পশ্চিমা নিরাপত্তা সংস্থাগুলির একটি স্মারক ও ভুল গণনার একটি পণ্য এবং আলকায়েদা আক্ষরিক অর্থে হলো একটি "ডাটাবেস", যা মূলত ছিল হাজার হাজার মুজাহিদিনের কম্পিউটার ফাইল, যাদের রাশিয়ানদের পরাজিত করার জন্য সিআইএ-এর সাহায্যে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল"। ২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি মুনির আকরাম ২০০৮ সালের ১৯ জানুয়ারী দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি চিঠিতে লিখেছেন:

সোভিয়েতের সামরিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আফগানদের সমর্থন করার কৌশলটি সিআইএসহ বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা বিকশিত হয়েছিল। যেমন: ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স বা আইএসআই। সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের পর পশ্চিমা শক্তিগুলি এই অঞ্চল থেকে দূরে চলে যায় এবং সোভিয়েত বিরোধী জিহাদ পরিচালনার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে আগমনকারী ৪০,০০০ জিহাদি পিছনে থেকে যায়। এরপর পাকিস্তানকে চরমপন্থা, মাদক ও বন্দুকের আঘাতের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

বার্তাসংস্থা সিএনএনের সাংবাদিক পিটার বার্গেন এবং পাকিস্তানি আইএসআই ব্রিগেডিয়ার মুহাম্মদ ইউসুফ ও আফগান কর্মসূচিতে জড়িত সিআইএ কর্মী; যেমন: ভিনসেন্ট ক্যানিস্ট্রারো এ কথা অস্বীকার করেছেন যে, সিআইএ বা অন্য মার্কিন কর্মকর্তাদের সাথে বিদেশী মুজাহিদিন বা বিন লাদেনের যোগাযোগ ছিল বা তারা তাদের সশস্ত্র, প্রশিক্ষিত, প্রশিক্ষিত অথবা অনুপ্রাণিত করেছিলেন। ২০০৪ সালে প্রকাশিত বই ঘোস্ট ওয়ার্স- এ স্টিভ কল লিখেন যে, সিআইএ বিদেশী যোদ্ধাদের রাসরি সমর্থন দেওয়ার কথা চিন্তা করেছিল, কিন্তু এ ধারণাটি কখনই আলোচনার বাইরে চলে যায়নি এবং বাস্তবতার রূপ পরিগ্রহ করেনি।

বার্গেন ও অন্যরা যুক্তি দেখান যে, স্থানীয় ভাষা, রীতি নীতি এবং জমির সাথে অপরিচিত বিদেশী যোদ্ধাদের নিয়োগের কোন প্রয়োজন সিআইএ'র ছিল না। কারণ সেখানে প্রায় একচতুর্থাংশেরও বেশি স্থানীয় আফগান যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক ছিলেন। বার্গেন আরও যুক্তি দেন যে, বিদেশী মুজাহিদদের আমেরিকান তহবিলের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। কারণ তারা নিজেদেরই অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন ডলার পেতেন। সবশেষে তিনি যুক্তি দেন যে, মার্কিনরা বিদেশী মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ দিতে পারত না। কারণ পাকিস্তানি কর্মকর্তারা তাদের হাতে গোনা কয়েকজন সদস্যকে পাকিস্তানে কাজ করার অনুমতি দেবেন না। এছাড়া আফগানিস্তানও কাউকে অনুমতি দেবেন না। আফগান আরবরা প্রায় সবসময় জিহাদি ইসলামপন্থী ছিলেন এবং পশ্চিমাদের প্রতি তারা প্রতিকূলভাবেই বিদ্বেষী ছিল। পশ্চিমারা মূলত আফগান মুসলিমদের সাহায্য করছিল।

বার্গেনের মতে, যিনি ১৯৯৭ সালে বিন লাদেনের সাথে প্রথম টেলিভিশন সাক্ষাত্কার পরিচালনা করেছিলেন: "ধারণা করা হয় যে, সিআইএ বিন লাদেনকে অর্থায়ন করেছিল বা বিন লাদেনকে প্রশিক্ষিত করেছিল ...এটি একটি লোককথা। এর কোনো প্রমাণ বা ভিত্তি নেই ... বিন লাদেনের নিজস্ব অর্থ ছিল। তিনি মার্কিন বিরোধী ছিলেন। তিনি গোপনে ও স্বাধীনভাবে কাজ করছিলেন ... এখানে আসল ঘটনা হলো ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত, যখন তারা সত্যিকারে তার অবস্থান যাচাই শুরু করার জন্য একটি ইউনিট স্থাপন করেছিল। এর আগে পর্যন্ত এই লোকটি আসলে কে ছিলেন, সে সম্পর্কে সিআইএ-এর কাছে কোনো ধারণাই ছিল না।" জেসন বার্ক আরো লিখেছেন:

সিআইএ আফগানিস্তানে ঢেলে দেওয়া ৫০ কোটি ডলারের কিছু অংশ আল-জাওয়াহিরির গ্রুপে পৌঁছেছিল। আল-জাওয়াহিরি বিন লাদেনের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে উঠেছিলেন। ... যাহোক, বিন লাদেনের অফিস অফ সার্ভিসেস, যা যুদ্ধক্ষেত্রে বিদেশী সাহায্যের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা কিছু নগদ মার্কিন ডলার পেয়েছিল।

এছাড়া অনেক বিশ্লেষক আল কায়েদার সিআইএ-এর সহযোগিতা গ্রহণের বিষয়টি অযৌক্তিক ও প্রমাণহীন বলে মনে করেন। আমেরিকা এবং তার মিত্র দেশগুলি সোভিয়েত ও আফগান যুদ্ধে আফগান মুজাহিদিনদের সহযোগিতা করলেও তা আল কায়েদা গোষ্ঠী সংঘটিত হওয়ার অনেক আগেই ঘটেছিল এবং সেই সময় আল কায়েদা নামে কোনো সংগঠনের অস্তিত্বই ছিল না। এর পর ৯০ এর দশক যখন আল কায়েদা সংঘটিত হওয়া শুরু করে, তখন তারা মার্কিন বিরোধী শক্তি হিসেবেই অভিভূত হয়। এছাড়া উসামা বিন লাদেন বিশাল অর্থ সম্পদের মালিক ছিলেন এবং তিনি তার সকল অর্থ সম্পত্তি এই কাজেই ব্যয় করেছিলেন। এ সকল বিষয় বিবেচনা করে অনেক গবেষক সিআইএ কর্তৃক আল কায়েদাকে সহযোগিতা করা বা স্বয়ং সিআইএ আল কায়েদাকে সৃষ্টি করার মত বিষয়টিকে ষড়যন্ত্র তত্বের অংশ মনে করেন।

বৈশ্বিক প্রভাব

২০১১ সালের নরওয়েতে হামলার অপরাধী আন্ডারস বেহরিং ব্রেইভিক হামলা করার ক্ষেত্রে আল–কায়েদা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং এটিকে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে সফল এবং প্রভাবক বিপ্লবী আন্দোলন বলে অভিহিত করেছিলেন। বিভিন্ন লক্ষ্যে হামলা করে তিনি আলকায়েদার একটি ইউরোপীয় সংস্করণ তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন।

বিভিন্ন স্থানে আল কায়েদার আদলে সংঘটিত হামলার উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া একটি বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ২০১২ সালে একজন সাংবাদিক রিপোর্ট করেছিলেন যে, একজন সিনিয়র মার্কিন সামরিক পরিকল্পনাকারী জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, "যখনই কোনো গোষ্ঠী আল কায়েদার কালো ব্যানার উত্থাপন করে, তখনই কি আমাদের ড্রোন এবং বিশেষ অপারেশন অভিযান অবলম্বন করা উচিত? কতদিন আমরা সারা বিশ্বে শাখা-প্রশাখায় তাড়া চালিয়ে যেতে পারি?"

সমালোচনা

ইসলামি চরমপন্থা ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসের ১ম শতাব্দীতে খারিজিদের উত্থানের সাথে সাথে শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে তা বিস্তৃতি লাভ করে। তাদের উত্থান মূলত রাজনৈতিক অবস্থান থেকে শুরু হয় এবং খারিজিরা এমন একটি চরম ও উগ্রপন্থী মতবাদ তৈরি করে, যা তাদের মূলধারার সুন্নিশিয়া মুসলিম উভয় থেকে আলাদা করে। মুসলমানদের মধ্যে খারিজি মতবাদ সুন্নি এবং শিয়াদের মধ্যে মূল বিভেদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যদিও তখন মুসলিম সমাজে শিয়া নামে কোনো সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল না। তারা মূলত আলী রা. এর সমর্থক হিসেবে নিজেদের জাহির করত এবং খেলাফত প্রশ্নে হজরত আলীকে সমর্থন করতো।

নবী মুহাম্মদ সা. এর মৃত্যুর পরে মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উত্তরাধিকার নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এই বিরোধ ইসলামের ১ম খলিফা আবু বকর এবং দ্বিতীয় খলিফা উমর ফারুকের মৃত্যুর পরে তৃতীয় খলিফা হজরত উসমানের যুগে উদ্ভূত হয় এবং একদল পথভ্রষ্ট মুসলিম হজের সময় তাঁর পদত্যাগের দাবিতে তার বাসভবন ঘেরাও করে। তখনই প্রথমবার ইসলামি সমাজে বিভক্তির জন্ম নেয় এবং মুসলমানরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায়। বিদ্রোহীরা খলিফা উসমান রা. এর পদত্যাগ দাবি করে আলীকে তার স্থলাভিষিক্ত করার দাবি জানায়। আলীর সমর্থকরা পরবর্তী সময়ে শিয়া নামে পরিচিতি লাভ করে। তবে পূর্ববর্তী শিয়ারা হজরত আবু বকরউসমানের খিলাফত নিয়ে কোন নেতিবাচক মন্তব্য করত না। এই বিশ্বাস মূলত তৃতীয় শতাব্দীর পর তাদের মাঝে জন্ম লাভ করেছে।

এভাবে প্রথম ফিতনার (প্রথম ইসলামি গৃহযুদ্ধ) সময় খারেজীরা শিয়া, সুন্নি উভয়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং তারা বিশেষভাবে তাকফিরের (কোনো মুসলিমকে ইসলামবহির্ভূত ঘোষণা করা ) জন্য একটি চরম উগ্রপন্থা অবলম্বন করার ক্ষেত্রে সুপরিচিত হয়ে ওঠে, যার মাধ্যমে তারা সুন্নি, শিয়া উভয় মুসলিমদের কাফের বা মুনাফিক বলে ঘোষণা করেছিল এবং তাই তাদের সকলকে ধর্মত্যাগী হিসেবে হত্যার যোগ্য বলে মনে করেছিল। হজরত আলী রা. তাদের কঠোর হাতে দমন করতে গিয়ে নিজেই তাদের হাতে হত্যার শিকার হন।

বেশ কয়েকটি সূত্র মতে, আলকায়েদা ও এর সহযোগী সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মীয় পণ্ডিত ও প্রাক্তন যোদ্ধারা আল-কায়েদার তাকফির নীতি এবং মুসলিম দেশগুলিতে নির্বিচারে মুসলিম হত্যার কারণে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছেন; বিশেষ করে ইরাকে। সেখানে সংঘটিত আত্মঘাতী বোমা হামলায় হাজার বেসামরিক মুসলিম নিহত হয়েছেন, যাদের সাথে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার কোনো সংযোগ নেই।

নোমান বেনোটম্যান নামে লিবিয়ান ইসলামিক ফাইটিং গ্রুপের (LIFG) একজন প্রাক্তন জিহাদি সদস্য ২০০৭ সালের নভেম্বরে আল কায়েদা নেতা আয়মান আল–জাওয়াহিরির সমালোচনায় একটি খোলা চিঠি দিয়ে প্রকাশ্যে আসেন। তখন তিনি লিবিয়ার শাসনের সাথে তার প্রাক্তন গ্রুপের কারাবন্দী সিনিয়র নেতাদের শান্তি আলোচনায় প্রবেশ করার জন্যে রাজি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ২০০৭ সালের নভেম্বরে আয়মান আল–জাওয়াহিরি যখন আল–কায়েদার কেন্দ্রের সাথে এই গোষ্ঠীর সংযুক্তি ঘোষণা করেছিলেন, তখন লিবিয়ার সরকার সেই গোষ্ঠীটির ৯০ জন সদস্যকে কয়েক মাস আগে জেল থেকে মুক্তি দেয় এই মর্মে যে, "তারা সবাই সহিংসতা ত্যাগ করেছে বলে বলা হয়েছিল"।

২০০৭ সালে ১১ই সেপ্টেম্বর হামলার বার্ষিকীতে সৌদি আলেম সালমান আল আউদা উসামা বিন লাদেনকে ব্যক্তিগতভাবে তিরস্কার করেছিলেন। শায়খ আল আউদা একজন ধর্মীয় পণ্ডিত এবং সাহওয়ার অন্যতম জনক, যা একটি ইসলামি জাগরণ আন্দোলন ছিল, যা ১৯৮০ এর দশকে সৌদি আরবে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ আন্দোলন পরবর্তীতে প্রচলিত সৌদি আইনে শরিয়ার প্রভাব বৃদ্ধিতে ব্যাপক অবদান রেখেছিল বলে ধারণা করা হয়। শায়খ আউদা প্রচলিত জিহাদবাদের ব্যাপক সমালোচনাও করেছেন। এর প্রচলিত পদ্ধতির বিষয়ে তিনি অনেক আপত্তি উত্থাপন করেছেন।

শেখ সালমান আল আউদা একটি টেলিভিশনে আল-কায়েদার আমিরকে সম্বোধন করে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন:

আমার ভাই ওসামা, কত রক্ত ​​ঝরেছে আজ পর্যন্ত ? আল-কায়েদার নামে কত নিরীহ মানুষ, শিশু, বৃদ্ধ ও নারীকে হত্যা করা হয়েছে ? আপনি কি এই শত সহস্র বা লক্ষ লক্ষ লোকের বোঝা আপনার পিঠে বহন করে সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাথে দেখা করতে পেরে খুশি হবেন?

পিউ পোল অনুসারে, ২০০৮ সালের পর মুসলিম বিশ্বে আল–কায়েদার প্রতি সমর্থন অনেক কমে গিয়েছিল। ইন্দোনেশিয়া, লেবাননবাংলাদেশে আত্মঘাতী বোমা হামলার সমর্থন গত পাঁচ বছরে অর্ধেক বা তার বেশি কমেছে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক একটি চিন্তা কেন্দ্র ফ্রি টুমরোর ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে করা জরিপ অনুসারে, সৌদি আরবে মাত্র দশ শতাংশ লোক আল-কায়েদা সম্পর্কে অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গি রেখেছিল।

২০০৭ সালে বন্দী হওয়া সাইয়েদ ইমাম আল–শরীফ, যিনি একজন প্রভাবশালী আফগান আরব এবং আল কায়েদার আদর্শগত নেতা ও তার তাকফিরের প্রাক্তন সমর্থক তার ওয়াসিকাত তারশিদ আল-আমল আল-জিহাদি ফি মিসর ওয়াল আলম ( ইংরেজি: Rationalizing Jihad in Egypt and the World) বইয়ের মাধ্যমে আল-কায়েদা থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন।

যদিও পূর্বে আল-কায়েদার সাথে সংযুক্ত ছিল, ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে LIFG জিহাদের জন্য একটি নতুন কোড সম্পন্ন করে, যা সংশোধনী অধ্যয়ন শিরোনামের ৪১৭ পৃষ্ঠার একটি ধর্মীয় দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। এটির বিশ্বাসযোগ্যতা ও মধ্যপ্রাচ্যের আরো বেশ কিছু বিশিষ্ট জিহাদি আলকায়েদা থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে এলআইএফজি'র পরিবর্তনের বিষয়টি দৃঢ় করার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।

আল কায়েদার আমির এবং সদস্যরা সর্বদা নিজেদের খারেজি হওয়ার বিষয়টি কঠোরভাবে অস্বীকার করে আসছে। তাদের মতে, খারেজি হওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্রের বিরোধীতা করা জরুরি। অথচ তাদের লড়াই মার্কিন আধিপত্য এবং মুসলিম বিশ্বে তাদের সহযোগী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে।

অন্যান্য সমালোচনা

সিরিয়ায় অবস্থানকারী বিলাল আব্দুল করিম নামের একজন আমেরিকান সাংবাদিক সোমালিয়ায় আল-কায়েদার সহযোগী গোষ্ঠী আল-শাবাব সম্পর্কে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন। তার এই ডকুমেন্টারিতে গ্রুপের প্রাক্তন সদস্যদের সাক্ষাৎকারও অন্তর্ভুক্ত ছিল, যারা আল-শাবাব ছেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে এতে আলোকপাত করেছিলেন। দলটির সদস্যরা বিচ্ছিন্নতা, গোষ্ঠীতে ধর্মীয় সচেতনতার অভাব, অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি এবং পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলেন। তবে করিমের প্রতিক্রিয়ায় গ্লোবাল ইসলামিক মিডিয়া ফ্রন্ট করিমের নিন্দা করে। তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করে এবং প্রাক্তন যোদ্ধাদের অভিযোগ অস্বীকার করে।

২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ট ঘোষণা করেছিল যে, আইএস খিলাফত পুনরুদ্ধার করেছে; তখন গ্রুপের তৎকালীন মুখপাত্র আবু মুহাম্মাদ আল-আদনানি একটি অডিও বিবৃতি প্রকাশ করে দাবি করে যে, "সমস্ত আমিরাত ও গোষ্ঠীর বৈধতা খিলাফতের কর্তৃত্ব সম্প্রসারণের ফলে শূন্য হয়ে যায়"। বক্তৃতায় আল-কায়েদার একটি ধর্মীয় খণ্ডন অন্তর্ভুক্ত ছিল, শিয়াদের ব্যাপারে তাদের অত্যন্ত নম্র হওয়ার জন্য এবং তাদের কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করা; বিশেষ করে খলিফা আবু বকর আল-বাগদাদিকে বায়াত না দেওয়ার জন্যে। আল-আদনানি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যে, "একটি রাষ্ট্রের পক্ষে একটি সংগঠনের প্রতি আনুগত্য করা কখনই উপযুক্ত কাজ নয়৷ এছাড়াও তিনি অতীতের একটি উদাহরণও স্মরণ করিয়ে দেন, যেখানে ওসামা বিন লাদেন আল-কায়েদার সদস্য ও সমর্থকদের আবু ওমর বাগদাদির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন, যখন গোষ্ঠীটি ইরাকে ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক হিসাবে কাজ করছিল। আল কায়েদার নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি এর নিন্দা করেছিলেন। জাওয়াহিরি আল-নুসরা ফ্রন্টের মতো আইএসের প্রাক্তন মিত্রদের মধ্যে উপদল ও বিভাজনকে উৎসাহিত করছিলেন।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

মিডিয়া

Tags:

আল-কায়েদা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতিআল-কায়েদা সাংগঠনিক কার্যক্রমআল-কায়েদা নেতৃত্বআল-কায়েদা অর্থায়নআল-কায়েদা উদ্দেশ্য ও সামরিক কৌশলআল-কায়েদা নামকরণআল-কায়েদা মতাদর্শআল-কায়েদা ধর্মীয় সামঞ্জস্যতাআল-কায়েদা ইতিহাসআল-কায়েদা হামলাআল-কায়েদা মার্কিন সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই নীতিআল-কায়েদা কার্যক্রমআল-কায়েদা সিআইএ সম্পৃক্তার অভিযোগআল-কায়েদা বৈশ্বিক প্রভাবআল-কায়েদা সমালোচনাআল-কায়েদা আরও দেখুনআল-কায়েদা তথ্যসূত্রআল-কায়েদা উৎসআল-কায়েদা বহিঃ সংযোগআল-কায়েদাআরব জাতিআরবি ভাষাইউরোপীয় ইউনিয়নখিলাফতজাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদজিহাদন্যাটোবিপ্লববিশ্বের ইতিহাসরোমান্স ভাষাসমূহসর্ব-ইসলামবাদসালাফি জিহাদবাদ১১ সেপ্টেম্বরের হামলা১৯৯৮২০০২ বালি বোমা হামলা

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীবীর্যশ্রীকৃষ্ণকীর্তনইউরোপজয়া আহসানজার্মানিমেটা প্ল্যাটফর্মসকমনওয়েলথ অব নেশনসহোমিওপ্যাথিবিকাশআওরঙ্গজেববারো ভূঁইয়াবাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহের তালিকানেপোলিয়ন বোনাপার্টসংযুক্ত আরব আমিরাতপশ্চিমবঙ্গমঙ্গল গ্রহযোনি পিচ্ছিলকারকসোমালিয়াতাজমহলচিকিৎসকঅনাভেদী যৌনক্রিয়াফুসফুসদ্য কোকা-কোলা কোম্পানিসুভাষচন্দ্র বসুশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ভারতীয় সংসদভারতের রাষ্ট্রপতিদের তালিকাআব্বাসীয় স্থাপত্যবাসুকীত্রিভুজশিক্ষাদিনাজপুর জেলাদক্ষিণ এশিয়ালিওনেল মেসিপ্লাস্টিক দূষণনারায়ণগঞ্জ জেলাবাণাসুরহার্নিয়াবাংলাদেশের উপজেলাচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়এম. জাহিদ হাসানমাটিদ্বাদশ জাতীয় সংসদ সদস্যদের তালিকানারী খৎনাপ্রাকৃতিক সম্পদমিয়া খলিফামাতৃভাষীর সংখ্যা অনুসারে ভাষাসমূহের তালিকামুস্তাফিজুর রহমানবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টরসমূহআবু হানিফাসৌদি আরবক্রিকেটমহাভারতখাদ্যটিকটকরয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুবাংলাদেশের সিটি কর্পোরেশনের তালিকাকৃত্তিবাসী রামায়ণনেপালআল মনসুরজ্বীন জাতিভারতীয় জনতা পার্টিহজ্জআর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলসন্ধিটাঙ্গাইল জেলাশনি (দেবতা)০ (সংখ্যা)আবদুল মোনেম লিমিটেডবাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিতক্ষকনোয়াখালী জেলাবাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধনীসমূহআল-আকসা মসজিদপুরুষে পুরুষে যৌনতামুসাফিরের নামাজনূর জাহান🡆 More