আল-আকসা মসজিদ: মুসলমানদের প্রথম কিবলা

আল–আকসা মসজিদ ( আরবি: ٱلْـمَـسْـجِـد الْاَقْـصَى, প্রতিবর্ণীকৃত: আল-মাসজিদ আল-আকসা), মসজিদুল আকসা বা বাইতুল মুকাদ্দাস হলো জেরুসালেমের পুরনো শহরে অবস্থিত ইসলামের ৩য় পবিত্রতম মসজিদ এবং এর সাথে একই প্রাঙ্গণে কুব্বাত আসসাখরা, কুব্বাত আসসিলসিলা ও কুব্বাত আন নবী নামক স্থাপনাগুলো অবস্থিত। স্থাপনাগুলো সহ এই পুরো স্থানটিকে হারাম আল শরিফ বলা হয়। এছাড়াও স্থানটি টেম্পল মাউন্ট বলে পরিচত এবং ইহুদি ধর্মে পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। ইসলামের বর্ণনা অনুযায়ী মুহাম্মদ (সা) মিরাজের রাতে মসজিদুল হারাম থেকে আল-আকসা মসজিদে এসেছিলেন এবং এখান থেকে তিনি ঊর্ধ্বাকাশের দিকে যাত্রা করেন। ইতিহাসবিদ পণ্ডিত ইবনে তাইমিয়ার মতে, আসলে সুলায়মান এর তৈরি সম্পূর্ণ উপাসনার স্থানটির নামই হল মসজিদুল আল-আকসা। মুহাদ্দিসগণ (হাদিস বিষয়ে পণ্ডিত) এই বিষয়ে একমত যে সম্পূর্ণ উপাসনার স্থানটিই ইসলামের নবী সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) তৈরি করেছিলেন যা পরবর্তীতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। মুসলমানরা বিশ্বাস করে, নির্মাণের পর থেকে এটি ঈসা (আঃ) (খ্রিস্টধর্মে যিশু) সহ অনেক নবীর দ্বারা এক আল্লাহকে উপাসনার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। এই স্থান মুসলিমদের প্রথম কিবলা (প্রার্থনার দিক)। হিজরতের পর কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণে কাবা নতুন কিবলা হয়। বর্তমানে আল-আকসা মসজিদ বলতে বোঝায় কিবলি মসজিদ, মারওয়ানি মসজিদ ও বুরাক মসজিদ (৩টির) এর সমন্বয়  যা হারাম আল শরীফ এর চার দেয়াল এর মধ্যেই অবস্থিত।

মসজিদ আল-আকসা

বাইতুল মুকাদ্দাস
আল-আকসা মসজিদ: নাম উৎপত্তি, ইতিহাস, স্থাপত্য
আল-আকসা মসজিদ জেরুসালেম-এ অবস্থিত
আল-আকসা মসজিদ
আল-আকসা মসজিদ
জেরুসালেমের পুরনো শহরে আল-আকসার অবস্থান।
স্থানাঙ্ক: ৩১°৪৬′৩৪″ উত্তর ৩৫°১৪′০৯″ পূর্ব / ৩১.৭৭৬১৭° উত্তর ৩৫.২৩৫৮৩° পূর্ব / 31.77617; 35.23583
অবস্থান জেরুসালেমের পুরনো শহর
প্রতিষ্ঠিত ৭০৫ সালে
শাখা/ঐতিহ্য ইসলাম
প্রশাসন জেরুসালেম ইসলামি ওয়াকফ
পরিচালনা
স্থাপত্য তথ্য
ধরন প্রাথমিক ইসলামি, মামলুক
ধারণক্ষমতা ৫,০০০+
দৈর্ঘ্য ২৭২ ফুট
প্রস্থ ১৮৪ ফুট
আবৃত স্থান ১,৪৪,০০০ বর্গমিটার (১৫,৫০,০০০ বর্গফুট)
গম্বুজ ২টি বৃহৎ + দশটি ছোট
মিনার
মিনারের উচ্চতা ৩৭ মিটার (১২১ ফু) (শীর্ষতম)
ভবনের উপকরণ চুনাপাথর (বাইরের দেয়াল, মিনার, বহির্ভাগ), স্বর্ণ, সীসা ও পাথর (গম্বুজ), সাদা মার্বেল (ভেতরের স্তম্ভ) এবং মোজাইক

খলিফা উমর বর্তমান মসজিদের স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের যুগে মসজিদটি পুনর্নির্মিত ও সম্প্রসারিত হয়। এই সংস্কার ৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে তার পুত্র খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের শাসনামলে শেষ হয়। ৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর এটি পুনর্নির্মাণ করেন। পরে তার উত্তরসুরি আল মাহদি এর পুনর্নির্মাণ করেন। ১০৩৩ খ্রিষ্টাব্দে আরেকটি ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফাতেমীয় খলিফা আলি আজ-জাহির পুনরায় মসজিদটি নির্মাণ করেন যা বর্তমান অবধি টিকে রয়েছে।

বিভিন্ন শাসকের সময় মসজিদটিতে অতিরিক্ত অংশ যোগ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে গম্বুজ, আঙ্গিনা, মিম্বর, মিহরাব, অভ্যন্তরীণ কাঠামো। ১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ক্রুসেডাররা জেরুসালেম দখল করার পর তারা মসজিদটিকে একটি প্রাসাদ এবং একই প্রাঙ্গণে অবস্থিত কুব্বাত আস সাখরাকে গির্জা হিসেবে ব্যবহার করত। সুলতান সালাহউদ্দিন জেরুসালেম পুনরায় জয় করার পর মসজিদ হিসেবে এর ব্যবহার পুনরায় শুরু হয়। আইয়ুবী, মামলুক, উসমানীয়, সুপ্রিম মুসলিম কাউন্সিল ও জর্ডানের তত্ত্বাবধানে এর নানাবিধ সংস্কার করা হয়। বর্তমানে পুরনো শহর ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তবে মসজিদটি জর্ডা‌নি/ফিলিস্তিনি নেতৃত্বাধীন ইসলামি ওয়াকফের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।

নাম উৎপত্তি

আল-আকসা মসজিদ: নাম উৎপত্তি, ইতিহাস, স্থাপত্য 
আল আকসার  কিবলি মসজিদ এবং কুব্বাত সুলাইমান (১৯০৭ সালে প্রকাশিত চিত্র)।

মসজিদুল আকসা অর্থ "দূরবর্তী মসজিদ"।  মিরাজের রাতে মুহাম্মদ (সা) বোরাকে চড়ে মক্কা থেকে এখানে এসেছিলেন মর্মে কুরআনে উল্লেখ রয়েছে। অনেক বছর ধরে মসজিদুল আকসা বলতে পুরো এলাকাকে বোঝানো হত এবং মসজিদকে আল-জামি আল-আকসা  বলা হত।

ইতিহাস

আল-আকসা মসজিদ: নাম উৎপত্তি, ইতিহাস, স্থাপত্য 
হারাম আল শরিফের " দক্ষিণ দেয়ালসহ " মসজিদটি । দেয়ালটি যেবুসিয়দের তৈরি ।যারা খ্রিষ্টের জন্মেরও ৩০০০ বছর পূর্বে ইসরাইলে বসবাস করতেন।
আল-আকসা মসজিদ: নাম উৎপত্তি, ইতিহাস, স্থাপত্য 
মুসলিম বিশ্বাস মতে "দক্ষিণ দেয়াল" এর নিকটেই কোথাও "বোরাককে" বেঁধে রেখে ছিলেন নবী (সাঃ)

নির্মাণপূর্ব যুগ

আল-আকসা মসজিদ: নাম উৎপত্তি, ইতিহাস, স্থাপত্য 
১৮৯০ সালে তৈরি "হারাম আস শরীফ" বা "আল-আকসার" নক্সা (ইহুদীখ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বিদের নিকট "টেম্পল মাউন্ট" নামে পরিচিত)। ইতিহাসবিদ পণ্ডিত ইবনে তাহমিয়া বলেছেন ," আসলে সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) এর তৈরি সম্পূর্ণ উপাসনার স্থানটির নামই হল মসজিদুল আল-আকসা"। মুহাদ্দিসগণ এই বিষয়ে একমত যে সম্পূর্ণ উপাসনার স্থানটিই ইসলামের নবী সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) তৈরি করেছিলেন যা পরবর্তীকালে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। [টীকাঃ আল আকসা মসজিদ স্থাপনাটির (মুসলমানদের নিকট পবিত্র স্থানটুকু ) অবস্থান সম্বন্ধে একটি প্রচলিত ভুল ধারণা রয়েছে ।সবচেয়ে প্রচলিত সোনালি গম্বুজওয়ালা স্থাপনাটি আসলে কুব্বাত আল  সাখরা (ডোম অব দ্যা রক)। ধূসর সীসার প্লেট দ্বারা আচ্ছাদিত গম্বুজওয়ালা স্থাপনাটি আসলে কিবলি মসজিদ। "আল-আকসা" মসজিদটি আসলে কিবলি মসজিদ , মারওয়ানি মসজিদ ও বুরাক মসজিদ ৩টির সমন্বয় যা "হারাম আল শরীফ" এর চার দেয়াল এর মধ্যেই অবস্থিত।]

ইসলামের নবী ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) (আব্রাহাম) জেরুসালেমেও একটি উপাসনার স্থান প্রতিষ্ঠা করছিলেন। কাবা নির্মাণের চল্লিশ বছর পর (খ্রিষ্টপূর্ব ২১৭০) তিনি এটিকে আরও সম্প্রসারণ করেন যা পরবর্তীকালে "বাইতুল মুকাদ্দাস" নামে পরিচিত হয়। মসজিদে হারামের তুলনায় দূরতম উপাসনার স্থান হওয়ায়, ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) এটিকে "মাসজিদুল আকসা’ বলেও উল্লেখ করতেন। তার পুত্র ইসহাক (আলাইহিস সালাম) ও এখানে ইবাদত করতেন তবে তিনিও তার পিতার মত কাবাতে হজ করতে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ইসহাক (আলাইহিস সালাম) এর দ্বিতীয় পুত্র  ইয়াকুব (আলাইহিস সালাম) এই অঞ্চলের এক আল্লাহতে বিশ্বাসীদের জন্য উপাসনার স্থান হিসাবে এটিকে বর্ধিত করেছিলেন। পরবর্তিতে সুলায়মান (আলাইহিস সালাম) এই উপাসনার স্থানটির স্থাপত্য (সেকেন্ড টেম্পল) তৈরি ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন (খ্রিষ্টপূর্ব ১০০৪) । মুসলমানরা বিশ্বাস করে এই কাজে তিনি  জ্বীনদেরকে নিয়োগ করেছিলেন। এবং আল্লাহ তায়ালা "গলিত তামার ঝরণা" প্রবাহিত করেছিলেন। এরপর ব্যবিলনের সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচ্যাডনেজার; সুলায়মান (আলাইহিস সালাম) এর তৈরি স্থাপত্যগুলি ধ্বংস করেন (খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৬)।

এই স্থান রাজা হেরোড দ্য গ্রেটের সময় (২০৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে) সম্প্রসারিত হয়। মসজিদটি একটি প্লাটফর্মের উপর অবস্থিত যা হেরোডের প্রকৌশলীরা বিভিন্ন স্থানগত অবস্থা কাটিয়ে উঠার জন্য নির্মাণ করেছিলেন। সেকেন্ড টেম্পলের সময় বর্তমান মসজিদের স্থানটিতে রয়েল স্টোয়া ( প্রশাসনিক ভবন) ছিল।  এরপর ৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমানরা এটিকে ধ্বংস করে (পুড়িয়েও ফেলেছিল), দেবতা জুপিটারের উপাসনার স্থানে পরিণত করেছিল। ৩১৫ খ্রিষ্টাব্দে  খ্রিষ্টানে রূপান্তরিত রোমান সম্রাজ্য এটিকে ময়লা ফেলার স্থানে পরিণত করে এবং এসময় ইহুদীরাও এটিকে তাদের পবিত্র স্থান বলে মনে করত না।

একসময় ধারণা করা হত যে সম্রাট জাস্টিনিয়ানের সময় নির্মিত নিয়া চার্চ বর্তমান মসজিদুল আকসার স্থানে অবস্থিত ছিল। তবে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ইহুদি মহল্লার দক্ষিণ অংশে এর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়।

১৯৩০ এর দশকে সংস্কারের সময় সরিয়ে নেয়া কাঠের বীম ও প্যানেল বিশ্লেষণে দেখা যায় যে এগুলো লেবাননের সিডার এবং সাইপ্রেস দ্বারা নির্মিত ছিল। রেডিওকার্ব‌ন ডেটিং পরীক্ষায় এর কিছু ৯ম শতাব্দীর বলে জানা গেছে।

উমাইয়া যুগের নির্মাণ

বর্তমান স্থাপনাটি উমাইয়া যুগের। দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব প্রথম এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। কয়েকজন মুসলিম পণ্ডিত যেমন মুজিরউদ্দিন আল-উলাইমি, জালালউদ্দিন সুয়ুতি ও শামসউদ্দিন আল-মুকাদ্দাসি বলেন যে খলিফা আবদুল মালিক ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদ পুনর্নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করেন। সেসাথে তিনি কুব্বাত আস সাখরা নির্মাণ করেন। আবদুল মালিক মসজিদের কেন্দ্রীয় অক্ষ প্রায় ৪০ মিটার (১৩০ ফু) পশ্চিমে সরিয়ে আনেন যা হারাম আল শরিফ নিয়ে তার সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ ছিল। পুরনো অক্ষ একটি মিহরাব দ্বারা চিহ্নিত করা হয় যা "উমরের মিহরাব" বলে পরিচিত। কুব্বাত আস সাখরার উপর গুরুত্ব দিয়ে আবদুল মালিক তার স্থপতিদের দ্বারা নতুন মসজিদকে সাখরার সাথে এক সারিতে আনেন।

অন্যদিকে ক্রিসওয়েলের মতে আবদুল মালিকের ছেলে প্রথম আল ওয়ালিদ মসজিদ পুনর্নির্মাণ করেন এবং দামেস্কের কর্মরা এতে কাজ করে। অধিকাংশ পণ্ডিতদের একমত যে মসজিদের পুনর্নির্মাণ আবদুল মালিকের সময় শুরু হয় এবং আল ওয়ালিদের সময় তা শেষ হয়। ৭১৩-১৪ খ্রিষ্টাব্দে কয়েকটি ভূমিকম্পে জেরুসালেমের ক্ষতি হয় এবং মসজিদের পূর্ব অংশ ধ্বংস হয়। এ কারণে আল-ওয়ালিদের শাসনামলে পুনর্নির্মাণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

ভূমিকম্প ও পুনর্নির্মাণ

৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদুল আকসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর চার বছর পর আস-সাফাহ উমাইয়াদের উৎখাত করে আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর ৭৫৩ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদ পুনর্নির্মাণের জন্য তার সংকল্প ব্যক্ত করেন এবং ৭৭১ খ্রিষ্টাব্দে তা সমাপ্ত হয়। ৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় একটি ভূমিকম্পের ফলে আল মনসুরের সংস্কারের সময়ের দক্ষিণ অংশ বাদে অনেক অংশ ধ্বংস হয়। ৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে তার উত্তরসুরি খলিফা আল-মাহদি এর পুনর্নির্মাণ করেন। তিনি দৈর্ঘ্য কমিয়ে প্রস্থ বৃদ্ধি করেন। আল-মাহদির সংস্কার এ বিষয়ে প্রথম লিখিত বিবরণ বলে জানা যায় যা কাজের বর্ণনা প্রদান করে। ৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে জেরুসালেমে জন্ম নেয়া আরব ভূগোলবিদ শামসউদ্দিন আল-মুকাদ্দাসি লিখেছেন যে এসময় মসজিদে পনেরটি দরজা ও মুসল্লিদের ধারণের জন্য উত্তর দক্ষিণ বরাবর পনেরটি  সারি ছিল।

১০৩৩ খ্রিষ্টাব্দে আরেকটি ভূমিকম্প হয় ফলে মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফাতেমীয় খলিফা আলি আজ-জাহির ১০৩৪ থেকে ১০৩৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মসজিদ পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করেন। এসময় মুসল্লিদের ধারণের জন্য পনেরটি মূল সারির সংখ্যা কমিয়ে সাতটি করা হয়। আজ-জাহির কেন্দ্রীয় কক্ষের চারটি তোরণ এবং করিডোর নির্মাণ করেন যা বর্তমানে মসজিদের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। পারস্যের ভূগোলবিদ নাসির খসরু ১০৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তার ভ্রমণের সময় মসজিদুল আকসার বর্ণনা দিয়েছেন:

"হারাম এলাকা জেরুসালেমের পূর্ব অংশে অবস্থিত; এবং (এই মহল্লার) বাজারের মধ্যে দিয়ে গিয়ে একটি বৃহৎ ও সুন্দর ফটক দিয়ে আপনি এই এলাকায় প্রবেশ করবেন... এই ফটক পার হওয়ার পর আপনি দুটি বৃহৎ স্তম্ভের সারির (রিওয়াক) ডানে থাকবেন যেগুলোর প্রত্যেকটিতে নয় ও বিশটি মার্বেল স্তম্ভ আছে, যেগুলোর শীর্ষ ও ভিত্তি রঙ্গিন মার্বেলের, এবং সংযুক্তিগুলো সীসার। স্তম্ভের শীর্ষে আর্চ উত্থিত যা চুন বা সিমেন্ট ছাড়া পাথরে নির্মিত, এবং প্রতিটি আর্চ পাঁচ বা ছয়টির বেশি পাথরের ব্লক দ্বারা তৈরী নয়। এই স্তম্ভসারিগুলো মাকসুরাহ নিয়ে যায়"।

১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ক্রুসেডের সময় ক্রুসেডাররা জেরুসালেম দখল করে নেয়। তারা মসজিদকে "সলোমনের মন্দির" এবং কুব্বাত আস সাখরাকে টেমপ্লাম ডোমিনি (ঈশ্বরের গম্বুজ) নাম দেয়। কুব্বাত আস সাখরা এসময় অগাস্টিনিয়ানদের তত্ত্বাবধানে গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়, আল-আকসা মসজিদকে রাজপ্রাসাদ ও পাশাপাশি ঘোড়ার আস্তাবল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ১১১৯ খ্রিষ্টাব্দে একে নাইটস টেম্পলারদের সদরদপ্তর করা হয়। এ সময় মসজিদে কিছু অবকাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়। এর মধ্যে ছিল উত্তরের বারান্দা সম্প্রসারণ, অতিরিক্ত এপস যোগ এবং একটি বিভক্তকারী দেয়াল নির্মাণ। কিছু স্থাপনার পাশাপাশি একটি নতুন মঠ ও গির্জা নির্মিত হয়। টেম্পলাররা দালানের পশ্চিম ও পূর্বে খিলানযুক্ত বর্ধি‌তাংশ নির্মাণ করে যার মধ্যে পশ্চিমেরটি বর্তমানে মহিলাদের নামাজের জায়গা এবং পূর্বেরটি ইসলামি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে আইয়ুবীয়রা জেরুসালেম জয় করার পর মসজিদুল আকসায় কয়েকটি সংস্কার সাধিত হয়। জুমার নামাজের জন্য মসজিদকে প্রস্তুতের নিমিত্তে জেরুসালেম জয়ের এক সপ্তাহের মধে ক্রুসেডারদের স্থাপন করা টয়লেট ও শস্যের গুদাম সরিয়ে ফেলা হয়।, মেঝে দামি কার্পেটে আচ্ছাদিত করা হয়, এবং ভেতরের অংশ গোলাপজল এবং সুগণ্ধি দিয়ে সুগণ্ধযুক্ত করা হয়। সালাহউদ্দিনের পূর্বসূরি জেনগি সুলতান নুরউদ্দিন জেনগি ১১৬৮-৬৯ খ্রিষ্টাব্দে হাতির দাঁত ও কাঠ দিয়ে একটি মিম্বর নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন যা তার মৃত্যুর পর নির্মাণ সমাপ্ত হয়। নুরউদ্দিনের মিম্বরটি সালাহউদ্দিন মসজিদে স্থাপন করেন। দামেস্কের আইয়ুবী সুলতান আল-মুয়াজ্জাম ১২১৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনটি ফটকসহ উত্তরের বারান্দা নির্মাণ করেন। ১৩৪৫ খ্রিষ্টাব্দে আল-কামিল শামানের অধীনে মামলুকরা পূর্ব দিকে আরো দুটি সারি ও ফটক যুক্ত করে।

উসমানীয়রা ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দে ক্ষমতা নেয়ার পর মসজিদের কোনো বড় পরিবর্তন করেনি কিন্তু পুরো হারাম আল শরিফে সামগ্রিকভাবে পরিবর্তন আনা হয়। এসময় কাসিম পাশার ফোয়ারা (১৫২৭) নির্মিত হয়, রারাঞ্জ সেতু সংস্কার এবং তিনটি মুক্ত গম্বুজ নির্মিত হয়। এসকল স্থাপনা জেরুসালেম গভর্নরগণ নির্মাণ করিয়েছিলেন। সুলতানগণ মিনারের সম্প্রসারণ করেন। ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে গভর্নর সুলাইমান পাশা আল-আদিল জীর্ণ অবস্থার কারণে মসজিদ সংস্কার করেন।

আধুনিক যুগ

মসজিদটির ভেতরের কিছু দুষ্প্রাপ্য দৃশ্য

১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে বিশ শতকের প্রথম সংস্কার সাধিত হয়। এসময় জেরুসালেমের গ্র্যান্ড মুফতি মুহাম্মদ আমিন আল-হুসাইনির অধীন সুপ্রিম মুসলিম কাউন্সিল তুর্কি স্থপতি মিমার কামালউদ্দিন বেকে মসজিদুল আকসা ও এর পরিপার্শ্বের স্থাপনাগুলো সংস্কারের জন্য দায়িত্ব দেয়। এছাড়াও কাউন্সিল ব্রিটিশ স্থপতি, মিশরীয় প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয় কর্মকর্তাদের সংস্কারে অবদান ও তদারকির দায়িত্ব দিয়েছিল। এই সংস্কারের মধ্যে ছিল মসজিদের প্রাচীন উমাইয়া ভিত্তি মজবুত করা, ভেতরের কলাম মজবুত করা, নতুন বীম যুক্তকরণ, একটি মঞ্চ নির্মাণ, আর্চ এবং মূল গম্বুজের ভেতরের অংশ সংরক্ষণ, দক্ষিণ দেয়াল পুনর্নির্মাণ এবং কেন্দ্রীয় সারির কাঠগুলো কংক্রিটের স্ল্যাব দ্বারা প্রতিস্থাপন। এসময় প্লাস্টারে ঢাকা পড়ে যাওয়া ফাতেমীয় আমলের মোজাইক ও খোদিত লিপি ফিরিয়ে আনা হয়। আর্চগুলো স্বর্ণ এবং সবুজ ছোপযুক্ত জিপসাম দ্বারা সৌন্দর্যমন্ডিত করা হয় এবং কাঠের বীমগুলো পিতল দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়। কিছু স্টেইন্ড গ্লাসের জানালা তাদের আব্বাসীয়ফাতেমীয় নকশা অপরিবর্তিত রেখে নতুন করা হয়। ১৯২৭ ও ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ভূমিকম্পে মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তবে ১৯৩৮ ও ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তা সারিয়ে তোলা হয়।

১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২১ আগস্ট অস্ট্রেলীয় পর্যটক ডেনিস মাইকেল রোহান কর্তৃক মসজিদে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। রোহান ওয়ার্ল্ডওয়াইড চার্চ অফ গড নামক এভাঞ্জেলিকাল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। তার ধারণা ছিল যে মসজিদুল আকসা পুড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে তিনি যীশুর দ্বিতীয় আগমনকে ত্বরান্বিত করতে পারবেন এবং ইহুদি মন্দির তৈরীর পথ করতে পারবেন। রোহানকে এরপর একটি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সেই বছর রাবাতে মুসলিম দেশগুলোর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশাহ ফাহাদ বিন আবদুল আজিজ এর উদ্যোক্তা ছিলেন। এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ওআইসি গঠনের ক্ষেত্রে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে।

আল-আকসা মসজিদ: নাম উৎপত্তি, ইতিহাস, স্থাপত্য 
মসজিদটি হারাম আস-শরিফের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত

১৯৮০ এর দশকে গুশ এমুনিম আন্ডারগ্রাউন্ড নামক সংগঠনের সদস্য বেন শোশান ও ইয়েহুদা এতজায়ন আল-আকসা মসজিদ ও কুব্বাত আস সাখরা উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। এতজায়ন বিশ্বাস করতেন যে স্থাপনা দুটি উড়িয়ে দিলে তা ইসরায়েলের আধ্যাত্বিক জাগরনে ভূমিকা রাখবে এবং ইহুদি জনগণের সকল সমস্যা সমাধান করবে। তারা এও ধারণা করতেন যে তৃতীয় মন্দির মসজিদের স্থানে নির্মিত হতে হবে। প্রথম ইন্তিফাদা চলার সময় ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি ইসরায়েলি সেনারা মসজিদের বাইরে বিক্ষোভকারীদের উপর রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস ছোড়ে এবং এতে ৪০ জন মুসল্লি আহত হয়। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ অক্টোবর দাঙ্গায় ইসরায়েলি সীমান্ত পুলিশ কর্তৃক ২২ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও ১০০ জনের বেশি আহত হয়। টেম্পল মাউন্ট ফেইথফুল নামক ইহুদি ধর্মীয় গোষ্ঠী তৃতীয় মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করতে যাচ্ছে ঘোষণা করলে এই প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল।

২০০০ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা এরিয়েল শ্যারন এবং লিকুদ পার্টির সদসরা ১০০০ সশস্ত্র রক্ষীসহ আল-আকসা চত্বর পরিদর্শন করেন। ব্যাপক সংখ্যক ফিলিস্তিনি এর প্রতিবাদ করে। শ্যারন ও লিকুদ পার্টির সদস্যরা স্থানত্যাগ করার পর হারাম আল শরিফের প্রাঙ্গণে ইসরায়েলি দাঙ্গা পুলিশের উপর পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে বিক্ষোভ শুরু হয়। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও রাবার ছুড়লে ২৪ জন আহত হয়। এই পরিদর্শনের ফলে পাঁচ বছরব্যপী আন্দোলন চলে সাধারণভাবে আল-আকসা ইন্তিফাদা নামে পরিচিত। তবে কিছু ধারাভাষ্যকার ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা, যেমন ইমাদ ফালুজি ও আরাফাতের উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করেন যে ইন্তিফাদা কয়েক মাস আগে ইয়াসির আরাফাতের ক্যাম্প ডেভিড আলোচনা থেকে ফেরার পর থেকে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ২৯ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি সরকার মসজিদে ২,০০০ দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করে। জুমার নামাজের পর একদল ফিলিস্তিনি মসজিদ ত্যাগ করার পর তারা পুলিশের উপর পাথর নিক্ষেপ করে। পুলিশ এরপর মসজিদ চত্বরে প্রবেশ করে গুলি ও রাবার বুলেট ছোড়া শুরু করে ফলে চারজন নিহত ও প্রায় ২০০ জন আহত হয়।

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর ইসরায়েলি পুলিশ ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে জেরুসালেম দখল করার পর প্রথমবার আল-আকসায় প্রবেশ করে বলে ইসলামিক ওয়াকফের পরিচালক শাইখ আজ্জাম আল-খতিব উল্লেখ করেছেন। পূর্ববর্তী মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয় এ পুলিশ হারাম আল শরিফ চত্বরে প্রবেশ করেছে, মসজিদে নয়।

স্থাপত্য

আল-আকসা মসজিদ: নাম উৎপত্তি, ইতিহাস, স্থাপত্য 
কুব্বাত আস সাখরা। এটি ইসলামী স্থাপত্যের সর্বপ্রাচীন নমুনা। মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে ইব্রাহিম আঃ) এখানেই তার পুত্র ইসমাইল আঃ) কে কুরবানি দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। আদম (আলাইহিস সালাম) কে সৃষ্টিরও ২০০০ বছর পূর্বে ফেরেশতারা এই জায়গায় এসেছিলেন এবং ইসরাফিল (আলাইহিস সালাম) কেয়ামতের সময় এখানেই শিঙ্গায় ফুঁ দেবেন। এখানে অবস্থিত সাখরা নামক পাথরের কারণে স্থানটি ধর্মীয় দিক দিয়ে গুরুত্ববহ। ইহুদি প্রথা অনুযায়ী এটি বেহেশতপৃথিবীর মধ্যকার আধ্যাত্মিক সংযোগ।

আয়াতাকার আল-আকসা মসজিদ ও এর পরিপার্শ্ব মিলিয়ে আকার ১,৪৪,০০০ বর্গমিটার (১৫,৫০,০০০ ফু), তবে শুধু মসজিদের আকার প্রায় ৩৫,০০০ বর্গমিটার (৩,৮০,০০০ ফু) এবং ৫,০০০ মুসল্লি ধারণ করতে পারে। মসজিদ ৮৩ মি (২৭২ ফু) দীর্ঘ, ৫৬ মি (১৮৪ ফু) প্রশস্ত সম্মুখবর্তী কুব্বাত আস সাখরায় ধ্রুপদি বাইজেন্টাইন স্থাপত্য দেখা গেলেও মসজিদুল আকসায় প্রথম দিককার ইসলামি স্থাপত্য দেখা যায়।

গম্বুজ

আবদুল মালিকের নির্মিত গম্বুজ বর্তমানে নেই। বর্তমান গম্বুজটি আজ-জাহির নির্মাণ করেছিলেন এবং এটি সীসার এনামেলওয়ার্ক আচ্ছাদিত কাঠ দ্বারা নির্মিত। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে কংক্রিটে গম্বুজ পুনর্গঠিত হয় এবং সীসার এনামেলওয়ার্কের পরিবর্তে এনোডাইজড অ্যালুমিনিয়াম দ্বারা আচ্ছাদিত হয়। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে আজ-জাহিরের সময়কারমূল নকশা ফিরিয়ে আনার জন্য এলুমিনিয়ামের কভারের বদলে পুনরায় সীসা স্থাপন করা হয়।

উমাইয়া ও আব্বাসীয় আমলে মিহরাবের সম্মুখে নির্মিত গম্বুজগুলোর মধ্যে টিকে রয়েছে এমন কয়েকটি গম্বুজের মধ্যে আল-আকসার গম্বুজ অন্যতম। অন্যগুলো হল দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ (৭১৫) এবং সুসার জামে মসজিদ (৮৫০)। গম্বুজের ভেতরে ১৪শ শতাব্দীর অলংকরণ রয়েছে। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের অগ্নিকাণ্ডের সময় এসকল অলংকরণ চিরতরে হারিয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়েছিল কিন্তু ট্রাটেজিও প্রক্রিয়ায় তা ফিরিয়ে আনা হয়।

মিনার

আল-আকসা মসজিদ: নাম উৎপত্তি, ইতিহাস, স্থাপত্য 
১২৭৮ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত আল-ফাখারিয়া মিনার আল-আকসা মসজিদের চারটি মিনারের মধ্যে প্রথম নির্মিত হয়।

দক্ষিণ, উত্তর ও পশ্চিম পাশে মোট চারটি মিনার রয়েছে। প্রথম মিনারটি আল-ফাখারিয়া মিনার নামে পরিচিত যা ১২৭৮ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণপশ্চিম অংশে নির্মিত হয়। মামলুক সুলতান লাজিন এটি নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন। এটি নির্মাণের তত্ত্বাবধায়ক আল-দিন আবদুর রহমানের বাবা ফখরউদ্দিন আল-খলিলির নামে নামকরণ করা হয়েছে। প্রথাগত সিরিয়ান শৈলীতে এটি নির্মিত হয়। এর ভিত্তি ও উলম্ব অংশ বর্গাকার এবং এটি তিনতলা বিশিষ্ট। মুয়াজ্জিনের বারান্দা দুই লাইন বিশিষ্ট মুকারনাস দ্বারা অলঙ্কৃত করা হয়েছে। কুলুংগি ঘিরে রয়েছে একটি বর্গাকার অংশ যা একটি সিসা আচ্ছাদিত পাথরের গম্বুজে শেষ হয়।

আল-আকসা মসজিদ: নাম উৎপত্তি, ইতিহাস, স্থাপত্য 
আল-আকসার, কিবলি মসজিদের অভ্যন্তর ভাগ ।
আল আকসার অন্তরীক্ষ দৃশ্য।

দ্বিতীয়টি গাওয়ানিমা মিনার বলে পরিচিত। এটি ১২৯৭-৯৮ খ্রিষ্টাব্দে স্থপতি কাজি শরফউদ্দিন আল-খলিলি কর্তৃক নির্মিত হয়। এটিও সুলতান লাজিনের আদেশে নির্মিত হয়েছিল। এটি ছয় তলা উচু এবং হারাম আল শরিফ প্রাঙ্গণের সর্বো‌চ্চ মিনার। এই দুটি টাওয়ার সম্পূর্ণভাবে পাথরের তৈরি, শুধু মুয়াজ্জিনের বারান্দার শামিয়ানা কাঠের তৈরি। শক্ত কাঠামোর কারণে গাওয়ানিমা মিনার ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। মিনারটি পাথরের ছাচ ও গ্যালারির মাধ্যমে কয়েকটি তলায় বিভক্ত। প্রথম দুই তলা প্রশস্ত এবং টাওয়ার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। পরের চারটি তলা সিলিন্ডার আকৃতির ড্রাম এবং কন্দ আকৃতির গম্বুজ নিয়ে গঠিত। প্রথম দুই তলায় সিড়ি বাইরে অবস্থিত। কিন্তু তৃতীয় তলা থেকে মুয়াজ্জিনের বারান্দা পর্যন্ত সিড়ি মিনারের ভেতরে পেচানোভাবে অবস্থিত।

১৩২৯ খ্রিষ্টাব্দে সিরিয়ার মামলুক গভর্নর তানকিজ তৃতীয় মিনার নির্মাণের আদেশ দেন যা বাব আল-সিলসিলা নামে পরিচিত। এটি মসজিদের পশ্চিমে অবস্থিত। এই মিনার ঐতিহ্যবাহী সিরিয়ান বর্গাকার টাওয়ার রীতিতে নির্মিত এবং সম্পূর্ণ পাথর দ্বারা তৈরি।

সর্বশেষ মিনারটি ১৩৬৭ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়। এটি মিনারাত আল-আসবাত নামে পরিচিত। এটি সিলিন্ডার আকৃতির পাথরের উত্থিত অংশ দ্বারা গঠিত যা পরবর্তী কালের উসমানীয় সুলতানরা নির্মাণ করেছিলেন। এটি মামলুক নির্মিত বর্গাকার ভিত্তির উপর ত্রিকোণাকার রূপান্তরের অংশ থেকে উঠেছে। মুয়াজ্জিনের বারান্দায় উত্থিত অংশ সরু হয়ে যায় এবং এটি বৃত্তাকার জানালা যুক্ত যার শেষপ্রান্তে কন্দ আকৃতির গম্বুজ রয়েছে। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পের পর গম্বুজটি পুনর্নির্মাণ করা হয়।

মসজিদের পূর্ব পাশে কোনো মিনার নেই। তবে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ পঞ্চম মিনার নির্মাণের ইচ্ছা ঘোষণা করেন যা জাবাল আজ-জয়তুনের দিকে থাকবে। এই মিনার জেরুসালেমের পুরনো শহরের সবচেয়ে সুউচ্চ বলে পরিকল্পিত।

বহির্ভাগ ও বারান্দা

১০৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ফাতেমীয় খলিফা আল-মুসতানসির নির্মাণ করেন। ক্রুসেডাররা তাদের শাসনামলে এর ক্ষতিসাধন করে। পরে আইয়ুবীরা এর সংস্কার করে। এই অংশে টাইলস দ্বারা আবৃত করা হয়। জেরুসালেমের ক্রুসেডার অবকাঠামো থেকে বহির্ভাগের আর্চের জন্য উপকরণ সংগ্রহ করা হয় বহির্ভাগের পাথরের আর্চগুলো বেশিরভাগ রোমানেস্ক স্থাপত্য শৈলীর। মামলুকদের নির্মিত বাইরের আর্চ একইপ্রকার সাধারণ নকশা অণুসরণ করে। কেন্দ্রীয় আর্চে মসজিদের প্রবেশপথ অবস্থিত।

প্রথম ক্রুসেডের সময় নাইটস টেম্পলাররা বারান্দার কেন্দ্রীয় অংশ নির্মাণ করে। পরে সালাহউদ্দিনের ভাইপো আল-মুয়াজ্জাম ১২১৭ খ্রিষ্টাব্দে বারান্দা নির্মাণের আদেশ দেন।

আল-আকসা মসজিদ: নাম উৎপত্তি, ইতিহাস, স্থাপত্য 
মসজিদের ভেতরের দৃশ্য, এতে স্তম্ভসহ কেন্দ্রীয় সারিটি দেখা যাচ্ছে।

অভ্যন্তরভাগ

আল-আকসা মসজিদে সাতটি হাইপোস্টাইল অংশ রয়েছে এবং এর সাথে মসজিদের দক্ষিণ অংশের পূর্ব ও পশ্চিমে ছোট অংশ রয়েছে। আব্বাসীয়ফাতেমীয় আমলের ১২১টি স্টেইনড গ্লাসের জানালা রয়েছে। এগুলোর এক চতুর্থাংশ ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কার করা হয়।

মসজিদের অভ্যন্তরভাগে ৪৫টি স্তম্ভ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৩৩টি সাদা মার্বেল এবং ১২টি পাথরের তৈরি। স্তম্ভের শীর্ষ চার প্রকারের: কেন্দ্রীয়গুলো ভারি এবং পুরনো শৈলীর। গম্বুজের নিচেরগুলো করিন্থিয়ান ধাচের এবং ইতালীয় সাদা মার্বেলে তৈরি। পূর্বের শীর্ষ ভারি ঝুড়ি আকৃতির এবং পূর্ব ও পশ্চিমেরগুলোও ঝুড়ি আকৃতির। স্তম্ভ এবং জোড়গুলো কাঠের বীম দ্বারা যুক্ত।

মসজিদের একটি বড় অংশ চুনকাম করা। কিন্তু গম্বুজের ড্রাম এবং এর নিচের দেয়াল মোজাইক ও মার্বেল সজ্জিত। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর ইতালীয় শিল্পী কর্তৃক কিছু রঙ্গিন কাজ পুনরুদ্ধার করা হয়। মিশরের বাদশাহ ফারুক সিলিঙের রঙের জন্য অর্থ প্রদান করেছিলেন।

জেনগি সুলতান নুরউদ্দিন জেনগি আলেপ্পোর কারিগর আখতারিনিকে মিম্বর নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন। ক্রুসেডারদের হাত থেকে জেরুসালেম উদ্ধার করার পর এই মিম্বর মসজিদে উপহার হিসেবে দেয়ার কথা ছিল। এটি নির্মাণে ছয় বছর লাগে (১১৬৮-৭৪)। নুরউদ্দিন জেরুসালেম জয় করার আগে মারা যান। ১১৮৭ খ্রিষ্টাব্দে সালাহউদ্দিন জেরুসালেম জয় করেন এবং মিম্বরটি মসজিদে স্থাপন করেন। এর কাঠামো হাতির দাঁত এবং সুন্দরভাবে কাটা কাঠ দিয়ে গঠন করা হয়েছিল। আরবি ক্যালিগ্রাফি, জ্যামিতিক ও ফুলের নকশা এর কাঠের উপর খোদিত হয়। ডেনিস মাইকেল রোহান এটি ধ্বংস করার পর এর স্থলে অন্য মিম্বর বসানো হয়। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে ইসলামি ওয়াকফের প্রধান আদনান আল-হুসাইনি বলেন যে একটি নতুন মিম্বর স্থাপন করা হবে; ফেব্রুয়ারিতে এই মিম্বর স্থাপন করা হয়। সালাহউদ্দিনের মিম্বরের নকশার ভিত্তিতে জামিল বাদরান এটি নির্মাণ করেন। এটি জর্ডানে নির্মিত হয় এবং কারিগররা প্রাচীন কাঠখোদাই প্রক্রিয়ায় কাজ করেছেন। এটি যুক্ত করার পেরেকের বদলে কীলক ব্যবহার করা হয়। তবে নকশা করার কাজে কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়েছিল।

অজুর স্থান

মসজিদের প্রধান অজুর স্থান আল-কাস (কাপ) নামে পরিচিত। এটি মসজিদের উত্তরে মসজিদ ও কুব্বাত আস সাখরার মধ্যে অবস্থিত। মুসল্লিরা এখানে অজু করেন। ৭০৯ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়ারা এটি নির্মাণ করে। কিন্তু ১৩২৭-২৮ খ্রিষ্টাব্দে গভর্নর তানকিজ এটি আরো বড় করেন। একসময় এর জন্য পানি বেথলেহেমের কাছে সুলাইমানের সেতু থেকে সরবরাহ করা হলেও বর্তমানে জেরুসালেমের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে পানি সরবরাহ করা হয়। ২০শ শতাব্দীতে আল-কাসে কল ও পাথরের তৈরি বসার স্থান স্থাপন করা হয়।

কাসিম পাশার ফোয়ারা ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দে উসমানীয় আমলে নির্মিত হয়। এটি মসজিদের উত্তরে কুব্বাত আস সাখরার প্লাটফর্মে অবস্থিত। এটি মুসল্লিদের অজু ও খাবার পানি সরবরাহ করত। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এর ব্যবহার ছিল। বর্তমানে এটি স্মৃতিমূলক স্থাপনা হিসেবে রয়েছে।

ইসলামে ধর্মীয় গুরুত্ব

আল-আকসা মসজিদ: নাম উৎপত্তি, ইতিহাস, স্থাপত্য 
কুব্বাত জিব্রাইল। জালালউদ্দিন সয়ূতি (রহঃ) এর মতে , মেরাজের রাত্রে ঊর্ধ্বাকাশে গমনের পূর্বে এই নির্দিষ্ট স্থানেই  নবী (সাঃ) নবিগণ ও ফেরেস্তাদের সাথে নামাজ পড়েছিলেন ।

জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলূল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন, যখন কুরাইশরা আমাকে অস্বীকার করল, তখন আমি কা‘বার হিজর অংশে দাঁড়ালাম। আল্লাহ্ তা‘আলা তখন আমার সামনে বায়তুল মুকাদ্দাসকে তুলে ধরলেন, যার  কারণে আমি দেখে দেখে বাইতুল মুকাদ্দাসের নিদর্শনগুলো তাদের কাছে ব্যক্ত করছিলাম।

সহীহ বুখারী:খণ্ড ৫, বই ৫৮ ,হাদিস নংঃ ২২৬

আল-আকসা মসজিদ: নাম উৎপত্তি, ইতিহাস, স্থাপত্য 
১৯০৭ সালে প্রকাশিত, বাব আল সিলসিলা সহ আল আকসা মসজিদের একাংশ।
আল-আকসা মসজিদ: নাম উৎপত্তি, ইতিহাস, স্থাপত্য 
কুব্বাত আল মিরাজ। মুসলমানরা বিশ্বাস করে মিরাজ এর রাত্রে এই নির্দিষ্ট স্থানটি থেকেই নবী (সাঃ ) ঊর্ধ্বাকাশে গমন করেছিলেন ।

ইসলামে আল-আকসা মসজিদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিশ্বাস করে যে ,এটি পৃথিবীতে নির্মিত দ্বিতীয় মসজিদ যা মসজিদুল হারামের পরে নির্মিত হয়। কুরআনে মিরাজের ঘটনা উল্লেখ করার সময় এই স্থানের নাম নেয়া হয়েছে।রাশিদুন খিলাফত এর পরেও ইসলামি পণ্ডিতরা একে ঐতিহ্যগতভাবে "আল-ইসরা " বলে উল্লেখ করত (যেহেতু সূরা বনী ইসরাঈল (রাত্রির যাত্রা) এ এটিকে উল্লেখ করা হয়েছে) । এই সুনির্দিষ্ট আয়াতটি  ইসলামে "আল-আকসা" এর গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছে । এই আয়াতটিতে বলা হয়েছে " পবিত্র ও মহিমময় তিনি  যিনি তাঁর বান্দাকে রাতারাতি  ভ্রমণ করিয়েছেন (মক্কার) মাসজিদুল হারাম হতে (ফিলিস্তীনের) মাসজিদুল আকসায় "।   এই আয়াতটির অনুবাদ ও ব্যাখ্যায় প্রায় সব পণ্ডিতই সুনির্দিষ্টভাবে "আল-আকসা" ও "মসজিদ আল-হারাম" উল্লেখ করেছেন  এবং বর্ণিত "আল- আকসা" টি যে "জেরুসালেমে " অবস্থিত "আল-আকসা" টিই তা নিশ্চিত করেছেন (ড. মুজিবুর রহমান ,মহসিন খান,আব্দুল হামিদ ফাইজী ও অধ্যাপক মোজাম্মেল হকের বঙ্গানুবাদেও তাই )।

আরবি (  إِسْراءٌ ) শব্দের অর্থ হল , "রাতে নিয়ে যাওয়া "। পরে ( لَيْلًا ) শব্দটি উল্লেখ করে রাতের অল্প একটি সময়ের কথা বোঝানো হয়েছে যার জন্য  ( لَيْلًا ) (অনির্দিষ্ট) ব্যবহার করা হয়েছে (রাতের এক অংশে অথবা সামান্য অংশে )। দূরত্বকে বলা হয় ( أَقْصَى)।   ‘আল-বাইতুল মুকাদ্দাস’ বা ‘বাইতুল মাকদিস’ ফিলিস্তীন এর কদস অথবা জেরুসালেম বা (পুরাতন নাম) ঈলীয়া শহরে অবস্থিত।  এবং সে সময়ের বাহনে মক্কা থেকে ক্বুদ্‌স শহরে যেতে ৪০ দিন লাগত সেকারণে  ‘মাসজিদুল আকসা’ (দূরতম মসজিদ) বলা হয়েছে। মুফাসসিরগন এই  আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে , এটি ছিল বনি ইসরাইলের দাওয়াততাবলিগের জায়গা এবং নামাযের কেবলা, যা মুসলমানদের কাছেও সম্মানিত ও পবিত্র ।

অন্যান্য মুসলমান পণ্ডিতরা হারাম আস শরীফ এর কার্যক্রম বিস্তারিত জানার জন্য তোরাহ্ (আরবিতে তাওরাত বলা হয় ) ব্যবহার করেছিলেন।

ইসরা ও মিরাজ

'ইসরা' শব্দের অভিধানিক অর্থ হল "রাতে ভ্রমণ"। মেরাজ শব্দটি আরবি ভাষার "উরুজ ধাতু" হতে এসেছে , যার অর্থ উন্নতি বা ঊর্ধ্বে উঠা।ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত সফরকে 'ইসরা' এবং মসজিদুল আকসা হতে আরশে আজিমে (ঊর্ধ্বাকাশ) সফরকে মিরাজ বলা হয়।যে রাতে ইসলামের নবী মুহাম্মদের (সা.) ঐশ্বরিক উপায়ে ঊর্ধ্বাকাশে আরোহণ করেছিলেন এবং স্রষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করেন সেই রাতই হল শবে মেরাজ ।ইসলামে মিরাজের বিশেষ গুরুত্ব আছে, কেননা এই মিরাজের মাধ্যমেই ইসলাম ধর্মের পঞ্চস্তম্ভের দ্বিতীয় স্তম্ভ অর্থাৎ নামাজ মুসলমানদের জন্য অত্যাবশ্যক; অর্থাৎ (ফরজ) নির্ধারণ করা হয় এবং দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান নির্দিষ্ট করা হয়।

কুরআন ও ইসলামি বিবরণ অনুযায়ী আল-আকসা মসজিদে মুহাম্মদ (সা) মিরাজের রাতে ,বিদ্যুৎ ও আলোর চেয়ে দ্রুতগামী বাহন বোরাকে চড়ে এসেছিলেন। মিরাজ শেষে নবী (সাঃ) প্রথম বাইতুল মুক্কাদ্দিসে অবতরণ করেন। সেখান থেকে বোরাকে করে প্রভাতের পূর্বেই মক্কায় পৌঁছেন।

ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী নবী (সাঃ) এর নবুওয়াত প্রকাশের একাদশ বৎসরের (৬২০ খ্রিষ্টাব্দ) রজব মাসের ২৬ তারিখের দিবাগত রাতে  প্রথমে কাবা শরিফ থেকে জেরুসালেমে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসায় গমন করেন । তিনি এখানে নামাজ পড়েন এবং তার পেছনে অন্যান্য নবী রাসুলগণ নামাজ আদায় করেন।      

অতঃপর তিনি বোরাকে (বিশেষ বাহন) আসীন হয়ে ঊর্ধ্বলোকে গমন করেন।  ঊর্ধ্বাকাশে সিদরাতুল মুনতাহায় তিনি আল্লাহ'র সাক্ষাৎ লাভ করেন। ফেরেশতা জিব্রাইল পুরো যাত্রায় তার সাথে ছিলেন। কুরআন শরিফের সূরা বনী ইসরাঈল এর প্রথম আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ।

অধিকাংশ মুসলমান মনে করেন যে , সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল । সূরা বনী ইসরাঈল এর প্রথম আয়তটিতে 'সোবহান' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী ভাষায় বিস্ময়কর সংবাদের ক্ষেত্রে 'সোবহান' শব্দ ব্যবহৃত হয়। এখানে 'আবদ' (বান্দা) শব্দটি দ্বারা "আত্মা ও দেহ" বোঝানো হয়েছে , শুধু আত্মাকে নয়।

প্রথম কিবলা

আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত: আমি বললাম, "হে আল্লাহর রাসূল! পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কোন মাসজিদ তৈরী করা হয়েছে? তিনি বললেন, মসজিদে হারাম। আমি বললাম, অতঃপর কোনটি? তিনি বললেন, মসজিদে আকসা। আমি বললাম, উভয় মসজিদের (তৈরীর) মাঝে কত ব্যবধান ছিল? তিনি বললেন, চল্লিশ বছর। অতঃপর তোমার যেখানেই সালাতের সময় হবে, সেখানেই সালাত আদায় করে নিবে। কেননা এর মধ্যে ফযীলত নিহিত রয়েছে।"

সহীহ বুখারী:খণ্ড ৮, বই ৫৫ ,হাদিস নংঃ ৫৮৫

ইসলামে আল-আকসা মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। প্রথম দিকে মুসলমানরা এই স্থানকে কিবলা (দিক) হিসেবে ব্যবহার করত।হিজরতের পরে কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হওয়ায় এর পরিবর্তে কাবা নতুন কিবলা হয়। মসজিদ আল কিবলাতাইনে নামাজের সময় এই আয়াত নাজিল হয়। এরপর থেকে কাবা কিবলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রথম দিকের মুফাসসিরদের (কুরআনের ব্যাখ্যাকারী) মতে , ৬৩৮ সালে জেরুসালেম বিজয়ের পর উমর ( রাঃ ) প্রবেশের সময় কাব আল আহবারের থেকে পরামর্শ নিয়েছিলেন (মসজিদ তৈরির জন্য সবচেয়ে উত্তম জায়গা কোনটি হতে পারে ?)। তিনি ছিলেন একজন ইহুদী থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত  ব্যক্তি  যিনি মদিনা থেকে তার সাথে এসেছিলেন । তিনি পরামর্শ   দিয়েছিলেন যে এটি  কুব্বাত আস-সাখরার (ডোম অব দ্য রক) পেছনে হওয়া উচিত "...... এর ফলে গোটা জেরুসালেম আপনার সামনে থাকবে "। উমর  প্রত্যুত্তর দিলেন , " তোমার মত ইহুদীবাদের সাথে মিলে গেছে  !" । এই কথোপকথনের পরপরই  উমর একটি স্থান পরিষ্কার করতে শুরু করলেন । যেটি আবর্জনা ও রাবিশে পরিপূর্ণ ছিল । তিনি তার জোব্বাটি ব্যবহার করলেন এবং অন্য সাহাবারা তাকে অনুকরণ করল যতক্ষণ না জায়গাটি পরিষ্কার হয়েছিল । উমর এরপর সেই স্থানে নামাজ পড়লেন যেখানে নবী (সাঃ) মেরাজের পূর্বে নামাজ পড়েছিলেন বলে মুসলমানরা বিশ্বাস করে থাকে । বর্ণনা অনুসারে উমর সেই স্থানটিকে মসজিদ হিসেবে পুনঃনির্মাণ করেছিলেন । যেহেতু দাউদ (আলাইহিস সালাম) ও সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) এর প্রার্থনার স্থান হিসেবে পূর্ব থেকেই এটি একটি পবিত্র উপাসনার স্থান ,তাই উমর স্থাপনাটির দক্ষিণস্থ কোনে এটি নির্মাণ করেন। যাতে কুব্বাত আস-সাখরা (ডোম অব দ্য রক ) মসজিদটি  ও ক্বাবার মধ্যস্থানে না পড়ে যায় এবং মুসলমানরা নামাজের সময় একমাত্র মক্কার দিকেই মুখ করতে পারে ।

আল-আকসা মসজিদ: নাম উৎপত্তি, ইতিহাস, স্থাপত্য 
আল আকসা মসজিদের বুরাক মসজিদ। হারাম আস শরীফের দক্ষিণ-পশ্চিমস্থ কোনে এই ছোট স্থাপনাটি অবস্থিত। ইসলামের বর্ণনা অনুযায়ী মুহাম্মদ (সা) ঊর্ধ্বাকাশের দিকে যাত্রার পূর্বে এখানেই বোরাককে বেঁধে রেখেছিলেন। ডান পাশের দেয়ালটি হল পশ্চিম দেয়ালের বিপরীত পার্শ্ব।

ধর্মীয় মর্যাদা

জেরুসালেম ইসলামে অন্যতম পবিত্র স্থান। কুরআনের অনেক আয়াতই জেরুসালেমকে নির্দেশ করেছে যার কথা একদম শুরুর দিকের ইসলামি পণ্ডিতরাও বলেছেন । "জেরুসালেম " এর কথা হাদিসেও অনেকবার উল্লেখ করা হয়েছে ।এখানে অবস্থিত মসজিদুল আকসা ইসলামে তৃতীয় সম্মানিত মসজিদ ; এবং একথা মধ্যযুগের অনেক লিপিতেও উল্লেখ করা হয়েছে । নবী (সাঃ) বলেছেন "একজন লোক ঘরে নামাজ পড়লে একটি নেকি পান, তিনি ওয়াক্তিয়া মসজিদে পড়লে ২৫ গুণ, জুমা মসজিদে পড়লে ৫০০ গুণ, মসজিদে আকসায় পড়লে ৫০ হাজার গুণ, আমার মসজিদে অর্থাৎ মসজিদে নববীতে পড়লে ৫০ হাজার গুণ এবং মসজিদুল হারাম বা কাবার ঘরে পড়লে এক লাখ গুণ সওয়াব পাবেন। (ইবনে মাজা, মিশকাত) । ধর্মীয় কারণে যে তিনটি স্থানে সফরের কথা মুহাম্মদ (সা) বলেছেন এই স্থান তন্মধ্যে অন্যতম। বাকি দুটি স্থান হল মসজিদুল হারামমসজিদে নববী। অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশান (ওআইসি) , ইসলামে তৃতীয় পবিত্র স্থান হিসেবে আল-আকসা মসজিদকে বোঝায় (এবং এর উপর আরবদের সার্বভৌম কতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দাবি করে )।

বর্তমান অবস্থা

প্রশাসন

আল-আকসা মসজিদ: নাম উৎপত্তি, ইতিহাস, স্থাপত্য 
১২০৬ সালে তৈরি আল নিহায়া (ব্যাকারণ) মাদ্রাসা। বর্তমানে এটি একটি লাইব্রেরি এবং জেরুসালেমের শরিয়া কোর্টের সদরদপ্তর ।

১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ছয় দিনের যুদ্ধের আগ পর্যন্ত জর্ডানের ওয়াকফ মন্ত্রণালয় এর তত্ত্বাবধায়ক ছিল। যুদ্ধে ইসরায়েল জয়ী হওয়ার পর ইসলামি ওয়াকফ ট্রাস্টের হাতে মসজিদের ভার প্রদান করা হয়। তবে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী মসজিদ এলাকায় টহল ও তল্লাশি চালাতে পারে। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের হামলার পর ওয়াকফ কর্তৃপক্ষ স্থপতি, প্রযুক্তিবিদ ও কারিগরদের নিয়োগ করে নিয়মিত তত্ত্বাবধান কার্যক্রম চালায়। ইসরায়েলের ইসলামিক মুভমেন্ট এবং ওয়াকফ আল-আকসা ইন্তিফাদার পর থেকে হারাম আল শরিফে মুসলিম নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা চালিয়েছে। কিছু কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে পরিত্যক্ত স্থাপনার সংস্কার

মুহাম্মদ আহমেদ হুসাইন প্রধান ইমাম এবং আল-আকসা মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাস ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে তাকে জেরুসালেমের গ্র্যান্ড মুফতি হিসেবে নিয়োগ দেন। ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি দ্বন্দ্ব্বের ক্ষেত্রে আল-আকসা মসজিদের অধিকার একটি ইস্যু। মসজিদসহ পুরো হারাম আল শরিফের উপর ইসরায়েল তার সার্বভৌমত্ব দাবি করে কিন্তু ফিলিস্তিনিদের দাবি এর অভিভাবকত্ব ইসলামি ওয়াকফের।২০০০ ক্যাম্প ডেভিড সম্মেলনে আলোচনায় ফিলিস্তিনিরা মসজিদ এবং পূর্ব জেরুসালেমের অন্যান্য ইসলামি স্থানগুলোর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দাবি করে।

প্রবেশাধিকার

আল-আকসা মসজিদ: নাম উৎপত্তি, ইতিহাস, স্থাপত্য 
মসজিদুল আকসার ভেতরে একজন ফিলিস্তিনি মুসলিমের কুরআন পাঠ।

ইসরায়েলের মুসলিম বাসিন্দা এবং পূর্ব জেরুসালেমে বসবাসরত ফিলিস্তিনিরা সাধারণত হারাম আল শরিফে প্রবেশ করতে পারে এবং মসজিদুল আকসায় নামাজ আদায় করতে পারে। তবে কখনো কখনো কিছু কিছু মুসলিমের প্রবেশে বাধা প্রদান করে। এই বিধিনিষেধের মাত্রা সময়ে সময়ে পরিবর্তন হয়। কখনো শুধু জুমার নামাজের সময় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। গাজার অধিবাসীদের জন্য বিধিনিষেধ অনেক বেশি কঠোর। ইসরায়েলি সরকারের দাবি যে নিরাপত্তার কারণে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।

খননকার্য

১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের যুদ্ধের পর হারাম আল শরিফের বাইরে কয়েক দফা খননকার্য চালানো হয়েছে। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ মসজিদের দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকের দেয়ালের বাইরে খননকার্য শুরু করে। ফিলিস্তিনিদের বিশ্বাস জন্মায় যে মসজিদের ভিত্তি দুর্বল করার জন্য এই খননকার্য চালানো হয়। তবে ইসরায়েল এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে। ইসরায়েলের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদের পশ্চিম অংশের নিচে ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে একটি সুড়ঙ্গ তৈরি করে। জেরুসালেমে ইউনেস্কোর বিশেষ দূত ওলেগ গ্রেবার বলেন যে ইসরায়েলি, ফিলিস্তিনিজর্ডানি সরকারের মধ্যে স্থানের দায়িত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে হারাম আল শরিফের দালান ও স্থাপনাগুলোর অবনতি হচ্ছে।

২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে  এই বিভাগ কর্তৃক প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষের অণুসন্ধানের জন্য খননকার্য শুরু হয়। সরকার এখানে একটি পায়ে চলা সেতু নির্মাণ করতে চেয়েছিল যা মাগরাবি ফটকের দিকে নিয়ে যাবে। এই স্থানটি হারাম আল শরিফ কমপ্লেক্সের একমাত্র স্থান যেখনে অমুসলিমরা প্রবেশ করে থাকে। এই অংশটি মসজিদ থেকে ৬০ মিটার (২০০ ফু) দূরে অবস্থিত ছিল। এই খননকার্যের কারণে মুসলিম বিশ্বে নিন্দা উঠে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মসজিদের ভিত্তি ধ্বংস করার চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়। ফিলিস্তিনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও হামাসের নেতা ইসমাইল হানিয়া খননকার্য প্রতিরোধের জন্য ফিলিস্তিনিদের এক হওয়ার ডাক দেন। অন্যদিকে ফাতাহ বলে যে তারা ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধবিরতি সমাপ্ত করবে। ইসরায়েল তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে।

চিত্রশালা

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

গ্রন্থপঞ্জি

সিরাজুল ইসলাম, এ. এন. এম. (২০১৭)। আল আকসা মসজিদের ইতিকথা। 4th: বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার। আইএসবিএন 9848420037 

বহিঃসংযোগ

Tags:

আল-আকসা মসজিদ নাম উৎপত্তিআল-আকসা মসজিদ ইতিহাসআল-আকসা মসজিদ স্থাপত্যআল-আকসা মসজিদ ইসলামে ধর্মীয় গুরুত্বআল-আকসা মসজিদ বর্তমান অবস্থাআল-আকসা মসজিদ চিত্রশালাআল-আকসা মসজিদ আরও দেখুনআল-আকসা মসজিদ তথ্যসূত্রআল-আকসা মসজিদ গ্রন্থপঞ্জিআল-আকসা মসজিদ বহিঃসংযোগআল-আকসা মসজিদ

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

অণুজীবজয়া আহসানভূমি পরিমাপমহাত্মা গান্ধীবাংলা ব্যঞ্জনবর্ণব্যাকটেরিয়াআল মনসুরকরোনাভাইরাসবাংলাদেশ পুলিশযক্ষ্মাবাংলাদেশের জাতীয় পতাকাচট্টগ্রাম বিভাগদক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাযিনাআন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসহযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরবঙ্গবন্ধু সেতুপারমাণবিক ভরের ভিত্তিতে মৌলসমূহের তালিকামাশাআল্লাহনেপালচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়দক্ষিণ কোরিয়াদেশ অনুযায়ী ইসলামপ্রাচীন ভারতঢাকা মেট্রোরেলচিরস্থায়ী বন্দোবস্তকিরগিজস্তানশচীন তেন্ডুলকরঅভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়বাংলাদেশের সিটি কর্পোরেশনের তালিকাইরানমহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রশাহরুখ খানবাঁশবৈষ্ণব পদাবলিবাংলাদেশের নদীর তালিকাতাজমহলঢাকাষাট গম্বুজ মসজিদকাতারব্রাজিল জাতীয় ফুটবল দলবৃত্তশিয়া ইসলামের ইতিহাসচুয়াডাঙ্গা জেলাভাইরাসশশী পাঁজাচতুর্থ শিল্প বিপ্লবসাদ্দাম হুসাইনইন্টারনেটআমার সোনার বাংলারামমোহন রায়জয়নুল আবেদিনইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সবৃত্তি (গুণ)উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতানদের তালিকাপদ্মা সেতুবাঙালি জাতিশাকিব খানযৌনসঙ্গমর‍‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নইউক্রেনে রুশ আক্রমণ (২০২২-বর্তমান)সাতই মার্চের ভাষণকালিদাসলোকনাথ ব্রহ্মচারীক্ষুদিরাম বসুম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাবওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবসাধু ভাষাশিবখাদ্যমিয়ানমারসিরাজউদ্দৌলাবইআমাশয়দিল্লিময়ূরী (অভিনেত্রী)বাংলাদেশের প্রশাসনিক অঞ্চলরক্তশূন্যতা🡆 More