কংক্রিট

সিমেন্ট, বালি, খোয়া (ইটের টুকরো), পাথরের টুকরো পানির সঙ্গে মিশিয়ে যে নির্মাণসামগ্রী বা মিশ্রণ (মশলা) তৈরি করা হয়, তাকে ঢেলে চাপ দিয়ে নির্দিষ্ট আকার দেয়া হয়। শুকানোর পর একেই কংক্রিট বলে।

সাধারণ কংক্রিটের চাপ (টান) ও ঘাতসহতা ক্ষমতা কম। তাই মধ্যখানে লোহা বা ইস্পাতের রড রেখে তার চারিদিকে কংক্রিট জমালে তা অত্যন্ত শক্ত এবং চাপ ও ঘাতসহ হয়। এ ধরনের কংক্রিটকে বলে রি-ইনফোর্সড (re-inforced) কংক্রিট অথবা রি-ইনফোর্সড সিমেণ্ট কংক্রিট, সংক্ষেপে আর সি সি (RCC)। কংক্রিট এর মধ্যে বাতাসের পরিমাণ যত কম, অর্থাৎ ঘনত্ব যত বেশি হয় এবং পানি ও সিমেন্টের অনুপাত যত কম হয় কংক্রিট তত বেশি শক্ত হয়। তবে এ অনুপাত ০.২ এর কম হলে সিমেন্টের হাইড্রেশন বিক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পানির স্বল্পতা থাকায় এ কংক্রিটের শক্তিমত্তা কম হয়।

কংক্রিট
রোমান সাম্রাজ্যে কংক্রিটের তৈরি একটি প্রাচীন মন্দির ।
কংক্রিট
বসটন সিটি হল : কংক্রিটের তৈরি একটি আধুনিক স্থাপত্য

ইতিহাস

অনেক প্রাচীন সভ্যতায় কংক্রিট ব্যবহার করা হয়েছে। মিসরের পিরামিড নিয়ে এক গবেষণায় বলা হয়, পিরামিড তৈরিতে কংক্রিট এর ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে।রোমক সাম্রাজ্যে চূনা(quicklime) পোজ্জলানা(pozzolana) এবং পামিস(pumice) দিয়ে রোমক কংক্রিট তৈরি করা হত যা দিয়ে অনেক রোমক স্থাপত্যশিল্পে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু বলা হয় রোমকরা কংক্রিট তৈরি করে নি।.

কংক্রিট 
হাড্রিয়ানের মন্দির : রোমান কংক্রিটের তৈরি স্থাপত্যের একটি উদাহরণ

উপাদান

কংক্রিটের প্রধান উপাদান হল সিমেন্ট, পাথর, বালি এবং পানি। বিভিন্ন কাজের ব্যবহার উপযোগী করতে এর সাথে রাসায়নিক মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়।

সিমেন্ট

কংক্রিট 
Several tons of bagged cement, about two minutes of output from a 10,000 ton per day cement kiln

দৈনন্দিন কাজে সাধারণত পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়। এটি কংক্রিট, মর্টার এবং প্ল্যাস্টারের মৌলিক উপাদান। বাংলাদেশে অর্ডিনারি পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট (CEM I) এবং পোর্টল্যান্ড কমপোসিট সিমেন্ট (CEM II) তৈরী হয়। এর প্রধান উপাদান হল: ক্যালসিয়াম সিলিকেট (C2S, C3S), ট্রাইক্যালসিয়াম অ্যালুমিনেট (C3A) and ক্যালসিয়াম অ্যালুমিনোফেরেট (C4AF) এবং জিপসাম

রাসায়নিক মিশ্রণ

রাসায়নিক মিশ্রণ সাধারণত পাউডার অথবা তরল অবস্থায় থাকে। চাহিদামত কংক্রিট তৈরি করার জন্য ইহা কংক্রিটের সাথে যোগ করা হয়। সাধারণত সিমেন্টের ওজনের ৫% এর নিচে এর ব্যবহার হয়। মিশ্রণ অনেক রকম হতে পারে, যেমন:

  • Accelerant: সিমেন্টের হাইড্রেশন বিক্রিয়ার গতি বৃদ্ধি করে, ফলে কংক্রিট দ্রুত জমাট বাঁধে।
  • Retarder: সিমেন্টের হাইড্রেশন বিক্রিয়ার গতি হ্রাস করে, ফলে কংক্রিট দেরিতে জমাট বাঁধে। বাণিজ্যিক কংক্রিট পরিবহন করতে সময় লাগে বলে এ ধরনের মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়।
  • Air entrainment: কংক্রিটের মধ্যে বাতাস প্রবেশ করায়, ফলে কংক্রিট বরফ গলা ও জমাট বাঁধা চক্রের দ্বারা কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যদিও এর ফলে কংক্রিটের শক্তি কমে যায়। ১% বাতাস বেশি প্রবেশ করলে শক্তিমত্তা প্রায় ৫% কমে যায়।
  • Plasticizer: এটি ফ্রেশ কংক্রিটের ওয়ার্কিবিলিটি বাড়াতে সাহায্য করে, ফলে একই ওয়ার্কিবিলিটি পেতে কম পানি ব্যবহার করা যায়। ফলে কংক্রিটের শক্তিমত্তা বাড়ে। উচ্চ শক্তিমত্তার কংক্রিট তৈরীতে এর ব্যবহার হয়। এটি 'water reducer' নামে বেশি প্রচলিত।
  • Superplasticizer: এক ধরনের বিশেষ plasticizers যা একই সাথে Retarder এবং Plasticizer হিসেবে কাজ করে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উচ্চ শক্তিমত্তার কংক্রিট তৈরীতে এর ব্যবহার হয়।
  • Pigment: বিভিন্ন রঙের কংক্রিট বানিয়ে বাহ্যিক সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য এটি ব্যবহার করা হয়।
  • Corrosion inhibitor: কংক্রিটের ইস্পাত এবং লোহার বারের ক্ষয়রোধ করতে ব্যবহৃত হয়।
  • Bonding agents: নতুন এবং পুরাতন কংক্রিটের সংযোগ করতে ব্যবহার করা হয়।
  • Pumping aids: কংক্রিট পাম্পিয়ের সময় এর উপাদানগুলোর বিচ্ছিন্নতা বা 'segregation' এবং 'bleeding' রোধ করতে ব্যবহার করা হয়।

প্রস্তুত প্রণালী

বেশি পরিমাণের কংক্রিট সাধারণত ব্যাচিং প্ল্যান্টে করা হয়ে থাকে। অল্প পরিমাণের কংক্রিট হাতে অথবা সাধারণ মিশ্রণ যন্ত্রে (মিক্সার মেশিনে) তৈরি করা সম্ভব। ব্যাচিং প্ল্যান্টে সাধারণত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কংক্রিট তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে ঘণ্টায় ১০০ ঘনমিটার পর্যন্ত কংক্রিট তৈরি করা যায়।

ডিজাইন

ব্যবহার এবং কংক্রিটের শক্তিমত্তার উপর নির্ভর করে কংক্রিটের মিক্স ডিজাইন করা হয়। বাংলাদেশে সাধারণত ACI-211 অনুসরণ করে কংক্রিটের মিক্স ডিজাইন করা হয়।

ওয়ার্কিবিলিটি

ওয়ার্কিবিলিটি (Workability) হল ফ্রেশ (মাত্র তৈরী করা) কংক্রিটের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম, যা দ্বারা পরিমাপ করা হয় এর কর্মযোগ্যতা। সাধারণত slump test এর মাধ্যমে কংক্রিটের ওয়ার্কিবিলিটি মাপা হয়। slump cone এর উচ্চতা ১২ ইঞ্চি, নিচের দিকের ব্যাস ৮ ইঞ্চি এবং উপরের দিকের ব্যাস ৪ ইঞ্চি। এটি কংক্রিট দ্বারা ভর্তি করে কোণটি উঠিয়ে ফেলা হয়, তারপর কংক্রিটের উচ্চতা ১২ ইঞ্চি থেকে কতটুকু কমল সেটি মাপা হয়। এ পরিমাপ সাধারণত ইঞ্চি, সেন্টিমিটার বা মিলিমিটারে প্রকাশ করা হয়। এ পরিমাণটি slump value নামে পরিচিত।

স্ট্রেন্থ টেস্ট

সাধারণত সিলিন্ডার বা ঘনক আকৃতির নমুনা নিয়ে ইউনিভারসাল টেস্টিং মেশিনে কংক্রিটের শক্তিমত্তা বের করা হয়। সিলিন্ডারের উচ্চতা ব্যাসের দ্বিগুন হয়। নমুনা হিসেবে ঘনক ব্যবহার করলে স্ট্রেন্থ একই উপাদানের সিলিন্ড্রিক্যাল নমুনা হতে বেশি দেখায়। এর কারণ হল দৈর্ঘ্য বরাবর দৈর্ঘ্য সংকোচনের কারণে প্রস্থ হ্রাস পায়। প্রস্থ বরাবর ইউসিসি মেশিনের সাথে তুলনামূলক বেশি ঘর্ষণের ফলে ঘনকে শক্তি বেশি দেখায়। বাংলাদেশে সাধারণত ASTM C39 অনুসারে ৪ ইঞ্চি ব্যাস এবং ৮ ইঞ্চি উচ্চতার সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়।

কিউরিং

কিউরিং বলতে বোঝায় কংক্রিটকে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা। কংক্রিটের শক্তিমত্তা নির্ভর করে এর উপাদান সিমেন্টের সাথে পানির হাইড্রেশন বিক্রিয়ার উপর। তাই সাধারণভাবে কিউরিং ভাল হলে কংক্রিটের শক্তি বেশি হয়।

বৈশিষ্ট্য

কংক্রিট সাধারণত compressive strength নিতে পারে কিন্তু tensile strength নিতে পারে না। tensile strength নেয়ার জন্য সাধারণত লোহা বা ইস্পাতের রিইনফোর্সমেন্ট রড দেয়া হয়। এ রড এবং কংক্রিট একত্রে সাধারণভাবে আরসিসি (reinforced cement concrete, RCC) নামে পরিচিত। এছাড়া কংক্রিটকে আগের থেকে compressive শক্তি প্রয়োগ করলে এটি কিছুটা Tensile Force নিতে পারে। এ ধরনের কংক্রিট প্রিস্ট্রেসড কংক্রিট নামে পরিচিত। ঢালাইয়ের আগে এবং পরে দুভাবেই প্রিস্ট্রেস দেয়া সম্ভব।

ব্যবহার

কংক্রিট নির্মাণকাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পাকা বাড়ি, দালান-কোঠা, পুল-কালভার্ট, এমনকী সড়ক নির্মাণে কংক্রিট অপরিহার্য। সম্প্রতি বিভিন্ন ধরনের মূর্তি, ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণেও কংক্রিট ব্যবহৃত হচ্ছে। এসফল্টের রাস্তার চেয়ে কংক্রিটের রাস্তার এককালীন নির্মাণ ব্যয় বেশি হলেও সাধারণত এটি তুলনামুলক বেশি টেকসই হওয়ায় গড়পড়তা খরচ কম। তাছাড়া উচ্চ গতির রাস্তা তৈরির জন্য কংক্রিট ব্যবহার করা হয়। স্টিল কাঠামোর চেয়ে কংক্রিটের কাঠামো তুলনামূলক বেশি অগ্নিসহ। তবে ভূমিকম্পে tensile লোড আসে বলে রিইনফোর্সমেন্ট না থাকলে শুধু কংক্রিট ভেঙে পড়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।

বহি:সংযোগ


তথ্যসূত্র

নোট

বহির্সূত্র

Tags:

কংক্রিট ইতিহাসকংক্রিট উপাদানকংক্রিট প্রস্তুত প্রণালীকংক্রিট বৈশিষ্ট্যকংক্রিট ব্যবহারকংক্রিট বহি:সংযোগকংক্রিট তথ্যসূত্রকংক্রিট বহির্সূত্রকংক্রিটপাথরপানিবালিসিমেন্ট

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

দৈনিক ইত্তেফাকচর্যাপদআকিকাবাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধনীসমূহযতিচিহ্নসাঁওতালসাইবার অপরাধভারতের ইতিহাসশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানমিল্ফমাইকেল মধুসূদন দত্তখুলনা বিভাগআন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসজগদীশ চন্দ্র বসুমঙ্গল শোভাযাত্রামোশাররফ করিমহার্নিয়ালক্ষ্মণসেনদ্বাদশ জাতীয় সংসদ সদস্যদের তালিকারাজশাহী বিভাগভোটপদ (ব্যাকরণ)এল নিনোরুবেলডায়াজিপামবিজ্ঞাননড়াইল জেলাসন্ধিসমকামী মহিলাবঙ্গাব্দপশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন, ২০২১আরবি ভাষাইশার নামাজপাবনা জেলাকাঁঠালগৌতম বুদ্ধআডলফ হিটলারকক্সবাজারসাজেক উপত্যকাবাংলাদেশের সরকারি কলেজের তালিকাজুনাইদ আহমেদ পলকই-মেইলনীল বিদ্রোহকোণআনন্দবাজার পত্রিকাজসীম উদ্‌দীনবাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মরত জেনারেলদের তালিকাশ্বেতকণিকাআলী খামেনেয়ীময়মনসিংহ জেলাভারতের সংবিধানধর্মবিন্দুচাঁদ২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগশব্দ (ব্যাকরণ)প্লাস্টিক দূষণরামকৃষ্ণ পরমহংসপ্রধান পাতাদারুল উলুম দেওবন্দদৈনিক যুগান্তরবাংলাদেশের নদীবন্দরের তালিকাকুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টরূপাঞ্জনা মিত্রভূগোলসিলেটবাংলাদেশী জাতীয় পরিচয় পত্রশেখ হাসিনাইসলামে বিবাহআমার দেখা নয়াচীনখালিদ বিন ওয়ালিদপ্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণসার্বিয়াব্যাকটেরিয়ারামমোহন রায়বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টরসমূহ🡆 More