ধারাবাহিক অস্তিত্বের দিক থেকে ভারতের সভ্যতা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়সী সভ্যতা। যদি আমরা লিখন পদ্ধতি, ধাতুর কাজ, ও অ-কৃষিভিত্তিক নাগরিক বসতি স্থাপনকে সভ্যতার ন্যূনতম সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচনা করি, তবে সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা হল মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা (খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ সহস্রাব্দ), এবং প্রায় কাছাকাছি সময়ের মিশরীয় সভ্যতা। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দের মধ্যেই সিন্ধু নদের উপত্যকায় এরকম আদি সভ্যতার উন্মেষ ঘটে। চীনে তা ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দের সময়। কিন্তু মিশরীয় ও মেসোপটেমীয় সভ্যতাগুলি রোমান সাম্রাজ্যের সময়ে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে এই এলাকাগুলি ইসলামের অধীনে আসে। ফলে এলাকাগুলির বর্তমান সভ্যতার সাথে প্রাচীন সুমেরীয় বা মিশরীয় সভ্যতার কোন মিল নেই। অন্যদিকে ভারতীয় সভ্যতা প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত মোটামুটি অবিকৃত রয়ে গেছে।
ভারতীয় উপমহাদেশ পশ্চিমে আফগানিস্তান থেকে পূর্বে বঙ্গোপসাগর এবং উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে ভারতীয় উপদ্বীপের প্রান্তসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত। রাশিয়াকে বাদ দিয়ে গোটা ইউরোপের আয়তনের সমান এই এলাকার আয়তন। আর ভৌগোলিক, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত দিক থেকে এটি ইউরোপের চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্যময়। বিশ্বের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ লোকের বাস এখানে। এই বিশাল এলাকাটি ইতিহাসের খুব কম সময়ের জন্যই একটিমাত্র শাসকের অধীনে ছিল এবং তা-ও পুরোপুরি নয়। বর্তমানে এলাকাটি পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মায়ানমার রাষ্ট্রগুলিতে বিভক্ত। কিন্তু প্রতিটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই আঞ্চলিক প্রভেদের পরিমাণ বিপুল। তাই ভারতীয় উপমহাদেশের একটি সাধারণ সামগ্রিক ইতিহাস বর্ণনা করা দুরূহ।
সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা অনেক বিশাল, সুপরিকল্পিত নগরী নির্মাণ করেছিল, এবং এগুলির আংশিক পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছে, কিন্তু এদের সভ্যতার লিখিত নিদর্শনগুলিতে, যেমন - কাদামাটির চাঙড় কিংবা সিলমোহর, ইত্যাদিতে যে লেখা আছে, যেগুলির পাঠোদ্ধার করা এখনও সম্ভব হয়নি।সিন্ধু সভ্যতার বাসিন্দাদের ব্যাপারে আজ পর্যন্ত অসংখ্য মতামত এসেছে,সভ্যতাটি আবিষ্কারের পর তাৎক্ষনিক ভাবে কিছু পশ্চিমা পণ্ডিত(হুইজেল প্রমুখ) দাবী করেন সভ্যতাটি বর্তমান দক্ষিণভারতীয় দ্রাবিড়দের।যাদের বহিরাগত আর্যরা পরাজিত করে ও সভ্যতাটি ধ্বংস করে দেয়।এই তত্ত্ব দীর্ঘদিন প্রাধান্য পায়।কিন্তু গত বিশ বছর যাবত পরিচালিত তাবৎ পর্যবেক্ষণে এ তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়েছে।বর্তমান বিশেষজ্ঞদের ধারণা,এই প্রাচীন সভ্যতাটি আর্য,দ্রাবিড়(অস্ট্রালয়েড),মঙ্গোল এমনকি সুমেরীয়দেরও মিলিত সৃস্টি।তাছাড়া কোন বাইরের আক্রমণের প্রমাণও পাওয়া যায় নি(প্রাপ্ত ত্রিশটির মত মৃতদেহের কঙ্কাল সিন্ধু সভ্যতার বিলুপ্ত হবারও বহু পরের সময়কার যাকে শুরুতে গণহত্যার প্রমাণ বলা হয়েছিল) ।আবহাওয়া পরিবর্তন,সরস্বতী নদীর শুকিয়ে যাওয়া,ভুমিকম্প প্রভৃতি মিশ্র কারণে এ সভ্যতা পরিত্যক্ত হয়।উদ্ধারকৃত দ্রব্যের মধ্যে স্বস্তিকা ও মাতৃমূর্তি যথাক্রমে আর্য ও দ্রাবিড়দের উপস্থিতির প্রমাণ।যাই হোক,এ সভ্যতা ধ্বংস হলেও এর ধারাবাহিকতায় বর্তমান ভারতীয় সভ্যতার ভিত স্থাপিত হয়। গ্রিক মহাবীর আলেকজান্ডার যখন ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারত আক্রমণ করেন, তার আগেই ভারতে বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজ্যের উৎপত্তি ঘটে। আলেকজান্ডার চলে গেলে মৌর্য রাজবংশের অধীনে এই উত্তর ভারতীয় রাজ্যগুলি একত্রিত হয়ে মৌর্য সাম্রাজ্য গঠন করে (৩২২-১৮০ খ্রিপূ)। এরপর কুশানরা উত্তর থেকে আক্রমণ করে এবং ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কুশান সাম্রাজ্য গঠন করে। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে স্থানীয় গুপ্ত রাজবংশ ক্ষমতায় আসে এবং মৌর্যদের হারানো সাম্রাজ্যের প্রায় পুরোটাই পুনরুদ্ধার করে। গুপ্তরা ৩য় শতক থেকে ৫ম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত উত্তর ভারত শাসন করে। এই সময় দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যের মধ্যে বিভক্ত ছিল। গুপ্তদের পর হর্ষবর্ধন সামান্য সময়ের জন্য উত্তর ভারত শাসন করেন (৬ষ্ট শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত)। এরপর আবার গোটা ভারত বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাজ্যের এক জটিল সহাবস্থানমূলক ব্যবস্থায় ফেরত যায়। তবে এই সমস্ত রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মাঝেও ভারতীয় সভ্যতার মূল উপাদানগুলি অবিচ্ছিন্নভাবে খ্রিস্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত সঞ্চারিত হয়ে এসেছে।
সভ্যতার অনেক আগেই কৃষির উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১০ম শতকের পরে পশ্চিম এশিয়া (উত্তর ইরাক, সিরিয়া, পূর্ব তুরস্ক) অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক গ্রাম ও ছোট শহরের আবির্ভাব হয়। সুমের সভ্যতা থেকে ভারতের দূরত্ব খুব বেশি ছিল না। পারস্য উপসাগর থেকে উপকূল ধরে এগোলেই সিন্ধু নদের মোহনায় পৌঁছানো যেত। আর স্থলপথে ইরান ও বেলুচিস্তান হয়ে সেখানে পৌঁছানো যেত। ফলে সুমের থেকে সিন্ধু নদ পর্যন্ত উপকূলীয় পথ এবং অভ্যন্তরীণ স্থলপথ --- উভয় অঞ্চলেই কৃষির প্রসার ঘটেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকের মধ্যেই সিন্ধু অববাহিকায় কৃষিকাজ শুরু হয়ে যায় এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতক নাগাদ নদীর উপকূল জুড়ে এখানে ছোট বড় শহর স্থাপিত হয়। কৃষির উন্নয়নের সাথে সাথে বড় বড় নগরীর পত্তন ঘটে এবং সেই সাথে শুরু হয় সিন্ধু সভ্যতার।
সিন্ধু সভ্যতার যেসমস্ত নগরীর সন্ধান পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে আছে রাজস্থানের কালিবাঙ্গান, পাকিস্তানের হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো। এই তিনটি নগরী এবং আরো প্রায় দুশ ছোট বড় শহরের এক বিশাল নগর সভ্যতা পূর্বে ঊর্ধ্ব গঙ্গা এবং দক্ষিণে বর্তমান মুম্বাই শহর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সিন্ধু সভ্যতা আকারে ছিল সমসাময়িক প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে সর্ববৃহৎ। সিন্ধু নদ এবং এর উপনদী ও শাখানদী ছিল এই সভ্যতার প্রাণ। সিন্ধু নদ হিমালয় পর্বতমালায় উৎপত্তিলাভ করে পাঞ্জাবের নিম্নভূমি ও ঊষর রাজস্থানের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সিন্ধু মরুভূমির মধ্য দিয়ে আধুনিক করাচি শহরের কাছে গিয়ে সাগরে পড়েছে। গোটা সিন্ধু অববাহিকাই শুষ্ক অঞ্চল, বিশেষত এর দক্ষিণ অর্ধাংশ মরুভূমিই বলা চলে। তাই কৃষিকাজ ছিল পানিসেচের উপর নির্ভরশীল। বার্ষিক বন্যার কারণে পানির অভাব মিটতো ও উর্বর পলির সঞ্চয় হত। কিন্তু বছরের বেশির ভাগ সময় গরম ও শুষ্ক ছিল বলে মিশর ও সুমেরের মত এখানেও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটে। নদনদীগুলি সস্তায় ও সহজে বিভিন্ন কৃষিদ্রব্য পরিবহনের কাজেও লাগানো হত।
সুমেরীয় সভ্যতা ও সিন্ধু সভ্যতার মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করা দুঃসাধ্য। সুমেরীয়দের লিপি এবং সিন্ধু সভ্যতার লিপির মধ্যে তেমন মিল পাওয়া যায় না। তাছাড়া সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা ও শিল্পকলাও অনন্য। তাই সিন্ধু সভ্যতা সুমেরীয় সভ্যতার সম্প্রসারণ নয়, বরং একক, আলাদা একটি সভ্যতা ছিল বলে ধারণা করা হয়। সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা যে সিলমোহরগুলি ব্যবহার করত, সেগুলির সাথে সুমের তথা মেসোপটেমিয়ার সিলমোহরের মিল আছে। ধারণা করা হয় সুমেরদের সাথে সিন্ধুর লোকদের বাণিজ্য স্থাপিত হয়েছিল এবং সুমেরদের কাছ থেকে তারা সিলমোহরের ধারণাটি নিয়েছিল। সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন দ্রব্য সুমেরে এবং সুমেরের দ্রব্য সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলিতে পাওয়া গেছে। এই দুই সভ্যতার মধ্যস্থলে বর্তমান বাহরাইনে একটি প্রত্নতাত্ব্বিক স্থানের খোঁজ পাওয়া গেছে যেখানে এই দুই সভ্যতারই বিভিন্ন নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়; ধারণা করা হয় এই স্থানটি ছিল দুই সভ্যতার অন্তর্বর্তী একটি বাণিজ্যকেন্দ্র।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article প্রাচীন ভারত, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.