রক্ত (ইংরেজি: blood) হলো মানুষ ও অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীর সংবহন তন্ত্রের একটি দৈহিক তরল যা কোষে প্রয়োজনীয় পদার্থসমূহ যেমন পুষ্টিদায়ক পদার্থ ও অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং কোষ থেকে বিপাকীয় বর্জ্য পদার্থসমূহ একই কোষসমূহ থেকে দূরে বহন করে নিয়ে যায়। সংবহন তন্ত্রের রক্ত প্রান্তীয় রক্ত নামেও পরিচিত, এবং এটি যে রক্তকণিকাসমূহ বহন করে তা প্রান্তীয় রক্ত কণিকা নামে পরিচিত।
রক্ত | |
---|---|
বিস্তারিত | |
শনাক্তকারী | |
লাতিন | হিমা (haema) |
মে-এসএইচ | D001769 |
টিএ৯৮ | A12.0.00.009 |
টিএ২ | 3892 |
এফএমএ | FMA:9670 |
শারীরস্থান পরিভাষা |
রক্ত রক্তকণিকা দিয়ে গঠিত যেগুলো রক্তরস বা প্লাজমাতে ভাসমান অবস্থায় থাকে। রক্তের ৫৫% হলো রক্তরস যার অধিকাংশই পানি (আয়তনে প্রায় ৯২%), এছাড়াও রক্তরসে প্রোটিন, গ্লুকোজ, খনিজ আয়ন, হরমোন, কার্বন ডাই অক্সাইড (রক্তরস বর্জ্য পদার্থ পরিবহণের প্রধান মাধ্যম হওয়ায়), ও রক্তকণিকা বিদ্যমান। রক্তরসের প্রধান প্রোটিন হলো অ্যালবিউমিন, যা রক্তের কলোয়ডাল অভিস্রবণিক চাপ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। রক্তকণিকাগুলো লোহিত রক্তকণিকা (RBC বা ইরিথ্রোসাইট নামেও পরিচিত), শ্বেত রক্তকণিকা, (WBC বা লিউকোসাইট নামেও পরিচিত) ও অণুচক্রিকা (প্লেটলেট বা থ্রম্বোসাইট নামেও পরিচিত)। মেরুদণ্ডী প্রাণীদের সবচেয়ে বেশি থাকে লোহিত রক্তকণিকা, এর মধ্যে থাকে হিমোগ্লোবিন নামক লৌহসমৃদ্ধ প্রোটিন যা রক্তে অক্সিজেন পরিবহণের কাজ করে। অপরদিকে, কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রধানত বহিঃকোষীয়ভাবে পরিবাহিত হয় কারণ বাইকার্বনেট আয়ন রক্তরসে পরিবাহিত হয়। মেরুদণ্ডী প্রাণীদের রক্তের হিমোগ্লোবিন অক্সিজেনের সাথে যুক্ত হলে রং উজ্জ্বল লাল বর্ণের হয় এবং অক্সিজেন মুক্ত হলে গাঢ় লাল বর্ণের হয়। কিছু প্রাণী, যেমন ক্রাস্টেশান বা কবচী ও কম্বোজ প্রাণী অক্সিজেন পরিবহণের জন্য হিমোগ্লোবিনের পরিবর্তে হিমোসায়ানিন ব্যবহার করে। কীটপতঙ্গ ও কিছু মলাস্ক বা কম্বোজ প্রাণী রক্তের পরিবর্তে হিমোলিম্ফ নামক তরল ব্যবহার করে। হিমোলিম্ফ বদ্ধ সংবহনতন্ত্রের মধ্যে থাকে না।
রক্ত হৃদ্যন্ত্রের পাম্প বা সঞ্চালন ক্রিয়ার ফলে রক্তনালির মধ্য দিয়ে সারা দেহে পরিবাহিত হয়। ফুসফুসবিশিষ্ট প্রাণীদের ক্ষেত্রে, ধামনিক রক্ত প্রশ্বাসের মাধ্যমে টেনে নেওয়া বায়ু থেকে অক্সিজেন দেহের, টিসুতে বহন করে এবং শিরাস্থ রক্ত কোষে উৎপন্ন কার্বন ডাই-অক্সাইড টিসু থেকে ফুসফুসে বহন করে নিয়ে যায়।
রক্ত সম্পর্কিত চিকিৎসা পরিভাষা প্রায়শই hemo- (হিমো-) অথবা hemato- (হিমাটো-) দিয়ে শুরু হয় (এগুলোর ব্রিটিশ বানান যথাক্রমে haemo- ও haemato-), এটি এসেছে গ্রিক শব্দ αἷμα (হাইমা) থেকে যার অর্থ "রক্ত"। শারীরস্থান ও কলাস্থানবিদ্যার পরিভাষায় রক্ত হলো একটি বিশেষ ধরনের তরল যোজক কলা
রক্ত দেহের অভ্যন্তরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, যেমন:
রক্ত একটি প্রোটিন-সমৃদ্ধ তরল দিয়ে গঠিত যা প্লাজমা বা রক্তরস নামে পরিচিত। রক্তরসে ভাসমান অবস্থায় কোষীয় উপাদানগুলো যেমন শ্বেত রক্তকণিকা, লোহিত রক্তকণিকা ও অণুচক্রিকা থাকে। মানব দেহের মোট ওজনের ৭-৮% হলো রক্ত, লোহিত রক্তকণিকার আয়তন মোট রক্তের ৪৫, রক্তরস ৫৪.৩% ও শ্বেত কণিকা প্রায় ০.৭%। রক্তের গড় আপেক্ষিক গুরুত্ব ১০৬০ kg/m3, যা বিশুদ্ধ পানির আপেক্ষিক গুরুত্ব ১০০০ kg/m3-এর কাছাকাছি।
কোষ | কোষ/μL (গড়) | প্রায়িক স্বাভাবিক সীমা | মোট শ্বেতকণিকার শতকরা হার |
---|---|---|---|
মোট শ্বেতকণিকা | ৯০০০ | ৪০০০-১১,০০০ | ... |
নিউট্রোফিল | ৫৪০০ | ৩০০০-৬০০০ | ৫০-৭০ |
ইওসিনোফিল | ২৭৫ | ১৫০-৩০০ | ১-৪ |
বেসোফিল | ৩৫ | ০-১০০ | ০-৪ |
লিম্ফোসাইট | ২৭৫০ | ১৫০০-৪০০০ | ২০-৪০ |
মনোসাইট | ৫৪০ | ৩০০-৬০০ | ২-৮ |
লোহিত রক্তকণিকা | ৪.৮×১০৬ (মহিলা) ৫.৪×১০৬ (পুরুষ) | ... | ... |
অণুচক্রিকা | ৩,০০,০০০ | ২,০০,০০০-৫,০০,০০০ | ... |
এক মাইক্রোলিটার রক্তে থাকে:
প্যারামিটার | মান | তথ্যসূত্র |
---|---|---|
হিমাটোক্রিট | ৪৫ ± ৭ (৩৮–৫২%) পুরুষের ক্ষেত্রে ৪২ ± ৫ (৩৭–৪৭%) মহিলাদের ক্ষেত্রে | |
pH | ৭.৩৫–৭.৪৫ | |
ক্ষার আধিক্য | −৩ থেকে +৩ | |
PO2 | ১০–১৩ kPa (৮০–১০০ mm Hg) | |
PCO2 | ৪.৮–৫.৮ kPa (৩৫–৪৫ mm Hg) | |
HCO3− | ২১–২৭ mM | |
অক্সিজেন সম্পৃক্তি | অক্সিজেনযুক্তকৃত:৯৮–৯৯% অক্সিজেন বিযুক্তকৃত: ৭৫% |
উপাদানসমূহ | এসআই একক | অন্য একক |
---|---|---|
গ্লুকোজ (অভুক্তাবস্থা) | ৩.৬—৫.৮ mmol/L | ৬৫–১০৪ mg/dL |
বিলিরুবিন | ৩–২১ μmol/L | ০.১৮–১.২৩ mg/dL |
বাইকার্বনেট (HCO− 3) | ২১–২৯ mmol/L | ২১–২৯ mEq/L |
ক্যালসিয়াম (Ca2+) | ২.১–২.৬ mmol/L | ৮.৫–১০.৫ mg/dL ৪.২–৫.২ mEq/L |
কপার বা তামা (Cu2+) | ১০–২২ μmol/L | ৬৪–১৪০ μg/dL |
কোলেস্টেরল | <৫.০ mmol/L | <২০০ mg/dL |
প্রোটিন (মোট) | ৬০–৮০ g/L | ৬–৮ g/dL |
ম্যাগনেসিয়াম (Mg2+) | ০.৭৫–১.০ mmol/L | ১.৫–২.০ mEq/L ১.৮২–২.৪৩ mg/dL |
পটাশিয়াম (K+) | ৩.৬–৫.০ mmol/L | ৩.৬–৫.০ mEq/L |
সোডিয়াম (Na+) | ১৩৫–১৪৫ mmol/L | ১৩৫–১৪৫ mEq/L |
ক্লোরাইড (Cl−) | ৯৫–১০৭ mmol/L | ৯৫–১০৭ mEq/L |
আয়রন বা লৌহ (Fe) | ১৪–৩২ μmol/L (পুরুষ) ১০–২৮ μmol/L (মহিলা) | ৭৮–১৭৮ μg/dL (পুরুষ) ৫৬–১৫৭ μg/dL (মহিলা) |
ক্রিয়েটিনিন | ৬৪–১১১ μmol/L (পুরুষ) ৫০–৯৮ μmol/L (মহিলা) | ০.৭২–১.২৬ mg/dL (পুরুষ) ০.৫৭—১.১১ mg/dL (মহিলা) |
ইউরিয়া | ২.৫—৬.৬ mmol/L | ১৫—৪০ mg/dL |
প্লাজমা বা রক্তরস হলো রক্তের ফ্যাকাশে হলুদ বর্ণের স্বচ্ছ তরল অংশ। এতে ৯১% থেকে ৯২% পানি এবং ৮% থেকে ৯% কঠিন বস্তু থাকে। কঠিন বস্তুর মধ্যে জৈব ও অজৈব উভয় ধরনের পদার্থই বিদ্যমান। স্বাভাবিক রক্তরস আয়তন হলো দৈহিক ওজনের ৫%, অথবা ৭০ কেজি ওজনবিশিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রায় ৩৫০০ মি.লি.। রক্তরস স্থির অবস্থায় জমাট বেঁধে যায়, তবে অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট বা তঞ্চনরোধক যোগ করলে তরল থাকে। যদি সম্পূর্ণ রক্তকে জমাট বাঁধতে দেওয়া হয় এবং জমাট-বাঁধা অংশকে অপসারণ করা হয়, তাহলে অবশিষ্ট তরলকে রক্তাম্বু বা রক্তমস্তু বলে। রক্তাম্বুতে রক্তরসের মতো প্রায় একই ধরনের উপাদান থাকে, তবে এতে ফাইব্রিনোজেন ও তঞ্চন ফ্যাক্টর বা নিয়ামক II, V ও VIII অপসারিত হয় এবং রক্ত তঞ্চনের সময় অণুচক্রিকার ভাঙনের কারণে সেরোটোনিন নামক উপাদান বেশি পরিমাণে থাকে।
রক্তের pH কিছুটা ক্ষারীয় এবং খুব কঠোরভাবে ৭.৩৫ থেকে ৭.৪৫ সীমার মধ্যে নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়। রক্তে বহিঃস্থ কোষীয় তরলের pH ৭.৩৫-এর নিচে হলে তা খুবই অম্লীয় এবং ৭.৪৫-এর উপরে উঠলে তা খুবই ক্ষারীয়। pH ৬.৯-এর নিচে নামলে বা ৭.৮-এর উপরে উঠলে তা সাধারণত প্রাণঘাতী। রক্তের pH, অক্সিজেনের আংশিক চাপ (pO2), কার্বন ডাই-অক্সাইডের আংশিক চাপ (pCO2) এবং বাইকার্বনেট (HCO3−) মাত্রা দেহের সাম্যাবস্থা কৌশলের মাধ্যমে খুব সতর্কতার সাথে নিয়ন্ত্রিত হয় এবং দেহের অম্ল-ক্ষার সাম্যাবস্থা বজায় থাকে। দেহের শ্বসনতন্ত্র ও মূত্রতন্ত্র এক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করে।
মানুষের রক্ত প্রায় অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের মতোই, তবে কোষের সংখ্যা, আকৃতি, প্রোটিনের গঠন প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রজাতিভেদে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। অস্তন্যপায়ী মেরুদণ্ডীদের ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রধান পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়:
রক্ত হৃদ্যন্ত্রের সঞ্চালন ক্রিয়ার মাধ্যমে রক্তনালির মধ্য দিয়ে সারা দেহে পরিবাহিত হয়। মানবদেহে, রক্ত হৃদ্যন্ত্রের শক্তিশালী বাম নিলয় থেকে চালিত হয়ে ধমনিসমূহের মাধ্যমে প্রান্তীয় টিসুতে পৌঁছায় এবং শিরাসমূহের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের ডান অলিন্দে ফিরে আসে। অতঃপর এটি ডান নিলয়ে প্রবেশ করে এবং ফুসফুসীয় ধমনির মধ্য দিয়ে ফুসফুসে চালিত হয় এবং ফুসফুসীয় শিরার মধ্য দিয়ে বাম অলিন্দে ফিরে আসে। এরপর রক্ত পুনরায় বাম নিলয়ে প্রবেশ করে এবং পুরো শরীরে সঞ্চালিত হয়। প্রশ্বাসের মাধ্যমে গৃহীত বাতাস থেকে প্রাপ্ত অক্সিজেন ধামনিক রক্তের মাধ্যমে বাহিত হয়ে দেহের সকল কোষে পৌঁছে যায় এবং কোষের বিপাকীয় ক্রিয়ার ফলে উৎপাদিত কার্বন ডাই-অক্সাইড শিরাস্থ রক্তের মাধ্যমে বাহিত হয়ে ফুসফুসে পৌঁছায় ও বাইরে নিঃশ্বসিত হয়। তবে একটি ব্যতিক্রম আছে তা হলো, ফুসফুসীয় ধমনি কার্বন ডাই-অক্সাইডসমৃদ্ধ রক্ত বহন করে অন্যদিকে ফুসফুসীয় শিরা অক্সিজেনযুক্ত রক্ত বহন করে। কঙ্কাল পেশির চলনের ফলে একটি অতিরিক্ত ফিরতি প্রবাহ সৃষ্টি হতে পারে, কঙ্কাল পেশি শিরাগুলোকে সংনমিত করতে পারে এবং শিরার কপাটিকাগুলোর মধ্য দিয়ে রক্তকে চালিত করে ডান অলিন্দে পৌঁছায়। ১৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম হার্ভে রক্ত সংবহনের একটি বিখ্যাত বর্ণনা প্রদান করেন।
মেরুদণ্ডী প্রাণীদের ক্ষেত্রে রক্তের বিভিন্ন কোষ হিমাটোপোয়েসিস বা রক্তজনন প্রক্রিয়ায় অস্থি মজ্জাতে তৈরি হয়, এর মধ্যে রয়েছে ইরিথ্রোপোয়েসিস বা লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদন, মায়েলোপোয়েসিস বা শ্বেতকণিকা ও অণুচক্রিকা উৎপাদন। শিশুদের ক্ষেত্রে প্রায় সকল অস্থি থেকে লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদিত হয়; প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে দীর্ঘ অস্থি থেকে উৎপাদিত হয়, যেমন: কশেরুকার দেহ, স্টার্নাম বা বক্ষাস্থি, বক্ষপঞ্জর, শ্রোণিচক্রের অস্থি, ঊর্ধ্ব বাহু ও পায়ের অস্থি। অধিকন্তু, শৈশবকালীন মিডিয়াস্টিনাম বা ফুসফুস মধ্যগ বা মধ্যকাতে অবস্থিত থাইমাস গ্রন্থি টি লিম্ফোসাইটের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করে। রক্তের প্রোটিনসমৃদ্ধ উপাদান (তঞ্চনকারী প্রোটিনসহ) প্রধানত যকৃতে উৎপাদিত হয়, অন্যদিকে হরমোনগুলো তৈরি হয় অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিতে এবং জলীয় অংশ নিয়ন্ত্রিত হয় হাইপোথ্যালামাসের মাধ্যমে ও বৃক্ক এটি বজায় রাখতে সাহায্য করে। স্বাস্থ্যবান লোহিত রক্তকণিকার জীবৎকাল ১২০ দিন, প্লীহা ও যকৃতের কুপফার কোষে এগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
স্বাভাবিক সামুদ্রিক উচ্চতার বায়ুচাপে ধামনিক রক্তের একটি নমুনায় ৯৮.৫% অক্সিজেন রাসায়নিকভাবে হিমোগ্লোবিনের সাথে বন্ধন তৈরি করে। প্রায় ১.৫% অক্সিজেন হিমোগ্লোবিনের সাথে যুক্ত না থেকে রক্তের অন্যান্য তরলে ভৌতভাবে দ্রবীভূত থাকে। স্তন্যপায়ী ও অন্যান্য অনেক প্রজাতিতে হিমোগ্লোবিন হলো অক্সিজেনের প্রাথমিক পরিবাহক। প্রতি গ্রাম হিমোগ্লোবিনের সাথে ১.৩৬ থেকে ১.৪০ মি.লি. O2 বন্ধন তৈরি করে, একজন সুস্থ মানুষের দেহে প্রতি ১০০ মি.লি. রক্তে প্রায় ১৫ গ্রাম হিমোগ্লোবিন থাকে। সুতরাং যদি ১০০% হিমোগ্লোবিন অক্সিজেন দ্বারা সম্পৃক্ত হয়, তাহলে প্রতি ১০০ মি.লি. রক্তের ১৫ গ্রাম হিমোগ্লোবিন প্রায় ২০ মি.লি. অক্সিজেনের সাথে বন্ধন তৈরি করতে পারে। স্বাভাবিক সিস্টেমিক ধামনিক রক্তে (যা প্রায় ৯৭% সম্পৃক্ত) প্রতি ১০০ মি.লি. রক্তে প্রায় ১৯.৪ মি.লি. অক্সিজেন হিমোগ্লোবিনের সাথে যুক্ত হয়। টিসুর কৈশিক জালিকার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করার সময় (যেখানে অক্সিজেনের আংশিক চাপ ৪০ মি.মি. পারদ, ৭৫% সম্পৃক্ত হিমোগ্লোবিন) এই পরিমাণ কমে গড়ে ১৪.৪ মি.লি. হয়। সুতরাং স্বাভাবিক অবস্থায়, ফুসফুস থেকে টিসুতে প্রতি ১০০ মি.লি. রক্ত প্রবাহে প্রায় ৫ মি.লি. অক্সিজেন পরিবাহিত হয়। অপরদিকে, ৩৭°C (৯৮.৬°F) তাপমাত্রায় প্রতি ১ মি.মি. পারদ আংশিক চাপে ১ মি.লি. প্লাজমা বা রক্তরসে ০.০০০০৩ মি.লি. O2 ভৌতরূপে দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। ১০০ মি.মি. পারদ আংশিক চাপে প্রতি মি.লি. রক্তরসে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ০.০০৩ মি.লি., অথবা প্রতি ১০০ মি.লি. রক্তে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ০.৩ মি.লি. (রক্তের অক্সিজেনের হিসাব শতকরা আয়তন বা প্রতি ১০০ মি.লি. রক্তে কত মি.লি. অক্সিজেন দ্রবীভূত আছে এই হিসেবে প্রকাশ করা হয়।)।কঠোর অনুশীলনের সময় অক্সিজেন চাহিদা প্রায় ১৬ গুণ বা তারও বেশি বেড়ে যেতে পারে। এমন অবস্থায় যদি কেবল ভৌতরূপে দ্রবীভূত অক্সিজেন কে টিসুর প্রয়োজনীয় সকল অক্সিজেন চাহিদা মেটাতে হতো, তাহলে কার্ডিয়াক আউটপুট বা হৃদ্গত উৎপাদন প্রতি মিনিটে ১০০০ লিটারের চেয়ে বেশি হতে হতো। কঠোর অনুশীলনের সময় একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির কার্ডিয়াক আউটপুট সর্বোচ্চ প্রতি মিনিটে প্রায় ২৫ লিটার হতে পারে। প্রশিক্ষিত মল্ল ক্রীড়াবিদের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ৩৫ লিটারের চেয়ে বেশি হতে পারে। এজন্য রক্তে ভৌতরূপে দ্রবীভূত অক্সিজেন দেহের বিপাকীয় চাহিদা মেটাতে সক্ষম না, এমনকি বিশ্রামের সময়েও না। ফুসফুসীয় ও নাভি ধমনি ও তাদের অনুরূপ শিরাসমূহ ব্যতীত, ধমনিসমূহ হৃৎপিণ্ড থেকে অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত বহন করে ধমনিকা ও কৈশিকার মধ্য দিয়ে দেহের টিসুতে পৌঁছায়, যেখানে বিপাকীয় কাজে অক্সিজেন ব্যবহৃত হয়; পরবর্তীতে, উপশিরা ও শিরা কার্বন ডাই অক্সাইড সমৃদ্ধ টিসু থেকে হৃৎপিণ্ডে নিয়ে যায়। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিশ্রামরত অবস্থায় ফুসফুস ত্যাগ করা রক্তে হিমোগ্লোবিনের অক্সিজেন সম্পৃক্তি ৯৮-৯৯%, এবং দেহে অক্সিজেন সরবরাহের হার ৯৫০ থেকে ১১৫০ মি.লি./মিনিট। বিশ্রামরত অবস্থায় একজন স্বাস্থ্যবান প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির অক্সিজেন ব্যয়ের হার প্রতি মিনিটে ২০০-২৫০ মি.লি., এবং ফুসফুসে ফিরে আসা কার্বন ডাই-অক্সাইড সমৃদ্ধ রক্তেও অক্সিজেন সম্পৃক্তি প্রায় ৭৫% (৭০ থেকে ৭৮%) ক্রমাগত শারীরিক অনুশীলনের সময় অক্সিজেনের ব্যবহার বেড়ে যায় ফলে শিরাস্থ রক্তের অক্সিজেন সম্পৃক্তি হ্রাস পায়, প্রশিক্ষিত মল্ল ক্রীড়াবিদের ক্ষেত্রে তা ১৫ শতাংশের নিচে নেমে আসতে পারে; যদিও এটি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য শ্বসন হার ও রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধি পায়, তবে এই অবস্থায় ধামনিক রক্তে অক্সিজেন সম্পৃক্তি ৯৫% বা এর নিচে নামতে পারে। ক্রমাগত হাইপোক্সিয়া (অক্সিজেন সম্পৃক্তি ৯০ শতাংশের নিচে) স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক, তীব্র হাইপোক্সিয়া (সম্পৃক্তি ৩০ শতাংশের কম) খুব দ্রুত প্রাণনাশক।
ভ্রূণ অমরার মাধ্যমে অক্সিজেন গ্রহণ করায় খুব কম অক্সিজেন চাপের সম্মুখীন হয় ( প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ফুসফুসে প্রাপ্ত মাত্রার প্রায় ২১%), তাই ভ্রূণের রক্তে অন্য ধরনের একটি হিমোগ্লোবিন তৈরি হয় যার অক্সিজেনের প্রতি আসক্তি অনেক বেশি। এটি ভ্রূণীয় হিমোগ্লোবিন বা 'হিমোগ্লোবিন এফ' নামে পরিচিত।
১ dL বা ১০০ mL রক্তে অবস্থিত ১৫ g হিমোগ্লোবিনে গ্যাসের পরিমাণ (mL/dL) | ||||
---|---|---|---|---|
ধামনিক রক্ত (PO2 ৯৫mm Hg; PCO2 ৪০ mm Hg; Hb ৯৭% সম্পৃক্ত ) | শিরাস্থ রক্ত (PO2 ৪০ mm Hg; PCO2 ৪৬ mm Hg; Hb ৭৫% সম্পৃক্ত ) | |||
গ্যাস | দ্রবীভূত | সমন্বিত | দ্রবীভূত | সমন্বিত |
O2 | ০.২৯ | ১৯.৫ | ০.১২ | ১৫.১ |
CO2 | ২.৬২ | ৪৬.৪ | ২.৯৮ | ৪৯.৭ |
N2 | ০.৯৮ | ০ | ০.৯৮ | ০ |
রক্তে CO2 পরিবহণ O2 পরিবহণের মতো এত সমস্যাসংকুল নয় কারণ অনেক অস্বাভাবিক পরিস্থতিতেও অক্সিজেনের তুলনায় কার্বন ডাই-অক্সাইড বেশি পরিমাণে পরিবাহিত হতে পারে। রক্তে CO2-এর দ্রাব্যতা অক্সিজেনের তুলনায় ২০ গুণ বেশি; সমান আংশিক চাপে একটি সরল দ্রবণে অক্সিজেনের তুলনায় বেশি পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড থাকে। রক্তে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণের সাথে অম্ল-ক্ষার সাম্যের একটি সম্পর্ক রয়েছে। স্বাভাবিক বিশ্রামরত অবস্থায়, প্রতি ১০০ মি.লি. রক্তে গড়ে ৪ মি.লি. CO2 টিসু থেকে ফুসফুসে পরিবাহিত হয়।কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি থাকে মাইটোকন্ড্রিয়ায়, সেখানে কোষীয় শ্বসনের সময় এটি উৎপন্ন হয়। সেখান থেকে ব্যাপনের মাধ্যমে প্রথমে ইন্টারস্টিশিয়ামে, তারপর রক্তে চলে আসে। বিশ্রামরত অবস্থায় ৭০-কেজি ওজনবিশিষ্ট একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রতি মিনিটে টিসু বিপাকের মাধ্যমে প্রায় ২০০-২৫০ মি.লি. কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয় যেটি শিরাস্থ রক্তের মধ্য দিয়ে দেহ থেকে অপসারণ হওয়ার জন্য ফুসফুসে যায়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ ব্যক্তির কার্ডিয়াক আউটপুট প্রতি মিনিটে ৫ লিটার হওয়ায়, ফুসফুসের মধ্য দিয়ে পরিবাহিত প্রতি ১০০ মি.লি. রক্ত থেকে অবশ্যই ৪ থেকে ৫ মি.লি. কার্বন ডাই-অক্সাইড বিমুক্ত হবে। রক্তের মধ্য দিয়ে CO2-এর মাধ্যমে তিনটি উপায়ে ফুসফুসের অ্যালভিওলাস বা বায়ুস্থলীতে পরিবাহিত হয়:
CO2 + H2O → H2CO3 → H+ + HCO−
3
অধিকাংশ বাইকার্বনেট আয়ন ব্যাপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লোহিত রক্তকণিকা থেকে রক্তরসে চলে আসে এবং বৈদ্যুতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ক্লোরাইড আয়ন লোহিত রক্তকণিকায় প্রবেশ করে, যা 'ক্লোরাইড শিফট' নামে পরিচিত।
কিছু অক্সিহিমোগ্লোবিন অক্সিজেন ত্যাগ করে ডিঅক্সিহিমোগ্লোবিনে পরিণত হয়। ডিঅক্সিহিমোগ্লোবিন অধিকাংশ হাইড্রোজেন আয়নের (H+) সাথে বন্ধন তৈরি করে কারণ অক্সিহিমোগ্লোবিনের তুলনায় এর হাইড্রোজেনের প্রতি আসক্তি বেশি।
লসিকা হলো টিসু তরল যা লসিকাবাহতে প্রবেশ করে। এটি রক্ত থেকে কৈশিক নালির অতিপরিস্রাবণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে টিসুতে তৈরি হয়। ত্বকের এপিডার্মিস বা উপত্বক, শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি, অস্থি মজ্জা ও কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র ব্যতীত দেহের প্রায় সকল অঞ্চল ও অঙ্গসমূহে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লসিকাবাহিকা রয়েছে (ত্বকের ডার্মিস বা অন্তস্ত্বক, ফুসফুস, অন্ত্র, জেনিটোইউরিনারি সিস্টেমে সবচেয়ে বেশি থাকে)। ক্ষুদ্র বাহিকাসমূহের মাধ্যমে সংগৃহীত লসিকা বৃহৎ লসিকাবাহে প্রবেশ করে। অতঃপর এটি থোরাসিক ডাক্ট ও ডান লসিকা নালির মধ্য দিয়ে যথাক্রমে বাম ও ডান সাবক্লেভিয়ান শিরা বা অক্ষক-নিম্ন শিরার মাধ্যমে শিরাস্থ রক্তে প্রবেশ করে। এটিতে তঞ্চন নিয়ামকসমূহ থাকে এবং স্থির অবস্থায় জমাট বাঁধে। অধিকাংশ অবস্থানেই, এটি প্রোটিনও ধারণ করে যা কৈশিক নালির প্রাচীর ভেদ করে এসেছে এবং পুনরায় লসিকার মাধ্যমে রক্তে ফিরে যেতে পারে। তাসত্ত্বেও রক্তরসের তুলনায় লসিকার প্রোটিন উপাদান সাধারণত কম। অন্ত্র থেকে লসিকাবাহতে লিপিড শোষিত হয়, খাবার খাওয়ার পরে থোরাসিক ডাক্টের লসিকা চর্বি বা স্নেহ পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকায় দুধের মতো হয়। লিম্ফোসাইটসমূহও প্রধানত লসিকাবাহের মাধ্যমে সংবহনে প্রবেশ করে।
রক্তসংবহন সারাদেহে তাপ পরিবহণ করে এবং এই প্রবাহের সমন্বয় তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ত্বকের পৃষ্ঠতলে রক্তপ্রবাহের বৃদ্ধি ঘটলে (যেমন গরম আবহাওয়া অথবা কঠোর অনুশীলন) ত্বক উষ্ণতর হয়ে যায়, ফলে তাপ হরণ দ্রুততর হয়। অপরদিকে, বাহ্যিক তাপমাত্রা হ্রাস পেলে, তাপ হরণ প্রতিরোধ করার জন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও ত্বকের পৃষ্ঠতলে রক্তপ্রবাহ হ্রাস পায় এবং দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসমূহে প্রবাহিত হয়।
অঙ্গভেদে রক্তপ্রবাহের হার ভিন্ন হয়। সবচেয়ে বেশি রক্ত সরবরাহ রয়েছে যকৃতে, যেখানে প্রতি মিনিটে প্রায় ১৩৫০ মি.লি. রক্ত প্রবাহিত হয়। রক্ত প্রবাহের দিক দিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে বৃক্ক (১১০০ mL/min) ও মস্তিষ্ক (~৭০০ mL/min)। প্রতি ১০০ গ্রাম টিসুতে রক্ত প্রবাহের আপেক্ষিক হার ভিন্ন হয়, এক্ষেত্রে বৃক্ক, অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি ও থাইরয়েড গ্রন্থি যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
রক্তের রঞ্জক পদার্থ (হিমোক্রোম) রক্তের একটি প্রোটিন যা অক্সিজেন পরিবহণ করে। বিভিন্ন প্রাণী বিভিন্ন প্রোটিন ব্যবহার করে।
মেরুদণ্ডী প্রাণীদের রক্তের রঙের প্রধান নির্ণায়ক হলো হিমোগ্লোবিন। প্রতিটি অণুর চারটি হিম গ্রুপ রয়েছে এবং বিভিন্ন অণুর সাথে তাদের আন্তঃক্রিয়া প্রকৃত রঙের পরিবর্তন ঘটায়। মেরুদণ্ডী প্রাণী ও অন্যান্য হিমোগ্লোবিন-ব্যবহারকারী প্রাণীগুলোর ধামনিক ও কৈশিকার রক্ত উজ্জ্বল লাল, কারণ অক্সিজেন হিম গ্রুপকে একটি কড়া লাল রং প্রদান করে। অক্সিজেন-বিহীন রক্ত একটু গাঢ়তর লাল হয়; এটি শিরায় থাকে এবং রক্তদান ও শিরাস্থ রক্তের নমুনা সংগ্রহ করার সময় দেখা যেতে পারে। এর কারণ হলো, অক্সিজেনযুক্ত ও অক্সিজেন-বিযুক্ত অবস্থায় হিমোগ্লোবিন দ্বারা শোষিত আলোর বর্ণালি আলাদা হয়।
কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়ায় রক্ত টকটকে লাল হয়, কারণ কার্বন মনোক্সাইড (CO) কার্বক্সিহিমোগ্লোবিন ((HbCO) গঠন করে। সায়ানাইড বিষক্রিয়ায়, শরীর অক্সিজেন ব্যবহার করতে পারে না, তাই শিরাস্থ রক্ত অক্সিজেনযুক্ত থাকে, ফলে রক্তের উজ্জ্বলতা বাড়ে। কিছু কিছু অবস্থা আছে যখন হিমোগ্লোবিনের হিম গ্রুপ আক্রান্ত হয়, যা ত্বকের রং কে নীলাভ করে দেয়;– এই লক্ষণটিকে সায়ানোসিস বা নীলাভা বলে। হিম জারিত হলে মেটহিমোগ্লোবিন তৈরি হয়, যেটি অপেক্ষাকৃত বেশি বাদামি রঙের এবং অক্সিজেন পরিবহণে অক্ষম। সালফহিমোগ্লোবিনিমিয়া নামক বিরল ক্ষেত্রে ধামনিক হিমোগ্লোবিন আংশিকভাবে অক্সিজেনযুক্ত হয় এবং নীলাভ আভাযুক্ত গাঢ় লাল বর্ণের হয়। ত্বকের উপরিতলের নিকটবর্তী শিরাগুলো বিবিধ কারণে নীল দেখায়। তবে এই বর্ণ উপলব্ধি বা প্রত্যক্ষকরণের পরিবর্তন শিরাস্থ রক্তের প্রকৃত রঙের তুলনায় বরং ত্বকের আলোক বিক্ষেপণ বৈশিষ্ট্য ও দৃষ্টিকর্টেক্স দ্বারা দৃষ্টিসম্বন্ধীয় ইনপুট প্রক্রিয়াকরণের সাথে সম্পর্কিত। প্রাসিনোহিমা গণের স্কিঙ্ক নামক টিকটিকির রক্তে বিলিভার্ডিন নামক বর্জ্য পদার্থ জমা হওয়ার ফলে এদের রক্ত সবুজ রঙের হয়।
সেফালোপড, গ্যাস্ট্রোপড বা উদরপদ ও কিছু আর্থ্রোপড বা সন্ধিপদী যেমন, রাজ কাঁকড়া অধিকাংশ কম্বোজ প্রাণীর রক্ত নীল, কারণ এদের রক্তে কপারসমৃদ্ধ প্রোটিন হিমোসায়ানিন প্রায় ৫০গ্রাম/লিটার ঘনত্বে থাকে। অক্সিজেনহীন অবস্থায় হিমোসায়ানিন বর্ণহীন, অক্সিজেন যুক্ত হওয়ার পর গাঢ় নীল বর্ণের হয়ে যায়। এই প্রাণীগুলো শীতল পরিবেশে নিম্ন অক্সিজেন চাপে বসবাস করে বলে এদের সংবহনে রক্ত ধূসর-সাদা থেকে অনুজ্জ্বল পীতবর্ণের হয়, এবং রক্তপাতের সময় যখন রক্ত বাতাসের সংস্পর্শে আসে, তখন গাঢ় নীল বর্ণ ধারণ করে। হিমোসায়ানিন জারিত হওয়ায় বর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যায়। হিমোসায়ানিন বহিঃকোষীয় তরলে অক্সিজেন বহন করে, যা স্তন্যপায়ীদের লোহিত রক্তকণিকায় হিমোগ্লোবিনের সাহায্যে অন্তঃকোষীয় অক্সিজেন পরিবহণের বিপরীত।
অধিকাংশ অ্যানিলিডা পর্বের কীট ও কিছু সামুদ্রিক পলিকিট্স বা বহুশূকপদী অক্সিজেন পরিবহণের জন্য ক্লোরোক্রুয়োরিন ব্যবহার করে। লঘু দ্রবণে এটি সবুজ বর্ণের।
সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণী সাইপাঙ্কিউলিড, প্রায়াপিউলিড বা শিশ্ন কীট, ব্র্যাকিয়োপড বা বাহুপদী ও অ্যানেলিড কীট, ম্যাগেলোনার রক্তে অক্সিজেন পরিবহণে হিমারিথ্রিন ব্যবহৃত হয়। অক্সিজেন যুক্ত হলে এটি বেগুনি-গোলাপী রং ধারণ করে।
অ্যাসিডিয়ান ও টিউনিকেট উপপর্বের কিছু প্রজাতির (সামুদ্রিক ফোয়ারা নামেও পরিচিত) রক্তে ভ্যানাডিন নামক প্রোটিন থাকে। এই প্রোটিনগুলো ভ্যানাডিয়াম দিয়ে গঠিত, ফলে এদের দেহে পারিপার্শ্বিক সামুদ্রিক পানির চেয়েও প্রায় ১০০ গুণ বেশি ভ্যানাডিয়াম থাকে। হিমোসায়ানিন ও হিমোগ্লোবিনের মতো হিমোভ্যানাডিন অক্সিজেন পরিবহণ করে না। তবে, অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসলে ভ্যানাডিন সরিষার মতো হলুদ রং হয়ে যায়।
অক্সিজেন ছাড়া অন্যান্য পদার্থসমূহও হিমোগ্লোবিনের সাথে বন্ধন তৈরি করতে পারে; কিছু ক্ষেত্রে, এটি দেহের অনিবর্তনীয় ক্ষতি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কার্বন মনোক্সাইড যখন প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুস থেকে রক্তে বাহিত হয়, তখন এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ কার্বন মনোক্সাইড একমুখী বিক্রিয়ার মাধ্যমে অনিবর্তনীয়ভাবে হিমোগ্লোবিনের সাথে যুক্ত হয়ে কার্বোক্সিহিমোগ্লোবিন নামক যৌগ গঠন করে, যার ফলে অক্সিজেনের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য খুব অল্প পরিমাণ হিমোগ্লোবিন মুক্ত অবস্থায় থাকে, ফলে রক্তের মাধ্যমে খুব অল্প পরিমাণ অক্সিজেন অণু পরিবাহিত হয় এবং ধীরে ধীরে শ্বাসরোধ ঘটায়। বায়ুচলন বেশি হয় না এমন বদ্ধ কক্ষে আগুন লাগলে ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়, কারণ বায়ুতে কার্বন মনোক্সাইড সঞ্চিত হতে থাকে ধূমপানের সময়েও কিছু কার্বন মনোক্সাইড হিমোগ্লোবিনের সাথে যুক্ত হতে পারে।
রক্ত সঞ্চারণের জন্য মানব দাতার নিকট থেকে রক্ত সংগ্রহ করা হয় এবং রক্ত ব্যাঙ্কে সঞ্চয় করে রাখা হয়। মানুষের রক্তের গ্রুপ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে, রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে এবিও রক্তগ্রুপ পদ্ধতি ও রেসাস রক্তগ্রুপ পদ্ধতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গতিহীন গ্রুপের রক্ত পরিসঞ্চালনের ফলে গুরুতর, প্রায়শই প্রাণ-সংহারী জটিলতা তৈরি হতে পারে, সঙ্গতিপূর্ণ গ্রুপের রক্ত পরিসঞ্চালন নিশ্চিত করতে রক্তমিল বা ক্রসম্যাচিং করা হয়। শিরাভ্যন্তরীণ প্রয়োগ করা হয় এমন রক্তের উপাদানগুলো হলো অণুচক্রিকা, রক্তরস, ক্রায়োপ্রিসিপিটেট বা হিম-অধঃক্ষেপ ও সুনির্দিষ্ট তঞ্চন ফ্যাক্টর কনসেন্ট্রেট।
অনেক ধরনের ওষুধ (অ্যান্টিবায়োটিক থেকে শুরু করে কেমোথেরাপি বা রাসায়নিক চিকিৎসা ) অন্তঃশিরা প্রয়োগ করা হয়, কারণ এগুলো পরিপাক নালি থেকে পর্যাপ্তভাবে শোষিত হয় না। গুরুতর তাৎক্ষণিক রক্তপাতের পর, প্লাজমা বা রক্তরস প্রসারক নামে পরিচিত তরল প্রিপারেশনগুলো, শারীরবৃত্তীয় ঘনত্বে লবণের দ্রবণসমূহ (NaCl, KCl, CaCl2 ইত্যাদি), কলোয়ডাল দ্রবণসমূহ, যেমন ডেক্সট্র্যান, মানব সিরাম অ্যালবিউমিন অথবা ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা শিরাভ্যন্তরীণভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ-রকম জরুরি অবস্থায়, রক্ত পরিসঞ্চালনের তুলনায় একটি রক্তরস প্রসারক প্রয়োগ অনেক বেশি ফলপ্রসূ জীবন-রক্ষাকারী পদ্ধতি, কারণ সঞ্চারিত লোহিত রক্তকণিকাসমূহের বিপাক রক্ত সঞ্চারণের পরপরই শুরু হয় না।
আধুনিক তথ্য-প্রমাণ ভিত্তিক মেডিসিন-এ, রক্তমোক্ষণ কতক বিরল রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়, যেমন, হিমোক্রোমাটোসিস বা লৌহ-সঞ্চয় ব্যাধি ও পলিসাইথিমিয়া বা লালিকাধিক্য। তবে, ঊনবিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত রক্তমোক্ষণ ও হিরুডোথেরাপি বা জোঁক চিকিৎসা ছিল খুবই প্রচলিত দুটি অপ্রমাণিত পদ্ধতি, কারণ হিপোক্রেটিসের মেডিসিন অনুসারে ভ্রমাত্মকভাবে অনেক রোগের কারণ হিসেবে রক্তের আধিক্যকে মনে করা হতো।
ইংরেজি blood (প্রাচীন ইংরেজিতে blod) শব্দটির উদ্ভব হয়েছে জার্মানীয় ভাষা থেকে এবং অন্যান্য সকল জার্মানীয় ভাষায় একই রকম অর্থের সমোদ্ভাবিত শব্দ রয়েছে (যেমন, জার্মান Blut, সুইডিশ blod, গথিক blōþ)। কোনো ইন্দ-ইউরোপীয় গৃহীত ব্যুৎপত্তি নেই।
রবিন ফহর্যাউস (একজন সুইডিশ চিকিৎসক যিনি ইএসআর আবিষ্কার করেছিলেন) বলেছিলেন যে, হিউমারিজম বা দেহরসবাদের প্রাচীন গ্রিক পদ্ধতি, যেখানে ভাবা হতো যে দেহ চারটি স্বতন্ত্র দৈহিক তরল ধারণ করে (ভিন্ন ভিন্ন ধাত সহযোগে), একটি স্বচ্ছ পাত্রে রক্ত তঞ্চনের পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। একটি কাঁচের পাত্রে রক্ত টেনে প্রায় এক ঘণ্টা রেখে দিলে, চারটি ভিন্ন স্তর দেখা যায়। তলদেশে একটি কালো পিণ্ড গঠিত হয় (কালো পিত্ত)। পিণ্ডের উপরে লোহিত রক্তকণিকার স্তর। এর উপরে শ্বেতকণিকার সাদা স্তর থাকে (শ্লেষ্মা)। শিরোভাগের স্তরটি অচ্ছ হলুদ সিরাম বা রক্তাম্বু (হলুদ পিত্ত)।
১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে কার্ল ল্যান্ডস্টাইনার এবিও রক্তগ্রুপ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ইয়ান ইয়ান্সকি ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম রক্তকে চারটি শ্রেণিতে (A, B, AB এবং O) ভাগ করেন বলে স্বীকৃতি প্রদান করা হয় যা আজও ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৯০৭ সালে প্রথমবারের মতো উপযুক্ততা নির্ণয়ে এ বি ও পদ্ধতি ব্যবহার করে রক্ত সঞ্চারণ করা হয়। ১৯১৪ সালের ২৭ শে মার্চ সর্বপ্রথম পরোক্ষ রক্ত সঞ্চারণ করা হয়। রেসাস ফ্যাক্টর আবিষ্কার হয় ১৯৩৭ সালে।
টেমপ্লেট:Blood টেমপ্লেট:Lymphocytes
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article রক্ত, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.