তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল

তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল বা বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল (ইংরেজি: Electrical and Electronic Engineering) প্রকৌশল পেশার একটি প্রধান শাখা যা মূলত তড়িৎ বর্তনী ও তড়িৎচুম্বকত্ব নিয়ে কাজ করে। উল্লেখযোগ্য পেশা হিসেবে তড়িৎ প্রকৌশল আত্মপ্রকাশ করে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে, যখন টেলিগ্রাফি এবং বিদ্যুৎশক্তির ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। বর্তমানে তড়িৎ প্রকৌশলের ব্যাপ্তি বিদ্যুৎশক্তি, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ইলেকট্রন বিজ্ঞান, টেলিযোগাযোগ সহ আরও কিছু উপশাখা জুড়ে বিস্তৃত।

তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল
বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বণ্টন ব্যবস্থার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন তড়িৎ প্রকৌশলীগণ করে থাকেন।
তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল
বৈদ্যুতিন প্রকৌশলীরা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ও জটিল বৈদ্যুতিন তড়িৎ বর্তনী তৈরি করে থাকেন।

যখন শুধু তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল বলা হয় তখন মূলত যে শাখা বড় আকারের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা বা যন্ত্রপাতি যেমন বিদ্যুৎশক্তি সঞ্চালন, বৈদ্যুতিক মোটর নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সংক্রান্ত কার্যাবলি সম্পাদন করে তাকে বোঝানো হয়। অন্যদিকে ক্ষুদ্র আকারের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি যেমন কম্পিউটার, সমন্বিত বর্তনী ইত্যাদি বৈদ্যুতিন প্রকৌশলের অন্তর্গত। অন্য কথায় তড়িৎ বা বৈদ্যুতিক প্রকৌশলীগণ সাধারণত শক্তি সঞ্চালনের জন্য বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাকে কাজে লাগান আর বৈদ্যুতিন প্রকৌশল প্রকৌশলীগণ তথ্য আদানপ্রদানের কাজে বিদ্যুৎ শক্তিকে ব্যবহার করেন। মৌলিক তত্ত্বের দিকটি বিবেচনা করলে বলা যায়, তড়িৎ প্রকৌশলে পরিবাহীর মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং বৈদ্যুতিন প্রকৌশলে অর্ধপরিবাহী এবং অন্তরকের মধ্য দিয়ে প্রবাহ নিয়ে আলোচনা করা হয়।

ইতিহাস

আদি ইতিহাস

তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল 
মাইকেল ফ্যারাডের আবিষ্কার থেকে তড়িৎ মোটর ও এ সম্পর্কিত প্রযুক্তির উদ্ভব ও বিকাশ হয়।

সপ্তদশ শতক থেকেই বিদ্যুৎশক্তি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি আকর্ষণীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এর উপরে গবেষণা করার তীব্রতা বাড়তে থাকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে। এই শতকে গেয়র্গ সিমোন ওম, মাইকেল ফ্যারাডে, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ১৮২৭ সালে জর্জ ও'ম কোন তড়িৎ পরিবাহীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত তড়িৎ প্রবাহ ও এর দুই প্রান্তের বিভব পার্থক্যের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয়ের সূত্র প্রদান করেন যা ও‍’মের সূত্র নামে পরিচিত। মাইকেল ফ্যারাডে ১৮৩১ সালে তড়িৎচুম্বকীয় আবেশ আবিষ্কার করেন এবং ১৮৭৩ সালে জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল বিদ্যুৎ ও চৌম্বক শক্তির একীভূত রূপ সম্পর্কিত তত্ত্ব প্রকাশ করেন।

তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল 
টমাস আলভা এডিসন সর্বপ্রথম বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করেন

তখন তড়িৎ প্রকৌশল পদার্থবিজ্ঞানের একটি শাখা হিসেবেই বিবেচিত হতো। পরে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী প্রদান শুরু করে। ১৮৮৩ সালে জার্মানির টেখনিশে উনিভের্সিটেট ডার্মষ্টাট এবং যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মত তড়িৎ প্রকৌশল পাঠ্যসূচী প্রণয়ন করে।

এই সময়ে তড়িৎ প্রকৌশল সম্পর্কিত কাজের পরিমাণ নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৮৮২ সালে সর্বপ্রথম টমাস আলভা এডিসন লোয়ার ম্যানহাটনের ঊনপঞ্চাশ জন গ্রাহকের কাছে ১১০ ভোল্টের বিদ্যুৎ সরবরাহ করেন। তার সরবরাহকৃত বিদ্যুৎ ছিল একমুখী প্রবাহ ধরনের। ১৮৮৭ সালে নিকোলা টেসলা পরিবর্তী প্রবাহ ধরনের বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য কৃতিস্বত্ব বা স্বত্ত গ্রহণ করেন। পরবর্তী কয়েক বছর টেসলা ও এডিসনের মধ্যে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ধরন নিয়ে দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। এই দ্বন্দ্ব বিদ্যুতের লড়াই (War of Currents) নামে পরিচিত। বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সঞ্চালনের পদ্ধতি হিসেবে পরিবর্তী প্রবাহ একমুখী প্রবাহকে সরিয়ে স্থান দখল করে নেয় মূলত সঞ্চালন ব্যবস্থার তুলনামূলক দক্ষতা ও উন্নততর নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে।

এই দুজনের অবদানের কারণে তড়িৎ প্রকৌশল বেশ অগ্রসর হয়ে যায়। আবেশ মোটরপলিফেজ ব্যবস্থার উপরে টেসলার কাজ অনেক দিন ধরে বিজ্ঞানীদেরকে প্রভাবিত করে রাখে। অন্যদিকে টমাস এডিসন বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ এবং স্টক টিকারের প্রভূত উন্নতি ঘটান যা তার কোম্পানির জন্য অত্যন্ত লাভজনক হয়। এডিসনের কোম্পানি পরে বিখ্যাত জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়। ইতিমধ্যে ১৮ শতকের শেষ দিকে তড়িৎ প্রকৌশলের জগতে অন্যান্য দিকপালের আগমন শুরু হয়ে যায়।

তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল 
নিকোলা টেসলা প্রথম দীর্ঘ দূরত্বের বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইন স্থাপন করেন।

আধুনিক উন্নয়ন

বেতারের উন্নয়নের সময়কালে অনেক বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক বেতার এবং ইলেক্ট্রনিক্সের উন্নয়নে অবদান রাখেন। হাইন্‌রিশ হের্ৎস ১৮৮৮ সালে তার বিখ্যাত ইউএইচএফ (UHF) পরীক্ষার সময়ে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে বেতার তরঙ্গ প্রেরণ (স্পার্ক গ্যাপ ট্রান্সমিটারের সাহায্যে) ও চিহ্নিত করতে সক্ষম হন। ১৮৯৫ সালে নিকোলা টেসলা নিউ ইয়র্কের ওয়েষ্ট পয়েন্টে অবস্থিত তার পরীক্ষাগার থেকে ৮০.৪ কিমি দূরে বেতার সংকেত ধরতে সক্ষম হন। ১৯০৪ সালে জন ফ্লেমিং প্রথম বেতার টিউব, যা ডায়োড নামে পরিচিত, আবিষ্কার করেন। দুই বছর পরে রবার্ট ভন লিবেন ও লি ডি ফরেষ্ট পৃথক গবেষণায় বিবর্ধক টিউব বা ট্রায়োড আবিষ্কার করেন। তারপর ১৯৩১ সালে ম্যানফ্রেড ভন আর্ডেনে ক্যাথোড রশ্মি নল আবিষ্কার করেন যা পরবর্তীতে টেলিভিশন উদ্ভাবনে সহায়তা করেছিল। ১৯২০ সালে আলবার্ট হাল ম্যাগনিট্রন আবিষ্কার করেন যা ১৯৪৬ সালে পার্সি স্পেনসারকে মাইক্রোওয়েভ ওভেন উদ্ভাবনে সহায়তা করেছিল। ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ডঃ উইম্পেরিসের নেতৃত্বে রাডার (এটিও ম্যাগনিট্রন ব্যবহার করে তৈরী) উদ্ভাবনের পথে অনেকদূর এগিয়ে যায় এবং ১৯৩৬ সালের আগস্ট মাসে বাউডসেতে প্রথম রাডার কেন্দ্র স্থাপন করে।

১৯৪১ সালে কনরাড ৎসুজে পৃথিবীর প্রথম সম্পূর্ণ র্কমক্ষম ও প্রোগ্রাম করার উপযোগী কম্পিউটার জেডথ্রি (Z3) জনসমক্ষে আনেন। এরপর ১৯৪৬ সালে জন প্রেসপার একার্ট ও জন মাউচলি এনিয়াক উদ্ভাবন করেন যা পৃথিবীতে কম্পিউটার যুগের সূচনা করে। এইসব যন্ত্রের গাণিতিক দক্ষতা বিজ্ঞানীদেরকে অ্যাপোলো মিশন ও নাসার চাঁদে অবতরণ সহ সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটাতে এবং নিত্য নতুন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা করছে।

১৯৪৭ সালে উইলিয়াম ব্র্যাডফোর্ড শকলি, জন বারডিন এবং ওয়াল্টার হাউজার ব্র্যাটেইনের ট্রানজিস্টর উদ্ভাবন ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশের জগতে নতুন দুয়ার উন্মোচন করে এবং এর ফলশ্রুতিতে ১৯৫৮ সালে জ্যাক কিলবি এবং ১৯৫৯ সালে রবার্ট নয়েস পৃথকভাবে সমন্বিত বর্তনী উদ্ভাবন করেন। ইন্টেলের মার্সিয়ান হফ ১৯৬৮ সালে প্রথম মাইক্রোপ্রসেসর উদ্ভাবন করেন এবং ব্যক্তিগত কম্পিউটার আবিষ্কারের পথ করে দেন। যদিও ইন্টেল ৪০০৪, ৪-বিটের প্রসেসর যা ১৯৭১ সালে আবিষ্কৃত হয়, প্রথম মাইক্রোপ্রসেসর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে কিন্তু ১৯৭৩ সালে ৮-বিটের প্রসেসর ইন্টেল ৮০৮০ আবিস্কৃত হওয়ার পরই প্রথম ব্যক্তিগত কম্পিউটারের জন্ম হয়। এই কম্পিউটারটির নাম ছিল অল্টেয়ার ৮৮০০

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা

তড়িৎ প্রকৌশলীগণ একটি স্নাতক সম্মাননা অর্জন করে থাকেন যার প্রধান বিষয় থাকে তড়িৎ প্রকৌশল। এই সম্মাননা সাধারণত চার অথবা পাঁচ বছরের পড়াশোনার সফল সমাপনান্তে প্রদান করা হয় এবং এই সম্মাননা বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে স্নাতক (সম্মান) প্রকৌশল, স্নাতক (সম্মান) বিজ্ঞান, স্নাতক (সম্মান) প্রযুক্তি বা স্নাতক (সম্মান) প্রায়োগিক বিজ্ঞান নামে প্রদান করা হয়। এই সম্মাননার পাঠ্যতালিকায় প্রধানত পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, পপকল্প ব্যবস্থাপনা এবং তড়িৎ প্রকৌশলের নির্দিষ্ট বিষয়াদি থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ের বিষয়গুলোতে তড়িৎ প্রকৌশলের সকল বা প্রায় সকল শাখা সর্ম্পকে শিক্ষাদান করা হয়। পরবর্তীতে পড়াশুনার শেষের দিকে শিক্ষার্থীরা এক বা একাধিক শাখা বেছে নিয়ে তাতে বিশেষত্ব অর্জন করে।

কিছু সংখ্যক তড়িৎ প্রকৌশলী স্নাতকোত্তর সম্মাননা যেমন স্নাতকোত্তর প্রকৌশল সম্মাননা বা প্রকৌশলে এমপিএইচ সম্মাননাও অর্জন করেন। স্নাতকোত্তর প্রকৌশল সম্মাননার পাঠ্যতালিকা গবেষণা, বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা অথবা এই দুইয়ের সংমিশ্রণে গঠিত হয়। যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের অনেক দেশে স্নাতকোত্তর প্রকৌশল সম্মাননাকে একটু দীর্ঘ দৈর্ঘ্যের স্নাতক সমমানের সম্মাননা গণ্য করা হয়।

পেশাদার প্রকৌশলী

বিশ্বের অধিকাংশ দেশে প্রকৌশলে স্নাতক সম্মাননা প্রাপ্তি পেশাদার প্রকৌশলী হবার প্রথম ধাপ হিসেবে গণ্য হয়। প্রকৌশলে স্নাতক সম্মাননা অর্জনের পরে একজন প্রকৌশলীকে পেশাদারিত্বের সনদ অর্জনের জন্য বেশ কিছু শর্ত (প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জনসহ) পূরণ করতে হয়। এই সনদ অর্জনের পরে একজন প্রকৌশলী পেশাদার প্রকৌশলী(যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাদক্ষিণ আফ্রিকায়), চার্টার্ড প্রকৌশলী ( যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, ভারতজিম্বাবুয়েতে), পি ইঞ্জ (বাংলাদেশে), চার্টার্ড পেশাদার প্রকৌশলী (অস্ট্রেলিয়ানিউজিল্যান্ডে), ইউরোপীয় প্রকৌশলী (ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত বেশিরভাগ দেশে) ইত্যাদি নামে অভিহিত হন।

পেশাদারিত্বের সনদ অর্জনের লাভ দেশ ভেদে কমবেশি হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় "কেবলমাত্র একজন পেশাদার প্রকৌশলীই (প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ার) জনস্বার্থে বা ব্যক্তিমালিকানাধীনে নির্মিত প্রকৌশল কাজ সমূহে মোহরাংকন করতে পারবেন।‍" কোন কোন দেশে এই যোগ্যতা রাজ্য এবং রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা বিধিবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে যেমন কুইবেকের "ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাক্ট"। কোন কোন দেশে অবশ্য এরকম কোন আইনের অস্তিত্ব নেই। তবে আইন থাকুক বা নাই থাকুক, সব দেশের সব পেশাদারিত্বের সনদ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ নীতিগত ভাবে একটি নিয়ম মেনে চলে যা তাদের সকল সদস্যকে মেনে চলতে হয় অন্যথায় বহিষ্কৃত হবার সম্ভাবনা থাকে। এভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলি প্রকৌশল পেশার নীতিগত মান সমুন্নত রাখতে মূল্যবান ভূমিকা পালন করে। এমনকি আদালতে যেখানে কাজের জন্য সনদের অত্যন্ত ক্ষুদ্র মূল্য প্রদান করা হয় অথবা মূল্য দেওয়াই হয়না, সেখানেও প্রকৌশলীদের চুক্তিনামা মেনে চলতে হয়। কোন কারণে যদি একজন প্রকৌশলীর নির্মাণ বা কাজ ব্যর্থ হয়, তাহলে তিনি অবহেলার দায়ে অভিযুক্ত হতে পারেন, এমনকি চরমক্ষেত্রে "ক্রিমিনাল নেগলিজেন্স" বা অবহেলার অপরাধে দণ্ডিত হতে পারেন। একজন প্রকৌশলীর কাজকে অবশ্যই আরো অনেক রীতি এবং নীতি যেমন গৃহনির্মাণ নীতি বা পরিবেশ আইন মেনে সম্পন্ন হতে হয়।

তড়িৎ প্রকৌশলীদের উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স (আইইইই) এবং ইন্সটিটিউশন অফ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স (আইইই)। আইইইই-এর ভাষ্যমতে তারা তড়িৎ প্রকৌশলে পৃথিবীর মোট প্রকাশনা ও নিবন্ধের ৩০ শতাংশ প্রকাশ করে, সারা বিশ্বে তাদের ৩৬০,০০০ জনেরও বেশি সদস্য রয়েছে এবং তারা বাৎসরিক ৩০০টিরও বেশি সম্মেলনের আয়োজন করে। আইই ১৪টি জার্নাল প্রকাশ করে, সারা বিশ্বে তাদের সদস্য সংখ্যা ১২০,০০০ জনেরও বেশি, এবং তারা দাবী করে তারা ইউরোপের সর্ববৃহৎ পেশাদার প্রকৌশলী সংস্থা। প্রাযুক্তিক জ্ঞান এবং দক্ষতা প্রকৌশলীদের ভুবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। তাই পেশাদারিত্ব বজায় রাখার স্বার্থে প্রযুক্তি সর্ম্পকিত সংস্থার সদস্য হওয়া, নিজ নিজ ক্ষেত্রের সাময়িকীসমূহে অবহিত থাকা এবং ক্রমাগত জ্ঞানার্জন করার অভ্যাস বজায় রাখা জরুরী।

যন্ত্রপাতি এবং কর্মক্ষেত্র

তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল 
একজন তড়িৎ প্রকৌশলী যে সমস্ত যন্ত্র নিয়ে কাজ করেন তার মধ্যে রাডার একটি

গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম থেকে শুরু করে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন পর্যন্ত তড়িৎ প্রকৌশলীরা প্রযুক্তির একটি বিশাল স্থান দখল করে আছেন। তারা বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা এবং ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশের নকশা প্রণয়ন, আবিষ্কার বা উদ্ভাবন, নিরীক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় তারা টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার নকশা প্রণয়ন করতে পারেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কার্যক্রম দেখাশুনা করতে পারেন, ঘরবাড়ির আলো ও বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থা দেখাশুনা করতে পারেন, গৃহকর্মে ব্যবহার্য যন্ত্রের নকশা প্রণয়ন করতে পারেন অথবা শিল্পকারখানার যন্ত্রপাতির বৈদ্যুতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।

তড়িৎ প্রকৌশলের মূল ভিত্তি হল পদার্থবিজ্ঞান আর গণিত, কারণ এর মাধ্যমে কোন যান্ত্রিক ব্যবস্থার কার্যপদ্ধতি কী হবে তার যৌক্তিক ও গাণিতিক বিশ্লেষন করা যায়। আধুনিককালের বেশিরভাগ প্রকৌশল কার্যক্রমে কম্পিউটার ব্যবহার করা হয় এবং বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা বা যন্ত্রপাতির নকশা প্রনয়নের সময় কম্পিউটারের সহায়তা নেওয়া এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। যদিও চিন্তা বা আইডিয়াগুলো অঙ্কনের মাধ্যমে দ্রুত অন্যদের কাছে পৌঁছে দেয়ার দক্ষতাকে এখনো অমূল্য বিবেচনা করা হয়।

তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল 
কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে যোগাযোগব্যবস্থা সহ ভূ-উপগ্রহ সম্পর্কিত কাজ তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশলীদের কাজের অনেক ক্ষেত্রের মধ্যে অন্যতম।

যদিও সকল তড়িৎ প্রকৌশলীরই প্রাথমিক বর্তনী তত্ত্ব বা সার্কিট থিওরি জানা আছে, তবুও তাদের কাজের ক্ষেত্র বিস্তৃত বলে তারা কাজ অনুসারে বিভিন্ন তত্ত্ব ব্যবহার করেন। মূলত কে কোন তত্ত্ব ব্যবহার করেন তা তাদের কর্মক্ষেত্রের উপরে নির্ভর করে। যেমন একজন তড়িৎ প্রকৌশলী যার কর্মক্ষেত্র ভিএলএসআই (সমন্বিত বর্তনী বা আইসি ডিজাইনের কাজ), তার কাজের জন্য কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান এবং কঠিন অবস্থা পদার্থবিজ্ঞান নিত্য প্রয়োজনীয়, কিন্তু যিনি বৃহদাকারের তড়িৎ যন্ত্রাদি নিয়ে কাজ করেন তার জন্য এগুলো নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। এমনকি একজন তড়িৎ প্রকৌশলী যিনি টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার ডিজাইন নিয়ে কাজ করেন, তার জন্য বর্তনী তত্ত্বও অপ্রয়োজনীয় হতে পারে কারণ তিনি কাজ করেন তৈরি যন্ত্রাংশ নিয়ে। সম্ভবত তড়িৎ প্রকৌশলীদের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দক্ষতা হচ্ছে দৃঢ় গাণিতিক দক্ষতা, কম্পিউটার জ্ঞান এবং তড়িৎ প্রকৌশলের সাথে সম্পর্কিত প্রাযুক্তিক ভাষা ও ধারণা সহজেই আত্মস্থ করার ক্ষমতা।

বেশিরভাগ প্রকৌশলীর ক্ষেত্রেই প্রকৌশল সম্পর্কিত কাজ তাদের কাজের একটা ছোট অংশ। অন্যান্য কাজ যেমন গ্রাহক বা ব্যবহারকারীদের সাথে প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা, বাজেট তৈরী, প্রকল্পের সময়সূচী তৈরি ইত্যাদি তাদের কাজের একটা বড় অংশ বলে বিবেচিত হয়। অনেক জ্যেষ্ঠ বা ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী কলাকুশলী এবং অন্যান্য প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে গঠিত একটা দলের নেতৃত্ব দেন। এজন্য প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দক্ষতা একটা বড় ভূমিকা পালন করে। বেশিরভাগ প্রকৌশল প্রকল্পের সাথে দলিলপত্রাদি তৈরি ও ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন হয় এবং দক্ষ লিখিত যোগাযোগ ক্ষমতা এক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

তড়িৎ প্রকৌশলীদের কাজের স্থান তাদের কাজের ধরনের মতই বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অত্যাধুনিক গবেষণাগারে যেমন তড়িৎ প্রকৌশলীদেরকে দেখা যায়, তেমনি তড়িৎ প্রকৌশলীদেরকে পাওয়া যায় কোন পরামর্শ প্রদানকারী সংস্থার কর্মকর্তা হিসেবে অথবা কোন ভূ-গর্ভস্থ খনিতে। কর্মক্ষেত্রে তড়িৎ প্রকৌশলীগনকে প্রায়ই বিজ্ঞানী, ইলেকট্রিশিয়ান, কম্পিউটার প্রোগ্রামার বা অন্যান্য প্রকৌশলী ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার লোকজনদের কাজকর্ম দেখাশোনা করতে হয়।

শাখাসমূহ

তড়িৎ প্রকৌশলের অনেক শাখা রয়েছে, তার মধ্যে নিম্নোক্ত শাখাগুলো সর্বাপেক্ষা পরিচিত। অনেক তড়িৎ প্রকৌশলী এগুলোর একটি শাখায় কাজ করলেও অনেকেই আবার একাধিক শাখার সমন্বয়ে কাজ করেন। কখনওবা কোন কোন শাখা যেমন ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বা কম্পিউটার প্রকৌশলকে তাদের বিপুল ব্যাপ্তির কারণে প্রকৌশলেরই আলাদা বিভাগ বলে ধরা হয়।

বিদ্যুৎ শক্তি

তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল 
বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার একটি খুঁটি

তড়িৎ সংক্রান্ত প্রকৌশল বা শক্তি প্রকৌশল প্রধানত বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন, সঞ্চালন ও বণ্টন এবং এ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি যেমন রূপান্তরক, বৈদ্যুতিক জেনারেটর, বৈদ্যুতিক মোটর ইত্যাদি তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে কাজ করে। পৃথিবীর অনেক এলাকায় অনেক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের জেনারেটরকে একসাথে একটি কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত করা হয় যাকে গ্রিড বলে। সরকারীভাবে এই গ্রিডের রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখাশোনা করা হয়। বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীগণ এই কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন থেকে নির্দিষ্ট ফি প্রদান করে সস্তায় বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে পারেন। বিদ্যুৎ শক্তি প্রকৌশলীরা এই গ্রিডের নকশা প্রণয়ন ও স্থাপন থেকে শুরু করে এই গ্রিডের সাথে সংযুক্ত হওয়া যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ পর্যন্ত বিভিন্ন কাজ করে থাকেন।

নিয়ন্ত্রণ প্রকৌশল

তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল 
নভোখেয়াযান কলাম্বিয়ার উৎক্ষেপণ

নিয়ন্ত্রণ প্রকৌশল মূলত অত্যাধুনিক যান্ত্রিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক সমূহের নকশা প্রণয়ন নিয়ে কাজ করে যেন এই যান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলোকে চাহিদা অনুযায়ী কাজ করানো যায়। এমন নিয়ন্ত্রক প্রণয়ন করার জন্য তড়িৎ প্রকৌশলীরা তড়িৎ বর্তনী, ডিজিটাল সংকেত প্রসেসর এবং অতিক্ষুদ্র নিয়ন্ত্রক ব্যবহার করে থাকেন। নিয়ন্ত্রণ প্রকৌশলের ব্যবহার আধুনিক বাণিজ্যিক বিমান সংস্থার ফ্লাইট এবং প্রচালন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে অনেক আধুনিক মোটরযানের গতি নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। শিল্প কারখানার স্বনিয়ন্ত্রণের (Automation) ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে।

নিয়ন্ত্রণ প্রকৌশলীরা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রনয়নের সময় প্রায়ই ফিডব্যাক ব্যবস্থা ব্যবহার করেন। উদাহরণ স্বরূপ স্বয়ংক্রীয় গতি নিয়ন্ত্রিত মোটরগাড়ীর কথা বলা যায়। এগুলোতে মোটরযানের গতির উপরে সার্বক্ষনিক নজরদারী করা হয় এবং ফলাফল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় ক্রমাগত প্রেরণ করা হয়। ফলে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ফলাফল অনুসারে গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। নভোখেয়াযান উৎক্ষেপণ থেকে শুরু করে মহাশূন্যে এর পরিচালনায় নিয়ন্ত্রণ প্রকৌশল ব্যবহৃত হয়।

ইলেকট্রনিক্স

তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল 
বিভিন্ন বৈদ্যুতিন যন্ত্রাংশ, আকারের তুলনা করার জন্য উপরে মিলিমিটারে দাগাঙ্কিত একটি রুলার বা মাপকাঠি দেখানো হয়েছে।

ইলেকট্রনিক প্রকৌশল প্রধানত ইলেকট্রনিক বর্তনীর নকশা প্রণয়ন এবং পরীক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হয়। ইলেকট্রনিক বর্তনী সাধারণত রোধক, ধারক, আবেশক, ডায়োড প্রভৃতি দ্বারা কোন নির্দিষ্ট কার্যক্রম সম্পাদন করার জন্য তৈরি করা হয়। বেতার যন্ত্রের টিউনার যেটি শুধুমাত্র আকাংক্ষিত বেতার স্টেশন ছাড়া অন্য গুলোকে বাতিল করতে সাহায্য করে, ইলেকট্রনিক বর্তনীর একটি উদাহরণ। পাশে আরেকটি উদাহরনের ছবি দেওয়া হলো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ইলেকট্রনিক্স প্রকৌশল পরিচিত ছিল রেডিও প্রকৌশল নামে। তখন এর কাজের পরিধি ছিল রাডার, বাণিজ্যিক বেতার এবং আদি টেলিভিশন নিয়ে। বিশ্বযুদ্ধের পরে যখন ভোক্তা বা ব্যবহারকারীকেন্দ্রিক যন্ত্রপাতির উন্নয়ন শুরু হল, তখন থেকে প্রকৌশলের এই শাখা বিস্তৃত হতে শুরু করে এবং আধুনিক টেলিভিশন, অডিও ব্যবস্থা, কম্পিউটার এবং মাইক্রোপ্রসেসর এই শাখার অন্তর্ভুক্ত হয়। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে বেতার প্রকৌশল নামটি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে দশকের শেষ নাগাদ ইলেকট্রনিক্স প্রকৌশল নাম ধারণ করে।

১৯৫৯ সালে সমন্বিত বর্তনী উদ্ভাবনের পূর্বে ইলেকট্রনিক বর্তনী তৈরি হত বড় আকারের পৃথক পৃথক যন্ত্রাংশ দিয়ে। এই সব বিশাল আকারের যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি বর্তনীগুলো বিপুল জায়গা দখল করত এবং এগুলো চালাতে অনেক শক্তি লাগত। এই যন্ত্রাংশগুলোর গতিও ছিল অনেক কম। অন্যদিকে সমন্বিত বর্তনী বা আইসি অসংখ্য (প্রায়ই ১০ লক্ষ বা এক মিলিয়নেরও বেশি) ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তড়িৎ যন্ত্রাংশ, যাদের বেশিরভাগই মূলত ট্রানজিস্টর, দিয়ে গঠিত হয়। এই যন্ত্রাংশগুলোকে একটা ছোট্ট, প্রায় একটা কয়েনের আকারের সিলিকন চিলতে বা চিপের উপরে সমন্বিত করে সমন্বিত বর্তনী তৈরি করা হয়। বর্তমানের অত্যাধুনিক কম্পিউটার বা নিত্য দিনের প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি সবই প্রধানত সমন্বিত বর্তনী বা আইসি দ্বারা নির্মিত।

মাইক্রোইলেকট্রনিক্স

তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল 
১২×৬.৭৫ মিমি আকারের মাইক্রো বর্তনী

মাইক্রোইলেকট্রনিক্স প্রকৌশল অত্যন্ত ক্ষুদ্র, মূলত আণুবীক্ষণীক স্তরে, ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশের নকশা ও নির্মাণ নিয়ে কাজ করে। এসব ক্ষুদ্র ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ সমন্বিত বর্তনী তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয় অথবা কখনো কখনো নিজেরাই ইলেকট্রনিক যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সবচেয়ে প্রচলিত এবং পরিচিত মাইক্রোইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ হচ্ছে অর্ধপরিবাহী ট্রানজিস্টর। কিন্তু সকল প্রধান ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ যেমন রোধক, ধারক, আবেশক ইত্যাদিকে আণুবীক্ষণীক স্তরে তৈরি করা যায়।

প্রায় সকল মাইক্রো ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য সিলিকনকে অন্য কোন রাসায়নিক পদার্থের সাথে আণবিক স্তরে নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে চাহিদামতো ততিচ্চুম্বকীয় বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করা হয়। এই কারণে মাইক্রো ইলেকট্রনিক্সের সাথে কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানরসায়নের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

সংকেত প্রক্রিয়াজাতকরণ

তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল 
বেয়ার ছাঁকনি সংকেত প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবহার করে।

নাম শুনেই বোঝা যায় সংকেত প্রক্রিয়াজাতকরণ মূলত বৈদ্যুতিক বিশ্লেষণ এবং প্রভাবায়নের কাজ করে। সংকেত দুই ধরনের হতে পারে। প্রথমত অ্যানালগ সংকেত, যেখানে সংকেত তথ্য অনুযায়ী ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়। দ্বিতীয়ত ডিজিটাল সংকেত, যেখানে সংকেত তথ্য অনুসারে বিচ্ছিন্ন কিছু মান অনুযায়ী দফায় দফায় পরিবর্তিত হয়। অ্যানালগ সংকেতের ক্ষেত্রে শাব্দিক সংকেত বিবর্ধন ও পরিশ্রুতকরণ এবং টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে সংকেত মড্যুলেশন ও ডিমড্যুলেশন সংকেত প্রক্রিয়াজাতকরণের আওতায় পড়ে। অন্যদিকে ডিজিটাল সংকেতের ক্ষেত্রে ডিজিটালি স্যাম্প্‌লকৃত সংকেতের সংকোচন, ত্রুটি চিহ্নিতকরণ ও ত্রুটি সংশোধন সংকেত প্রক্রিয়াজাতকরণের মধ্যে পড়তে পারে।

টেলিযোগাযোগ

তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল 
মিলস্টার কৃত্রিম উপগ্রহ যোগাযোগ ব্যবস্থা

টেলিযোগাযোগ প্রকৌশল তড়িৎ প্রকৌশলের সেই শাখা যা সমকেন্দ্রিক তার (কো-এক্সিয়াল কেবল), অপটিক্যাল ফাইবার অথবা শূন্যস্থানের মত কোন চ্যানেল বা মাধ্যম দ্বারা তথ্য আদানপ্রদান নিয়ে কাজ করে। শূন্যস্থান দিয়ে তথ্য আদানপ্রদানের খাতিরে তথ্যকে প্রেরণের উপযোগী বাহক কম্পাংকে (ক্যারিয়ার ফিকোয়েন্সি) রূপান্তরের জন্য বাহক তরঙ্গে কোডিং করতে হয়। এই প্রক্রিয়াটির নাম মড্যুলেশন। সুপরিচিত এনালগ মডুলেশন কৌশলের মধ্যে বিস্তার মড্যুলেশন এবং কম্পাংক মডুলেশন উল্লেখযোগ্য। কোন যোগাযোগ ব্যবস্থার দক্ষতা এবং ব্যয় ব্যবহৃত মড্যুলেশন কৌশলের উপরে নির্ভর করে। দক্ষ ব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবেই বেশি ব্যয়বহুল। তাই দক্ষ যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রণয়ন করার সাথে সাথে ব্যয়ও সংকোচন করে এ দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখা প্রকৌশলীর দায়িত্ব।

একটি যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা হয়ে গেলে টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলীগণ তখন ঐ ব্যবস্থায় ব্যবহৃতব্য প্রেরক ও গ্রাহক যন্ত্রের (ট্রান্সমিটার ও রিসিভার) নকশা করেন। কখনো কখনো গ্রাহক ও প্রেরক যন্ত্র একসাথে করে ট্রান্সসিভার নামের উভমুখী যোগাযোগের যন্ত্র তৈরি করা হয়। প্রেরক যন্ত্র ডিজাইন করার সময় এর দ্বারা ব্যবহৃতব্য তড়িৎ শক্তির পরিমাণ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে কারণ এর সাথে প্রেরক যন্ত্রের প্রেরিত সংকেতের শক্তি জড়িত। যদি কোন প্রেরক যন্ত্রের প্রেরিত সংকেতের শক্তি অপর্যাপ্ত হয়, তবে প্রেরিত তথ্যের সাথে নয়েজ মিশে তথ্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

সহায়ক যন্ত্র সম্পর্কিত প্রকৌশল

তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল 
উড়োজাহাজ বা মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রক যন্ত্রপাতিসমূহ পাইলটকে যান নিয়ন্ত্রণের কাজে সহায়তা করে

সহায়ক যন্ত্র সম্পর্কিত প্রকৌশলে প্রধানত পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন জিনিস পরিমাপের যেমন চাপ, তাপমাত্রা, বেগ ইত্যাদি মাপ-জোখের উপযোগী যন্ত্র তৈরী নিয়ে কাজ করা হয়। এই সকল সূক্ষাতিসূক্ষ যন্ত্রপাতি তৈরী করার জন্য পদার্থবিজ্ঞানের উপরে খুব ভালো দখল থাকতে হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ঊড়োজাহাজ নিয়ন্ত্রণের জন্য এমন যন্ত্র প্রয়োজন হয় যা ক্রমাগত বাতাসের গতি এবং ভূমি হতে উচ্চতা মাপতে থাকে। আবার পেলশিয়ার-সীবেক এফেক্ট নীতি ব্যবহার করে তাপযুগলের সাহায্যে যে কোন দুটি বিন্দুর মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য নিরূপণ করা হয়।

প্রায়শঃই দেখা যায় সহায়ক যন্ত্রপাতিসমূহ এককভাবে ব্যবহৃত হয় না, বরং কোন বৃহদ তড়িৎ প্রকৌশল ব্যবস্থার অংশ বা সহায়ক হিসেবে অথবা সংবেদী যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এগুলো এমনকি দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিতেও ব্যবহৃত হয়। যেমন রেফ্রিজারেটরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সুইচটি ব্যবহৃত হয় তা আসলে একটি তাপযুগল। এই তাপযুগল আবার বড় বড় ফার্নেসের স্থির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার কাজেও ব্যবহৃত হয়। এই কারণে সহায়ক যন্ত্র সম্পর্কিত প্রকৌশলকে প্রায়ই নিয়ন্ত্রণ প্রকৌশলের প্রতিরূপ বলা হয়ে থাকে।

কম্পিউটার প্রকৌশল

তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল 
সুপার কম্পিউটার আজকাল নানাবিধ ক্ষেত্রে, যেমন ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থা বা গাণিতিক জীববিজ্ঞানে, ব্যবহার করা হয়

কম্পিউটার প্রকৌশল কম্পিউটার ডিজাইন ও কম্পিউটার ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করে। এর মধ্যে নতুন হার্ডওয়্যার ডিজাইন থেকে শুরু করে পিডিএ ডিজাইন এমনকি কোন শিল্প কারখানা নিয়ন্ত্রণের জন্য কম্পিউটারের ব্যবহার পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত। কম্পিউটার প্রকৌশলীগণ কোন কম্পিউটার ব্যবস্থার সফটওয়্যার নিয়েও কাজ করেন। অবশ্য প্রায়শই জটিল সফটওয়্যার ডিজাইন করাকে সফটওয়্যার প্রকৌশলের মধ্যে ধরা হয় এবং সফটওয়্যার প্রকৌশলকে আলাদা একটি শাখা ধরা হয়। কম্পিউটার প্রকৌশলীগণ যে সমস্ত যন্ত্র সম্পর্কে কাজ করেন, ডেস্কটপ কম্পিউটার তার একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ। বর্তমানে কম্পিউটার ভিডিও গেমের কনসোল থেকে শুরু করে ডিভিডি প্লেয়ার পর্যন্ত নাগরিক জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে জড়িয়ে আছে।

নিদ্যদিনের ব্যবহার্য সকল ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি কম্পিউটারের সবচেয়ে ব্যবহার বেশি লাগছে অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে। আধুনিক গবেষণা এমন স্তরে পৌঁছেছে যে, বাস্তব যন্ত্রপাতির সাহায্যে পরীক্ষণ পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তাই কম্পিউটার সিম্যুলেশন তার জায়াগা করে নিয়েছে। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান, বিশ্বতত্ত্ব, জৈব প্রযুক্তি এবং জিনতত্ত্বে এর ব্যবহার নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। এই বিষয়টি অবশ্য সফ্‌টওয়্যার প্রকৌশলের অধীনে আলোচিত হয়।

সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শাখা

তড়িৎ প্রকৌশল ও যন্ত্র প্রকৌশলের সমন্বয়ে মেকাট্রনিক্স বা তড়িৎযন্ত্র প্রকৌশল শাখার সৃষ্টি হয়েছে। এরকম সমন্বিত যন্ত্র ব্যবস্থাকে ইলেকট্রোমেকানিক্যাল বা তড়িৎযান্ত্রিক ব্যবস্থা বলা হয় এবং এখন এগুলোর দ্রুত প্রসার ঘটছে। স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন ব্যবস্থা, গার্হস্থ্য তাপ নিয়ন্ত্রণ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং উড়োজাহাজ ও মোটর গাড়ীর বিভিন্ন উপব্যবস্থা তড়িৎযান্ত্রিক ব্যবস্থার উদাহরণ।

তড়িৎযান্ত্রিক ব্যবস্থা শব্দটি মূলত বৃহদাকারের ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলেও ভবিষ্যতে অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকৃতির তড়িৎযন্ত্রের ব্যাপক প্রসার ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ডিজিটাল প্রজেক্টরে উন্নত ছবি সৃষ্টির জন্য, ইঙ্কজেট প্রিন্টারে উচ্চ মানের ছবি ছাপার নজল তৈরির জন্য ক্ষুদ্র তড়িৎযন্ত্র (মাইক্রো ইলেকট্রোমেকানিক্যাল ব্যবস্থা - এমইএমএস) ব্যবহৃত হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে যে, ভবিষ্যতে শরীরে অভিযোজন করার উপযোগী অতি ক্ষুদ্র চিকিৎসা যন্ত্র এবং উন্নততর আলোক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রণয়নের কাজে ক্ষুদ্র তড়িৎযন্ত্র সহায়তা করবে।

আরেকটি সম্পর্কিত শাখা হলো বায়োমেডিক্যাল প্রকৌশল, যা মূলত চিকিৎসাবিদ্যার যন্ত্রপাতি ডিজাইন নিয়ে কাজ করে। এর মধ্যে স্থায়ী যন্ত্রপাতি যেমন ভেন্টিলেটর, এমআরআই স্ক্যানার এবং ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাফ মনিটর এবং বহনযোগ্য যন্ত্রপাতি যেমন ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট, কৃত্রিম পেসমেকার এবং কৃত্রিম হৃদযন্ত্র অন্তর্ভুক্ত।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Tags:

তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল ইতিহাসতড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাতড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল পেশাদার প্রকৌশলীতড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল যন্ত্রপাতি এবং কর্মক্ষেত্রতড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল শাখাসমূহতড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শাখাতড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল আরও দেখুনতড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল তথ্যসূত্রতড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল বহিঃসংযোগতড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশলইংরেজি ভাষাইলেকট্রন বিজ্ঞানটেলিগ্রাফিটেলিযোগাযোগতড়িৎতড়িৎ বর্তনীতড়িৎচুম্বকত্বনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপ্রকৌশল

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

কলকাতারামহিন্দি ভাষাকৃত্তিবাসী রামায়ণগাণিতিক প্রতীকের তালিকামৈমনসিংহ গীতিকাবীর শ্রেষ্ঠবাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পটেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকুমিল্লাইউক্রেনে রুশ আক্রমণ (২০২২-বর্তমান)পদ্মা সেতুপরমাণুহযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরআবদুল মোনেম লিমিটেডউমাইয়া খিলাফত২০২২ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জিম্বাবুয়ে সফরবৃষ্টিপাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭০পশ্চিমবঙ্গের নদনদীর তালিকাবদরের যুদ্ধজান্নাতভাইরাসশাহবাজ আহমেদ (ক্রিকেটার)সিঙ্গাপুরশেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ভারতের সংবিধানরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাববিশ্ব দিবস তালিকামুদ্রাসুকুমার রায়দৈনিক যুগান্তরজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়জন্ডিসপুলিশ২০২২–২৩ নিউজিল্যান্ড পুরুষ ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফর (এপ্রিল ২০২৩)আব্বাসীয় খিলাফতউপজেলা পরিষদগ্রামীণ ব্যাংকসাহাবিদের তালিকাভূমি পরিমাপসানি লিওনকারকবাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিইংরেজি ভাষাবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়বৈষ্ণব পদাবলিসম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিলোকনাথ ব্রহ্মচারীপ্রোফেসর শঙ্কুদীপু মনিপশ্চিমবঙ্গের জেলাদ্বিতীয় মুরাদবাংলাদেশের জাতীয় পতাকাবিন্দুশিশ্ন বর্ধনপেশাসমাজবিজ্ঞানদক্ষিণ কোরিয়াবীর্যপূরণবাচক সংখ্যা (ভাষাতত্ত্ব)ফজরের নামাজমাইটোসিসমহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রতুলসীবিশ্বের মানচিত্রশক্তিআরব লিগগাজীপুর জেলাগোপাল ভাঁড়শীর্ষে নারী (যৌনাসন)আরবি ভাষাকিশোরগঞ্জ জেলারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)শিয়া ইসলামের ইতিহাসবাংলাদেশের জনমিতিদ্য কোকা-কোলা কোম্পানিপানিপথের প্রথম যুদ্ধবাংলা ভাষা আন্দোলন🡆 More