নালন্দা (সংস্কৃত: नालन्दा; পালি: Nālandā; /naːlən̪d̪aː/) ছিল প্রাচীন ভারতের মগধ রাজ্যে (অধুনা ভারতের বিহার রাজ্য) অবস্থিত একটি খ্যাতনামা মহাবিহার। এটি বিহারের রাজধানী পাটনা শহরের ৯৫ কিলোমিটার (৫৯ মা) দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত। খ্রিস্টীয় ৫ম শতাব্দী থেকে আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নালন্দা মহাবিহার ছিল ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়।:১৪৯ এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে ইতিহাসবিদগণ বিশ্বের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন।:১৪৮:১৭৪:৪৩:১১৯ বর্তমানে এটি একটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।
नालन्दा | |
অবস্থান | নালন্দা জেলা, বিহার, ভারত |
---|---|
অঞ্চল | মগধ |
ধরন | শিক্ষাকেন্দ্র, প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় |
দৈর্ঘ্য | ৮০০ ফু (২৪০ মি) |
প্রস্থ | ১,৬০০ ফু (৪৯০ মি) |
এলাকা | ১২ হেক্টর (৩০ একর) |
ইতিহাস | |
নির্মাতা | প্রথম কুমারগুপ্ত |
প্রতিষ্ঠিত | খ্রিস্টীয় ৫ম শতাব্দী |
পরিত্যক্ত | খ্রিস্টীয় ১৩শ শতাব্দী |
ঘটনাবলি | ১২০০ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি কর্তৃক লুণ্ঠন ও ধ্বংস |
স্থান নোটসমূহ | |
খননের তারিখ | ১৯১৫–১৯৩৭, ১৯৭৪–১৯৮২ |
প্রত্নতত্ত্ববিদ | ডেভিড বি. স্পুনার, হীরানন্দ শাস্ত্রী, পলক শাহ, জে. এ. পেজ, এম. কুরাইশি, জি. সি. চন্দ্র, এন. নাজিম, অমলানন্দ ঘোষ:৫৯ |
অবস্থা | সংরক্ষিত |
মালিকানা | ভারত সরকার |
ব্যবস্থাপনা | ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ |
জনসাধারণের প্রবেশাধিকার | আছে |
ওয়েবসাইট | ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ |
প্রাতিষ্ঠানিক নাম | নালন্দা মহাবিহার প্রত্নস্থল (নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়), নালন্দা, বিহার |
ধরন | সাংস্কৃতিক |
মানক | iv, vi |
অন্তর্ভুক্তির তারিখ | ২০১৬ (৪০তম অধিবেশন) |
রেফারেন্স নং | ১৫০২ |
স্টেট পার্টি | ভারত |
ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ নং এন-বিআর-৪৩ |
প্রাচীন ভারতে বৈদিক শিক্ষার উৎকর্ষ তক্ষশীলা, নালন্দা, বিক্রমশিলা প্রভৃতি বৃহদায়তন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির স্থাপনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। নালন্দা মহাবিহারের বিকাশ ঘটেছিল খ্রিস্টীয় ৫ম-৬ষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্ত সম্রাটগণের এবং পরবর্তীকালে কনৌজের সম্রাট হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতায়।:৩২৯ গুপ্ত যুগের উদার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ফলশ্রুতিতে খ্রিস্টীয় ৯ম শতাব্দী পর্যন্ত ভারতে এক বিকাশ ও সমৃদ্ধির যুগ চলেছিল। পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে অবশ্য সেই পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। সেই সময় পূর্ব ভারতে পাল শাসনকালে বৌদ্ধধর্মের তান্ত্রিক বিকাশ ছিল ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।:৩৪৪
খ্যাতির মধ্যগগনে থাকাকালীন নালন্দায় ভারত ছাড়াও তিব্বত, চীন, কোরিয়া ও মধ্য এশিয়ার পণ্ডিত ও ছাত্ররা অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করতে আসতেন।:১৬৯ ইন্দোনেশিয়ার শৈলেন্দ্র রাজবংশও যে এই মহাবিহারের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিল, তাও পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে স্পষ্ট।
বর্তমান কালে নালন্দা মহাবিহার সম্পর্কে জানা যায় মূলত হিউয়েন সাং ও ই ৎসিং প্রমুখ পূর্ব এশীয় তীর্থযাত্রী ভিক্ষুদের ভ্রমণ-বিবরণী থেকে। এঁরা খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে নালন্দায় এসেছিলেন। ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথ মনে করেন যে, নালন্দার ইতিহাস হল মহাযান বৌদ্ধধর্মেরই ইতিহাস। হিউয়েন সাং তাঁর ভ্রমণ-বিবরণীতে নালন্দার অবদান হিসেবে যে সকল পণ্ডিতের নাম করেছেন, তাঁদের অনেকেই মহাযান দর্শনের বিকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।:৩৩৪ নালন্দায় সকল ছাত্রই মহাযান এবং বৌদ্ধধর্মের আঠারোটি (হীনযান) সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থাদি অধ্যয়ন করতেন। সেই সঙ্গে বেদ, ন্যায়শাস্ত্র, সংস্কৃত ব্যাকরণ, ভেষজবিদ্যা ও সাংখ্য দর্শনও পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল।:৩৩২–৩৩৩
আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বখতিয়ার খিলজির এই মহাবিহার ধ্বংস করেন। পরে ১৯শ শতাব্দীতে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ প্রাথমিকভাবে এই প্রত্নস্থলে খননকার্য চালায়। ১৯১৫ সালে প্রথম এখানে নিয়মমাফিক খননকার্য শুরু হয় এবং ১২ হেক্টর জমিতে সুবিন্যস্ত এগারোটি মঠ ও ইঁটের তৈরি ছয়টি মন্দির আবিষ্কৃত হয়। এছাড়া ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে প্রচুর ভাস্কর্য, মুদ্রা, সিলমোহর ও উৎকীর্ণ লিপিও আবিষ্কৃত হয়। এগুলির কয়েকটি নিকটবর্তী নালন্দা পুরাতত্ত্ব সংগ্রহালয়ে রক্ষিত আছে।
২০১০ সালে ভারত সরকার বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য একটি প্রস্তাব পাস করে এবং রাজগীরে একটি সমসাময়িক ইনস্টিটিউট নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি "জাতীয় গুরুত্বের ইনস্টিটিউট" হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়েছে।
‘নালন্দা’ নামটির ব্যুৎপত্তি সংক্রান্ত একাধিক তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। চীনা তীর্থযাত্রী হিউয়েন সাং-এর মতে, এই নামটি এসেছে “ন অলম দা” কথাটি থেকে। এই কথাটির অর্থ “উপহার দানে যার বিরাম নেই” বা “অবিরত দান”। অপর চীনা পর্যটক ই ৎসিং অবশ্য বলেছেন যে, ‘নালন্দা’ নামটি ‘নাগ নন্দ’ নামে এক সাপের নাম থেকে এসেছে। উক্ত সাপটি স্থানীয় এক পুষ্করিণীতে বাস করত।:৩ নালন্দায় খননকার্য পরিচালনাকারী হীরানন্দ শাস্ত্রী বলেছেন যে, এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে ‘নাল’ (পদ্মের মৃণাল) পাওয়া যেত। তাই ‘নালন্দা’ নামটির আদি অর্থ ছিল ‘যা নাল অর্থাৎ পদ্মের মৃণাল প্রদান করে’।
প্রাচীনকালে নালন্দা ছিল একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। মগধের রাজধানী রাজগৃহ (অধুনা রাজগির) হয়ে যে বাণিজ্যপথটি চলে গিয়েছিল, নালন্দা সেই পথের ধারেই অবস্থিত ছিল। কথিত আছে, জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর ১৪টি চতুর্মাস নালন্দায় অতিবাহিত করেছিলেন। আরও বলা হয় যে, গৌতম বুদ্ধও নালন্দার নিকটবর্তী পাবরিক নামক আম্রবনে উপদেশ দান করেছিলেন। বুদ্ধের দুই প্রধান শিষ্যের অন্যতম সারিপুত্ত নালন্দা অঞ্চলেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং এখানেই নির্বাণ লাভ করেন।:১৪৮:২২৮ উক্ত দুই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব ৫ম-৬ষ্ঠ শতাব্দীতেও একটি গ্রাম হিসেবে নালন্দার অস্তিত্ব ছিল।
পরবর্তী কয়েকশো বছর নালন্দার অবস্থা কেমন ছিল তা জানা যায় না। ১৭শ শতাব্দীতে তিব্বতি লামা তারানাথ লিখেছেন যে, খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মৌর্য সম্রাট অশোক নালন্দায় সারিপুত্তের চৈত্যের স্থানে একটি বৃহৎ মন্দির নির্মাণ করান। তারানাথ আরও লিখেছেন যে, খ্রিস্টীয় ৩য় শতাব্দীতে মহাযান দার্শনিক নাগার্জুন ও তাঁর শিষ্য আর্যদেব ছিলেন নালন্দার ব্যক্তিত্ব। নাগার্জুন নালন্দার অধ্যক্ষও হয়েছিলেন। তারানাথের দেওয়া তথ্য থেকে এটুকু বোঝা যায় যে, খ্রিস্টীয় ৩য় শতাব্দীর আগেও নালন্দা ছিল বৌদ্ধধর্ম চর্চার একটি উদীয়মান কেন্দ্র। কিন্তু এই ধরনের তথ্যের সপক্ষে কোনও পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। খ্রিস্টীয় ৫ম শতাব্দীতে চীনা পর্যটক ফাহিয়েন ভারতে এসে সারিপুত্তের পরিনির্বাণ স্থল ‘নালো’ পরিদর্শন করেছিলেন। তিনি সেখানকার উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য হিসেবে একটি মাত্র স্তুপেরই নাম করেন।:৩৭:৪
নালন্দা মহাবিহারের নথিবদ্ধ ইতিহাসের সূচনা ঘটেছে গুপ্তযুগে। একটি সিলমোহর থেকে জানা যায় যে, এই মহাবিহারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শক্রাদিত্য নামে এক রাজা। হিউয়েন সাং ও অপর এক কোরীয় তীর্থযাত্রী উল্লেখ করেছেন যে, পর্যন্যবর্মণ এই স্থানে একটি সঙ্ঘারাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।:৪২ শক্রাদিত্য হলেন গুপ্ত সম্রাট প্রথম কুমারগুপ্ত (রাজত্বকাল আনুমানিক ৪১৫-৪৫৫)। নালন্দায় তাঁর মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে।:১৬৬:৩২৯ তাঁর উত্তরসূরি বুদ্ধগুপ্ত, তথাগতগুপ্ত, বালাদিত্য ও বজ্র পরবর্তীকালে আরও কয়েকটি মঠ ও মন্দির নির্মাণ করিয়ে নালন্দা মহাবিহারকে প্রসারিত ও পরিবর্ধিত করেন।:৫
সাধারণভাবে গুপ্ত রাজবংশ ছিল একটি ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজবংশ। যদিও নরসিংহগুপ্ত (বালাদিত্য) মহাযান দার্শনিক বসুবন্ধুর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি নালন্দায় একটি সঙ্ঘারাম এবং ৩০০ ফুট উঁচু একটি বিহার নির্মাণ করান। এই বিহারে বুদ্ধের একটি মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। হিউয়েন সাং-এর মতে, এই বিহারটি ছিল “বোধিবৃক্ষের তলায় নির্মিত মহাবিহারটির” অনুরূপ। তিনি আরও লিখেছেন যে, বালাদিত্যের পুত্র বজ্রও “ভক্তিসমাহিত চিত্তে” একটি সঙ্ঘারাম নির্মাণ করান।:৪৫:৩৩০
গুপ্তোত্তর যুগে দীর্ঘকাল যাবৎ বহু রাজা “ভাস্করদের দক্ষতাকে ব্যবহার করে” নালন্দায় নতুন নতুন বিহার, মঠ ও মন্দির নির্মাণ করিয়ে যান। কোনও এক সময়ে “মধ্য ভারতের এক রাজা” নালন্দা মহাবিহার চত্বরের অট্টালিকাগুলিকে পরিবেষ্টন করে একদ্বারবিশিষ্ট উচ্চ একটি প্রাচীর নির্মাণ করান। পূর্ণবর্মণ নামে আরেক জন রাজা (ইনি সম্ভবত মৌখরী রাজবংশের রাজা, যাঁকে “অশোক-রাজার বংশের শেষ বংশধর বলা হয়) ৮০ ফুট উঁচু তামার একটি বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করান। তিনি সেই মূর্তির জন্য ছয়টি ধাপবিশিষ্ট একটি বেদিও নির্মাণ করিয়েছিলেন।:৫৫
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর নালন্দা মহাবিহারের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কনৌজের সম্রাট হর্ষবর্ধন (রাজত্বকাল খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দী)। হর্ষবর্ধন বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন এবং নিজেকে নালন্দার ভিক্ষুদের দাস মনে করতেন। তিনি মহাবিহারের মধ্যে পিতলের একটি মঠ নির্মাণ করিয়েছিলেন এবং ১০০টি গ্রাম থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব নালন্দার জন্য মঞ্জুর করেছিলেন। এছাড়াও তিনি সেই গ্রামগুলির ২০০ জন গৃহস্থকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁরা যেন মহাবিহারের ভিক্ষুদের চাহিদা অনুসারে রোজ চাল, মাখন ও দুধ সরবরাহ করেন। নালন্দার প্রায় এক হাজার ভিক্ষু কনৌজে হর্ষবর্ধনের রাজকীয় উপাসনা সভায় উপস্থিত থাকতেন।:১৫১:৫
খ্রিস্টীয় ৮ম শতাব্দীর আগের নালন্দা সম্পর্কে তথ্যের মূল সূত্রগুলি হল চীনা ভিক্ষু হিউয়েন সাং-এর ভ্রমণবিবরণী সি-য়ু-কি এবং ই ৎসিং-এর ভ্রমণবিবরণী ভারত ও মালয় দ্বীপমালায় আচরিত বৌদ্ধধর্মের একটি বিবরণী ।
চীনা তীর্থযাত্রী ভিক্ষু হিউয়েন সাং ভারত পর্যটন করেন ৬৩০ থেকে ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে।:১১০ ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রথমবার নালন্দায় এসেছিলেন। এরপর ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি দ্বিতীয়বার নালন্দায় আসেন। নালন্দার মঠে তিনি প্রায় দুই বছর সময় অতিবাহিত করেছিলেন।:২৩৭ নালন্দায় তাঁকে সাদরে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল। শুধু তাই নয়, নালন্দায় তাঁর ভারতীয় নামকরণ করা হয়েছিল ‘মোক্ষদেব’।:৮ নালন্দার তদনীন্তন অধ্যক্ষ শীলভদ্রের অধীনে তিনি সেখানে অধ্যয়ন করেন।:১১১ সেই যুগে যোগাচার মতটি অংশত চীনে প্রচারিত হয়েছিল। হিউয়েন সাং মনে করতেন, শীলভদ্র যোগাচার বিষয়ে এক অতুলনীয় শিক্ষক এবং তাঁর কাছে শিক্ষালাভ করতে পেয়ে তাঁর বিদেশযাত্রার শ্রম সার্থক হয়েছে। বৌদ্ধশাস্ত্র ছাড়াও হিউয়েন সাং নালন্দায় ব্যাকরণ, ন্যায়শাস্ত্র ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি এই মহাবিহারে শিক্ষাদানও করেন।:১২৪
নালন্দায় অবস্থানকালে হিউয়েন সাং তাঁর বাসকক্ষের জানলার বাইরের দৃশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন:
...সম্পূর্ণ মহাবিহারটি ইষ্টকনির্মিত একটি প্রাচীরের দ্বারা পরিবেষ্টিত। এই প্রাচীরটি সমগ্র মহাবিহারটিকে বাইরে থেকে ঘিরে রেখেছে। একটি দ্বার দিয়ে এই মহৎ মহাবিহারে প্রবেশ করতে হয়। [সঙ্ঘারামের] মধ্যে অন্যান্য আটটি সভাগৃহ সেই মহাবিহার থেকে পৃথক অবস্থায় রয়েছে। সুসজ্জিত স্তম্ভ ও পরি-সদৃশ্য স্তম্ভশীর্ষগুলি একত্রে সূচালো পর্বতশীর্ষের ন্যায় সন্নিবেশিত। মনে হয় যেন, মানমন্দিরগুলি [সকালের] কুয়াশায় এবং স্তম্ভশীর্ষের কক্ষগুলি মেঘের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে।
হিউয়েন সাং ছিলেন হর্ষবর্ধনের সমসাময়িক এবং তাঁর সম্মানীয় অতিথি। হিউয়েন সাং হর্ষবর্ধনের জনকল্যাণমুখী কাজকর্মের বর্ণনা দিয়েছেন।:৫৫ হিউয়েন সাং-এর জীবনীকাল হয়ুই-লি লিখেছেন যে, নালন্দায় মহাযান দর্শনের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হত বলে কয়েকজন স্থবির এই মহাবিহারটিকে পছন্দ করতেন না। কথিত আছে, রাজা হর্ষবর্ধন ওড়িশা পরিদর্শনে গেলে তাঁরা নালন্দাকে পৃষ্ঠপোষকতা দানের জন্য রাজার নিন্দা করেন, নালন্দায় যে ‘আকাশকুসুম’ দর্শনের শিক্ষা দেওয়া হয় তার উপহাস করেন এবং বলেন যে, হর্ষবর্ধনের উচিত একটি কাপালিক মন্দিরেরও পৃষ্ঠপোষকতা করা।:৩৩৪ হর্ষবর্ধন এই কথা নালন্দার অধ্যক্ষকে জানালে, তিনি সাগরমতি, প্রজ্ঞারশ্মি, সিংহরশ্মি ও হিউয়েন সাং-কে ওড়িশার ভিক্ষুদের মত খণ্ডন করার জন্য প্রেরণ করেন।:১৭১
চীনে প্রত্যাবর্তনকালে হিউয়েন সাং ২০টি অশ্বপৃষ্ঠে ৫২০টি পেটিকায় করে ৬৫৭টি বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ (যার মধ্যে অনেকগুলিই ছিল মহাযান ধর্মগ্রন্থ) ও ১৫০টি সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে যান। এছাড়া তিনি নিজে ৭৪টি গ্রন্থ অনুবাদ করেছিলেন।:১১০:১৭৭ তাঁর চীনে প্রত্যাবর্তনের পরবর্তী ৩০ বছরে অন্যূন এগারো জন চীনা ও কোরীয় পর্যটক নালন্দায় এসেছিলেন।:৯
ফাহিয়েন ও হিউয়েন সাং-এর ভ্রমণবিবরণী পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে তীর্থযাত্রী ই ৎসিং শ্রীবিজয়ে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেন এবং ৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন। তিনি ভারতে চোদ্দো বছর অতিবাহিত করেছিলেন। এর মধ্যে দশ বছর তিনি কাটিয়েছিলেন নালন্দা মহাবিহারে।:১৪৪ ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি যখন চীনে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন সঙ্গে করে ৪০০টি সংস্কৃত গ্রন্থ নিয়ে যান। তারপরেই সেগুলি অনূদিত হয়।
হিউয়েন সাং তাঁর ভ্রমণবিবরণীতে ৭ম শতাব্দীর ভারতের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক চিত্র বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু ই ৎসিং তাঁর বিবরণ নিবদ্ধ রেখেছিলেন মূলত বৌদ্ধধর্মের উৎসভূমি ভারতে সেই ধর্মের চর্চা ও মঠের ভিক্ষুদের প্রথা, রীতিনীতি ও নিয়ম-নির্দেশিকার বর্ণনার মধ্যেই। ই ৎসিং লিখেছেন যে, ২০০টি গ্রামের (উল্লেখ্য, হিউয়েন সাং-এর সময় এই গ্রামের সংখ্যা ছিল ১০০টি) রাজস্বের আয় থেকে নালন্দার রক্ষণাবেক্ষণ চলত।:১৫১ তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায়, নালন্দা মহাবিহারে আটটি সভাগৃহ ও প্রায় ৩০০টি কক্ষ ছিল।:১৬৭ তিনি লিখেছেন, নালন্দার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অঙ্গ ছিল সকলের দ্বারা আচরিত একাধিক অনুষ্ঠান। প্রতিদিন সকালে একটি ঘণ্টাধ্বনির মাধ্যমে স্নানের সময় নির্দেশ করা হত। এই ঘণ্টাধ্বনি শুনে শতাধিক বা সহস্রাধিক ভিক্ষু নিজ নিজ বিহার থেকে বেরিয়ে চত্বরের মধ্যস্থ বা পার্শ্বস্থ একাধিক বিশালাকায় জলাধারে উপস্থিত হতেন এবং স্নান করতেন। এরপর আরেকটি ঘণ্টাধ্বনির মাধ্যমে বুদ্ধপূজার সময় নির্দেশ করা হত। সন্ধ্যায় ‘চৈত্যবন্দনা’ অনুষ্ঠিত হত। চৈত্যবন্দনার অঙ্গ ছিল ‘তিন পর্বের সেবা’, নির্দিষ্ট স্তোত্র, শ্লোক ও ধর্মগ্রন্থের নির্বাচিত অংশ পাঠ। এই অনুষ্ঠানটি সাধারণত মহাবিহারের কেন্দ্রস্থলে অনুষ্ঠিত হত। তবে ই ৎসিং লিখেছেন যে, নালন্দার অধিবাসীদের সংখ্যা এতটাই বেশি ছিল যে, প্রতিদিন এক স্থানে সকলের সমাবেশ কঠিন ছিল। তাই একটি সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান প্রচলিত হয়। এই অনুষ্ঠানে একজন পুরোহিত ধূপ ও পুষ্পবহনকারী সাধারণ ভৃত্য ও শিশুদের সঙ্গে করে একটি সভাগৃহ থেকে অন্য সভাগৃহে গিয়ে গিয়ে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করতেন। গোধূলির মধ্যেই এই অনুষ্ঠান শেষ হত।:১২৮–১৩০
খ্রিস্টীয় ৮ম শতাব্দীতে উত্তর-পূর্ব ভারতে পাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দী পর্যন্ত পাল রাজারা এই অঞ্চল শাসন করেছিলেন। পাল রাজবংশ ছিল একটি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী রাজবংশ। তাঁদের রাজত্বকালে নালন্দায় অনুশীলিত মহাযান মতবাদের সঙ্গে বজ্রযান নামে পরিচিত মহাযান দর্শনের তন্ত্র-প্রভাবিত একটি মতবাদের মিশ্রণ ঘটে। নালন্দা মহাবিহার গুপ্তযুগের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বহন করত এবং সেই উত্তরাধিকার ছিল বহু-প্রশংসিত। পাল সম্রাটরা একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। তাঁদের শাসনকালে নালন্দার আদলে জগদ্দল, ওদন্তপুরী, সোমপুর ও বিক্রমশিলায় চারটি মহাবিহার গড়ে ওঠে। উল্লেখ্য, পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল নালন্দা থেকে মাত্র ৬ মাইল (৯.৭ কিমি) দূরে ওদন্তপুরী মহাবিহারটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।:৩৪৯–৩৫২
নালন্দায় প্রাপ্ত উৎকর্ণ লিপিগুলি থেকে জানা যায়, গোপালের পুত্র ধর্মপাল ছিলেন নালন্দার পৃষ্ঠপোষক। উল্লেখ্য, তিনি বিক্রমশিলা মহাবিহারটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে পালযুগে নালন্দার সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ধর্মপালের পুত্র দেবপাল (রাজত্বকাল খ্রিস্টীয় ৯ম শতাব্দী)। তিনি সোমপুর মহাবিহারটি প্রতিষ্ঠা করেন। নালন্দার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে থেকে পাওয়া একাধিক ধাতুমূর্তিতে দেবপালের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া দুটি গুরুত্বপূর্ণ উৎকীর্ণ লিপি থেকেও তাঁর কথা জানা যায়। প্রথমটি হল একটি তাম্রলিপি। এই লিপি থেকে জানা যায়, সুবর্ণদ্বীপের (অধুনা ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা) শৈলেন্দ্র-বংশীয় রাজা বলপুত্রদেব “নালন্দার বহুমুখী উৎকর্ষে আকৃষ্ঠ হয়ে” সেখানে একটি মঠ নির্মাণ করেন এবং সেটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেবপালের কাছে পাঁচটি গ্রামের রাজস্ব অনুমোদন করার অনুরোধ জানান। দেবপাল তাঁর অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। ঘোসরাওয়ান উৎকীর্ণ লিপিটি হল দেবপালের সমসাময়িক কালের অপর একটি উৎকীর্ণ লিপি। এই লিপি থেকে জানা যায়, তিনি বীরদেব নামে এক বৈদিক পণ্ডিতকে অভ্যর্থনা জানান এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বীরদেব পরবর্তীকালে নালন্দার অধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়েছিলেন।:১৫২:৫৮:২৬৮
পালযুগে পূর্ব ভারতের পাঁচটি বৌদ্ধ উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র একটি রাষ্ট্র-পরিচালিত কার্যক্রম গঠন করেছিল। পণ্ডিতেরা সহজেই একটি শিক্ষাকেন্দ্র থেকে অপর শিক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে বিভিন্ন পদ অলংকৃত করতে পারতেন। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব প্রতীকচিহ্ন ছিল। সেই প্রতীকচিহ্নের কেন্দ্রে একটি ধর্মচক্র (সারনাথের মৃগদাবে বুদ্ধের প্রথম ধর্মোপদেশ দান বা ‘ধর্মচক্র-প্রবর্তনে’র প্রতীক) এবং তার দুই পাশে দুটি হরিণের চিত্র অঙ্কিত থাকত। এই প্রতীকচিহ্নের নিচে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটির নাম খোদিত থাকত। নালন্দার ক্ষেত্রে এই নামটি ছিল ‘শ্রী-নালন্দা-মহাবিহার-আর্য-ভিক্ষুসঙ্ঘস্য’ (অর্থাৎ, “নালন্দা মহাবিহারের সম্মানীয় ভিক্ষুদের সঙ্ঘ”)।:৩৫২:৫৫
বহু শিলালিপি ও সাহিত্যিক উপাদান থেকে জানা যায়, পাল রাজন্যবর্গ উদারভাবে নালন্দার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তবে পালযুগে অন্যান্য মহাবিহারগুলি নালন্দা থেকে অনেক শিক্ষিত ভিক্ষুকে গ্রহণ করায় নালন্দা একক গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। পালযুগে বৌদ্ধধর্মের উপর বজ্রযানের প্রভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল। নালন্দার উপরেও তার প্রভাব পড়েছিল। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি অতীতে মহাযান মতবাদকে কেন্দ্র করে এক উদার উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল, সেই নালন্দা মহাবিহার ধীরে ধীরে তান্ত্রিক মতবাদ ও জাদুবিদ্যার অনুশীলনে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে। তারানাথ ১৭শ শতাব্দীতে যে ইতিহাস গ্রন্থটি রচনা করেন, তাতে দাবি করা হয়েছে যে, নালন্দা সম্ভবত কোনও এক সময় বিক্রমশিলা মহাবিহারের অধ্যক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীনেও এসেছিল।:৩৪৪–৩৪৬:১০
নালন্দা মহাবিহারের যে অংশে আজ পর্যন্ত খননকার্য চালানো হয়েছে, তার আয়তন শুধুমাত্র দৈর্ঘ্যে ১,৬০০ ফুট (৪৮৮ মি) ও প্রস্থে ৮০০ ফুট (২৪৪ মি) বা প্রায় ১২ একর। তবে মধ্যযুগে নালন্দার আয়তন আরও বড়ো ছিল।:২১৭ নালন্দা মহাবিহার একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যকীর্তি। এটির বৈশিষ্ট্য হল একটি প্রকাণ্ড প্রাচীর ও তার একটিমাত্র প্রবেশ্বদ্বার। নালন্দায় আটটি পৃথক চত্বর ও দশটি মন্দির ছিল। সেই সঙ্গে অনেকগুলি ধ্যানকক্ষ ও শ্রেণিকক্ষও ছিল। নালন্দা ছিল একটি আবাসিক মহাবিহার। এখানে ছাত্রদের বহুশয্যাবিশিষ্ট বাসকক্ষও ছিল। খ্যাতির মধ্যগগনে থাকাকালীন নালন্দা মহাবিহারে ১০,০০০ ছাত্র ও ২,০০০ শিক্ষক ছিলেন। চীনা তীর্থযাত্রীদের মতে অবশ্য নালন্দার ছাত্রসংখ্যা ছিল ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ জনের মধ্যবর্তী।
সব ধরনের বিষয় এখানে অধীত হত। কোরিয়া, জাপান, চীন, তিব্বত, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য ও তুরস্ক থেকে ছাত্র ও পণ্ডিতেরা এখানে অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করতে আসতেন।
হিউয়েন সাং-এর বিবরণীতে ৭ম শতাব্দীর নালন্দা মহাবিহারের একটি বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, কীভাবে সুশৃঙ্খল সারিবদ্ধ স্তম্ভ, সভাগৃহ, হার্মিক ও মন্দিরগুলিকে “আকাশে কুয়াশার উপর উড্ডয়নশীল” মনে হত, যাতে নিজেদের কক্ষ থেকে ভিক্ষুরা “বায়ু ও মেঘের জন্মদৃশ্যের সাক্ষী থাকতে পারতেন”।:১৫৮ তিনি লিখেছেন::১৫৯
মঠগুলির চারিপাশে একটি নীল হ্রদ প্রবাহিত থাকত। সেই হ্রদে ভেসে থাকত পূর্ণ-প্রস্ফুটিত নীল পদ্ম; সুন্দর সুন্দর লাল কনক ফুল এখানে ওখানে দুলত, আর আম্রকুঞ্জের বাইরে অধিবাসীরা তাঁদের গভীর ও নিরাপদ আশ্রয় লাভ করতেন।
ই ৎসিং যে দশ বছর নালন্দায় অতিবাহিত করার পর প্রচুর গ্রন্থ সঙ্গে নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, সেই বিষয়ে ইতিহাসবিদগণ নিশ্চিত। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, এই মহাবিহারে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ছিল। প্রথাগত তিব্বতি সূত্র অনুসারে, নালন্দার গ্রন্থাগারটির নাম ছিল ‘ধর্মগঞ্জ’ (‘ধর্মের হাট’)। তিনটি বহুতলবিশিষ্ট ভবনে এই গ্রন্থাগারটি অবস্থিত ছিল। ভবনগুলির নাম ছিল ‘রত্নসাগর’ (‘রত্নের মহাসাগর’), ‘রত্নোদধি’ (‘রত্নের সমুদ্র’) ও ‘রত্নরঞ্জক’ (‘রত্নখচিত’)। রত্নোদধি ছিল নয়টি তলবিশিষ্ট ভবন। এখানেই পবিত্রতম ধর্মগ্রন্থ প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র ও গুহ্যসমাজ রক্ষিত ছিল।:১৫৯:১৭৪
নালন্দা মহাবিহারের গ্রন্থাগারে ঠিক কত বই ছিল তা জানা যায় না। তবে অনুমান করা হয়, সেখানে লক্ষাধিক গ্রন্থ ছিল। সেই গ্রন্থাগারে শুধুমাত্র ধর্মগ্রন্থের পুথিই রক্ষিত ছিল না। বরং ব্যাকরণ, ন্যায়শাস্ত্র, সাহিত্য, জ্যোতিষবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভেষজবিদ্যা-সংক্রান্ত গ্রন্থাবলিও ছিল। ইতিহাসবিদগণের অনুমান, নালন্দা মহাবিহারের গ্রন্থাগারটির একটি শ্রেণিবিন্যাস ক্রম ছিল এবং এই ক্রমটি সংস্কৃত ভাষাবিদ পাণিনির শ্রেণিবিন্যাস ক্রমের ভিত্তিতে বিন্যস্ত হয়েছিল।:৪ বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলি খুব সম্ভবত ত্রিপিটকের প্রধান তিনটি বিভাগের (বিনয় পিটক, সুত্ত পিটক ও অভিধম্ম পিটক) ভিত্তিতে বিন্যস্ত ছিল।:৩৭
হিউয়েন সাং-এর জীবনগ্রন্থে হয়ুই-লি লিখেছেন যে, নালন্দার সকল ছাত্রই মহাযান ও বৌদ্ধধর্মের আঠারোটি (হীনযান) সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করতেন। এছাড়াও তাঁরা বেদ, ‘হেতুবিদ্যা’ (ন্যায়শাস্ত্র), ‘শব্দবিদ্যা’ (ব্যাকরণ ও ভাষাতত্ত্ব), ‘চিকিৎসাবিদ্যা’ (ভেষজবিদ্যা), জাদুবিদ্যা-সংক্রান্ত অন্যান্য গ্রন্থ (অথর্ববেদ) ও সাংখ্য দর্শন অধ্যয়ন করতেন।:৩৩২–৩৩৩
হিউয়েন সাং নিজে শীলভদ্র ও অন্যান্যদের কাছে একাধিক বিষয় অধ্যয়ন করেছিলেন।:৬৫ ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন ছাড়াও ন্যায়শাস্ত্রে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত বিতর্ক ও আলোচনাসভার আয়োজন করা হত। নালন্দা মহাবিহারের প্রত্যেক ছাত্রকে দর্শনের সকল শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ন্যায়শাস্ত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অধ্যয়ন করতে হত এবং সেই সঙ্গে তাঁকে বৌদ্ধধর্মের সপক্ষে যুক্তি দর্শিয়ে অন্যান্য মত খণ্ডন করতে হত।:৭৩ এছাড়াও অনুমান করা হয় যে, নালন্দায় আইন, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও নগর-পরিকল্পনা প্রভৃতি বিষয় শিক্ষাদান করা হত।
প্রথাগত তিব্বতি বিশ্বাস অনুসারে, নালন্দায় “চারটি ডক্সোগ্রাফি” (তিব্বতি:গ্রুব-মথা) শিক্ষাদান করা হত:
হিউয়েন সাং-এর হিসাব অনুসারে, ৭ম শতাব্দীতে নালন্দায় প্রায় ১৫১০ জন শিক্ষক ছিলেন। এঁদের মধ্যে প্রায় ১০০০ জন সূত্র ও শাস্ত্রের ২০টি সংকলন ব্যাখ্যা করতে পারতেন, ৫০০ জন ৩০টি সংকলন ব্যাখ্যা করতে পারতেন এবং মাত্র ১০ জন ৫০টি সংকলন ব্যাখ্যা করতে পারতেন। হিউয়েন সাং নিজে ছিলেন সেই অল্পসংখ্যক শিক্ষকদের অন্যতম যাঁরা ৫০টি বা ততোধিক সংকলন ব্যাখ্যা করতে পারতেন। সেই সময় অধ্যক্ষ শীলভদ্রই কেবলমাত্র সূত্র ও শাস্ত্রের সকল প্রধান সংকলনগুলি অধ্যয়ন করেছিলেন।
চীনা ভিক্ষু ই ৎসিং লিখেছেন যে, নালন্দার সকল অধিবাসী ভিক্ষুর সম্মতিসাপেক্ষে কাজকর্ম ও প্রশাসন পরিচালনা-সংক্রান্ত সমস্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হত। এই ক্ষেত্রে তাঁরা একত্রে সমবেত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন:
কার্যসম্পাদনের জন্য ভিক্ষুদের সমবেত হয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে হত। তারপর তাঁর বিহারপালকে আদেশ করতেন, তিনি যাতে অধিবাসী সকল ভিক্ষুর কাছে গিয়ে গিয়ে করজোড়ে বিষয়টি নিবেদন ও বিজ্ঞাপিত করেন। একজন ভিক্ষুরও সম্মতি না পাওয়া গেলে প্রস্তাবটি গৃহীত হত না। তাঁকে মতপ্রকাশ করার জন্য বলপ্রয়োগ করতে হত না। যদি কোনও ভিক্ষু সকল অধিবাসীর সম্মতি ব্যতিরেকে কিছু করতেন, তবে তাঁকে বলপূর্বক মঠ ছাড়তে বাধ্য করা হত। কোনও বিষয়ে মতানৈক্য হলে তাঁরা সম্মতি অর্জনের জন্য (অপর গোষ্ঠীর সম্মুখে) যুক্তি প্রদর্শন করতে পারতেন। সম্মতি অর্জনের জন্য বলপ্রয়োগ বা চাপ সৃষ্টি করা হত না।
হিউয়েন সাংও লিখেছেন::১৫৯
এই পূতচরিত্র ব্যক্তিত্বদের সকলের জীবন স্বাভাবিকভাবেই নিয়ন্ত্রিত হত সর্বাধিক ভাবগম্ভীর ও কঠোরতম অভ্যাসের মাধ্যমে। তাই মঠের সাতশো বছরের ইতিহাসে কেউই শৃঙ্খলাভঙ্গ করেননি। রাজা মঠের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের চিহ্ন বর্ষণ করতেন এবং একশো শহর থেকে আহৃত রাজস্ব ধার্মিকদের ভরণপোষণের জন্য ব্যয় করতেন।
তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের মহাযান ও বজ্রযান উভয় শাখারই একটি বড়ো অংশের উৎস হল নালন্দার শিক্ষক-পরম্পরা ও প্রথা-রীতিনীতি। খ্রিস্টীয় ৮ম শতাব্দীতে তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের প্রচারে প্রধান ভূমিকা নেন নালন্দার বিশিষ্ট পণ্ডিত শান্তরক্ষিত। তিব্বতের রাজা খ্রি-স্রোং-দেউ-ৎসাং তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি সাম্যেতে একটি মঠও প্রতিষ্ঠা করেন। শান্তরক্ষিত ছিলেন সেই মঠের প্রথম অধ্যক্ষ। তিনি ও তাঁর শিষ্য কমলশীল দর্শনের প্রাথমিক শিক্ষাদান করেছিলেন। উল্লেখ্য, কমলশীলও ছিলেন নালন্দা মহাবিহারের পণ্ডিত। ৭৪৭ খ্রিস্টাব্দে তিব্বতের রাজা নালন্দা মহাবিহার থেকে পদ্মসম্ভবকে আমন্ত্রণ জানান। তাঁকেই তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক মনে করা হয়।:১১
ভারতীয় দার্শনিক ন্যায়শাস্ত্রের অন্যতম বৌদ্ধ প্রবর্তক পণ্ডিত ধর্মকীর্তি (আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দী) নালন্দা মহাবিহারে যে বৌদ্ধ পরমাণুবাদ শিক্ষা দেওয়া হত, তার অন্যতম আদি তাত্ত্বিক ছিলেন।
ভিয়েতনাম, চীন, কোরিয়া ও জাপানে অনুসৃত মহাযান সহ বৌদ্ধধর্মের অন্যান্য শাখাগুলিও নালন্দা মহাবিহারেই বিকাশ লাভ করেছিল। একাধিক গবেষকের মতে, পূর্ব এশীয় বৌদ্ধধর্মের গুরুত্বপূর্ণ সুত্র সুরঙ্গমা সূত্র সহ কয়েকটি মহাযান ধর্মগ্রন্থ নালন্দায় প্রচলিত মতবাদের অনুসারী।:২৬৪ রন এপস্টেইন আরও বলেছেন যে, এই সূত্রের সাধারত মতবাদটি অবশ্যই নালন্দায় গুপ্তযুগের শেষভাগে যে বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা দেওয়া হত, তার অনুগামী। সেই সময়েই সূত্রটি অনূদিত হয়েছিল।
প্রথাগত সূত্র থেকে জানা যায় যে, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ ও ৫ম শতাব্দীতে মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধ দুজনেই নালন্দায় এসেছিলেন। তাছাড়া নালন্দা হল বুদ্ধের অন্যতম বিখ্যাত শিষ্য সারিপুত্রের জন্ম ও নির্বাণলাভের স্থান।:১৪৮
ভারত থেকে বৌদ্ধধর্মের অন্তর্ধানের সঙ্গে নালন্দা মহাবিহারের গুরুত্ব কমতে থাকে। খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে ভারতের বিভিন্ন স্থান পর্যটনের সময় হিউয়েন সাং লক্ষ্য করেছিলেন যে, বৌদ্ধধর্ম ধীরে ধীরে পতনের দিকে এগিয়ে চলেছে। শুধু তাই নয়, তিনি নালন্দার পরিসমাপ্তির দুঃখজনক পূর্বাভাসও পেয়েছিলেন।:১৪৫ সেই সময় বৌদ্ধধর্ম দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিল। কেবলমাত্র অধুনা বিহার ও বাংলা অঞ্চলের রাজারাই এই ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করছিলেন। পাল শাসনকালে বৌদ্ধধর্মের প্রথাগত মহাযান ও হীনযান সম্প্রদায়ে গোপন আচার-অনুষ্ঠান ও জাদুবিদ্যা-কেন্দ্রিক তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্ম অন্তর্ভুক্ত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে বৈষ্ণব ও শৈব দার্শনিকদের পুনঃউত্থান হয় এবং ১১শ শতাব্দীতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশের রাজ্যচ্যুতি ঘটে । ফলে সেই সময় বৌদ্ধধর্মের রাজনৈতিক, দার্শনিক ও নৈতিক প্রভাব কমে এসেছিল। কিন্তু সেই সময়ও ভারতের কয়েকটি বৌদ্ধ মঠের উত্থান বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল। খ্রিস্টীয় ১৩শ শতাব্দীতে মুসলমানেরা সেগুলি আক্রমণ করে। সেইটিই ছিল ভারতে বৌদ্ধধর্মের উপর শেষ আঘাত।:২০৮:১৩:৩৩৩
এ জ্ঞানপীঠকেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। বেশ কয়েকবার বহিঃশত্রুর আক্রমণের মুখে পড়ে নালন্দা। প্রথমবার স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ খ্রি.) মিহিরকুলের নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হুনরা নালন্দা আক্রমণ করে। তারা বৌদ্ধ ছাত্র ও ধর্মগুরুদের হত্যা করে। স্কন্দগুপ্ত ও তার পরের বংশধররা নালন্দাকে পুণর্গঠন করেছিলেন।
খ্রিস্টীয় ১৩শ শতাব্দীতে তুর্কি গোষ্ঠীপতি বখতিয়ার খিলজি অবধের সেনানায়ক নিযুক্ত হয়। ফারসি ইতিহাসবিদ মিনহাজ-ই-সিরাজ তাঁর তাবাকাত-ই-নাসিরি গ্রন্থে পরবর্তী কয়েক দশকে বখতিয়ার খিলজির লুটতরাজের বিবরণ নথিভুক্ত করেছেন। বিহার সীমান্তের দুটি গ্রাম খিলজির হাতে সমর্পিত হয়েছিল। এই গ্রামদুটি রাজনৈতিকভাবে কার্যত মালিকানাহীন অঞ্চলে পরিণত হয়। সুযোগ বুঝে খিলজি বিহারে লুটতরাজ শুরু করেন। তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাঁকে এই কাজের জন্য স্বীকৃতি ও পুরস্কার দুইই দেন। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে খিলজি বিহারের একটি দুর্গ আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন এবং সেটি দখল করতে সক্ষমও হন। এই দুর্গ থেকে তিনি প্রচুর ধনসম্পত্তি লুট করেন। তাবাকাত-ই-নাসিরি গ্রন্থে এই লুণ্ঠনের বিবরণ পাওয়া যায়:
মুহাম্মদ-ই-বখত-ইয়ার সাহসের সঙ্গে খিড়কি দরজা দিয়ে সেই স্থানে প্রবেশ করেন, দূর্গটি দখল করেন এবং প্রচুর সামগ্রী লুট করেন। সেই স্থানের অধিকাংশ বাসিন্দাই ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং এই সকল ব্রাহ্মণদের সকলেরই মস্তক ছিল মুণ্ডিত। তাঁদেরকে হত্যা করা হয়। সেখানে প্রচুর বই ছিল।কিন্ত সেই সব বইয়ের অর্থ উদ্ধার করার মত কেউ বেঁচে ছিল না।তুর্কীরা পরে বুঝতে পারে এটি একটি মহাবিদ্যালয় ছিল।
উপরিউক্ত উদ্ধৃতিতে একটি বৌদ্ধ মঠ (বিহার) ও তার ভিক্ষুদের (মুণ্ডিতমস্তক ব্রাহ্মণ) উপর আক্রমণের কথা বলা হয়েছে। তবে বিভিন্ন ঐতিহাসিকের মত এটা ছিলো ওদন্তপুরী বিহার। কিন্তু যেহেতু নালন্দা ও ওদন্তপুরী মহাবিহারের দুরত্ব মাত্র কয়েক কিলোমিটার তাই নালন্দার ক্ষেত্রেও একই পরিণতি হয়েছিল বলে ধরা হয়।সেই যুগের অপর দুই বিহার বিক্রমশিলা ও জগদ্দল তুর্কীদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। এই সময়ের ঘটনাবলির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ হল তিব্বতি ভিক্ষুক ধর্মস্বামীর জীবনী।তিনি ১২৩৪ থেকে ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে আসেন।তিনি যখন ওদন্তপুরী আসেন তখন সেটি তুর্কী সেনাদের দুর্গে পরিণত হয়েছিল। নালন্দার অবস্থাও ছিল শোচনীয়।নালন্দায় রাহুল শ্রীভদ্র নামে নবতিপর শিক্ষক ৭০ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দান করতেন।ধর্মস্বামীর জীবনী অনুযায়ী তুর্কীরা নালন্দা সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে পারে নি।তার মতে নালন্দা চত্বরের জ্ঞাননাথ মন্দিরটি অপবিত্র করার পর এক তুর্কী সেনা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।
ধর্মস্বামী ছয়মাস নালন্দায় ছিলেন। নালন্দার ঐতিহাসিক গ্রন্থাগার তুর্কীদের আক্রমণের ফলে সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। তিনি নালন্দার উপর আরেকটি তুর্কী আক্রমণের প্রত্যক্ষদর্শীও ছিলেন।নিকটবর্তী ওদন্তপুরী মহাবিহার তখন তুর্কীদের সামরিক প্রধান কার্যালয়ে পরিণত হয়েছিল। সেখান কার মুসলিম সেনারা নালন্দা আক্রমণ করে।কেবলমাত্র ধর্মস্বামী ও তাঁর শিক্ষক রয়ে যান ও তাঁরা লুকিয়ে পড়েন। বাকি ভিক্ষুকরা অন্যত্র পালিয়ে যান।
সমসাময়িক তথ্যসূত্রের সমাপ্তি এখানেই ঘটেছে। তবে প্রথাগত তিব্বতি গ্রন্থ, যেগুলি অনেক পরবর্তীকালে রচিত হয়, সেগুলিতে বলা হয়েছে যে, নালন্দা আরও কিছুকাল চালু ছিল। যদিও এই মহাবিহার তখন তাঁর পূর্বের গরিমা সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছিল। লামা তারানাথ বলেছেন যে, তুর্কিরা সমগ্র মগধ জয় করেছিল এবং নালন্দা সহ বহু মঠ ধ্বংস করেছিল। নালন্দার প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। তবে তিনি আরও বলেছেন যে, চগলরাজা নামে বাংলার এক রাজা এবং তাঁর রানি পরবর্তীকালে ১৪শ ও ১৫শ শতাব্দীতে নালন্দার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তবে কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেখানে হয়নি।:১৫১
১৮শ শতাব্দীতে লিখিত পাগ সাম জোন জাং নামক গ্রন্থে আরেকটি তিব্বতি কিংবদন্তির কথা জানা যায়। এই কিংবদন্তি অনুসারে, মুদিত ভদ্র নামে এক বৌদ্ধ সাধু নালন্দার চৈত্য ও বিহারগুলি মেরামত করেন এবং তৎকালীন রাজার এক মন্ত্রী কুকুটসিদ্ধ সেখানে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। আরেকটি গল্প অনুসারে, ভবনটির যখন উদ্বোধন করা হচ্ছিল, তখন দুই জন ক্রুদ্ধ তীর্থিক ভিক্ষুক (ব্রাহ্মণ) সেখানে উপস্থিত হন। কয়েকজন তরুণ শিক্ষানবিশ ভিক্ষু তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন এবং তাঁদের গায়ে কাপড় কাচার জল ছিটিয়ে দেন। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সেই ভিক্ষুকেরা সূর্যকে প্রসন্ন করার জন্য বারো বছর তপস্যা করেন এবং তপস্যার শেষে একটি যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন। যজ্ঞকুণ্ডের ‘জাগ্রত ভষ্ম’ তাঁরা বৌদ্ধ মন্দিরগুলির উপর ছিটিয়ে দেন। এতে নালন্দার গ্রন্থাগারে আগুন লেগে যায়। কিন্তু রত্নোদধির পবিত্র পুথিগুলির থেকে অলৌকিক উপায়ে জল নির্গত হয় এবং বহু পুথি রক্ষা পায়। সেই ভিক্ষুকেরা তাঁদের নিজেদের জ্বালা আগুনেই ভষ্ম হয়ে যান।:২০৮:৩৪৩:১৫ এই ঘটনাটি কবে ঘটেছিল, তা সঠিক জানা যায় না। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ (যার মধ্যে পোড়া চালের একটি ছোটো ঢিপিও রয়েছে) জানা যায়, একাধিকবার নালন্দা চত্বরের কয়েকটি ভবনে বড়োসড়ো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল।:২১৪:৫৬ একটি শিলালিপি থেকে মহীপালের (রাজত্বকাল: ৯৮৮-১০৩৮ খ্রিস্টাব্দ) শাসনকালে নালন্দা মহাবিহারে একটি অগ্নিকাণ্ড এবং তারপরে মহাবিহারের পুনঃসংস্কারের কথা জানা যায়।:১৩
মধ্য এশিয়া, ইসলাম ও বৌদ্ধধর্ম বিষয়ক পণ্ডিত, সাউদার্ন মেথোডিস্ট বিশ্ববিদ্যালয় এর ধর্ম শিক্ষা বিষয়ক অধ্যাপক এবং প্রধান জোনাথন এলভার্সকগ একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে নালন্দার পতন ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, নালন্দায় বৌদ্ধদের কার্যক্রম শত শত বছর ধরে হয়েছে। তিনি বলেন, একজন ভারতীয় একজন ভারতীয় প্রভু "কুবলাই খান এর সভায় যাবার পূর্বে নালন্দায় শিক্ষিত ও সজ্জিত হন"। চৈনিক সন্যাসীগণ চতুর্দশ শতকেও নালন্দায় বিভিন্ন গ্রন্থ সংগ্রহ করতে গিয়েছেন। তিনি বলেন, "বৌদ্ধ ধর্ম অন্তত সপ্তদশ শতক পর্যন্ত ভারতবর্ষে টিকে ছিল"।
পতনের পর নালন্দা প্রায় বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছিল। ১৮১১-১৮১২ সাল নাগাদ স্থানীয় অধিবাসীরা সেই অঞ্চলে ধ্বংসস্তুপের একটি বিরাট চত্বরের দিকে ফ্রান্সিস বুকানন-হ্যামিলনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, তিনি সেই ক্ষেত্রটিতে সমীক্ষা চালান। যদিও তিনি মাটি ও ভগ্নাবশেষের সেই স্তুপকে ঐতিহাসিক নালন্দা মহাবিহার হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেননি। ১৮৪৭ সালে এই চিহ্নিতকরণের কাজটি করেন মেজর মার্কহ্যাম কিট্টো। আলেকজান্ডার কানিংহ্যাম ও সদ্যগঠিত ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (এএসআই) ১৮৬১-১৮৬২ সালে এখানে একটি সরকারি সমীক্ষা চালায়।:৫৯ ১৯১৫ সালের আগে এএসআই এই ক্ষেত্রটিতে নিয়মমাফিক খননকার্য শুরু করেনি। এই খননকার্য শেষ হয় ১৯৩৭ সালে। দ্বিতীয় দফায় খননকার্য ও পুনঃসংস্কার সংগঠিত হয়েছিল ১৯৭৪ ও ১৯৮২ সালে।
নালন্দার ধ্বংসাবশেষ যে জমির উপর অবস্থিত তার দৈর্ঘ্য উত্তর থেকে দক্ষিণে ১,৬০০ ফুট (৪৮৮ মি) এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে ৮০০ ফুট (২৪৪ মি)। খননকার্যের ফলে সুবিন্যস্ত পরিকল্পনায় সজ্জিত এগারোটি মঠ ও ইঁটের তৈরি ছয়টি প্রধান মন্দির আবিষ্কৃত হয়েছে। একটি ১০০ ফু (৩০ মি) প্রশস্ত পথ উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রসারিত ছিল। এই পথের পশ্চিম দিকে ছিল মন্দিরগুলি এবং পূর্ব দিকে ছিল মঠগুলি।:২১৭ অধিকাংশ স্থাপনা পর্যবেক্ষণ করে এই প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে, বিভিন্ন সময়ে এই স্থাপনাগুলি নির্মিত হয়। পুরনো ভবনের ধ্বংসাবশেষের উপরে নতুন ভবনও নির্মিত হয়েছিল। অনেক ভবনেই অন্তত একবার অগ্নিকাণ্ডের চিহ্ন বর্তমান রয়েছে।:২৭
নালন্দার সবকটি মঠই নকশা ও সাধারণ গঠনভঙ্গিমার দিক থেকে অনেকটা একই রকম। এগুলির নকশা আয়তাকার। এগুলির কেন্দ্রে ছিল একটি চতুষ্কোণাকার অঙ্গন, যেটি একটি বারান্দা দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকত। বারান্দাটি আবার বাইরের দিক থেকে ভিক্ষুদের বাসের জন্য নির্মিত কক্ষের বহিঃস্থ সারির দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকত। কেন্দ্রীয় কক্ষটির মুখ ছিল অঙ্গনটির প্রবেশপথের দিকে। এই কক্ষটি ছিল মন্দিরকক্ষ। এটির নির্মাণশৈলী এমন ছিল যাতে ভবনটিতে প্রবেশ মাত্রেই মন্দিরকক্ষটির দিকে দৃষ্টি যায়। ১ক ও ১খ সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত ভবনদুটি ছাড়া সবকটি মঠের মুখ ছিল পশ্চিম দিকে এবং সেগুলির পয়ঃপ্রণালীর মুখ ছিল পূর্ব দিকে। সিঁড়িগুলি ভবনগুলির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে নির্মিত হয়েছিল।:২১৯:২৮ ১ সংখ্যক মঠটিকে সর্বপ্রাচীন মনে করা হয়। এটি মঠশ্রেণির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এই ভবনটিতে নির্মাণকার্যের একাধিক স্তর পরিলক্ষিত হয়। মনে করা হয়, এই নিম্নবর্তী মঠটি ৯ম শতাব্দীতে দেবপালের রাজত্বকালে শ্রীবিজয়ের রাজা বালপুত্রদেবের অর্থানুকূল্যে নির্মিত হয়েছিল। এই ভবনটি আদিতে অন্তত দোতলা উঁচু ছিল এবং এখানে উপবিষ্ট বুদ্ধের একটি বিশালাকার মূর্তি ছিল।:১৯
নালন্দা মহাবিহার চত্বরের স্থাপনাগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ৩ নং মন্দিরটি। একাধিক সিঁড়ি এই মন্দিরটির শীর্ষদেশ অবধি উঠে গিয়েছে। প্রথম দিকে মন্দিরটি ছিল একটি ক্ষুদ্রকায় স্থাপনা। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে এটির আকার বৃদ্ধি পায়। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানা যায় যে, সর্বশেষ কাঠামোটি এই ধরনের সাতটি পুনর্নির্মাণের ফলে গঠিত হয়। এই স্তরবিশিষ্ট মন্দিরগুলির মধ্যে ৫ নং মন্দিরটি সর্বাপেক্ষা অধিক মনোগ্রাহী ও সর্বাধিক সুসংরক্ষিত। এই মন্দিরটির চার কোণে চারটি স্তম্ভ রয়েছে। এগুলির মধ্যে তিনটি স্তম্ভ বহির্মুখী। সিঁড়ির ধারের স্তম্ভগুলিও গুপ্তযুগীয় শিল্পকলায় সমৃদ্ধ অসাধারণ প্যানেলে সজ্জিত। এই প্যানেলগুলিতে নানারকম স্টাকো মূর্তি খোদিত রয়েছে। এই মূর্তিগুলিতে বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বগণ, জাতক কাহিনির দৃশ্যাবলি, শিব, পার্বতী, কার্তিক ও গজলক্ষ্মী প্রমুখ ব্রাহ্মণ্য দেবদেবী, বাদ্যরত কিন্নর, মকরদের বিভিন্ন রূপ এবং নরনারীর মৈথুনচিত্র দেখা যায়। এই মন্দিরটির চারদিকে ব্রতোদ্যাপনকল্পে স্থাপিত অনেকগুলি স্তুপ দেখা যায়। সেগুলির কয়েকটি ইটের তৈরি। এগুলির গায়ে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ থেকে নানা উদ্ধৃতি খোদিত রয়েছে। ৩ নং মন্দিরের শীর্ষদেশে একটি বেদিকক্ষ রয়েছে। বর্তমানে এই কক্ষে একটি বেদি রয়েছে। অতীতে এই বেদির উপর বুদ্ধের একটি বিশাল মূর্তি স্থাপিত ছিল।:২২২:১৭
২ নং মন্দিরে ২১১টি ভাস্কর্য প্যানেলের একটি ড্যাডো দেখা যায়। এই প্যানেলগুলিতে ধর্মীয় মোটিফ এবং শিল্পকলার ও দৈনন্দিন জীবনের নানা দৃশ্য লক্ষিত হয়। ১৩ নং মন্দির চত্বরটির বৈশিষ্ট্য হল চারটি কক্ষযুক্ত ইটের তৈরি ধাতু গলানোর একটি চুল্লি। এখানে পোড়া ধাতু ও ধাতুমল আবিষ্কৃত হয়েছে। তা থেকে বোঝা যায় যে, এটি ধাতু নিষ্কাষণের কাজে ব্যবহৃত হত। এই মন্দিরটির উত্তর দিকে রয়েছে ১৪ নং মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ। সেই মন্দিরে বুদ্ধের প্রকাণ্ড একটি মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। এই মূর্তির বেদিটিই নালন্দার একমাত্র ম্যুরাল চিত্রকলার নিদর্শন, যা অদ্যাবধি রক্ষিত আছে।:৩১–৩৩
অসংখ্য ভাস্কর্য, ম্যুরাল, তামার পাত, উৎকীর্ণ লিপি, সিলমোহর, মুদ্রা, ফলক, মৃৎপাত্র এবং পাথর, ব্রোঞ্জ, স্টাকো ও টেরাকোটায় নির্মিত শিল্পকলা নালন্দার ধ্বংসাবশেষের ভিতর থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে যে বৌদ্ধ ভাস্কর্যগুলি রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন ভঙ্গিমায় বুদ্ধের মূর্তি, অবলোকিতেশ্বর, জম্ভল, মঞ্জুশ্রী, মারীচি ও তারার মূর্তি। এছাড়াও ধ্বংসাবশেষের মধ্যে থেকে বিষ্ণু, শিব-পার্বতী, গণেশ, মহিষাসুরমর্দিনী ও সূর্য – এই সকল ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর মূর্তিও পাওয়া গিয়েছে।
নালন্দা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ভিক্ষুরা কিছু পুথি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। এগুলির কয়েকটি এখনও পাওয়া যায়। নিম্নলিখিত সংগ্রহশালাগুলিতে তা রক্ষিত আছে:
১৯৫১ সালে নালন্দা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষের কাছে বিহার সরকার প্রাচীন মহাবিহারটির অনুকরণে পালি ও বৌদ্ধধর্ম শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে নব নালন্দা মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করে। ২০০৬ সালে এটি একটি পরিগণ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায়।
২০১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর নালন্দার নিকটবর্তী রাজগিরে ১৫ জন ছাত্র নিয়ে একটি আধুনিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষাবর্ষের সূচনা ঘটে। প্রাচীন শিক্ষাকেন্দ্রটির পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়। ভারত সরকার এই বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষাপ্রাঙ্গন গঠনের জন্য ৪৫৫ একর জমি এবং ২৮২৮ কোটি টাকা (প্রায় ৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) অনুমোদন করে। চীন, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দেশের সরকারও এই বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনে অর্থসাহায্য করে।
নালন্দা বিহার রাজ্যের একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। ভারত ও বিদেশের প্রচুর পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন। বৌদ্ধ পর্যটন পথেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্যস্থল হল নালন্দা।
নালন্দার ধ্বংসাবশেষের কাছে দর্শকদের সুবিধার জন্য ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ একটি জাদুঘর পরিচালনা করে। এই জাদুঘরে নালন্দা ও নিকটবর্তী রাজগির থেকে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রী প্রদর্শিত হয়েছে। তবে ১৩,৪৬৩টি প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে মাত্র ৩৪৯টিই দর্শকরা দেখার সুযোগ পান। এগুলি চারটি গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়।
হিউয়েন সাং মেমোরিয়াল হল হল একটি ইন্দো-চীনা যৌথ উদ্যোগ। চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু ও পর্যটক হিউয়েন সাংয়ের সম্মানার্থে এই সভাঘরটি স্থাপিত হয়েছে। এই সভাঘরে হিউয়েন সাংয়ের মাথার খুলির একটুকরো হাড় প্রদর্শিত হয়েছে।
নালন্দার ধ্বংসাবশেষের কাছে নালন্দা মাল্টিমিডিয়া মিউজিয়াম নামে আরেকটি জাদুঘর বেসরকারি উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছে। এই জাদুঘরে নালন্দার ইতিহাস ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন ও অন্যান্য মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article নালন্দা, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.