হিউয়েন সাঙ

হিউয়েন সাঙ (বা হিউয়েন-সাং বা হুয়ান-সাং বা জুয়ানজ্যাং চীনা: 玄奘; ফিনিন: Xuán Zàng; ওয়েড-জাইলস: Hsüan-tsang শ্যুয়্যান্‌ ৎসাং) (৬০২ – ৬৬৪) ছিলেন বিখ্যাত চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু, পণ্ডিত, পর্যটক এবং অনুবাদক। তিনি উত্তর ভারতের সম্রাট হর্ষবর্ধন (৬০৬ – ৬৪৭) এর রাজত্বকালে চৈনিক এবং ভারতীয় বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ধারণামতে ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের কোন এক সময়ে তিনি ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলেন, এবং ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ তিনি বাংলায় প্রবেশ করেন। তিনি তার ভারত ভ্রমণ শুরু করেছিলেন লানপো বা লামখান থেকে। লামখানকে তৎকালীন ভারতবর্ষের লোকেরা লম্পক নামে ডাকত। তিনি বালখজুমধ, গচি, বামিয়ান এবং কপিশা হয়ে এ স্থানে এসেছিলেন। মূলত লামখান থেকেই তার ভারতবর্ষ ভ্রমণের সূচনা। তিনি মূলত গৌতম বুদ্ধের নিদর্শন এবং স্মৃতিধন্য স্থানসমূহ পরিদর্শন এবং ভারতবর্ষ থেকে বুদ্ধ ও অন্যান্য বৌদ্ধ ভিক্ষুদের রচনা সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এই ভ্রমণ শুরু করেছিলেন।

হিউয়েন সাঙ
হিউয়েন সাঙের একটি পোর্ট্রেট

প্রারম্ভিক জীবন

হিউয়েন সাঙ 
হিনান প্রদেশে হিউয়েন সাঙ এর আবাসস্থল

হিউয়েন সাঙ লুজহু প্রদেশের (বর্তমান হিনান প্রদেশ) গৌসি টাউনের চিনহি গ্রামে ৬০২ খ্রিষ্টাব্দে একটি সম্ভ্রান্ত ও উচ্চশিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বসূরী চেন শি ছিলেন হান সাম্রাজ্যের একজন মন্ত্রী। তার পিতামহের বাবা চেন কিন পূর্ব ওয়েই সাম্রাজ্যের শেনডেং প্রদেশের একজন বড় কর্মকর্তা ছিলেন আর তার পিতামহ চেন কাং উত্তর কিন সাম্রাজ্যের রাজকীয় একাডেমির অধ্যাপক ছিলেন এবং সর্বশেষে তার বাবা চেন হুই, শুই সম্রাজ্যের একজন ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে কাজ করেছেন কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আশঙ্কায় চাকরি ছেড়ে দেন। বিভিন্ন স্থান থেকে প্রাপ্ত তার আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে হিউয়েন সাঙ খুব ছোটবেলা থেকেই কনফুসিয়াসের গতানুগতিক তত্ত্বের উপর ব্যাপক আগ্রহ এবং পারদর্শিতা প্রদর্শন করতে থাকেন যা তার বাবাকে অবাক করে দেয়। তার ভাই বোনদের মতই হিউয়েন সাঙ তাদের বাবার কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা দীক্ষা লাভ করেন।

যদিও তার পরিবারের সকলে কনফুসিয়াসের তত্ত্বের উপর বিশ্বাসী ছিলেন তার পরও হিউয়েন সাঙ তার বড় ভাই চেন সু এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বৌদ্ধ ভিক্ষু হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ৬১১ খ্রিষ্টাব্দে তার বাবার মৃত্যু হলে হিউয়েন সাঙ লুয়াং প্রদেশে জিংতু বুদ্ধ আশ্রমে তার ভাইয়ের সাথে প্রায় পাঁচ বছর কাটান। সেই বুদ্ধ আশ্রমে সেই সময় বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ হিসেবে মাহায়ানার চর্চা করা হত।

৬১৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে যখন সুই সম্রাজ্য ভেঙে পড়ে তখন হিউয়েন সাঙ এবং তার ভাই তাং সম্রাজ্যের রাজধানী চ্যাংগানে পালিয়ে যান এবং একটি বৌদ্ধ আশ্রমে আরো প্রায় দুই বছর অতিবাহিত করেন। সেখানেই তিনি অভিধর্মদা শাস্ত্র সম্পর্কে ধারণা এবং জ্ঞান লাভ করেন।তার দীক্ষাগুরু ছিল শীলভদ্র।

৬২২ সালে প্রায় ২০ বছর বয়সে তিনি একজন পূর্ণ বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়ে ওঠেন। এই সময় তিনি বৌদ্ধতত্ত্ব বিষয়ে বিস্তৃত পড়াশোনা করেন এবং ভারতবর্ষে গিয়ে অরো জ্ঞানার্জনের ইচ্ছা পোষণ করেন। এই চিন্তা করে তিনি তার ভাইকে রেখে পুনরায় তাং সম্রাজ্যের রাজধানীতে চলে যান এবং সেখানে সংস্কৃত ভাষা চর্চা শুরু করেন। একই সময়ে তিনি বৌদ্ধতত্ত্বের অধিবিদ্যার উপর আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

তীর্থ যাত্রা

হিউয়েন সাঙ 
একটি ছবিতে হিউয়েন সাঙ কে পশ্চিমের দিকে যাত্রা করতে দেখা যাচ্ছে

৬২৯ সালে একটি স্বপ্ন দেখে ভারত যাত্রার প্রতি আকৃষ্ট হন। ঐ সময়ে তাং সম্রাজ্যের সাথে তুর্কদের যুদ্ধ চলছিল তাই তাং রাজা তাইজং সকল নাগরিকদের বিদেশ যাত্রা নিষেধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু হিউয়েন সাং ইউমেনে শহরের সদর দরজার বৌদ্ধ প্রহরীদের বুঝিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হন। তারপর তিনি ৬২৯ সালেই কুইংঘি প্রদেশ হয়ে গোবি মরুভূমি পার হয়ে ৬৩০ সালে তুর্পান পৌছান যেখানে তিনি বৌদ্ধ রাজার সাথে দেখা করেন যিনি হিউয়েন সাং কে কিছু মূল্যবান জিনিসপত্র এবং যাত্রার জন্য রসদ সরবরাহ করেন।
তুর্পান থেকে আরো পশ্চিমে যেতে থাকলে ইয়ানজি ও কুচা হয়ে কিরগিজস্তান পৌছান যেখানে তিনি তুর্ক খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। যদিও ৬৩০ সালের দিকে তুর্কদের সাথে তাং সম্রাজ্যের যুদ্ধ চলছিলো, যখন হিউয়েন সাং, খানের সাথে দেখা করেন তত দিনে তাং সম্রাজ্যের সাথে খানের বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিরগিজস্তান থেকে পরবর্তীতে তিনি বর্তমান উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে পৌছান। সেখান থেকে আরো পশ্চিমে পার্সিয়া নিয়ন্ত্রিত সমরখন্দ শহরে পৌছান। সমরখন্দে তিনি কিছু ধ্বংশ হয়ে যাওয়ে বৌদ্ধ স্থাপনা দেখে বিস্মিত হন। সমরখন্দ থেকে আরো পশ্চিমে আমু দরিয়া এবং তিরমিজে পৌছান যেখানে তিনি প্রায় এক হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাথে সাক্ষাৎ করেন।

আরো পশ্চিমে যেয়ে তিনি খুন্দুজ শহরে সেখানকার যুবরাজ তার্দুর অন্তুষ্টিক্রিয়া দেখার জন্য কিছুকাল অবস্থান করেন। সেখানেই তিনি ধর্মসীমা নামে এক বিখ্যাত বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সদ্য মৃত যুবরাজ তার্দুর উপদেশেই তিনি পরবর্তিতে আরো পশ্চিমে নব বিহার পরিদর্শন করেন। নব বিহারের বর্তমান নাম আফগানিস্তান। সেখানে তিনি অনেক বৌদ্ধ মঠ এবং মহাবিশ্ব গ্রন্থের অনুসারী প্রায় তিন হাজার বৌদ্ধ বিক্ষু দেখেন। হিউয়েন সাঙ এর মতে নব বিহার হল পৃথিবীর সর্ব পশ্চিমে অবস্থিত দেশ, যা বৌদ্ধ ধর্ম প্রতিপালন করে। নব বিহারে কিছুদিন অবস্থান করে ৬৩০ সালের দিকে তিনি আদিনপুর (বর্তমান জালালাবাদ) যান। জালালাবাদ এসেই তিনি মনে করতে থাকেন যে তিনি ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছেন।

ভারতবর্ষ

আদিনপুর ত্যাগ করে তিনি খাইবার পাস হয়ে পেশাওয়ার দিকে রওনা হন। যাওয়ার পথে তিনি অনেক বৌদ্ধ মঠ দেখেন কিন্তু সেগুলোতে সে তুলনায় বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিল না। হিউয়েন সাঙ এর মতে পূর্বে পেশওয়ারের বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কিত যে গৌরব ছিল তা তৎকালীন পেশওয়ার হারাতে বসেছিল। পেশাওয়ার থেকে তিনি সোয়াত উপত্যকার দিকে চলে যান যেখানে তিনি চোদ্দশ পরিত্যক্ত বৌদ্ধ মঠ দেখতে পান যেখানে পূর্বে প্রায় আঠারো হাজার ভিক্ষু বসবাস করতেন। সোয়াত উপত্যাকা দিয়ে তিনি সিন্ধু নদ পার হন। সিন্ধু পার হয়ে তিনি কাশ্মীরের দিকে ধাবিত হন। কাশ্মীরে হিউয়েনের সাথে বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘাসের সাথে দেখা হয়ে যায়। সংঘাস ছিলেন মাহায়ন গ্রন্থের পন্ডিৎ। হিউয়েন কাশ্মিরে ৬৩২ থেকে ৬৩৩ সাল পর্যন্ত অন্যান্য জ্ঞানী ভিক্ষুদের সাথে মাহায়ন অধ্যয়ন করে কাটান। এখানে অবস্থানকালেই তিনি তার বইয়ে খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতকে অনুষ্ঠিত প্রথম বৌদ্ধ কাউন্সিলের ব্যাপারে লিখেছিলেন। এরপর তিনি আরো পূর্বের দিকে লাহোর ও মতিপুরের দিকে রওনা দেন। তার ভারত ভ্রমণের সাথে বাংলা (বর্তমান ভারতের পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশ) তে আগমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। নালন্দা থেকে ৬০০ লি অতিক্রম করে কজংগলে আসেন সেখানে কিছুদিন অতিবাহিত করার পর ৯০০ লি পূর্ব দিকে পদ্মা পার হয়ে পুন্দ্রনগর আসেন সেখানেই অনেক দিন কাটান এর পর প্রায় ৯০০ লি উত্তর-পূর্বে কামরুপ যান সেখান থেকে ১৩০০ লি দক্ষিণে সমতট তার পর ৯০০ লি পশ্চিমে সমুদ্র তীরবর্তী তাম্রলিপ্তি তে যান সম্ভবত এর পর শশাঙ্ক এর রাজধানী কর্ণসুবর্ণ তে যান এবং এর পর উড়িষ্যা দিয়ে চীনে ফিরে যান।

রচনাসমূহ

  • Si-Yu-Ki: Buddhist Records of the Western World — হিউয়েন সাঙের মূল রচনার ইংরেজি অনুবাদ। ইংরেজিতে ভাষান্তর করেছেন স্যামুয়েল বিল। ১৮৮৪ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৬৯ সালে দিল্লী থেকে পুনর্মুদ্রণ হয়। এর বাংলা অনুবাদের নাম হিউয়েন সাঙ ভ্রমণ কাহিনী। ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাষান্তর করেছেন খুররম হোসাইন। ঢাকার শব্দ গুচ্ছ প্রকাশনী থেকে বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে ২০০৩ সালের ঢাকা বইমেলায়।

তথ্যসূত্র

  • হিউয়েন সাঙ ভ্রমণ কাহিনী - খুররম হোসাইনের বাংলা অনুবাদ।

বহিঃসংযোগ

Tags:

হিউয়েন সাঙ প্রারম্ভিক জীবনহিউয়েন সাঙ তীর্থ যাত্রাহিউয়েন সাঙ ভারতবর্ষহিউয়েন সাঙ রচনাসমূহহিউয়েন সাঙ তথ্যসূত্রহিউয়েন সাঙ বহিঃসংযোগহিউয়েন সাঙগৌতম বুদ্ধচীনচীনা ভাষাফিনিনবৌদ্ধ ধর্মহর্ষবর্ধন

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

আবু বকররাজশাহীবর্ষবরণডিএনএসামাজিক সমস্যাইলেকটোরাল কলেজ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)মানিকগঞ্জ জেলাফিশিংভারতের রাষ্ট্রপতিশিক্ষাবিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাআয়করবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলসজনেরামকৃষ্ণ পরমহংসআলবার্ট আইনস্টাইনকৃষিকাজকাজু বাদামপানিপথের প্রথম যুদ্ধম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাবকৃষকবাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধমাইটোকন্ড্রিয়াফিলিস্তিনআখিরাতপাবনা জেলাযক্ষ্মাঢাকা বিভাগরাদারফোর্ড পরমাণু মডেলভারতীয় দর্শনগাজীপুর জেলাজলাতংকফিলিস্তিনের ইতিহাসসুলতান সুলাইমানতাজমহলপ্রাকৃতিক দুর্যোগস্মার্ট বাংলাদেশমানুষমাদার টেরিজাঅকাল বীর্যপাতকোষ (জীববিজ্ঞান)আকিদামুজিবনগর সরকারমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসসূরা ইয়াসীনবেলি ফুলপশ্চিমবঙ্গঢাকা মেট্রোরেলের স্টেশনের তালিকামণি সিংপাণ্ডু রাজার ঢিবিন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডরামমুন্সি আব্দুর রউফদুর্নীতিবাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসসামাজিক কাঠামোভারতীয় জনতা পার্টিরংপুর জেলাপশ্চিমবঙ্গের জেলাদিনাজপুর জেলাকলকাতা উচ্চ আদালতমারমাহিন্দি ভাষাগ্রিনহাউজ গ্যাসবাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকসমূহসম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিগোত্র (হিন্দুধর্ম)লোকনাথ ব্রহ্মচারীমহেন্দ্র সিং ধোনিটুইটারবাক্যশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়নিমভূমিকম্পযাকাত🡆 More