ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজি (ফার্সি: اختيار الدين محمد بن بختيار الخلجي) (বখতিয়ার খিলজি নামেও সমধিক পরিচিত), তিনি ঘুরির একজন তুর্কি-আফগান সেনাপতি ও প্রাথমিক দিল্লি সালতানাতের সেনাপতি ছিলেন এবং তিনিই প্রথম মুসলিম হিসেবে বাংলা ও বিহার জয় করেছিলেন। তৎকালীন পূর্ব ভারতে তার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর ইসলামি পণ্ডিতদের দাওয়াতের তৎপরতা সর্বাধিক সাফল্য অর্জন করেছিল এবং ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলসমূহে সবচেয়ে বেশি মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজি
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি
মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজি এবং তার সহযোদ্ধা সুবাহদার আউলিয়া খাঁ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যায় সৈন্যদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ১২শ শতাব্দীর প্রথম দিকের চিত্র।
উত্তরসূরিশিরাণ খলজী
জন্মগরমশির, হেলমান্দ, আফগানিস্তান
মৃত্যু১২০৬
দেবকোট, দক্ষিণ দিনাজপুর, বঙ্গ
সমাধি
পীরপাল দরগাহ, নারায়ণপুর, গঙ্গারামপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর
পেশাসেনাধ্যক্ষ, শাসক

১১৯৭ এবং ১২০৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে খিলজির আক্রমণের ফলে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ব্যাপক নিপীড়ন ও গণহত্যা চালানো হয় এবং উত্তর ভারতে উচ্চ শিক্ষার ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের মারাত্মক ক্ষতি হয়। বাংলায়, খিলজির রাজত্ব ইসলাম দ্বারা বৌদ্ধধর্মের দুর্বল করার জন্য তাকে দায়ী সাব্যস্ত করা হয়ে থাকে। তিনি প্রথম দিকে সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেকের একজন মন্ত্রী ছিলেন।

১২০৬ সালে বখতিয়ার একটি দুর্ভাগ্যজনক তিব্বত অভিযান শুরু করেন এবংবাংলায় ফিরে আসার পর তিনি হত্যার শিকার হন আলী মর্দান দ্বারা । তার স্থলাভিষিক্ত হন মুহাম্মদ শিরান খিলজি।

প্রারম্ভিক জীবন

বখতিয়ার খলজি (মালিক গাজি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি হিসেবেও উল্লিখিত) ছিলেন মুসলিম খলজি উপজাতির একজন সদস্য, যারা ২০০ বছর আগে তুর্কিস্তান থেকে আফগানিস্থানে এসে বসতি স্থাপন করে। মুসলিম খলজি উপজাতি উত্তর-পূর্বের প্রায় সকল দখল-যুদ্ধে যোগদানকারী সেনাবাহিনীর অধিপতিদের কাজে নিযুক্ত ছিল।

তুর্কি বংশদ্ভুদ ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজি প্রাথমিক জীবনে একজন ভাগ্যান্বেষী সৈনিক ছিলেন। তিনি ছিলেন আফগানিস্তানের গরমশিরের (বর্তমানে দশতে মার্গ) অধিবাসী। তার বাল্যজীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে মনে করা হয় দারিদ্রের পীড়নে তিনি স্বদেশ ত্যাগ করেন এবং নিজের কর্মশক্তির উপর নির্ভর করে অন্যান্য অধিবাসীদের ন্যায় ভাগ্যান্বেষণে বের হন। প্রথমেই তিনি গজনির সুলতান মুহাম্মাদ ঘুরির সৈন্যবাহিনীতে চাকরির আবেদন করেও সফল হননি। গজনিতে চাকরিলাভে ব্যর্থ হয়ে তিনি দিল্লিতে কুতুবুদ্দিন আইবেকের দরবারে হাজির হন। এখানেও তিনি চাকরি পেতে ব্যর্থ হন। অতপর তিনি বদাউনে যান। সেখানকার শাসনকর্তা মালিক হিজবর উদ্দিন বখতিয়ার খলজিকে নগদ বেতনে সেনাবাহিনীতে চাকরি প্রদান করেন। কিন্তু উচ্চাভিলাষী বখতিয়ার সামান্য বেতনভুক্ত সিপাহি হয়ে পরিতৃপ্ত হতে পারেননি। অল্পকাল পর তিনি বদাউন ত্যাগ করে অযোদ্ধায় গমন করেন। অযোদ্ধার শাসনকর্তা হুসামউদ্দিন তাকে বর্তমান মির্জাপুর জেলার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে অবস্থিত ভগবৎ ও ভিউলি নামক দুইটি পরগনার জায়গির প্রদান করেন। এখানেই বখতিয়ার তার ভবিষ্যৎ উন্নতির উৎস খুঁজে পান এবং এই দুটি পরগনাই পরবর্তীকালে তার শক্তির উৎস হয়ে ওঠে।

বিহার বিজয়

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি 
নালন্দা বিহার।

১২০১ সালে বখতিয়ার মাত্র দুই হাজার সৈন্য সংগ্রহ করে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো আক্রমণ করতে থাকেন। সেই সময়ে তার বীরত্বের কথা চারিদিক ছড়িয়ে পরতে থাকে এবং অনেক মুসলিম সৈনিক তার বাহিনীতে যোগদান করতে থাকে, ফলে তার সৈন্যসংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে তিনি একদিন এক প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গের মতো স্থানে আসেন এবং আক্রমণ করেন। এই আক্রমণে তিনি প্রতিপক্ষের কোনো বাধার সম্মুখীন হননি। দুর্গজয়ের পর তিনি দেখেন যে দুর্গের অধিবাসীরা প্রত্যেকেই মুণ্ডিতমস্তক এবং দুর্গটি বইপত্র দিয়ে ভরা। জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি জানতে পারেন যে এটি একটি বৌদ্ধ বিহার। এটি ছিল ওদন্ত বিহার বা ওদন্তপুরী বিহার। সেই সময় থেকেই মুসলমানরা জায়গাটিকে বিহার বা বিহার শরিফ নামে ডাকে।

বিহার জয়ের পর বখতিয়ার খলজি অনেক ধনরত্ন সহ কুতুবুদ্দীন আইবেকের সাথে সাক্ষাত করতে যান এবং কুতুবুদ্দিন কর্তৃক সম্মানিত হয়ে ফিরে আসেন। এরপরই তিনি বাংলা জয়ের জন্য মনস্থির করেন এবং শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন।

বাংলা বিজয়

তৎকালীন বাংলার রাজা লক্ষ্মণসেন বাংলার রাজধানী নদিয়ায় অবস্থান করছিলেন কারণ নদিয়া ছিল বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে সবচেয়ে সুরক্ষিত অঞ্চল। বলা হয়ে থাকে যে, বখতিয়ার খলজীর নদিয়ায় আগমনের কিছুদিন পূর্বে রাজসভার কিছু দৈবজ্ঞ পণ্ডিত তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, এক তুর্কি সৈনিক তাকে পরাজিত করতে পারে। ফলে লক্ষ্মণসেনের মনে ভীতির সঞ্চার হয় এবং নদিয়ার প্রবেশপথ রাজমহল ও তেলিয়াগড়ের নিরাপত্তা জোরদার করেন। লক্ষ্মণসেনের ধারণা ছিল যে ঝাড়খণ্ডের শ্বাপদশংকুল অরণ্য দিয়ে কোনো সৈন্যবাহিনীর পক্ষে নদিয়া আক্রমণ করা সম্ভব নয় কিন্তু বখতিয়ার সেইপথেই তার সৈন্যবাহিনীকে নিয়ে আসেন। নদিয়া অভিযানকালে বখতিয়ার ঝাড়খণ্ডের মধ্য দিয়ে এত দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছিলেন যে তার সাথে মাত্র ১৭ জন সৈনিকই তাকে অনুসরণ করতে পেরেছিলেন। বখতিয়ার সরাসরি রাজা লক্ষ্মণসেনের প্রাসাদদ্বারে উপস্থিত হন এবং দ্বাররক্ষী ও প্রহরীদের হত্যা করে প্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করেন। এতে প্রাসাদের ভিতরে হইচই পড়ে যায় এবং লক্ষ্মণসেন দিগ্বিদিক হারিয়ে ফেলে প্রাসাদের পেছনের দরজা দিয়ে নৌপথে বিক্রমপুরে আশ্রয় নেন।

খলজি নদিয়া জয় করে পরবর্তীতে লক্ষণাবতীর (গৌড়) দিকে অগ্রসহ হন এবং সেখানেই রাজধানী স্থাপন করেন। এই লক্ষণাবতীই পরবর্তীকালে লখনৌতি নামে পরিচিত হয়। গৌড় জয়ের পর আরও পূর্বদিকে বরেন্দ্র বা উত্তর বাংলায় নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি এলাকাগুলোকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে প্রত্যেকটি প্রদেশের জন্য একেকজন সেনাপতিকে শাসক নিযুক্ত করেন। বখতিয়ারের সেনাধ্যক্ষদের মধ্যে তিনজনের নাম পাওয়া যায়, এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আলি মর্দান খলজি বরসৌলে, হুসামউদ্দিন ইওজ খলজি গঙ্গতরীর এবং সুবেদার আউলিয়া খাঁ পূর্ব বঙ্গে শাসনকর্তা নিযুক্ত হন।

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির ১৭ জন অগ্রগামীর মধ্যে অন্যতম ছিলেন আফগানিস্থানের গরমশিরের অধিবাসী বখতিয়ারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুবেদার আউলিয়া খাঁ। তিনি মুলত খলজি কর্তৃক বিজিত পূর্ব ভারতের বঙ্গ অঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন এবং মৃত্যুর আগপর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তার বংশধরেরা বংশপরম্পরায় এই অঞ্চল শাসন করেন। আউলিয়া খাঁ ১২০৬ সনে তার প্রিয় বন্ধু বখতিয়ার খলজিকে স্বরণীয় করে রাখতে তার নামে বর্তমান ভাওয়াল গাজীপুরের কালীগঞ্জ থানার বখতিয়ারপুর এলাকার নামকরণ করেছিলেন। যা বর্তমানে বক্তারপুর এলাকা হিসেবে পরিচিত। সেই সময় বখতিয়ারপুরে আউলিয়া খাঁ তার প্রাশাসনিক কেন্দ্র স্থাপন করেন। বসবাসের জন্য চমৎকার হওয়ায় তিনি পার্শ্ববর্তী ফুলহরী এলাকায় (বর্তমান ফুলদী গ্রাম) বসতি স্থাপন করেন। তথ্যসূত্রে জানা যায় সুবেদার আউলিয়া খাঁর বংশধর সার্কেল ইন্সপ্যাক্টর অব পুলিশ মুন্সী মুহাম্মদ ছরওয়ার খাঁ (তৎকালীন রূপগঞ্জ সার্কেল) বৃটিশ ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনামলে ফুলহরী নাম পরিবর্তন করে ফুলদী নামে নামকরণ করেন।

তিব্বত আক্রমণ

বখতিয়ারের রাজ্য পূর্বে তিস্তা নদী ও করতোয়া নদী, দক্ষিণে পদ্মা নদী, উত্তরে দিনাজপুর জেলার দেবকোট হয়ে রংপুর শহর পর্যন্ত এবং পশ্চিমে পূর্বে অধিকৃত বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। যদিও বাংলাদেশের বৃহদাংশ তার রাজ্যের বাইরে ছিল। সেসব অঞ্চল দখল না করে তিনি তিব্বত আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল তুর্কিস্তানের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা। তিব্বত আক্রমণের রাস্তা আবিষ্কারের জন্য বখতিয়ার বাংলার উত্তর পূর্বাংশের উপজাতীগোষ্টির সদস্য আলী মেচকে নিয়োগ দেন।

সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর তিনি তিন জন সেনাপতি ও প্রায় দশ হাজার সৈন্য সামন্ত নিয়ে লখনৌতি থেকে তিব্বতের দিকে রওনা দেন। সৈন্যবাহিনী বর্ধনকোট শহরের কাছে পৌঁছলে তারা তিস্তা নদীর চেয়েও তিন গুন চওড়া বেগমতী নদী পার না হয়ে নদীর তীর ধরে তিন দিনের দূরত্ব অতিক্রম করার পর একটি পাথরের সেতুর নিকটে আসেন এবং সেখানে তার দুইজন সেনাপতিকে সেতুর সুরক্ষায় রেখে সামনে অগ্রসর হন। সামনে একটি কেল্লা পরে। ঐ কেল্লার সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে বখতিয়ার জয়ী হলেও সৈন্যবাহিনী ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হয়। কেল্লার সৈন্যদের থেকে বখতিয়ার জানতে পারেন যে অদূরে করমবত্তন নামক শহরে কয়েক লক্ষ সৈন্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। এই কথা শুনে বখতিয়ার সামনের দিকে অগ্রসর না হয়ে প্রত্যাবর্তন করেন। ফেরার পথে তার সৈন্যরা প্রচূর কষ্ট সহ্য করে। সেতুর কাছে এসে বখতিয়ার দেখেন যে পার্বত্য লোকেরা তার দুই সেনাপতির উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের মেরে ফেলেছে এবং সেতুটি পুরোপুরি বিদ্ধস্ত করে দিয়েছে। এরপর বখতিয়ার খুব অল্প সংখ্যক সৈন্যসহ ফিরে আসতে সক্ষন হন। এই ঘটনার পরেই বখতিয়ার বুঝতে পারেন যে তিব্বত অভিযান বিফল হওয়ার ফলে তার শক্তি মারাত্বক ভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং এতে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।

মৃত্যু

তিব্বত অভিযান বিফল হলে বখতিয়ার দেবকোটে ফিরে আসেন। গৌহাটির নিকটে ব্রহ্মপুত্রের তীরে কানাই বড়শি বোয়া নামক স্থানে তুর্কি সেনাদলের বিধ্বস্ত হওয়ার বিভিন্ন আলামত পাওয়া যায়। তিব্বত অভিযান বিফল এবং সৈন্যবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতির ফলে লখনৌতির মুসলিম রাজ্যের প্রজাদের মধ্যে বিদ্রোহ ও বিরোধ দেখা দিতে শুরু করে। এরই ফলে বাংলার ছোট ছোট মুসলিম রাজ্যগুলো দিল্লির সাথে সম্ভাব্য বিরোধে আগে থেকেই কোনঠাসা হয়ে পড়ে। এরকম নানাবিধ চিন্তা এবং পরাজয়ের গ্লানির মানসিক চাপে বখতিয়ার অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পরেন। এর অল্প কিছুদিন পরে ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শয্যাশায়ী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মিনহাজ ই সিরাজের ত্ববাকত-ই-নাসিরী গ্রন্থ বর্ণনানুসারে, তিনি আলি মর্দান খিলজি কর্তৃক ছুরিকাঘাতে নিহত হন। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার নারায়ণপুরের পীরপাল গ্রামে তার সমাধিস্থল রয়েছে।

বিতর্ক ও সমালোচনা

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি সংক্রান্ত সকল তথ্যই মুসলিম ঐতিহাসিক মিনহাজউদ্দিন শিরাজের ত্ববাকত-ই-নাসিরী গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত। মিনহাজ, বখতিয়ারের মৃত্যুর প্রায় চল্লিশ বছর পর বাংলায় গিয়ে বাংলা বিজয়ের যে কাহিনী শুনেছিলেন তাই মূলত লিপিবদ্ধ করেছেন এবং তার উপর ভিত্তি করেই ইতিহাস রচিত হয়েছে।

১১৯৩ সালে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি ধ্বংস করার জন্য খলজিকে দায়ী করা হয়। সেখানে থাকা সকল ছাত্রদেরকেও সে সময় হত্যা করা হয়।

কিন্তু ইতিহাসের আলোকে বিশ্লেষণ করলে ঘটনাটি সঠিক মনে হয় না। কারণ, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কয়েকবার আক্রান্ত হয় বহিরাগতদের দ্বারা। চরম বৌদ্ধবৈরী মিহিরাকুলের দ্বারা আক্রান্ত হয় স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ খ্রি.)। ঘটে গণহত্যা। স্কন্দগুপ্ত ও তার স্থলবর্তীদের হাতে নালন্দা ঘুরে দাঁড়ালেও রাজা শশাঙ্ক মগধে প্রবেশ করে নালন্দা ধ্বংস করেন। চড়াও হন বৌদ্ধদের পবিত্র স্থানগুলোর ওপর। বিনষ্ট করেন বুদ্ধের পদচিহ্ন। শশাঙ্কের বিনাশযজ্ঞের বিবরণ পাওয়া যায় চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙয়ের (৬০২-৬৬৪) সফরনামায়। রাজা জাতবর্মা সোমপুর মহাবিহার আক্রমণ করে ধ্বংস করেন। মঠাধ্যক্ষ্য করুণাশ্রী মিত্রকে হত্যা করেন আগুনে পুড়িয়ে। হিন্দু রাজা ভোজবর্মার বেলাবলিপিতে রয়েছে যার বিবরণ।

ভারতের রাজ্যসভায় ২০১৪ সালে কংগ্রেস সদস্য করণ সিং ও সিপিএম সদস্য সীতারাম ইয়েচুরির মধ্যে নালন্দার ধ্বংস নিয়ে তর্ক হয়। করণ সিং জোরগলায় দাবি করেন বখতিয়ার খলজির হাতে কবে বিশ্ববিদ্যালয়টি ধ্বংস হয়? ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ জানাচ্ছে, ১১০০ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার আক্রমণ করেন। স্যার উলসলি হেগের মতে, বখতিয়ার ওদন্তপুরী আক্রমণ করেন ১১৯৩ সালে। স্যার যদুনাথ সরকারের (১৮৭০-১৯৫৮) মতে, ১১৯৯ সালে। কিন্তু বখতিয়ারের বঙ্গে আগমনের ঘটনা ঘটে ১২০৪ সালের ১০ মে! বাংলায় আসার ১০৪ বছর আগ থেকেই তিনি এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস শুরু করেছিলেন?

অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয় ১১৯৩ সালে। কিন্তু তখনো খলজির আগমনই ঘটেনি। যদুনাথ সরকার অবশ্য খলজির আগমনকে ১২০৪ থেকে পিছিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। তার মতে, খিলজি এসেছিলেন ১১৯৯ সালে। কিন্তু তাতেও ১১৯৩ সালে নালন্দা ধ্বংসের দায় তার ওপর চাপে না। আরেক

ইতিহাসবিদ মিনহাজ উদ্দীন আবু ওমর বিন সিরাজউদ্দীন জুযানির ত্ববাকত-ই-নাসিরীতে রয়েছে বখতিয়ারের সৈন্যদের ওদন্তপুরীর মঠে ভুলক্রমে আক্রমণের কথা। মিনহাজের ভাষ্য মতে, ২০০ সৈন্য নিয়ে বখতিয়ার বিহার দুর্গ আক্রমণ করেন। ওদন্তপুরীকে শত্রুদের সেনাশিবির মনে করেন। হামলায় বহু খুনোখুনি হয়। মূলত এটি সেনাশিবিরের মতোই ছিল। এর চার দিকে ছিল বেষ্টনী প্রাচীর। বিখ্যাত তিব্বতি ঐতিহাসিক লামা তারানাথ (১৫৭৫-১৬৩৪) লিখেছেন, সেন আমলে তুর্কি অভিযানের ভয়ে বৌদ্ধবিহারগুলোতে সুরক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হতো। তবকাতের অনুবাদক আবুল কালাম যাকারিয়ার (১৯১৮-২০১৬) মতে, লড়াই সম্ভবত একপক্ষীয় ছিল না, এখানে প্রচণ্ড প্রতিরোধ হয়েছিল, এমন সম্ভাবনা রয়েছে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ও (১৮৮৫-১৯৩০) দিয়েছেন বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং সেনাদের যৌথ প্রতিরোধের বিবরণ। সেনারা চার দিক থেকে কোণঠাসা হয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়ে থাকবে।

ড. সুশীলা মণ্ডলের মতে, ‘ওদন্তপুর ছিল দুর্গম, সুরক্ষিত, শিখরস্থিত আশ্রম। এখানে স্বয়ং বিহার রাজা গোবিন্দপাল নিজের সৈন্যদের নিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ফলে বিহার জয়ের জন্য খিলজি রাজধানীর পরে এখানে আক্রমণ করেন। ফলে সৈন্যদের পাশাপাশি বৌদ্ধভিক্ষুরাও অস্ত্র ধারণ করেন। যুদ্ধে তারা পরাজিত হন এবং গোবিন্দ পাল দেব নিহত হন।’ প্রবল যুদ্ধ শেষে অতিকষ্টে পেছনের দ্বার দিয়ে অভ্যন্তরে ঢুকে বখতিয়ারের সৈন্যরা রক্তপাত করেন। এখানে বেশির ভাগ বাসিন্দা ছিল নেড়া মাথা। বখতিয়ার যখন দেখলেন, সেখানে প্রচুর বই এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলেন এটি দুর্গ নয়, তখন নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেন। ওদন্তপুর বা উদন্তপুর ছিল একটি বৌদ্ধবিহার; যা আগ থেকেই ছিল বিপর্যস্ত। পাল রাজা ধর্মপাল (৭৭০-৮১০) এর প্রতিষ্ঠাতা। নালন্দা মহাবিহার থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে মগধে এর অবস্থান।

কোনো কোনো গবেষক দাবি করেছেন, সেন রাজাদের ব্রাহ্মণ্যবাদী গুপ্তচররা তুর্কি বাহিনীকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ওদন্তপুরীতে আক্রমণ করতে প্ররোচিত করে।

ড. দীনেশচন্দ্র সরকার (১৯০৭-১৯৮৪) দেখিয়েছেন, উদন্তপুর বৌদ্ধবিহার ধ্বংস হয় ১১৯৩ সালে। বিভিন্ন গবেষকের মতে ১১৯১-৯৩ সময়কালে। বলাবাহুল্য, বখতিয়ারের বঙ্গজয় এর পরের ঘটনা। বস্তুত ওদন্তপুরী আক্রমণও সংশয়পরিকীর্ণ। তা হলে মিনহাজের ওদন্তপুরী নালন্দাকে প্রমাণ করছে না। বাংলাদেশের ইতিহাস গ্রন্থে রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৮৮৮-১৯৮০) ঠিকই লিখেছেন, খলজির বাংলা জয় প্রশ্নে যত কাহিনী ও মতবাদ বাজারে চাউর আছে, সবই মিনহাজের ভাষ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ এ সম্পর্কে অন্য কোনো সমসাময়িক ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায়নি।’

বখতিয়ারের বাংলা জয়ের ৪০ বছর পরে মিনহাজুস সিরাজ বাংলা সফর করেন এবং এ সম্পর্কে প্রচলিত মৌখিক বক্তব্য ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহ করেন। রিচার্ড এম ইটন (১৯৬১-২০১৩) লিখেন, ১২০৪ সালে মুহাম্মাদ বখতিয়ারের সেন রাজধানী দখলের প্রায় সমসাময়িক একমাত্র বর্ণনা হচ্ছে মিনহাজের তবকাত-ই নাসিরি।

বাংলার ইতিহাস গ্রন্থে সুখময় মুখোপাধ্যায় (মৃত্যু ২০০০ খ্রি.) বাংলার ইতিহাস সুলতানি আমল গ্রন্থে ড. আবদুল করিম (১৮৭১-১৯৫৩), বাংলাদেশের ইতিহাস গ্রন্থে রমেশচন্দ্র মজুমদার দেখান, তবকাতে নালন্দা অভিযানের কোনো বিবরণ নেই, বখতিয়ার আদৌ নালন্দায় অভিযান করেননি। বস্তুত কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানেও বখতিয়ারের নালন্দা আক্রমণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

তবকাতের পরের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসগ্রন্থ হচ্ছে, আবদুল মালিক ইসামি রচিত ফুতুহ-উস-সালাতিন ও হাসান নিজামি (১৮৭৩-১৯৫৫) রচিত তাজ-উল-মাসির। এতেও নালন্দা অভিযানের কোনো উল্লেখ নেই। পরবর্তী ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন সলিম (মৃত্যু-১৮১৭) কিংবা চার্লস স্টুয়ার্টও (মৃত্যু-১৮৮৮) নালন্দা অভিযানের কোনো সূত্র খুঁজে পাননি। বস্তুত ধ্বংসের বহু দাগ গায়ে নিয়েও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে খিলজির বঙ্গজয়ের অনেক পরেও।

তিব্বত থেকে ধর্মস্বামীর যাতায়াতও ছিল এখানে। ১২৩৪-৩৬ এর মধ্যে তিনি আসেন নালন্দায়, দেখেন চালু আছে পাঠদান। মঠাধ্যক্ষ্য রাহুল শ্রীভদ্র পড়াচ্ছেন, পড়াশোনা করছেন ৭০ জন সাধু! খিলজির মৃত্যুর ২৯ বছর পরের ঘটনা এটি!

সরদার আবদুর রহমান দেখিয়েছেন, নালন্দা ধ্বংস আসলে হিন্দু-বৌদ্ধ সঙ্ঘাতের ফসল। তিনি দেখান, হিন্দু প্রচারক ও দার্শনিক শঙ্করাচার্যের (৭৮৮-৮২০) প্রচেষ্টায় বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ক্ষয় হয়। ১২ বছর ধরে সূর্যের তপস্যা করে যজ্ঞাগ্নি নিয়ে নালন্দার প্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারে এবং বৌদ্ধবিহারগুলোতে অগ্নিসংযোগ করেন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা। ফলে নালন্দা অগ্নিসাৎ হয়ে যায়।

ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮০-১৯৬১) তার বাংলার ইতিহাস গ্রন্থে নালন্দা ধ্বংসের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দায়ী করেন। বুদ্ধপ্রকাশ (জন্ম ১৯২৪) তার ‘আসপেক্টস অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি অ্যান্ড সিভিলাইজেশন’ গ্রন্থে এমন মতামতের পক্ষে জোরালো বয়ান হাজির করেন।

অর্জন

১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশি কবি আল মাহমুদ "বখতিয়ারের ঘোড়া" নামক এক কাব্যগ্রন্থ লেখেন, যেখানে বখতিয়ার খিলজিকে বাংলার একজন গুরুত্ত্বপূর্ণ বীর হিসেবে উল্লেখ করেন ৷ বাংলার ইতিহাসে তিনি একজন অন্যতম পরিচিত ব্যক্তি। বখতিয়ার খিলজির শাসনামলে ভারতের প্রচুর সংখ্যক মানুষ ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি খুতবা পড়ে নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন। বখতিয়ারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলায় মসজিদ, মাদ্রাসা এবং খানকাহ নির্মাণের মাধ্যমে ইসলামের নতুন আবাস স্থপিত হয়েছিল এবং তার আমিররা তার কাজকে অনুসরণ করেছিলেন।

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

পূর্বসূরী
সেন রাজবংশ
রাজা লক্ষণ সেন
খিলজী বংশ
১২০৪–১২০৬
উত্তরসূরী
মুহাম্মদ শিরাণ খিলজী

Tags:

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি প্রারম্ভিক জীবনইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি বিহার বিজয়ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি বাংলা বিজয়ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি তিব্বত আক্রমণইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি মৃত্যুইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি বিতর্ক ও সমালোচনাইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি অর্জনইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি তথ্যসূত্রইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি বহিঃসংযোগইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

অন্নদামঙ্গলরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্মরক্তশূন্যতাসৌরজগৎভারতের রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলসমূহবিড়ালখন্দকার মোশতাক আহমেদপাকিস্তানঈদ মোবারকবাংলাদেশ ব্যাংকখ্রিস্টধর্মঅর্থনীতিপূরণবাচক সংখ্যা (ভাষাতত্ত্ব)ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সপায়ুসঙ্গম২০২২ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জিম্বাবুয়ে সফরআকিদাষাট গম্বুজ মসজিদবাংলাদেশঅবতারসৈয়দ মুজতবা আলীবাংলাদেশের ইতিহাসইশার নামাজজীববৈচিত্র্যবদরের যুদ্ধবাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডহিন্দু উৎসবের তালিকামৈমনসিংহ গীতিকাজনসংখ্যা অনুযায়ী সার্বভৌম রাষ্ট্র ও নির্ভরশীল অঞ্চলসমূহের তালিকাবাংলাদেশের উপজেলাদর্শনআলবার্ট আইনস্টাইনমুনাফিকওসামা বিন লাদেনমুঘল সাম্রাজ্যমাহরামপূবালী ব্যাংক পিএলসিসার্বিয়ারশিদ চৌধুরীএশিয়াব্যঞ্জনবর্ণরক্তদুবাইজায়েদ খান (বাংলাদেশী অভিনেতা)সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ভৌগোলিক আয়তন অনুযায়ী সার্বভৌম রাষ্ট্র ও নির্ভরশীল অঞ্চলসমূহের তালিকাঅশোকলোকসভা কেন্দ্রের তালিকাআবু বকরখালিদ বিন ওয়ালিদজিএসটি ভর্তি পরীক্ষাবন্ধুত্বহোয়াটসঅ্যাপজরায়ুবিভিন্ন দেশের মুদ্রাঅর্শরোগরামায়ণউমর ইবনুল খাত্তাবইউসুফসৌদি রিয়ালদুর্গাশায়খ আহমাদুল্লাহরাশিয়ান্যাটোঅমর্ত্য সেনচাঁদপুর জেলালিঙ্গ উত্থান ত্রুটিবাংলাদেশী জাতীয় পরিচয় পত্রআমাশয়ইমাম বুখারীইন্সটাগ্রামরাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)কৃষ্ণশিয়া ইসলামের ইতিহাসচণ্ডীদাসহিন্দুরংপুরকালী🡆 More