আলৎসহাইমারের রোগ

আলৎসহাইমারের রোগ বা আলজাইমার রোগ বা আলঝেইমার রোগ (ইংরেজি: Alzheimer's Disease) এক ধরনের বার্ধক্যজনিত ও সুস্পষ্ট কারণবিহীন স্নায়বিক অবক্ষয়মূলক রোগ, যা চিত্তভ্রংশের সবচেয়ে সাধারণ রূপ। এই রোগের কোনও প্রতিকার নেই। রোগটি অগ্রগতির সাথে সাথে রোগীর অবস্থার অবনতি হয় এবং অবশেষে রোগী মৃত্যুর পথে পরিচালিত হয়। ১৯০৬ সালে জার্মান মনোচিকিৎসক ও স্নায়ুরোগবিজ্ঞানী আলইস আলৎসহাইমার সর্বপ্রথম এ রোগটির বর্ণনা দেন; তাই তার নামানুসারেই এ রোগের নাম রাখা হয়। সাধারণত মধ্য বয়সের শেষের দিকে বা বার্ধক্যে এসে (মোটামুটি ৬৫ বছর বয়সের বেশি বয়সের) লোকেরা এই রোগে আক্রান্ত হন। তবে আলৎসহাইমারের রোগের প্রারম্ভিক সূত্রপাত অনেক আগেও হতে পারে। এই রোগের ফলে উত্তরোত্তর স্মৃতিহানি ঘটে, চিন্তার করার ক্ষমতা হ্রাস পায়, স্থান-কাল-পাত্রে বিভ্রম ঘটে, ব্যক্তিত্ব ও মেজাজে পরিবর্তন আসে। কলাতাত্ত্বিকভাবে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলির (বিশেষত মস্তিষ্কের বহিঃস্তরের) অবক্ষয় এবং মস্তিষ্কে স্নায়ুতন্তুজট ও বিটা-অ্যামিলয়েডের চাপড়ার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়।

আলৎসহাইমারের রোগ
আলৎসহাইমারের রোগ
স্বাভাবিক বৃদ্ধব্যক্তির মস্তিষ্ক (বামে) ও আলৎসহাইমারের রোগে আক্রান্ত বৃদ্ধ ব্যক্তির মস্তিষ্কের (ডানে) তুলনামূলক রেখাচিত্র। যে বৈশিষ্ট্যগুলি দুটিকে পৃথক করেছে, সেগুলিও দেখানো হয়েছে।
বিশেষত্বস্নায়ুরোগবিজ্ঞান
লক্ষণসাম্প্রতিক ঘটনাবলী মনে রাখতে অসুবিধা, প্রাথমিক অবনতিশীল বাকবৈকল্য, দিকভ্রান্তি, মেজাজ ওঠানামা
জটিলতাসর্বশেষ পর্যায়ে পানিশূন্যতাফুসফুস প্রদাহ
রোগের সূত্রপাত৬৫ বছর বয়সের পরে
স্থিতিকালদীর্ঘমেয়াদী
কারণঅজ্ঞাত
ঝুঁকির কারণবংশগতি, মাথায় আঘাত, গুরুতর বিষণ্ণতা রোগ, উচ্চ রক্তচাপ
রোগনির্ণয়ের পদ্ধতিলক্ষণ-উপসর্গ এবং সংজ্ঞানাত্মক পরীক্ষার ভিত্তিতে এবং, অন্যান্য সম্ভাব্য কারণ নাকচ করার পরে
পার্থক্যমূলক রোগনির্ণয়স্বাভাবিক বয়োবৃদ্ধি, লিউই বস্তু চিত্তবিভ্রম, ট্রাইসোমি ২১
ঔষধঅ্যাসিটিলকোলিনেস্টেরেজ সংদমক, এন-মিথাইল ডি-অ্যাস্পার্টেট গ্রাহক বিরোধী ঔষধ (কম সুফল),
আরোগ্যসম্ভাবনাপ্রত্যাশিত অবশিষ্ট আয়ু ৩-৯ বছর
সংঘটনের হার২ কোটি ৯৮ লক্ষ (২০১৫)
মৃতের সংখ্যাসব ধরনের চিত্তভ্রংশ রোগীর মৃত্যু ১৬ লক্ষ (২০২১), যার ৬০-৮০% আলৎসহাইমারের রোগী

২০০৬ সালে ২ কোটি ৬৬ লক্ষ লোক এই রোগে আক্রান্ত ছিল। ২০২০ সাল নাগাদ এটি ৪ কোটিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। ধারণা করা হয় ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা প্রতি ৮৫ জনে ১ জন হবে এবং সব মিলিয়ে ১৫ কোটি অতিক্রম করবে।

নিদর্শন ও লক্ষণ-উপসর্গ

যদিও এই রোগ বিভিন্নজনে বিভিন্নভাবে বিকশিত হয় তথাপি এর কিছু সাধারণ উপসর্গ দেখা যায়। প্রাথমিক উপসর্গগুলোকে প্রায়শ বার্ধক্যজনিত সমস্যা বা মানসিক চাপের বহিঃপ্রকাশ বলে করে ভুল করা হয়। প্রারম্ভিক অবস্থায় প্রকাশিত উপসর্গসমূহের সবচেয়ে সাধারণ রূপ হল সাম্প্রতিক ঘটনা ভুলে যাওয়া, কিন্তু অতীতের ঘটনার (যা স্বাভাবিকভাবে মনে থাকে না) পূর্ণ স্মৃতিচারণ। রোগের অবনতির সাথে সাথে রোগী দ্বিধাগ্রস্ততা, অস্থিরতা, রোষপ্রবণতা, ভাষা ব্যবহারে অসুবিধা, দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিভ্রংশতা এবং ক্রমান্বয়ে শারীরিক ক্রিয়াকর্মের বিলুপ্ততা দেখা দেয় ও অবশেষে সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

কারণ

আলৎসহাইমারের রোগের প্রকৃত কারণ উদ্‌ঘাটন করা এখনও সম্ভব হয় নি। তবে গবেষণায় এটি নিরূপিত যে, এটি মস্তিষ্কের ভেতরে বিটা-অ্যামিলয়েডের চাপড়া (প্লাক) ও স্নায়ুতন্তুজটের (যা হাইড্রোফসফোরাইলেটেড টাউ প্রোটিনের সমষ্টি) সাথে সংশ্লিষ্ট রোগ। ৫-১০% ক্ষেত্রে বংশগতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।

এই রোগে আক্রান্তের মস্তিষ্কে তিনটি উপাদানের অস্বাভাবিক উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছেঃ

  1. বিটা-অ্যামিলয়েড চাপড়া
  2. স্নায়ুতন্তুজট (নিউরোফাইব্রিলারি ট্যাঙ্গেল, যা টাউ প্রোটিন দ্বারা গঠিত এক ধরনের আঁশ)
  3. অ্যাসিটাইলকোলিন

এই রোগের মূল ঘটনার সূত্রপাত হয় অ্যামিলয়েড বিটা নামক একধরনের প্রোটিন উৎপাদনের মাধমে যা পরবর্তীতে মস্তিষ্কের রক্তকণিকার ভেতরে দলা পাকিয়ে অ্যামিলয়েড চাপড়া গঠন করে। এই অ্যামিলয়েড চাপড়াই স্নায়ুকোষের মৃত্যুর জন্য দায়ী।

প্রকৃতপক্ষে অ্যামিলয়েড অগ্রদূত প্রোটিনের উৎসেচকীয় ভাঙনের ফলে বিটা-অ্যামিলয়েড তৈরি হয়। ধারণা করা হয় এই অ্যামিলয়েড অগ্রদূত প্রোটিন মূলত এক ধরনের স্নায়ু প্রতিরক্ষাকারী উপাদান। স্বাভাবিক ক্ষেত্রে স্নায়বিক চাপ অথবা আঘাতের কারণে এটি উৎপন্ন হয়। উৎপাদিত এই অ্যামিলয়েড প্রিকারসর প্রোটিনকে ভাঙনের জন্য দুই ধরনের এনজাইম যথাক্রমে আলফা সিক্রেটেজ ও বিটা সিক্রেটেজ প্রতিযোগিতা করে।

আলফা সিক্রেটেজের দ্বারা ভাঙনের ফলে কোনও অ্যামিলয়েড বিটা প্রোটিন তৈরি হয় না।

কিন্তু বিটা সিক্রেটেজের প্রভাবে এক ধরনের প্রোটিন উৎপন্ন হয় যা আবার গামা সিক্রেটেজের প্রভাবে আরো দুই ধরনের অ্যামিলয়েড-বিটা প্রোটিন উৎপন্ন করে যার একটি ৪০ অ্যামিনো এসিড এবং অপরটি ৪২ আমিনো এসিড সমৃদ্ধ। Aß42 (৪২টি আমিনো এসিড সমৃদ্ধ অ্যামিলয়েড-বিটা) আঠালো প্রকৃতির যা মস্তিষ্কের রক্তনালিকার ভেতরে দলা পাকিয়ে অ্যামিলয়েড চাপড়া গঠন করে।

এই অ্যামিলয়েড চাপড়া নিম্নোক্ত দুটি ঘটনার মাধ্যমে মস্তিষ্কের স্নায়ুর মৃত্যু ঘটায়ঃ

  1. প্রদাহ ও জারণ ক্রিয়ায় স্নায়ুকোষের ক্ষতিসাধন: অ্যামিলয়েড চাপড়া মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের সাহায্যকারী গ্লিয়াল কোষ অ্যাসট্রোসাইট ও মাইক্রোগ্লিয়াকে উদ্দেপিত করে। ফলশ্রুতিতে অ্যাসট্রোসাইট অ্যারাকিডোনিক এসিড উৎপন্ন করে এবং অ্যারাকিডোনিক এসিড থেকে প্রস্টাগ্লান্ডিন উৎপন্ন হয়। অপরদিকে মাইক্রোগ্লিয়া ক্ষতিকর মুক্ত অণু (ফ্রি র‍্যাডিকাল) তৈরি করে। এই প্রস্টাগ্লান্ডিন এবং মুক্ত অণু (ফ্রি র‍্যাডিকাল) স্নায়ুকোষের মৃত্যু ঘটায়।
  1. স্নায়ুতন্তুজট (নিউরোফাইব্রিলারি ট্যাঙ্গল বা টাউ প্রোটিনে গঠিত এক ধরনের আঁশ) গঠন: টাউ প্রোটিন হল অণুনালিকা (মাইক্রোটিবিউল) এর গাঠনিক উপাদান। অণুনালিকা সাধারণত স্নায়ুতন্তুজটর কোষদেহ থেকে ডেন্ড্রাইটের দিকে প্রয়োজনীয় উপাদান পরিবহনে সহায়তা করে। আলৎসহাইমারের রোগে আক্রান্তের স্নায়ুকোষের টাউ প্রোটিনের গাঠনিক পরিবর্তন ঘটে এবং এটি জট পাকিয়ে যায়। তখন একে স্নায়ুতন্তুজট বলে। এমতাবস্থায় স্নায়ুকোষে সক্রিয় অণুনালিকার পরিমাণ কমতে থাকে এবং পর্যায়ক্রমে স্নায়ুকোষের মৃত্যু ঘটে।

মস্তিষ্কের কর্টেক্সে ও সম্মুখ ভাগে বৃহদাকার পিরামিড আকৃতির অ্যাসিটাইলকোলিন স্নায়ুকোষ থাকে যা আসিটাইলকোলিন ক্ষরণের মাধ্যমে বুদ্ধিমত্তায় গুরুত্তপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই আসিটাইলকোলিন স্নায়ুকোষে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি অণুনালিকা থাকে।

আলৎসহাইমারের রোগে টাউ প্রোটিনের গাঠনিক পরিবর্তনের কারণে এই আসিটাইলকোলিন স্নায়ুকোষের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। সাথে সাথে বুদ্ধিমত্তা, অনুধাবনের ক্ষমতাও হ্রাস পায়।

চিকিৎসা

এখন পর্যন্ত আলৎসহাইমারের রোগের কোনও প্রতিকার নেই। এর চিকিৎসা রোগের লক্ষণ ও উপসর্গের হ্রাসকরণ এবং রোগের বিস্তার প্রতিরোধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। একটি বহুল আলোচিত একটি মানসিক সংলক্ষণ।

পাদটীকা

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Tags:

আলৎসহাইমারের রোগ নিদর্শন ও লক্ষণ-উপসর্গআলৎসহাইমারের রোগ কারণআলৎসহাইমারের রোগ চিকিৎসাআলৎসহাইমারের রোগ পাদটীকাআলৎসহাইমারের রোগ তথ্যসূত্রআলৎসহাইমারের রোগ বহিঃসংযোগআলৎসহাইমারের রোগআলইস আলৎসহাইমারইংরেজি ভাষাচিত্তভ্রংশ

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

স্বরধ্বনিব্রাজিলওয়ালাইকুমুস-সালামযোগাযোগকনডমবাংলাদেশের জনমিতিভৌগোলিক নির্দেশকত্রিভুজকৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবাংলা শব্দভাণ্ডারপূর্ণিমা (অভিনেত্রী)বাল্যবিবাহআল্লাহর ৯৯টি নামহিন্দি ভাষাবাংলাদেশ সরকারদক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাবাংলাদেশের বিভাগসমূহকুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টদুধদুর্গাপূজামেষ রাশি (জ্যোতিষ শাস্ত্র)গাঁজা (মাদক)বীর শ্রেষ্ঠবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ঋতুএল নিনোদারাজআর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলমার্কিন যুক্তরাষ্ট্ররাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়মাওলানাকক্সবাজারবাংলাদেশ আনসারহানিফ সংকেতঅসমাপ্ত আত্মজীবনীফজরের নামাজরাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)সন্ধিভারতীয় জনতা পার্টিশ্রীকৃষ্ণকীর্তনবাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিওয়ালটন গ্রুপমুঘল সম্রাটভারতের ইতিহাসবাস্তুতন্ত্রবিদায় হজ্জের ভাষণপ্রাকৃতিক সম্পদমৈমনসিংহ গীতিকাঅনাভেদী যৌনক্রিয়াব্রিটিশ রাজের ইতিহাসঅরিজিৎ সিংঅণুজীবছোটগল্পউদ্ভিদকোষআলিবিরাট কোহলিফরিদপুর জেলাভূগোলসাজেক উপত্যকাশেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়মহাত্মা গান্ধীআহসান মঞ্জিলজাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদসুলতান সুলাইমানচৈতন্যচরিতামৃতমাটিবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলরাজীব গান্ধী আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামরশ্মিকা মন্দানাবাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিরাষ্ট্রবিজ্ঞানশিবআমার সোনার বাংলাপর্তুগিজ সাম্রাজ্য🡆 More