বুধ গ্রহ: সৌরজগতের প্রথম এবং ক্ষুদ্রতম গ্রহ

বুধ (ইংরেজি: Mercury; আ-ধ্ব-ব: ) মার্কারি) সৌরজগতের প্রথম এবং ক্ষুদ্রতম গ্রহ। এটি সূর্যের সর্বাপেক্ষা নিকটতম গ্রহ। এর কোনো উপগ্রহ নাই। এটি সূর্যকে প্রতি ৮৮ দিনে একবার প্রদক্ষিণ করে। এর উজ্জ্বলতার আপাত মান -২.৬ থেকে +৫.৭ পর্যন্ত হয়ে থাকে। কিন্তু একে পৃথিবী থেকে সহজে দেখা যায় না, কারণ সূর্যের সাথে এর বৃহত্তম কৌণিক পার্থক্য হচ্ছে মাত্র ২৮.৩ ডিগ্রী। কেবল সকাল ও সন্ধ্যার ক্ষীণ আলোয় এটি দৃশ্যমান হয়। বুধ গ্রহ সম্বন্ধে সংগৃহীত তথ্যের পরিমাণ তুলনামূলক কম। বুধ অভিমুখী নভোযান মেরিনার ১০ ১৯৭৪ - ১৯৭৫ সালে অনুসন্ধানী অভিযান চালিয়েছিল এবং মেসেঞ্জার ২০০৪ - ২০১৫ সালে ৪০০০ বার অনুসন্ধানী অভিযান চালিয়েছিল।

বুধ ☿
বুধ গ্রহ: নামকরণ ও সংস্কৃতি, অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যাবলী, বায়ুমণ্ডল
মেসেঞ্জার কর্তৃক তোলা বুধের ছবি
বিবরণ
উচ্চারণ/ˈmɜːrkjəri/ ()
বিশেষণমারকিউরিয়ান, হারমিয়ান
কক্ষপথের বৈশিষ্ট্য
যুগ জে২০০০
অপসূর
অনুসূর
অর্ধ-মুখ্য অক্ষ
উৎকেন্দ্রিকতা০.২০৫ ৬৩০
কক্ষীয় পর্যায়কাল
  • ৮৭.৯৬৯ ১ দিন
  • (০.২৪০ ৮৪৬ বছর)
  • ০.৫ বুধ সৌর দিবস
যুতিকাল১১৫.৮৮ d
গড় কক্ষীয় দ্রুতি৪৭.৩৬২ km/s
গড় ব্যত্যয়১৭৪.৭৯৬°
নতি
  • ৭.০০৫° to Ecliptic
  • ৩.৩৮° to Sun's equator
  • ৬.৩৪° to Invariable plane
উদ্বিন্দুর দ্রাঘিমা৪৮.৩৩১°
অনুসূরের উপপত্তি২৯.১২৪°
উপগ্রহসমূহনেই
ভৌত বৈশিষ্ট্যসমূহ
গড় ব্যাসার্ধ
  • ৪৩৯.৭±১.০ কিমি
  • ০.৩৮২৯ পৃথিবী
সমরূপতার
পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল
  • ৭.৪৮×১০ km2
  • ০.১৪৭ টা পৃথিবী
আয়তন
  • ৬.০৮৩×১০১০ km3
  • ০.০৫৬ পৃথিবী
ভর
  • ৩.৩০২২×১০২৩ কিg
  • ০.০৫৫ পৃথিবী
গড় ঘনত্ব৫.৪২৭ g/cm3
বিষুবীয় পৃষ্ঠের অভিকর্ষ
  • ৩.৭ m/s2
  • ০.৩৮ g/s2
মুক্তি বেগ৪.২৫ km/s
নাক্ষত্রিক ঘূর্ণনকাল
  • ৫৮.৬৪৬ d
  • ৪০৭.৫ h
বিষুবীয় অঞ্চলে ঘূর্ণন বেগ১০.৮৯২ কিমি/ঘ (৩.০২৬ মি/সে)
অক্ষীয় ঢাল২.১১′ ± ০.১′
উত্তর মেরুর বিষুবাংশ
  •  ১৮ ৪৪মি ২সে
  • ২৮১.০১°
উত্তর মেরুর বিষুবলম্ব৬১.৪৫°
প্রতিফলন অনুপাত
  • ০.০৬৮ (Bond)
  • ০.১৪২ (geom.)
আপাত মান−২.৬ থেকে ৫.৭
কৌণিক ব্যাস৪.৫–১৩″
বায়ুমণ্ডল
পৃষ্ঠের চাপtrace
গঠন

ভৌত বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে বুধ অনেকটা চাঁদের মতো কারণ চাঁদের মতো এই গ্রহেও রয়েছে প্রচুর খাদ। গ্রহটির কোনো স্থিতিশীল বায়ুমণ্ডল নেই, নেই কোনো প্রাকৃতিক উপগ্রহ। এর একটি সুবৃহৎ লৌহ কেন্দ্র রয়েছে। এই কেন্দ্র কর্তৃক উৎপাদিত চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের তুলনায় ০.১% অধিক শক্তিশালী। বুধের পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা ৯০ থেকে ৭০০ কেলভিনের মধ্যে থাকে। সবচেয়ে উত্তপ্ত স্থান হচ্ছে অর্ধসৌর বিন্দু এবং শীতলতম স্থান হল এর মেরুর নিকটে অবস্থিত খাদসমূহের নিম্ন বিন্দু।

নামকরণ ও সংস্কৃতি

রোমানরা এই গ্রহের নামকরণ করেছিল তাদের ক্ষীপ্রগতি বিশিষ্ট বার্তাবাহক দেবতা মারকিউরি নামানুসারে। পৌরাণিক কাহিনীতে মার্কারি (বুধ) হল জুপিটার (বৃহস্পতি) ও মেইয়ার পুত্র। গোধূলি লগ্নে আকাশে বুধকে অতি দ্রুত গতিতে চলতে দেখা যায়। সম্ভবত এই কারণেই এর এই ধরনের নামকরণ করা হয়েছে। এই পৃষ্ঠায় সংযুক্ত তথ্যছকটির উপরে বুধ গ্রহের যে জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক প্রতীকের চিত্র দেয়া হয়েছে তা প্রকৃতপক্ষে দেবতার মাথা এবং তার টুপির প্রতীকী অর্থ বহন করে। এটি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন একটি জ্যোতিষ শাস্ত্রীয় চিহ্ন। গ্রিকরা বুধ গ্রহকে Στίλβων তথা "স্টিবলন" নামে ডাকত যার অর্থ দ্যুতি প্রদানকারী। গ্রীসে এর অন্য একটি নাম ছিল "হেরমাওন" বা "হার্মিস"। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর পূর্বে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বুধকে দুইটি পৃথক বস্তুর সমন্বয় মনে করত যার একটি কেবল সূর্যোদয়ের সময় এবং অপরটি কেবল সূর্যাস্তের সময় দেখা যায়। মার্কারি নামীয় এই গ্রহটির বাংলা নাম বুধ এসেছে ভারতে ব্যবহৃত এর সংস্কৃত নাম থেকে। ভারতে এর নাম ছিল বুধ (बुध)। বুধ হল চন্দ্রের পুত্রের নাম। চৈনিক, কোরীয়, জাপানি এবং ভিয়েতনামি সংস্কৃতিতে একে "জল তারা" (水星) বলা হয় যা বিশ্ব গঠনকারী পাঁচটি মৌলিক পদার্থের দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত। হিব্রুতে এর নাম হল কোখাভ্‌ খামা (כוכב חמה), তথা উত্তপ্ত বস্তুর তারা। এখানে উত্তপ্ত বস্তু বলতে সূর্যকে বোঝানো হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যাবলী

বুধ হল সৌরজগতের চারটি পার্থিব গ্রহের একটি এবং এটি পৃথিবীর মতো একটি পাথুরে বস্তু। এটি সৌরজগতের সবচেয়ে ছোট গ্রহ, যার নিরক্ষীয় ব্যাসার্ধ ২,৪৩৯.৭ কিলোমিটার (১,৫১৬.০ মা) । সৌরজগতের বৃহত্তম প্রাকৃতিক উপগ্রহ, গ্যানিমিড এবং টাইটানের তুলনায় বুধ ছোট। বুধ প্রায় ৭০% ধাতব এবং ৩০% সিলিকেট উপাদান নিয়ে গঠিত।

অভ্যন্তরীণ গঠন

বুধ চারটি পার্থিব গ্রহের একটি অর্থাৎ এরও পৃথিবীর মত কঠিন পৃষ্ঠভূমি রয়েছে। চারটি পার্থিব গ্রহের মধ্যে এর আকার সবচেয়ে ছোট; বিষুবীয় অঞ্চলে এর ব্যাস ৪৮৭৯ কিমি। বুধের গাঠনিক উপাদানসমূহের মধ্যে ৭০% ধাতব এবং বাকি ৩০% সিলিকেট জাতীয়। এর ঘনত্ব সৌর জাগতিক বস্তসমূহের ঘনত্বের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ৫.৪৩ গ্রাম/সেমি পৃথিবী থেকে সামান্য কম। মহাকর্ষীয় সংকোচনের প্রভাব সম্পূর্ণ উদ্ধার করতে পারলে বুধের গাঠনিক উপাদানসমূহের ঘনত্ব আরো বেশি হত।

বুধ গ্রহ: নামকরণ ও সংস্কৃতি, অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যাবলী, বায়ুমণ্ডল 
বুধের বৃহৎ কেন্দ্র

বুধের অভ্যন্তরীণ গঠন বোঝার ক্ষেত্রে এর ঘনত্ব ভাল ভূমিকা রাখতে পারে। পৃথিবীর উচ্চ ঘনত্বের মূল কারণ হচ্ছে মহাকর্ষীয় সংকোচন যার পরিমাণ কেন্দ্রে সবচেয়ে বেশি। বুধ অনেক ছোট এবং এর কেন্দ্র পৃথিবীর মত অতটা দৃঢ় ও সংকুচিত নয়। তাহলে বুধের এত উচ্চ ঘনত্বের মূল কারণ হতে পারে, এর কেন্দ্র অনেক বড় এবং লৌহসমৃদ্ধ। আধুনিককালে ভূতত্ত্ববিদরা আবিষ্কার করেছেন যে বুধের সমগ্র আয়তনের ৪২% ই হচ্ছে এর কেন্দ্র। যেখানে পৃথিবীর কেন্দ্র মাত্র ১৭%।

কেন্দ্রের চারপাশে ৬০০ কিমি অঞ্চল জুড়ে রয়েছে ম্যানটেল। বুধের ইতিহাস ঘেটে যে তথ্য পাওয়া গেছে সে অনুসারে এখন সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, অনেক আগে বুধের সাথে কয়েক কিলোমিটার ব্যাসবিশিষ্ট একটি বস্তুর সংঘর্ষ ঘটেছিল। এই সংঘর্ষে বুধের ম্যানটেলের বেশ কিছু অংশ খসে পড়ে। এ কারণেই বর্তমানে কেন্দ্রের তুলনায় ম্যানটেলের পুরুত্ব এত কম। অবশ্য এ বিষয়ে অন্যান্য মতও রয়েছে। ধারণামতে বুধের ভূ-ত্বকের পুরুত্ব ১০০ - ২০০ কিমি-এর মধ্যে। এর পৃষ্ঠতরের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে প্রচুর সরু ridge রয়েছে যার কয়েকটি প্রায় কয়েকশো কিলোমিটার পর্যন্ত প্রলম্বিত। বিশ্বাস করা হয় এগুলো বুধের কেন্দ্র এবং ম্যানটেল হিসেবে গঠিত হয়েছিলো, কিন্তু এগুলো শীতল ও সংকুচিত হওয়ার আগেই বুধের ভূ-ত্বক কঠিন হয়ে যায়।

আমাদের সৌর জগতের অন্যান্য বৃহৎ গ্রহগুলোর যেকোনটির তুলনায় বুধে লৌহের পরিমাণ বেশি। বুধে ধাতুর এই উচ্চ পরিমাণের কারণ ব্যাখ্যার জন্য বেশ কয়েকটি তত্ত্ব প্রস্তাব করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি গৃহীত তত্ত্বটি হচ্ছে: বুধে ধাতু-সিলিকেটের অনুপাত সাধারণ কনড্রাইট উল্কায় এই অনুপাতের সমান ছিল এবং একসময় এর ভর বর্তমান ভরের ২.২৫ গুণ ছিল। সৌর জগতের ইতিহাস থেকে জানা যায় এক পর্যায়ে একটি বৃহৎ প্লানেটেসিমল বুধে আঘাত হানে যার ভর এর ছয় ভাগের এক ভাগ ছিল। এই সংঘর্ষের ফলে এর মূল ভূ-ত্বক ও ম্যানটেলের অনেকাংশ ক্ষয়ে যায়, কিন্তু অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রটি আগের মতই রয়ে যায়। ফলে কেন্দ্র এতো বড় এবং লৌহসমৃদ্ধ। পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চন্দ্রের উৎপত্তি ব্যাখ্যার জন্যও অনুরুপ একটি তত্ত্ব প্রস্তাবিত হয়েছে। একে জায়ান্ট ইমপেক্ট তত্ত্ব বলা হয়। অন্য একটি মতে বলা হয়, বুধগ্রহ সূর্যের শক্তি উৎপাদনের পরিমাণ সুস্থিত হওয়ার পূর্বে সৌর নীহারিকা থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। সৃষ্টির আদিতে এর ভর সম্ভবত বর্তমান ভরের দ্বিগুণ ছিল। কিন্তু ভ্রূণ সূর্য সংকুচিত হওয়ার কারণে বুধের নিকটে তাপমাত্রা ২৫০০ থেকে ৩৫০০ কেলভিনে পৌঁছায়। অনেকের মতে এই তাপমাত্রা ১০,০০০ কেলভিনেরও উপর হতে পারে। এই উচ্চ তাপমাত্রায় বুধ পৃষ্ঠের অনেক শিলা জাতীয় বস্তুই হয়তো বাষ্পীভূত হয়ে গিয়েছিল এবং একটি শিলা বাষ্প বিশিষ্ট বায়ুমণ্ডল সৃষ্টি করেছিল। সৌর বায়ু এই শিলা বাষ্প সরিয়ে নিয়ে যায়। তৃতীয় অন্য একটি তত্ত্বে প্রস্তাব করা হয়েছে, যে কণাগুলো থেকে বুধ গ্রহের বিবৃদ্ধি ঘটছিলো সেগুলোর উপর সৌর নীহারিকা এক ধরনের গতিরোধক (drag) আরোপ করেছিল। এতে হালকা বস্তুগুলো আর বিবৃদ্ধি সাধনে অংশ নিতে পারেনি। এই তত্ত্বগুলোর প্রত্যেকটি বুধ পৃষ্ঠের গঠন সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন মত দেয়। এই তত্ত্বগুলো পরীক্ষা করে দেখার জন্য বুধ অভিযানে একটি মহাকাশযান পাঠানো হয়েছে: মেসেঞ্জার। এছাড়া ২০২৫ সালে আরো যান পাঠানো হবে যার নাম বেপিকলম্বো। এখন পর্যন্ত পাওয়া ফলাফলগুলো তৃতীয় তত্ত্বের পক্ষে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

পৃষ্ঠতলের ভূ-তত্ত্ব

বায়ুমণ্ডল

বুধ গ্রহ: নামকরণ ও সংস্কৃতি, অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যাবলী, বায়ুমণ্ডল 
পার্থিব গ্রহসমূহের আকারের তুলনা (বাম থেকে ডানে): বুধ, শুক্র, পৃথিবী, এবং মঙ্গল

বুধ গ্রহ এত ছোট যে এর পক্ষে কোন দীর্ঘ মেয়াদের জন্য বায়ুমণ্ডল গঠন ও তা ধরে রাখা সম্ভব নয়। কারণ ক্ষুদ্র হওয়ার কারণে এর অভিকর্ষ বল খুবই কম। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় বুধেরও একটি অতি সূক্ষ্ণ ও হালকা বায়ুমণ্ডল রয়েছে যার প্রধান উপাদান হচ্ছে: হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, অক্সিজেন, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং পটাশিয়াম। বায়ুমণ্ডলটি সুস্থিত নয়। এর মধ্যকার পরমাণুগুলো নিরন্তরভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এবং আবার বিভিন্ন উৎস থেকে সৃষ্টি হয়ে স্থান পূরণ করে নিচ্ছে। হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম পরমাণু সম্ভবত সৌর বায়ু থেকে উৎপন্ন হয়। সেখান থেকে সৃষ্টি হয়ে এই গ্যাসগুলো বুধের চুম্বক গোলকে ব্যাপ্ত হয়ে যায়, অবশ্য পরে আবার এগুলো মহাশূন্যে হারিয়ে যায়। বুধের ভূ-ত্বকে বিদ্যমান পদার্থগুলোর তেজস্ক্রিয় ভাঙন হিলিয়ামের অন্য একটি উৎস। এই ভাঙন থেকে সোডিয়াম এবং পটাশিয়ামও সৃষ্টি হয়। বুধে সম্ভবত বাষ্পও রয়েছে। এর পৃষ্ঠের সাথে ধূমকেতুগুলোর সংঘর্ষের কারণে এই বাষ্পের সৃষ্টি হয়।

চুম্বক গোলক

যদিও বুধ দীর্ঘ ১৭৬ দিনে একবার নিজ অক্ষে আবর্তন করে তথাপি এর একটি অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী এবং আপাতভাবে আঞ্চলিক চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে। এটি পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের ০.১%। বুধের চৌম্বক ক্ষেত্রের উৎপত্তির কারণ পৃথিবীর মত হতে পারে; অর্থাৎ হয়ত বুধেও ঘূর্ণনরত তরল পদার্থ দ্বারা সৃষ্ট এক ধরনের ডায়নামো থেকেই বুধ গ্রহে এই চৌম্বক ক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বুধের কেন্দ্র কোন তরল পদার্থের উপস্থিতির বিষয়টি নিয়ে বেশ সন্দীহান, কারণ দীর্ঘ ৪.৫ বিলিয়ন বছর ধরে গ্রহটি ধীরে ধীরে শীতল হচ্ছে। এখনও কেন্দ্রে তরল থেকে থাকলে তা থাকার একটি কারণ বর্তমানে দাড় করানো হয়েছে। মূলত একটি পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে যার মাধ্যমে বুধের কেন্দ্রে তরল কঠিনে রুপান্তরিত হয়নি। হতে পারে, অতি উচ্চ কক্ষীয় উৎকেন্দ্রিকতা বিশিষ্ট পর্যায় চলাকালে জোয়ার-ভাটার প্রভাব কেন্দ্রে কিছু তরল রয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আবার এমনও হতে পারে, বুধের বর্তমান চৌম্বক ক্ষেত্র একটি আদি ডায়নামো প্রভাবের অবশিষ্ট হিসেবে রয়ে গেছে, যদিও উক্ত প্রভাবটির কোন অস্তিত্ব বর্তমানে নেই। বর্তমানে চৌম্বক ক্ষেত্র কঠিন হয়ে যাওয়া চৌম্বক পদার্থের ভিতরে জমাটবদ্ধ হয়ে আছে। বুধ গ্রহের চৌম্বক ক্ষেত্র এর চারপাশের সকল সৌর বায়ুকে বিক্ষিপ্ত করার মত যথেষ্ট শক্তিশালী। প্রকৃতপক্ষে এই চৌম্বক ক্ষেত্র গ্রহটির চারপাশে চুম্বক গোলক নামক একটি আস্তরণের সৃষ্টি করেছে সৌর বায়ু যাকে অতিক্রম করতে পারে না। চাঁদের সাথে বুধের মূল পার্থক্য এখানেই। চাঁদের চৌম্বক ক্ষেত্র বেশ দূর্বল হওয়ায় কোন চুম্বক গোলক নেই, যার ফলে সৌর বায়ু চন্দ্রপৃষ্ঠে চলে আসে অতি সহজেই।

কক্ষপথ ও ঘূর্ণন

বুধ গ্রহ: নামকরণ ও সংস্কৃতি, অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যাবলী, বায়ুমণ্ডল  বুধ গ্রহ: নামকরণ ও সংস্কৃতি, অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যাবলী, বায়ুমণ্ডল 

প্রধান গ্রহগুলোর মধ্যে বুধের কক্ষপথ সবচেয়ে উৎকেন্দ্রিক। সূর্য থেকে এর দূরত্ব ৪৬,০০০,০০০ থেকে ৭০,০০০,০০০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকে। নিজের কক্ষপথে চারদিকে একবার ঘুরে আসতে এর সময় লাগে ৮৮ দিন। বামে উল্লেখিত চিত্রটিতে বুধের কক্ষপথের উপর উৎকেন্দ্রিকতার প্রভাব দেখানো হয়েছে। এতে বুধের কক্ষপথ একটি বৃত্তাকার কক্ষপথের উপরে স্থাপন করা হয়েছে যার অর্ধ-মুখ্য অক্ষ বুধের সমান। দেখা যাচ্ছে প্রতি পাঁচ দিন অন্তর বুধ গ্রহ বিস্তর দূরত্ব অতিক্রম করে। এ থেকে বোঝা যায় গ্রহটি যখন অনুসূরের নিকটবর্তী হয় তখন এর বেগ সবচেয়ে বেশি থাকে।গোলকের আকৃতি সূর্য থেকে এর দূরত্বের ব্যাস্তানুপাতিক। সূর্য থেকে এর দূরত্বের তারতম্যের কারণ হিসেবে এটিকে উল্লেখ করা যায়। সূর্য থেকে দূরত্বের এই তারতম্যের সাথে গ্রহটির নিজ অক্ষের চারদিকে ঘূর্ণনের ফলে সৃষ্ট স্পিন-কক্ষপথ রেজোন্যান্স একত্রিত হয়ে এর কক্ষপথে তাপমাত্রার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে।

বুধের কক্ষপথ পৃথিবীর সমতলের (ভূ-কক্ষ) সাথে ৭° কোণে আনত। বামের চিত্রে এটি দেখানো হয়েছে। পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে অবস্থানকালীন সময়ে সূর্যের সম্মুখ বরাবর বুধ গ্রহের অতিক্রম কেবল তখনই ঘটতে পারে, যখন গ্রহটি ভূ-কক্ষের সমতলেকে অতিক্রম করে। গড়ে প্রতি ৭ বছরে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। বুধের এক্সিয়াল টিল্ট মাত্র ০.০১°, যা বৃহস্পতির চেয়ে ৩০০ গুণ কম। ৩.১ ডিগ্রীতে অবস্থিত সকল গ্রহের মধ্যে বুধের এক্সিয়াল টিল্টের মান দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। এর দ্বারা বোঝা যায়, বুধের বিষুব রেখার সন্নিকটে দণ্ডায়মান একজন পর্যবেক্ষক ভর দুপুড় বেলায় সূর্যকে জেনিথের এক ডিগ্রীর ১০০ ভাগের এক ভাগ দক্ষিণ বা উত্তরেও দেখতে পাবে না। একইভাবে মেরু অঞ্চলে সূর্য দিগন্তের ০.০১° উপরে কখনও উদিত হয় না। বুধের কিছু নির্দিষ্ট বিন্দুতে, পর্যবেক্ষক দেখতে সমর্থ হবেন যে, সূর্য তার সম্পূর্ণ গতিপথের অর্ধেক পর্যন্ত এসে আবার উল্টো দিকে চলতে শুরু করেছে এবং এক পর্যায়ে পরবর্তী উদয়ের পূর্বেই অস্ত গিয়েছে। এই ঘটনাটি বুধ গ্রহের একই দিনে ঘটে। এটি ঘটার নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। অনুসূরের ঠিক চার দিন পূর্বে বুধ গ্রহের কৌণিক বেগ ঘূর্ণন বেগের ঠিক সমান হয়। এর ফলে সূর্যের আর কোন আপাত গতি থাকে না। অনুসূরের পর বুধের কৌণিক বেগ ঘূর্ণন বেগের চেয়ে বাড়তে থাকে। এতে মনে হয় সূর্য স্বাভাবিক গতির উল্টো দিকে চলছে। অনুসূরের চার দিন পর এই বিন্দুগুলোতে সূর্যের গতি আবার আগের মত হয়ে যায়।

সৌর জগতের বয়স যতদিন হয়েছে ততদিনে বুধ গ্রহের উৎকেন্দ্রিকতা ০ থেকে ০.৪৭ পর্যন্ত পরিবর্তীত হয়েছে। বুধের কক্ষপথের সিমুলেশনের মাধ্যমে এটি জানা গেছে। এই বিষয়টি দ্বারাই বুধের স্পিন-কক্ষপথ রেজোন্যান্সের মান ৩.২ হওয়ার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। কারণ এ ধরনের পরিস্থিতি উচ্চ উৎকেন্দ্রিকতা বিশিষ্ট পর্যায়ে উত্থিত হওয়ার কথা।

অনুসূরের অগ্রগমন

বুধের আবর্তনকাল ৮৮ দিন। কিন্তু পৃথিবী থেকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখা যায় এর কক্ষপথের ধীর পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তনটির ব্যাখ্যা দেযয়া হয়েছে বুধের অনুসূর বিন্দুর পরিবর্তনের মাধ্যমে। এই ঘটনাটি বুধের অনুসূরের অগ্রগমন নামে চিহ্নিত। এর পরিমাণ প্রতি ১০০ বছরে ১°৩৩'২০। এই অগ্রগমনের একটি কারণ হচ্ছে ভূ-কক্ষের বিষুবন বিন্দুর অগ্রগমন। এই কারণটিই মুখ্য। এছাড়া শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ অগ্রগমনের কারণ হচ্ছে অন্যান্য গ্রহের আকর্ষণ। প্রতি একশ বছরে বুধের অনুসূর বিন্দু ৪৩ পরিমাণ অগ্রসর হয়। নিউটনীয় বলবিজ্ঞানের সাহায্যে এর কোন ব্যাখ্যা প্রদান সম্ভব হয় নি। অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী মনে করতেন বুধ ও সূর্যের মাঝখানে অন্য কোন গ্রহ আছে। যেমন, ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ল্য ভেরিয়ে ১৮৫৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর ফ্রেঞ্চ একাডেমিতে যে গবেষণাপত্র জমা দেন তাতে অগ্রগমনের দুইটি সম্ভাব্য কারণ উল্লেখিত ছিল: শুক্র গ্রহের যে ভর বিজ্ঞানীদের পরিজ্ঞাত প্রকৃত ভর তা থেকে সামান্য বেশি অথবা বুধ ও শুক্রের মাঝখানে অন্য একটি গ্রহ বিদ্যমান। প্রথম সম্ভাবনা দিয়ে অগ্রগমন ব্যাখ্যা করা গেলেও সেক্ষেত্রে পৃথিবীর গতি নিয়ে নতুন সমস্যা দেখা দেয়।

দ্বিতীয় সম্ভবনায় বলা হয়েছে মধ্যখানের এই গ্রহটির আকর্ষণের কারণে অগ্রগমন ঘটে। কিন্তু অতি সূক্ষ্ণ অনেক গবেষণা সত্ত্বেও এ ধরনের কোন গ্রহের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয় নি। এ থেকে বিজ্ঞানীরা মেনে নেন, এই গতির ব্যাখ্যা নিউটনের চিরায়ত বলবিজ্ঞানের সাহায্যে সমাধান করা সম্ভব নয়। পরবর্তীতে আলবার্ট আইনস্টাইন তার আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে বলেন, সূর্যের অবস্থিতির জন্য স্থান-কাল মহাশূন্যে একটি বক্রতার সৃষ্টি হয় এবং সাধারণ নিউটনীয় নীতি এই বক্রতারই ফল। সূর্যের চারদিকে উক্ত বক্রপথে যেতে বুধের কক্ষের পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে এর অনুসূর বিন্দুর অগ্রগমন ঘটে। এই তত্ত্ব অনুসারে অগ্রগমনের পরিমাণ প্রতি ১০০ বছরে ৪৩.০৩ যা মূল পরিমাণের সাথে সুন্দরভাবে মিলে যায়। তাই বুধের অনুসূরের অগ্রগমন বর্তমানে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের একটি প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

স্পিন-কক্ষপথ অনুরণন

বুধ গ্রহ: নামকরণ ও সংস্কৃতি, অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যাবলী, বায়ুমণ্ডল 
এক কক্ষপথে ঘূর্ণনের পর, বুধগ্রহ ১.৫ গুণ ঘূর্ণায়মান হয়েছে, তাই দুটি সম্পূর্ণ কক্ষপথে ঘূর্ণনের পরে একই গোলার্ধ আবার আলোকিত হয়।

অনেক বছর যাবৎ মানুষ ধারণা করত, বুধ গ্রহ সূর্যের সাথে একই পর্যায় এবং দশায় tidally locked হয়ে আছে। এ থেকে ধারণা জন্মায়, এটি নিজ কক্ষপথে একবার ঘুরে আসার সময় মাত্র একবার নিজ অক্ষে আবর্তন করে, যার ফলে এর একটি দিকই সবসময় সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে, ঠিক যেমন চাঁদের একটি দিকই সবসময় পৃথিবীর দিকে মুখ করা থাকে। কিন্তু ১৯৬৫ সালে রাডার পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে এর স্পিন-কক্ষপথ রেজোন্যান্স ৩:২। অর্থাৎ বুধ গ্রহ যে সময়ে সূর্যের চারদিকে দুইটি আবর্তন সম্পন্ন করে সে সময়েই এটি নিজ অক্ষের চারদিকে তিনবার ঘূর্ণন সম্পন্ন করে। এর কক্ষপথের উৎকেন্দ্রিকতা এই অনুরণন সীমাটিকে অনুসূর বিন্দুতে বেঁধে রাখে। সূর্যের জোয়ার-ভাটার প্রভাব যখন সবচেয়ে শক্তিশালী হয় তখন একে বুধের আকাশে প্রায় স্থির দেখায়। একই পর্যায় ও দশায় বুধ গ্রহের এই আবদ্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বুধ গ্রহ যখন পর্যবেক্ষণের জন্য সবচেয়ে উপযোগী স্থানে থাকে তখন ৩:২ রেজোন্যান্সে এটি যে বিন্দুতে থাকত সেই বিন্দুতেই একে দেখা যায়। ফলে এর একটি দিকই পর্যবেক্ষণ করা যায়। বুধের স্পিন-কক্ষপথ অনুরণন ৩:২ হওয়ার কারণে এর একটি সৌর দিন ১৭৬ পার্থিব দিনের সমান হয়। সৌর দিন বলতে সূর্যের দুইটি মধ্যরেখা অতিক্রমের (meridian transit) মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্যকে বোঝায়। অপরদিকে সেখানে এক নাক্ষত্রিক দিনের (ঘূর্ণনের পর্যায়কাল) দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৫৮.৭ দিন। কক্ষপথের বিভিন্ন সিমুলেশনের মাধ্যমে দেখা গেছে মিলিয়ন বছরের মধ্যে বুধের কক্ষপথের উৎকেন্দ্রিকতা ০ থেকে ০.৪৭ -এর মধ্যে অনিয়মিতভাবে উঠানামা করে। এই ঘটনাটি দ্বারা বুধের ৩:২ স্পিন-কক্ষপথ অনুরণনের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়। কারণ পর্যায়কালের এত উচ্চ উৎকেন্দ্রিকতার কারণে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে।

পর্যবেক্ষণ

বুধ গ্রহের আপাত মান ২.০ (লুব্ধক-এর চেয়ে বেশি) থেকে ৫.৫ এর মধ্যে থাকে। সূর্যের অতি নিকঠে অবস্থিত বলে একে পর্যবেক্ষণ করা বেশ দুঃসাধ্য। কারণ সূর্যের অত্যুজ্জ্বল আলোর কারণে অনেকটা সময় বুধকে দেখাই যায় না। ভোর বা সন্ধ্যার ক্ষীণ আলোতেই কেবল বুধকে দেখা যায়। হাবল মহাশূন্য দূরবীন বুধ গ্রহকে কখনই পর্যবেক্ষণ করতে পারে না। নিরাপত্তার কারণেই হাবল দূরবীনকে সূর্যের নিকটে নেয়া হয় না।

পৃথিবী থেকে যেমন চাঁদের কলা দেখা যায়, তেমনি বুধেরও কলা রয়েছে। অন্তঃসংযোগে এটি একেবারে নতুন এবং বহিঃসংযোগে পূর্ণ থাকে। কিন্তু নবীন এবং পূর্ণ থাকা অবস্থায় বুধকে দেখা যায় না। কারণ এ সময় এই গ্রহটি সূর্যের সাথেই উদিত হয় এবং অস্ত যায়। কলার প্রথম এবং শেষ চতুর্থাংশ পূর্ব ও পশ্চিম দিকে সর্বোচ্চ দ্রাঘনে (elongation) ঘটে থাকে। বুধ থেকে সূর্যের দূরত্ব যখন অনুসূর থেকে ১৮.৫° দূরে থাকে তখন কলার প্রথম চতুর্থাংশে সর্বোচ্চ দ্রাঘন ঘটে। আর শেষ চতুর্থাংশের ক্ষেত্রে এটি ঘটে অপসূর বিন্দু থেকে ২৮.৩° দূরত্বে। পশ্চিম দিকে যখন সর্বোচ্চ দ্রাঘন ঘটে তখন বুধ সূর্য থেকে সবচেয়ে আগে উদিত হয়। আর পূর্বে সর্বোচ্চ দ্রাঘনের ক্ষেত্রে এটি সূর্য অস্ত যাবার সবচেয়ে পরে অস্ত যায়।

বুধ গ্রহ: নামকরণ ও সংস্কৃতি, অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যাবলী, বায়ুমণ্ডল 
মেরিনার ১০ থেকে তোলা বুধের দৃশ্য

প্রতি ১১৬ দিনে বুধ গ্রহে অন্তঃসংযোগ ঘটে। অবশ্য গ্রহটির উৎকেন্দ্রিক কক্ষপথের কারণে এই সময় ১১১ থেকে ১২১ দিন পর্যন্ত যে কোন দিন হতে পারে। অন্তঃসংযোগের প্রতি পার্শ্বে এর প্রতীপ গতি ৮ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে উঠানামা করতে পারে। এই পর্যবেক্ষণটি অবশ্যই পৃথিবীর সাপেক্ষে হতে হবে। এই উচ্চ পার্থক্যের কারণও গ্রহটির উৎকেন্দ্রিক কক্ষপথ। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের তুলনায় দক্ষিণ গোলার্ধে বুধ গ্রহকে ভালভাবে দেখা যায়। কারণ সূর্যের পশ্চিম দিকে বুধের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ দ্রাঘন তখনই ঘটে যখন দক্ষিণ গোলার্ধে early autumn থাকে। আবার পূর্বদিকে সর্বোচ্চ দ্রাঘনের সময় দক্ষিণ গোলার্ধে থাকে late winter ঋতু। এই উভয় ক্ষেত্রেই বুধ ভূ-কক্ষের সাথে সর্বোচ্চ মানের কোণ উৎপন্ন করে এবং এর ফলে প্রতিক্ষেত্রে সূর্য উদিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পূর্বে বুধ পৃথিবীর আকাশে উদিত হয় এবং সূর্য অস্ত যাবার কয়েক ঘণ্টা পর বুধ অস্ত যায়। এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণ গোলার্ধের যে দেশগুলো দক্ষিণ তাপমাত্রা অঞ্চলের অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত সে দেশগুলো থেকে বুধ গ্রহকে স্পষ্ট দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে আর্জেন্টিনা এবং নিউজিল্যান্ডের মত দেশগুলো। কিন্তু উত্তর তাপমাত্রা অঞ্চলের অক্ষরেখা বিশিষ্ট স্থানসমূহে রাতের আকাশে বুধ কখনই দিগন্তের উপরে উঠে না। একটি পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় অন্যান্য কয়েকটি গ্রহ এবং উজ্জ্বল তারার মত বুধ গ্রহকেও স্পষ্ট দেখা যায়।

বুধ যখন গিবাস কলায় অবস্থান করে তখন পৃথিবীর সাপেক্ষে এর উজ্জ্বলতা সবচেয়ে বেশি হয়। অন্য কোন কলায় এই উজ্জ্বলতা পাওয়া যায় না। বুধ যখন অর্ধ-চন্দ্র আকৃতির থাকে তখন পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব গিবাস কলায় দূরত্বের চেয়ে কম হয়। কিন্তু এই অধিক দূরত্ব থেকেই বুধের সবচেয়ে বেশি অঞ্চল আলোকিত দেখা যায়। শুক্র গ্রহের ক্ষেত্রে ঠিক এর বিপরীতটি সত্য। শুক্র গ্রহকে যখন পৃথিবী থেকে অর্ধচন্দ্র আকৃতির দেখায় তখনই এর উজ্জ্বলতা সবচেয়ে বেশি হয়। কারণ গিবাস কলার তুলনায় এই কলাতেই শুক্র পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটে আসে।

গবেষণা

প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানী

প্রাচীন ইতিহাসে বুধ গ্রহের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে। তখন মেসোপটেমিয়ায় বসবাসকারী সুমেরীয়দের কাছে এটি উবু-ইদিম-গুদ-উদ নামে পরিচিত ছিল। অবশ্য এর আরও কয়েকটি নাম ছিল তাদের কাছে। সুমেরীয়দের উত্তরসূরী হিসেবে পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ব্যাবিলনীয়রা (২০০০ - ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। তারাও প্রাচীনকালে এই গ্রহটি চিহ্নিত করতে সমর্থ হয়। এই পর্যবেক্ষণগুলোর কোন তথ্যসূত্র এখন আর পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ সপ্তম শতাব্দী বা তারও আগে ব্যাবিলনীয়রা এই পর্যবেক্ষণ করেছিল। তারা এই গ্রহকে বলত নাবু বা নেবু। এই নামকরণ তারা করেছিল তাদের পুরাণ অনুসারে দেবতাদের বার্তাবাহকের নামে। প্রাচীন গ্রিকরা এর দুইটি নাম দেয়। যখন ভোরের আকাশে একে দেখা যায় তখন এর নাম দেয় এপোলো; আর যখন সন্ধ্যার আকাশে উদিত হয় তখন এর নাম দেয় হার্মিস। অবশ্য গ্রীকরাই প্রথম বুঝতে পেরেছিল যে এপোলো ও হার্মিস নামীয় এই দুটি বস্তু আসলে একই। পিথাগোরাস প্রথম এই প্রস্তাবনাটি করেছিলেন।

ভূমিস্থিত দূরবীন দিয়ে গবেষণা

বুধ গ্রহ: নামকরণ ও সংস্কৃতি, অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যাবলী, বায়ুমণ্ডল 
মেরিনার ১০ থেকে তোলা ছবি (৪.৩ কিমি দূর থেকে)। এটি পৃথবীর দূরবীন থেকে তোলা সবচেয়ে ভাল ছবিটির সমতুল্য।

পৃথিবী থেকে দূরবীনের মাধ্যমে প্রথম পর্যবেক্ষণটি করেছিলেন বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি, সপ্তদশ শতাব্দীতে। তিনি শুক্র গ্রহের কলা পর্যবেক্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন; কিন্তু তার দূরবীনটি বুধের কলা দেখার মত শক্তিশালী ছিল না। ১৬৩১ সালে বিজ্ঞানী পিয়েরে গ্যাসেন্ডি সর্বপ্রথম একটি বস্তুকে সূর্যের সামনে দিয়ে অতিক্রম করতে দেখেন। তিনি মূলত সূর্যের সামনে দিয়ে বুধ গ্রহের অতিক্রম দেখতে পান যা সম্পর্কে পূর্বেই ইয়োহানেস কেপলার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ১৬৩৯ সালে জিওভান্নি বাতিস্তা জুপি একটি দূরবীন ব্যবহার করে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করেন, এই বস্তুটির শুক্র গ্রহ ও চাঁদের মত কক্ষপথীয় কলা রয়েছে কি-না। এই পর্যবেক্ষণ থেকে নিঃসন্দেহে এটি প্রমাণিত হয় যে, বুধ গ্রহ সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তন করছে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানের জগতে একটি অতি বিরল ঘটনা হচ্ছে পৃথিবীর সাপেক্ষে (অর্থাৎ পৃথিবী থেকে দেখা হলে) একটি গ্রহ অন্য একটি গ্রহের সামনে এসে পড়ে এবং এর ফলে একটি গ্রহ অদৃশ্য হয়ে যায়। এই ঘটনাটিকে অদৃশ্যকরণ বলে। কিন্তু বুধ এবং শুক্র গ্রহ কয়েক শতাব্দী পরপরই একে অপরকে অদৃশ্য করে দেয়। ইতিহাসে হয়ত এ ধরনের ঘটনা বেশ কয়েকবার ঘটেছে। অবশ্য ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে এই ঘটনার একটি পর্যবেক্ষণের বর্ণনাই পাওয়া যায়। ১৭৩৭ সালের ২৮ মে তারিখে রয়েল গ্রিনিচ মানমন্দিরের বিজ্ঞানী জন বেভিস এরকম একটি অদৃশ্যকরণ পর্যবেক্ষণ করেন। শুক্র কর্তৃক বুধ গ্রহের পরবর্তী অদৃশ্যকরণের ঘটনা ঘটবে ২১৩৩ সালে।

অন্যান্য গ্রহগুলোর তুলনায় বুধ গ্রহকে অনেক কম পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। ১৮০০ সালে ''Johann Schröter'' বুধের পৃষ্ঠতলীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ পর্যবেক্ষণ করেন, কিন্তু তিনি এর কক্ষীয় পর্যায় পরিমাপ করেন প্রায় ২৪ ঘণ্টা যা ছিল ভুল। ১৮৮০-এর দশকে ''Giovanni Schiaparelli'' বুধের বিস্তৃত মানচিত্র নির্ণয় করেন এবং বলেন, এর কক্ষীয় পর্যায় ৮৮ দিন। tidal locking-এর সময় বুধের কক্ষীয় পর্যায় ৮৮ দিনই পরিমাপ করা হয়েছিল। এই ঘটনাটিকে সঙ্কালিক ঘূর্ণন (synchronous rotation) নামে অভিহিত করা হয়। পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদের ক্ষেত্রেও এটি ঘটতে দেখা যায়।

বুধের ঘূর্ণন যে সঙ্কালিক (synchronous) তা সকলেই গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৬০-এর দশকে বেতার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যখন এই প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ হয় তখন অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানীই বিশেষ আহত হন। এই গ্রহের জোয়ার-ভাটার আবদ্ধতার (tidally locked) কারণে এর অন্ধকার অংশ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হওয়ার কথা। কিন্তু তা থেকে প্রাপ্ত বেতার নিঃসরণ পরিমাপ করে দেখা গেছে অন্ধকার অংশের তাপমাত্রা আকাঙ্ক্ষিত তাপমাত্রার চেয়ে বেশি। অর্থাৎ বুধের অন্ধকার অংশও অতটা ঠাণ্ডা নয়, যতটা মানুষ এককালে মনে করতো। এই পর্যবেক্ষণের কারণেই বুধের সঙ্কালিক ঘূর্ণন বৈশিষ্ট্য সন্দেহের সম্মুখীন হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এর বদলে শক্তিশালী তাপ-বণ্টন তত্ত্ব এবং এর মতো আরও বেশ কয়েকটি পদ্ধতির কথা উল্লেখ করতে থাকেন। এসময়, তথা ১৯৬৫ সালে রাডারের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করার ফলস্বরূপ এটি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছিল যে, বুধের ঘূর্ণনকাল ৫৯ দিন। এই পর্যবেক্ষণের পর ইতালীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী Giuseppe Colombo লক্ষ্য করেন, ঘূর্ণনকালের এই মান বুধের কক্ষীয় পর্যায়কালের দুই-তৃতীয়াংশ। এর প্রেক্ষিতে তিনি নতুন একটি তত্ত্বের কথা বলেন। তার মতে বুধে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম ধরনের জোয়ার-ভাটা সংক্রান্ত আবদ্ধতার (tidal locking) সৃষ্টি হয়েছে। কারণ স্বাভাবিক আবদ্ধতা থাকলে গ্রহটির ঘূর্ণনকাল ও কক্ষীয় পর্যায়ের অনুপাত ১:১ হওয়ার কথা যা রেজোন্যান্স সৃষ্টি করে থাকে। কিন্তু বুধের ক্ষেত্রে সৃষ্ট টাইডাল লকিংয়ের কারণে এই অনুপাতটি হয়েছে ৩:২। এই অনুপাতটি একটি গ্রহের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এবং এর কারণেই গ্রহগোলো একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য হয়। Data from Mariner ১০ subsequently confirmed this view.

ভূ-কেন্দ্রিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সৌর জগতের সবচেয়ে ভিতরের দিকে অবস্থিত এই গ্রহটি সম্বন্ধে আর তেমন কিছু জানা যায়নি। মানুষ যখন বুধের উদ্দেশ্যে মহাজাগতিক সন্ধানী যান প্রেরণ করে তখন এই গ্রহ সম্বন্ধে আরও অনেক কিছু জানা সম্ভব হয়। বর্তমানে বুধের অধিকাংশ মৌলিক ধর্মই মানুষ জানতে পেরেছে। অবশ্য অতি সাম্প্রতিককালে বুধ গ্রহ পর্যবেক্ষণের জন্য আরও শক্তিশালী ও নিখুঁত ভূ-কেন্দ্রিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। ২০০০ সালে মাউন্ট উইলসন মানমন্দিরে অবস্থিত ৬০-ইঞ্চি দূরবীনের সাহায্যে বুধের পৃষ্ঠতলের বেশ কিছু উচ্চ রিজল্যুশনবিশিষ্ট ছবি তোলা হয়েছে। এমনকি বুধ অভিযানে প্রেরিত মেরিনার মহাকাশযান দ্বারাও এই অংশের কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। মাউন্ট উইলসন মানমন্দির থেকে তোলা এ ধরনের ছবিগুলোকে লাকি ইমেজিং-এর অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। এরপর তোলা আরও কিছু ছবির মাধ্যমে বুধে একটি সুবৃহৎ দুই রিং বিশিষ্ট ইমপ্যাক্ট অববাহিকার (double ringed impact bsin) অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে। এই অববাহিকাটি এমনকি ক্যালরিস বেসিনের চেয়েও বড়। মেরিনার মহাকাশযানের মাধ্যমে এই বেসিন যে গোলার্ধে অবস্থিত তার ছবি ধারণ করা সম্ভব হয়নি। আপাতত এই বেসিনটির নাম দেয়া হয়েছে স্কিনাকাস অববাহিকা।

সন্ধানী যানের মাধ্যমে গবেষণা

প্রকৃতপক্ষে পৃথিবী থেকে বুধ গ্রহ পর্যবেক্ষণ করতে যেয়ে বেশ কিছু কারিগরি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কারণ পৃথিবীর চেয়ে বুধ অনেক কাছ থেকে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এজন্যই বিজ্ঞানীরা মহাকাশযান প্রেরণের মাধ্যমে উচ্চতর গবেষণার দিকে নজর দেন। বুধের উদ্দেশ্যে পৃথিবী থেকে প্রেরিত একটি মহাকাশযানকে সূর্যের মহাকর্ষীয় বিভব উৎসের দিকে অবশ্যই ৯১ মিলিয়ন কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে হবে। বুধের নিকট দিয়ে অতিক্রমকারী একটি Hohmann transfer orbit-এর ভিতর প্রবেশ করতে হলে সন্ধানী যানটিকে একটি নির্দিষ্ট গতিবেগ অর্জন করতে হবে। পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে বেরোবার সময় এর বেগ থাকে পৃথিবীর কক্ষীয় বেগের সমান অর্থাৎ প্রায় ৩০ কিমি/সে.। বুধের পাশের Hohmann transfer orbit-এ প্রবেশ করতে যে বেগ প্রয়োজন তা অর্জনের জন্য এক্ষেত্রে বেগের প্রচুর পরিবর্তন করতে হয়, যতটা অন্য কোন গ্রহে অভিযানের ক্ষেত্রে করতে হয় না। এজন্যই বুধ অভিযান অন্যান্য অভিযানের তুলনায় বেশি কষ্টকর।

সূর্যের বিভব উৎসের তীব্রতা কমে যাওয়ার কারণে যে বিভব শক্তি বিমুক্ত হয় তা গতিশক্তিতে পরিণত হয়। এর ফলে বুধের পাশ দিয়ে খুব দ্রুত চলে যাওয়া ঠেকাতে হলে মহাকাশযানের বেগে আরও বেশি পরিবর্তন আনতে হবে। উপরন্তু বুধের পৃষ্ঠে নিরাপদে অবতরণ করতে হলে সন্ধানী যান বহনকারী রকেটকে সম্পূর্ণভাবেই তার নিজস্ত মোটরের উপর নির্ভর করতে হয়। কারণ বুধের বায়ুমণ্ডল অতি ক্ষীণ হওয়ায় তা অ্যারোব্রেকিং-এর সুবিধা পাবেনা। প্রকৃতপক্ষে পুরো সৌর জগৎ অতিক্রম করতে একটি মহাকাশযানকে যে পরিমাণ শক্তি সরবরাহ করতে হয় তার চেয়ে বুধে অবতরণ করাতে হলে বেশি শক্তি দিতে হয়। এ কারণেই ছোট্ট এই গ্রহটিতে এ পর্যন্ত মাত্র একটি সন্ধানী যান প্রেরণ করা সম্ভব হয়েছে।

মেরিনার ১০

বুধ গ্রহ: নামকরণ ও সংস্কৃতি, অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যাবলী, বায়ুমণ্ডল 
মেরিনার ১০ মহাজাগতিক সন্ধানী যান।

বুধ গ্রহ অভিযানে প্রেরিত একমাত্র মাজাগতিক সন্ধানী যানের নাম মেরিনার ১০। মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা ১৯৭৪-৭৫ সালে এই যান প্রেরণ করে। কাজটি বেশ কষ্টকর ছিল। এজন্য মেরিনার ১০ শুক্র গ্রহের অভিকর্ষকে কাজে লাগিয়েছে। মূলত শুক্রের অভিকর্ষকে কাজে লাগিয়ে মেরিনার ১০ তার কক্ষীয় বেগকে নিয়ন্ত্রণ করে বুধের দিকে অগ্রসর হতে পেরেছে। মহাকর্ষীয় স্লিংশট নামক এই প্রভাব মেরিনার ১০ই প্রথমবারের মত ব্যবহার করেছে। মেরিনার ১০ প্রথমবারের মত বুধের অতি কাছ থেকে প্রচুর ছবি পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে প্রচুর খাদবিশিষ্ট বুধ পৃষ্ঠের প্রকৃত চিত্র সম্বন্ধে জানা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া আরও অনেকগুলো ভূ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য আবিষ্কৃত হয়েছে। যেমন সুবৃহৎ খাড়া ঢালু গর্ত। এই গর্তগুলোকে পরবর্তীতে বুধের ঠাণ্ডা লৌহ কেন্দ্রের কারণে সৃষ্ট বলে বর্ণনা করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত মেরিনার ১০এর কক্ষীয় পর্যায় ঠিক বুধের ৩ নাক্ষত্রিক দিনের সমান ছিল। এর কারণে মেরিনার ১০ যখনই বুধের কাছাকাছি হতে পেরেছে তখন সবসময়ই বুধের একটিমাত্র পৃষ্ঠ মহাকাশযানটির সামনে আসতে পেরেছে। ফলস্বরুপ বুধের সমগ্র পৃষ্ঠের মাত্র ৪৫% মানচিত্রের মাধ্যমে চিত্রিত করা সম্ভব হয়েছে।

সন্ধানী যানটি তিন তিনবার বুধের খুব সন্নিকটে যেতে পেরেছিল। এর মধ্যে নিকটতম ছিল বুধ পৃষ্ঠের ৩২৭ কিমি দূর পর্যন্ত। প্রথমবার কাছে যাওয়ার মাধ্যমে মেরিনার ১০ বুধে একটি অভাবনীয় চৌম্বক ক্ষেত্রের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে। ভূ-তত্ত্ববিদরা সবাই এতে আশ্চর্য হয়েছিলেন। তারা দেখেন বুধের ঘূর্ণন বেগ যা ধরা হয়েছিল তার চেয়ে বেশ খানিকটা ধীর। এর ফলে উক্ত চৌম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে সেখানে একটি ডায়নামো ক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয়বার যখন মেরিনার ১০ বুধের খুব সন্নিকটে যায় তখন বুধ পৃষ্ঠের প্রচুর ছবি তোলা সম্ভব হয়। কিন্তু তৃতীয়বার নিকটবর্তী হওয়াটা ছিল আরও কার্যকরী। কারণ তখন গ্রহটির চৌম্বক ধর্ম সম্বন্ধে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত জানা সম্ভব হয়। উপাত্তগুলো থেকে বোঝা যায়, গ্রহটির চৌম্বক ক্ষেত্র অনেকটা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের মত যা গ্রহের চারপাশের সৌর বায়ুকে পথচ্যুত করতে পারে। অবশ্য বুধের চৌম্বক ক্ষেত্রের উৎপত্তি সম্বন্ধে এখনও বিতর্ক রয়ে গেছে এবং এ সম্বন্ধে বেশ কয়েকটি তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়েছে। শেষবারের মত বুধের সন্নিকটে যাওয়ার পর মেরিনার ১০-এর জ্বালানী প্রায় ফুরিয়ে যায়। এর ফলে পৃথিবী থেকে এই অভিযানের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে। অবশেষে পৃথিবীর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অভিযানের কার্যকলাপ বন্ধ করে দেয়। মূলত পৃথিবী থেকে সঙ্কেত দেয়া হয়েছিল যেন, মেরিনার ১০ নিজেই নিজের কার্যকলাপ বন্ধ করে দেয়। ধারণা করা হয় মেরিনার ১০ এখনও সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এবং প্রতি কয়েকমাসে একবার করে বুধ গ্রহের সন্নিকটে যাচ্ছে।

মেসেঞ্জার

বুধের উদ্দেশ্যে নাসা কর্তৃক প্রেরিত দ্বিতীয় অভিযান ছিল মেসেঞ্জার (ME S S EN GE R - MErcury Surface, Space ENvironment, GEochemistry, and Ranging) যা ২০০৪ সালের আগস্ট ৩ তারিখে প্রেরিত হয়। । একটি বোয়িং ডেল্টা ২ রকেটের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কেপ ক্যানাভেরাল মহাশূন্য স্টেশন থেকে এটি প্রেরণ করা হয়েছিল। এই সন্ধানী যানটি বেশ কয়েকবার বুধের সন্নিকটে যেতে সমর্থ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। একে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে তা সুনির্দিষ্ট প্রাসে চলার মাধ্যমে বুধের চারদিকে নিজস্ব একটি কক্ষপথ তৈরীতে সমর্থ হয়। ২০০৫ সালের আগস্ট মাসে এটি পৃথিবীর কাছ দিয়ে উড়ে যায় এবং ২০০৭ সালের অক্টোবর ও জুন মাসে শুক্র গ্রহের কাছ দিয়ে উড়ে যায়। এই যানটি বুধের নিকট দিয়ে তিন তিনবার উড়ে যাবে বলে শিডিউল করা হয়েছে। এর উড়ে যাওয়ার সময়গুলো হবে জানুয়ারি ২০০৮, অক্টোবর ২০০৮ এবং সেপ্টেম্বর ২০০৯। এর পর তা ২০১১ সালের মার্চ মাসে বুধ গ্রহের চারপাশে কক্ষপথে প্রবেশ করবে।

মেসেঞ্জারকে পাঠানো হয়েছে মূলত বুধের ছয়টি মৌলিক বিষয়ে অনুসন্ধান করার জন্য। এগুলো হচ্ছে: বুধের উচ্চ ঘনত্ব, এর ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস, এর চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রকৃতি, এর কেন্দ্রের গঠন, এর মেরু অঞ্চলসমূহে আসলেই বরফ রয়েছে কিনা, এবং এর পাতলা বায়ুমণ্ডল কোথা থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখে সন্ধানী যানটিতে মেরিনার ১০-এর চেয়ে আরও শক্তিশালী ইমেজিং যন্ত্রপাতি সন্নিবেশিত করা হয়েছে যাতে বুধের আরও কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত অধিক রিজল্যুশনবিশিষ্ট ছবি তোলা যায়। এছাড়া এতে রয়েছে যুতসই বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্র যার সাহায্যে বুধের ভূত্বকে মৌলসমূহের প্রাচুর্য নির্ণয় করা সম্ভব, রয়েছে ম্যাগনেটোমিটার এবং আয়নিত কণিকাসমূহের গতিবেগ নির্ণয়ের যন্ত্রাবলী। সন্ধানী যানটি যখন বুধকে কেন্দ্র করে তার কক্ষপথ বরাবর আবর্তন করবে তখন এর গতিবেগের সূক্ষ্মতম পরিবর্তন পরিমাপের জন্য এই গতিমাপক পন্ত্রগুলো দেয়া হয়েছে। এই পরিবর্তন পরিমাপের মাধ্যমে বুধের অভ্যন্তরীন গঠন সম্বন্ধে বিস্তারিত জানা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বেপিকলম্বো

বুধ গ্রহ: নামকরণ ও সংস্কৃতি, অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যাবলী, বায়ুমণ্ডল 
মেরিনার ১০ সন্ধানী যানের মাধ্যমে তোলা বুধের ছবি

জাপান ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির সাথে যৌথভাবে একটি অভিযানের পরিকল্পনা করছে যা বেপিকলম্বো নামে পরিচিত। এই অভিযানে দুই সন্ধানী যান ব্যবহৃত হবে যারা বুধের কক্ষপথ পরিভ্রমণ করবে। দুটি সন্ধানী যানের একটি বুধের মানচিত্র প্রণয়নের কাজ করবে এবং অপরটি এর ম্যাগনেটোস্ফিয়ার নিয়ে গবেষণায় ব্যবহৃত হবে। একটি ল্যান্ডার সহ মূল পরিকল্পনাটি করা হয়ে গেছে। ২০১৩ সালে রাশিয়ার সয়ুজ রকেটসমূহ এই সন্ধানী যানটি বহনের কাজ করবে। মেসেঞ্জারের সাথেই বেপিকলম্বো বেশ কয়েকবার বুধের অতি সন্নিকটে যাবে। একইভাবে এটি চাঁদ এবং শুক্র গ্রহের নিকট দিয়ে উড়ে গিয়ে বুধের কক্ষপথে প্রবেশ করার পূর্ব বেশ কয়েকবার এর নিকটবর্তী হবে। আনুমানিক ২০১৯ সালের দিকে এটি বুধের কক্ষপথে প্রবেশ করবে এবং প্রায় এক বছর ধরে একে অধ্যয়ন করবে।

সন্ধানী যান দুটি মেসেঞ্জারের মতই একটি বর্ণালীবীক্ষণ অ্যারে বহন করবে এবং গ্রহটিকে অনেকগুলো তরঙ্গদৈর্ঘ্য্যে পর্যবেক্ষণ করবে। ধর্তব্য তরঙ্গদৈর্ঘ্য্যের মধ্যে রয়েছে অবলোহিত, অতিবেগুণী, রঞ্জন রশ্মি এবং গামা রশ্মি। কার্যকরভাবে বুধ গ্রহ অধ্যয়নের পাশাপাশি বিজ্ঞানীরা বেপিকলম্বোর মাধ্যমে আরেকটি কাজ করার ব্যাপারে আশাবাদী। এটি হচ্ছে সূর্যের সাথে সন্ধানী যানটির নৈকট্যকে ব্যবহার করে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো পরীক্ষা করা। বেশ নিখুঁতভাবে এটি করা সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে। এই অভিযানটির নামকরণ করা হয়েছে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী গিউসেপ (বেপি) কলম্বোর (Giuseppe Colombo) নামানুসারে। তিনিই প্রথম সূর্যের সাথে বুধের কক্ষীয় রেজোন্যান্স নির্ণয় করেছিলেন। এছাড়াও তিনি ১৯৭৪ সালে মেরিনার ১০ মহাকাশযানের অভিকর্ষ-প্রভাবিত প্রাস নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

তথ্যসূত্র

Tags:

বুধ গ্রহ নামকরণ ও সংস্কৃতিবুধ গ্রহ অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যাবলীবুধ গ্রহ বায়ুমণ্ডলবুধ গ্রহ চুম্বক গোলকবুধ গ্রহ কক্ষপথ ও ঘূর্ণনবুধ গ্রহ পর্যবেক্ষণবুধ গ্রহ গবেষণাবুধ গ্রহ তথ্যসূত্রবুধ গ্রহ আরও দেখুনবুধ গ্রহ বহিঃসংযোগবুধ গ্রহআন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালাআপাত মানইংরেজি ভাষাগ্রহমেরিনার ১০মেসেঞ্জার (নভোযান)সূর্যসৌরজগৎ

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

মৌর্য সাম্রাজ্যমহাস্থানগড়নামাজের নিয়মাবলীঅণুজীবপ্রথম উসমানইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ঢাকা বিভাগফেরেশতাইউরোপীয় দেশগুলো ও অধীনস্থ ভূভাগের তালিকানরেন্দ্র মোদীআবু হানিফাশচীন তেন্ডুলকরমঙ্গোল সাম্রাজ্যবাংলা সাহিত্যের ইতিহাসপলল শাখানোরা ফাতেহিবাংলাদেশের পদমর্যাদা ক্রমবিজয় দিবস (বাংলাদেশ)শেখ হাসিনামাহিয়া মাহিক্রিয়াপদত্রিভুজ১৮৫৭ সিপাহি বিদ্রোহবিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমভারতবাঙালি হিন্দু বিবাহবন্ধুত্বঅর্থনীতিমঙ্গলকাব্যবাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধনীসমূহচেন্নাই সুপার কিংসমিশরবিকাশবাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনমাদারীপুর জেলাইসলামে যৌনতাএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)কিশোরগঞ্জ জেলাবৌদ্ধধর্মবিশ্ব দিবস তালিকাযুক্তফ্রন্টজন্ডিসমানিক বন্দ্যোপাধ্যায়এশিয়ান্যাটোগোপালগঞ্জ জেলাময়মনসিংহ জেলাবৃহস্পতি গ্রহক্যান্সারদুধবাংলাদেশের পোস্ট কোডের তালিকালোকনাথ ব্রহ্মচারীশায়খ আহমাদুল্লাহশিবা শানুমাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ময়মনসিংহপানি দূষণপ্রাণ-আরএফএল গ্রুপকৃত্তিবাসী রামায়ণউদ্ভিদইরানসংস্কৃত ভাষাভাষাঠাকুরমার ঝুলিআর্দ্রতারুতুরাজ গায়কোয়াড়ভারতীয় উপমহাদেশবাংলাদেশের ইতিহাসগাজওয়াতুল হিন্দলাইসিয়ামযৌনাসনআনন্দবাজার পত্রিকাজীমূতবাহনবাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহের তালিকাআমবেদান্তসারইন্সটাগ্রামবিদ্যালয়🡆 More