ভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জি

ভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জি (অথবা শালিবাহন পঞ্জিকা) হল ভারতীয় উপমহাদেশে বহুলপ্রচলিত একটি প্রাচীন সৌরচান্দ্রিক নির্ভর বর্ষপঞ্জীর সংশোধিত সৌরনির্ভর রূপ যা বর্তমানে ভারতের জাতীয় বর্ষপঞ্জি। এর পঞ্জিকা সাল বঙ্গাব্দের ৫১৫ বছর পূর্বে এবং খ্রিস্টাব্দের ৭৮ বছর পরে প্রচলিত হয়।

ইতিহাস

উৎপত্তি

ভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জি 
শকাব্দীয় মুদ্রা

এর বর্ষপঞ্জীর উৎস নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য আছে। কুষাণ রাজা কণিষ্ককে এই বর্ষপঞ্জির আদিপুরুষ শক পঞ্জিকার প্রণেতা বলে বিশ্বাস করা হয়। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতানুসারে প্রাচীন ভারতীয় নৃপতি শালিবাহনের প্রয়াণ দিবস থেকেই এর সূচনা। এটি একটি সৌর পঞ্জিকা এবং পূর্বে এর মাস এবং দিনাঙ্ক গণিত হত খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে উদ্ভূত প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিষয়ক গ্রন্থ ‘সূর্য সিদ্ধান্তের’ সৌরবর্ষ গণনার বিধি মান্য করে অর্থাৎ রবিসংক্রান্তি অনুসারে।

একটি রাশি থেকে অপর একটি রাশিতে সূর্যের আপাতগমনের (প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর বার্ষিক গতি) ফলে মাস পরিবর্তিত হত। পূর্ব ভারতে প্রচলিত বঙ্গাব্দে এবং ভাস্করাব্দে বর্ষগণনার ক্ষেত্রে এখনও এই প্রাচীন পদ্ধতিটিই অনুসৃত হয়ে থাকে। শক পঞ্জিকায় অঞ্চলভেদে বিভিন্ন সময়ে বর্ষারম্ভ হত। যেমন উত্তর ভারতে বছর শুরু হত চৈত্র মাসে কিন্তু পূর্ব ভারতে নববর্ষ অনুষ্ঠিত হত বৈশাখ মাসে। ভারতীয় ইতিহাসের আধুনিক যুগেও অন্যান্য অব্দের পাশাপাশি এর ব্যবহার বহুলভাবে লক্ষিত হয়। আসামে "ভাস্করাব্দ" নামক একটি পঞ্জিকা ও পঞ্জিকা সালের প্রচলিত থাকলেও শক পঞ্জিকা ও এর পঞ্জিকা সাল শকাব্দের ব্যবহারই বহুল প্রচলিত। সূর্যসিদ্ধান্তের প্রাচীন নিয়ম মেনেই অসমে ১ বহাগ (বৈশাখ) পালিত নববর্ষ উৎসব "বহাগ বিহু" থেকে শকাব্দ গণনা করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বঙ্গদেশে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিক এবং সাময়িক পত্রে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য “তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা”।

জাতীয় বর্ষপঞ্জি হিসেবে গ্রহণ

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন ভারত একটি প্রজাতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রে রূপান্তরিত হবার পরে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার একটি জাতীয় পঞ্জিকা প্রচলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এর ফলে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ ১৮৭৯ শকাব্দে ভারত সরকার বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে একটি “পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি” গঠন করেন। এই কমিটি শকের পঞ্জিকা সহ ভারতে প্রচলিত অন্যান্য বর্ষপঞ্জিসমূহের সংস্কারসাধনে নিযুক্ত হয়। উক্ত কমিটি শকাব্দকে ঋতুনিষ্ঠ ও সর্বস্তরে ব্যবহারোপযোগী করে তোলার জন্য এবং আন্তর্জাতিক স্তরে প্রচলিত গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলার জন্য এই বর্ষপঞ্জীকে সংস্কার করতে উদ্যোগী হয়। “সূর্য সিদ্ধান্তে” উল্লিখিত নিরয়ণ বর্ষগণনারীতি পরিহার করে “পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি” সায়ন সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করে এবং বারো মাসের দৈর্ঘ্য স্থির করে দেয়। এছাড়া বার্ষিক গতির সাথে সমন্বয় রেখে অধিবর্ষে চৈত্র মাসে একটি অতিরিক্ত দিন যোগ করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ মার্চ (১ চৈত্র ১৮৭৯ শক) ভারত সরকার এই সংস্কারপ্রাপ্ত পঞ্জিকাকে ভারতের জাতীয় পঞ্জিকা হিসাবে গ্রহণ করে এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সর্বস্তরে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর সাথে “ভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জি”-এর ব্যবহার প্রচলন করে। কিন্তু সমস্ত প্রশাসনিক বিভাগে, আকাশবাণী এবং দূরদর্শনের ঘোষণায় শক পঞ্জিকা এবং এর পঞ্জিকা সাল শকাব্দের প্রচলন হলেও এখনও ১ চৈত্র (২১/২২ মার্চ), ভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জীর নববর্ষের দিন জাতীয় ছুটির দিন হিসাবে স্বীকৃত হয়নি। ধর্মীয় নিরয়ণ বর্ষপঞ্জীর বহুল প্রচলনের কারণেই সম্ভবত সংস্কারকৃত এই বর্ষপঞ্জিটি উপেক্ষিত রয়ে গেছে।

বর্ষপঞ্জির গঠন

বর্ষপঞ্জির মাসগুলো পার্শ্বীয় রাশি এর পরিবর্তে বৌদ্ধ পঞ্জিকায় ব্যবহৃত ক্রান্তীয় রাশি অনুসরণ করে। উক্ত কমিটির সিদ্ধান্তানুসারে ভারতের জাতীয় বর্ষপঞ্জির বারো মাসের দিনসংখ্যা হল এইরূপ:

# মাস দৈর্ঘ্য গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী অনুসারে মাসের আরম্ভকাল যে ক্রান্তীয় রাশিতে (Tropical zodiac) সূর্য অবস্থিত
১) চৈত্র ৩০ দিন(অধিবর্ষে ৩১ দিন) ২২ মার্চ (অধিবর্ষে ২১ মার্চ) মেষ
২) বৈশাখ ৩১ দিন ২১ এপ্রিল বৃষ
৩) জ্যৈষ্ঠ ৩১ দিন ২২ মে মিথুন
৪) আষাঢ় ৩১ দিন ২২ জুন কর্কট
৫) শ্রাবণ ৩১ দিন ২৩ জুলাই সিংহ
৬) ভাদ্র ৩১ দিন ২৩ অগস্ট কন্যা
৭) আশ্বিন ৩০ দিন ২৩ সেপ্টেম্বর তুলা
৮) কার্তিক ৩০ দিন ২৩ অক্টোবর বৃশ্চিক
৯) অগ্রহায়ণ ৩০ দিন ২২ নভেম্বর ধনু
১০) পৌষ ৩০ দিন ২২ ডিসেম্বর মকর
১১) মাঘ ৩০ দিন ২১ জানুয়ারি কুম্ভ
১২) ফাল্গুন ৩০ দিন ২০ ফেব্রুয়ারি মীন

কমিটির ঘোষণা অনুসারে প্রত্যেক বছর মহাবিষুবের পরদিন অর্থাৎ গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর ২২ মার্চ তারিখে এই পঞ্জিকার বর্ষ আরম্ভ হয় এবং তারিখ অনুসারে সেই দিনটি হল ১ চৈত্র। কেবল অধিবর্ষে বর্ষারম্ভ হয় ২১ মার্চ।

মাসগুলোর নাম পুরনো বৌদ্ধ সৌরচান্দ্রিক পঞ্জিকা থেকে নেওয়া হয়েছে, তাই বানানের বিভিন্নতা বিদ্যমান, এবং কোন তারিখটি কোন পঞ্জিকার অন্তর্গত তার সম্ভাব্য উৎস নিয়ে বিভ্রান্তির রয়েছে।

এই বর্ষপঞ্জিতে সপ্তাহের প্রথম দিন রাভিভারা (রবিবার)। রবিবার আধুনিক বর্ষপঞ্জিটির প্রণেতা ভারত সরকারের সরকারি ছুটির দিন।

শক বর্ষপঞ্জির সপ্তাহ
সপ্তাহের দিন শক গ্রেগরীয়
রাভিভারা রবিবার
সোমভারা সোমবার
মঙ্গলভারা মঙ্গলবার
বুধভারা বুধবার
ব্রাহাস্পাতিভারা বৃহস্পতিবার
শুক্রাভারা শুক্রবার
শানিভারা শনিবার

এই সংশোধিত পঞ্জিকায় বর্ষগণনার বিধি অনুসারে এই পঞ্জিকার সালের সাথে ৭৮ যোগ করে প্রাপ্ত যোগফলকে ৪ (চার) দ্বারা ভাগ করে যদি ভাগশেষ থাকে ০ (শূন্য) তাহলে সেই বছর অধিবর্ষ হয়। কিন্তু শকাব্দের সাথে ৭৮ যোগ করার পর প্রাপ্ত যোগফল যদি ১০০-এর গুণিতক হয় তাহলে তাকে ৪০০ দ্বারা ভাগ করার পর যদি ভাগশেষ থাকে ০ (শূন্য) তাহলে সেই বছর অধিবর্ষ হয়।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Tags:

ভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জি ইতিহাসভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জি বর্ষপঞ্জির গঠনভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জি আরও দেখুনভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জি তথ্যসূত্রভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জি বহিঃসংযোগভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জিখ্রিস্টাব্দবঙ্গাব্দবর্ষপঞ্জীভারতশকাব্দ

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

সাঁওতালমানুষভূত্বকউসমানীয় সাম্রাজ্যকৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাদ্বৈত শাসন ব্যবস্থাবাংলাদেশ রেলওয়েরামইসরায়েলের ইতিহাসযৌনাসনঅন্নদামঙ্গলমুখমৈথুনবহুব্রীহি সমাসঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েবাংলাদেশের ইতিহাসওয়ালটন গ্রুপআনু মুহাম্মদহামগাজওয়াতুল হিন্দসিলেটচন্দ্রগুপ্ত মৌর্যগেরিনা ফ্রি ফায়ারআগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাবিশ্বায়নআকিজ গ্রুপআলী খামেনেয়ীপ্রাচীন ভারতশান্তিনিকেতনযোগাযোগপাখিহিন্দুধর্মের ইতিহাসপ্রথম ওরহানওমানথাইল্যান্ডআদমসমকামিতাসমাজপাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারচট্টগ্রাম বিভাগঅস্ট্রেলিয়াপ্রাণ-আরএফএল গ্রুপমৌর্য সাম্রাজ্যআল হিলাল সৌদি ফুটবল ক্লাবযুক্তরাজ্যইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিসূরা নাসফেরেশতাখুলনা বিভাগইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সব্যবস্থাপনাবিভিন্ন দেশের মুদ্রাবাংলাদেশী জাতীয় পরিচয় পত্রশায়খ আহমাদুল্লাহবাংলাদেশঢাকা বিভাগবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টরসমূহবিদ্যালয়মীর মশাররফ হোসেনবঙ্গবন্ধু-১ভারতের রাষ্ট্রপতিদের তালিকাওপেকম্যালেরিয়াযিনামোহনবাগান সুপার জায়ান্টথানকুনিদারাজমৌসুমি বায়ুশাকিব খান অভিনীত চলচ্চিত্রের তালিকাকোষ বিভাজনকৃষ্ণচূড়াটাইফয়েড জ্বরকুষ্টিয়া জেলাঅভিস্রবণসাদ্দাম হুসাইনবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ঢাকা মেট্রোরেলবৃহস্পতি গ্রহকাবামৌলসমূহের ইলেকট্রন বিন্যাস (উপাত্ত পাতা)🡆 More