মার্কসবাদ

মার্কসবাদ (আরো একটি বানান শৈলীঃ মার্ক্সবাদ) ঊনবিংশ শতাব্দীর দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং বিপ্লবী কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক অনুশীলন ও সামাজিক তত্ত্ব। এই তত্ত্বে সামাজিক পরিবর্তনের দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিতে সামাজিক দ্বন্দ্ব ও শ্রেণি-সম্পর্ককে ভিত্তি করে সমাজ বিশ্লেষণের বিশ্বদর্শন ও প্রক্রিয়া বয়ান করা হয়েছে। মার্কসবাদী প্রক্রিয়াকে পদ্ধতিগত অর্থনৈতিক পরিবর্তনে শ্রেণিসংগ্রামের ভূমিকা এবং পুঁজিবাদের বিকাশের সমালোচনা ও বিশ্লেষণে অর্থনৈতিক ও সামজিক-রাজনৈতিক জিজ্ঞাসা ও প্রয়োগে ব্যবহার করা হয়।

মার্কসবাদ
কার্ল মার্কস

প্রয়োগিক বিবেচনায় মার্কসবাদ হচ্ছে মালিক শ্রেণির তথা বুর্জোয়া শ্রেণির শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন তথা মজুরি-দাসত্ব থেকে প্রলেতারিয়েতের বা শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির মতবাদ। এটি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও বৈপ্লবিক সাধনক্রিয়ার সামগ্রিক রূপ। ঊনিশ শতকের জার্মান দর্শন, ইংরেজি অর্থশাস্ত্র এবং ফরাসি সমাজতন্ত্র রূপে মানবজাতির যা শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মার্কসবাদ সে সবের বৈধ উত্তরাধিকার। । হেগেলের দর্শন, অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডোর অর্থনীতি তত্ত্ব এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি সমাজতন্ত্রের সমন্বয়ে তিনি সমাজের সমালোচনা করেন যেটাকে তিনি বৈজ্ঞানিক ও বিপ্লবী দাবি করেন। পুঁজি: "রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনা'(ডাস কাপিটাল) বইয়ে তার চিন্তার সুসংগত বহিপ্রকাশ ঘটে।

মার্কসবাদের মর্মার্থ

এমিল বার্ণসের মতে মার্কসবাদ হলো এই জগৎ, জীবন এবং তারই অংশ মানব সমাজ সম্পর্কে সাধারণ তত্ত্ব। এই তত্ত্ব মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতার বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত। যে সব অস্পষ্ট ধারণা এতদিন প্রচলিত ছিলো এবং এখনও আছে মার্কসীয় তত্ত্ব সে সবগুলির বিরোধী। মার্কসের তত্ত্ব তার সমসাময়িক সমাজের ক্ষেত্রে, অর্থাৎ পুঁজিবাদী সমাজের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়। মার্কসীয় রাজনীতি তত্ত্ব অর্থনীতি, ইতিহাস ও সামাজিক তত্ত্বের পটভূমিতেই বিবেচ্য। তত্ত্ব হিসেবে মার্কসবাদের কোনো শেষ সীমারেখা নেই; ইতিহাসের যত অগ্রগতি হয় এবং মানুষ অধিকতর পরিমাণে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকে ততই মার্কসবাদ সমৃদ্ধ হতে থাকে। মার্কসবাদী দর্শন কোন কঠোরভাবে সংজ্ঞায়িত দর্শনের উপশাখা নয়, কারণ এই দর্শন নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা যেমন নন্দনতত্ত্ব, নীতিবিদ্যা, সত্তাতত্ত্ব, তত্ত্বীয় মনোবিজ্ঞান, এবং বিজ্ঞানের দর্শনের তার প্রভাব বিস্তৃত করেছে। এছাড়া মার্কসবাদী দর্শন রাষ্ট্রদর্শন এবং ইতিহাসের দর্শনকে সুস্পষ্টভাবে প্রভাবিত করেছে। দর্শনের মার্কসবাদের চাবিকাঠি তার দ্বান্দ্বিক বস্তবাদ এবং এটির সকল চিন্তার লক্ষ্য হচ্ছে রাজনৈতিক অনুশীলনের প্রতি দায়বদ্ধতা।

সার্বিক দেখা

একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি হচ্ছে উৎপাদনের উপায়ের সামাজিক মালিকানা। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে উৎপাদনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তিগত মুনাফা তৈরি নয়, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সকল সদস্যদের বৈষয়িক ও আত্মিক সন্তুষ্টিকরণ। অর্থাৎ সমাজতন্ত্রে উৎপাদন হচ্ছে ব্যবহারের জন্য। যেমন এঙ্গেলস লক্ষ্য করেছেন: "উৎপন্ন দ্রব্য যেখানে প্রথমে উৎপাদককে ও পরে দখলকারীকে দাসত্ববন্ধনে বাঁধে, দখলের সেই পুঁজিবাদী পদ্ধতির জায়গায় তখন আসে দখলের এমন এক পদ্ধতি আধুনিক উৎপাদন-উপায়ের চরিত্র যার ভিত্তি; একদিকে উৎপাদন সচল ও সম্প্রসারণের উপায়স্বরূপ প্রত্যক্ষ সামাজিক দখল, এবং অন্যদিকে জীবিকা নির্বাহ ও উপভোগের উপায়স্বরূপ প্রত্যক্ষ ব্যক্তিগত দখল।"

ঐতিহাসিক ভিত্তি

রাষ্ট্রিক অর্থনীতিতে মার্কসবাদের পূর্বসূরি হলেন ইংরেজ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ এবং ডেভিড রিকার্ডো। তারা দেখান যে সমাজের সমস্ত সম্পদের মূল উৎস হলও শ্রম এবং তাতে করে বৈজ্ঞানিক অর্থনীতির ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। উনিশ শতকের মহান কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রী সাঁ সিমোঁ শার্ল ফুরিয়ে এবং রবার্ট ওয়েন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করেন এবং ভবিষ্যৎ সমাজের প্রধান প্রধান দিকের একটা ছবি দেন। তবে তা প্রতিষ্ঠার পথ দেখান কাল্পনিক পথে। জার্মান দর্শন, ব্রিটিশ অর্থনীতি এবং কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র রূপে মানবজাতির শ্রেষ্ঠ যা কিছু সৃষ্টি, তার বৈধ উত্তরাধিকারী হলও মার্কসবাদ। তবে মার্কস, এঙ্গেলস তাদের তাত্ত্বিক পূর্বসূরিদের ধারাবাহকই ছিলেন না, তারা বিচার করে সেগুলি ঢেলে সাজিয়েছেন, গড়ে তুলেছেন নতুন মতবাদ। তাদের মতবাদে প্রকাশ পায় সবচেয়ে প্রগতিশীল ও বৈপ্লবিক শ্রেণী, প্রলেতারিয়েতের মৌলিক স্বার্থ। মেহনতিদের সামাজিক মুক্তির ইতিহাসে তারা সত্যিকারের এক বিপ্লব ঘটান।

ভিত্তি-উপরিকাঠামোর দ্বন্দ্ব

মার্কসবাদের মতে উৎপাদন ব্যবস্থা বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হলো ভিত্তি, আর ভিত্তির উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা হলো উপরিকাঠামো। মার্কসবাদী রাজনীতি অনুসারে, আগে ভিত্তি, পরে উপরিকাঠামো; আগে অর্থনীতি, পরে সংস্কৃতি। মানুষের জীবন চর্চার ক্ষেত্রে ভিত্তিটাই হলো প্রাথমিক বা মুখ্য উপাদান, আর উপরিকাঠামো হলো গৌণ বা কম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অবশ্য এখানে উল্লেখ্য যে, ভিত্তি-উপরিকাঠামোর সম্পর্কটা যান্ত্রিক নয়, পরন্তু দ্বান্দ্বিক। অর্থাৎ ভিত্তি উপরিকাঠামোকে গড়ে তোলে, আবার উপরিকাঠামোও ভিত্তির উপর ক্রিয়া করে_এরা পরস্পরকে যুগপৎ দ্বান্দ্বিকভাবে প্রভাবিত করে। মার্কসীয় রাজনীতি ভিত্তি-উপরিকাঠামোকে এইরূপ দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের জায়গা থেকে দেখে থাকে।

ধারণাসমূহ

ঐতিহাসিক বস্তুবাদ

"সমাজ ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত নয়, কিন্তু আন্তঃসম্পর্কের যোগফলকে প্রকাশ করে, সেই সম্পর্কগুলোর ভেতরেই ব্যক্তিগণ দাঁড়ায়।"

—  Karl Marx, Grundrisse, 1858

ইতিহাসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদী তত্ত্ব হচ্ছে সমাজব্যাখ্যার পদ্ধতি। মার্কসের কাছে সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরের জন্যই সমাজের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন অনুভূত হয়।

মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রয়োগকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলা যায়। সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার অনুশীলন নয়, সমাজবিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মগুলোর অনুশীলনই ঐতিহাসিক বস্তুবাদের কাজ। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সমাজের অতীত ও বর্তমান ঘটনাবলিকে সঠিকভাবে বুঝতে সাহায্য করবার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমজীবী জনগণের স্বার্থে সমাজজীবনের রূপান্তর ঘটাতেও সাহায্য করে। এক কথায় সমাজকে সম্যক উপলব্ধিতে সাহায্য করে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ।

তথ্যসূত্র

বিবলিওগ্রাফি

  • {{cite book |title=My Life: A Spoken Autobiography|last=Castro, Fidel
  • Coltman, Leycester (২০০৩)। The Real Fidel Castro। New Haven and London: Yale University Press। আইএসবিএন 978-0-300-10760-9  templatestyles stripmarker in |শেষাংশ= at position 1 (সাহায্য)
  • Green, Sally (১৯৮১)। Prehistorian: A Biography of V. Gordon Childe। Bradford-on-Avon, Wiltshire: Moonraker Press। আইএসবিএন 0-239-00206-7  templatestyles stripmarker in |শেষাংশ= at position 1 (সাহায্য)
  • Lenin, Vladimir (1967 [1913])। Karl Marx: A Brief Biographical Sketch with an Exposition of Marxism। Peking: Foreign Languages Press।  templatestyles stripmarker in |শেষাংশ= at position 1 (সাহায্য); এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য) Available online at here [২]
  • Marx, Karl (১৮৪৯)। Wage Labour and Capital। Germany: Neue Rheinische Zeitung।  templatestyles stripmarker in |শেষাংশ= at position 1 (সাহায্য) Available online here [৩]
  • Trigger, Bruce G. (২০০৭)। A History of Archaeological Thought (Second Edition)। New York: Cambridge University Press। আইএসবিএন 978-0-521-60049-1  templatestyles stripmarker in |শেষাংশ= at position 1 (সাহায্য)
  • Avineri, Shlomo (১৯৬৮)। The Social and Political Thought of Karl Marx। Cambridge University Press। 
  • Dahrendorf, Ralf (১৯৫৯)। Class and Class Conflict in Industrial Society। Stanford, CA: Stanford University Press। 
  • Jon Elster, An Introduction to Karl Marx. Cambridge, England, 1986.
  • Michael Evans, Karl Marx. London, 1975.
  • Kołakowski, Leszek (১৯৭৬)। Main Currents of Marxism। Oxford University Press। 
  • Parkes, Henry Bamford (১৯৩৯)। Marxism: An Autopsy। Boston: Houghton Mifflin। 
  • Prychitko, David L. (২০০৮)। "Marxism"। David R. Henderson (ed.)। Concise Encyclopedia of Economics (2nd সংস্করণ)। Library of Economics and Liberty। আইএসবিএন 978-0865976658ওসিএলসি 237794267 
  • Robinson, Cedric J.: Black Marxism: The Making of the Black Radical Tradition, 1983, Reissue: Univ North Carolina Press, 2000
  • Rummel, R.J. (1977) Conflict In Perspective Chap. 5 Marxism, Class Conflict, and the Conflict Helix
  • McLellan, David (২০০৭)। Marxism After Marx। Basingstoke: Palgrave Macmillan। 

বহিঃসংযোগ

সাধারণ উৎসসমূহ

ভূমিকার প্রবন্ধসমূহ

মার্কসবাদী ওয়েবসাইটসমূহ

Tags:

মার্কসবাদ ের মর্মার্থমার্কসবাদ সার্বিক দেখামার্কসবাদ ঐতিহাসিক ভিত্তিমার্কসবাদ ভিত্তি-উপরিকাঠামোর দ্বন্দ্বমার্কসবাদ ধারণাসমূহমার্কসবাদ তথ্যসূত্রমার্কসবাদ বহিঃসংযোগমার্কসবাদঐতিহাসিক বস্তুবাদকার্ল মার্কসপুঁজিবাদফ্রিডরিখ এঙ্গেলস

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

বৌদ্ধধর্মবিদায় হজ্জের ভাষণবঙ্গভঙ্গ আন্দোলনলিওনেল মেসিইন্দোনেশিয়াবাংলাদেশের স্থল বন্দরসমূহের তালিকাভারতের স্বাধীনতা বিপ্লবীদের তালিকাইউক্যালিপটাসকানাডানামাজের নিয়মাবলীপূরণবাচক সংখ্যা (ভাষাতত্ত্ব)বিন্দুইরাকসুকান্ত ভট্টাচার্যওমানডাচ্-বাংলা ব্যাংক পিএলসিসাদ্দাম হুসাইনব্রাজিল জাতীয় ফুটবল দলওপেকবাংলাদেশের সংবাদপত্রের তালিকাইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ভরিইহুদিঢাকা মেট্রোরেলের স্টেশনের তালিকাঅশ্বত্থবিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকাশ্মীরযোনিথ্যালাসেমিয়াফেরেশতাযোগাসনগোত্র (হিন্দুধর্ম)পশ্চিমবঙ্গের জেলাকমনওয়েলথ অব নেশনসআয়াতুল কুরসিবাংলাদেশের জেলাপশ্চিমবঙ্গবাংলাদেশ পুলিশশরীয়তপুর জেলাবাংলাদেশের নদীর তালিকাপানিলোহিত রক্তকণিকাপায়ুসঙ্গমবাস্তুতন্ত্রপ্রাকৃতিক ভূগোলসাঁওতালইসরায়েল–হামাস যুদ্ধমিঠুন চক্রবর্তীকৃত্তিবাস ওঝাসূরা নাসকিশোরগঞ্জ জেলামঙ্গল গ্রহঠাকুরমার ঝুলিচাঁদপুঁজিবাদভালোবাসাবিরাট কোহলিঅমর সিং চমকিলাসিলেট বিভাগজনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় (বাংলাদেশ)তক্ষকসাইপ্রাসবাংলাদেশ সেনাবাহিনীসন্ধিশান্তিনিকেতনমুসাফিরের নামাজশাহ সিমেন্টবাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলইন্টার মিলানথানকুনিইন্দিরা গান্ধীমুহাম্মাদের বংশধারাভারতের জনপরিসংখ্যানসার্বিয়াবাংলাদেশের জেলাসমূহের তালিকাসাদিকা পারভিন পপিপশ্চিমবঙ্গের নদনদীর তালিকা🡆 More