ভাষা আন্দোলন দিবস

ভাষা আন্দোলন দিবস (যা মাতৃভাষা দিবস বা জাতীয় শহীদ দিবস নামেও পরিচিত) বাংলাদেশে পালিত একটি জাতীয় দিবস। ১৯৫২ সালে তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় আন্দোলনের মাধ্যমে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার লক্ষ্যে যারা শহীদ হয় তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের জন্য এই জাতীয় দিবসটি পালন করা হয়।

ভাষা আন্দোলন দিবস
ভাষা আন্দোলন দিবস
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষা আন্দোলনে শহীদদের সম্মানে নির্মিত শহীদ মিনার
আনুষ্ঠানিক নামভাষা আন্দোলন দিবস
অন্য নামশহীদ দিবস
পালনকারীভাষা আন্দোলন দিবস বাংলাদেশ
উদযাপনজাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করে উত্তোলন, প্যারেড, জাতীয় সঙ্গীতআমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গান গাওয়া, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
তারিখ২১ ফেব্রুয়ারি
পরবর্তী আয়োজন২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
সংঘটনবার্ষিক
সম্পর্কিতআন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

ইতিহাস

প্রেক্ষাপট

১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষাভাষী ৪ কোটি ৪০ লাখ জনগণ পাকিস্তান অধিরাজ্যের অংশ হয়ে যায়। পাকিস্তানের সরকার, প্রসাশন, সামরিক বাহিনীতে পাকিস্তানের পশ্চিম প্রান্তের আধিপত্য দেখা দেয়। করাচিতে জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনে শুধুমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা এবং স্কুল ও মিডিয়াতে ব্যবহার করার প্রস্তাব করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব প্রান্তে এর প্রতিবাদ দেখা দেয়। ঢাকায় ছাত্ররা তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা আবুল কাসেমের নেতৃত্বে র‍্যালি বের করে। বৈঠকে বাংলাকে পাকিস্তানের একটি সরকারি ভাষা এবং পূর্ব বাংলার শিক্ষার মাধ্যম করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে, পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন অনুমোদিত বিষয় তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেয় এবং একই সঙ্গে মুদ্রার নোট এবং স্ট্যাম্প থেকে বাংলা মুছে ফেলা হয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেন। এতে বাঙালি জনগণ বিক্ষুব্ধ হয় এবং ছাত্রদের একটি বড় অংশ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাকে একটি সরকারী ভাষা করার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জমায়েত হয়। এজন্য ছাত্ররা ঢাকায় মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করে।

প্রতিবাদ

ভাষা আন্দোলন দিবস 
ঢাকায় ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ মিছিল।

১৯৫২ সালের হিসেবে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক ছিল বাঙালী, যারা মোট নাগরিকের প্রায় ৫৪%। ঐ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) শুধুমাত্র উর্দুকে জাতীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রতিবাদে বাঙালী ছাত্ররা সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। সকাল নয়টায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে জড়ো হতে শুরু করে। সশস্ত্র পুলিশ বেষ্টিত ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সোয়া এগারোটার দিকে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভাঙার চেষ্টা করে। ছাত্রদের একটি দল ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে দৌড় দেয় এবং বাকিরা পুলিশ পরিবেষ্টিত ক্যাম্পাসে মিছিল করে। উপাচার্য পুলিশকে গুলি চালানো বন্ধ করতে এবং ছাত্রদেরকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার আদেশ দেন। ছাত্রদের চলে যাবার সময় পুলিশ ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের জন্য কিছু ছাত্রকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের সংবাদ পেয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা পূর্ব বাংলা গণপরিষদ অবরোধ করে সেখানে তাদের প্রস্তাব উপস্থাপনের দাবি জানায়। ছাত্রদের একটি দল বিল্ডিঙের মধ্যে দ্রুত ঢোকার চেষ্টাকালে পুলিশ গুলি চালায় এবং তাতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউর সহ অনেক ছাত্র নিহত হয়। হত্যাকাণ্ডের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সারা শহর জুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। দোকানপাট, অফিস ও গনপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ধর্মঘট শুরু হয়। আইনসভায়, মনোরঞ্জন ধর, বসন্তকুমার দাস, শামসুদ্দিন আহমেদ এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সহ ছয় বিধায়ক মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে আহত ছাত্রদের দেখতে হাসপাতালে যাওয়ার দাবি জানান এবং শোকের চিহ্ন হিসেবে গণপরিষদ মুলতবির দাবি করেন। মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, শরফুদ্দীন আহমেদ, শামসুদ্দীন আহমেদ খন্দকার এবং মশিউদ্দিন আহমেদ সহ সরকারি দলের কিছু সদস্য সমর্থন দেন। তবে নুরুল আমিন এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

এই আন্দোলনের সাথে বেগম আফসরুন্নেসা,লিলি খান,আনোয়ারা খাতুন ও যুক্ত ছিলেন।বাংলার ভাষা আন্দোলনে আরো যে সকল নারী রা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন,তাঁরা হলেন সুফিয়া ইব্রাহিম ও শাফিয়া খাতুন।এঁরা ভাষা-সৈনিক হিসেবে প্রণম্য।[১]

প্রতিক্রিয়া

সংবিধান সংশোধন

১৯৫৪ সালের ৭ মে গণপরিষদে মুসলিম লীগের সমর্থনে বাংলা আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বাংলা পাকিস্তানের দ্বিতীয় জাতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পায় এবং সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১৪ (১) পুনর্লিখিত হয় এভাবে "পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং বাংলা"।

তবে, আইয়ুব খানের নেতৃত্বে গঠিত সামরিক সরকার উর্দুকে একমাত্র জাতীয় ভাষা হিসেবে পুনরস্থাপনের চেষ্টা চালায়। ৬ জানুয়ারি ১৯৫৯-এ তার সরকার একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে ১৯৫৬ সালের সংবিধানের দুই রাষ্ট্র ভাষা নীতি সমর্থনের সরকারি অবস্থান পুনর্বহাল করে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা

যদিও ১৯৫৬ সালেই সরকারি ভাষার সমস্যা নিষ্পত্তি হয়ে যায়, আইয়ুব খানের সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানের (পূর্ব বাংলার নতুন নামকরণ) ক্ষতি করে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষার প্রয়াস চালু রাখে। জনসংখ্যার দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানীরা সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও সামরিক ও বেসামরিক চাকুরীর ক্ষেত্রে অনুপস্থাপিতই হয়ে থাকে এবং রাষ্ট্রীয় তহবিল ও অন্যন্য সরকারী সহায়তার সামান্য অংশই পেতে থাকে। কোন প্রতিনিধি সরকার না থাকার কারণেই এ অবস্থার মধ্যে থাকতে হয় তাদের। অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার কারণে দুই পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকায় এবং অধিকতর স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে বাঙালী জাতীয়তাবাদী মনোভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা আওয়ামী লীগ ছয় দফা আন্দোলন শুরু হয়। এর একটি দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের নাম বদলে "বাংলাদেশ" রাখার, যা পরবর্তীতে পূর্ব বাংলার মানুষকে ধাবিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে।

স্মৃতিরক্ষা

এই আন্দোলন স্মৃতিরক্ষায় গণহত্যার স্থানে একটি আনুষ্ঠানিক এবং প্রতীক ভাস্কর্য শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়েছে। দিনটি বাংলাদেশে এবং পরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শহীদ দিবস হিসাবে পালিত হয়। এই দিনটি বাংলাদেশে সরকারী ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ইউনেস্কোর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বরের সাধারণ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশের জমা দেয়া এবং অন্যান্য ২৮ টি দেশের সমর্থনে জমা দেওয়া খসড়া প্রস্তাবটি গ্রহণ করে।

আসাম ও উত্তর-পূর্ব ভারত

১৯ মে, ১৯৬১-তে ভারতের আসাম রাজ্যে অসমীয়া ভাষাকে বাধ্যতামুলক করার প্রতিবাদে বাঙালী অধ্যুষিত বরাক উপত্যকার শিলচর শহরে আন্দোলনরত ১১ জন মারা যায় পুলিশের গুলিতে।

আসাম ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বাঙালীরা শিলচর রেলস্টেশনে নিহত ১১ জনের স্মরণে ১৯শে মে ভাষা আন্দোলন দিবস হিসেবে পালন করে।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

গ্রন্থপঞ্জি

  • আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, ঢাকা, ১৯৭৫।
  • আবদুল হক, ভাষা-আন্দোলনের আদি পর্ব, ঢাকা, ১৯৭৬।
  • বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, ১ম খন্ড, ঢাকা, ১৯৭৯।

বহিঃসংযোগ

Tags:

ভাষা আন্দোলন দিবস ইতিহাসভাষা আন্দোলন দিবস প্রতিক্রিয়াভাষা আন্দোলন দিবস স্মৃতিরক্ষাভাষা আন্দোলন দিবস আসাম ও উত্তর-পূর্ব ভারতভাষা আন্দোলন দিবস আরও দেখুনভাষা আন্দোলন দিবস তথ্যসূত্রভাষা আন্দোলন দিবস গ্রন্থপঞ্জিভাষা আন্দোলন দিবস বহিঃসংযোগভাষা আন্দোলন দিবসপূর্ব বাংলাবাংলা ভাষাবাংলা ভাষা আন্দোলনবাংলাদেশে পালিত দিবসসমূহশহীদসরকারী ভাষা

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিক্রোমোজোমবাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানতুরস্কইসলাম ও হস্তমৈথুনঅর্থ (টাকা)বীর শ্রেষ্ঠওজোন স্তরহিন্দুধর্মভারতের রাষ্ট্রপতিদের তালিকালাইসিয়ামকান্তনগর মন্দিরদিল্লি ক্যাপিটালসনরসিংদী জেলামুঘল সম্রাটবাংলাদেশের ব্যাংকসমূহের তালিকাকালেমাইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিপুঁজিবাদমানুষব্যাংকএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশের ইতিহাসতাসনিয়া ফারিণঅসমাপ্ত আত্মজীবনীশিব নারায়ণ দাসধর্মহিসাববিজ্ঞানশশাঙ্কপুরুষে পুরুষে যৌনতারাষ্ট্রবিজ্ঞান০ (সংখ্যা)উত্তম কুমারের চলচ্চিত্রের তালিকাবক্সারের যুদ্ধবর্তমান (দৈনিক পত্রিকা)প্রযুক্তিপলাশীর যুদ্ধজাতিসংঘের মহাসচিবশরীয়তপুর জেলাজাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়দৈনিক যুগান্তরবিভিন্ন দেশের মুদ্রাকানাডাউইলিয়াম শেকসপিয়রপারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রসমূহের তালিকাসিলেট বিভাগমিয়া খলিফাতৃণমূল কংগ্রেসশব্দ (ব্যাকরণ)গণিতঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েশ্রাবস্তী দত্ত তিন্নিকুষ্টিয়া জেলাভিসাঅভিস্রবণলক্ষ্মীপুর জেলালালবাগের কেল্লাইন্সটাগ্রামরামবাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়জীবাশ্ম জ্বালানিআসানসোলআল্লাহর ৯৯টি নামঅপটিক্যাল ফাইবারজনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় (বাংলাদেশ)নিফটি ৫০ভারতীয় জনতা পার্টি২০২২ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জিম্বাবুয়ে সফরইউরোপীয় দেশগুলো ও অধীনস্থ ভূভাগের তালিকাক্রিকেটইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনলাহোর প্রস্তাববাংলাদেশের একাডেমিক গ্রেডিং পদ্ধতিঝড়বাংলাদেশের পদমর্যাদা ক্রমসমকামিতাদেব (অভিনেতা)বই🡆 More