বামপন্থী রাজনীতি

বামপন্থী রাজনীতি হলো রাজনৈতিক ভাবাদর্শের একটি পরিসর যেখানে সামাজিক সাম্য ও সমতাবাদ অর্জনকে সমর্থন করা হয় ও দাবি করা হয় এবং প্রায়শই সামাজিক স্তরবিন্যাসের বিরোধিতা করা হয়। সাধারণত বামপন্থী রাজনীতি সমাজে তাঁদের সঙ্গে জড়িত যাঁরা অন্যের তুলনায় কম পায় বা সুযোগহীন থাকে; সেইসাথে এই ধরনের রাজনীতির সঙ্গে একটি ধারণা জড়িত যে সমাজে অযৌক্তিক বৈষম্য রয়েছে যা হ্রাস বা বিলুপ্ত করা প্রয়োজন। অর্থনীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক ব্যারি ক্লার্কের মতে, বামপন্থী রাজনীতির সমর্থকরা দাবি করে যে মানব উন্নয়নের বিকাশ ঘটে যখন ব্যক্তিরা সহযোগিতামূলক, পারস্পরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্কে জড়িত থাকে যা কেবল তখনই উন্নতি করতে পারে যখন মর্যাদা, ক্ষমতা ও সম্পদের অত্যধিক পার্থক্য দূরীভূত করা হয়।

বামপন্থী রাজনীতি
ফ্রান্সে একটি বিক্ষোভের ছবি। বাম ধারার রাজনীতির বুৎপত্তি ঘটে।
বামপন্থী রাজনীতি
১৯১২ সালের লরেন্স পোশাক শ্রমিকদের হরতালে শ্রমিক ইউনিয়নের বিক্ষোভ

বাম–ডান রাজনৈতিক মতপরিসরের মাঝে বামডান শব্দদ্বয় ফরাসি বিপ্লবের সময় উদ্ভাবিত হয়েছিল, ফরাসি এস্টেট জেনারেলে (ফরাসি: États généraux) আসন ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে। এস্টেটের সভায় বাম দিকে বসতো বিরোধী দল এবং ডান দিকে বসতো শাসক দল। বাম দিকে বসার কারণে তাঁদের বলা হত "বামপন্থী"। বামপন্থীরা সাধারণত পুরাতন শাসন (ফরাসি: Ancien Régime) ও বুর্বোঁ রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করতো এবং বিপ্লব, একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের সৃষ্টি ও সমাজের ধর্মনিরপেক্ষকরণকে সমর্থন করতো; যেখানে ডানদিকের আসনধারী শাসকগোষ্ঠী পুরাতন শাসনের প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের সমর্থন করতো। পরবর্তীকালে ফ্রান্সের অনুকরণে অন্যান্য দেশের আইনসভায়ও বিরোধী দলের সদস্যদের বামদিকে বসার রীতি চালু হয়। ১৮১৫ সালে ফরাসি রাজতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পরে বাম শব্দটির ব্যবহার আরও বিশিষ্ট হয়ে ওঠে, যখন এটি স্বতন্ত্রদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হত। পন্থী শব্দটি ১৯ শতকের শেষের দিকে প্রথম বাম ও ডানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল, সাধারণত অপমানজনক অভিপ্রায়ে, এবং বামপন্থী শব্দটি তাঁদের জন্য প্রয়োগ করা হয়েছিল যাঁরা তাঁদের ধর্মীয় বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অসনাতন ছিলেন।

বামপন্থী বলে বিবেচিত ভাবাদর্শগুলো একটি নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে রাজনৈতিক মতপরিসর বরাবর ওভারটন উইন্ডো (Overton window) বসানোর উপর নির্ভর করে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। ১৮ শতকের শেষের দিকে প্রথম উদার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার পর, বাম শব্দটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উদারনীতিবাদ ও ফ্রান্সে প্রজাতান্ত্রিকতাকে বর্ণনা করার জন্য ব্যবহৃত হত, যা প্রথাগত রক্ষণশীল ও রাজতন্ত্রবাদীদের ডানপন্থী রাজনীতির তুলনায় নিম্ন স্তরের শ্রেণিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণকে সমর্থন করতো। আধুনিক রাজনীতিতে, বাম শব্দটি সাধারণত ধ্রুপদী উদারনীতিবাদের বাম দিকমুখী ভাবাদর্শ ও আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু মাত্রার গণতন্ত্রকে সমর্থন করে। আজ সামাজিক উদারনীতিবাদ ও সামাজিক গণতন্ত্রের মতো মতাদর্শগুলিকে কেন্দ্র-বাম হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যেখানে বামপন্থীরা সাধারণত পুঁজিবাদের আরও সমালোচনামূলক আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত, যেমন– শ্রমিক আন্দোলন, সমাজতন্ত্র, নৈরাজ্যবাদ, সাম্যবাদ, মার্কসবাদ ও সিন্ডিক্যালিজম, যার প্রতিটি ১৯ ও ২০ শতকে প্রাধান্য লাভ করে। এছাড়াও বামপন্থী শব্দটি সাংস্কৃতিকভাবে উদারনৈতিক সামাজিক আন্দোলনের বিস্তৃত পরিসরে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, যার মধ্যে রয়েছে নাগরিক অধিকার আন্দোলন, নারীবাদী আন্দোলন, এলজিবিটি (সমকামী, উভকামীরূপান্তরিত লিঙ্গ) অধিকার আন্দোলন, গর্ভপাত-অধিকার আন্দোলন, বহুসংস্কৃতিবাদ, যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন ও পরিবেশ আন্দোলন, পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর বিস্তৃত পরিসর।

কর্মসূচি

বিশ শতক পরবর্তীকালে বামপন্থী হতে হলে যে বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার তা হচ্ছে বামপন্থীদের সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদ বিরোধী হতে হবে। এছাড়াও বামপন্থী হতে হলে তাদের অবশ্যই সামন্তবাদবিরোধী তথা সামন্ততন্ত্রের অবশেষ উচ্ছেদের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে; সবরকম সম্ভাব্য আকার ও রূপে বিরাজমান ভূমিদাস প্রথার জেরগুলো, যেমন বর্গাপ্রথার উচ্ছেদ করে ভূমিসংস্কার করতে হবে। তৃতীয়ত রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল আইন বা বিধিবিধানকে তারা সমর্থন করবে না। চতুর্থত, তাঁরা উগ্র-জাতীয়তাবাদের বিরোধী অবস্থানে সুদৃঢ় থাকবে।

অর্থনীতি

বামপন্থী অর্থনীতি মুলত কেইন্সীয় অর্থনীতিতে বিশ্বাস করে এবং কারখানা গণতন্ত্র ও সামাজিক বাজারের মাধ্যমে কল্যাণ রাষ্ট্রে অর্থনীতির জাতীয়করণে এবং কেন্দ্রীয় পরিকল্পনায় একটি নৈরাজ্যবাদী বা সিন্ডিক্যালিজমের পক্ষে স্বব্যবস্থাপনার নৈরাজ্যবাদী সাম্যবাদের পক্ষে দাঁড়ায়। শিল্প বিপ্লবের সময় বামপন্থীরা ট্রেড ইউনিয়নকে সমর্থন করত। বিশ শতকের শুরুতে অনেক বামপন্থী অর্থনীতিতে সরকারের শক্তিশালী হস্তক্ষেপের পক্ষে দাঁড়ান।

প্রকারভেদ

বামপন্থী রাজনীতির মতপরিসর কেন্দ্র-বাম থেকে দূর-বাম বা অতি-বাম পর্যন্ত বিস্তৃত। কেন্দ্র-বাম শব্দটি দ্বারা রাজনৈতিক মূলধারার মধ্যে একটি অবস্থানকে বর্ণনা করা হয় যেখানে পুঁজিবাদ ও বাজার অর্থনীতিকে গ্রহণ করে নেওয়া হয়। দূর-বামঅতি-বাম শব্দদ্বয় এমন অবস্থানের জন্য ব্যবহার করা হয় যেগুলো আরও উগ্রবাদী, আরও জোরালোভাবে পুঁজিবাদ ও মূলধারার প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করে, এর পরিবর্তে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ও প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজের পক্ষে সমর্থন করে, যা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক গণতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করে। কেন্দ্র-বামপন্থার মধ্যে রয়েছে সামাজিক গণতন্ত্র, সামাজিক উদারনীতিবাদ, প্রগতিশীলতা ও সবুজ রাজনীতি। কেন্দ্র-বামপন্থার সমর্থকরা একটি ক্ষমতাপ্রাপ্ত সরকারি খাত ও একটি সমৃদ্ধ বেসরকারি খাতের সাথে মিশ্র অর্থনীতিতে সম্পদের বাজার বণ্টনকে গ্রহণ করে। কেন্দ্র-বামপন্থী নীতিগুলো সাধারণত জনস্বার্থ সংক্রান্ত বিষয়ে রাষ্ট্রের সীমিত হস্তক্ষেপের পক্ষে থাকে।

বেশ কয়েকটি দেশে দূর-বামউগ্র বাম শব্দগুলো নৈরাজ্যবাদ, স্বায়ত্তশাসন ও সাম্যবাদের বিভিন্ন প্রকারের সঙ্গে যুক্ত। এগুলো সেইসব গোষ্ঠীগুলোকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয় যাঁরা পুঁজিবাদ বিরোধী ও ইকো-সন্ত্রাসবাদের পক্ষে। ফ্রান্সে, সমাজতান্ত্রিক দল দ্বারা প্রতিনিধিত্বকারী কেন্দ্র-বাম ধারা, ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা প্রতিনিধিত্বকারী বাম ধারা এবং নৈরাজ্যবাদী-সাম্যবাদী, মাওবাদী ও ত্রোৎস্কিবাদীদের দ্বারা প্রতিনিধিত্বকারী দূর-বাম ধারার মধ্যে একটি পার্থক্য তৈরি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ হোমল্যান্ড সিকিউরিটি "বামপন্থী চরমপন্থী"দেরকে এমন গোষ্ঠী হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছে যাঁরা "প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পরিবর্তে সহিংস বিপ্লবের মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে চায়"। দূর-ডানপন্থী রাজনীতির মতোই চরমপন্থী দূর-বামপন্থী রাজনীতিও রাজনৈতিক সহিংসতা, মৌলবাদ, গণহত্যা, সন্ত্রাসবাদ, নাশকতা ও সম্পত্তির ক্ষতি, জঙ্গি সংগঠন গঠন, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, ষড়যন্ত্র, জেনোফোবিয়াজাতীয়তাবাদকে অনুপ্রাণিত করেছে।

চীনে, চীনা নতুন বামপন্থী বাক্যাংশটি দ্বারা তাঁদের বোঝানো হয় যাঁরা ১৯৮০ ও ১৯৯০ এর দশকে তেং শিয়াওফিং প্রণীত অর্থনৈতিক সংস্কারের বিরোধিতা করে, এর পরিবর্তে মাওবাদী নীতির পুনরুদ্ধার ও একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে অবিলম্বে রূপান্তরের পক্ষে সমর্থন দেয়। পশ্চিমা বিশ্বে, নতুন বামপন্থী শব্দটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রাজনীতির জন্য ব্যবহৃত হয়।

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Tags:

বামপন্থী রাজনীতি কর্মসূচিবামপন্থী রাজনীতি অর্থনীতিবামপন্থী রাজনীতি প্রকারভেদবামপন্থী রাজনীতি তথ্যসূত্রবামপন্থী রাজনীতি আরও পড়ুনবামপন্থী রাজনীতি বহিঃসংযোগবামপন্থী রাজনীতিভাবাদর্শসামাজিক স্তরবিন্যাস

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫)ফিফা বিশ্বকাপ ফাইনালের তালিকাটুয়েন্টি২০ আন্তর্জাতিকের রেকর্ড তালিকাপল্লী সঞ্চয় ব্যাংককলকাতা নাইট রাইডার্সহাবীবুল্লাহ্‌ বাহার কলেজব্যোমযাত্রীর ডায়রিযশোর জেলাঅপু বিশ্বাসজনসংখ্যা অনুযায়ী সার্বভৌম রাষ্ট্র ও নির্ভরশীল অঞ্চলসমূহের তালিকাঅকাল বীর্যপাতকম্পিউটারশিক্ষাসলিমুল্লাহ খানজাতীয় গণহত্যা স্মরণ দিবসবাংলাদেশের প্রশাসনিক অঞ্চলস্পিন (পদার্থবিজ্ঞান)পর্তুগালমাশাআল্লাহজাতীয়তাবাদবাঙালি হিন্দু বিবাহমিয়ানমারপাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭০তুতানখামেনইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিসুন্দরবনএ. পি. জে. আবদুল কালামমহাভারতঅস্ট্রেলিয়াসবচেয়ে বেশি গোলকারী ফুটবলারের তালিকাটাইফয়েড জ্বর২০২৩আল-আকসা মসজিদকোস্টা রিকা জাতীয় ফুটবল দলদিনাজপুর জেলাবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধআবদুল হামিদ খান ভাসানীশাহ জাহানচোখবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়মুস্তাফিজুর রহমানবদরের যুদ্ধ২৭ মার্চগোপনীয়তাকুড়িগ্রাম জেলাচতুর্থ শিল্প বিপ্লববাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলবাংলার ইতিহাসগাণিতিক প্রতীকের তালিকাতাপমাত্রাইহুদি ধর্মহরে কৃষ্ণ (মন্ত্র)ভূমি পরিমাপখুলনা বিভাগশশাঙ্কআবু হুরাইরাহভারতের ইতিহাসখুলনাবিড়ালসংস্কৃতিবাংলাদেশের জাতীয় পতাকাপীযূষ চাওলাবেদমুহাম্মাদ ফাতিহসূরা ক্বদরহোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীঅর্থনীতিনিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রযাকাতঈদুল ফিতরগজলউইকিপিডিয়ানামাজের সময়সমূহবাংলা স্বরবর্ণপরীমনিপিরামিডসেনেগালবাংলাদেশের কোম্পানির তালিকাকোকা-কোলা🡆 More