রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ

স্বামী বিবেকানন্দ ব্যতীত রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের ষোড়শ সাক্ষাৎশিষ্য ছিলেন, যারা রামকৃষ্ণ পরমহংসের উপদেশ অনুযায়ী সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। ভক্তগণের কাছে তারা পরমহংসের দূত নামেও পরিচিত। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সংস্কারে এই ষোড়শ শিষ্যের অবদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রামকৃষ্ণের প্রয়াণের পর স্বামী বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী শিষ্যদের নিয়ে বরাহনগরে একটি পোড়ো বাড়িতে ওঠেন এবং গৃহী শিষ্যদের অর্থসাহায্যে প্রথম মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। শুরু হয় রামকৃষ্ণ মিশনের যাত্রা। রামকৃষ্ণ পরমহংসের নামে একাধিক প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন হল স্বামী বিবেকানন্দের স্থাপন করা প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলির একটি। এটি স্থাপিত হয়েছে ১৮৯৭ সালে। স্বাস্থ্যরক্ষা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণকার্য, গ্রাম ব্যবস্থাপনা, আদিবাসী কল্যাণ, প্রাথমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিস্তারে রামকৃষ্ণ মিশন একাধিক শাখাকেন্দ্রের মাধ্যমে কাজ করে থাকে। রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যকলাপ ভারতে হিন্দু পুনর্জাগরণ আন্দোলনের একটি অন্যতম প্রধান অঙ্গ হিসেবে গণ্য হয়। রামকৃষ্ণ পরমহংসের নামাঙ্কিত আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ১৯২৩ সালে স্বামী অভেদানন্দ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ (বেদান্ত সোসাইটি)। ১৯২৯ সালে রামকৃষ্ণ মিশনের কয়েক জন বিক্ষুব্ধ সদস্য স্থাপন করেন রামকৃষ্ণ সারদা মঠ। ১৯৭৬ সালে স্বামী নিত্যানন্দ স্থাপন করেন রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশন। ১৯৫৯ সালে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ভগিনী সংগঠন হিসেবে স্থাপিত হয় শ্রীসারদা মঠ ও রামকৃষ্ণ সারদা মিশন।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ
১৮৯৬ সালে গৃহীত আলমবাজার মঠ (যুক্তরাজ্যের প্রতি স্বামী অভেদানন্দের বিদায় সম্বর্ধনা)
(বাম দিক থেকে) দাঁড়িয়ে: স্বামী অদ্ভুতানন্দ, স্বামী যোগানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ, স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ, স্বামী তুরীয়ানন্দ, স্বামী নির্মলানন্দ, এবং স্বামী নিরঞ্জনানন্দ; বসে রয়েছেন: স্বামী সুবোধানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ (চেয়ারে) এবং স্বামী অখণ্ডানন্দ

সন্ন্যাসী শিষ্য

স্বামী বিবেকানন্দ

দেখুন:স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২)

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ 

স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন একজন হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদী রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য। বিবেকানন্দের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ১২ জানুয়ারি উত্তর কলকাতার সিমলা অঞ্চলে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে এফএ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হওয়ার সময় রামচন্দ্র দত্ত একবার নরেন্দ্রনাথকে সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে ধর্মোপদেশ দানের জন্য নিমন্ত্রণ জানানো হয়, এটিই ছিল রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও তরুণ নরেন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎকার। পরে নরেন্দ্রনাথের সঙ্গীতপ্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব তাকে দক্ষিণেশ্বরে নিমন্ত্রণ করেন।

১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে নরেন্দ্রনাথের পিতা হঠাৎ মারা গেলে ও ঋণদাতারা ঋণশোধের জন্য তাদের তাগাদা দিতে শুরু করে এবং আত্মীয়স্বজনরা তাদের পৈতৃক বাসস্থান থেকে উৎখাত করার চেষ্টা শুরু করে। তিনি চাকরির অনুসন্ধান শুরু করেন এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠেন। কিন্তু একই সময়ে দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সান্নিধ্যে তিনি শান্তি পেতে থাকেন। এরপর নরেন্দ্রনাথ ঈশ্বর-উপলব্ধির জন্য সংসার ত্যাগ করতে মনস্থ করেন এবং রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে গুরু বলে মেনে নেন। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের গলার ক্যান্সার ধরা পড়লে নরেন্দ্রনাথসহ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের অন্যান্য শিষ্যগণ তার সেবা-যত্ন করেন। এই সময়ও নরেন্দ্রনাথের ধর্মশিক্ষা চলতে থাকে। কাশীপুরে নরেন্দ্রনাথ নির্বিকল্প সমাধি লাভ করেন। নরেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য কয়েকজন শিষ্য এই সময় রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কাছ থেকে সন্ন্যাস ও গৈরিক বস্ত্র লাভ করেন। এভাবে রামকৃষ্ণ শিষ্যমণ্ডলীতে প্রথম সন্ন্যাসী সংঘ স্থাপিত হয়। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব নরেন্দ্রনাথকে শিক্ষা দেন মানব সেবাই ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সাধনা।

রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের মৃত্যুর পর তার ভক্ত ও অনুরাগীরা তার শিষ্যদের সাহায্য করা বন্ধ করে দেন। নরেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য শিষ্যেরা বসবাসের জন্য নতুন বাসস্থানের খোঁজ শুরু করেন। অনেকে বাড়ি ফিরে গিয়ে গৃহস্থ জীবন যাপন করতে থাকেন। অবশিষ্ট শিষ্যদের নিয়ে নরেন্দ্রনাথ উত্তর কলকাতার বরাহনগর অঞ্চলে একটি ভাঙা বাড়িতে নতুন মঠ প্রতিষ্ঠা করার কথা চিন্তা করেন। বরাহনগর মঠ হল রামকৃষ্ণ মঠের প্রথম ভবন। এই মঠে নরেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য শিষ্যেরা ধ্যান ও কঠোর ধর্মানুশীলন অভ্যাস করতেন।

১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে, নরেন্দ্রনাথ বৈষ্ণব চরণ বসাকের সঙ্গে সঙ্গীতকল্পতরু নামে একটি সঙ্গীত-সংকলন সম্পাদনা করেন। নরেন্দ্রনাথই এই বইটির অধিকাংশ গান সংকলন ও সম্পাদনা করেছিলেন। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য তিনি বইটির কাজ শেষ করে যেতে পারেননি।

নরেন্দ্রনাথের গুরুভ্রাতা বাবুরামের মা নরেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য সন্ন্যাসীদের আঁটপুর গ্রামে আমন্ত্রণ জানান। আঁটপুরেই বড়দিনের পূর্বসন্ধ্যায় নরেন্দ্রনাথ ও আটজন শিষ্য আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। নরেন্দ্রনাথ গ্রহণ করেন "স্বামী বিবেকানন্দ" নাম।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ 
অদ্বৈত আশ্রম, মায়াবতী, রামকৃষ্ণ মঠের একটি শাখা, প্রতিষ্ঠাকাল মার্চ ১৯, ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ, পরবর্তীতে স্বামী বিবেকানন্দের অনেক লেখা প্রকাশ করে, বর্তমানে "প্রবুদ্ধ ভারত" সাময়িকী প্রকাশ করে

প্রথম বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলন ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগোর আর্ট ইনস্টিটিউটে উদ্বোধন হয়। এদিন বিবেকানন্দ তার প্রথম সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। তিনি ভারত এবং হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন।

১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ১ মে কলকাতায় বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠা করেন ধর্ম প্রচারের জন্য সংগঠন "রামকৃষ্ণ মঠ" এবং সামাজিক কাজের জন্য সংগঠন "রামকৃষ্ণ মিশন"। এটি ছিল শিক্ষামূলক, সাংস্কৃতিক, চিকিৎসা-সংক্রান্ত এবং দাতব্য কাজের মধ্য দিয়ে জনগণকে সাহায্য করার এক সামাজিক-ধর্মীয় আন্দোলনের প্রারম্ভ। রামকৃষ্ণ মিশনের আদর্শের ভিত্তি হচ্ছে কর্ম যোগ। স্বামী বিবেকানন্দের দ্বারা দুটি মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যার মধ্যে কলকাতার কাছে বেলুড়ের মঠটি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রধান কার্যালয় করা হয়েছিল এবং অন্যটি হিমালয়ের মায়াবতীতে আলমোড়ার নিকটে অদ্বৈত আশ্রম নামে পরিচিত এবং পরে তৃতীয় মঠটি মাদ্রাজে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ইংরেজিতে প্রবুদ্ধ ভারত ও বাংলায় উদ্বোধন নামে দুটি সাময়িকী চালু করা হয়েছিল।

(বাঁদিকে) মুম্বই শহরে গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ার কাছে স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তি।
(ডানদিকে) কর্ণাটকের মহীশূর শহরের শ্রীরামকৃষ্ণ বিদ্যাশালায় স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তি।

৪ জুলাই ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে ধ্যানরত অবস্থায় তিনি মৃত্যু বরণ করেন, তার শিষ্যদের মতে, বিবেকানন্দের মহাসমাধি ঘটেছিল।

স্বামী ব্রহ্মানন্দ

দেখুন:স্বামী ব্রহ্মানন্দ (১৮৬৩-১৯২২)

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ 
১৯০৮ সালে মাদ্রাজে স্বামী ব্রহ্মানন্দ

স্বামী ব্রহ্মানন্দ ছিলেন প্রসিদ্ধ বাঙালি সন্ন্যাসী ও রামকৃষ্ণ পরমহংসের অন্যতম প্রধান শিষ্য। শ্রীরামকৃষ্ণ তাকে নিজের ভাবসন্তানের মর্যাদা দেন। ব্রহ্মানন্দের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল রাখালচন্দ্র ঘোষ। ১৮৬৩ সালের ২১শে জানুয়ারি কলকাতার নিকটস্থ বসিরহাট মহকুমার শিকরা-কুলীনগ্রামে পিতা আনন্দমোহন ঘোষের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। রাখাল ছোটবেলা থেকে ঈশ্বরে আসক্ত ছিলেন এবং শৈশব থেকেই ধ্যান অনুশীলন করতেন। বারো বছর বয়সে তাকে পড়াশোনার জন্য কলকাতায় পাঠান হয়।

তার জন্মের আগে তার গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব স্বপ্নদর্শন পেয়েছিলেন যে দেবী তাকে একটি শিশু দেখান পরবর্তীতে যিনি তার পুত্র হবেন। রাখাল দক্ষিণেশ্বরে আসার সাথে সাথে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস তাকে সেই শিশু বলে স্বীকৃতি দেন এবং তার সাথে পুত্রের মতো আচরণ করেন। কয়েকবার তার সান্নিধ্যে আসার পর রাখাল শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য দক্ষিণেশ্বরে আসেন। গুরু নির্দেশনায় তিনি তীব্র আধ্যাত্মিক অনুশাসন অনুশীলন করা শুরু করেন এবং গূঢ় আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করেন। ১৮৮৬ সালে গুরুর মৃত্যুর পর যখন বরানগরে নতুন সন্ন্যাসী ভ্রাতৃত্ব গঠিত হয়, রাখাল তাতে যোগ দেন। তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন এবং ব্রহ্মানন্দ নাম ধারণ করেন। দুই বছর পরে তিনি বরানগর মঠ ত্যাগ করেন এবং কিছু সময়ের জন্য একজন পরিব্রাজক সন্ন্যাসী হয়ে বারাণসী, ওঁকারনাথ, বৃন্দাবন, হরিদ্বার এবং অন্যান্য স্থানে ভ্রমণ করে গভীর মননশীল জীবনযাপন শুরু করেন। এই সময়কালে তিনি অদ্বৈতবাদী অভিজ্ঞতার সর্বোচ্চ শিখর অতিক্রম করেন এবং টানা কয়েকদিন সমাধিতে নিমগ্ন থাকতেন বলে জানা যায়। ১৮৯০ সালে তিনি মঠে ফিরে আসেন। ১৮৯৭ সালে ভারতে ফিরে আসার পর স্বামী বিবেকানন্দ যখন সন্ন্যাস জীবনকে নতুন সংজ্ঞা দিতে পরিকর হন, তখন স্বামী ব্রহ্মানন্দ তাকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করেছিলেন। এই দুই সন্ন্যাসী গুরুভাইয়ের মধ্যে গভীর ভ্রাতৃত্ব বেশ সমাদৃত ছিল।

১৮৯৭ সালের ১লা মে কলকাতার বাগবাজারে রামকৃষ্ণ মিশনের একটি সংগঠন গঠিত হলে স্বামী বিবেকানন্দ এর সাধারণ সভাপতি নির্বাচিত হন এবং স্বামী ব্রহ্মানন্দ প্রথম এবং একমাত্র কলকাতার সভাপতি নির্বাচিত হন। বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠার পর স্বামী বিবেকানন্দ যখন রামকৃষ্ণ মঠকে একটি ট্রাস্ট হিসাবে নিবন্ধিত করেন, তখন স্বামী ব্রহ্মানন্দ এর সভাপতি হন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

সভাপতি হিসাবে তাঁর মেয়াদকালে রামকৃষ্ণের উপদেশের ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং ভারতে এবং বিদেশে বেশ কয়েকটি নতুন শাখা কেন্দ্র খোলা হয়। স্বামী বিবেকানন্দ একটি সমিতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা রামকৃষ্ণ মিশন তার সময়ে পুনরুজ্জীবিত এবং নিবন্ধিত হয়েছিল। তার শিষ্য যোগীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১২ সালে বরানগর, কলকাতায় তার নামে "ব্রহ্মানন্দ বালকশ্রম" নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা এখন বরানগর রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম উচ্চ বিদ্যালয় হিসাবে পরিচিত। প্রশাসনের তার দক্ষ গুণাবলীর জন্য, স্বামী বিবেকানন্দ তাকে 'রাজা' উপাধি দিয়েছিলেন এবং তারপর থেকে তিনি শ্রদ্ধার সাথে সকলের দ্বারা 'রাজা মহারাজ' নামে পরিচিত হন। তিনি ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের ছয়জন শিষ্যের একজন যাঁকে গুরু ঈশ্বরকোটী বলে গণ্য করতেন।

তিনি তার জীবনের দীর্ঘ সময় পুরী এবং ভুবনেশ্বরে কাটিয়েছেন। তিনি পুরী এবং ভুবনেশ্বরে রামকৃষ্ণ আশ্রম স্থাপনের জন্য কাজ করেন। ১৯২২ সালের ১০ই এপ্রিল তিনি অসুস্থতার কারণে ইহলোক ত্যাগ করেন। বেলুড় মঠে যেখানে তাঁর দেহ সমাধিস্থ করা হয় সেখানে তাঁর স্মৃতিতে একটি মন্দির রয়েছে।

স্বামী তুরীয়ানন্দ

দেখুন:স্বামী তুরীয়ানন্দ (১৮৬৩-১৯২২)

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ 
রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ 
রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কিছু সন্ন্যাসী শিষ্য (বাম থেকে ডানদিকে): ত্রিগুণাতীতানন্দ, শিবানন্দ, বিবেকানন্দ, তুরীয়ানন্দ ও ব্রহ্মানন্দ, নীচে স্বামী সারদানন্দ। ১৮৯৯ সালে তোলা ছবি

কিছু মানুষ যারা এই পৃথিবীতজ আবির্ভূত তো হন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা এজগতের জন্য নয়, স্বামী তুরীয়ানন্দ ছিলেন তাদেরই একজন। যার পিতৃপ্রদত্ত নাম হরিনাথ চট্টোপাধ্যায়। ১৮৬৩ সালের ৩ জানুয়ারি উত্তর কলকাতায় এক পরিচিত পরিবারে চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করলেও শৈশবে তিনি তার পিতামাতাকে হারান এবং তার বড় ভাই মহেন্দ্রনাথের যত্নে বেড়ে ওঠেন। স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি আর কলেজে যায়নি। পরিবর্তে, তিনি তার সময়কে ধ্যান এবং শঙ্করের অদ্বৈত বেদান্ত অধ্যয়নের জন্য উৎসর্গ করেন। তার প্রায় ১৭ বছর বয়সে বাগবাজারে কালীনাথ বসু-র পৈতৃক বাড়িতে এসে প্রথমবার দক্ষিণেশ্বরে শ্রী রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করেন, এবং তার পরে তিনি প্রায়শই গুরুর কাছে যাওয়া শুরু করেন। গুরু তাকে যোগীপুরুষ বলে আখ্যায়িত করা শুরু করেন। কাশীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের শেষ অসুস্থতার সময় তাকে সেবায় নিয়োজিত থাকা শিষ্যদের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন। গুরুর মৃত্যুর পর হরি বরানগর মঠে যোগ দেন এবং তুরীয়ানন্দ নাম ধারণ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তিন বছর পর তিনি মঠ ত্যাগ করেন এবং বিভিন্ন স্থানে কখনও একা, কখনও তাঁর ভাই সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তপস্যা করে সময় কাটান। স্বামী বিবেকানন্দ দ্বিতীয়বার পশ্চিম দেশের উদ্দেশ্যে গেলে তিনি স্বামী তুরীয়ানন্দকে সঙ্গে নিয়ে যান। স্বামীজি ভারতে ফিরে গেলে, তুরীয়ানন্দ তার কাজ চালিয়ে যান। প্রথমে নিউইয়র্ক, বস্টন এবং পরে ক্যালিফোর্নিয়ায় তিনি গুরুর উপদেশ প্রচার করেন। তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে তিনি ১৯০২ সালের জুন মাসে আমেরিকা ত্যাগ করেন। ভারতে এসে তিনি স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুর খবর শুনে মর্মাহত হন। তুরীয়ানন্দ পরবর্তীকালে বেশ কয়েক বছর বৃন্দাবনে, হিমালয়ের বিভিন্ন স্থানে, দেরাদুন, কনখল, আলমোড়া প্রভৃতি স্থানে গভীর মনন অনুশীলন করে অতিবাহিত করেন। অবশেষে তিনি ১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বারাণসীতে বসতি স্থাপন করেন। এর গত কয়েক বছর ধরে তিনি মধুমেহ রোগেও ভুগছিলেন। ১৯২২ সালের ২১শে জুলাই বারাণসীতে তিনি মারা যান। মৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগে তিনি তার গুরুভাই স্বামী অখণ্ডানন্দ-র সাথে 'সত্যম, জ্ঞানম অনন্তম ব্রহ্ম' অর্থাৎ 'ঈশ্বরই সত্য, প্রজ্ঞা এবং অসীম' উপনিষদিক মন্ত্রটি পুনরাবৃত্তি করেছিলেন যার পরে তাকে বাংলায় বিড়বিড় করতে শোনা গিয়েছিল 'ব্রহ্ম সত্য, জগৎ সত্য; সব সত্য, সত্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠ' যার অর্থ 'ঈশ্বর সত্য, জগৎও সত্য, সবকিছুই সত্য। জীবন সত্যের উপর ভিত্তি করে'। এটি বিবেকচূড়ামণির গোঁড়াবাক্য 'ব্রহ্ম সত্যম জগৎ মিথ্যা' অর্থাৎ ঈশ্বর সত্য এবং বিশ্ব মিথ্যা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। এই অবিলম্বে উচ্চারিত হওয়া অপ্রচলিত শেষ কথাগুলি একজন সিদ্ধ ঋষির দেখা দর্শন হিসাবে গণ্য যিনি জগতের সর্বত্র ঈশ্বরকে বিরাজমান দেখেন।

স্বামী অভেদানন্দ

দেখুন:স্বামী অভেদানন্দ (১৮৬৬-১৯৩৯)

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ 
১৯১০ সালে তোলা স্বামী অভেদানন্দের ছবি

১৮৬৬ সালের ২রা অক্টোবর উত্তর কলকাতায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন, পিতৃপ্রদত্ত নাম কালীপ্রসাদ চন্দ্র। তার বাবা রসিকলাল চন্দ্র ও মা নয়নতারা দেবী‌। ১৮৮৪ সালে ১৮ বছর বয়সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষার জন্য অধ্যয়ন করার সময় তিনি দক্ষিণেশ্বরে যান এবং শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেন। এটিই তার প্রথম সাক্ষাৎকার হলেও তাকে তিনি গুরুর আসনে অধিষ্ঠিত করেন।। এরপর, ১৮৮৫ সালের এপ্রিল মাসে, রামকৃষ্ণের জীবনের শেষ অসুস্থতার সময়ে প্রথমে শ্যামপুকুর এবং তারপর কলকাতার কাছে কাশীপুর গার্ডেন-হাউসে তাঁর সাথে থাকার জন্য নিজ বাসগৃহ ত্যাগ করেন।

১৮৮৬ সালে তাঁর গুরুর মৃত্যুর পর, তিনি বরানগর মঠের একটি ঘরে নিজেকে বন্ধ করে তীব্র সাধনায় (ধ্যানে) নিমজ্জিত হন, এর ফলে তাঁর সহশিষ্যদের মধ্যে তিনি "কালী তপস্বী" নামে পরিচিত পান। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর, তিনি বিবেকানন্দ এবং অন্যান্যদের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ন্যাসী হয়ে এবং "স্বামী অভেদানন্দ" নাম ধারণ করেছিলেন।

লন্ডনে অদ্বৈত বেদান্তের উপর তাঁর প্রথম বক্তৃতা তাৎক্ষণিকভাবে সফল হয়েছিল। পরে তিনি নিউইয়র্কে চলে যান। তিনি শতাব্দীর এক চতুর্থাংশ ধরে পশ্চিমের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ উভয়ই) এলাকাগুলোতে খুব ব্যাপকভাবে সফর করেছেন এবং বক্তৃতা দিয়েছেন। তাঁর বক্তৃতাগুলি পশ্চিমা বুদ্ধিমত্তার ক্রিমকে আকৃষ্ট করেছিল এবং সত্যের আন্তরিক অনুসন্ধানকারীদেরও আকৃষ্ট করেছিল। হনুলুলুতে নিখিল প্রশান্ত মহাসাগরীয় শিক্ষা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার পর তিনি ১৯২১ সালে ভারতে ফিরে আসেন এবং নিজের মতো করে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ১৯২৩ সালে কলকাতায় একটি 'রামকৃষ্ণ বেদান্ত সোসাইটি' গঠন করেন। ১৯২২ সালে তিনি পায়ে হেঁটে হিমালয় পার হয়ে তিব্বত পৌঁছেন, যেখানে তিনি বৌদ্ধ দর্শন ও তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম অধ্যয়ন করেন। ১৯২৪ সালে তিনি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ) দার্জিলিং-এ রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৭ সালে তিনি রামকৃষ্ণ বেদান্ত সোসাইটির মাসিক ম্যাগাজিন বিশ্ববাণী প্রকাশ করা শুরু করেন, যা তিনি ১৯২৭ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত সম্পাদনা করেছিলেন। এটি এখনও প্রকাশিত হয়। ১৯৩৬ সালে, তিনি রামকৃষ্ণের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের অংশ হিসেবে কলকাতার টাউন হলে ধর্ম সংসদে সভাপতিত্ব করেন। রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠে ১৯৩৯ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর তিনি যখন নশ্বর কুণ্ডলী ত্যাগ করেন তখন গুরু সরাসরি সাক্ষাৎ সন্ন্যাসী শিষ্যদের যুগের অবসান ঘটে। শ্রী রামকৃষ্ণ এবং শ্রী সারদা দেবীর উপর বেশ কয়েকটি সূক্ষ্ম সংস্কৃত স্তোত্রের লেখক তিনি - সবচেয়ে জনপ্রিয় হল 'প্রকৃতিম পরমম্'। স্বামী অভেদানন্দ ছিলেন বৌদ্ধিক বুদ্ধিমত্তা, ভক্তিমূলক উদ্দীপনা এবং যোগিক আত্মদর্শনের মতো বেশ কয়েকটি প্রতিভার বিরল সংমিশ্রণ। তিনি একজন ভাল বক্তা এবং একজন প্রফুল্ল ছিলেন। এমনকি শৈশবকাল থেকেই তার সংস্কৃত অধ্যয়নের প্রতি ঝোঁক ছিল। বড় হওয়ার সাথে সাথে তিনি প্রাচ্য এবং পশ্চিম উভয় দার্শনিক কাজের অধ্যয়নের প্রতি আকৃষ্ট হন। তার যোগী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাকে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে নিয়ে আসে যিনি অবিলম্বে তাকে তার নিকট শিষ্য হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তিনি গুরুর নির্দেশনায় মনস্তাত্ত্বিক জীবনে দ্রুত অগ্রসর হন। জ্ঞান ও পটুতার জন্য স্বামী বিবেকানন্দ পশ্চিমে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য একজন উপযুক্ত সহকারী হিসাবে স্বাভাবিকভাবেই স্বামী অভেদানন্দের কথা ভেবেছিলেন।

স্বামী অদ্ভূতানন্দ

দেখুন:স্বামী অদ্ভূতানন্দ (?-১৯২০)

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ 
স্বামী অদ্ভূতানন্দ

যদিও রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বেশিরভাগ প্রত্যক্ষ শিষ্য বাঙালি বুদ্ধিজীবী পরিবার থেকে এসেছিলেন, এর বিপরীতে অদ্ভূতানন্দের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব সত্ত্বেও থাকা মননশক্তি তাকে বাকিদের মধ্যে অনন্য করে তুলেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পূর্ব ভারতের বিহার প্রদেশের ছাপরায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল রাখতুরাম, যদিও তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যান্য শিষ্যদের কাছে লাটুরাম বা লাটু মহারাজ নামে পরিচিত ছিলেন। দারিদ্র্যের ফলে লাটুরাম ও তার কাকা জীবিকার সন্ধানে কলকাতায় আসতে বাধ্য হন। লাটুরাম রামকৃষ্ণের গৃহস্থ ভক্ত রামচন্দ্র দত্তর সহায়তায় তাঁর পরিচারক হিসেবে যোগ দেন। ধীরে ধীরে শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষায় তিনি আকৃষ্ট হন। শ্রীরামকৃষ্ণের গলায় ক্যানসার ধরা পড়লে তার সুবিধার জন্য, ভক্তরা রামকৃষ্ণকে দক্ষিণেশ্বর থেকে উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুরে নিয়ে যান। লাটু তার ব্যক্তিগত পরিচারক হয়ে তার সাথে যান। তিনি পরে ১৮৮৫-র ১১ ডিসেম্বর রামকৃষ্ণের সাথে কাশীপুরে চলে যান। তিনি গুরুর শেষ দিনগুলিতে গুরুসেবায় নিযুক্ত ছিলেন। যার কথা স্মরণ করে লাটু বলেছিলেন, "গুরুর সেবা করা আমাদের উপাসনা ছিল। আমাদের অন্য কোন আধ্যাত্মিক অনুশাসনের প্রয়োজন ছিল না।" লাটু রামকৃষ্ণের কাছ থেকে একটি গেরুয়া কাপড় এবং জপমালা পেয়েছিলেন। ১৮৮৬ সালের ১৬ আগস্ট রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর, লাটু সারদা দেবী এবং রামকৃষ্ণের অন্যান্য সাধারণ ও সন্ন্যাসী শিষ্যদের সাথে বৃন্দাবন, বারাণসী, অযোধ্যা পরিদর্শনে তীর্থযাত্রায় যান।

রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর, নরেন্দ্র তথা বিবেকানন্দ এবং অন্য কিছু শিষ্য বরানগরে একটি পুরানো জরাজীর্ণ বাড়িতে প্রথম রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে নরেন সহ কিছু শিষ্য তাদের সন্ন্যাসী ব্রত নেন এবং ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন, ধ্যান ও তপস্যা অনুশীলনে নিযুক্ত হন। লাটু ১৮৮৭ সালে তাদের সাথে যোগ দেন এবং সন্ন্যাসীর ব্রত গ্রহণ করেন, পরে বিবেকানন্দ তাকে সন্ন্যাসীর নাম দিয়েছিলেন অদ্ভূতানন্দ। ১৯০৩ থেকে ১৯১২ পর্যন্ত দীর্ঘ নয় বছর তিনি তার গুরুর অপর এক গৃহস্থ শিষ্য বলরাম বসুর বাড়ীতে কাটান।

১৯১২ সালের অক্টোবর মাসে তিনি বলরাম বসুর বাড়ী ত্যাগ করে বারাণসীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন এবং আর কখনো কলকাতা ফেরত আসেননি। এখানে তিনি প্রথম দিকে রামকৃষ্ণ অদ্বৈত আশ্রমে এবং পরে বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করতেন। ভক্তগণ তাকে প্রায়শই ধ্যানে মগ্ন থাকতে দেখতেন এবং তিনি খুব কমই খাবার খাওয়ার জন্য সময় পেতেন। বারাণসীতে, তিনি তার ভক্ত ও সাধারণ মানুষকে তার গুরুর শিক্ষা এবং আধ্যাত্মিক নির্দেশ প্রচার করতে থাকেন। ১৯২০ সালের ২৪শে এপ্রিল মধুমেহ এবং পচনশীল ক্ষত রোগের বশে স্বামী অদ্ভূতানন্দ পূণ্য শহর বারাণসীতে দেহত্যাগ করেন।

স্বামী অদ্বৈতানন্দ

দেখুন:স্বামী অদ্বৈতানন্দ (১৮২৮-১৯০৯)

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ 
স্বামী অদ্বৈতানন্দ

তিনি ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বয়োজ্যোষ্ঠ সাক্ষাৎশিষ্য। ১৮২৮ সালের ২৮শে আগস্ট কলকাতা থেকে কিছু মাইল দূরে চব্বিশ পরগনার জগদ্দলের নিকট রাজপুর গ্রামে পিতা গোবর্ধন শূর ঘোষের ঘরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল গোপালচন্দ্র ঘোষ। ১৮৮৪ সালে তাঁর স্ত্রী মারা গেলে এবছরই মার্চ বা এপ্রিল মাসে ৫৫ বছর বয়সে তিনি রামকৃষ্ণের কাছে আসেন। এই প্রথম সাক্ষাতে, রামকৃষ্ণ এবং গোপাল ঘোষের মধ্যে কোন সংযোগ ছিল বলে মনে হয় না। তার বন্ধু তাকে কিছু বোঝানোর পর তিনি দ্বিতীয়বার দেখা করেন। এই সাক্ষাৎকারে রামকৃষ্ণ তাঁর সাথে বিচ্ছিন্নতার কথা বলেছিলেন। তৃতীয় বারের সাক্ষাতে গোপাল ঘোষ স্মরণ করে বলতেন, "গুরু আমাকে তখনই ধারণ করেছিলেন। আমি দিনরাত তাঁর কথা ভাবতাম। গুরুর কাছ থেকে বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় আমার বুকে ব্যথা দিত। আমি যতই চেষ্টা করি না কেন, আমি তার মুখ ভুলতে পারিনি।"

রামকৃষ্ণ গোপালকে তাঁর শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁকে "বড় গোপাল" বা "অধ্যক্ষ" বলে সম্বোধন করেছিলেন কারণ তিনি রামকৃষ্ণের চেয়ে আট বছরের বড় ছিলেন। অন্য শিষ্যরা তাকে "গোপাল-দা" বলে ডাকতেন (-দা মানে বড়ভাই)। তিনি শীঘ্রই রামকৃষ্ণের ঘনিষ্ঠ অনুচর এবং পবিত্র মায়ের সহকারী হয়ে ওঠেন। রামকৃষ্ণ গৃহস্থালির বিষয়ে তার ব্যবস্থাপনা এবং মানুষের সাথে তার মিষ্টি আচরণের প্রশংসা করেছিলেন। বেশ কয়েক বছর পরে, গোপালই রামকৃষ্ণকে গেরুয়া কাপড় দিয়েছিলেন যা রামকৃষ্ণ তাঁর বেশ কয়েকজন শিষ্যকে (গোপাল সহ) সন্ন্যাস জীবনে দীক্ষিত করতে ব্যবহার করেছিলেন। ১৮৮৫ সালের সেপ্টেম্বরে, যখন শ্রীরামকৃষ্ণ তার ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য কলকাতার শ্যামপুকুর এবং তারপরে ডিসেম্বরে কাশীপুরে চলে আসেন, তখন গুরুমা সারদামণি দেবীকে সহায়তা করার জন্য গোপাল ও অন্যন্য শিষ্যরাও তার সাথে চলে যান ও যথাসাধ্য সেবা সুশ্রূষা করেন।

১৮৮৬ সালে রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর তিনি সন্ন্যাস ব্রত নেন এবং স্বামী অদ্বৈতানন্দ হন। তার থাকার কোন জায়গা ছিল না বলে রামকৃষ্ণের অপর এক গৃহস্থ শিষ্য সুরেন্দ্রর সহায়তায় তাকে রাখার জন্য এবং অন্যান্য সন্ন্যাসীদের অস্থায়ী বাসস্থান হিসাবে তথা তাকে দেখার জন্য কলকাতা শহরতলির বরানগরে একটি জায়গায় পুরাতন একটি বাড়ী ভাড়া দেওয়া হয়েছিল, যা পরে মঠের রূপ পায়। তিনিই সর্বপ্রথম বরানগর মঠে বসবাস শুরু করেন। ১৮৮৭ সালে তিনি এই বরানগর মঠ ত্যাগ করেন এবং প্রথমে বারাণসী তারপর কেদারনাথ, বদ্রীনাথ এবং বৃন্দাবন যান। ১৮৯০ সালে গুরু মায়ের সাথে তিনি গয়াতে পূর্বপুরুষদের জন্য তর্পণাচার পালন করেন এবং তারপরে মীরাটে গিয়ে কয়েক সপ্তাহ স্বামী বিবেকানন্দ এবং ছয়জন অন্যান্য সন্ন্যাসী গুরুভাইদের সাথে দেখা করেছিলেন।

১৮৮৭ সালে স্বামী অদ্বৈতানন্দ আলমবাজারে এবং তারপর নীলাম্বর বাবুর বাগানবাড়ীতে চলে যান, স্বামী বিবেকানন্দ এবং অন্যান্য সন্ন্যাসীর শিষ্যদের সাথে গঙ্গার তীরে বেলুড়ে নতুন কেনা জায়গাটি নির্মাণ ও উন্নয়নে যোগ দেন। তিনি পুরাতন নদীঘাটের দিকে এলাকা বাঁধাই করা এবং নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নকরণের তদারকির দায়িত্ব নেন। তিনি বাকি শিষ্যদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ও বৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও একটি সবজি বাগান এবং দুগ্ধ খামার শুরু করেছিলেন।

স্বামী তুরীয়ানন্দ একবার বলেছিলেন, "আমরা গোপালদা-র কাছে যথেষ্ট ঋণী, কারণ আমরা তাঁর কাছ থেকে সব কাজের সূক্ষ্মতা শিখেছি। তিনি বেশ দক্ষ ছিলেন এবং তিনি যা করতেন তা মন দিয়ে সম্পন্ন করতেন। তিনি তাঁর অভ্যাসে খুব কড়া ছিলেন। তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিয়মনিষ্ঠ ছিলেন ও প্রত্যহ ধ্যান অনুশীলন করতেন।"

১৯০১ সালে তাকে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অন্যতম ন্যাসপাল করা হয়, পরে তিনি সহকারী সভাপতি হন। এমনকি তার বৃদ্ধ বয়সেও তিনি ব্যক্তিগত পরনির্ভরশীলতা প্রত্যাখ্যান করতেন, তিনি বিশ্বাস করতেন সন্ন্যাসীদের সবক্ষেত্রে স্বনির্ভর হওয়া উচিত। তিনি প্রতিদিন গীতা পাঠ করতেন এবং অন্যান্য শিষ্যদের গানের সাথে তবলায় সঙ্গদ করতেন।

স্বামী অদ্বৈতানন্দ ১৯০৯ সালে ১৮শে ডিসেম্বর ৮১ বছর বয়সে শ্রী রামকৃষ্ণের নাম জপ করতে করতে মারা যান।

স্বামী নির্মলানন্দ

দেখুন:স্বামী নির্মলানন্দ (১৮৬৩-১৯৩৮)

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ 
স্বামী নির্মলানন্দ

নির্মলানন্দ প্রধানত দক্ষিণ ভারতের কেরল, ব্যাঙ্গালোরতামিলনাড়ুতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকলিন, বর্মা এবং বাংলাদেশে (স্বামী নির্মলানন্দের জীবনযাপন এবং প্রবুদ্ধ ভারত-এর পুরানো বিষয়গুলি) রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠায় মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ১৮৬৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর কলকাতার বাগবাজার এলাকার বোসপাড়া লেনে দেবনাথ দত্তের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল তুলসীচরণ দত্ত। বেনারস ও কলকাতায় তার পরিবারের বিষয়াশয় ছিল। পরবর্তীকালে, তিনি বেনারসের বেঙ্গলি টোলা হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং হরিপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের সহপাঠী হন যিনি পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ মিশনের আরেকজন মহান সন্ন্যাসী এবং রামকৃষ্ণের সাক্ষাৎশিষ্য হন ও আরো পরে স্বামী বিজ্ঞানানন্দ নামে পরিচিত হন। তিনি ১৮৮৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং তালচেরের রাজার কাছ থেকে প্রশংসার সনদ ও একটি পদক পান।

১৮৮২ সালে নির্মলানন্দের বয়স যখন আঠারো বছর, তখন তিনি তাঁর প্রতিবেশী বলরাম বসুর বাড়িতে প্রথম দেখা করেছিলেন। তিনি প্রথমে তার বন্ধু হরিনাথের সাথে এবং পরে একা রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করতে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে গিয়েছিলেন। তিনি মাঝে মাঝে বলরাম বসুর বাড়িতে রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতেন এবং তাঁর কাছ থেকে দীক্ষাশিক্ষা নিতেন। কাশীপুরের বাগানবাড়িতে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের শেষ পর্যায়ে তার সঙ্গে দেখাও করতেন। গুরুর মৃত্যুর পর নরেন্দ্রনাথ তথা স্বামী বিবেকানন্দ বরানগরের রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৭ সালের শেষের দিকে তিনি বরানগর মঠের স্থায়ী সদস্য হয়ে ওঠেন এবং সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করে স্বামী নির্মলানন্দ নাম পান।

১৯০১ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারী যখন বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মঠকে একটি ট্রাস্ট হিসাবে নিবন্ধন করতে চান, তখন নির্মলানন্দ সদ্য প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সহকারী সচিব হন। বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর, নির্মলানন্দকে স্বামী অভেদানন্দের আহ্বানে ১৯০৩ সালে স্বামী ব্রহ্মানন্দ আমেরিকায় পাঠান। তিনি নিউ ইয়র্কে যোগধ্যানের ক্লাস শিখিয়েছিলেন এবং ব্রুকলিনে একটি বেদান্ত কেন্দ্র চালু করেছিলেন। তিনি বক্তৃতাও দিতেন এবং সংস্কৃত ও উপনিষদ শিক্ষা দিতেন। তিনি আড়াই বছর আমেরিকায় থাকার পর স্বামী ব্রহ্মানন্দের 'মাতৃভূমির পুনর্জন্মের' ডাকে ভারতে ফিরে আসেন, যখন জন্য ডাকেন। নির্মলানন্দ বেঙ্গালুরু এবং কেরলে রামকৃষ্ণ মিশনের কেন্দ্রগুলির বিকাশ ও প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিলেন। সারদা দেবীকে ব্যাঙ্গালোর রামকৃষ্ণ মঠে আনার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। রামকৃষ্ণানন্দ ১৯০৪ সালে ব্যাঙ্গালোর কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তৎকালীন সভাপতি ব্রহ্মানন্দ সেখানে একটি আশ্রম তৈরি করেন। ১৯০৯ সালে নির্মলানন্দকে ব্যাঙ্গালোর আশ্রমের প্রধান করে পাঠানো হয়। ১৯১১ সালে যখন সারদা দেবী রামেশ্বরমে ভ্রমণ করতে যান, নির্মলানন্দ তাকে ব্যাঙ্গালোরে বেড়াতে নিয়ে আসেন। হরিপাড়ের আশ্রমটি ১৯১৩ সালের ৪ঠা মে খোলা হয়। নির্মলানন্দ এই আশ্রমে থাকাকালীন কেরলে সমস্ত বর্ণভিত্তিক বৈষম্যের অবসান কঠোরভাবে আটকেছিলেন। ১৯১৬ সালে নির্মলানন্দ তিরুবনন্তপুরমের কাছে একটি আশ্রম নির্মাণ শুরু করেন। ২৬শে নভেম্বর নির্মলানন্দ এবং ব্রহ্মানন্দ কেরলে পৌঁছে, ওট্টপালম, কোট্টায়ম, হরিপাড়, কুইলন সহ বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে ৮ই ডিসেম্বর তিরুবনন্তপুরম যান ও আশ্রমের ভিত্তি স্থাপন করেন।

১৯২৪ সালের মার্চ মাসে তিরুবনন্তপুরমের আশ্রমের মূল ভবনটি সম্পন্ন হলে ৭ই মার্চ রামকৃষ্ণের জন্মবার্ষিকীতে এর সূচনা হয়। ১৯২৫ সালে তিনি প্রায় এক মাস তিরুবনন্তপুরম আশ্রমে অবস্থান করেন এবং নৃসিংহানন্দ, ওজাসানন্দ, উর্জাসানন্দ, পুরঞ্জানন্দ, বালকৃষ্ণানন্দ, অর্জাবানন্দ ও উমেশানন্দ নামে সাত শিষ্যকে সন্ন্যাস দেন। ১৯২৬ সালের ডিসেম্বরে ওট্টপালমে রামকৃষ্ণ নিরঞ্জন আশ্রম খোলা হয়। ১৯২৭ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি কুর্গে আশ্রমের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। এছাড়াও তিনি পল্লাবরম সারদা বিদ্যালয় এবং নিরঞ্জনা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কুমারী পূজা শুরু করেছিলেন এবং সামাজিকভাবে নিপীড়িত নাম্বুদ্রী মহিলাদের উন্নতির জন্য কাজ করেছিলেন।

১৯২৯ সালে রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী এবং ভক্তদের একটি বিচ্ছিন্ন দল বাগবাজারে রামকৃষ্ণ সারদা মঠ শুরু করলে তিনি তাদের প্রথম সভাপতি হওয়ার গ্রহণের অনুরোধ গ্রহণ করেন। স্বামী নির্মলানন্দ ১৯৩৮ সালের এপ্রিলে কেরলের ওট্টপালমের কাছে রামকৃষ্ণ মঠের শাখা কেন্দ্রে মারা যান।

স্বামী অখণ্ডানন্দ

দেখুন:স্বামী অখণ্ডানন্দ (১৮৬৪-১৯৩৭)

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ 
স্বামী অখণ্ডানন্দ

স্বামী অখণ্ডানন্দ রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন-এর তৃতীয় অধ্যক্ষ ও মিশনের সেবা কার্যের প্রধান উদ্যোক্তা। তার পিতৃপ্রদত্ত নাম গঙ্গাধর ঘটক গঙ্গোপাধ্যায়। ১৮৬৪ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর আহিরীটোলার শ্রীমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা থাকলেও আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি তার তেমন আগ্রহ ছিল না। পরে তিনি গীতাউপনিষদ মুখস্থ করেন। শৈশবেও, তিনি স্বভাবগতভাবে সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং প্রায়শই বাবা-মাকে না জানিয়ে গোপনে ভিক্ষুকদের খাবার দিতেন।

বারো বছর বয়সে তাকে উপনয়ন দেওয়া হয় এবং তারপর থেকে তিনি প্রতিদিন তিনবার গায়ত্রী মন্ত্র পুনরাবৃত্তি করতেন এবং শিবের মাটির মূর্তি তৈরি করে তাঁর পূজা করতেন। গঙ্গাধর এবং তার বন্ধু হরিনাথ ১৮৭৭ সালে বাগবাজারে দীননাথ বসুর বাড়িতে শ্রী রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করেন। রামকৃষ্ণ ঐসময়ে সমাধিতে ছিলেন এবং সম্ভবত একারণেই রামকৃষ্ণের প্রতি তাদের আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে ওঠে। ঐ সময়েই তিনি তার বাবা-মাকে না বলে একজন সন্ন্যাসীর সাথে অদৃশ্য হয়ে যান, পরে ঐ সন্ন্যাসী তাকে তার কিশোর বয়সের উল্লেখ করে সুপরামর্শ দিলে উদ্বিগ্ন পিতামাতার কাছে বাড়িতে ফিরে আসেন।

তিনি ১৮৮৩ সালের মে মাসে উনিশ বছর বয়সে দক্ষিণেশ্বরে দ্বিতীয়বার রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করেন, রাত্রি যাপন করেন এবং ফিরে আসেন এবং কয়েক দিন পরে আবার রাত্রি যাপন করেন। এর পরে তিনি ভিড় এড়াতে সপ্তাহান্তে নিয়মিত যাওয়া শুরু করেন। পরে রামকৃষ্ণ তাঁর বেশিরভাগ অভ্যাস যেমন শুধুমাত্র নিজের রান্না করা খাবার খাওয়া, নিরামিষভোজী, তপস্যা অনুশীলন করা, এগুলিকে বৃদ্ধসুলভ আখ্যা দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে পরে রামকৃষ্ণ কিছু দর্শনার্থীকে বুঝিয়েছিলেন যে পূর্বজন্মে তার অভ্যাসের কারণেই তিনি এমন স্বভাব পেয়েছেন। গঙ্গাধর তার অভ্যাস বজায় রেখেছিলেন।

১৮৮৫ সালের সেপ্টেম্বরে, যখন শ্রীরামকৃষ্ণ তার ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য কলকাতার শ্যামপুকুর এবং তারপরে ডিসেম্বরে কাশীপুরে চলে আসলে তিনিও গুরুসেবায় নিযুক্ত হন। ১৮৮৬ সালে‌ শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর ১৮৮৭ সালে কেদারনাথ এবং বদ্রীনাথ পরিদর্শন করার পর তিনি তিব্বত ভ্রমণে যান ও সেখানে লাসা এবং অন্যান্য জায়গায় তিন বছর বসবাস করেন, 1890 সালে ভারতে ফিরে আসেন। ঐ মাসেই তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করে স্বামী অখণ্ডানন্দ নাম পান।

১৮৯৪ সালে তিনি গুরুশিক্ষার প্রচার শুরু করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন দেশের সমস্যার মূল কারণ শিক্ষার অভাব, তাই তিনি রাজস্থানে ক্ষেত্রীতে থাকাকালীন দ্বারে দ্বারে গিয়ে সকলকে তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করতে উৎসাহিত করেছিলেন। ফলস্বরূপ স্থানীয় স্কুলে ভর্তির হার মাত্র ৮০ থেকে বেড়ে ২৫৭ তে পৌঁছায়। এরপর তিনি জয়পুর, চিতোরগড়, উদয়পুর প্রভৃতি স্থানে গিয়ে স্থানীয় শাসকদের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, খাদ্যত্রাণ বিতরণ এবং স্থানীয় কুটির শিল্পকে সহযোগিতা করতে বলেন।

১৮৯৭ সালের ১৫ই মে মাহুলায় তিনি ত্রাণকার্য চালান। মুর্শিদাবাদের সারগাছিতে দরিদ্রদের জন্য কাজ শুরু করেন। তার কাজ কিছু ধনী ব্যক্তির মধ্যে অসন্তুষ্টি তৈরি করলে তারা তার বিরুদ্ধে বিবেকানন্দের কাছে অভিযোগের চিঠি লেখেন। যদিও জবাবে বিবেকানন্দ তাকে তার কাজ চালিয়ে যেতে বলেছিলেন।

১৯২২ সালে স্বামী ব্রহ্মানন্দ মারা গেলে স্বামী শিবানন্দ মঠের সভাপতি এবং স্বামী অখণ্ডানন্দ সহ সভাপতি পদে নিযুক্ত হন। ১৯৩৪ সালে স্বামী শিবানন্দের মৃত্যু থেকে ১৯৩৭ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি বেলুড়মঠে ৭২ বছর বয়সে তার মৃত্যু পর্যন্ত স্বামী অখণ্ডানন্দ সভাপতি ছিলেন।

স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ

দেখুন:স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ (১৮৬৪-১৯৩৭)

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ 
স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ

১৮৬৫ সালের ৩০শে জানুয়ারি চব্বিশ পরগনার ভাঙড়ের নিকট নাওড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃপ্রদত্ত নাম সারদাপ্রসন্ন মিত্র। সারদাপ্রসন্ন কলকাতার শ্যামপুকুরে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে (বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্তি হন। সেখানে প্রধান শিক্ষক ছিলেন মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, যিনি "শ্রীম" নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনিই শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী ও বাণী সংক্রান্ত সংকলন শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের লেখক।

১৮৮৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করার জন্য তার অন্যতম শিষ্য তথা ভক্ত শ্রীম তরুণ সারদাপ্রসন্নকে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে নিয়ে যায়। খুব অল্প বয়সে সারদাপ্রসন্নর মনে ধর্মীয় মনোভাব দেখিয়েছিলেন তিনি, যা শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে যোগাযোগের পরই সম্ভবত আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। তিনি মেট্রোপলিটন কলেজে যোগদানের পর প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে যেতেন।:১৭২ ধীরে ধীরে তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে নিজের গুরু ও পথপ্রদর্শক হিসেবে মানতে শুরু করেন ও তার দেখানো পথে চলার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি গুরু রামকৃষ্ণের শেষ সময়ে কাশীপুরের বাগানবাড়ীতে তার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।

১৮৮৬ সালে রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর, তিনি বরানগর মঠে নরেন্দ্রনাথ দত্ত (পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ) এবং রামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ শিষ্যদের সাথে থাকতে শুরু করেন‌ ১৮৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ও তার গুরুভাইয়েরা সন্ন্যাসের ব্রত গ্রহণ করেন এবং তিনি ত্রিগুণাতীতানন্দ নামে পরিচিত হন। ১৮৯১ সালে ত্রিগুণাতীতানন্দ বৃন্দাবন, মথুরা, জয়পুর, আজমীর, কাথিয়াবাড় তীর্থযাত্রা শুরু করেন। পোরবন্দরে তিনি বিবেকানন্দের সাথে দেখা করেন ও পরে তিনি বরানগর মঠে ফিরে আসেন। ১৮৯৫ সালে, তিনি পায়ে হেঁটে কৈলাস পর্বতমানস সরোবর হ্রদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।:১৭৬ ১৮৯৭ সালে তৎকালীন বাংলার অবিভক্ত দিনাজপুর জেলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তিনি সেখানে ত্রাণ কাজের আয়োজন করেন। বিবেকানন্দ বেদান্তের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একটি পত্রিকার পরিকল্পনা করেছিলেন, এই উদ্দেশ্যে একটি প্রেস কেনা হয় এবং ত্রিগুণাতীতাকে ঐ উদ্বোধন পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্ব দেওয়া হয়।:১৭৮

স্বামী যোগানন্দের মৃত্যুর পর, ত্রিগুণাতীতানন্দ কিছু সময়ের জন্য সারদা দেবীর ব্যক্তিগত পরিচারিক হন। ১৯০২ সালে অসুস্থতার কারণে স্বামী তুরীয়ানন্দ আমেরিকা থেকে সময়পূর্বে ফিরে এলে ত্রিগুণাতীতানন্দকে তার জায়গায় পাঠানো হয়। ১৯০৩ সালে ২রা জানুয়ারি তিনি সান ফ্রান্সিসকোতে পৌঁছান এবং তাকে সানফ্রান্সিসকো বেদান্ত সমাজের সভাপতি টিএইচ লোগানের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক সপ্তাহ পর তিনি মিস্টার অ্যান্ড মিসেস সিএফ পিটারসনের বাড়িতে যান, যেখানে তিনি তার কাজের সদর তৈরি করেন।:১৮০ সমাজের কাজ চালনার জন্য অচিরের বড় বাড়ীর দরকারে ৪০, স্টেইনার স্ট্রিটে তিনি কার্যালয় স্থানান্তর করেন। ১৯০৬ সালের জানুয়ারিতে ওয়েবস্টার স্ট্রিটের বাড়ীটি পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম হিন্দু মন্দির হিসাবে পরিচিতি পায়।

স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ দীর্ঘস্থায়ী বাত এবং ব্রাইটস রোগে ভুগছিলেন। ১৯১৪ সালের ২৭শে ডিসেম্বর তিনি একটি রবিবারের সভা করছিলেন, তখনই একজন প্রাক্তন ছাত্র সদস্যের উপর একটি বোমা হামলা হয়। এর ফলে ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয় এবং তিনি মারাত্মকভাবে আহত হয়। ১৯১৫ সালের ১০ই জানুয়ারী তিনি মারা যান।

স্বামী সুবোধানন্দ

দেখুন:স্বামী সুবোধানন্দ (১৮৬৭-১৯৩২)

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ 
স্বামী সুবোধানন্দ

তিনি ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবে সাক্ষাৎ শিষ্যদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। শিষ্যমণ্ডলী থেকে শিষ্য পথপ্রদর্শক স্বামী বিবেকানন্দ, প্রত্যেকের কাছেই তিনি "খোকা" নামে পরিচিত ছিলেন। ১৮৬৭ সালের ৮ই নভেম্বর উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা শ্রীশঙ্কর ঘোষের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন সুবোধচন্দ্র ঘোষ। ছাত্রাবস্থায় তিনি সুরেশচন্দ্র দত্তের "দ্য টিচিংস অফ শ্রীরামকৃষ্ণ" নামে একটি বাংলা বই পড়েছিলেন। এতে মুগ্ধ হয়ে তিনি দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের সেই রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সাধক তাকে খুব আন্তরিকভাবে স্বাগত জানান। এরপর থেকে তিনি মঙ্গলবার এবং শনিবার রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করতে যেতেন। বাবা-মায়ের বাধা সত্ত্বেও সুবোধ তার সান্নিধ্যে আসেন ও রামকৃষ্ণের তত্ত্বাবধানে অনুশীলনের অংশ হিসাবে দক্ষিণেশ্বরেই গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে তার আধ্যাত্মিক সাধনার বিকাশ ঘটান। সুবোধানন্দ নিজের সম্পর্কে রামকৃষ্ণের দৃষ্টিভঙ্গি জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, "অনেকে আপনার সম্পর্কে অনেক কথা বলে, আমি নিজে প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত সেগুলি বিশ্বাস করি না।":২৭৮ গুরু তাকে মহেন্দ্র গুপ্তের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন যিনি পরবর্তীতে "শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত" লেখেন।

১৮৮৬ সালে রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর, সুবোধ তার বাড়ি ছেড়ে চলে যান এবং নরেন্দ্রনাথ দত্তের (যিনি পরে বিবেকানন্দ নামে পরিচিত হন) পরিকল্পিত বরানগর মঠে যোগ দেন। তিনি সন্ন্যাসী ধারণের স্বামী সুবোধানন্দ নামে পরিচিত হন।:২৮০ ১৮৮৯ সালের শেষ দিকে ব্রহ্মান্দার সাথে, সুবোধানন্দ বেনারাসে গিয়েছিলেন, যেখানে তিনি কঠোর তপস্যা অনুশীলন করন। ১৮৯০ সালে তারা একসঙ্গে ওমকার, গিরনার, বোম্বে, দ্বারকা এবং বৃন্দাবন সহ পশ্চিম ও মধ্য ভারতে তীর্থযাত্রার জন্য যান। তিনি আধ্যাত্মিক খোঁজে হিমালয়ের কেদারনাথ ও বদ্রীনাথ পর্যন্ত গিয়েছিলেন। তিনি দক্ষিণ ভারতে কন্যাকুমারীও ভ্রমণ করেন।

স্বামী বিবেকানন্দ পশ্চিমা দেশ থেকে ফিরে আসার পর গুরুভাইদের মানব কল্যাণে কাজ করার জন্য পরামর্শ দেন। সুবোধানন্দ তার সেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং সদ্য প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের জন্য বিভিন্ন পদে ক্ষমতাসীন ছিলেন। ১৮৯৯ সালে তাকে প্রাথমিকভাবে মঠের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কলকাতায় মহামারী শুরু হলে সুবোধানন্দ, সদানন্দ এবং বোন নিবেদিতার সাথে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার ব্যবস্থা করন।:২৮১ উড়িষ্যার চিল্কা দ্বীপপুঞ্জে 1908 সালের দুর্ভিক্ষের সময় তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের সহকর্মী সন্ন্যাসীদের সাথে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের ত্রাণদানের কাজ করেছিলেন।

পরবর্তী সময়ে সক্রিয় কাজে অপারক হলেও মানুষকে কল্যাণের কাজে তিনি উদ্বুদ্ধ করতেন। বিগত বছরগুলোতে তিনি রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের বাণী প্রচারের জন্য বাংলাবিহারে ব্যাপক সফর করেন। তিনি শিশুসহ বিপুল সংখ্যক মানুষকে দীক্ষা দেন। শিষ্যদের মধ্যে তিনি সামাজিক অবস্থান, বর্ণ, লিঙ্গ বা বয়সের বাছ-বিচার কখনও করেননি।

সুবোধানন্দ ছিলেন বিবেকানন্দ কর্তৃক নিযুক্ত বেলুড় মঠ-এর প্রথম পর্যায়ের অছিদের একজন, যিনি পরবর্তীতে কোষাধ্যক্ষ হিসেবেও নিযুক্ত হন।

১৮৯৭ সালে মাদ্রাজে ইয়ং মেনস হিন্দু অ্যাসোসিয়েশনের সভায় তিনি তাঁর বহুচর্চিত বক্তৃতা রাখেন, তার মূল বক্তব্য ছিল সন্ন্যাসব্রহ্মচর্য

স্বামী বিজ্ঞানানন্দ

দেখুন:স্বামী বিজ্ঞানানন্দ (১৮৬৮-১৯৩৮)

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ 
স্বামী বিজ্ঞানানন্দ

স্বামী বিজ্ঞানানন্দ একজন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন এবং ভারতের পূর্ববর্তী রাজ্য ইউনাইটেড প্রভিন্সে জেলা প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি সংস্কৃতে পণ্ডিত ও ধর্ম-দার্শনিক কাজে দক্ষ ছিলেন। ১৮৬৮ সালের ৩০শে অক্টোবর তৎকালীন চব্বিশ পরগনায় দক্ষিণেশ্বরের নিকট বেলঘরিয়ায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল হরিপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৯ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর বেলঘরিয়ায় কেশব চন্দ্র সেনের বাড়ীতে তিনি সর্বপ্রথম রামকৃষ্ণকে দেখেন। হাইস্কুলের প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় দেওয়ান গোবিন্দ মুখার্জির বাড়িতেও তিনি রামকৃষ্ণকে দেখেছিলেন। ১৮৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র হরিপ্রসন্ন তার সহযোগী ছাত্র শরৎ, এবং বরদা পালের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে যান। রামকৃষ্ণ হরিপ্রসন্নের প্রতি অগাধ ভালবাসা এবং স্নেহ দেখান।

কলকাতা থেকে প্রথম কলা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে হরিপ্রসন্ন বিহারের বাঁকিপুর চলে যান। তিনি পাটনা কলেজ থেকে স্নাতক হন এবং পুণেতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান। এই সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণ মারা যান এবং কথিত আছে মারা যাবার আগের রাতে তিনি স্বপ্নে তার দেখা পান।

তিনি গাজীপুর, ইটাওয়া, মীরাট, বুলন্দশহরে চাকরি করেন। ইটাওয়ায় স্বামী সুবোধানন্দের সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি আলমবাজার মঠে মাসিক ৬০ টাকা অনুদান দিতে থাকেন। মায়ের পরবর্তী জীবনের জন্য যথেষ্ট অর্থোপার্জন করে তিনি আলমবাজার মঠে যোগ দেন।

১৮৯৬ সালে স্বামী বিবেকানন্দ পশ্চিমের দেশ ভ্রমণ করে ফিরে আসার কিছু আগে হরিপ্রসন্ন আলমবাজার মঠে যোগ দিয়ে সেখানে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস জীবনে তিনি স্বামী বিজ্ঞানানন্দ নামে পরিচিত হন। স্বামী বিজ্ঞানানন্দ বিবেকানন্দের সাথে রাজপুতানা এবং দেশের অন্যত্র ভারত ভ্রমণে গিয়েছিলেন। ১৮৯৯ সালে প্রকৌশলী হিসাবে তিনি বেলুড় মঠে মঠের ভবন নির্মাণের কাজ তদারকি শুরু করেন। একজন পরিভ্রমণকারী সন্ন্যাসী হিসাবে তিনি অনেক জায়গা পরিদর্শন করে ১৯০০ সালে এলাহাবাদে আসেন। ঐ সময়ে এখানে একদল তরুণ ছাত্র ব্রহ্মবাদীন ক্লাব নামে একটি সংগঠন শুরু করে, তারা এ জন্য স্বামীজি মহারাজের সাহায্য প্রার্থনা করলে তিনি যথাসাধ্য উন্নয়নমূলক কাজ করতে অগ্রসর হন। তিনি এলাহাবাদকে তার স্থায়ী অবস্থান করে তোলেন এবং সেখানে তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের একটি কেন্দ্র স্থাপন করেন। ১৯০৮ সালে এলাহাবাদের মুঠিগঞ্জে রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পর থেকে এলাহাবাদ এবং তৎ সংলগ্ন এলাহাকায় তিনি বহু উন্নয়নমূলক কাজ করেন এবং তার গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের বাণী প্রচার করতে থাকেন। তার বেশ‌ কিছু শিষ্য তথা ভক্তও ছিলেন।

১৯৩৪ সালে তিনি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সহসভাপতি এবং ১৯৩৭ সালে সভাপতি পদে নিযুক্ত হন। তার শেষ কয়েক বছরে তিনি ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেন, তথা রেঙ্গুনকলম্বো সহ রামকৃষ্ণ মঠের অনেক কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। ১৯৩৮ সালের ১৪ই জানুয়ারি স্বামী বিজ্ঞানানন্দ বেলুড় মঠ ও মন্দির নির্মাণ এবং শ্রীরামকৃষ্ণের মার্বেলের মূর্তির তৈরির বিষয়ে মনোনিবেশ করেন। এরপরে শ্রী রামকৃষ্ণের জন্মদিন উপলক্ষে তিনি বেলুড়ে আর মাত্র একবার সফর করেছিলেন। এলাহাবাদে ফিরে আসেন তিনি ১৯৩৮ সালে ২৫শে এপ্রিল মঠেই মারা যান।

স্বামী নিরঞ্জনানন্দ

দেখুন:স্বামী নিরঞ্জনানন্দ (১৮৬২-১৯০৪)

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ 
স্বামী নিরঞ্জনানন্দ

নিরঞ্জনানন্দ ছিলেন সেই কয়েকজন শিষ্যদের মধ্যে একজন রামকৃষ্ণ যাদের "নিত্যসিদ্ধ" বা "ঈশ্বরকোটী" বলে অভিহিত করেছেন, যার অর্থ পূর্ণতাপ্রাপ্ত আত্মা। তিনি ১৮৬২ সালে তৎকালীন বাংলা প্রদেশের চব্বিশ পরগনার রাজারহাট-বিষ্ণুপুর নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল নিত্যনিরঞ্জন ঘোষ, তবে তিনি নিরঞ্জন নামেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তিনি তাঁর মামা কালীকৃষ্ণ মিত্রের সঙ্গে কলকাতায় থাকতেন। শৈশবে তিনি একদল আধ্যাত্মবাদীর সাথে যুক্ত হন, যা তার জীবনের পরবর্তী সময়ে সফলতা এনে দেয়।:১২৬:১২৯ জীবনের এক সময়ে তিনি মুর্শিদাবাদ জেলায় একজন নীলকর সংগ্রাহকের চাকরি নেন।

নিরঞ্জনের বয়স যখন প্রায় আঠারো বছর তখন তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথমবার সাক্ষাৎ পান। আধ্যাত্মবাদের প্রতি তার ঝোঁক বুঝতে পেরে রামকৃষ্ণ স্পষ্টতই তাকে এই বলে তিরস্কার করেছিলেন যে, যদি তুমি ভূত-প্রেতের কথা ভাব তাহলে তুমি ঐরূপই হয়ে যাবে, আর ঈশ্বরের কথা ভাবলে তোমার জীবনে হবে ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রকাশ ঘটবে।:১২৭

একবার নিরঞ্জন একটি নৌকা করে দক্ষিণেশ্বরে যাচ্ছিলেন, তখন তার কিছু সহযাত্রী তার গুরু রামকৃষ্ণ সম্পর্কে খারাপ কথা বলতে শুরু করলে নিরঞ্জন ক্ষুব্ধ হয়ে নৌকাটি ডুবিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। রামকৃষ্ণ ঘটনাটি জানতে পারলে তিনি এ বিষয়ে নিরঞ্জনকে বোঝান, "ক্রোধ হল মারাত্মক পাপ, তুমি কেন এই ক্রোধের অধীন হবে? মূর্খ লোকেরা তাদের অনভিজ্ঞ অজ্ঞতায় অনেক কিছু বলে থাকেন, তাবলে তাদের কথা না ধরে বরং গুরুত্ব না-ই দেওয়া উচিত"।:১৩০

শ্রীরামকৃষ্ণ নিরঞ্জনের অফিসে কাজ করাটাকে ভালোভাবে নেন নি, কিন্তু তিনি যখন শুনেছিলেন যে নিরঞ্জন তার বয়স্ক মায়ের জন্য এই চাকরি নিয়েছেন, তখন তিনি বিষয়টি বুঝতে পেরে সম্মতি দেন।

রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর নিরঞ্জন ও শশী মহারাজ (পরবর্তীতে রামকৃষ্ণানন্দ) বেশিরভাগ দেহভস্ম একটি পৃথক কলসে সংরক্ষণ করে তারা বলরাম বসুর বাড়িতে রেখেছিলেন, যা পরে বেলুড় মঠে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

নিরঞ্জন ১৮৮৭ সালে অন্যান্য গুরুভাইদের সাথে সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করেন এবং রামকৃষ্ণ আদেশের সন্ন্যসের প্রথম আবাস বরানগর মঠে স্থায়ীভাবে থাকতে আসেন। তাকে বিবেকানন্দ সন্ন্যাস নাম স্বামী নিরঞ্জনানন্দ (নিরঞ্জন, অর্থাৎ নির্দোষ) নাম দিয়েছিলেন। শারীরিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার দরুন মঠে তিনি বেশিরভাগ শ্রমসাধ্য কাজ করতেন। তিনি পুরীতে ভ্রমণ করেন এবং 1887 সালের এপ্রিল মাসে আবার মঠে ফিরে আসেন। তিনি কাশীপুরে যেখানে রামকৃষ্ণকে দাহ করা হয়েছিল সেখানে গুরুর জন্য একটি বেদী তৈরি করেন ও একই জায়গায় একটি বেল গাছ রোপণ করেন। তিনি ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে দেওঘরে তীর্থযাত্রা করতে যান এবং বংশী দত্তের বাগানবাড়িতে থেকে ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে জীবনযাপন করেন। তিনি প্রয়াগ (এলাহাবাদ) যান ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে ভ্রমণ করেন। কিছুকাল তিনি সেখানে ধর্মপ্রচারক হিসেবে বসবাস করে তাঁর প্রভুর আদর্শ শিক্ষা দেন। ১৮৯৭ সালে বিবেকানন্দ ভারতে ফিরে এলে তিনি তার সাথে সমগ্র উত্তর ও দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ করেন। ১৮৯৮ সালে তিনি আলমোড়া যান এবং সেখানে তিনি শুদ্ধানন্দ (সুধীর মহারাজ)-কে দীক্ষা নেন। এরপর তিনি বারাণসীতে গিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবনযাপন করেন। সেখানে তিনি একদল যুবককে সেবা ও ত্যাগের পথে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।

পরে তিনি হরিদ্বারের কাছে কনখলে গিয়ে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় ফিরে আসেন। সুস্থ হওয়ার পর, তিনি বারাণসীতে ফিরে যান ও সেখানে বিবেকানন্দের সাথে দেখা করেন। বিবেকানন্দ অসুস্থ থাকাকালীন তিনি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন এবং তাঁর দারোয়ান হয়ে লোকের ভিড় থেকে তাকে বিরত রাখতেন। বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর তিনি হরিদ্বারে ফিরে আসেন। তার শেষ জীবনকালে তিনি দীর্ঘস্থায়ী আমাশয়ে ভুগছিলেন। ১৯০৪ সালে ৯ই মে হরিদ্বারে মারা যান।

স্বামী প্রেমানন্দ

দেখুন:স্বামী প্রেমানন্দ (১৮৬১-১৯১৮)

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ 
স্বামী প্রেমানন্দ

১৮৬১ সালে ১০ই ডিসেম্বর হুগলি জেলার আঁটপুর গ্রামে তারাপ্রসন্ন ঘোষ ও মাতঙ্গিনী দেবীর ঘরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল বাবুরাম ঘোষ। ভগিনী কৃষ্ণভামিনী ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের এক গৃহস্থ শিষ্য বলরাম বসুর স্ত্রী। ছোট থেকেই তিনি সংসার থেকে বিমুখ বৈরাগী পুরুষ ছিলেন। গ্রামের ভিতরে থেকে পাশ করে তিনি কলকাতায় পড়তে আসেন, সেখানে তার সাথে দেখা হয় মহেন্দ্র গুপ্ত তথা শ্রী"ম"-এর। শ্রীম ও তার সহপাঠী রাখালের সহযোগিতায় তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সান্নিধ্য পান।

বাবুরাম রাখালকে সাথে নিয়ে রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করতে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের যাতায়াত শুরু করেন। তিনি বিবেকানন্দ তথা নরেন্দ্রনাথ দত্তের সাথেও সাক্ষাৎ করেছিলেন। কয়েকবার দক্ষিণেশ্বরে যাবার পর তিনি সরাসরি রামকৃষ্ণের প্রভাবের অধীনে আসেন যিনি তাকে গূঢ় শিক্ষা দিয়েছিলেন। এই সময় বাবুরামের বছর ছিল মাত্র ২০। রামকৃষ্ণ একবার তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন, বাবুরাম তার অন্তর থেকে বিশুদ্ধ, কোন অশুচি চিন্তাধারা কখনও তার মনে প্রবেশ করতে পারে না।

১৮৮৬ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত শ্রীরামকৃষ্ণের চিকিৎসা ও সেবায় তিনি বাকি গুরুভাইদের সাথে হাত মেলান। এর ফলে গুরুভাইয়েরা এক হয়ে তাদের লক্ষ্যের প্রতি অগ্রসর হন এবং নরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে বরানগরে প্রথম মঠ প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়। ঐ বছর ডিসেম্বরে সমস্ত গুরুভাই আঁটপুরে তার পৈতৃক ভিটায় একত্রিত হয়ে সন্ন্যাস নেন ও বাবু মহারাজে স্বামী প্রেমানন্দ নাম পান। রামকৃষ্ণানন্দ মাদ্রাজ চলে যাওয়ার পর প্রেমানন্দ গুরুর নিত্যপূজার দায়িত্ব নেন।

১৯০২ সালে বিবেকানন্দের দেহত্যাগের পর রামকৃষ্ণ মিশনের তৎকালীন সভাপতি স্বামী ব্রহ্মানন্দ প্রেমানন্দকে বেলুড়ে মঠের দৈনন্দিন বিষয় তথা দৈনিক পূজা, প্রবর্তন, যুবক ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসী, ভক্ত ও অতিথি আপ্যায়ন, বিভিন্ন প্রশাসনিক এবং দীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। তিনি নিজে অসময়ে মঠে আসা ভক্তদের জন্য রান্না করতেন এবং তাদের আরামের সমস্ত দায় নিতেন। এ জন্য তিনি ‘মঠের মা’ পরিচিতি লাভ করে ছিলেন।

প্রেমানন্দ দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করে বেলুড় মঠে সংস্কৃত শিক্ষার পরিবেশ চালু করেছিলেন। তিনি পাশ্চাত্য দর্শনের মতো অন্যান্য বিষয়ের অধ্যয়নকেও উৎসাহিত করতেন। তিনি নারী শিক্ষার উপরও খুব জোর দিয়েছিলেন এবং এ প্রসঙ্গে একজন ভদ্রমহিলাকে লিখেছিলেন, "বাংলা থেকে হাজার হাজার নিবেদিতা বেরিয়ে আসুক... গার্গী, লীলাবতী, সীতা ও সাবিত্রীরা এই ভূমিতে নতুন করে উদিত হউক।"

দেওঘরে রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠে তাঁর সম্মানে প্রেমানন্দ ধাম নামে একটি ছাত্রাবাস রয়েছে।

মঠে প্রায় ৬ বছর কাজ করার পর তিনি শিবানন্দ এবং তুরীয়ানন্দর সাথে ১৯১০ সালে অমরনাথের তীর্থযাত্রার করেন। ফিরে এসে তিনি রামকৃষ্ণের বাণী বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচার করেন। তিনি পূর্ববঙ্গে বিশেষভাবে জনপ্রিয় ছিলেন এবং সেখানকার যুবকদের সামাজিক ও দাতব্য কাজের জন্য অনুপ্রাণিত করেছিলেন। দীর্ঘ এবং কঠিন ভ্রমণ তার স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে এবং তিনি একটি মারাত্মক কালাজ্বরের শিকার হন। পরে তিনি ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভুগে ১৯১৮ সালে ৩০ জুলাই শরীর ত্যাগ করেন।

স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ

দেখুন:স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ (১৮৬৩-১৯১১)

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ 
স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ

১৮৬৩ সালে ১৩ই জুলাই হুগলি জেলার খানাকুলের নিকট ইছাপুর গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্র চক্রবর্তীর ঘরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল শশীভূষণ চক্রবর্তী। তার বাবার দরুন ছোটবেলা থেকে আচার-উপাসনার প্রতি আগ্রহ জন্মায়। উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় গিয়ে তিনি তার খুড়তুতো ভাই শরতের (পরবর্তীতে স্বামী সারদানন্দ) সাথে থাকা শুরু করেন।

কলকাতার একটি কলেজে পড়ার সময়, শশী এবং শরৎ ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন এবং কেশবচন্দ্র সেনের কাছ থেকে রামকৃষ্ণের কথা শোনেন। ১৮৮৩ সালের অক্টোবরে তারা দক্ষিণেশ্বর যান এবং রামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিকতার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। শশী কলেজে তার পড়াশোনা বাদ দিয়ে শ্যামপুকুর এবং কাশীপুরে তাঁর গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসের শেষ সময়ে তার সেবা কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন। গুরুর দেহত্যাগের পর তিনি বরানগর মঠে যোগ দেন। পরে আঁটপুরে সন্ন্যাস গ্রহণ করে রামকৃষ্ণানন্দ নাম ধারণ করেন। স্বামী রামকৃষ্ণানন্দই রামকৃষ্ণের প্রতিদিনের আচার-অনুষ্ঠান পূজার পদ্ধতি প্রণয়ন ও প্রবর্তন করেছিলেন।

বাংলায় ১৮৯৭ সালের দুর্ভিক্ষের ত্রাণ কাজের জন্য তিনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ত্রাণসাহায্য সংগ্রহ করেন। সরাসরি সেই ত্রাণের কাজে জড়িত থাকা অখণ্ডানন্দকে তিনি সংগৃহীত এই ত্রাণ সাধারণকে বিতরণের জন্য দেন।

তিনি বিশেষ তীর্থযাত্রা না করে প্রথমদিকে মঠের কাজেই মনোনিবেশ করেছিলেন। কিন্তু বিবেকানন্দ পশ্চিমা দেশ ভ্রমণ করে ফিরে এসে কাকে দক্ষিণ ভারতের চেন্নাইয়ের রামকৃষ্ণ মঠের একটি শাখা প্রবর্তন করতে বললে তিনি নির্দিষ্টতা পালন করতে চেন্নাই গমন করেন।‌‌ তিনি সেখানে চেন্নাই শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ, ব্যাঙ্গালোর শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ, চেন্নাইয়ের ময়িলাপুরে রামকৃষ্ণ মিশন ছাত্রাবাসিক, জর্জ টাউনে ন্যাশনাল স্কুল ফর গার্লস, মাদ্রাজ থেকে রামকৃষ্ণ–বিবেকানন্দের উপর বিভিন্ন বই প্রকাশ করা শুরু করেন। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ১৪ বছর ধরে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের বাণী প্রচার করতে গিয়ে তিনি যে ত্যাগ ও কষ্টের কাহিনী সঙ্গী করেছিলেন তা রামকৃষ্ণ বাণীপ্রচারের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এরপর থেকে দক্ষিণ ভারতে তিনি ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছিলেন। তিরুবনন্তপুরম, মহীশূর, বেঙ্গালুরু এবং মুম্বাইতে কেন্দ্রের সূচনা তার অগ্রণী প্রচেষ্টার জন্য অনেক বেশি ঋণী। এছাড়াও তিনি আলেপ্পি, এর্নাকুলাম, মসুলিপত্তনম, তিরুনেলবেলি ও দেশের বাইরে বর্মায় রেঙ্গুন ভ্রমণ করেন। তাঁর শেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব ছিল ১৯১১ সালে সারদা দেবীর দক্ষিণ ভারত সফরের ব্যবস্থা করা যে ঘটনাটি সমগ্র ভারতে এবং বিশেষ করে দক্ষিণ ভারত জুড়ে রামকৃষ্ণ বাণীপ্রচার বৃদ্ধিতে ব্যাপক প্রেরণা দেয়। তিনি তার সহকর্মী স্বামী নির্মলানন্দকে দক্ষিণ ভারতের রামকৃষ্ণ মিশনের সহচরদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। এর ফলে বিশেষ করে বেঙ্গালুরু এবং কেরালায় নির্মলানন্দ মিশনের দায়িত্ব গ্রহণ করতে অগ্রসর হন এবং ১৯৩৮ সালে আমৃত্যু রামকৃষ্ণানন্দের শুরু করা কাজগুলিকে সম্প্রসারণে চালিয়ে যান।

সারদা দেবীর দক্ষিণ ভারতে ভ্রমণের সময় অবিরাম কাজ ও তাঁর সেবা করার কিছুদিন পর তিনি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। তার গুরুভাই নির্মলানন্দের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্যকর আবহাওয়ায় স্বাস্থ্য ভাল হওয়ার আশা নিয়ে বেঙ্গালুরুতে তিনি কয়েক সপ্তাহ কাটান। কিন্তু শারীরিক অবনতি অব্যাহত থাকায় তাকে কলকাতায় পাঠানো হয়। ১৯১১ সালের ২১শে আগস্ট কলকাতায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

স্বামী সারদানন্দ

দেখুন:স্বামী সারদানন্দ (১৮৬৫-১৯২৭)

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ 
স্বামী সারদানন্দ

১৮৬৫ সালের ২৩শে ডিসেম্বর কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটে একটি ধনী ও গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী। বড় হওয়ার সাথে সাথে তিনি ব্রাহ্ম নেতা কেশবচন্দ্র সেনের প্রভাবে আসেন এবং ব্রাহ্মসমাজের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে শুরু করেন। ১৮৮২ সালে তিনি স্কুলের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন।

১৮৮৩ সালে অক্টোবর মাসে তার ভাই শশীকে নিয়ে রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করতে দক্ষিণেশ্বর যান। এরপর থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করার জন্য দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে যেতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার সাথে সাথে তিনি আধ্যাত্মিক অনুশীলনের দিকনির্দেশ পেতে শুরু করেন।

১৮৮৫ সালে গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মৃত্যুর পর তিনি এবং তার অন্যান্য গুরুভাইয়েরা বরানগর মঠে কঠোর ও অভাবী জীবন অতিবাহিত করেন। আঁটপুরে তারা সন্ন্যাস গ্রহণ করলে তিনি স্বামী সারদানন্দ নামে পরিচিত হন।

সারদানন্দ পুরী, কাশী, অযোধ্যাঋষিকেশ সহ উত্তর ভারতের অনেক স্থানে ভ্রমণ করেন। এছাড়াও তিনি হিমালয়ে গঙ্গোত্রী, কেদারনাথ এবং বদ্রীনাথ ভ্রমণ করেন। ১৮৯০ সালে সারদানন্দ আলমোড়ায় আসেন। সেখানে তিনি বিবেকানন্দের সাথে দেখা করেন এবং তারা একসাথে গাড়োয়ালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখান থেকে মুসৌরির কাছে রাজপুরে এসে তুরীয়ানন্দের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর তিনি ঋষিকেশে যান এবং সেখানে কনখলে ব্রহ্মানন্দের সঙ্গে দেখা করেন।‌‌ দিল্লি থেকে তিনি কাশী যান এবং সেখানে কিছুকাল অবস্থান করে স্বামী অভেদানন্দের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে তিনি রক্ত ​​আমাশয়ে ভোগেন এবং ১৮৯১ সালে বরানগর মঠে ফিরে আসেন। পরবর্তীকালে, সুস্থ হওয়ার পর তিনি শ্রী সারদা দেবীর জন্মস্থান জয়রামবাটীতে যান। পরে ১৮৯২ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং রামকৃষ্ণ মঠ আলমবাজারে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৮৯৬ সালে বিবেকানন্দের ডাকে সারদানন্দ বেদান্ত প্রচারের জন্য লন্ডনও পারি দেন।

১৮৯৯ সালে কলকাতায় প্লেগ মহামারী আকার ধারণ টরলে রামকৃষ্ণ মিশন ত্রাণের আয়োজন করে। সারদানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা এবং অন্যান্য গুরুভাইরাও ত্রাণ কাজে জড়িত ছিলেন। ঐ বছর তিনি মিশনের তহবিল সংগ্রহের জন্য স্বামী তুরীয়ানন্দের সাথে গুজরাট ভ্রমণ করেন এবং আমেদাবাদ, জুনাগড়, ভাবনগর ইত্যাদি অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করে হিন্দিতে বক্তৃতা দেন। বিবেকানন্দের দ্বিতীয়বার পশ্চিমে প্রস্থানের পর, তিনি তরুণ সন্ন্যাসীদের প্রশিক্ষণও শুরু করেন। এরপর ডিসেম্বর মাসে তিনি আমন্ত্রণ পেয়ে ঢাকা, বরিশালনারায়ণগঞ্জ যান এবং সেখানে অশ্বিনীকুমার দত্তের বাড়িতে অবস্থান করেন।

কলকাতায় ফিরে আসার পর, তিনি তাঁর কাকা ঈশ্বরচন্দ্র চক্রবর্তীর নির্দেশনায় তান্ত্রিক উপাসনার প্রতি আগ্রহী হন। এই অভিজ্ঞতার পর তিনি "ভারতে শক্তি পূজা" নামে একটি বই লেখেন। ১৯০২ সালে বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর তিনি বেলুড় মঠের দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা শুরু করেন এবং আগেই শুরু করা বাংলা পত্রিকা "উদ্বোধন" সম্পাদনা ও প্রকাশের কাজটিও গ্রহণ করেন।

১৯১৩ সালে বর্ধমানে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তাঁর অধীনে রামকৃষ্ণ মিশন তহবিল সংগ্রহ করে ত্রাণ শুরু করে। ১৯১৬ সালে তিনি গয়া, কাশী, বৃন্দাবনে তীর্থযাত্রার জন্য যান এবং দুইমাস পর ফিরে আসেন। ১৯২০ সালে সারদা দেবীর এবং ১৯২২ সালে ব্রহ্মানন্দের মৃত্যুর পর, সারদানন্দ ধীরে ধীরে সক্রিয় কাজ থেকে সরে আসেন।

১৯২৭ সালের ৬ই আগস্ট তার বৃক্ক সংক্রান্ত রোগসহ অ্যাপোপ্লেক্সি ধরা পড়ে। ১৯ শে আগস্ট তিনি মারা যান।

স্বামী শিবানন্দ

দেখুন:স্বামী শিবানন্দ (১৮৫৪-১৯৩৪)

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ 
স্বামী শিবানন্দ

স্বামী শিবানন্দের ভক্ত ও শিষ্যরা তাকে মহাপুরুষ মহারাজ বলে অভিহিত করতেন। ১৮৫৪ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি চব্বিশ পরগনার বারাসাতের নিকট একটি গ্রামে বাঙালি উকিল ব্রাহ্মণ রামকানাই ঘোষালের বাড়ীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল তারকনাথ ঘোষাল।

১৮৮০ সালের মে মাসে রামচন্দ্র দত্তের বাড়িতে তিনি প্রথমবার রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে দেখেন। এর কয়েক দিন পরে তিনি দক্ষিণেশ্বরে কালী মন্দির দেখতে যান। কিছুদিন পরমহংসের সঙ্গ পাওয়ার পর তিনি তার নির্দেশনায় সাধনা ও ধ্যান অনুশীলন করতে শুরু করেন। তার বোনের বিয়ের জন্য যথেষ্ট যৌতুক না দিতে পেরে তিনি হবু ভগ্নীপতির বাড়ীর এক কন্যাকে বিবাহ করতে বাধ্য হন। ১৮৮১-৮২ সালে তার বিয়ে হয়। বিয়ের তিন বছর পর তার স্ত্রী মারা গেলে বরানগর মঠ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কখনও ভক্তের বাড়ীতে বা কখনও একাকী জায়গায় থাকা শুরু করেন।

১৮৮৬ সালে তার গুরু রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর তার সাক্ষাৎশিষ্য তথা গুরুভাইদের একটি ছোট দল আঁটপুরে মিলিত হয়ে সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তারকনাথ ঘোষালের নামকরণ হয় স্বামী শিবানন্দ। তারা বরানগরের একটি জরাজীর্ণ বাড়িতে থাকা শুরু করেন। এভাবে রামকৃষ্ণ আদর্শের বরানগর মঠের সূচনা হয়।

সন্ন্যাস পরবর্তী কালে গুরু শিক্ষা প্রচারে শিবানন্দ উত্তর ভারতে ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি আলমোড়ায় যান, যেখানে তিনি একজন স্থানীয় ধনী ব্যক্তি লালা বদ্রীলাল শাহের সাথে পরিচিত হন, তিনিও রামকৃষ্ণের শিষ্যদের একজন ভক্ত ছিলেন। ১৮৯৩ সালের শেষের দিকে তিনি ই.টি. স্টার্ডি নামে একজন ধর্মতত্ত্বে আগ্রহী ইংরেজের সাথে দেখা করেন, যিনি পরে ইংল্যান্ডে বিবেকানন্দের সাথে দেখা করার পর তার ভক্ত ও অনুসারী হয়ে ওঠেন। তার মননশীল জীবনযাপনের দিকে বেশি ঝোঁক ছিল এবং বেশ কয়েকবার হিমালয়ে যাত্রা করেন। তিনি স্বামী তুরীয়ানন্দের সাথে ১৯০৯ সালে অমরনাথেও যান।

১৮৯৭ সালে বিবেকানন্দ পশ্চিমা দেশগুলি থেকে ভারতে ফিরে আসার পর শিবানন্দের ভ্রমণ জীবনের সমাপ্তি ঘটে। তিনি বিবেকানন্দকে স্বাগত জানাতে মাদ্রাজে যান এবং তাকে সাথে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। বিবেকানন্দ শিবানন্দকে বেদান্তের জ্ঞান প্রচারে শ্রীলঙ্কায় পাঠান। সেখানে তিনি গীতা ও রাজযোগের উপর পাঠ দেন। ১৮৯৮ সালে বেলুড়ে নতুন প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মঠে ফিরে আসেন। ১৮৯৯ সালে কলকাতায় প্লেগ শুরু হলে শিবানন্দ বিবেকানন্দের অনুরোধে ত্রাণ কার্যক্রম সংগঠিত করতে সাহায্য করেন। ১৯০০ সালে তিনি বিবেকানন্দের সাথে চম্পাবতের মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রমে যান। দেওঘরের রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠে তাঁর সম্মানে "শিবানন্দ ধাম" নামে একটি ছাত্রাবাস রয়েছে।

১৯০২ সালে, বিবেকানন্দের মৃত্যুর ঠিক আগে ভিঙ্গার রাজার স্বামী বিবেকানন্দকে দান ব্যবহার করা সম্পত্তিতে অদ্বৈত আশ্রম শুরু করতে বারাণসীতে যান। সেখানে তিনি সাত বছর আশ্রমপ্রধান ছিলেন।। এই সময়ে তিনি বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতা স্থানীয় হিন্দিতে অনুবাদ করেন।

১৯১০ সালে তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯১৭ সালে যখন বাবুরাম মহারাজ (স্বামী প্রেমানন্দ) অসুস্থ হয়ে মারা গেলে মঠ ও মিশনের পরিচালনার দায়িত্ব শিবানন্দের উপর পড়ে। ১৯২২ সালে স্বামী ব্রহ্মানন্দের মৃত্যুর পর তিনি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দ্বিতীয় সভাপতি হন। ব্রহ্মানন্দের মতো তিনি তার দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি ধ্যান অনুশীলন করতেন। তিনি পূর্ববঙ্গের ঢাকামৈমনসিংহে যান ও বেশ কিছু আধ্যাত্মিক সাধককে দীক্ষা দেন। ১৯২৪ এবং ১৯২৭ সালে তিনি দক্ষিণ ভারতে দুটি দীর্ঘ সফরে যান এবং উটি, বোম্বেনাগপুরে রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৫ সালে তিনি দেওঘরে যান এবং রামকৃষ্ণ মিশনের স্থানীয়দের জন্য একটি নতুন ভবন খোলেন।

১৯৩০ সাল থেকে শিবানন্দের স্বাস্থ্য দ্রুত ভেঙে পড়ে। ১৯৩৩ সালের এপ্রিল মাসে তার স্ট্রোক হয় এবং একদিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ১৯৩৪ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি গুরু রামকৃষ্ণের জন্মদিনের কয়েকদিন পর শিবানন্দ মারা যান। পরে বেলুড় মঠের পুরাতন মন্দির সংলগ্ন ছোট কক্ষটি 'শিবানন্দের ঘর' নামে পরিচিতি লাভ করে।

স্বামী যোগানন্দ

দেখুন:স্বামী যোগানন্দ (১৮৬১-১৮৯৯)

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ 
স্বামী যোগানন্দ

১৮৬১ সালের ৩০ শে মার্চ দক্ষিণেশ্বরের নিকট নবীনচন্দ্র রায় চৌধুরীর বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃ প্রযুক্ত নাম ছিল যোগীন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী। তার পরিবার ছিল কলকাতার স্বনামধন্য সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের অংশ। যোগীন্দ্রনাথ শৈশব থেকেই মননশীল প্রকৃতির ছিলেন এবং দিনের বেশকিছু সময় ধ্যান করতেন। সতের বছর বয়সে যোগিন রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেন। সেই সময়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার জন্য অধ্যয়ন করছিলেন। রামকৃষ্ণ যোগিনের আধ্যাত্মিক সম্ভাবনাকে বুঝে তা পরিপুষ্ট করার জন্য বারবার দক্ষিণেশ্বরে আমন্ত্রণ পাঠাতেন। এর প্রভাব তার পড়াশোনার উপর পড়ে। তাকে নিয়ে তার পিতামাতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। বাবা মায়ের কথায় তিনি চাকরির সন্ধানে কানপুরে এক আত্মীয়ের কাছে যান। কর্মসংস্থান পেতে ব্যর্থ হয়ে ধ্যান করে সময় অতিবাহিত করা শুরু করেন। ছেলেকে গৃহস্থ করতে তার বাবা-মা তাকে বিয়ে প্রস্তাব দেন।

বিয়ের পর যোগিন আবার রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করেন এবং আবার তার আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষাকে এগিয়ে নিতে ঘন ঘন দক্ষিণেশ্বরে যেতে শুরু করেন। বিয়ের পরেও যোগিন জাগতিক বিষয়ে উদাসীন ছিলেন যা তাকে রামকৃষ্ণের শিক্ষার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু করে তোলে। তিনি যোগিনকে প্রায়শই বলতেন, "একজন মানুষ ধার্মিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করতেই পারেন তা'বলে তার বোকামি করার দরকার নেই।"

১৮৮৭ সালে স্বামী বিবেকানন্দের নেতৃত্বে গুরুভাইয়েরা সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করেন এবং যোগিন স্বামী যোগানন্দ নাম পান। তিনি ১৮৯১ সালে বারাণসী ভ্রমণ করতে গিয়ে একটি নির্জন বাগানবাড়ীতে থেকে কঠোর জীবনযাপন করেন। তপস্যা এবং আধ্যাত্মিক অনুশীলনের কারণে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে এবং তিনি কলকাতায়, নবগঠিত বরানগর মঠে ফিরে আসেন। কলকাতায় ফিরে তিনি এবং সারদা দেবী বলরাম বসুর বাড়ীতে থাকা শুরু করেন। এসময়ে তিনি তার গুরুমায়ের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।

যোগানন্দই সর্বপ্রথম দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রাঙ্গণে রামকৃষ্ণের জন্মবার্ষিকীর সার্বজনীন উদযাপনের আয়োজন করেছিলেন। ১৮৯৭ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসার সময় স্বামী বিবেকানন্দকে প্রবেশ অভ্যর্থনা দেন। উভয় অনুষ্ঠানেই তিনি অনেক যুবককে রামকৃষ্ণ ভাবধারায় প্রভাবিত করেছিলেন এবং একাধিক কার্যক্রম সংগঠন ও সমন্বয় করেছিলেন। ১৮৯৭ সালে রামকৃষ্ণ মিশনের গঠনের পর যোগানন্দ তার সহসম্পাদক নির্বাচিত হন এবং সফলভাবে সংগঠনের গঠনমূলক পরিচালনা করেন। ১৮৯৮ সালে যোগানন্দ নবগঠিত বেলুড় মঠ-এ রামকৃষ্ণের জন্মবার্ষিকীর আয়োজন করেন। ১৮৯৯ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কার্যালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।

যোগানন্দ দীর্ঘ অসুস্থতার পর ১৮৯৯ সালে ২৮শে মার্চ মারা যান। রামকৃষ্ণ ও সারদা দেবীর সাক্ষাৎশিষ্যদের মধ্যে যারা সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে তিনিই প্রথম মৃত্যুবরণ করেন। অসুস্থতার সময় বিবেকানন্দের শিষ্য কল্যাণানন্দ তার সেবা করেছিলেন। তার জীবনের শেষ দিনগুলিতে যোগীন মা কিছুদিন তার পরিচর্যা করেন। তাঁর মৃত্যুতে সারদা দেবী মর্মাহত হয়েছিলেন।

গৃহস্থ শিষ্য

নিম্নোক্ত ব্যক্তিবর্গ হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের গৃহস্থ শিষ্য:

টীকা

তথ্যসূত্র

This article uses material from the Wikipedia বাংলা article রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.

Tags:

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ সন্ন্যাসী শিষ্যরামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ গৃহস্থ শিষ্যরামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ টীকারামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ তথ্যসূত্ররামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণবরাহনগররামকৃষ্ণ পরমহংসরামকৃষ্ণ মঠরামকৃষ্ণ মিশনস্বামী অভেদানন্দস্বামী বিবেকানন্দ

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

জুবায়ের জাহান খানটেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাবলবঙ্গভঙ্গ আন্দোলনঅক্সিজেনমাইটোসিসবাংলাদেশের জাতীয় পতাকাউসমানীয় সাম্রাজ্যমাক্সিম গোর্কিপশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকোষ নিউক্লিয়াসযৌন প্রবেশক্রিয়াভারতের প্রধানমন্ত্রীদের তালিকাবাংলাদেশ পুলিশযোনিমুহাম্মদ ইকবালমুহাম্মাদের বংশধারালিওনেল মেসিআলীই-মেইলকারকবিবাহনরসিংদী জেলাবাংলা স্বরবর্ণকলি যুগবঙ্গবন্ধু টানেলবাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টরসমূহক্যান্টনীয় উপভাষাউমাইয়া খিলাফতগাঁজাহরে কৃষ্ণ (মন্ত্র)সিপাহি বিদ্রোহ ১৮৫৭ডেভিড অ্যালেনজনগণমন-অধিনায়ক জয় হেজেলা প্রশাসকআর্যতাওরাতসূর্য সেনক্রোয়েশিয়ামৌর্য সাম্রাজ্যসামরিক বাহিনীস্বাধীনতাভূগোলফুটবলঅস্ট্রেলিয়াকনমেবলঅনুসর্গশাকিব খানসত্যজিৎ রায়প্রধান পাতামুহাম্মাদের স্ত্রীগণজাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়২০২৩ ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপবাংলাদেশ ছাত্রলীগপাঠান (চলচ্চিত্র)সুকুমার রায়অনাভেদী যৌনক্রিয়াবাংলাদেশের একাডেমিক গ্রেডিং পদ্ধতিবাস্তব সংখ্যাছারপোকালালনইসলামে বিবাহজগদীশ চন্দ্র বসুচিঠিশ্রীকৃষ্ণকীর্তনমোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীলিঙ্গ উত্থান ত্রুটিফিফা বিশ্বকাপনিউমোনিয়াবাংলাদেশের সংবিধানভীমরাও রামজি আম্বেদকরপৃথিবীর ইতিহাসদোলোর ই গ্লোরিয়াসভ্যতাদক্ষিণ কোরিয়াআন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসহস্তমৈথুনের ইতিহাসমাটি🡆 More