বিশাল এশিয়া মহাদেশে বহু বিচিত্র ভাষা প্রচলিত। এগুলি বেশির ভাগই কোন বৃহত্তর ভাষা পরিবারের অন্তর্গত। তবে কিছু বিচ্ছিন্ন ভাষাও দেখতে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় এশিয়া মহাদেশে প্রায় ২২০০টি ভাষা প্রচলিত, যা সব মহাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এশিয়া ও ইউরোপের মিলনস্থলে তুর্কীয় ভাষাপরিবারটি তুরস্ক থেকে শুরু হয়ে ককেসাস অঞ্চলের অংশবিশেষ, ভোলগা নদীর তীরবর্তী কিছু অঞ্চল, প্রাক্তন সোভিয়েত মধ্য এশিয়ার বেশির ভাগ অংশ, ইরানের উত্তর-পশ্চিমাংশ, এবং দক্ষিণ সাইবেরিয়ার এক বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে প্রচলিত। এছাড়া এদের একটি দলছুট সদস্য ইয়াকুট ভাষা উত্তর-পূর্ব সাইবেরিয়াতে প্রচলিত। তুর্কীয় ভাষাগুলিকে মঙ্গোলীয় ও তুঙ্গুসীয় ভাষাপরিবারের সাথে একত্রিত করে অনেক সময় বৃহত্তর আলতায়ীয় ভাষাপরিবারের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়।
মঙ্গোলিক ভাষাগুলি প্রধানত মঙ্গোলিয়া ও উত্তর চীনে প্রচলিত। তবে আফগানিস্তানে (মোঘল ভাষা) এবং ককেসাস পর্বতমালার ঠিক উত্তরে (কালমিক ভাষা) কিছু বিচ্ছিন্ন মঙ্গোলিক ভাষা দেখতে পাওয়া যায়। মঙ্গোলিক ভাষাপরিবারের প্রধানতম ভাষা হল মঙ্গোলীয় ভাষা বা স্থানীয় নামানুসারে খাল্খা ভাষা।
তুঙ্গুসীয় ভাষাগুলিতে সাইবেরিয়া ও পূর্ব রাশিয়ার ছোট ছোট সম্প্রদায় কথা বলেন। মঙ্গোলিয়া এবং উত্তর-পূর্ব চীনেও এগুলি প্রচলিত। সবচেয়ে বিখ্যাত তুঙ্গুসীয় ভাষাটির নাম মান্চু ভাষা। ১৬৪৪ সাল থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত যে রাজবংশ চীন শাসন করেছিল, তাদের মাতৃভাষা ছিল এই মানচু ভাষা। বর্তমানে মানচু ভাষা বিলুপ্তির পথে।
উত্তর এশিয়াতে আরও কিছু ভাষা প্রচলিত যেগুলিকে প্রত্ন-সাইবেরীয় বা প্রত্ন-এশীয় ভাষা নামে ডাকা হয়। তবে এটি কোন বংশগত নামকরণ নয়। ইয়েনিসেই নদীর তীরে প্রচলিত কেট ভাষা, কোলিমা নদীর তীরে প্রচলিত ইউকাগির ভাষা, এবং আমুর নদীর মোহনা ও সাখালিন দ্বীপে প্রচলিত নিভ্খ ভাষা এরকম তিনটি বিচ্ছিন্ন ভাষা। এছাড়াও আছে ক্ষুদ্র চুকোটকো-কামচাটকান পরিবারের ভাষাগুলি; এগুলি চুকোটকা ও কামচাটকা উপদ্বীপদ্বয়ে প্রচলিত স্থানীয় আদিবাসী ভাষা। এদের মধ্যে আছে চুকচি ভাষা, করিয়াক ভাষা, ও কামচাডাল ভাষা। কেউ কেউ মনে করেন এগুলি উত্তর আমেরিকার এস্কিমো-আলেউট ভাষাগুলির সাথে সম্পর্কিত।
ইউরোপ ও এশিয়ার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত পার্বত্য ককেসাসে বহু ভাষা প্রচলিত। আরবেরা অঞ্চলটির নাম দিয়েছিল “ভাষাময় পর্বত”। ককেসাস অঞ্চলে আর্মেনীয় ও অসেটীয় নামের দুইটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা এবং আজারবাইজানি নামের একটি তুর্কীয় ভাষা প্রচলিত হলেও এখানকার বাকি সমস্ত স্থানীয় ভাষা একান্তই ককেসাস অঞ্চলের নিজস্ব। এগুলিকে ককেসীয় ভাষা বলা হয়। ককেসীয় ভাষাগুলি ককেসাসের বাইরে কোথাও প্রচলিত না হলেও এদের নিজেদের মধ্যকার বংশগত সম্পর্ক স্থাপন করা অত্যন্ত দুরূহ। ভাষাবিজ্ঞানীরা এগুলিকে একটি মাত্র পরিবারের ভাষা হিসেবে গণ্য না করে বরং তিন বা চারটি ভিন্ন ভিন্ন পরিবারে ভাগ করে আলোচনা করেন। এদের মধ্যে দক্ষিণ ককেসীয় ভাষাপরিবারে অন্তর্গত ভাষার মধ্যে আছে জর্জীয় ভাষা। প্রায় ৩০ লক্ষ বক্তাবিশিষ্ট জর্জীয় ভাষা বক্তাসংখ্যার বিচারে বৃহত্তম ককেসীয় ভাষা। এছাড়াও ককেসীয় ভাষাগুলির মধ্যে একমাত্র জর্জীয় ভাষাতেই একটি দীর্ঘ সাহিত্যিক ঐতিহ্য বিদ্যমান। খ্রিস্টীয় ৫ম শতকে লেখা জর্জীয় সাহিত্যের নিদর্শন পাওয়া গেছে। উত্তর-পশ্চিম ককেসীয় ভাষাগুলি কৃষ্ণ সাগরের উপকূলে বা কাছে অবস্থিত। মধ্য-উনিশ শতকে অভিবাসনের ফলে তুরস্কের কিছু অংশেও এই ভাষাগুলি প্রচলিত। তুরস্কে স্থানীয়ভাবে উবিখ ভাষা নামের একটি ককেসীয় ভাষা প্রচলিত, তবে এটি এখন বিলুপ্তির পথে। উবিখ ভাষাটি সবচেয়ে বেশি ব্যঞ্জনধ্বনিবিশিষ্ট ভাষার রেকর্ড গড়েছিল। অন্যান্য ককেসীয় ভাষার মধ্যে আছে উত্তর-মধ্য ককেসীয় ভাষাপরিবার এবং উত্তর-পূর্ব ককেসীয় ভাষাপরিবার। উত্তর-মধ্য ককেসীয় ভাষাগুলিকে অনেক সময় উত্তর-পূর্ব ককেসীয় পরিবারের অন্তর্গত ধরা হয়। এই ভাষাগুলি বেশির ভাগই দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় একটি করে গ্রামে বা লোকালয়ে প্রচলিত।
দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়াতে প্রচলিত ভাষাগুলির মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় আফ্রো-এশীয় ভাষাপরিবারের কথা। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলিতে প্রচলিত আরবি ভাষাই প্রধানতম আফ্রো-এশীয় ভাষা। এছাড়াও ইসরায়েলে হিব্রু ভাষা এবং অন্যত্র বিচ্ছিন্নভাবে আরামীয় ভাষা, সিরীয় ভাষা, ইত্যাদি আফ্রো-এশীয় ভাষা প্রচলিত।
দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতীয় উপমহাদেশ চারটি ভাষাপরিবারের মিলনক্ষেত্র। অঞ্চলটির উত্তরাংশে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের একটি উপপরিবার ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহ প্রাধান্য বিস্তার করেছে। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড় ভাষাগুলি প্রচলিত। তবে কিছু দ্রাবিড় ভাষা উত্তর ভারতেও প্রচলিত, যেমন পাকিস্তানে প্রচলিত ব্রাহুই ভাষা। উপমহাদেশের উত্তর প্রান্তসীমাতে পাহাড়ী চীনা-তিব্বতি ভাষাসমূহের অবস্থান। চতুর্থ ভাষাপরিবারটি হল অস্ট্রো-এশীয় ভাষাপরিবার বা মন-মুন্ডা-খমের ভাষাপরিবার। এই পরিবারের ভাষাগুলি প্রধানত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে প্রচলিত হলেও এদের অনেকগুলি বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মধ্য ভারত থেকে পূর্ব ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত। ভারতে সবচেয়ে বেশি বক্তাবিশিষ্ট অস্ট্রো-এশীয় ভাষাটি হল সাঁওতালি ভাষা। উপরের চারটি ভাষাপরিবারের বাইরে পাকিস্তানে বুরুশাস্কি নামের বিচ্ছিন্ন একটি ভাষার এবং আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে প্রচলিত ভাষাগুলির কোন বংশগতি নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে প্রচলিত অস্ট্রো-এশীয় ভাষাগুলির মধ্যে আছে ভিয়েতনামের ভিয়েতনামীয় ভাষা ও ক্যাম্বোডিয়ার খমের ভাষা। এখানে আরও দুইটি ভাষাপরিবার অবস্থিত। তাই ভাষাপরিবারের সদস্য থাই ভাষা থাইল্যান্ডে এবং লাও ভাষা লাওসে প্রচলিত। চীনা-তিব্বতি ভাষাপরিবারের সদস্যের মধ্যে তিব্বতি-বর্মী উপশাখার বর্মী ভাষা মিয়ানমারে এবং তিব্বতি ভাষা তিব্বতে প্রচলিত।
পূর্ব এশিয়ার চীনা-তিব্বতি ভাষাগুলির মধ্যে বৃহত্তম হল ম্যান্ডারিন চীনা ভাষা। এটি এবং অন্যান্য চীনা ভাষাগুলি গণচীনে প্রচলিত। দক্ষিণ চীনে মিয়াও-ইয়াও ভাষাপরিবারের ভাষাগুলি প্রচলিত। এগুলিকে চীনা-তিব্বতি পরিবারের সদস্য হিসেবে গণ্য করা হয় না। পূর্ব এশিয়াতে আরও দুইটি বিচ্ছিন্ন ভাষা প্রচলিত। এদের একটি হল কোরীয় উপদ্বীপে প্রচলিত কোরীয় ভাষা এবং দ্বীপরাষ্ট্র জাপানে প্রচলিত জাপানি ভাষা। কোরীয় ও জাপানি ভাষাকে আলতায়ীয় ভাষাপরিবারের অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। উরালীয় ও আলতায়ীয় ভাষাগুলির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন নিয়েও অনুরূপ বিতর্ক চলছে। জাপানের উত্তরতম দ্বীপ হোক্কাইদোতে আইনু নামের একটি বিচ্ছিন্ন ভাষা প্রচলিত।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দক্ষিণ প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে পূর্বদিকে প্রসারিত অসংখ্য দ্বীপ জুড়ে অস্ট্রোনেশীয় ভাষাগুলি প্রচলিত। এদের মধ্যে আছে মালয় উপদ্বীপ এবং ইন্দোনেশিয়া তথা মালয় দ্বীপপুঞ্জে প্রচলিত মালয় ভাষা, বালি ভাষা, ইত্যাদি। পূর্বে নিউ গিনি দ্বীপ পর্যন্ত, উত্তরে ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ ও তাইওয়ান পর্যন্ত এবং পশ্চিমে আফ্রিকার নিকটস্থ মাদাগাস্কার দ্বীপে প্রচলিত মালাগাসি ভাষা পর্যন্ত এই ভাষাগুলি বিস্তৃত।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article এশিয়ার ভাষা, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.