অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞান

অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞান (ইংরেজি: Infrared astronomy) হল জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের একটি শাখা। অবলোহিত (আইআর) বিকিরণে দৃশ্যমান মহাজাগতিক বস্তুগুলি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ এই শাখার উপজীব্য। অবলোহিত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ০.৭৫ থেকে ৩০০ মাইক্রোমিটারের মধ্যে ওঠানামা করে। অবলোহিত বিকিরণ দৃশ্য বিকিরণের মধ্যে পড়ে, যা ওঠানামা করে ৩৮০ থেকে ৭৫০ ন্যানোমিটার ও সাবমিলিমিটার তরঙ্গের মধ্যে।

অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞান
হাবলের ওয়াইড ফিল্ড ক্যামেরা ৩ কর্তৃক অবলোহিত আলোয় গৃহীত ক্যারিনা নীহারিকা

১৮০০ সালে উইলিয়াম হার্শেল অবলোহিত আলো আবিষ্কার করার পর ১৮৩০-এর দশকে অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূত্রপাত ঘটে। প্রথম দিকে এই ক্ষেত্রে অগ্রগতি সীমাবদ্ধ ছিল। ২০শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সূর্যচাঁদ ছাড়া অবলোহিত আলোয় গঠিত অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তুগুলিকে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে বেতার জ্যোতির্বিজ্ঞানের বেশ কয়েকটি আবিষ্কারের পরে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে, দৃশ্যমান তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিসরের বাইরে থেকেও তথ্য প্রাপ্তিসাধ্য। সেই সময়ই আধুনিক অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূচনা ঘটে।

অবলোহিত ও আলোকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রায়শই একই দূরবিনের মাধ্যমে অনুশীলন করা হয়। কারণ, দৃশ্যমান ও অবলোহিত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিসীমার মধ্যে সচরাচর একই দর্পণলেন্স কার্যকরী হয়। দুই ক্ষেত্রেই সলিড স্টেট ডিটেকটর ব্যবহৃত হয়। যদিও ক্ষেত্র অনুযায়ী সলিড স্টেট ডিটেকটরের ধরন আলাদা হয়। অনেক তরঙ্গদৈর্ঘ্যে অবলোহিত আলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের জলীয় বাষ্প কর্তৃক বিশোষিত হয়। তাই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যথাসম্ভব অধিক উচ্চতায় বায়ুমণ্ডলের উচ্চতর স্থানে অধিকাংশ অবলোহিত দূরবিনগুলি স্থাপিত। মহাকাশেও কয়েকটি অবলোহিত মানমন্দির রয়েছে। যেমন, স্পিৎজার স্পেস টেলিস্কোপ ও হার্শেল স্পেস অবজার্ভেটরি।

ইতিহাস

অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞান 
হাবলের যুগান্তকারী প্রায়-অবলোহিত নিকমোস
অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞান 
স্ট্র্যাটোস্ফেরিক অবজার্ভেটরি ফর ইনফ্রারেড অ্যাস্ট্রোনমি (সোফিয়া) হল বিমানে অবস্থিত একটি অবলোহিত দূরবিন (ছবিটি ২০০৯ সালের একটি পরীক্ষার সময় গৃহীত)।

উইলিয়াম হার্শেলকে অবলোহিত বিকিরণের আবিষ্কর্তা রূপে গণ্য করা হয়। ১৮০০ সালে তিনি একটি প্রিজমের ভিতর দিয়ে যাওয়া বিভিন্ন রঙের সূর্যালোকে একটি থার্মোমিটার রেখে পরীক্ষা চালান। তিনি লক্ষ্য করেন, সূর্যালোকের দ্বারা ঘটিত তাপমাত্রার বৃদ্ধি দৃশ্য বর্ণালির "বাইরে", লাল রংটি পেরিয়েই সর্বাধিক। অবলোহিত তরঙ্গদৈর্ঘ্যে তাপমাত্রার এই বৃদ্ধির কারণ সূর্যের কোনও বিশেষ গুণ নয়, বরং প্রিজমের বর্ণালি-সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়া। কিন্তু তাপমাত্রার বৃদ্ধি যাই হোক না কেন, হার্শেল তা থেকে অনুমান করেন যে, সূর্য থেকে কোনও অদৃশ্য বিকিরণের ঘটনা ঘটছে। তিনি এই বিকিরণের মান দেন "ক্যালোরিফিক রশ্মি" এবং দেখাতে থাকেন যে এটিও দৃশ্য আলোর মতোই প্রতিফলিত, সঞ্চারিত ও বিশোষিত হতে পারে।

অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞান 
শ্যাজন্যানটোর মালভূমির উচ্চভাগে অবস্থিত আটাকামা লার্জ মিলিমিটার অ্যারে অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুশীলনের একটি উৎকৃষ্ট স্থান।

১৮৩০-এর দশক থেকে অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তু থেকে আগত অবলোহিত বিকিরণ শনাক্ত করার চেষ্টা শুরু হয় এবং সমগ্র ১৯শ শতাব্দী ধরেই এই প্রচেষ্টা চলে। ১৮৬৫ সালে স্কটল্যান্ডের অ্যাস্ট্রোনমার রয়্যাল চার্লস পিয়াজি স্মিথ পর্বতশীর্ষ জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর ধারণাগুলি পরীক্ষা করার জন্য স্পেনের তেনেরিফে দ্বীপে অভিযানের সময় প্রথম চাঁদ থেকে আগত বিকিরণ শনাক্ত করেন। আর্নেস্ট ফক্স নিকোলস স্বাতী ও অভিজিৎ নক্ষত্র থেকে আগত অবলোহিত বিকিরণ শনাক্ত করার চেষ্টায় একটি বিশেষায়িত ক্রুকস রেডিওমিটার ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার ফলাফলগুলিকে অপ্রামাণিক মনে করেন। তা সত্ত্বেও উক্ত নক্ষত্র দু-টির ফ্লাক্সের যে অনুপাত তিনি দেখিয়েছিলেন তা বর্তমান পরিমাপের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সেই জন্য জর্জ রেইক নিকোলকে অবলোহিতে সূর্য ভিন্ন অন্য কোনও তারার প্রথম শনাক্তকারী রূপে গণ্য করেন।

২০শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রটি ধীরে ধীরে সমৃদ্ধিলাভ করতে শুরু করে। এই সময় সেথ বার্নেস নিকোলসন ও এডিসন পেটিট নিখুঁত অবলোহিত দীপ্তি পরিমাপে সক্ষম এবং কয়েকশো তারার প্রতি সংবেদনশীল থার্মোপাইল ডিটেক্টর প্রস্তুত করেন। যদিও ১৯৬০-এর দশকের আগে মূলধারার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দ্বারা জ্যোতির্বিজ্ঞানের এই ধারাটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবহেলিত ছিল। যে সকল বিজ্ঞানীরা অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুশীলন করতেন, তাঁদের অধিকাংশই প্রকৃতপক্ষে ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পদার্থবিজ্ঞানী। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে বেতার জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাফল্য এবং সেই সঙ্গে অবলোহিত বিকিরণ শনাক্তকরণ প্রযুক্তির উন্নতির ফলে অধিকতর সংখ্যায় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই ক্ষেত্রটির দিকে নজর দেন এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি উপশাখা হিসেবে অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞানের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।

এরপর অবলোহিত মহাকাশ দূরবিনের ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে ইনফ্রারেড অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল স্যাটেলাইট (আইআরএএস) সারা আকাশ জুড়ে একটি সমীক্ষা চালায়। ১৯৯৫ সালে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি নির্মাণ করে ইনফ্রারেড স্পেস অবজার্ভেটরি। ১৯৯৮ সালে এই উপগ্রহটির তরল হিলিয়ামের রসদ ফুরিয়ে যায়। যদিও তার আগেই এটি কয়েকটি প্রাক্‌তারা আবিষ্কার করে এবং আমাদের মহাবিশ্বে জলের (এমনকি শনিইউরেনাসেও) সন্ধান পায়।

২০০৩ সালের ২৫ অগস্ট নাসা স্পিৎজার স্পেস টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণ করে। আগে এটির নাম ছিল স্পেস ইনফ্রারেড টেলিস্কোপ ফেসিলিটি। ২০০৯ সালে এই টেলিস্কোপটিরও তরল হিলিয়ামের রসদ ফুরিয়ে যাওয়ায় এবং এটি দূর অবলোহিত পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এই টেলিস্কোপের মাধ্যমে একাধিক নক্ষত্র, ডাবল হেলিক্স নীহারিকা এবং বহিঃসৌরজাগতিক গ্রহগুলির আলো আবিষ্কৃত হয়। দূরবিনটি ৩.৬ ও ৪.৫ মাইক্রোমিটার ব্যান্ডে কাজ চালিয়ে যায়। সেই থেকে অন্যান্য অবলোহিত দূরবিনগুলির সাহায্যেও সৃষ্টিপ্রক্রিয়াধীন নতুন নক্ষত্র, নীহারিকা ও নাক্ষত্রিক শিশুঘর আবিষ্কৃত হয়। অবলোহিত দূরবিনগুলি আমাদের সামনে ছায়াপথের সম্পূর্ণ নতুন একটি অংশকে তুলে ধরেছে। এগুলি কোয়াসারের মতো চরম দূরবর্তী বস্তুগুলিকেও পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রেও বিশেষ সুবিধাজনক। কোয়াসারগুলি ক্রমশই পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এর ফলে যে বিপুল লালসরণ ঘটছে, তার জন্য আলোক দূরবিনের মাধ্যমে এগুলির প্রতি লক্ষ্য স্থির রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। অবলোহিত দূরবিন এগুলির অনেক বেশি তথ্য আমাদের দেয়।

২০০৮ সালের মে মাসে আন্তর্জাতিক অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একটি দল প্রমাণ করেন, আন্তঃছায়াপথ ধূলি দূরবর্তী ছায়াপথগুলি থেকে আগত আলোকে বহুলাংশে ম্লান করে দেয়। ছায়াপথগুলিকে যতটা উজ্জ্বল দেখায়, প্রকৃতপক্ষে সেগুলি তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ উজ্জ্বল। দৃশ্য আলোর অনেকটাই ধূলি কর্তৃক বিশোষিত হয় এবং তারপর অবলোহিত আলোর রূপে বিচ্ছুরিত হয়।

আধুনিক অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞান

অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞান 
টারান্টুলা নীহারিকার হাবল অবলোহিত দৃশ্য।

দৃশ্য আলোর তুলনায় সামান্য বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্য-যুক্ত অবলোহিত বিকিরণ প্রায়-অবলোহিত নামে পরিচিত। এর আচরণও অনেকটা দৃশ্য আলোর মতোই এবং একই ধরনের সলিড স্টেট যন্ত্র ব্যবহার করে এটি শনাক্ত করা যায় (এই জন্য অনেক কোয়াসার, নক্ষত্র ও ছায়াপথ আবিষ্কৃত হয়েছে)। তাই বর্ণালির প্রায়-অবলোহিত অংশটিকে প্রায়-অতিবেগুনি অংশটির মতো সাধারণত "আলোক" বর্ণালির অংশের মধ্যে গণ্য করা হয়। কেক অবজার্ভেটরিতে ব্যবহৃত আলোক দূরবিনের মতো অনেক দূরবীন দৃশ্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঙ্গে প্রায়-অবলোহিত তরঙ্গদৈর্ঘ্যেও কার্যকরী হয়। দূর-অবলোহিত সাবমিলিমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলি পর্যন্ত প্রসারিত। মনা কেয়া অবজার্ভেটরির জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল টেলিস্কোপের মতো দূরবিনগুলি দিয়ে এগুলি পর্যবেক্ষণ করা যায়।

অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞান 
শিল্পীর কল্পনায় ডব্লিউ২২৪৬-০৫২৬ ছায়াপথ। এই ছায়াপথটি ৩৫০ ট্রিলিয়ন সূর্যের আলোর মতো তীব্র অবলোহিত আলোয় উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অন্যান্য সকল প্রকার তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণের মতো অবলোহিতকেও মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার কাজে ব্যবহার করেন। বস্তুতই ২মাস ও ওয়াইজ জোতির্বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত অবলোহিত পরিমাপগুলি ইতিপূর্বে অনাবিষ্কৃত নক্ষত্রগুচ্ছগুলি আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কার্যকরী হয়েছে। এই ধরনের কয়েকটি ঘনসন্নিবদ্ধ নক্ষত্রগুচ্ছ হল এফএসআর ১৪২৪, এফএসআর ১৪৩২, ক্যামারগো ৩৯৪, ক্যামারগো ৩৯৯, ম্যাজায়েস ৩০ ও ম্যাজায়েস ৯৯। অধিকাংশ প্রধান আলোক দূরবিন এবং শুধুমাত্র অবলোহিত জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে ব্যবহৃত অল্প কয়েকটি অবলোহিত দূরবিন সহ সকল অবলোহিত দূরবিনকেই তরল নাইট্রোজেনে কনকনে ঠান্ডা করতে হয় এবং উষ্ণ বস্তুগুলির থেকে রক্ষাকবচ দ্বারা পরিকল্পিতভাবে আবৃত রাখতে হয়। কারণ, অবলোহিত তরঙ্গদৈর্ঘ্যে কয়েকশো কেলভিন কম তাপমাত্রা-যুক্ত বস্তুগুলি সেগুলির তাপ শক্তির অধিকাংশই বিচ্ছুরিত করে দেয়। অবলোহিত ডিটেক্টরগুলিকে শীতল অবস্থায় না রাখা হলে সেই ডিটেক্টরগুলি থেকেই বিকিরণ ছড়ায়। সেই বিকিরণের ফলে সৃষ্ট অনাকাঙ্খিত গোলমালে যে কোনও মহাজাগতিক উৎস থেকে আগত বিকিরণ ছোটো হয়ে যায়। বর্ণালির মধ্য-অবলোহিত ও দূর-অবলোহিত অংশে এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

উচ্চতর কৌণিক বিভাজন পাওয়ার জন্য কোনও কোনও অবলোহিত দূরবিনকে সংযুক্ত করে জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ব্যতিচারমাপ গঠন করা হয়। একটি ব্যতিচারমাপের কার্যকরী বিভাজন স্থির করা হয় দূরবিনগুলির পারস্পরিক দূরত্বের দ্বারা। এক্ষেত্রে প্রত্যেকটি দূরবিনের আকার কোনও ভূমিকা গ্রহণ করে না। অ্যাডপটিভ অপটিকসের সঙ্গে একত্রে ব্যবহৃত হলে অবলোহিত ব্যতিচারমাপগুলি উচ্চ কৌণিক বিভাজন পেতে সক্ষম হয়। এই ধরনের যন্ত্রের কয়েকটি উদাহরণ হল কেক অবজার্ভেটরিতে ব্যবহৃত দু-টি ১০ মিটারের দূরবিন এবং চারটি ৮.২ মিটারের দূরবিন, যেগুলি দিয়ে ভেরি লার্জ টেলিস্কোপ ইন্টারফেরোমিটার গঠিত।

অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞান 
অবলোহিতে বায়ুমণ্ডলীয় বাতায়ন

ভূমি-ভিত্তিক দূরবিনগুলির অবলোহিত সংবেদনশীলতার পথে প্রধান সীমাবদ্ধতা হল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল। জলীয় বাষ্প অবলোহিত বিকিরণের একটি বড়ো অংশ বিশোষিত করে এবং বায়ুমণ্ডল নিজেও অবলোকিত তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বিচ্ছুরণ ঘটায়। সেই জন্য অধিকাংশ অবলোহিত দূরবিনই নির্মিত হয় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচু কোনও অতি শুষ্ক স্থানে, যাতে সেগুলি বায়ুমণ্ডলের জলীয় বাষ্পের অনেকটা উপরে থাকতে পারে। পৃথিবীতে অবলোহিত দূরবিন স্থাপনের কয়েকটি উপযুক্ত স্থান হল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪২০৫ মিটার উচ্চতায় মনা কেয়া অবজার্ভেটরি, চিলিতে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৬৩৫ মিটার উচ্চতায় প্যারানাল অবজার্ভেটরি এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে অবস্থিত আন্টার্কটিকার ডোম সি-র মতো তুষার-মরু অঞ্চলগুলি। তবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচু স্থানগুলিতেও পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের স্বচ্ছতা সীমাবদ্ধ। একমাত্র অবলোহিত বাতায়নগুলি (সেই সব তরঙ্গদৈর্ঘ্য যেখানে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল স্বচ্ছ) এর ব্যতিক্রম। প্রধান অবলোহিত বাতায়নগুলির তালিকা নিচে দেওয়া হল:

বর্ণালি তরঙ্গদৈর্ঘ্য
(মাইক্রোমিটার)
জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক
ব্যান্ড
দূরবিন
প্রায় অবলোহিত ০.৬৫ থেকে ১.০ আর ও আই ব্যান্ড সকল প্রধান আলোক দূরবিন
প্রায় অবলোহিত ১.১ থেকে ১.৪ জে ব্যান্ড অধিকাংশ প্রধান আলোক দূরবিন এবং অবলোহিত পর্যবেক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট অধিকাংশ দূরবিন
প্রায় অবলোহিত ১.৫ থেকে ১.৮ এইচ ব্যান্ড অধিকাংশ প্রধান আলোক দূরবিন এবং অবলোহিত পর্যবেক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট অধিকাংশ দূরবিন
প্রায় অবলোহিত ২.০ থেকে ২.৪ কে ব্যান্ড অধিকাংশ প্রধান আলোক দূরবিন এবং অবলোহিত পর্যবেক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট অধিকাংশ দূরবিন
প্রায় অবলোহিত ৩.০ থেকে ৪.০ এল ব্যান্ড অবলোহিত পর্যবেক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট অধিকাংশ দূরবিন এবং কয়েকটি আলোক দূরবিন
প্রায় অবলোহিত ৪.৬ থেকে ৫.০ এম ব্যান্ড অবলোহিত পর্যবেক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট অধিকাংশ দূরবিন এবং কয়েকটি আলোক দূরবিন
মধ্য অবলোহিত ৭.৫ থেকে ১৪.৫ এন ব্যান্ড অবলোহিত পর্যবেক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট অধিকাংশ দূরবিন এবং কয়েকটি আলোক দূরবিন
মধ্য অবলোহিত ১৭ থেকে ২৫ কিউ ব্যান্ড অবলোহিত পর্যবেক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট অধিকাংশ দূরবিন এবং কয়েকটি আলোক দূরবিন
দূর অবলোহিত ২৮ থেকে ৪০ জেড ব্যান্ড অবলোহিত পর্যবেক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটি দূরবিন এবং কয়েকটি আলোক দূরবিন
দূর অবলোহিত ৩৩০ থেকে ৩৭০ অবলোহিত পর্যবেক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটি দূরবিন এবং কয়েকটি আলোক দূরবিন
দূর অবলোহিত ৪৫০ সাবমিলিমিটার সাবমিলিমিটার দূরবিন

অবলোহিত দূরবিনের আদর্শ স্থান হল মহাকাশ। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাধার ফলে ছবির অস্পষ্ট হয়ে যায় এবং বায়ুমণ্ডলীয় বিশোষণও অবলোহিত পর্যবেক্ষণের পথে বিশেষ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। তাই মহাকাশ থেকে অবলোহিত দূরবিনে উচ্চতর বিভাজনে ছবি তোলা সম্ভব হয়। বর্তমানে মহাকাশে অবস্থিত অবলোহিত দূরবিনের মধ্যে রয়েছে হার্শেল স্পেস অবজার্ভেটরি, স্পিৎজার স্পেস টেলিস্কোপ ও ওয়াইড-ফিল্ড ইনফ্রারেড সার্ভে এক্সপ্লোরার। কক্ষপথে দূরবিন স্থাপন ব্যয়বহুল বলে কয়েকটি বিমানবাহিত মানমন্দিরও চালু করা হয়েছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে স্ট্র্যাটোস্পেরিক অবজার্ভেটরি ফর ইনফ্রারেড অ্যাস্ট্রোনমি ও কুইপার এয়ারবর্ন অবজার্ভেটরি। এই মানমন্দিরগুলি সম্পূর্ণত না হলেও বায়ুমণ্ডলের সর্বাধিক উচ্চতর স্থানে দূরবিন স্থাপন করেছে, যাতে মহাকাশ থেকে আগত অবলোহিত আলো বায়ুমণ্ডলের জলীয় বাষ্প দ্বারা বিশোষিত না হতে পারে।

সোফিয়া চিত্র — অতিনবতারা অবশেষ উৎক্ষেপ থেকে গ্রহ-গঠনকারী উপাদান সৃষ্টি হচ্ছে।

অবলোহিত প্রযুক্তি

গবেষণা দূরবিনে ব্যবহৃত সবচেয়ে সুপরিচিত অবলোহিত ডিটেক্টর অ্যারেগুলির অন্যতম হল মারকিউরি ক্যাডমিয়াম টেল্যুরাইট (HgCdTe) অ্যারে। এগুলি ০.৬ থেকে ৫ মাইক্রোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মধ্যে কাজ করে। দীর্ঘতর তরঙ্গদৈর্ঘ্য পর্যবেক্ষণ বা উচ্চতর সংবেদনশীলতা লাভের জন্য অন্যান্য ডিটেক্টরেরও প্রয়োজন হয়ে থাকে। সেগুলির মধ্যে রয়েছে ন্যারো-গ্যাপ অর্ধপরিবাহী ডিটেক্টর, কম তাপমাত্রার বোলোমিটার অ্যারে বা ফোটন-গণনাকারী অতিপরিবাহিতা টানেল জাংশন অ্যারে।

অবলোহিত দূরবিনের তাপমাত্রা কম রাখার জন্য কুল্যান্ট অনেক সময় কুল্যান্ট ব্যবহার করা হয়। তবে এটি ফুরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কুল্যান্ট রসদ ফুরিয়ে গেলে মহাকাশ অভিযান শেষ হয়ে যায়, নতুবা "উষ্ণ" পর্যবেক্ষণের কাজ করতে শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ, উৎক্ষেপণের প্রায় দশ মাস পরে ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে ওয়াইড-ফিল্ড ইনফ্রারেড সার্ভে এক্সপ্লোরারের (ওয়াইজ) কুল্যান্ট নিঃশেষিত হয়ে যায়।

আরও দেখুন

  • দূর-অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞান
  • অবলোহিত বর্ণালিবিজ্ঞান
  • বৃহত্তম অবলোহিত দূরবিনগুলির তালিকা
  • রেডিও গ্যালাক্সি জু

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Tags:

অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞান ইতিহাসঅবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞান আধুনিক অবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞান অবলোহিত প্রযুক্তিঅবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞান আরও দেখুনঅবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞান তথ্যসূত্রঅবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞান বহিঃসংযোগঅবলোহিত জ্যোতির্বিজ্ঞানঅবলোহিতইংরেজি ভাষাজ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানজ্যোতির্বিজ্ঞানজ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তুটেরাহার্জ বিকিরণতরঙ্গদৈর্ঘ্যদৃশ্যমান আলোন্যানোমিটার

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

শাহ জালালদ্বিপদ নামকরণদ্য কোকা-কোলা কোম্পানিআবহাওয়াসমকামিতাসার্বজনীন পেনশনইব্রাহিম (নবী)আনারসরক্তের গ্রুপইরান২০২৪ ইসরায়েলে ইরানি হামলাবিদীপ্তা চক্রবর্তীলোকসভাও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন (১৮৬১–১৯০১)মানবজমিন (পত্রিকা)দাজ্জালবন্ধুত্বশাকিব খান অভিনীত চলচ্চিত্রের তালিকামাশাআল্লাহবাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসবাংলাদেশহোমিওপ্যাথিবাংলা উপসর্গের তালিকাবাংলাদেশের জেলারায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রইসলামের নবি ও রাসুলবাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নযোনিভালোবাসাআর্জেন্টিনাচিকিৎসকদুবাইবেগম রোকেয়াবিভক্তিভারতীয় জনতা পার্টিপলাশীর যুদ্ধগ্রীষ্মবাংলাদেশের ইতিহাসপশ্চিমবঙ্গের জেলাদারুল উলুম দেওবন্দবীর উত্তমহামাসবীর্যযিনাআল্লাহবঙ্গভঙ্গ (১৯০৫)অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাদেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরইন্দিরা গান্ধীউপজেলা পরিষদনিমজাতিসংঘ মাদক ও অপরাধবিষয়ক সংস্থাবাংলাদেশী জাতীয় পরিচয় পত্রঅপারেটিং সিস্টেমঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরহিন্দি ভাষাকোষ (জীববিজ্ঞান)প্রথম উসমানসূরা কাফিরুনবাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীনেপোলিয়ন বোনাপার্টভাষা আন্দোলন দিবসসানি লিওনমানব দেহবাংলাদেশের উপজেলার তালিকাজারুলপানিইন্সটাগ্রামছোটগল্পটাইফয়েড জ্বরপশ্চিমবঙ্গে ভারতের সাধারণ নির্বাচন, ২০২৪রামমোহন রায়তুরস্কসুকান্ত ভট্টাচার্য🡆 More