লাইসোসোম

লাইসোসোম বা লাইসোজোম (ইংরেজি:Lysosome) এক ধরনের কোষীয় অঙ্গাণু যা সাধারণত প্রাণী কোষে পাওয়া যায়।কোষের সাইটোপ্লাজমে দ্বি-স্তর বিশিষ্ট লিপো-প্রোটিন সম্বনয়ে গঠিত মেমব্রন বা ঝিল্লি দ্বারা আবৃত যে অঙ্গাণুটি নানাবিধ হাইড্রোলাইটিক এনজাইমের ধারক বা বাহক হিসেবে কাজ করে তাই লাইসোজোম বলে।এতে বিদ্যমান ভেসিকলগুলো হাইড্রোলাইটিক এনজাইম এর আধার হিসেবে কাজ করে। একে আত্মঘাতী থলিকা বা আত্মঘাতী স্কোয়াড বলা হয়। লাইসোসোম শব্দটি গ্রিক থেকে আগত। গ্রিক লাইসো শব্দের অর্থ হজমকারী এবং সোমা শব্দের অর্থ বস্তু।

লাইসোসোম

আবিষ্কার

নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান দ্য দুভ ১৯৫৫ সালে লাইসোসোম আবিষ্কার ও নামকরণ করেন।

বেলজিয়ামের ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অফ লুভ এর অধ্যাপক ক্রিশ্চিয়ান দে দুভ এবং তার দল ১৯৪৯ সালে যকৃতে ইনসুলিনের ক্রিয়া-কৌশল নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিলেন। এসময় তারা শর্করা বিপাকের (গ্লাইকোলাইসিস) ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম এবং ইনসুলিনের লক্ষ্যবস্তু গ্লুকোজ ৬-ফসফাটেজ (G6P) এনজাইমের ওপর লক্ষ্য রেখেছিলেন। তারা দেখতে পেলেন যে, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের প্রধান এনজাইম হল G6P। কিন্তু বারবার পরীক্ষার পরও তারা কোষীয় নির্যাস থেকে এনজাইমটি আলাদা করতে পারেন নি। তাই এনজাইমটি আলাদা করতে তারা আরও cell fractionation পদ্ধতি অবলম্বন করেন।

এনজাইমটি সণাক্ত করতে তারা অ্যাসিড ফসফাটেজ ব্যবহার করে একটি পদ্ধতি অবলম্বন করেন। কিন্তু এর ফলাফল ছিল অপ্রত্যাশিতভাবে খুবই কম; প্রত্যাশিত মানের ১০% এর কাছাকাছি। এরপর একদিন তারা ৫ দিন ধরে সংরক্ষিত কিছু বিশুদ্ধ কোষ ভগ্নাংশের ক্রিয়াকলাপ পরিমাপ করেন। তারা লক্ষ্য করেন, এনজাইমের ক্রিয়া বৃদ্ধি পেয়ে আবার নতুন নমুনাসমূহের মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। পরীক্ষাটি বারবার করেও একই রকম ফলাফল পাওয়া যায়। এ কারণে প্রস্তাব করা হয় যে, কোন একটি প্রতিবন্ধকতার জন্য ভিত্তিস্তরে এনজাইমের দ্রুত প্রবেশ সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে একটি নির্দিষ্ট সময় পার হবার পরই কেবল এনজাইমগুলোর ব্যাপন ঘটে। তারা এই প্রতিবন্ধকতাকে “ঝিল্লি দ্বারা পরিবেষ্টিত ও অ্যাসিড ফসফাটেজ ধারণকারী একটি থলের ন্যায় কাঠামো ”- বলে আখ্যা দেন।

ঝিল্লিযুক্ত ভগ্নাংশ, যেগুলো কোষীয় অঙ্গাণু বলে পরিচিত, সেখান থেকে একটি সম্পর্কহীন এনজাইম cell fractionation প্রক্রিয়ার সাথে পাওয়া যায়। এদের পরিপাকীয় বৈশিষ্ট্যের সাথে মিল রেখে, ১৯৫৫ সালে দে দুভ এদের নাম দেন “লাইসোসোম”।

ভারমন্ট বিশ্ববিদ্যালয় এর অ্যালেক্স বি. নভিকফ সেই বছরই দে দুভ এর গবেষণাগার পরিদর্শনে যান এবং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে সফলভাবে লাইসোসোম অঙ্গাণুটির প্রথম দৃশ্যমান প্রমাণ সংগ্রহ করেন। এছাড়া অ্যাসিড ফসফাটেজের জন্য একটি রঞ্জক পদ্ধতি ব্যবহার করে, দে দুভ ও নভিকফ লাইসোসোমের পানিগ্রাহী এনজাইমের অবস্থান নিশ্চিত করেন।

অ্যালেক্স বি. নভিকফ ১৯৬০ সালে এদের আণুবীক্ষণিক গঠন বর্ণনা করেন। ১৯৬০ সালে Matile এটি নিউরোস্পোরা ছত্রাকে পর্যবেক্ষণ করেন।

অবস্থান

লোহিত রক্তকণিকা ব্যতীত প্রায় সব প্রাণীকোষেই লাইসোসোম থাকে। শ্বেত রক্তকণিকায় অধিক পরিমাণে লাইসোসোম পাওয়া যায়। এছাড়া যকৃত কোষ, বৃক্ক কোষ ও অন্ত্রআবরণী কোষে লাইসোসোম বেশি থাকে।

উৎপত্তি

লাইসোসোম 

এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম থেকে এদের উৎপত্তি এবং গলজি বডি কর্তৃক প্যাকেজকৃত।

ভৌত গঠন

লাইসোসোম দ্বি-স্তর বিশিষ্ট লিপোপ্রোটিন আবরণী দ্বারা আবদ্ধ থাকে। ভ্যাকুওল ঘন তরলপূর্ণ ও এসিডিক হয়। লাইসোসোম সাধারণত বৃত্তকার। এর ব্যাস সাধারণত ০.২ থেকে ০.৮ মাইক্রোমিলি এর মধ্যে হয়। তবে এদের আকার ছোট-বড় হতে পারে। যেমন: বৃক্ক কোষের লাইসোসোম অপেক্ষাকৃত বড় হয়। এমন কি বড় লাইসোসোম এর আকার ছোটগুলোর চেয়ে ১০ গুণেরও বেশি বড় হতে পারে।

রাসায়নিক গঠন

লাইসোসোমে ৬০ টিরও বেশি এনজাইম এবং ঝিল্লিতে ৫০টিরও বেশি ধরনের মেমব্রেন প্রোটিন পাওয়া গেছে। এ এনজাইমগুলো অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম এ সংশ্লেষিত হয়। প্রধান এনজাইমগুলো হল:

  • DNAase
  • RNAase
  • লাইসোজাইম
  • এস্টারেজ
  • স্যাকারেজ
  • এসিড লাইপেজ
  • অ্যারাইল সালফোটেজ
  • ফসফোলাইপেজ
  • ফসফোটেজ এস্টারেজ
  • গ্যালাকটোসাইডেজ
  • গ্লুকোসাইডেজ
  • ডেক্সট্রোনেজ

ইত্যাদি

লাইসোসোমের অভ্যন্তর এসিডিক। এর পি.এইচ প্রায় ৪.৫ থেকে ৫ এর মধ্যে যা সাইটোসল (সাইটোপ্লাজম এর ম্যাট্রিক্স) এর পি.এইচ (৭.২) এর চেয়ে কম।

লাইসোসোম 
এসিডিক হওয়ার জন্য লাইসোসোমের প্রোটন সংগ্রহ

প্রকারভেদ

১.প্রাথমিক লাইসোসোম: প্রাথমিক সদ্য গঠিত এনজাইম পূর্ণ ক্ষুদ্র থলি বিশেষ।

২.অটোফ্যাগোসোম বা সাইটোলাইসোসোম: কোষের অপ্রয়োজনীয় অবাঞ্ছিত বা ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মসৃণ পর্দা দ্বারা আবৃত হয়ে পৃথক অংশ গঠন করে। এর সাথে এক বা একাধিক প্রাথমিক লাইসোসোম মিলিত হয়ে অটোফ্যাগোসোম গঠন করে। এতে মাইটোকন্ড্রিয়া, রাইবোসোম, পারঅক্সিসোম, গ্লাইকোজেন দানা ইত্যাদির স্বপাচন ঘটে।

৩.হেটারোফ্যাগোসোম বা গৌণ লাইসোসোম: ফ্যাগোসাইটোসিস বা পিনোসাইটোসিসের ফলে উৎপন্ন ফ্যাগোসোমের সাথে একাধিক প্রাথমিক লাইসোসোম মিলিত হয়ে হেটারোফ্যাগোসোম গঠন করে।

৪.রেসিডুয়াল বডি বা টেলো লাইসোসোম: অপাচিত বস্তু যুক্ত গৌণ লাইসোসোমকে টেলো লাইসোসোম বলে।

৫, উদ্ভিদ কোষে সম্প্রতি একস্তর বিশিষ্ট Oleosome নামে লাইসোসোম পাওয়া গেছে ।

কাজ

  • ফ্যাগোসাইটোসিস ও পিনোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় জীবাণু ধ্বংস করে।লাইসোসোম 
  • অন্তঃকোষীয় পরিপাক এ সহায়তা করে।
  • প্রোটিনকে ডাইপেপটাইড ও কার্বোহাইড্রেটকে মনোস্যাকারাইডে পরিণত করে।
  • কোষে খাদ্যাভাব দেখা দিলে লাইসোসোমের এনজাইমগুলো কোষের অঙ্গাণুগুলো ধ্বংস করে দেয়। একে স্বগ্রাস বা অটোফ্যাগি বলে। এভাবে সমগ্র কোষ পরিপাক হয়ে গেলে তাকে অটোলাইসিস বলে।
  • লাইসোসোমের এনজাইমগুলো কোষের মধ্যে গৃহীত খাদ্যবস্তু, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি জারিত করলে তাকে হেটারোফ্যাগি বলে।
  • শুক্রাণুর দ্বারা ডিম্বাণুর আবরণ বিগলনে লাইসোসোম ভূমিকা রাখে।
  • কোষ বিভাজনকালে এরা কোষীয় ও নিউক্লিও আবরণী ভাঙতে সহায়তা করে। এরা কোষে কেরাটিন প্রস্তুত করে।

লাইসোসোম কোষের ক্ষতি করে না কেন?

  1. লাইসোসোমের ঝিল্লি কোষের বাকি অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে।
  2. লাইসোসোমের অভ্যন্তর এসিডিক। এর পি.এইচ প্রায় ৪.৫ থেকে ৫ এর মধ্যে এনজাইমগুলো পি.এইচ সেনসেটিভ এবং শুধু এসিডিয় পরিবেশে কাজ করে। সাইটোসল (সাইটোপ্লাজম এর ম্যাট্রিক্স) এর পি.এইচ (৭.২) প্রশম বলে কোষের অ্যালকালাইন পরিবেশে এরা কাজ করে না।

রোগ

  1. লাইসোসোমে এনজাইমের ঘাটতির ফলে কিছু পদার্থ (যেমন: গ্লাইকোজেন, গ্লাইকোলিপিড) লাইসোসোমে সঞ্চিত যা ২০ প্রকারের কনিজেনিট্যাল রোগ সৃষ্টি করে। এদের লাইসোসোমাল স্টোরেজ ডিজিস (Lysosomal storage disease) বলে। এর সরাসরি কোনো চিকিৎসা নেই।
    লাইসোসোম 
    Lysomal Storage Diseases
  2. ব্লাড ক্যান্সার এর ক্ষেত্রে নিউক্লিয়েজ এনজাইম নিউক্লিয়াসে জিনগত পরিবর্তন ঘটায়।

তথ্যসূত্র

Tags:

লাইসোসোম আবিষ্কারলাইসোসোম অবস্থানলাইসোসোম উৎপত্তিলাইসোসোম ভৌত গঠনলাইসোসোম রাসায়নিক গঠনলাইসোসোম প্রকারভেদলাইসোসোম কাজলাইসোসোম তথ্যসূত্রলাইসোসোমঅঙ্গাণুইংরেজিএনজাইমকোষগ্রিক ভাষাভেসিকল

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

বাল্যবিবাহক্লিওপেট্রামিশনারি আসনহস্তমৈথুনচিরস্থায়ী বন্দোবস্তছোলাহোলিকা দহনজাতিসংঘের মহাসচিবযোনিরঙের তালিকাভালোবাসাব্রিটিশ রাজের ইতিহাসসেন্ট মার্টিন দ্বীপআসমানী কিতাবতুরস্কতিতুমীরসালমান এফ রহমানবাংলাদেশের ব্যাংকসমূহের তালিকাব্রাজিলবাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষকজিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুকবেদে জনগোষ্ঠীঐশ্বর্যা রাইগরুবিভিন্ন ধর্ম ও বিশ্বাসের তালিকাজানাজার নামাজরাধাবাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রআসরের নামাজপলাশীর যুদ্ধসানি লিওনমুঘল সাম্রাজ্যফরাসি বিপ্লবের কারণনিরাপদ যৌনতাবিমল করবিপাশা বসুমদিনাতথ্যপলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমরমজান (মাস)মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনবাটাসমকামিতাসজনেবৌদ্ধধর্মের ইতিহাসযুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতাবিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমচাঁদপলাশগোপাল ভাঁড়স্বত্ববিলোপ নীতিবরিশাল বিভাগ২০২৩–২৪ ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগচর্যাপদকানাডামিশরশীলা আহমেদটেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাবুর্জ খলিফাপিনাকী ভট্টাচার্যওয়েব ব্রাউজারআকিজ গ্রুপবাংলা ব্যঞ্জনবর্ণমহাসাগরছিয়াত্তরের মন্বন্তর২০২৬ ফিফা বিশ্বকাপস্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রমতিউর রহমান (বীরশ্রেষ্ঠ)আহল-ই-হাদীসনেপোলিয়ন বোনাপার্টডেঙ্গু জ্বরমশামহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলদোয়ালালবাগের কেল্লাঢাকা বিভাগবাঙালি সংস্কৃতিওয়েব ধারাবাহিক🡆 More