পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস বলতে মূলত খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দ থেকে খ্রিস্টীয় বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত, বঙ্গের প্রাচীন, মধ্যযুগীয় ও প্রাক-আধুনিক কালের ইতিহাসকেই বোঝানো হয়। পশ্চিমবঙ্গে খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৪২ হাজার বছরপূর্বের মানববসতির প্রমান পাওয়া যায়। উক্ত সময়কালের মানববসতির উপস্থিতি পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার পাহাড়ের গুহায় পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের জ্ঞাত ইতিহাসের সূচনা ২,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে দামোদর উপত্যকা ও বিদ্যাধরী নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে মানব সভ্যতার উন্মেষ ও প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশে ১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে বঙ্গ রাজ্যের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়, যেটি উত্তর ভারতের বৈদিক সভ্যতার সমসাময়িক ছিল।
মহাজনপদগুলির মধ্যে মগধ ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শক্তিশালী হয়ে ওঠে, এই সময়ে মগধের নন্দ রাজ্যবংশের শাসকগণ পশ্চিমবঙ্গের ভূখণ্ডটি নিজেদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। নন্দ সাম্রাজ্যের পরবর্তী মগধ কেন্দ্রিক সকল সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। পশ্চিমবঙ্গের তাম্রলিপ্ত মগধ কেন্দ্রিক মৌর্য সাম্রাজ্যের মূল সমুদ্র বন্দর ছিল। মগধ কেন্দ্রিক সাম্রাজ্যসমূহের অবসানের পরে উত্তর ভারতে গড়ে ওঠা গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ ভূখণ্ড শাসিত হয়েছিল।
পশ্চিমবঙ্গ তথ্য বাংলায় ৬৯০ খ্রিস্টাব্দে গৌড় রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায়ই গৌড়কে বাংলায় প্রথম সুপ্রতিষ্ঠিত স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্তা হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এর পরে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে যথাক্রমে পাল ও সেন সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। এই সাম্রাজ্য দুটি মূলত বাংলা কেন্দ্রিক ছিল।
ইসলামিক বিজয় ১৩তম শতাব্দীর প্রথম দিকে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ সহ বাংলা গজনবী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। পশ্চিমবঙ্গে ১৩তম শতাব্দীতে ১৪তম শতাব্দীতে দিল্লি সালতানাত ও ১৪তম শতাব্দী থেকে ১৬তম শতাব্দীতে বাংলা সালতানাতের অধিনে শাসিত হয়েছিল। ১৬তম শতাব্দীতে, বাংলা সালতানাতের পতনের পরে পশ্চিমবঙ্গ মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ স্বাধীন নবাব বাংলার রাজধানী ছিল। বাংলার নবাবদের থেকে পশ্চিমবঙ্গ সহ বাংলার শাসনভারের নিয়ন্ত্রণ ইংরেজরা ১৭৬৫ সালে নিজেদের নিকট নিয়েছিল। ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে বিভক্ত হয়; পশ্চিমবঙ্গ ভারত অধিরাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় ও ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
এই অঞ্চলে ৪২,০০০ হাজার বছরের প্রাচীন মানববসতির উপস্থিতির প্রমাণ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, মাইক্রোলিথিক সময়কালের অন্তর্গত। এই মানব বসতি অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে কানা ও মহাদেববেরায় আবিষ্কৃত হয়েছে। কানা থেকে প্রাপ্ত মাইক্রোলিথিক সরঞ্জামগুলি ৪২,০০০ বছরের পুরাতন এবং মহাদেবেরায় থেকে প্রাপ্ত মাইক্রোলিথিক সরঞ্জামগুলি ৩৪,০০০ থেকে ২৫,০০০ বছরের পুরাতন।
ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরবর্তী হাটপাড়ায় প্রায় ১৫,০০০-২০,০০০ বছরের প্রাচীন মানব বসতির প্রমাণ মিলেছে। এখানে পাথরের তৈরি প্রায় ২০০ টি ছোট অস্ত্রের সন্ধান মিলেছে। এছাড়াও এখানে শস্য জাতীয় দানা ও মাছের হাড় পাওয়া গিয়েছে। প্রত্ন বিশেষজ্ঞদের মতে, হাটপাড়ার প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা গণকর থেকে মহীপাল পর্যন্ত ভাগীরথীর পাড় বরাবর বিস্তৃত ছিল। এই এলাকার মানুষের খাদ্যাভাসের মধ্যে মাছের ব্যাপক ব্যবহার ছিল, এবং সেগুলি যে পুড়িয়ে খাওয়া হত তাও বোঝা যায় আবিষ্কৃত মাছের কাঁটাগুলির তামাটে রং দেখে।
পাঁচটি প্রধান নদী উপত্যকায় নব্য প্রস্তর সংস্কৃতি সংঘটিত হয়েছিল, যেগুলি হল অজয়-ময়ূরাক্ষী নদী উপত্যকা, দারাকেশ্বর—দামোদর নদ উপত্যকা, গন্ধেশ্বরী নদী উপত্যকা, তারাফেনী নদী উপত্যকা ও সুবর্ণরেখা নদী উপত্যকায় অবস্থিত। এছাড়াও কালিম্পঙে একটি নব্য প্রস্তর সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। প্রত্নক্ষেত্রগুলি থেকে উদ্ধার করা প্রধান যন্ত্রগুলির মধ্যে রয়েছে সেল্ট (অক্ষ ও অ্যাডজেস উভয়), ওয়েজ, চিসেল, ছিদ্রযুক্ত সরঞ্জাম ও পাউন্ডার, মাইক্রোলিথ এবং হাড়ের সরঞ্জাম।
তাম্র যুগ মূলত তাম্র বস্তুর আবির্ভাবের সঙ্গে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে শুরু হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের তাম্র বা চ্যালকোলিথিক সংস্কৃতি পরবর্তী হরপ্পান (হরপ্পান ৫) ও বৈদিক সভ্যতার সমসাময়িক।
অজয়-দামোদর উপত্যকায় একটি তাম্র সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছিল। আনুমানিক ১৫০০ – ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে তাম্র সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল। এই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত শহরগুলি ছিল আধুনিক বর্ধমান বিভাগের পাণ্ডু রাজার ঢিবি, মঙ্গলকোট ও ভরতপুর এবং আধুনিক মেদিনীপুর বিভাগের ডিহর। অজয় নদের দক্ষিণ তীরের তাম্রযুগীয় একটি প্রত্নক্ষেত্র হল পাণ্ডু রাজার ঢিবি, যেখানে সর্পিল চুড়ি, আংটি ও মাছ ধরার হুক পাওয়া গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে, কালো ও লাল মৃৎপাত্র সংস্কৃতি হল আনুমানিক ৭০০ – ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে মধ্য ও পূর্ব গঙ্গা সমভূমিতে বিকশিত একটি তাম্রযুগ ও প্রারম্ভিক লৌহ যুগীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্কৃতি, পরবর্তীতে এটি উত্তরাঞ্চলীয় কালো পালিশ মৃৎপাত্র সংস্কৃতি দ্বারা অনুসৃত হয়েছিল।
লৌহ যুগে মুদ্রা, ধাতব অস্ত্র, কৃষি ও সেচের বিকাশ ঘটেছিল। পশ্চিমবঙ্গের বহু প্রত্নস্থল তাম্র যুগ থেকে লৌহ যুগের সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম-দক্ষিণপশ্চিম অংশে লৌহ যুগের প্রত্নস্থলগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের লৌহ যুগে যে সংস্কৃতিটি গড়ে অথেছিল উঠেছিল সেটি হল নর্দার্ন ব্ল্যাক পলিশড ওয়্যার সংস্কৃতি। আধুনিক পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম অংশ (বাহিরি), মেদিনীপুরের পশ্চিম অংশ (কাঁকরাঝোর, ধুলিয়াপুর), পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়া (তুলসীপুর, কুমারডাঙ্গা) অঞ্চলগুলি লোহার প্রধান উৎপাদক ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করেছিল।
ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারত অনুসারে, বঙ্গ রাজ্যের পশ্চিমাংশ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত ছিল। বঙ্গকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপনিবেশ সহ একটি থ্যালাসোক্রেসি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার ইতিহাস অনুসারে, শ্রীলঙ্কার প্রথম রাজা ছিলেন রাজকুমার বিজয়, যিনি লঙ্কা দ্বীপ জয় করতে ভারত থেকে যাত্রাকারী একটি নৌবহরের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
প্রাচীন বাংলার বেশ কয়েকটি ভূ-রাজনৈতিক বিভাজন পরিলক্ষিত হয়, যার মধ্যে কয়েকটি আধুনিক পশ্চিমবঙ্গের ভূখণ্ডে অবস্থিত ছিল। ভূ-রাজনৈতিক বিভাগসমূহের ক্ষেত্র-অঞ্চল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রসারিত ও হ্রাস পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত ভূ-রাজনৈতিক বিভাগগুলি হল পুণ্ড্রবর্ধন, বঙ্গ, সুহ্ম ও রাঢ়। পুণ্ড্রবর্ধনের পশ্চিম অংশ আধুনিক মালদা বিভাগের অন্তর্গত ছিল এবং বঙ্গের পশ্চিম অংশটি আধুনিক পশ্চিমবঙ্গের প্রেসিডেন্সি বিভাগ এবং মেদিনীপুর বিভাগের অন্তর্গত ছিল। সমগ্র সুহ্ম আধুনিক বর্ধমান বিভাগ, মেদিনীপুর বিভাগ এবং প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্গত ছিল এবং রাঢ় আধুনিক পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিভাগের সম্পূর্ণ বীরভূম ও বর্ধমান জেলা, বাঁকুড়া জেলার পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব ভাগ ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমভাগ রাঢ়ের অন্তর্গত ছিল।
বাংলার লৌহ যুগে পশ্চিমবঙ্গ মগধকেন্দ্রিক সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। তব, সমসাময়িক গ্রীক বিবরণগুলি বাংলার গঙ্গাঋদ্ধিকে আলাদাভাবে উল্লেখ করে, যা আধুনিক পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে জুড়ে গড়ে উঠেছিল, যদিও ইঙ্গিত করে যে মগধ ও গঙ্গাঋদ্ধি একই সার্বভৌম দ্বারা শাসিত হয়েছিল। ইতিহাসবিদ হেম চন্দ্র রায়চৌধুরী তত্ত্ব করেন যে নন্দরা বর্তমান বিহার ও উত্তর প্রদেশে তাদের মূল অঞ্চলগুলির উপর কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করেছিল, কিন্তু তাদের সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী অংশগুলিতে যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসনের অনুমতি দিয়েছিল।
কলকাতা থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে পুনর্ভবার তীরে অবস্থিত বাণগড়ে মৌর্য যুগ থেকে পাল যুগ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের আদি ইতিহাসের প্রমাণ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের লৌহ যুগের নিদর্শন এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে, যা প্রাক-মৌর্য, মৌর্য ও শুঙ্গ যুগের অন্তর্ভুক্ত। পশ্চিমবঙ্গ প্রতিটি মগধ সাম্রাজ্যকে সমুদ্রপথ সরবরাহ করেছিল। সাম্রাজ্যগুলি তাম্রলিপ্ত সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমুদ্র বাণিজ্য পরিচালনা করত, যা আধুনিক দিনের তমলুক শহরের কাছে অবস্থিত ছিল। ডারিয়ানের মতে, মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে তাম্রলিপ্তি সমগ্র অববাহিকার প্রধান বন্দর হিসেবে সর্বজনীন জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এই বন্দরে সিলন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পশ্চিম ভারত ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে জাহাজ আসত। বিদ্যাধরী নদীর তীরে চন্দ্রকেতুগড় নামে আরেকটি বন্দর শহর অবস্থিত ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যে, এখানে মৌর্য ও শুঙ্গ যুগের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। খননকার্যে পোড়ামাটির বা টেরাকোটার মূর্তি ও রথ পাওয়া গিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের ভূমিখণ্ডেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নাটকীয় উথান গতেছিল ঘটেছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ফোর্ট উইলিয়ামের (কলকাতা) প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করতে শুরু করলে, ফরাসীদের উৎসাহে নবাব সিরাজউদ্দৌলা আক্রমণ করেন। রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে, ব্রিটিশ সৈন্যরা ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে চন্দননগর দখল করে এবং ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুন পলাশীর যুদ্ধে নবাবকে গুরুতরভাবে পরাজিত করে। ব্রিটিশরা বাংলার জন্য তাদের পছন্দের নবাবকে শাসনভার প্রদান করে এবং দক্ষিণে তাদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করে। ফরাসিরা ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদী তীরবর্তী চন্দননগরের শাসনভার লাভ করেছিল।
মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে জোট করে বাঙালিরা তাদের অঞ্চল পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বক্সারের যুদ্ধে (১৭৬৫) আবার পরাজিত হয়েছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির অংশ হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে প্রদেশ থেকে কর আদায়ের অধিকার দেওয়া হয়। এইভাবে, কোম্পানিটি সাম্রাজ্যের কর সংগ্রাহক হয়ে ওঠে, যখন স্থানীয় মুঘল সম্রাট নিযুক্ত নবাবরা প্রদেশ শাসন করতে থাকে। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় শাসনের এই ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয় এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রদেশের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সময় ভারতীয় সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের কেন্দ্র দিল্লি থেকে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়।
শিল্প বিপ্লবের প্রাথমিক পর্যায়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক বাংলা থেকে সংগ্রহ করা মূলধন গ্রেট ব্রিটেনে বস্ত্র তৈরির মতো বিভিন্ন শিল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছিল। কোম্পানির নীতি কোম্পানির শাসনামলে বাংলায় বস্ত্রশিল্পের অ-উদ্যোগীকরণের দিকে পরিচালিত করে। অ-উদ্যোগীকরণের ফলে বাংলার বস্ত্রশিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ — বাংলার অন্যতম প্রধান বস্ত্র শিল্প কেন্দ্র — অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল হয়ে পরে, যে শহরকে রবার্ট ক্লাইভ তৎকালীন লন্ডনের থেকে বিত্তশালী শহর হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।
কোম্পানি শাসনের সময়, ১৭৭০ সালে একটি ধ্বংসাত্মক দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, যা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। একটি দুর্ভিক্ষ লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করেছিল। এই দুর্ভিক্ষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার রাজ্য। বৃহত্তর বাংলার অঞ্চলগুলির মধ্যে মধ্য ও উত্তরবঙ্গে দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছিল; এই অঞ্চলগুলি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মালদা ও জলপাইগুড়ি বিভাগের অংশ। দুর্ভিক্ষ এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে বিধ্বস্ত করেছিল।
ভারতের দ্বিতীয় ও বাংলার প্রথম রেলপথ পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া ও হুগলী শহরের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছিল। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া ও হুগলী রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যে রেল পরিষেবা চালু হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের ও বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত।
১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ভারতীয় সৈন্যদের একটি বিদ্রোহ, যা দ্রুত উত্তর ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পরেছিল। এই বিদ্রোহ সূচনা বা স্ফুলিঙ্গ পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেই সংগঠিত হয়েছিল ব্যারাকপুরের সেনা ছাউনিতে মঙ্গল পাণ্ডের বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা মহাবিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল, এবং ব্রিটিশ শাসকগণ পশ্চিমবঙ্গ সহ বাংলার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে ও কোম্পানির শাসন প্রতিস্থাপন করে। ফোর্ট উইলিয়াম ভারতে ব্রিটিশ-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলির রাজধানী হিসাবে অবিরত ছিল। বাংলার গভর্নর একই সাথে বহু বছর ধরে ভারতের গভর্নর-জেনারেল ছিলেন। ভিক্টোরিয়া ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে "ভারতের সম্রাজ্ঞী" উপাধি গ্রহণ করেন, সেই সময়ে ব্রিটিশরা কলকাতাকে — বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী — ব্রিটিশ রাজের রাজধানী ঘোষণা করে। কলকাতার পৌরসভায় ঔপনিবেশিক রাজধানী গড়ে ওঠে, যা কয়েক দশক ধরে ভারতের রাজধানী হিসেবে কাজ করে। পশ্চিমবঙ্গ ছিল ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিল্প কেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা শহর ব্রিটিশ শাসন আমলে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান শিল্প ও বানিজ্য কেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ১৯তম শতকে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে সহ বেশ কয়েকটি রেল কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ব্রিটিশ বাংলার বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর ছিল পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা বন্দর, যা পূর্ববর্তী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্যতম ব্যস্ততম বন্দর ছিল; ব্রিটিশ বার্মার সঙ্গে ব্যাপক সংখ্যায় জাহাজ চলাচল চালু ছিল। কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাঙালি জনসংখ্যার অধিকাংশই কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল এবং বাঙালি সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতারা ভারতীয় রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যকলাপে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল।
১৯৪৭ সালের ২০ জুন, বঙ্গীয় আইন পরিষদের বঙ্গ প্রদেশের ভবিষ্যত নির্ধারণের জন্য মিলিত হয় যেখানে ভারত বা পাকিস্তানের মধ্যে সংযুক্ত বাংলা বা পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গে বিভক্ত যথাক্রমে বাঙালি মুসলমান এবং বাঙালি হিন্দুদের আবাসস্থল হিসাবে গঠনের প্রস্তাব হয়। প্রাথমিক যৌথ অধিবেশনে, পরিষদ ১২০-৯০ দ্বারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে যদি বঙ্গ পাকিস্তানের নতুন গণপরিষদে যোগ দেয় তবে এটি ঐক্যবদ্ধ বা অবিভক্ত থাকবে। পরে, পশ্চিমবঙ্গের আইনপ্রণেতাদের একটি পৃথক বৈঠকে ৫৮-২১ ভোটে সিদ্ধান্ত নেয় যে প্রদেশটি বিভক্ত করা উচিত এবং পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের বিদ্যমান গণপরিষদে যোগদান করা উচিত। পূর্ব বাংলার আইনপ্রণেতাদের আরেকটি পৃথক সভায় ১০৬-৩৫ ভোটে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে প্রদেশটি বিভক্ত করা উচিত নয় এবং ১০৭-৩৪ সালের মধ্যে দেশভাগের ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানে যোগ দেবে। ভারতীয় জনতা পার্টি ও পশ্চিমবঙ্গের রাজভবন এই ২০ জুন তারিখকে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠা দিবস অর্থাৎ "পশ্চিমবঙ্গ দিবস" হিসাবে পালন করে।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.