আনা আখ্মাতোভা (Anna Akhmatova) (১৮৮৯-১৯৬৬) একজন খ্যাতনামা রুশ কবি। তার আসল নাম আনা আন্দ্রেইয়েভ্না গোরেংকো। প্রায় অর্ধ শতাব্দী সময় জুড়ে তিনি রুশ কবিতার সেইন্ট পিটার্স্বার্গ ধারার প্রাণকেন্দ্র ছিলেন। তিনি স্বল্প দৈর্ঘ্যের কবিতা থেকে শুরু করে দীর্ঘ কবিতাচক্র পর্যন্ত লিখেছেন। তার কবিতার বিষয়বস্তু বিবিধ - সময়, স্মৃতি, সৃজনশীল নারীদের পরিণতি, এবং স্টালিনের ত্রাসের রাজত্বের মধ্যে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। তিনি ১৯৬৫ সালে নোবেল পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত হন এবং পরের বছর পুরস্কারের জন্য দ্বিতীয় সর্বাধিক (তিনটি) মনোনয়ন পান।
তিনি ওডেসার নিকটে বলশোই ফন্টান-এ জন্মগ্রহণ করেন। কৈশোরে তার বাবা-মার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আনা কিয়েভ ও সেইন্ট পিটার্সবার্গে পড়ালেখা করেন। তার প্রিয় কবি রাসিন্, পুশকিন ও বারাতিন্স্কির লেখা পড়ে উদ্বুদ্ধ হন এবং মাত্র ১১ বছর বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেন। তবে তার বাবা নিজ নাম ব্যবহার করতে রাজী না হওয়ায় তিনি তার এক তাতার পূর্বপুরুষের নাম বেছে নেন - আখ্মাতোভা।
১৯১০ সালে তিনি নবীন কবি নিকোলাই গুমিল্ইয়োভ-কে বিয়ে করেন। কিন্তু গুমিল্ইয়োভ স্ত্রীকে তেমন সময় দিতেন না। বরঞ্চ তিনি চলে যেতেন দেশ বিদেশ সফরে। এ ছাড়াও তিনি আখমাতোভার প্রতিভাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না। কিন্তু আলেক্সান্দ্র ব্লক মতামত দেন যে তিনি আখমাতোভার কবিতাকেই বেশি পছন্দ করেন! ১৯১২ সালে নিকোলাই ও আনার ছেলে লেভ্-এর জন্ম হয়।
তার প্রথম কবিতার বই সন্ধ্যা প্রকাশিত হয় ১৯১২ সালে। ছোট পরিসরের হলেও কবিতাগুলো মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে তীক্ষ্ণ, অনেকটা ইংরেজ কবি টমাস হার্ডির কবিতার মতো। সন্ধ্যা গ্রন্থটি সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করে। বছর দুই পরে যখন তার দ্বিতীয় বই তসবীহ প্রকাশিত হয়, ততদিনে হাজার হাজার মহিলা কবি 'আখমাতোভার মতো' কবিতা লেখা শুরু করে দিয়েছেন। নারী-পুরুষের প্রেমের সবচেয়ে দোদুল্যমান, মর্মভেদী মুহুর্তগুলোকে নিয়ে লেখা তার এ সময়ের কবিতা ব্যাপক ভাবে অনুকরণ করা হয়। আখমাতোভা উক্তি করেন 'আমাদের দেশের নারীদের আমি বলতে শিখিয়েছি কিন্তু তাদের চুপ করা শিখাতে পারিনি।'
রুশ কবিতার এই অধ্যায়টিকে রৌপ্য যুগ আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে। আখমাতোভা তার আভিজাত্য ও শৈল্পিক সততার জন্যে 'নেভা-র রানী' এবং 'রৌপ্য যুগের মধ্যমণি' নামে অভিহিত হন।
১৯২১ সালে সোভিয়েত বিরোধী কার্যকলাপের দায়ে নিকোলাই গুমিল্ইয়োভ-কে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। কিছুকাল পরে আনা পুনরায় বিয়ে করেন। প্রথমে আসিরীয় বিশেষজ্ঞ ভ্লাদিমির শিলেইকো-কে, তারপর আরেক গবেষক নিকোলাই পুনিন-কে। পুনিনও স্টালিনের ক্যাম্পে প্রাণ হারান। বিখ্যাত সাহিত্যিক বরিস পাস্তের্নাক বিবাহিত হলেও কয়েকবার আনাকে প্রস্তাব দেন, কিন্তু আনা প্রতিবারই তাকে প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯২৫ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত স্টালিন সরকার আখ্মাতোভাকে কার্যত স্তব্ধ করে রাখে। এ সময়ে তিনি নিজের কবিতা প্রকাশ করতে পারতেন না। বিদেশী কবিতা অনুবাদ করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন। পুশকিনের উপর কিছু অসামান্য রচনাও লিখেন গবেষণাধর্মী সাহিত্য সাময়িকীর জন্যে। তার সমস্ত বন্ধুরা হয় স্টালিন কর্তৃক নির্যাতিত হন নয়তো বিদেশে পাড়ি জমান।
১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামার মধ্যে আখমাতোভার একটি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশনার অনুমতি পায়। লেনিনগ্রাদের লোমহর্ষক অবরোধ (Siege of Leningrad) তিনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। তার দেশাত্মবোধক কবিতা দৈনিক প্রাভ্দা-র প্রথম পাতায় ছাপা হয়। ১৯৪৪ সালে তিনি যখন মধ্য এশিয়া থেকে আবার লেনিনগ্রাদে ফিরে আসেন, তার মনে হয় যে তার প্রিয় শহর ভূতুড়ে রূপ ধারণ করেছে।
১৯৪৬ সালে দার্শনিক আইসেইয়াহ বার্লিন তার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। স্টালিনের সহোচর জ্দানোভ এ কথা জানতে পেরে আখমাতোভাকে গালি দেন 'আধা বেশ্যা, আধা সন্ন্যাসিনী' বলে। তার সমস্ত কবিতার উপর নিষোধাজ্ঞা বলবত করা হয়। পুত্র লেভ্ গুলাগ ক্যাম্পে কারাদন্ড ভোগ করেন। আখমাতোভা ছেলের মুক্তির জন্যে স্টালিনের উদ্দেশ্যে কিছু স্তুতিমূলক কবিতা পর্যন্ত লিখেন। তার পরেও স্টালিনের সাথে তার সম্পর্ক সংকটময় থেকেই যায়।
১৯৫৩ সালে স্বৈরাচারী স্টালিন মারা যান, এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কিছুটা লাঘব হয়। রুশ কবিদের মধ্যে আখমাতোভার শ্রেষ্ঠত্ব কমিউনিস্ট পার্টির হর্তা-কর্তারাও মেনে নিতে বাধ্য হন। কোমারোভো-তে অবস্থিত তার বাড়িতে জোসেফ ব্রডস্কি সহ নতুন প্রজন্মের অন্যান্য কবিদের তখন নিয়মিত আনাগোনা। সেইন্ট পিটার্স্বার্গের কবিতার ঐতিহ্যকে এরাই বাঁচিয়ে রাখেন। প্রখ্যাত মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্ট-ও ১৯৬২ সালে তাকে দেখতে কোমারোভো-তে যান।
১৯৬৫ সালে রুশ সরকার আখমাতোভা-কে বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি দেয়। তিনি ইতালির সিসিলি দ্বীপ ও ইংল্যান্ড সফর করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সন্মানসূচক ডক্টোরেট খেতাবে ভূষিত করে। এ সময় তার ভ্রমনসঙ্গিনী ছিলেন লিডিয়া চুকোভ্স্কায়া যিনি আজীবন আনার বন্ধু এবং সেক্রেটারী ছিলেন।
১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে আখমাতোভা মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর সাহিত্যজগৎে তার নামযশ ক্রমশই বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৯ সালে তার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তার সুবিখ্যাত কবিতা রিকুইয়েম (Requiem) অবশেষে রাশিয়াতে মুক্তি লাভ করে। রিকুইয়েম বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বিয়োগাত্মক কবিতাগুলোর অন্যতম বলে পরিগণিত।
বিশের দশক থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত আখমাতোভা মস্কোর যে বাড়িতে বসবাস করতেন, বর্তমানে সেখানে তার স্মরণে একটি জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article আনা আখমাতোভা, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.