অশনাক্ত উড়ন্ত বস্তু বা সংক্ষেপে অউব (ইংরেজি: Unidentified Flying Object or, UFO), এমন একটি উড়ন্ত বস্তু যা সেটির প্রত্যক্ষদর্শী দ্বারা এবং তদন্ত করার পরেও শনাক্ত করা যায় না। সহজ ভাষায়, আকাশে দৃশ্যমান যে কোনো অচেনা-অজানা বস্তু বা আলোকেই ইউএফও বলা হয়। এই সংজ্ঞা অনুসারে, এটিকে একটি ইউএফও বিমান হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা যায়, যে এটি এর পরিচয় দেওয়ার পূর্বেই বিমান নিয়ন্ত্রণকারী রাডার গুলোতে হঠাৎ আবির্ভূত হতে দেখতে পাওয়া যায়। যাইহোক, সাধারণ ভাষায় ও কল্পনায় অশনাক্ত উড়ন্ত বস্তু বলতে বুঝায় ভিনগ্রহ হতে আগত বুদ্ধিমান জীব। উড়ন্ত পিরিচ বা প্লেট হিসেবেও ১৯৪০-১৯৯০ এর দশকগুলোতে এই বিষয়টি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠে ছিল। কারণ যে সব অশনাক্ত উড়ন্ত বস্তু আকাশে দেখতে পাওয়া যেত তার বেশির ভাগ উড়ন্ত বস্তুগুলো পিরিচ বা প্লেটের আকৃতির হয়ে থাকতো। অশনাক্ত উড়ন্ত বস্তুর বিষয় নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে ইউফোবিদ্যা এবং যারা এসব নিয়ে গবেষণা করেন তাদের ইউফোলজিস্ট বলা হয়।
কতিপয় ইউফোলোজিস্টদের মতে, ইউএফও বলতে আকাশ বা মহাশূন্যের পর্যবেক্ষকরা যেসব অপ্রাকৃতিক বা অজানা বস্তু দেখা পায় সেগুলোই হলো ইউএফও। এগুলোকে কোনো কর্তৃপক্ষ বা বিশ্লেষক কৃত্রিম বস্তু (উদাহরণস্বরূপ, কৃত্রিম উপগ্রহ, যানবাহন, বেলুন) অথবা প্রাকৃতিক বস্তু (যেমন: উল্কা, গ্রহ, উল্কা বৃষ্টি, প্রাকৃতিক কারণ ইত্যাদি) হিসাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছিল। আর যে অশনাক্ত উড়ন্ত বস্তু বা ইউএফওগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উপর দেখতে পাওয়া যায় তাকে অশনাক্ত ভাসমান বস্তু বা ইউএসও (Unidentified Submerged Objects or, USO) বলা হয়। যদিও পূর্বে এমন বস্তু দেখা গেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরেই ১৯৪৭ সালের ২৪ জুন ইউএফও জন্ম ধরা হয়। সাধারণত এটিকে বৈজ্ঞানিক বিশ্বে একটি ছদ্মবিজ্ঞানের দ্বারা গণ্য করা হয়। সাম্প্রতিক বছরে, ইউএফও–এর দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকৃত জাদুঘর বানানো হয়েছে। একটি হলো নিউ মেক্সিকোর রজওয়েলের আন্তর্জাতিক ইউএফও জাদুঘর এবং অপরটি হলো এর শাখা ইস্তাম্বুলে।
অশনাক্ত উড়ন্ত বস্তু বা ইউএফও পর্যবেক্ষণ নিয়ে ইতিহাস জুড়ে বিভিন্ন গবেষণা ও প্রতিবেদন করা হয়েছে। এদের মধ্যে কিছু ছিল নিঃসন্দেহে প্রাকৃতিক জ্যোর্তিবিদ্যা সংক্রান্ত, যেমন: ধূমকেতু, উজ্জ্বল উল্কা, একটি বা পাঁচটি গ্রহ যা খালি চোখে দেখা যায়, যুক্ত গ্রহীক, অথবা বায়ুমন্ডলীয় দৃষ্টিবিভ্রন্ত আলোমালা যেমন: প্রতিসূর্য বা পারহেলিয়া এবং লেন্স আকৃতির মেঘমালা। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় হ্যালির ধূমকেতুর কথা, যেটি চীনের জ্যোর্তির্বিজ্ঞানীরা সম্ভবত খ্রীষ্ট্পূর্ব ২৪০ বছর অথবা ৪৬৭ বছর আগে প্রথম রেকর্ড করে ছিল। যাইহোক, তাদের প্রকৃত কারণ ইতিহাস জুড়ে অপ্রাকৃতিক, স্বর্গদূত অথবা অন্যান্য ধর্মীয় পূর্বাভাস বলে মনে করেছে। মধ্যযুগে কিছু বস্তু চিত্রাঙ্কন করা হয়েছে যা দেখলে অনুরূপ ইউএফও মনে হতে পারে। মধ্যযুগে এবং আধুনিক যুগের অভ্যুদয়ের সময় এমন অন্যান্য চিত্রাঙ্কনগুলোকে ইতিহাসবিদরা প্রায়ই ধর্মীয় প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেন। শেন কুও (১০৩১–১০৯৫), যিনি মধ্যযুগীয় চীন সরকারের একজন পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন, বহুবিদ্যাজ্ঞ, আবিস্কারক, তিনি অশনাক্ত উড়ন্ত বস্তুর সম্বন্ধে তার লেখা Dream Pool Essays(১০৮৮) বইতে একটি জীবন্ত অনুচ্ছেদ লিখে ছিলেন। ১১তম শতাব্দীতে চীনের ইয়াংচৌ শহরে আনহুই ও জিয়াংসু নামের দুই জন ইউএফও প্রত্যক্ষদর্শীর প্রমাণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। তাঁরা রাতে এক দরজা-বিশিষ্ট উড়ন্ত চাকী দেখেছিল বলে দাবি করেন। যেটির দরজার ভেতর থেকে থেকে আগতো উজ্জল আলোক গাছগুলো (আপাতদৃষ্টিতে ভিনগ্রহী প্রাণী) থেকে আগত আলো প্রায় দশ মাইল ব্যাসার্ধ জায়গা জুরে আলোকিত করেছিল এবং তাদের ভাষ্যমতে, চাকীটি প্রচণ্ড গতিতে তার নিজ স্থান থেকে উড্ডয়ন করতে সক্ষম হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পর্যন্ত নিয়মিত ইউএফও দেখা শুরু হয়েছিল, এর মধ্যে ২৪শে জুন, ১৯৪৭ সালে একজন বিখ্যাত মার্কিন ব্যবসায়ী ক্যানেথ আর্নল্ড যখন তার ব্যক্তিগত প্লেন ওয়াশিংটন এর রাইনার পর্বতমালা কাছে দিয়ে উড়ছিল, তখন তিনি উড়ন্ত চাকী দেখার দাবি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নয়টা অতি উজ্জ্বল বস্তু রাইনারের দিকে মুখ করে উল্ট পাশে উড়ছিল। অনুরুপ বস্তু ১৯৪৭ সালে আমেরিকাতে আরও দেখা গিয়েছিল।
আর্নল্ডের এই বিষয়টিতে প্রথম মিডিয়া প্রচার করেছিল এবং জনগণের দৃষ্টিও আর্কষণ করেছিল। আর্নল্ড বর্ণনা করেছিলেন যা তিনি দেখেছিলেন, "একটি পিঠার মত চ্যাপ্টা, পিরিচের মতো অকৃতির এবং এতো পাতলা ছিল যে ঠিকমত দেখা যাচ্ছিল না, অর্ধেক চাঁদ অকৃতি, পিছের দিক চ্যাপ্টা ডিম্বাকার এবং সামনের দিক উত্তল। ..... মনে হচ্ছিল একটা বড় চ্যাপ্টা চাকী এবং এমনভাবে উড়ছে, যেন একটা চারা পানির উপর লাফাচ্ছে।" অল্প দিনের মধ্যে আর্নল্ডের "উড়ন্ত বস্তু" বা "উড়ন্ত পিরিচ"-এর বিষয়টি অনেক দূর পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। আর্নল্ডের দেখাকে অনুসরণ করে অন্যানরাও একই ধরনের বস্তু দেখেছে বলে কয়েক সপ্তাহে শত শত রিপোর্ট করেছিল। এর বেশিরভাগই আমেরিকাতে। কিন্তু একই সময়ে অন্যান্য দেশসমূহেতেও এরকম জিনিস দেখেছিল বলে রিপোর্ট কর হয়েছিল। পরবর্তী বছরগুলোতে এ ধরনের অন্যান্য বিষয়ের রিপোর্টের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। যেমন: ৪ঠা জুলাই, সন্ধ্যাবেলা যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিমান দল ইডাহোর উপর নয়টারও বেশি একই রকম চাকী দেখেছিল।
মার্কিন ইউএফওলজিস্ট টেড ব্লোচার তাঁর সংবাদপত্র প্রতিবেদনে আর্নল্ডের বর্ণনাসহ অন্যান্য রিপোর্টগুলো নিয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা করেন, তিনি ৬-৮ জুলাইয়ের সঙ্গে ৪ঠা জুলাইয়ের ঘটনার উপর হঠাৎ অপ্রত্যশিত মিল খুজে পান। ব্লোচার লক্ষ্য করেছিলেন যে, পরবর্তী কয়েক দিন সর্বাপেক্ষা মার্কিন সংবাদপত্রের প্রধান পাতায় "উড়ন্ত পিরিচ" বা "উড়ন্ত চাকীর" এর ঘটনায় ভরা ছিল। ৮ই জুলাইয়ের পর যখন বিমান কর্মকর্তারা রজওয়েলের বিখ্যাত উড়ন্ত চাকী বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাটি সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করতে শুরু করেছিল, তারা তখন একে একটি পরীক্ষামূলক বস্তুর ধ্বংসাবশেষ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিল।
মধ্যযুগে ও ক্যামেরা আবিষ্কারের পুর্বে যে সকল অশনাক্ত উড়ন্ত বস্তু দেখার দাবি করা হয়েছিল, তাদের বেশিরভাগেরই উৎস সীমিত, অনির্ভরযগ্য ও কল্পনাপ্রবণ, এর একটি সহজ ব্যাখ্যা ইতিহাসবিদরা দিয়েছেন। যেমন:
প্রাচীনকাল হতেই আকাশে অদ্ভুত অদ্ভুত সব বস্তু দেখার খবর শোনা গেলেও ১৯৪৭ সালে যখন আমেরিকাতে প্রথম UFO দেখা যাবার খবর ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়, তারপর থেকে এটিই হয়ে ওঠে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। এর পর আরো কয়েক হাজার UFO দেখার খবর পাওয়া যায় এবং এর মধ্যে প্রায় শতকরা ৯০ ভাগই মিথ্যা। সাধারণ মানুষ প্রায়ই উজ্জ্বল কোন গ্রহ কিংবা তারা, বিমান, পাখি, বেলুন, ঘুড়ি, ডিম্বাকার আকৃতির মেঘ দেখে তা UFO ভেবে ভুল করেছে। তবে এর জন্য প্রয়োজন সময় সাপেক্ষ তদন্ত। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকী বিবেচনা করে মার্কিন বিমানবাহিনী ১৯৪৭ সালে UFO তদন্তে নামে। তদন্তের কাজ শেষ হয় ১৯৬৯ সালে। এ সময়ে প্রাপ্ত সর্বমোট ১২,৬১৮ টি ঘটনার মধ্যে ৭০১ টি ঘটনার কোন ব্যাখ্যা তারা দিতে পারে নি। মার্কিন বিমানবাহিনী তাদের তদন্ত শেষ করে এই বলে যে “বিমান বাহিনীর তদন্তে কোন UFO এর প্রতিবেদন করেনি এবং আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ভয়ের কোন ইঙ্গিত দেয়নি।” ১৯৬৯ সালের পর আর কোন মার্কিন সংস্থা UFO তদন্ত কাজে সরাসরি হাত দেয়নি। এরপর ১৯৯৭ সালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা মার্কিন সামরিক বাহিনীর উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন গোয়েন্দা বিমান ব্যবহারের কথা ফাঁস করে দেয়। ১৯৫০ হতে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত যতগুলো UFO দেখা গেছে তার মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ ঘটনার জন্য দায়ী Lockheed U-2A এবং Lockheed SR-71 নামের এই বিমান দুটি। যদিও কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, তারপরও অনেকেই এটিকে ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দাদের আকাশযান বলে মনে করেন। আর বিষয়টিকে উড়িয়ে দেবার উপায় নেই। অধিকাংশ বিজ্ঞানীই এই মহাশুন্যে কোথাও না কোথায় অতিমানবীয় বুদ্ধিমান প্রানীর অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article অশনাক্ত উড়ন্ত বস্তু, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.