হিন্দু দর্শন বলতে বোঝায় প্রাচীন ভারতে উদ্ভূত একগুচ্ছ দর্শনের একটি সমষ্টি। এটি ভারতীয় দর্শনসমূহের একটি অংশ যা প্রাচীন বেদকে জ্ঞানের প্রামাণ্য ও গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসাবে স্বীকার করা হয়। মূল ধারার হিন্দু দর্শনের মধ্যে ছয়টি দার্শনিক শাখা বিদ্যমান, যাকে একত্রে ষড়দর্শন বলা হয়। এগুলো হল: সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা ও বেদান্ত। ষড়দর্শন বেদের প্রামাণ্যতা স্বীকার করে বলে একে আস্তিক দর্শনও বলা হয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতে আরও কয়েকটি দার্শনিক শাখার উদ্ভব ঘটেছিল যেগুলো বেদকে অস্বীকার করে কিছুটা একই ধরনের দার্শনিক ধারণা প্রচার করেছিল। এগুলো নাস্তিক দর্শন নামে পরিচিত। ভারতীয় নাস্তিক দর্শনগুলো হল: বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম, চার্বাক, আজীবক এবং অন্যান্য। তবে এগুলোকে হিন্দু দর্শনের অংশ বলে অনেকে মনে করেন না। হিন্দু দর্শন বলতে কেবল আস্তিক দর্শনকেই বুঝানো হয়।
আস্তিক দর্শনের বিভিন্ন শাখাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং আস্তিক ও নাস্তিক শাখাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও পার্থক্য নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ১৮শ ও ১৯শ শতাব্দীর ভারততত্ত্ববিদ ও প্রাচ্যবিদদের রচনা থেকে এই মতভেদের সূচনা। মনে রাখতে হবে, এঁদের রচনার উৎস সেই যুগে প্রাপ্ত অল্প কিছু ভারতীয় সাহিত্য গ্রন্থ ও মধ্যযুগীয় ধর্মগ্রন্থ। হিন্দু দর্শনের বিভিন্ন পরস্পর-সম্পর্কযুক্ত ধারাগুলো বৈচিত্র্যপূর্ণ। ইতিহাস, ধারণা, একই মূল ধর্মগ্রন্থ, একই তত্ত্ববিদ্যা ও মুক্তিতত্ত্ব ও বিশ্বতত্ত্বের মাধ্যমে এগুলো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। বৌদ্ধ ও জৈনধর্মকে পৃথক দর্শন ও ধর্ম হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে চার্বাক ইত্যাদি কয়েকটি নাস্তিক শাখাকে হিন্দু দর্শনের অন্তর্গত মনে করা হয়।
ষড়দর্শনের একটি বা দুটি শাখার সঙ্গে সম্পর্ক-যুক্ত কয়েকটি আস্তিক্যবাদী উপশাখাও হিন্দু দর্শনের অন্তর্গত। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ন্যায়ের বাস্তববাদ, বৈশেষিকের প্রকৃতিবাদ, সাংখ্যের দ্বৈতবাদ, অদ্বৈত বেদান্তের অদ্বৈতবাদ ও মোক্ষলাভের জন্য আত্মজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার ধারণা, যোগের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ এবং কৃচ্ছ্রসাধন ও আস্তিক্যবাদী ধারণার বিভিন্ন উপাদান উল্লেখযোগ্য। এই ধরনের দর্শনগুলোর থেকে পাশুপত শৈবধর্ম, শৈবসিদ্ধান্ত, প্রত্যভিজ্ঞ ও বৈষ্ণবধর্মের উৎপত্তি। কোনো কোনো উপশাখায় কয়েকটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনুরূপ তান্ত্রিক ধারণার অবতারণা করা হয়েছে। এই সব উপশাখাগুলো পুরাণ ও আগমে পাওয়া যায়।
হিন্দু দর্শনের প্রত্যেকটি শাখার বিস্তারিত জ্ঞানতত্ত্বীয় সাহিত্য পাওয়া যায়। এগুলোকে ‘প্রমাণ বলা হয়। এছাড়া প্রত্যেকটি শাখার অধিবিদ্যা, মূল্যবিদ্যা ও অন্যান্য বিষয়ের উপর তাত্ত্বিক গ্রন্থও পাওয়া যায়।
মধ্যযুগ থেকে ব্রাহ্মণেরা ভারতীয় দর্শনকে আস্তিক ও নাস্তিক – এই দুই ভাগে বিভক্ত করে এসেছে। হিন্দুধর্মের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, হিন্দু দর্শনের ছয়টি প্রধান শাখা (ষড়দর্শন) খ্রিস্টের জন্মের সমসাময়িক কাল থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্য বা খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। এই দার্শনিক শাখাগুলোর মধ্যে বৈচিত্র্য ও প্রত্যেকটি প্রধান শাখার মধ্যে মতবাদের বিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কোনো গবেষক অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন যে, হিন্দু দর্শনকে আস্তিক ও নাস্তিক – এই দুই ভাগে ভাগ করার প্রবণতাটি যথেষ্ট বা যথাযথ কিনা তা নিয়ে। অন্যদিকে এমন কিছু দার্শনিক উপশাখাও ছিল, যেগুলোর মধ্যে আস্তিক ও নাস্তিক উভয় মতবাদের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল।
ঈশ্বরএ বিশ্বাসী নয় বরং প্রাচীন বেদএ বিশ্বাসী ব'লে নিম্নোক্ত ছয়টি দর্শনের আস্তিক অস্তিত্ব স্বীকৃত। এগুলোর প্রত্যেকটিকে ‘দর্শন’ বলা হয়। প্রত্যেকটি দর্শনেই বেদের প্রামাণ্যতা ও ‘আত্মা’র অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। আস্তিক দর্শনগুলো হল:
দর্শনের যে সকল শাখা বেদের প্রামাণ্যতা স্বীকার করে না, সেগুলোকে নাস্তিক দর্শন বলা হয়। নাস্তিক দর্শনগুলোর মধ্যে চারটি শাখা প্রধান:
প্রধান আস্তিক্য ও নাস্তিক্যবাদী শাখাগুলোর পাশাপাশি কিছু কিছু উপশাখাও রয়েছে যেগুলো বিভিন্ন মতবাদকে যুক্ত করে নিজস্ব দর্শন খাড়া করেছে। মধ্যযুগীয় পণ্ডিত মধ্ব জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে এই জাতীয় নিম্নোক্ত উপশাখাগুলোকে হিন্দু দর্শনের উপশাখা বলে বর্ণনা করেছেন:
উপরিউক্ত উপশাখাগুলো ন্যায়ের বাস্তববাদ, বৈশেষিকের প্রকৃতিবাদ, অদ্বৈত বেদান্তের অদ্বৈতবাদ ও মোক্ষলাভের জন্য আত্মজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা, যোগের আত্ম-সংযম এবং ঈশ্বরবাদী ধারণাগুলোর নানা উপাদান গ্রহণ করে নিজস্ব দার্শনিক মতবাদ গড়ে তোলে। কোনো কোনো উপশাখায় বৌদ্ধধর্মের অনুরূপ তান্ত্রিক প্রভাবও দেখা যায়।
শাখা | সাংখ্য | যোগ | ন্যায় | বৈশেষিক | মীমাংসা | অদ্বৈত | বিশিষ্টাদ্বৈত | দ্বৈত | অচিন্ত্যভেদাভেদ | পাশুপত | শৈবসিদ্ধান্ত | কাশ্মীর শৈবধর্ম | রসেশ্বর | পাণিনীয় |
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
শ্রেণী | যুক্তিবাদ, দ্বৈতবাদ, নিরীশ্বরবাদ | দ্বৈতবাদ, আধ্যাত্মিক অনুশীলন | বাস্তবতাবাদ, যুক্তি, ব্যাখ্যামূলক দর্শন | প্রকৃতিবাদ, পরমাণুবাদ | ধর্মব্যাখ্যা, ভাষাতত্ত্ব, আচারবাদ | অদ্বৈতবাদ | বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদ, সর্বেশ্বরবাদ | দ্বৈতবাদ, ঈশ্বরতত্ত্ব | একাধারে অদ্বৈতবাদ ও দ্বৈতবাদ | আস্তিক্যবাদ, আধ্যাত্মিক অনুশীলন | আস্তিক্যবাদী দ্বৈতবাদ | আস্তিক্যবাদী অদ্বৈতবাদ ও আদর্শবাদ | অপরসায়ন | ভাষাতত্ত্ব, ভাষার দর্শন |
দার্শনিক | কপিল, ঈশ্বরকৃষ্ণ, বাচস্পতি মিশ্র, গুণরত্ন, আরও... | পতঞ্জলি, যাজ্ঞবল্ক্য, ব্যাস | অক্ষপাদ গৌতম, বাৎস্যায়ন, উদয়ন, জয়ন্ত ভট্ট আরও... | কণাদ, প্রশস্তপাদ, শ্রীধরের ন্যায়কণ্ডলী, আরও... | জৈমিনী, কুমারিল ভট্ট, প্রভাকর আরও... | গৌড়পাদ, আদি শঙ্কর, মধুসূদন সরস্বতী, বিদ্যারণ্য, আরও... | যমুনাচার্য, রামানুজ আরও... | মধ্ব, জয়তীর্থ, ব্যাসতীর্থ, রাঘবেন্দ্র স্বামী | চৈতন্য মহাপ্রভু, বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামী, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, বলদেব বিদ্যাভূষণ, রূপ গোস্বামী, আরও... | হরদত্তাচার্য, নকুলীশ | হরদত্তাচার্য, নকুলীশ | সদ্যোজ্যোতি মেয়কন্দর, অঘোরশিব | বসুগুপ্ত, অভিনবগুপ্ত, জয়রথ, গোবিন্দ ভাগবত, সর্বজ্ঞ রামেশ্বর | পাণিনি, ভর্তৃহরি, কাত্যায়ন |
ধর্মগ্রন্থ | সাংখ্যপ্রবচন সূত্র, সাংখ্যকারিকা, সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী আরও... | যোগসূত্র, যোগ যাজ্ঞবল্ক্য, সাংখ্য প্রবচন ভাষ্য | ন্যায়সূত্র, ন্যায়ভাষ্য, ন্যায়বর্তৃকা আরও... | বৈশেষিক সূত্র, পদার্থ ধর্ম সংগ্রহ, দশপদার্থ শাস্ত্র, আরও... | পূর্ব মীমাংসা সূত্র, মীমাংসাসূত্রভাষ্যম্, আরও... | ব্রহ্মসূত্র, প্রস্থানত্রয়ী, অবধূত গীতা, অষ্টাবক্র গীতা, পঞ্চদশী আরও... | সিদ্ধিত্রয়ম্, শ্রীভাষ্য, বেদার্থ সংগ্রহ | অনুব্যাখ্যান, ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য, সর্ব শাস্ত্রার্থ সংগ্রহ, তত্ত্বপ্রকাশিকা, ন্যায়সুধা, ন্যায়ামৃত, তর্কতাণ্ডব, দ্বৈতদ্যুমণি | ভাগবত পুরাণ, ভগবদ্গীতা, ষট্সন্দর্ভ, গোবিন্দ ভাষ্য, চৈতন্যচরিতামৃত | গণকারিকা, পঞ্চার্থ ভাষ্যদীপিকা, রাশিকর ভাষ্য | শৈব আগম, শ্রীমতকিরণ, রৌরবতন্ত্র, মৃগেন্দ্র | বসুগুপ্তের শিবসূত্র, তন্ত্রলোক | রসার্ণব, রসহৃদয়, রসেশ্বর সিদ্ধান্ত | বাক্যপদীয়, মহাভাষ্য, বার্তৃককার |
দার্শনিক ধারণা | পুরুষ, প্রকৃতি, গুণ, সৎকার্যবাদ | যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়ম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান, সমাধি | প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান, অন্যথাক্যতিবাদ, নিঃশ্রেয়স আরও... | পদার্থ, দ্রব্য, সামান্য, বিশেষ, সমবায়, পরমাণু | অপৌরুষেয়ত্ব, অর্থাপত্তি। অনুপলব্ধি, সতঃপ্রামাণ্যবাদ | জীবমুক্ত, মহাবাক্য, সাধনচতুষ্টয়, সত্যের তিন স্তর, বিবর্তবাদ | হিত, অন্তব্যাপী, বহুব্যাপী, আরও... | প্রপচ্চ, মুক্তিযোগ, নিত্যসংসারী, তমোযোগ | সম্বন্ধ, অভিধেয়, প্রয়োজন | পশুপতি, আটটি পঞ্চক | চর্যা, মন্ত্রমার্গ, রোধশক্তি | চিতি, মালা, উপায়, অনুত্তর, অহম্, স্বাতন্ত্র্য | পারদ, পারদের তিনটি ধরন | স্ফোট, অষ্টাধ্যায়ী |
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article হিন্দু দর্শন, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.