পশ্চিমবঙ্গের ভূগোল অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গ পূর্ব ভারতের একটি রাজ্য। দক্ষিণে ২১º৩৮’ উত্তর অক্ষাংশ থেকে উত্তরে ২৭º১০’ উত্তর অক্ষাংশ এবং পশ্চিমে ৮৫º৫০’ পূর্ব দ্রাঘিমা থেকে পূর্বে ৮৯º৫০’ পূর্ব দ্রাঘিমা পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটি বিস্তৃত। এ-রাজ্যের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর, ধুবুলিয়া, বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলী, গুসকরা, আউশগ্রাম, রাজবাঁধ, দুর্গাপুর, বাঁকুড়া জেলার দুর্লভপুর এবং পুরুলিয়া জেলার আদ্রা শহরের উপর দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে কর্কটক্রান্তি রেখা প্রসারিত। এ-রাজ্যের উত্তর সীমা যেমন হিমালয় পর্বতমালাকে স্পর্শ করেছে, তেমনি দক্ষিণ সীমায় রয়েছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার সুবিশাল বদ্বীপ ও বঙ্গোপসাগর। তিনটি বিদেশি রাষ্ট্র – নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশ এবং পাঁচটি ভারতীয় রাজ্য – সিক্কিম, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও আসাম প্রত্যক্ষভাবে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী। এছাড়াও সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত সান্নিধ্যের জন্য ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গেও পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বিদ্যমান।
রাজ্যের উত্তরে রয়েছে হিমালয়ের সুউচ্চ শৃঙ্গ, আবার দক্ষিণে রয়েছে সমুদ্র-উপকূলীয় সমভূমি; পশ্চিম দিকে যেমন রয়েছে ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল, তেমনি পূর্বদিকে রয়েছে গাঙ্গেয় বদ্বীপ সমভূমি। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একমাত্র রাজ্য যার উত্তরে হিমালয় ও দক্ষিণে সমুদ্র রয়েছে। এই রাজ্যে মালভূমি ও সমভূমির সহাবস্থান দেখা যায়।
পশ্চিমবঙ্গ ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পূর্বদিকে অবস্থিত। এ-রাজ্যের উত্তরে হিমালয় এবং হিমালয়ের কোলে অবস্থিত নেপাল ও ভুটান রাষ্ট্র এবং সিক্কিম রাজ্য; পূর্বদিকে অসম রাজ্য ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র, পশ্চিমে বিহার, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশা এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। পশ্চিমবঙ্গের আয়তন ৮৮,৭৫২ বর্গ কিলোমিটার বা ৩৪,২৬৭ বর্গ মাইল। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম মেট্রোপলিটান বা পৌরপুঞ্জ অঞ্চল এবং তৃতীয় বৃহত্তম নগর।
পশ্চিমবঙ্গে পাঁচটি রাজনৈতিক বিভাগ ও মোট ২৩টি জেলা রয়েছে। যেমন – বর্ধমান বিভাগের অন্তর্গত পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূম ও হুগলি; মেদিনীপুর বিভাগের অন্তর্গত পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম ও পুরুলিয়া; জলপাইগুড়ি বিভাগের অন্তর্গত কোচবিহার, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কালিম্পং ও আলিপুরদুয়ার; মালদা বিভাগের অন্তর্গত উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ ও মুর্শিদাবাদ এবং প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্গত কলকাতা, নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও হাওড়া জেলা। প্রতিটি জেলা মহকুমাশাসক কর্তৃক শাসিত মহকুমা ও মহকুমাগুলি ব্লকে বিভক্ত থাকে (ব্যতিক্রম কলকাতা)। পঞ্চায়েত ও পুরসভা নামক স্থানীয় শাসনপ্রতিষ্ঠানগুলি নিয়ে ব্লক গঠিত হয়। এছাড়াও গঙ্গার উত্তরের আটটি জেলাকে একত্রে উত্তরবঙ্গ ও গঙ্গার দক্ষিণের পনেরোটি জেলাকে একত্রে দক্ষিণবঙ্গ বলা হয়। উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ দুটি গুরুত্বপূর্ণ আরক্ষা (পুলিশ) বিভাগীয় আঞ্চলিক একক।
পশ্চিমবঙ্গের উত্তরদিকে পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতমালা হিমালয় অবস্থান করছে। সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালার অংশ বিশেষ পর্বতময় এই অঞ্চলটি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর-পশ্চিম সিমান্তে পূর্ব হিমালয় পর্বতশ্রেণির উপর অবস্থিত। একমাত্র শিলিগুড়ি মহকুমা বাদে পুরো দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ি জেলার উত্তর-পূর্বের সামান্য কিছু অংশ এই অঞ্চলের অন্তর্গত।
এই পার্বত্যভূমি তরাই-এর সমভূমি থেকে ৩০০ মিটার সমোন্নতি রেখা বরাবর হঠাৎ খাড়াভাবে উপরে উঠে গিয়েছে (সমান উচ্চতাযুক্ত অঞ্চলকে যে রেখা দিয়ে যুক্ত করা হয়, তাকে সমোন্নতি রেখা বলা হয়)।
প্রধানত পাললিক ও রূপান্তরিত শিলা দিয়ে গঠিত এই অঞ্চলটির ভূপ্রকৃতি অত্যন্ত বন্ধুর। এবড়ো-খেবড়ো পার্বত্যভূমি, পাহাড়ের খাঁড়া ঢাল, গভীর গিরিখাত এবং ছুরির ফলার মতো পর্বতশিরা এই অঞ্চলের প্রধান ভুপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য।
হিমালয় পর্বতের কয়েকটি গিরিশ্রেণি এবং উপত্যকা নিয়ে গঠিত এই অঞ্চলটি দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকের ক্রমশ উঁচু হয়ে গেছে। তিস্তা নদী সিকিম থেকে এই অঞ্চলে প্রবেশ করে সুগভীর গিরিখাত দ্বারা এই অঞ্চলটিকে দু’ভাগে ভাগ করেছে, যেমন— (১) তিস্তার পশ্চিমদিকের পার্বত্য অঞ্চল এবং (২) তিস্তার পূর্ব দিকের পার্বত্য অঞ্চল। তিস্তার পশ্চিম দিকের পার্বত্য অঞ্চলটি পূর্ব দিকের পার্বত্য অঞ্চলের তুলনায় উঁচু।
দার্জিলিং হিমালয়ের সর্বোচ্চ অংশ এখানে অবস্থিত। এখানকার প্রধান দুটি পর্বতশ্রেনী হল সিঙ্গালিলা (দার্জিলিংকে নেপাল থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে) এবং দার্জিলিং-মহালধিরাম শৈলশিরা। সিংগালিলার চারটি উল্লেখযোগ্য পর্বতশৃঙ্গ হল সান্দাকফু (৩৬৩৬ মি), ফালুট (৩,৫৯৫ মি), টংলু (৩,০৩৬ মি) ও সবরগ্রাম (৩,৫৪৩ মি)। সিঙ্গালিলা পর্বতের সান্দাকফু (Sandakphu) পশ্চিমবঙ্গের উচ্চতম শৃঙ্গ। দার্জিলিং-কার্শিয়াং পর্বতমালার উল্লেখযোগ্য শৃঙ্গ হল টাইগার হিল (২,৫৬৭মি)।
তিস্তার পূর্বদিকে রয়েছে দুরবিনদারা পর্বত। এই পর্বতটি কালিম্পং শহর এর ঢালে অবস্থিত। কালিম্পং থেকে দুরবিনদারা পর্বতটি ক্রমশ নিচু হয়ে পূর্বদিকে জলঢাকা নদীর উপত্যকার দিকে এগিয়ে গেছে। এই অঞ্চলে দার্জিলিং হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ঋষিলা অবস্থিত। ঋষিলা শৃঙ্গের উচ্চতা ৩,১৩০ মি.। ঋষিলা শৃঙ্গের আরও পূর্বদিকে জলপাইগুড়ি জেলার উত্তর অংশে ডলোমাইট শিলায় গঠিত নাতিউচ্চ বক্সা-জয়ন্তী পাহাড় অবস্থিত। এই অঞ্চলটি অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে বিচ্ছিন্ন পাহাড়ে পরিণত হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য পর্বতশৃঙ্গ সমূহ
স্থানাঙ্ক | চূড়া | উচ্চতা (মিটার) |
---|---|---|
১ | সান্দাকফু | ৩৬৩৬ |
২ | ফালুট | ৩৫৯৫ |
৩ | সাবারগ্রাম | ৩৫৪৩ |
৪ | রাচেলা ডান্ডা | ৩১৭০ |
৫ | টংলু | ৩০৩৬ |
৬ | টাইগার হিল | ২৫৬৭ |
৭ | ঘুম হিল | ২৪০০ |
৮ | ডেলো হিল | ১৭০৪ |
৯ | বক্সা হিল | ১৪০০ |
১০ | দুরবিন হিল | ১৩৭২ |
পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম অংশে অবস্থিত এই ঢেউখেলানো উঁচুভুমি ও মালভুমি অঞ্চলটি সমগ্র পুরুলিয়া জেলা এবং বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমদিকের ৫০ মিটারের বেশি উচ্চতাযুক্ত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয়েছে। গ্রানাইট ও নিস্ শিলা দ্বারা গঠিত এই উচ্চভূমি অঞ্চলটি হল ছোটনাগপুর মালভূমির অংশ বিশেষ।ভূ-তাত্ত্বিক গঠন অনুসারে এই অঞ্চলটি পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন অঞ্চল। প্রাচীন আগ্নেয় ও পাললিক শিলা দিয়ে এই মালভূমি অঞ্চল গঠিত। এটি ছোটনাগপুর মালভূমির পূর্ব প্রান্তের ভগ্ন ঢালু অংশ। ইহা পশ্চিম থেকে পূর্বে ঢালু।
সমগ্র উচ্চভূমি অঞ্চলটি দক্ষিণে বরাভূম উচ্চভূমি, পশ্চিমে পুরুলিয়া উচ্চভূমি এবং উত্তর-পূর্বে শুশুনিয়া উচ্চভূমিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সুবর্ণরেখা, কংসাবতী, দ্বারকেশ্বর, কোপাই, অজয়, দামোদর প্রভৃতি নদীগুলির ক্ষয় কাজের ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের এই উচ্চভূমি অঞ্চলটি সমপ্রায় ভূমিতে পরিণত হয়েছে এবং অপেক্ষাকৃত কঠিন শিলা দ্বারা গঠিত এই উচ্চভূমির বাকি অংশগুলো এখানে সেখানে টিলার মতো ছোট ছোট পাহাড়ের আকারে দঁড়িয়ে আছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাহাড় হল পুরুলিয়া জেলার অযোধ্যা, বাঘমুন্ডি ও পাঞ্চেৎ, বাঁকুড়া জেলার বিহারীনাথ ও শুশুনিয়া, ঝাড়গ্রাম জেলায় বেলপাহাড়ি, বীরভূমের মামাভাগ্নে পাহাড়, মথুরাখালি প্রভৃতি। অযোধ্যা পাহাড়ের গোরগাবুরু পশ্চিমবঙ্গের মালভূমি অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। গোগরাবুরু শৃঙ্গের উচ্চতা ৬৭৭ মি.।
উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল এবং পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চলকে বাদ দিলে পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ স্থানই বৈচিত্র্যহীন সমভূমি। পশ্চিমবঙ্গের এই অঞ্চলটি নদীবাহিত পলি সঞ্চয়ের ফলে গড়ে উঠেছে। ভূপ্রকৃতি ও মৃত্তিকার পার্থক্যের জন্য পশ্চিমবঙ্গের সমগ্র সমভূমি অঞ্চলকে ছয়ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন— (১) তরাই ও ডুয়ার্স অঞ্চল, (২) উত্তরের সমভূমি অঞ্চল, (৩) রাঢ় অঞ্চল, (৪) উপকূলের বালুকাময় সমভূমি (৫) গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চল ও (৬) সুন্দরবন অঞ্চল।
তরাই (কথাটির অর্থ আর্দ্র অঞ্চল) হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে ৩৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত জলাভূমিময় তৃণভূমি, সাভানা ও বনভূমির একটি অঞ্চল। পশ্চিমবঙ্গের পার্বত্য অঞ্চলের দক্ষিণে দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমা এবং জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জেলার উত্তরাংশে নদীবাহিত বালি ও নুড়ি জমে তরাই অঞ্চলটির সৃষ্টি হয়েছে। এই অঞ্চলটি উত্তর থেকে দক্ষিণে ঢালু হয়ে গিয়েছে। অসংখ্য নদীখাত তরাই অঞ্চলটিকে বিভিন্ন সমান্তরাল অংশে বিভক্ত করেছে। এই অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছে তিস্তা নদীর ডানদিকের অংশ তরাই এবং বাঁদিকের অংশ ডুয়ার্স নামে পরিচিত।তরাই অঞ্চলের উত্তরে অবস্থিত হিমালয়ের পাথর, নুড়ি আর ক্ষয়প্রাপ্ত মাটিতে তৈরি বনময় ভাবর অঞ্চল। তরাই অঞ্চলের মাটিতে কাদা ও বালির পর্যায়ক্রমিক স্তর দেখা যায়। এখানকার ভৌমজলপৃষ্ঠ (ওয়াটার টেবিল) উচ্চ হওয়ায় অনেক ঝোরা ও জলভূমি দেখা যায়। তরাই অঞ্চলের নদীগুলিতে বর্ষাকালে দুকূল ছাপিয়ে বন্যা হয়। তরাই-ডুয়ার্স সাভানা ও তৃণভূমি একটি বাস্তু-অঞ্চল (ইকোরিজিয়ন)। এই অঞ্চলটি গোটা তরাই অঞ্চলের মধ্যভাগ জুড়ে অবস্থিত। এইখানে লম্বা লম্বা ঘাসের তৃণভূমি, সাভানা এবং চিরহরিৎ ও পর্ণমোচী বনভূমি দেখা যায়। ভূমিভাগের সাধারণ উচ্চতা ৮০-১০০ মিটার। তিস্তা, তোর্সা, রায়ডাক, জলঢাকা, সঙ্কোশ প্রভৃতি বড় এবং একাধিক ছোট নদীর বয়ে আনা বালি, নুড়ি ও পাথরে গড়ে উঠেছে তরাই।
পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলের দক্ষিণে, তরাই ও গঙ্গার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। জলপাইগুড়ি জেলার দক্ষিণাঞ্চল, উত্তর দিনাজপুর জেলা (উত্তরের কয়েকটি অংশ বাদে), দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা, মালদহ জেলা ও কোচবিহার জেলার দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে এই সমভূমি গঠিত। উত্তর দিনাজপুরের যে সংকীর্ণ ভূখণ্ডটি মালদহ ও দক্ষিণ দিনাজপুরের সঙ্গে দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার সংযোগ রক্ষা করছে তার নাম মহানন্দা করিডোর। উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরের সমস্ত অঞ্চলই পলল সমভূমি। তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা প্রভৃতি নদীর পলি জমে এই অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে। মোটামুটিভাবে সমতল হলেও মাঝে মাঝে এখানে সেখানে খাল-বিল এবং উঁচু-নিচু জমি চোখে পড়ে। এখানে কোনও কোনও স্থানে ৩০ মিটার পর্যন্ত উঁচু ঢিবি দেখা যায়।
ভুপ্রকৃতিগত ভাবে উত্তরের সমভূমি অঞ্চলকে তাল, বরেন্দ্রভূমি ও দিয়ারা এই তিনটি অংশে ভাগ করা যায়। মহানন্দা নদী মালদহ জেলাকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। পূর্বাংশটি প্লাবন সমভূমি। এটি পুরনো পলিমাটিতে গঠিত। এখানে কয়েকটি টিলাও দেখা যায়। এই অঞ্চলটি বরেন্দ্রভূমি নামে পরিচিত এবং এটি গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের অংশ। পশ্চিমাংশটি নতুন পলিমাটিতে গঠিত। এই অংশে কালিন্দী নদী মহানন্দা নদীতে মিশেছে। মালদহের কালিন্দী নদীর উত্তরে অবস্থিত ভূমিভাগ তাল নামে পরিচিত। এটি একটি নিম্নভূমি। এখানে অনেক জলা ও বিল দেখা যায়। কালিন্দী নদীর দক্ষিণে অবস্থিত উর্বর অংশটির নাম দিয়ারা। জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার দক্ষিণাঞ্চলও নতুন পলিমাটি এবং তিস্তা, তোর্সা, রায়ডাক, জলঢাকা, সঙ্কোশ, বালাসোন, পুনর্ভবা, আত্রেয়ী ও অন্যান্য ছোট নদীগুলির জমা করা নুড়িপাথরে তৈরি হয়েছে।
পশ্চিমের মালভূমির পূর্ব সীমা থেকে ভাগীরথী-হুগলী নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত সামান্য ঢেউ খেলানো ও পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঢালু হয়ে যাওয়া বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চলটি রাঢ় সমভূমি নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান এবং বীরভূম জেলার পূর্বাংশ রাঢ় অঞ্চলের অন্তর্গত। পুরানো পলিমাটি দিয়ে গঠিত এই অঞ্চলটির মাটির রঙ লাল। এখানকার মাটি ল্যাটেরাইট প্রকৃতির। তাই এই মাটির রং লাল। এখানকার জমির স্বাভাবিক ঢাল পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। অজয়, দামোদর, ময়ূরাক্ষী, শিলাবতী, কংসাবতী, বক্রেশ্বর প্রভৃতি হল রাঢ় অঞ্চলের প্রধান নদী। এই অঞ্চলটি কৃষিকাজে অত্যন্ত উন্নত।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার উপকূল ভাগ এই অঞ্চলের অন্তর্গত। সর্বদক্ষিণের উপকূলবর্তী তটভূমি বালুকাময়। এখানকার তটভূমির ঢাল খুবই কম। এখানে বিভিন্ন স্থানে বালিয়াড়ি দেখা যায়। তটভূমির উত্তর দিকের বালিয়াড়িগুলি সমুদ্র উপকূলের সমান্তরালভাবে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। দুটি বালিয়াড়ির মাঝের নিচু অংশে জলাভূমি দেখা যায়। এই সমভূমি নদীপ্রবাহ ও বায়ুপ্রবাহের দ্বারা বাহিত বালি ও কাদায় গঠিত। উপকূল অঞ্চলের সমান্তরালে বালিয়াড়ি ও জলাভূমি দেখা যায়। দিঘা বালিয়াড়ি বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে কাছে এবং কাঁথি বালিয়াড়ি সবচেয়ে দূরে অবস্থিত। কোথাও কোথাও সমুদ্র থেকে বালিয়াড়িগুলির দূরত্ব ১৫-১৬ কিলোমিটার এবং উচ্চতা ১১-১২ মিটার।
এই বদ্বীপ অঞ্চলটি পূর্বদিকে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে পশ্চিমে কান্দি মহকুমা বাদে সমগ্র মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, হাওড়া, হুগলী, কলকাতা উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা এবং বর্ধমান ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পূর্বাংশের ৫০ মিটার সমোন্নতি রেখা বরাবর বিস্তৃত। এই অঞ্চলের উত্তরে পদ্মা নদী এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর উপস্থিত। সমগ্র অঞ্চলটি সমতল হলেও উত্তর থেকে দক্ষিণে ক্রমশ ঢালু হয়ে গিয়েছে। এই অঞ্চল পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপের একটি অংশ। গঙ্গা বা পদ্মা, ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর, দ্বারকেশ্বর, রূপনারায়ণ, কাঁসাই প্রভৃতি নদনদী বাহিত পলি সঞ্চয়ের ফলে কালক্রমে সমুদ্রবক্ষ থেকে এই নতুন ভূভাগ বা বদ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে।
গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চলকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন— (১) মুমূর্ষ বদ্বীপ, (২) পরিণত বদ্বীপ ও (৩) সক্রিয় বদ্বীপ।
(১) মুমূর্ষ বদ্বীপ :- নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলার এই বদ্বীপ অংশে নদীগুলো গঙ্গা বা পদ্মা থেকে বিছিন্ন হয়ে মৃতপ্রায় হওয়ায় এই অঞ্চলের বদ্বীপ গঠন আর সম্ভব নয়। এখানে তাই প্রচুর বিল, জলাভূমি ও অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ দেখা যায়।
(২) পরিণত বদ্বীপ :- ছোটনাগপুরের মালভূমি থেকে নদীবাহিত প্রচুর বালি, কাঁকর, পলি প্রভৃতি জমে বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া ও হুগলী জেলায় এই বদ্বীপ অঞ্চলের গঠন প্রায় শেষ হয়েছে। তাই এখানে জলাভূমির সংখ্যা অনেক কম এবং মৃত্তিকাও বেশ কঠিন।
(৩) সক্রিয় বদ্বীপ :- উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা এবং কলকাতা জেলার দক্ষিণে অবস্থিত সুন্দরবন অঞ্চলে নদী ও সমুদ্র বাহিত পলি দিয়ে বদ্বীপ গঠনের কাজ আজও চলছে। সমুদ্রের জোয়ারের প্রভাবে এখানকার মৃত্তিকা কিছুটা লবণাক্ত।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার দক্ষিণাংশ এবং উত্তর ২৪ পরগনার দক্ষিণ পূর্বাংশ এই অঞ্চলের অন্তর্গত। এই অঞ্চলটি পুরোপুরিভাবে সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চলের অন্তর্গত, তাই এখানে বদ্বীপ গঠনের কাজ এখনোও চলছে। সুন্দরবনের নদীগর্ভ ছাড়া সমস্ত অংশই সমতল। সমুদ্রতল থেকে এই অঞ্চলের গড় উচ্চতা মাত্র ৩-৪ মিটার হওয়ায় এর অনেকটাই সমুদ্রজলের জোয়ারে ঢেকে যায়। সুন্দরবন অঞ্চলটি পশ্চিমবঙ্গের ১০২ টি ছোটো দ্বীপ নিয়ে গঠিত। ৪৮ টি দ্বীপ এ মানুষ এর বসতি রয়েছে। এই অঞ্চল এর মাটি লবনাক্ত ও কাদা প্রকৃতির। এই অঞ্চলে শ্বাসমূল ও ঠেসমূলযুক্ত ম্যানগ্রোভ অরণ্য গড়ে উঠেছে। সুন্দরী গাছের উপস্থিতির কারণে সুন্দরবন নামকরণ হয়েছে।মাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০-৪০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। এই অঞ্চলে গঙ্গা প্রধান নদী হলেও অসংখ্য নদী আছে যেমন কালিন্দী,রায়মঙ্গল, মাতলা, বিদ্যাধরী ইত্যাদি। এছাড়া বিশ্ব বিখ্যাত রয়াল বেঙ্গল টাইগার এই অঞ্চলের ই সম্পদ।
পশ্চিমবঙ্গ একটি নদীমাতৃক রাজ্য। পশ্চিমবঙ্গের ভূপ্রকৃতি অনুসারে এই রাজ্যের উত্তর ও পশ্চিম দিক উঁচু এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক বঙ্গোপসাগরের দিকে ক্রমশ ঢালু হয়ে যাওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের নদনদীগুলো উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল এবং পশ্চিমের মালভূমি থেকে উৎপন্ন হওয়ার পর দক্ষিণ অথবা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। উৎপত্তি ও গতিপ্রকৃতি অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের নদীগুলিকে পাঁচটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়, যথা:
গঙ্গা ভারতের তথা পশ্চিমবঙ্গের সর্ব প্রধান নদী। গঙ্গা নদী হিমালয় পর্বতের গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ নামে তুষার গুহা থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রথমে উত্তরপ্রদেশ এবং পরে বিহারের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রাজমহল পাহাড়ের কাছে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে কিছুদুর প্রবাহিত হয়ে মুর্শিদাবাদ জেলার মিঠিপুরের কাছে ভাগীরথী ও পদ্মা নামে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। গঙ্গার একটি শাখা ভাগীরথী-হুগলী নামে দক্ষিণ দিকে পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে, আর প্রধান শাখাটি পদ্মা নামে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথী–হুগলী নদীই গঙ্গা নামে পরিচিত। মুর্শিদাবাদ থেকে নবদ্বীপ শহর পর্যন্ত এই নদীর নাম ভাগীরথী এবং নবদ্বীপ থেকে মোহানা পর্যন্ত এই নদীর নাম হুগলী নদী। হুগলী নদীর দক্ষিণাংশে জোয়ার ভাঁটার প্রভাব দেখা যায়। অতিরিক্ত জল এনে কলকাতা বন্দরকে বাঁচানোর জন্য গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মিত হয়েছে।
ভাগীরথী-হুগলী নদীর পূর্ব দিকের নদীগুলির মধ্যে জলঙ্গী, ভৈরব, মাথাভাঙ্গা, চুর্ণী, ইছামতী, বিধ্যাধরি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই নদীগুলোর বেশির ভাগই পদ্মার শাখানদী। বর্ষাকাল ছাড়া বছরের অন্য সময়ে এই সব নদীতে বিশেষ জলপ্রবাহ থাকে না এবং বর্ষাকালে অতিবৃষ্টির ফলে প্রায়ই বন্যা দেখা যায়।
জলঙ্গী নদী :- জলঙ্গী নদীর দৈর্ঘ্য ২০৬ কিলোমিটার। জলঙ্গী নদী উত্তর-পশ্চিমাংশে নদিয়া-মুর্শিদাবাদ জেলার সীমান্ত বরাবর দক্ষিণ-পশ্চিম মুখে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর নদিয়া জেলার মাঝখান দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়ে নবদ্বীপের নিকট ভাগীরথী নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
ভাগীরথী-হুগলী নদীর পশ্চিম দিকের নদী গুলোর মধ্যে (১) ময়ূরাক্ষী, (২) অজয়, (৩) দামোদর, (৪) দ্বারকেশ্বর, (৫) শিলাবতী ( শিলাই), (৬) কংসাবতি (কাঁসাই), (৭) রূপনারায়ন, (৮) হলদি, (৯) কেলেঘাই, (১০) সুবর্ণরেখা প্রভৃতি নদী উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে অজয়, দামোদর ও ময়ূরাক্ষী নদী ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে এবং অন্যান্য নদীগুলো পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম দিকের মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়েছে। পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চলে উৎপন্ন হয়ে শিলাবতী ও দারকেশ্বর নদী দুটি মিলিত হয়ে রূপনারায়ণ নামে কিছু দূর প্রবাহিত হয়ে অবশেষে গেঁওখালির কাছে হুগলী নদীতে পতিত হয়েছে। এছাড়া কেলেঘাই ও কংসাবতী নদী যুক্ত হয়ে হলদি নদীর সৃষ্টি করেছে। এইসব নদীর মধ্যে কেবলমাত্র সুবর্ণরেখা নদীটি ওড়িশার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে, অন্য নদীগুলো ভাগীরথী-হুগলী নদীতে পতিত হয়েছে। এইসব নদী প্রধানত বৃষ্টির জলে পুষ্ট হওয়ায় নদীতে সারাবছর সমান জল প্রবাহ থাকে না এবং অতিবৃষ্টিতে বন্যার সৃষ্টি হয়।
দামোদর নদ : দামোদর পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম অংশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী। দামোদর নদীটি ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পালামৌ জেলার ছোটনাগপুর মালভূমির খামারপাত পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে উলুবেড়িয়ার কাছে ভাগীরথী-হুগলী নদীতে পতিত হয়েছে। বর্তমানে দামোদর নদের মুল প্রবাহ শীর্ণ হয়ে হুগলী নদীতে পড়েছে এবং এই নদীর বেশির ভাগ জল তার শাখা নদী মুন্ডেশ্বরীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। দামোদরের প্রধান শাখা মুন্ডেশ্বরী রূপনারায়ণ নদীতে মিশেছে।
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিকের নদীগুলির মধ্যে (১) মেচি, (২) বালাসন, (৩) মহানন্দা, (৪) তিস্তা, (৫) জলঢাকা, (৬) তোর্সা, (৭) রায়ডাক, (৮) সঙ্কোশ, (৯) কালজানি প্রভৃতি প্রধান। মহানন্দা ছাড়া এইসব নদী উত্তরের হিমালয় পর্বত থেকে উৎপন্ন হয়ে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার উপর দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তিস্তা উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী। হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হওয়ায় তিস্তা ও জলঢাকা নদী দুটি অত্যন্ত খরস্রোতা এবং এইসব নদীতে সারাবছরই জল থাকে। উত্তরবঙ্গের নদীখাতগুলি পলি, বালি ও নুড়ি প্রভৃতি জমে উঁচু হয়ে যাওয়ায় বর্ষার সময় এইসব নদীতে কখনও কখনও বন্যা দেখা যায়। এই নদীগুলির সমভূমি অংশে নৌকা চালানো যায়।
মাতলা, গোসাবা, বিদ্যাধরী, পিয়ালী, ইছামতী, কালিন্দী, রায়মঙ্গল, সপ্তমুখী, বড়তলা, জামিরা প্রভৃতি দক্ষিণবঙ্গ ও সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য নদনদী। প্রত্যেকটি নদীই দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। ইছামতী, মাতলা, হাড়িয়াডাঙা, সপ্তমুখি, জামিরা প্রভৃতি নদীগুলো বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের জলে পুষ্ট, তাই এদের জল লবণাক্ত। জোয়ারের সময় এই নদীগুলোতে নৌকা চালানো যায়।
পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমী প্রকৃতির। পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূপ্রকৃতি গত বৈচিত্র পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুর নিয়ন্ত্রক। উত্তরে হিমালয় পর্বত থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের বিস্তার এবং ভূমিরূপের নানান বৈচিত্র্য এই রাজ্যের বিভিন্ন অংশের বায়ুর উষ্ণতা, বায়ু প্রবাহ ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তারতম্য ঘটিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিক থেকে যতই উত্তর দিকে যাওয়া যায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ততই বাড়তে থাকে এবং তাপমাত্রা কমতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার পার্বত্য অঞ্চল ছাড়া সমস্ত পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু সাধারণভাবে উষ্ণ ও আর্দ্র এবং ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ুর দ্বারা প্রভাবিত। জলবায়ু অঞ্চল হিসাবে, পশ্চিমবঙ্গ গ্রীষ্মপ্রধান উষ্ণ মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত।
পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুকে মোটামুটি চারটি প্রধান ঋতুতে ভাগ করা যায়। যেমন— (১) শুষ্ক গ্রীষ্মকাল, (২) আর্দ্র গ্রীষ্মকাল, (৩) শরৎকাল ও (৪) শীতকাল। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বসন্তকাল ও হেমন্তকাল স্বল্পস্থায়ী। তাই পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুর ক্ষেত্রে এদের বিশেষ কোন প্রভাব নেই। বছরের বিভিন্ন ঋতুতে পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুতে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।
মার্চ মাস থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়ে পশ্চিমবঙ্গে গ্রীষ্মকাল বিরাজ করে। মার্চ মাস থেকে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়তে থাকে এবং মে মাসে উত্তাপ সর্বোচ্চ হয়। গ্রীষ্মকালে পশ্চিমবঙ্গের সমভূমি অঞ্চলের উত্তাপ ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠতে থাকে। এই সময় সমভূমি অঞ্চলের উষ্ণতা ২৬° সেলসিয়াস থেকে ৪৫° সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়। গ্রীষ্মকালে পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চলে উত্তাপের প্রকোপ তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি হয় এবং মালদহ অঞ্চলে দুপুরে উত্তপ্ত ‘লু’ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকে। গ্রীষ্মকালে পশ্চিমবঙ্গের গড় উত্তাপ ২০° থেকে ৩০° সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। তবে স্থানে স্থানে গড় তাপমাত্রার পার্থক্য দেখা যায়। দুর্গাপুর, আসানসোল প্রভৃতি স্থানে তাপমাত্রা ৪০° থেকে ৪৫° সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে। তবে উচ্চতার জন্য জলপাইগুড়িতে এবং সমুদ্রের নিকটবর্তী হওয়ায় সাগর দ্বীপে তাপমাত্রা ২০° সেলসিয়াসের নিচে থাকে। পর্বতের উঁচু স্থানে অবস্থিত হওয়ায় গ্রীষ্মকালে শিলিগুড়ি বাদে দার্জিলিং জেলার আবহাওয়া খুব মনোরম ও আরামদায়ক হয়। মোটামুটিভাবে ১৪° থেকে ১৭° সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের সমভূমি অঞ্চলে এপ্রিল-মে মাসে কালবৈশাখী ঝড় হয়। কালবৈশাখীর স্বল্পস্থায়ী বৃষ্টিপাতের সঙ্গে প্রবল ঝড়, বজ্রপাত ও প্রচুর শিলাবৃষ্টি হয়।
আর্দ্র গ্রীষ্মকালকে মৌসুমি বায়ুর আগমনের কাল বা বর্ষাকাল বলে জুন মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ে পশ্চিমবঙ্গে বর্ষাকাল থাকে। গ্রীষ্মের প্রচন্ড উত্তাপের ফলে পশ্চিমবঙ্গ সহ উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চলে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। এর ফলে বঙ্গোপসাগরের উচ্চচাপ কেন্দ্র থেকে জলীয় বাষ্পপূর্ণ আর্দ্র বায়ু ওই নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে ছুটে আসে। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের ফলে ১৫ই জুনের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে প্রবল বর্ষণ শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গের গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ১৮০ সেন্টিমিটার, এর মধ্যে প্রায় ১২৫ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত বর্ষাকালেই হয়ে থাকে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে ক্রমশ বাড়তে থাকে। বর্ষাকালে পশ্চিমবঙ্গের স্থান বিশেষে ১৩০ থেকে ৪০০ সেন্টিমিটারেরও বেশি বৃষ্টিপাত হয়। উত্তরবঙ্গে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি গড় ৩০০ সেমির মতো এবং পশ্চিমাংশে মালভূমি অঞ্চলে সবচেয়ে কম, গড়ে ১৫০ সেমি.।
শরৎকালকে মৌসুমি বায়ুর প্রত্যাবর্তন কাল বলে। অক্টোবর মাস থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে শরৎকাল বিরাজ করে। শরৎকালকে বর্ষার বিদায়ী কাল বলা হয়। অক্টোবর মাস থেকে নভেম্বর মাস এই দুই মাসে বৃষ্টি ও উষ্ণতা দুইই কমে থাকে। উষ্ণতা ২০° থেকে ২৫° সেলসিয়াস হয়। রাত্রিতে একটু একটু শীত-শীত বোধ হয় এবং ভোরবেলা শিশির পড়ে। সময়টা খুব আরামদায়ক। তবে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ এবং ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তির ফলে হঠাৎ আসা ঘূর্ণবাত বা ‘আশ্বিনের ঝড়’ মাঝে মাঝে উপদ্রবের সৃষ্টি করে। কালবৈশাখীর ঝড়ের তুলনায় এই ঝড় বেশি অনিষ্টকর। অনেক সময় সমুদ্র উত্তাল হয়ে উপকূলের ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
ডিসেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি মাস, এই তিন মাস পশ্চিমবঙ্গে শীতকাল। উত্তরে দার্জিলিং-এর পার্বত্য অঞ্চল বাদে পশ্চিমবঙ্গের অন্যত্র শীতকালে গড়ে তাপমাত্রা থাকে ১৩° থেকে ১৯° সেলসিয়াস। দার্জিলিংয়ের পার্বত্য অঞ্চলে শীত সবচেয়ে বেশি, 0° থেকে ৫° সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়। এই সময় দার্জিলিং-এ মাঝে মাঝে তুষারপাতও হয়। শীতকালে পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চলেও উষ্ণতা কমে যায়। এই অঞ্চলে শীত ও গ্রীষ্মের উষ্ণতার পার্থক্য খুব বেশি। অর্থাৎ গ্রীষ্মে উত্তাপ খুব বেশি এবং শীতে উত্তাপ খুব কম। পশ্চিমবঙ্গে শীতকালে সাধারণত বৃষ্টিপাত হয় না, তবে পশ্চিমাবায়ুর প্রভাবে ঝড়ো বাতাস ও অল্প বৃষ্টিপাত হয়। কলকাতা ও আশপাশে শীতকালে ভোরের দিকে কুয়াশা হয়।
একমাত্র শিলিগুড়ি মহকুমা বাদে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার বাকি অংশ হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলের অন্তর্গত। বেশি উচ্চতায় অবস্থিত হওয়ার ফলে দার্জিলিং জেলার পার্বত্য অংশে পশ্চিমবঙ্গের সমতলভূমির তুলনায় তাপমাত্রা অনেক কম। ফলে গ্রীষ্মকালে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অঞ্চলের লোকেরা যখন প্রচন্ড গরমে হাঁসফাঁস করে, তখন দার্জিলিং পাহাড়ের লোকেরা শীতের হাত থেকে বাঁচতে গরম পোশাক পরে। গ্রীষ্মকালে পশ্চিমবঙ্গের বাকি অংশে যখন অসহ্য গরম, তখন পার্বত্য অঞ্চলের আবহাওয়া খুবই মনোরম থাকে। দার্জিলিং-এর পার্বত্য অঞ্চলের গ্রীষ্মকালীন গড় উষ্ণতা হল ১৫° সেলসিয়াস। এই সময় পার্শ্ববর্তী জলপাইগুড়ি জেলার সমতল অংশে তাপমাত্রা প্রায় ২০° সেলসিয়াসের কাছাকাছি থাকে। শীতকালে দার্জিলিং জেলার পার্বত্য অঞ্চলে প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ে। শীতকালে দার্জিলিং অঞ্চলের তাপমাত্রা মাত্র ২° সেলসিয়াস বা তারও নিচে নেমে যায়। এই অঞ্চলের শীতকালীন গড় উষ্ণতা ২° সেলসিয়াস হলেও, অনেক সময় সর্বনিম্ন উষ্ণতা হিমাঙ্কের নিচে চলে যায়। শীতকালে দার্জিলিং শহর ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলে মাঝে মাঝে তুষারপাত হয়। বর্ষাকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সুউচ্চ হিমালয় পর্বতের গায়ে ধাক্কা খেয়ে দার্জিলিং-এর পার্বত্য অঞ্চলে তুমুল শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত ঘটায়। এই জন্য পশ্চিমবঙ্গের অন্য সব অঞ্চলের তুলনায় এই অঞ্চলের গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক বেশি। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ৪০০ সেন্টিমিটার। বর্ষাকালের পর শরৎকাল এলে দার্জিলিং জেলার আবহাওয়া আবার মনোরম হয়ে ওঠে। মনোরম আবহাওয়া ও জলবায়ুর জন্য গ্রীষ্ম ও শরৎকালে সারা পৃথিবী থেকে বহু পর্যটক এই অঞ্চলে বেড়াতে আসেন। তাই এখানকার দার্জিলিং, সান্দাকফু, কালিম্পং, লাভা, মিরিক প্রভৃতি স্থানে বহু পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।
১. পার্বত্য মৃত্তিকা: পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে এই মৃত্তিকা পাওয়া যায় । এই মৃত্তিকার রং কালো ও ধূসর। মোটামুটি উর্বর ও পডসল মৃত্তিকা। এই মৃত্তিকা চা চাষের পক্ষে উপযুক্ত। কমলালেবু এবং সিঙ্কোনা বৃক্ষ এই মৃত্তিকাতে ভালো জন্মায়। ২. প্রাচীন পলি গঠিত মৃত্তিকা: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ, উত্তর দিনাজপুর ,বীরভূম এবং বীরভূমের পূর্বাংশে এই মৃত্তিকা পাওয়া যায়। এই মৃত্তিকা বয়সে প্রবীণ ।মাঝারি উর্বর প্রকৃতির।ভাঙ্গর নামে পরিচিত। এই মৃত্তিকা তে ধান, গম, আখ তুঁতে ভালো জন্মায়। ৩. নবীন পলিগঠিত মৃত্তিকা: মুর্শিদাবাদ ,নদিয়া ,উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি ও পূর্ব মেদিনীপুরে এই মৃত্তিকা পাওয়া যায়। এই মৃত্তিকা বয়সে নবীন উর্বর প্রকৃতির ও খাদার নামে পরিচিত। এই মৃত্তিকা তে ধান, গম, পাট প্রভৃতি চাষ হয়। ৪. ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা: সমগ্র পুরুলিয়া ,বীরভূম ,বাঁকুড়া ,বর্ধমান,পশ্চিম মেদিনীপুরের পশ্চিমাংশে এই মৃত্তিকা পাওয়া যায়, এই মৃত্তিকা ইটের মতো শক্ত ও অনুর্বর প্রকৃতির এবং জলধারন ক্ষমতা অন্যান্য মৃত্তিকার চেয়ে কম। ৫. লাল মাটি: পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমে মালভূমি অঞ্চলে লাল মাটি দেখা যায়। এই অঞ্চলকে রাঢ় অঞ্চল বলা হয়।এই প্রকৃতির মৃত্তিকা অনুর্বর ও জলধরন ক্ষমতা কম। ৬. লবণাক্ত মাটি: পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন ও কাঁথি উপকূলে এই মৃত্তিকা দেখতে পাওয়া যায়। এই মাটিতে লবণের পরিমাণ বেশি থাকে। এই মাটিতে নারকেল সুপারি তরমুজ ইত্যাদি ফসল জন্মায়।
১ কার্তিক চন্দ্র মন্ডল, ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের ভূগোল
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article পশ্চিমবঙ্গের ভূগোল, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.