এই অনুচ্ছেদটি রাশিয়া ও তার পূর্বসূরি রাষ্ট্রসমূহ যেসব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, সেসব যুদ্ধে রুশ সামরিক বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত যুদ্ধাপরাধসমূহের বিবরণ।
১৫৮০ সালে রুশ সাম্রাজ্য এবং তাদের কসাক মিত্ররা সাইবেরিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার করতে আরম্ভ করে। সাইবেরিয়া দখলের প্রক্রিয়ায় রুশ ও কসাকরা সাইবেরিয়ার বহুসংখ্যক আদি অধিবাসীকে হত্যা করে। যেমন- কামচাটকায় বসবাসকারী ২০,০০০ স্থানীয় অধিবাসীর মধ্যে প্রায় ১২,০০০ কসাকদের হাতে নিহত হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে রুশ আমুর অঞ্চলের আদিবাসীদের আক্রমণ করে। স্থানীয়রা রুশ আক্রমণকারীদের বর্বরতার জন্য তাদের লাল দাঁড়ি নামকরণ করে ('লাল দাঁড়ি' বৌদ্ধ রূপকথার এক ধরনের দানব)।
১৬৪০-এর দশকে লেনা নদীর নিকটে রুশ অগ্রাভিযানের সময় বহুসংখ্যক ইয়াকুত নিহত হয়, এবং ১৬৯০-এর দশকে রুশরা কামচাটকায় অসংখ্য কোরিয়াক, কামচাদাল ও চুকচি জাতির মানুষকে হত্যা করে।
১৭২৯ সালে চুকচিরা রুশদেরকে পরাজিত করলে রুশ সেনাপতি মেজর পাভলুতস্কিকে চুকচিদের বিরুদ্ধে অভিযানের দায়িত্ব দেয়া হয়। তার অধীনে রুশ সৈন্যরা ১৭৩০–১৭৩১ সালে চুকচিদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় লিপ্ত হয় এবং চুকচি নারী ও শিশুদের দাসে পরিণত করে। ১৭৪২ সালে রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথ চুকচি ও কোরিয়াকদের তাদের বাসভূমি থেকে বিতাড়িত করার এবং তাদের সংস্কৃতি ধ্বংস করে ফেলার নির্দেশ দেন। কিন্তু রুশদের এই অভিযান ব্যর্থ হয়। ১৭৪৪ এবং ১৭৫৩–১৭৫৪ সালে কোরিয়াকদের বিরুদ্ধেও গণহত্যার অভিযান চালায়। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে কামচাদালদের ৯০% এবং মানসিদের ৫০% রুশ ও কসাকদের হাতে প্রাণ হারায়। রুশ বিজয়ের পর অ্যালিউতরাও রুশ ও কসাকদের দ্বারা হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও অন্যান্য অপরাধের শিকার হয়।
১৭৩৫–১৭৩৯ সালের রুশ–তুর্কি যুদ্ধের সময় রুশ বাহিনী দখলকৃত অঞ্চলে হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপসহ নানা ধরনের যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হয়। ১৭৩৬ সালে রুশ বাহিনী অটোমান তুর্কিদের করদরাজ্য ক্রিমিয়ান খানাত আক্রমণ করে। এই আক্রমণকালে রুশ সৈন্যরা হাজার হাজার ক্রিমিয়ান তাতার নারী-পুরুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। তারা ক্রিমিয়ার শত শত গ্রাম ও নগর জ্বালিয়ে দেয় এবং বহু স্মৃতিসৌধ, গ্রন্থাগার, বিদ্যালয় ও ধর্মীয় উপাসনালয় ধ্বংস করে দেয়। পরবর্তী বছরে রুশ বাহিনী আবার ক্রিমিয়া, অ্যাজোভ ও ওজাকভে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের সময় রুশ সৈন্যরা ৬,০০০ বাসগৃহ, ৩৮টি মসজিদ, ২টি গির্জা এবং ৫৫টি কারখানা ধ্বংস করে দেয়।
রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখলের প্রেক্ষিতে ১৭৮৭ সালে রাশিয়া ও অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধের সময় রুশ সামরিক নেতাদের নির্দেশে রুশ সৈন্যরা অটোমান সাম্রাজ্যের নিকট হতে দখলকৃত প্রতিটি শহরের সকল অধিবাসীকে হত্যা করে।
১৮৬৪ সালে ককেশাস বিজয়ের পর রুশ সরকার সার্কাশীয়দের ককেশাস থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে ৬ লক্ষ থেকে ১৫ লক্ষ সার্কাশীয় রুশ সৈন্যদের হাতে প্রাণ হারায় এবং আরো প্রায় ১৫ লক্ষ সার্কাশীয় নিজ বাসভূমি থেকে বিতাড়িত হয়।
১৯০৪–১৯০৫ সালে রুশ–জাপান যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধের অন্যতম প্রধান রণাঙ্গন ছিল চীন সাম্রাজ্যের মাঞ্চুরিয়া। এই যুদ্ধের সময় রুশ সৈন্যরা মাঞ্চুরিয়ায় বহু চীনা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, অসংখ্য চীনা নারীকে ধর্ষণ করে এবং যারা তাদের এসব কর্মকাণ্ডে বাধা দিয়েছিল তাদের মেরে ফেলে। রুশদের ধারণা ছিল, যেহেতু চীনারা এশীয়, তারা নিশ্চয়ই রাশিয়াকে পরাজিত করার জন্য এশীয় জাপানিদের সহযোগিতা করছে, কাজেই তাদের শাস্তি পাওয়া উচিত। রুশ সৈন্যরা 'পীত আতঙ্কে' ভুগছিল, এবং কেবল জাপানিদের নয়, সকল এশীয়কেই শত্রু হিসেবে দেখছিল। তাদের এই মনোভাবের কারণে চীনা জনগণ অশেষ দুর্ভোগের শিকার হয়।
১৯৩৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিনল্যান্ড আক্রমণ করে এবং প্রথম ফিনিশ–সোভিয়েত যুদ্ধ শুরু হয়। ফিনল্যান্ডের ওপর নির্বিচার সোভিয়েত বিমান হামলার ফলে ৯৫৭ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয় এবং হাজার হাজার সাধারণ মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তীব্র সোভিয়েত বিমান হামলার ফলে ফিনল্যান্ডের ভিপুরি শহরটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরপেক্ষ ইরানকে আক্রমণ করে। ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট সোভিয়েত বিমানবাহিনীর ভারী বোমারু বিমানসমূহ বন্দর পাহলভী ও রেশতসহ ইরানের গিলান প্রদেশ জুড়ে বিমান হামলা চালায়। এই হামলায় কমপক্ষে ২০০ জন বেসামরিক ইরানি নিহত হয়। পরবর্তীতে ইরানের উর্মিয়া শহরে সোভিয়েত বিমান হামলায় ১২ জনেরও বেশি বেসামরিক ইরানি নিহত হয় এবং শহরটির বাজারের অধিকাংশ ধ্বংস হয়ে যায়। হামাদান শহরে সোভিয়েত বিমান হামলায় একটি শিশু প্রাণ হারায়।
১৯৪৪ সালে সোভিয়েত বাহিনী পোল্যান্ড থেকে দখলদার জার্মান বাহিনীকে বিতাড়িত করে সাময়িকভাবে পোল্যান্ড দখল করে। এসময় সোভিয়েত সৈন্যরা পোলিশ জনগণের বিরুদ্ধে লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অন্যান্য অপরাধে লিপ্ত হয় তারা জার্মানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকারী বহু পোলিশ মুক্তিযোদ্ধাকে গ্রেপ্তার করে এবং দনেতস্ক অঞ্চলের শ্রম শিবিরে প্রেরণ করে। কেবল ১৯৪৫ সালেই সোভিয়েতরা ৫০,০০০ পোলিশ নাগরিককে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন শ্রম শিবিরে প্রেরণ করে। তাছাড়া, ১৯৪৪–১৯৪৭ সালে এক লক্ষেরও বেশি পোলিশ নারী সোভিয়েত সৈন্যদের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়।
সোভিয়েত বাহিনীর বুদাপেস্ট অবরোধকালে বিভিন্ন কারণে প্রায় ৩৮,০০০ বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারায়: এদের মধ্যে ১৩,০০০ হাঙ্গেরীয় সরাসরি সোভিয়েত আক্রমণের ফলে নিহত হয়। সোভিয়েতরা শহরটি দখলের পর ব্যাপক হারে লুটতরাজ, নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও গণধর্ষণ আরম্ভ করে দেয়। প্রায় ২,০০,০০০ হাঙ্গেরীয় নারী সোভিয়েত সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়। হাঙ্গেরীয় মেয়েদের অপহরণ করে সোভিয়েত সেনাঘাঁটিগুলোতে নিয়ে যাওয়া হত, যেখানে তাদের বারবার ধর্ষণ করা হত এবং কখনো কখনো হত্যা করা হত। সোভিয়েত সৈন্যরা এমনকি বুদাপেস্টে অবস্থিত নিরপেক্ষ দেশগুলোর দূতাবাস কর্মীদেরও গ্রেপ্তার ও ধর্ষণ করে, উদাহরণস্বরূপ, সোভিয়েত সৈন্যরা শহরটিতে অবস্থিত সুইডিশ দূতাবাসে আক্রমণ চালিয়ে দূতাবাসের একজন নারী কর্মীকে ধর্ষণ করেছিল।
১৯৪৫ সালের এপ্রিলে সোভিয়েত সৈন্যরা ভিয়েনা দখল করে। ভিয়েনা দখলের পরপরই সোভিয়েত সৈন্যরা শহরটিতে নির্বিচার লুটতরাজ আরম্ভ করে দেয় এবং অসংখ্য অস্ট্রীয় নারীকে ধর্ষণ করে।
১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে সৈন্য প্রেরণ করে এবং আফগানিস্তানের সমাজতান্ত্রিক সরকারের বিরোধী মুজাহিদদের সঙ্গে দীর্ঘ দশ বছরব্যাপী এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধের সময় সোভিয়েত সৈন্যরা গণহত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষণসহ নানা ধরনের যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হয়। দশ বছরব্যাপী দখলদারিত্বের সময় সোভিয়েত বাহিনীর হাতে ৮,০০,০০০ থেকে ২০,০০,০০০ বেসামরিক আফগান প্রাণ হারায়। বিশেষত আফগানিস্তানের নগরহার, গজনী, জাবুল, লাঘাম, কুনার, কান্দাহার, বাদাখশান প্রভৃতি প্রদেশে সোভিয়েত বাহিনী ব্যাপক হারে গণহত্যা চালায়। এর পাশাপাশি বুবি ট্র্যাপ, মাইন এবং রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করে তাদের শস্য ও সেচব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়। তদুপরি, সোভিয়েত সৈন্যরা অসংখ্য আফগান নারীকে অপহরণ ও ধর্ষণ করে। যেসব নারী সোভিয়েত সৈন্যদের দ্বারা অপহৃত ও ধর্ষিত হয়, তারা বাড়ি ফিরলে তাদের পরিবার তাদেরকে 'অসম্মানিত' হিসেবে বিবেচনা করে এবং তারা সামাজিক লাঞ্ছনার শিকার হয়।
১৯৯৪ সালে রুশ সৈন্যরা চেচেনদের স্বাধীনতা অর্জনের প্রচেষ্টা নস্যাৎ করার জন্য চেচনিয়ায় আক্রমণ চালায়। প্রায় দুই বছরব্যাপী এই যুদ্ধে রুশ বাহিনীর হাতে চেচনিয়ার প্রায় ৮০,০০০ বেসামরিক অধিবাসী প্রাণ হারায়। কেবল গ্রোজনিতেই রুশ বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণের ফলে ৩৫,০০০ বেসামরিক নারী-পুরুষ নিহত হয়, যাদের মধ্যে প্রায় ৫,০০০ শিশুও ছিল। নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি রুশ সৈন্যরা ব্যাপক হারে লুটতরাজে লিপ্ত হয় এবং অসংখ্য চেচেন নারীকে ধর্ষণ করে। তদুপরি, রুশ আক্রমণের ফলে চেচনিয়ার ৫ লক্ষেরও বেশি অধিবাসী উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article রুশ যুদ্ধাপরাধসমূহ, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.