শাফায়াত জামিল

কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) শাফায়াত জামিল (জন্ম: ১ মার্চ ১৯৪০ — মৃত্যু: ১১ আগস্ট ২০১২) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর বিক্রম খেতাব প্রদান করে।

কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল
শাফায়াত জামিল
জন্ম(১৯৪০-০৩-০১)১ মার্চ ১৯৪০
মৃত্যু১১ আগস্ট ২০১২(2012-08-11) (বয়স ৭২)
সমাধিবনানী কবরস্থান
জাতীয়তাবাংলাদেশী
নাগরিকত্বশাফায়াত জামিল ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত)
শাফায়াত জামিল পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে)
শাফায়াত জামিল বাংলাদেশ
মাতৃশিক্ষায়তনঢাকা কলেজ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি
পেশাসামরিক কর্মকর্তা
পরিচিতির কারণবীর বিক্রম
সামরিক পরিষেবা
শাখা Bangladesh Army seal বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
শাফায়াত জামিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী
কাজের মেয়াদ১৯৭১–১৯৮০ (বাংলাদেশ),
১৯৬২–১৯৭১ (পাকিস্তান)

প্রারম্ভিক জীবন

শাফায়াত জামিল ১৯৪০ সালের ১ মার্চ কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার খড়গমারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম এ এইচ এম করিমউল্লাহ এবং মায়ের নাম লায়লা জোহরা বেগম। তার পিতা এএইচ করিমুল্লাহ ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (জুডিশিয়াল) অফিসার ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম রাশিদা শাফায়াত। তাদের তিন ছেলে। শাফায়াত জামিল ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ঐ একাডেমীতে জেনারেল পারভেজ মুশাররফের (পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপতি) সহপাঠী ছিলেন।

কর্মজীবন

শাফায়াত জামিল ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশনপ্রাপ্ত হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল কুমিল্লা সেনানিবাসে। সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসনের কথা বলে পাকিস্তানি সেনারা এই রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানিকে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঠায়। একটি কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের সংবাদ পেয়ে তিনি তার ও অপর কোম্পানির সবাইকে নিয়ে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রতিরোধপর্বে আশুগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আখাউড়া-গঙ্গাসাগর এলাকায় যুদ্ধ করেন। এরপর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মতিনগরে যান। তাকে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি দেওয়ানগঞ্জ, সিলেটের ছাতকসহ আরও কয়েক স্থানে যুদ্ধ করেন।

মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে জামিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মেজর পদে উন্নীত হন এবং ২৬ মার্চ সদ্য স্বাধীনতা ঘোষণা করা বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার খবর জানতে পেরে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী অন্যান্য বাঙালী অফিসার এবং ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের (ডাকনাম বেবি টাইগার্স) সেনাদের সাথে সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন। ১০ অক্টোবর সিলেট সেক্টরে বদলি হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সেক্টর-১১ এর অধীনে বাংলাদেশ ফোর্সের (BDF) অফিসার হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। জুন মাসে তিনি সেক্টর ১১ এর অধীনে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার হিসাবে নিয়োগ পান, এই সেক্টরের সেক্টর কামান্ডার ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান, যিনি পরবর্তীতে জেড ফোর্স ব্রিগেড গঠন করেছিলেন। ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছোট এবং বড় আকারের গেরিলা অভিযানে অংশ নিয়েছিলো। এছাড়াও জিয়া জামিলকে তেল ঢাকা এলাকা মুক্ত এবং নিরাপদ রাখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। লেফট্যানেন্ট নুরুন্নবী এবং আনোয়ার মেজর জামিলকে এই এলাকার প্রথমিক প্রশাসনিক কার্যকলাপে সহায়তা করেছিলেন। ২৭ আগস্ট প্রথম ডাকঘর এবং দুটি সাব পোস্ট-অফিসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জিয়ার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন তিনি। ১১ অক্টোবর ১৯৭১ মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সিলেটের ছাতকের যুদ্ধে অংশ নেয়। ছাতক অপারেশন সফল না হলেও ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ৩৬৪ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করে।

১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোর্খা রেজিমেন্টের তিনটি কোম্পানি সিলেটের রাধানগরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ করে। কিন্তু তাদের সেই আক্রমণ ব্যর্থ হয়। পাকিস্তানিদের পাল্টা আক্রমণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় তখন। এরপর মিত্রবাহিনীর জেনারেল গিল নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক শাফায়াত জামিলের ওপর দায়িত্ব দিয়ে সিলেটের রাধানগর এলাকার ছোটখেল মুক্ত করান। প্রথাগত সামরিক যুদ্ধে এক কোম্পানি বা তার কম সেনা থাকলে ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক সাধারণত যুদ্ধের ময়দানে না গেলেও শাফায়াত জামিল নিজেই ওই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। যোদ্ধা হিসেবে গোর্খাদের সুনাম পৃথিবীব্যাপী। ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোর্খা রেজিমেন্টের জন্য দুরূহ কাজটি শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সম্ভব করেন। ২৭ নভেম্বর গভীর রাতে অভিযানটি শুরু হয়। ধানখেতের মধ্য দিয়ে প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা এগিয়ে চললেন পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের দিকে। সবার সামনে ছিলেন শাফায়াত জামিল ও কোম্পানি অধিনায়ক এস আই নূরুন্নবী খান। পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের কাছাকাছি গিয়ে তিনি অগ্রসর হলেন বাঁ দিক থেকে এবং এস আই নূরুন্নবী ডান দিক দিয়ে। ক্ষিপ্রতার সঙ্গে গুলি করতে করতে তারা পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন বাংকারের দিকে এগিয়ে চললেন। কয়েকটি বাংকারে হাতাহাতি যুদ্ধ হলো। প্রচণ্ড আক্রমণের তীব্রতায় কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনারা সেখান থেকে পালিয়ে গেল। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যেই ছোটখেল মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে এল। নিহত হলো অসংখ্য পাকিস্তানি সেনা। আশপাশে চলছিল বিক্ষিপ্ত গোলাগুলি। চারদিকে মৃত পাকিস্তানি সেনাদের লাশ, অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। ভোরের আলোয় শাফায়াত জামিল তদারক করছেন অবস্থান সুদৃঢ় করার কাজ। এমন সময় তার ডান কোমরে গুলি লাগে। ছিটকে পড়েন তিনি, গুরুতর আহত হন। সহযোদ্ধারা তাকে ফিল্ড হাসপাতালে পাঠান।

যুদ্ধের পরে

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে জামিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন এবং বীর বিক্রম পদক লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি কর্নেল পদে উন্নীত হন এবং ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর তিনি এবং খালেদ মোশাররফ খন্দকার মোস্তাক আহমদের বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থান ঘটান। ৬ নভেম্বর মোস্তাক রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম তার স্থলাভিষিক্ত হন। ৭ নভেম্বর এক পাল্টা অভ্যুত্থানে খালেদ মোশাররফকে হত্যা করা হয় এবং কর্নেল জামিল গ্রেফতার হন। জামিল ১৯৮০ সালের ২৬ মার্চ সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত হন।

মৃত্যু

জামিল ২০১২ সালের ১১ আগস্ট ঢাকার উত্তরায় নিজ বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

পুরস্কার ও সম্মাননা

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

  • "জীবন যুদ্ধ: যুদ্ধের জীবন" লে কর্নেল নুরুন নবী খান
  • জামিল, শাফাত, "৭১ স্বাধীনতা যুদ্ধ - রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট এবং নভেম্বর ষড়যন্ত্র"
  • বাংলাদেশ সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলন ১৯৭১

Tags:

শাফায়াত জামিল প্রারম্ভিক জীবনশাফায়াত জামিল কর্মজীবনশাফায়াত জামিল মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকাশাফায়াত জামিল যুদ্ধের পরেশাফায়াত জামিল মৃত্যুশাফায়াত জামিল পুরস্কার ও সম্মাননাশাফায়াত জামিল তথ্যসূত্রশাফায়াত জামিল আরও পড়ুনশাফায়াত জামিলআগস্ট ১১বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধবীর বিক্রমমার্চ ১

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

জসীম উদ্‌দীনমুজিবনগর সরকারহরমোনবিশ্ব দিবস তালিকানরেন্দ্র মোদীহিন্দুধর্মের ইতিহাসইউরোপস্বরধ্বনিযোনিহারুন-অর-রশিদ (পুলিশ কর্মকর্তা)বাংলাদেশের কোম্পানির তালিকাসুভাষচন্দ্র বসুমহাদেশসুফিয়া কামালসমাজবিজ্ঞানগাঁজা (মাদক)সাঁওতালমাইকেল মধুসূদন দত্তরাজশাহীআয়িশামৌলসমূহের ইলেকট্রন বিন্যাস (উপাত্ত পাতা)দৈনিক প্রথম আলোআফগানিস্তানফাতিমা২০২৪ ইসরায়েলে ইরানি হামলাআবু মুসলিমক্রিকেটবাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনদারুল উলুম দেওবন্দহামাসকবিতাআলিভারতের রাষ্ট্রপতিদ্য কোকা-কোলা কোম্পানিকৃত্তিবাসী রামায়ণবৃষ্টিবঙ্গবন্ধু সেতুবারো ভূঁইয়াপূরণবাচক সংখ্যা (ভাষাতত্ত্ব)বাংলাদেশের বিভাগসমূহবাংলাদেশের একাডেমিক গ্রেডিং পদ্ধতিসমাজকারাগারের রোজনামচাবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধডাচ্-বাংলা ব্যাংক পিএলসিডায়ানা, প্রিন্সেস অব ওয়েলসরঙের তালিকাদৌলতদিয়া যৌনপল্লিবাংলা শব্দভাণ্ডারদিনাজপুর জেলাবাংলাদেশের পোস্ট কোডের তালিকাতাহসান রহমান খানচেন্নাই সুপার কিংসবাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসইতালিশিয়া ইসলামের ইতিহাসআবুল কাশেম ফজলুল হকসিরাজউদ্দৌলাজ্ঞানশেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০শক্তিকানাডাশুক্রাণুআব্বাসীয় বিপ্লবলগইনইসতিসকার নামাজবাংলাদেশে পালিত দিবসসমূহজাতীয় সংসদইসলামে বিবাহআতাভাইরাসপদ্মা সেতুউসমানীয় খিলাফতভূমণ্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধিআরব্য রজনী🡆 More