রাখীবন্ধন

রাখীবন্ধন উৎসব বা রাখীপূর্ণিমা দক্ষিণ এশিয়ার একটি উৎসব। এই উৎসব ভাই ও বোনের মধ্যে প্রীতিবন্ধনের উৎসব। হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ ও শিখরা এই উৎসব পালন করে। এই দিন দিদি বা বোনেরা তাদের ভাই বা দাদার হাতে রাখী নামে একটি পবিত্র সুতো বেঁধে দেয়। এই রাখীটি ভাই বা দাদার প্রতি দিদি বা বোনের ভালবাসা ও ভাইয়ের মঙ্গলকামনা এবং দিদি বা বোনকে আজীবন রক্ষা করার ভাই বা দাদার শপথের প্রতীক। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব উদযাপিত হয়।

রাখীবন্ধন
রাখীবন্ধন
রাখী বাঁধা হচ্ছে
আনুষ্ঠানিক নামরাখীবন্ধন উৎসব
রাখীপূর্ণিমা
অন্য নামরাখী
পালনকারীহিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ, শিখ
ধরনসাংস্কৃতিক
তারিখ১১ই আগস্ট ২০২২
৩০শে আগস্ট ২০২৩
সংঘটনবার্ষিক
সম্পর্কিতভাইবোন
বন্ধুত্ব
ভাইফোঁটা

অনুষ্ঠান

রাখীবন্ধন উৎসবের দিন দিদি বা বোনেরা তাদের ভাই বা দাদার হাতের কবজিতে রাখী নামে একটি পবিত্র সুতো বেঁধে দেয়। পরিবর্তে ভাই বোনকে উপহার দেয় এবং সারাজীবন তাকে রক্ষা করার শপথ নেয়। এরপর ভাই-বোন পরস্পরকে মিষ্টি খাওয়ায়। উত্তর ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ে সহোদর ভাইবোন ছাড়াও জ্ঞাতি ভাইবোন এবং অন্যান্য আত্মীয়দের মধ্যেও রাখীবন্ধন উৎসব প্রচলিত। অনাত্মীয় ছেলেকেও ভাই বা দাদা মনে করে রাখী পরানোর রেওয়াজ রয়েছে।

রাখীবন্ধন 
একটি মহিলা রাখির কেনাকাটা করছেন
রাখীবন্ধন 
কব্জিতে রাখি বাঁধা

পৌরাণিক রাখীবন্ধন

কৃষ্ণ ও দ্রৌপদী

মহাভারতে আছে, একটি যুদ্ধের কৃষ্ণের কবজিতে আঘাত লেগে রক্তপাত শুরু হলে পাণ্ডবদের স্ত্রী দ্রৌপদী তাঁর শাড়ির আঁচল খানিকটা ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাতে বেঁধে দেন। এতে কৃষ্ণ অভিভূত হয়ে যান। দ্রৌপদী তাঁর অনাত্মীয়া হলেও, তিনি দ্রৌপদীকে নিজের বোন বলে ঘোষণা করেন এবং দ্রৌপদীকে এর প্রতিদান দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। বহু বছর পরে, পাশাখেলায় কৌরবরা দ্রৌপদীকে অপমান করে তাঁর বস্ত্রহরণ করতে গেলে কৃষ্ণ দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করে সেই প্রতিদান দেন। এইভাবেই রাখীবন্ধনের প্রচলন হয়।

বলিরাজা ও লক্ষ্মী

অন্য একটি গল্পে রয়েছে, দৈত্যরাজা বলি ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। বিষ্ণু বৈকুণ্ঠ ছেড়ে বালির রাজ্য রক্ষা করতে চলে এসেছিলেন। বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী স্বামীকে ফিরে পাওয়ার জন্য এক সাধারণ মেয়ের ছদ্মবেশে বলিরাজের কাছে আসেন। লক্ষ্মী বলিকে বলেন, তাঁর স্বামী নিরুদ্দেশ। যতদিন না স্বামী ফিরে আসেন, ততদিন যেন বলি তাঁকে আশ্রয় দেন। বলিরাজা ছদ্মবেশী লক্ষ্মীকে আশ্রয় দিতে রাজি হন। শ্রাবণ পূর্ণিমা উৎসবে লক্ষ্মী বলিরাজার হাতে একটি রাখী বেঁধে দেন। বলিরাজা এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে লক্ষ্মী আত্মপরিচয় দিয়ে সব কথা খুলে বলেন। এতে বলিরাজা মুগ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে বৈকুণ্ঠে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। বলিরাজা বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেন। সেই থেকে শ্রাবণ পূর্ণিমা তিথিটি বোনেরা রাখীবন্ধন হিসেবে পালন করে।

সন্তোষী মা

বলিউডের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র জয় সন্তোষী মা-এ (১৯৭৫) রক্ষাবন্ধন সংক্রান্ত একটি গল্প বলা হয়েছে। রাখীবন্ধনের দিন গণেশের বোন গণেশের হাতে একটি রাখী বেঁধে দেন। এতে গণেশের দুই ছেলে শুভ ও লাভের হিংসে হয়। তাদের কোনো বোন ছিল না। তারা বাবার কাছে একটা বোনের বায়না ধরে। গণেশ তখন তাঁর দুই ছেলের সন্তোষ বিধানের জন্য দিব্য আগুন থেকে একটি কন্যার জন্ম দেন। এই দেবী হলেন গণেশের মেয়ে সন্তোষী মা। সন্তোষী মা শুভ ও লাভের হাতে রাখী বেঁধে দেন।

ঐতিহাসিক রাখীবন্ধন

মহামতি আলেকজান্ডার ও পুরু রাজা

একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহামতি আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করলে আলেকজান্ডারের স্ত্রী রোজানা রাজা পুরুকে একটি পবিত্র সুতো পাঠিয়ে তাঁকে অনুরোধ করেন আলেকজান্ডারের ক্ষতি না করার জন্য। পুরু ছিলেন কাটোচ রাজা। তিনি রাখীকে সম্মান করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি নিজে আলেকজান্ডারকে আঘাত করেননি।

রানি কর্ণবতী ও সম্রাট হুমায়ুন

একটি জনপ্রিয় গল্প অনুযায়ী, চিতোরের রানি কর্ণবতী ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে একটি রাখী পাঠান। গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমণ করলে বিধবা রানি কর্ণবতী অসহায় বোধ করেন এবং তিনি হুমায়ুনকে একটি রাখী পাঠিয়ে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেন। কর্ণবতীর রাখী প্রেরণে অভিভূত হয়ে হুমায়ুন চিতোর রক্ষা করার জন্য সৈন্য প্রেরণ করেন। তবে হুমায়ুনের সেনা পাঠাতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। বাহাদুর শাহ রানির দুর্গ জয় করে নিয়েছিলেন। শোনা যায়, বাহাদুর শাহের সেনাবাহিনীর হাত থেকে সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য ১৫৩৫ সালের ৮ মার্চ রানি কর্ণবতী ১৩,০০০ পুরস্ত্রীকে নিয়ে জহর ব্রত পালন করে আগুনে আত্মাহুতি দেন। চিতোরে পৌঁছে হুমায়ুন বাহাদুর শাহকে দুর্গ থেকে উৎখাত করেন এবং কর্ণবতীর ছেলে বিক্রমজিৎ সিংকে সিংহাসনে বসান। সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে রাখী প্রেরণের কথা অবশ্য জানা যায় না। কোনো কোনো ঐতিহাসিক রাখী পাঠানোর গল্পটির সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেন। তবে মধ্য-সপ্তদশ শতকের রাজস্থানী লোকগাথায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রাখী বন্ধন

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাখী বন্ধন উৎসব পালন করেছিলেন। তিনি কলকাতা, ঢাকা ও সিলেট থেকে হাজার হাজার হিন্দু ও মুসলিম ভাই ও বোনকে আহ্বান করেছিলেন একতার প্রতীক হিসাবে রাখী বন্ধন উৎসব পালন করার জন্য।

সেই সময় দেশে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা চরম পর্যায়ে ছিল। আমরা আজ ২২শে আগস্ট ২০২১ সালে রাখী বন্ধন উৎসব পালন করছি। কিন্তু ১০০ বছরেরও বেশি সময় আগে হিন্দু ও মুসলিম এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে একতা আনার জন্য রাখী বন্ধন উৎসব পালন করা হয়েছিল।

উনিশ শতকে আমাদের বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চরম পর্যায়ে ছিল যা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে অপরিমিত ভয়ের কারণ। এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয়  তারা বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করবে। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ সহ গোটা ভারতের বিভিন্ন নেতা এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিল এবং বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে।

১৯০৫ সালের জুন মাসে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৯০৫ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গভঙ্গ জন্য আইন পাশ করা হয়। এই আইন কার্যকরী হয় ১৬ই অক্টোবর, ১৯০৫।

শ্রাবণ মাসে হিন্দু ভাইবোনদের মধ্যে রাখী বন্ধন উৎসব পালন করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বোধ জাগিয়ে তোলা এবং ব্রিটিশদের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাইকে রাখী বন্ধন উৎসব পালন করার জন্য আহ্বান করেন। রবীন্দ্রনাথ এই দিনটির উদ্দেশে একটি গান লিখেছিলেন।

"বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল-

পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।

বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ-

পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান।

বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা –

সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান।

বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন –

এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান।"

রাখিবন্ধন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ আরো দুটি গান রচনা করেছিলেন, সে দু’টি গান হল -

  • জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ এবং
  • প্রভু, আজি দক্ষিণ হাত রেখো না ঢাকি

আরো পড়ুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Tags:

রাখীবন্ধন অনুষ্ঠানরাখীবন্ধন পৌরাণিক রাখীবন্ধন ঐতিহাসিক রাখীবন্ধন আরো পড়ুনরাখীবন্ধন তথ্যসূত্ররাখীবন্ধন বহিঃসংযোগরাখীবন্ধনজৈনদক্ষিণ এশিয়াপূর্ণিমাবৌদ্ধশিখশ্রাবণহিন্দুহিন্দু পঞ্জিকা

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিবাংলাদেশের কোম্পানির তালিকাযোহরের নামাজএল নিনোজিএসটি ভর্তি পরীক্ষাহিসাববিজ্ঞানইসলামি সহযোগিতা সংস্থাএইচআইভিটাঙ্গাইল জেলাসালমান বিন আবদুল আজিজসৈয়দ সায়েদুল হক সুমনখিলাফতরয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুদৌলতদিয়া যৌনপল্লিচুয়াডাঙ্গা জেলাদৈনিক প্রথম আলোবাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধনীসমূহকৃষ্ণইসতিসকার নামাজফারাক্কা বাঁধসূরা ইয়াসীনঅমর সিং চমকিলাআল-আকসা মসজিদপ্রাকৃতিক সম্পদকম্পিউটারবাসুকীআওরঙ্গজেববিদীপ্তা চক্রবর্তীপ্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণবাল্যবিবাহক্যান্সারমুসাফিরের নামাজইউসুফকাতারক্রিস্তিয়ানো রোনালদোনাদিয়া আহমেদরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরচিয়া বীজসিন্ধু সভ্যতাগীতাঞ্জলিপর্তুগিজ ভারতসোমালিয়াভারতীয় জনতা পার্টিপেশাউমর ইবনুল খাত্তাববাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিদের তালিকাবীর শ্রেষ্ঠরামপ্রসাদ সেন২০২৬ ফিফা বিশ্বকাপগাজওয়াতুল হিন্দসার্বজনীন পেনশনইসলামপল্লী সঞ্চয় ব্যাংকঅসহযোগ আন্দোলন (ব্রিটিশ ভারত)বাণাসুরকরোনাভাইরাসইউক্রেনে রুশ আক্রমণ (২০২২-বর্তমান)বিটিএসকানাডাডাচ্-বাংলা ব্যাংক পিএলসিচৈতন্য মহাপ্রভুসার্বিয়াকৃত্তিবাসী রামায়ণপশ্চিমবঙ্গে ভারতের সাধারণ নির্বাচন, ২০২৪বিদ্যাপতিবিষ্ণুবাঙালি হিন্দুদের পদবিসমূহনূর জাহানরামকৃষ্ণ পরমহংসবাস্তুতন্ত্রবাংলাদেশের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেভাগা আন্দোলনদুর্গাপূজাভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০মৈমনসিংহ গীতিকাকবিতাআমবাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসপাট্টা ও কবুলিয়াত🡆 More