বেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা

বেঙ্কটেশ্বর মন্দির হল ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের চিত্তুর জেলার অন্তর্গত তিরুপতির তিরুমালা শৈলশহরে অবস্থিত একটি অন্যতম প্রধান বিষ্ণু মন্দির। এই মন্দিরের প্রধান উপাস্য দেবতা হলেন হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর অবতার বেঙ্কটেশ্বর। তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বর মন্দির তিরুপতি মন্দির, তিরুমালা মন্দির ও তিরুপতি বালাজি মন্দির নামেও পরিচিত। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, কলিযুগের দুঃখ ও যন্ত্রণা থেকে মানব সমাজকে ত্রাণ করতে বিষ্ণু তিরুমালায় ‘বেঙ্কটেশ্বর’ রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। এই জন্য এই মন্দিরটিকে ‘কলিযুগ বৈকুণ্ঠম্‌’ বলা হয় এবং বেঙ্কটেশ্বরকে বলা হয় ‘কলিযুগ প্রত্যক্ষ দৈবতম্‌’ (কলিযুগের প্রত্যক্ষ দেবতা)। বেঙ্কটেশ্বর ‘বালাজি’, ‘গোবিন্দ’ ও ‘শ্রীনিবাস’ নামেও পরিচিত।

বেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা
বেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা
ধর্ম
অন্তর্ভুক্তিহিন্দুধর্ম
জেলাচিত্তুর
পরিচালনা সংস্থাতিরুমালা তিরুপতি দেবস্থানম্‌ (টিটিডি)
অবস্থান
অবস্থানতিরুপতি
দেশভারত
স্থাপত্য
ধরনদ্রাবিড় স্থাপত্য
শিলালিপিদ্রাবিড় ভাষাসমূহসংস্কৃত
উচ্চতা৮৫৩ মি (২,৭৯৯ ফু)
ওয়েবসাইট
tirumala.org

তিরুমালা পাহাড়টি শেষাচলম পর্বতমালার অংশবিশেষ। এই পাহাড় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৫৩ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। এই পাহাড়ের সাতটি চূড়া রয়েছে। হিন্দুরা এই সাতটি চূড়াকে আদিশেষের সাতটি মাথা মনে করেন। এই সাতটি চূড়ার নাম হল শেষাদ্রি, নীলাদ্রি, গরুড়াদ্রি, অঞ্জনাদ্রি, বৃষভাদ্রি, নারায়ণাদ্রি ও বেঙ্কটাদ্রি। বেঙ্কটেশ্বর মন্দির সপ্তম চূড়া বেঙ্কটাদ্রিতে স্বামী পুষ্করিণীর পাশে অবস্থিত। এই জন্য এই মন্দিরটিকে ‘সপ্তগিরির মন্দির’ও বলা হয়। তিরুমালা শহরটির আয়তন প্রায় ১০.৩৩ বর্গমাইল (২৭ কিমি)।

বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরটি দ্রাবিড় স্থাপত্যশৈলীর একটি নিদর্শন। অনুমান করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ নাগাদ এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল। এই মন্দিরের গর্ভগৃহটির নাম ‘আনন্দ-নিলয়ম্‌’। এখানেই মন্দিরের প্রধান দেবতা বেঙ্কটেশ্বরের বিগ্রহ পূর্বমুখী করে স্থাপিত। এই মন্দিরের পূজাপাঠে বৈখাসন আগম শাস্ত্র অনুসরণ করা হয়। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, বেঙ্কটেশ্বর মন্দির বিষ্ণুর আটটি ‘স্বয়ম্ভু ক্ষেত্রে’র অন্যতম এবং পৃথিবীতে অবস্থিত ১০৬তম তথা শেষ ‘দিব্য দেশম্‌’। তীর্থযাত্রীদের ভিড় সামলানোর জন্য মন্দির চত্বরে লাইন দেওয়ার দুটি ইমারত, তাঁদের বিনামূল্যে খাবার দেওয়ার জন্য তারিকোন্ডা বেঙ্কমাম্বা অন্নপ্রসাদম্‌ চত্বর, মস্তক মুণ্ডন ভবন এবং একাধিক তীর্থযাত্রী নিবাস রয়েছে।

সংগৃহীত দানের হিসেব অনুসারে, তিরুপতি বেঙ্কটেশ্বর মন্দির বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মন্দির। দৈনিক প্রায় ৫০,০০০ থেকে ১০০,০০০ (বছরে গড়ে ৩ থেকে ৪ কোটি) তীর্থযাত্রী এই মন্দির দর্শন করতে আসেন। ব্রহ্মোৎসবম্‌ প্রভৃতি বার্ষিক উৎসবগুলিতে এই মন্দিরে তীর্থযাত্রীর সংখ্যা ৫০০,০০০ ছাড়িয়ে যায়। এই কারণে বলা হয়, এই মন্দির বিশ্বের সেই ধর্মস্থান, যেখানে তীর্থযাত্রীর সমাগম সর্বাধিক সংখ্যায় হয়ে থাকে।

তিরুমালার বেঙ্কটেশ্বর মন্দির বিজয়ওয়াড়া থেকে প্রায় ৪৩৫ কিমি (২৭০ মা) হায়দ্রাবাদ থেকে ১৩৮ কিমি (৮৬ মা), চেন্নাই থেকে ২৯১ কিমি (১৮১ মা), দূরে অবস্থিত।

বেঙ্কটেশ্বর অবতার সম্পর্কে একাধিক কিংবদন্তি রয়েছে। একটি কিংবদন্তি অনুসারে, এই মন্দিরে বেঙ্কটেশ্বরের মূর্তি বর্তমান কলিযুগের শেষ অবধি বিরাজ করবে।

কিংবদন্তি

তিরুমালা সম্পর্কে একাধিক কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। একটি কিংবদন্তি অনুসারে, দ্বাপর যুগে বিষ্ণুর দাস আদিশেষ বায়ুর সঙ্গে একটি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মর্ত্যে গিয়ে শেষাচলম পর্বতমালায় অবস্থান করছিলেন। পুরাণ অনুসারে, তিরুমালা হল ‘আদিবরাহ ক্ষেত্র’। অসুর হিরণ্যাক্ষকে বধ করার পর আদিবরাহ এই পর্বতে অবস্থান করছিলেন। তবে শ্রীবেঙ্কটাচলমাহাত্ম্যম্‌ তিরুমালা মন্দির সম্পর্কে সর্বাধিক পরিচিত কিংবদন্তি। এই কিংবদন্তিটি নিম্নরূপ:

কলিযুগে ত্রিমূর্তির (ব্রহ্মা, বিষ্ণুশিব – এই তিন দেবতা) মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ, তা নির্ণয় করতে দেবর্ষি নারদের উপস্থিতিতে ঋষিরা একটি যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। ত্রিমূর্তিকে পরীক্ষা করার জন্য তারা ঋষি ভৃগুকে প্রেরণ করেন। ভৃগু প্রথমে ব্রহ্মা ও পরে শিবের কাছে যান। কিন্তু তারা কাউই ভৃগুর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন না দেখে, ভৃগু গেলেন বিষ্ণুর কাছে। বিষ্ণুও একইভাবে ভৃগুকে উপেক্ষা করলেন। তাতে ক্রুদ্ধ হয়ে ভৃগু বিষ্ণুর বক্ষস্থলে লাথি মারলেন। বিষ্ণু কিন্তু তাতেও ক্ষুব্ধ হলেন না। বরং ঋষিকে শান্ত করার জন্য তার পায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন এবং সেই আছিলায় ভৃগুর পায়ে স্থিত তার অহংকারের প্রতীক তৃতীয় চক্ষুটি নিংড়ে নিলেন। এতে ভৃগু নিজের ভুল বুঝতে পেরে বিষ্ণুর কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং সিদ্ধান্ত করলেন যে, ত্রিমূর্তির মধ্যে বিষ্ণুই শ্রেষ্ঠ। বিষ্ণুও ভৃগুকে ক্ষমা করলেন। কিন্তু বিষ্ণুপত্নী লক্ষ্মী এই ঘটনায় এতটাই অপমানিত বোধ করলেন যে, তিনি বৈকুণ্ঠ ত্যাগ করে কোলহাপুরে গিয়ে ধ্যানে বসলেন।

বিষ্ণু ‘শ্রীনিবাস’ নামে মানুষের রূপ ধরে লক্ষ্মীর সন্ধানে বৈকুণ্ঠ ত্যাগ করে তিরুমালা পর্বতে এসে ধ্যানে বসলেন। শ্রীনিবাসের কথা জানতে পেরে লক্ষ্মী শিব ও ব্রহ্মার কাছে প্রার্থনা করলেন। শিব ও ব্রহ্মা গাভী ও বাছুরের বেশ ধারণ করলেন। লক্ষ্মী সেই গাভী ও বাছুরটিকে তিরুমালার তৎকালীন অধিপতি চোল রাজার কাছে বিক্রি করে দিলেন। গাভীটি রোজ চরতে বেরিয়ে শ্রীনিবাসকে দুধ খাওয়াত। একদিন রাজভৃত্য রাখাল সেটি দেখতে পেয়ে রেগে গাভীটিকে আঘাত করতে গেল। কিন্তু শ্রীনিবাস সেই আঘাত নিজের উপর গ্রহণ করলেন। এই কাজে ক্রুদ্ধ হয়ে শ্রীনিবাস চোল রাজাকে অভিশাপ দিলেন যে, ভৃত্যের পাপের ভাগী তার প্রভু চোল রাজা অসুরে পরিণত হবেন। রাজা শ্রীনিবাসের কাছে ক্ষমা চাইলেন। শ্রীনিবাস জানালেন, পরজন্মে চোল রাজা আকাশরাজা রূপে জন্মগ্রহণ করবেন এবং তার কন্যা পদ্মাবতীর সঙ্গে শ্রীনিবাসের বিয়ে দিতে হবে।

এরপর শ্রীনিবাস তিরুমালায় তার মা বাকুলা দেবীর কাছে গিয়ে কিছুদিন বাস করলেন। চোল রাজা আকাশরাজা রূপে জন্মগ্রহণ করার পর অধুনা অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুচানুরের পদ্মা পুষ্পরিণীতে তার কন্যা পদ্মাবতীরও জন্ম হল। অন্ধ্রপ্রদেশেরই নারায়ণবনে শ্রীনিবাস ও পদ্মাবতীর বিবাহ সম্পন্ন হল। তারপর শ্রীনিবাস ফিরে এলেন তিরুমালায়। কয়েক মাস পর লক্ষ্মী যখন এই বিবাহের কথা জানতে পারলেন, তখন তিনিও তিরুমালায় শ্রীনিবাসের কৈফিয়ত চাইতে এলেন। কথিত আছে, লক্ষ্মী ও পদ্মাবতীর সাক্ষাতের সময় শ্রীনিবাস পাথরে পরিণত হন। ব্রহ্মা ও শিব বিস্ময়াবিষ্ট লক্ষ্মী ও পার্বতীর সামনে উপস্থিত হন। তারা এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিষ্ণুর অভিপ্রায়ের কথা জানান। বিষ্ণু চাইছেন, এই সাত পাহাড়ে অবস্থান করে তিনি কলিযুগের দুঃখ ও যন্ত্রণা থেকে মানব সমাজকে ত্রাণ করবেন। তখন স্বামীর সঙ্গে একত্রে থাকবেন বলে লক্ষ্মী ও পদ্মাবতীও প্রস্তর বিগ্রহে পরিণত হলেন। লক্ষ্মী রইলেন তার বুকের বাঁদিকে, অন্যদিকে পদ্মাবতী রইলেন তার বুকের ডানদিকে।

ইতিহাস

মধ্যযুগ

কাঞ্চীপুরমের পল্লব রাজবংশ (৯ম শতাব্দী), তাঞ্জাভুরের চোল রাজবংশ (১০ম শতাব্দী) এবং বিজয়নগর প্রধানেরা (১৪শ ও ১৫শ শতাব্দী) ছিলেন বেঙ্কটেশ্বরের একনিষ্ঠ ভক্ত। মন্দিরের বর্তমান আকার ও অর্থসম্পদের অধিকাংশই বিজয়নগর সাম্রাজ্যের দান করা হিরে ও সোনা থেকে এসেছে। ১৫১৭ সালে বিজয়নগরের সম্রাট কৃষ্ণদেবরায় বেঙ্কটেশ্বর মন্দির পরিদর্শনকালে যে সোনা ও রত্ন দান করেছিলেন, তা দিয়ে আনন্দ নিলয়মের (ভিতরের বেদী) ছাদটি মুড়ে দেওয়া হয়। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতনের পর মহীশূর রাজ্য ও গাডোয়াল সংস্থানম্‌ প্রভৃতির নেতারা এই মন্দিরে তীর্থযাত্রায় আসেন এবং অলংকার ও মূল্যবান সামগ্রী মন্দিরে দান করেন। মারাঠা সেনানায়ক প্রথম রাঘোজি ভোঁসলে (মৃত্যু: ১৭৫৫) এই মন্দির পরিদর্শনে এসে মন্দিরে পূজার্জনা পরিচালনার জন্য স্থায়ী প্রশাসন গড়ে দিয়ে যান।

আধুনিক যুগ

বেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা 
তিরুমালার স্বামী পুষ্করিণী

ব্রিটিশ শাসনকালে ১৮৪৩ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি গঠিত হয়। তিরুমালা সেই সময় মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এই সময় বেঙ্কটেশ্বর মন্দির এবং আরও কয়েকটি মন্দিরের প্রশাসনিক দায়িত্ব তিরুমালা তিরুপতি দেবস্থানমের (টিটিডি) অধীনে আসে। পরে ১৯৩২ সালে তিরুমালা তিরুপতি দেবস্থানম্‌ আইন পাস হয়।

ভারত স্বাধীন হলে ভাষার ভিত্তিতে অন্ধ্র রাজ্য গঠিত হয়। এই সময় তেলুগু-ভাষী অঞ্চল হিসেবে তিরুমালাও ভারত সরকার কর্ত্ররক অন্ধ্র রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়।

উৎকীর্ণ লিপিসমূহ

বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরের দেওয়ালে একাধিক লিপি উৎকীর্ণ রয়েছে। এই লিপিগুলির ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত গুরুত্ব অপরিসীম। পার্বত্য মন্দির এবং নিম্ন তিরুপতি ও তিরুচানুরের মন্দিরগুলিতে উৎকীর্ণ লিপির সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। এমনও প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে, মন্দিরের দেওয়ালের প্রাচীন কিছু লিপি উদ্ধারের আগেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।

দেবস্থানমের পরিচালনাধীন মন্দিরগুলির দেওয়ালে প্রায় ১০৬০টি লিপি উৎকীর্ণ রয়েছে। তিরুপতি মন্দির দেবস্থানম কর্তৃক প্রকাশিত লিপিগুলি এইভাবে বিন্যস্ত হয়েছে:

  • বেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা: ৬৪০টি লিপি।
  • গোবিন্দরাজ মন্দির, তিরুপতি: ৩৪০টি লিপি।
  • অন্যান্য মন্দির: ৮০টি লিপি।

লিপিগুলির সবকটিই তামিল, তেলুগুকন্নড় ভাষায় উৎকীর্ণ।

এছাড়াও মন্দিরে প্রায় ৩০০০ তাম্রলিপি রয়েছে। এগুলিতে তাল্লাপাকা আন্নামাচার্য ও তার উত্তরাধিকারীদের তেলুগু সংকীর্তন উৎকীর্ণ রয়েছে। সংগীততত্ত্ব ছাড়াও এই লিপিগুলি তেলুগু ভাষার একটি ঐতিহাসিক ভাষাতাত্ত্বিক উপাদানের একটি মূল্যবান উৎস।

দক্ষিণ ভারতের প্রায় সবকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় তিরুমালার এই মন্দিরটি পূর্ণ গৌরব অর্জন করেছিল। পল্লব, চোল, পাণ্ড্য, কডবরায়, যাদবরায়, তেলুগু চোল, তেলুগু পল্লব, বিজয়নগরের রাজন্যবর্গ (সঙ্গম, সালুব ও তুলুব রাজবংশ) এই মন্দিরের পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং তিরুমালা ও তিরুপতির মন্দিরগুলির দেওয়ালে বিভিন্ন লিপি খোদাই করে যান।

মন্দির প্রশাসন

তিরুমালা তিরুপতি দেবস্থানম্‌ (টিটিডি) একটি অছি পরিষদ কর্তৃক পরিচালিত হয়। ১৯৫১ সালে এই অছির সদস্য সংখ্যা ছিল ৫। ২০১৫ সালে একটি আইন পাস করে এই সংখ্যা বাড়িয়ে ১৫ করা হয়েছে। টিটিডি-র দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিচালনার জন্য একজন কার্যনির্বাহী আধিকারিক দায়ী থাকেন। এই আধিকারিককে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার নিয়োগ করে।

প্রতিদিন এই মন্দিরে প্রায় ৭৫,০০০ তীর্থযাত্রী আসেন। ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে এই মন্দিরের বার্ষিক বাজেট ধরা হয়েছে ২৫৩০.১০ কোটি টাকা। এই বাজেট ও ভক্তদের দান থেকে দাতব্য অছি পরিষদগুলি চলে। মন্দিরের বার্ষিক বাজেট থেকে মন্দিরের জনপ্রিয়তা অনুমান করা যায়। ২০০৮ সালে এই মন্দিরের বার্ষিক আয় ছিল ১০ বিলিয়ন টাকা। শ্রীবারি হুন্ডি ভক্তদের দান থেকে মন্দিরের প্রধান আয় হয়।

ভক্তেরা টিটিডি-কে যে পরিমাণ অর্থ দান করেন, তার পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা। মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াও টিটিডি একাধিক দাতব্য অছি পরিষদ পরিচালনা করে। এগুলিও বাজেট ভক্তদের দানের টাকায় চলে।

স্থাপত্য

বেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা 
তিরুমালা মন্দির ও বৈকুণ্ঠম লাইন চত্বর (সামনের অর্ধবৃত্তাকার ভবন)। নারায়ণগিরি পর্বতের শ্রীবারি পদলু থেকে তোলা ছবি।

দ্বারম্‌ ও প্রাকারম্‌

বাইরে থেকে মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশের জন্য তিনটি ‘দ্বারম্‌’ বা প্রবেশদ্বার রয়েছে। প্রথম প্রবেশদ্বারটির নাম ‘মহাদ্বারম্‌’ বা ‘পদিকাবলি’। এটি ‘মহাপ্রাকারম্‌’ বা চত্বরের বাইরের প্রাচীরে অবস্থিত। মহাদ্বারমের উপর একটি ৫০ ফুট উঁচু পাঁচ-তলা ‘গোপুরম্‌’ (মন্দিরের মিনার) রয়েছে। এই গোপুরমের চূড়ায় সাতটি কলস স্থাপিত রয়েছে।

দ্বিতীয় প্রবেশদ্বারটির নাম ‘বেন্দিবাকিলি’ বা রৌপ্যদ্বার। এটি ‘নাদিমিপদিকাবলি’ নামেও পরিচিত। এটি মন্দিরের ভিতরের প্রাচীর ‘সম্পঙ্গি প্রাকারমে’র গায়ে অবস্থিত। এই প্রবেশপথটির উপর একটি তিন-তলা গোপুরম রয়েছে। এই গোপুরমের উপরেও সাতটি কলস স্থাপিত আছে।

গর্ভগৃহে প্রবেশের দরজাটির নাম হল ‘বঙ্গারুবাকিলি’ বা স্বর্ণদ্বার। এই পথের দুই পাশে দ্বারপাল জয় ও বিজয়ের দুটি লম্বা তাম্রমূর্তি স্থাপিত। মোটা কাঠে নির্মিত এই দরজাটির উপর সোনার গিলটি করা পাতে বিষ্ণুর দশাবতারের ছবি খোদিত রয়েছে।

প্রদক্ষিণম্‌

মন্দিরের গর্ভগৃহের বা দেববিগ্রহের চারপাশের বৃত্তাকার অংশটিকে বলা হয় ‘প্রদক্ষিণম্‌’ (প্রদক্ষিণের পথ)। প্রদক্ষিণের জন্য তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে দুটি পথ রয়েছে। প্রথম পথটি রয়েছে মহাপ্রাকারম ও সম্পঙ্গি প্রাকারমের মধ্যস্থলে। এই পথটির নাম ‘সম্পঙ্গি প্রদক্ষিণম্‌’। এই পথটিতে একাধিক মণ্ডপ, ধ্বজাস্থলম্‌, বলিপিটম্‌, ক্ষেত্রপালিকা শিলা, প্রসাদ বিতরণ স্থল ইত্যাদি রয়েছে।

দ্বিতীয় প্রদক্ষিণ পথটির নাম ‘বিমানপ্রদক্ষিণম’। এটি আনন্দ-নিলয়ম-বিমানমের চারপাশে অবস্থিত। এই পথেই বরদারাজ ও যোগ-নৃসিংহ মন্দির, ‘পোটু’ (মন্দিরের প্রধান পাকশালা), ‘বঙ্গারু ববি’ (সুবর্ণ কূপ), ‘অঙ্কুরারপানা মণ্ডপম্‌’, যাগশালা, ‘নানালা’ (মুদ্রাভাণ্ড) ও ‘নোটলা’ (কাগজের নোটের ভাণ্ড), ‘পারকামানি’, ‘চন্দনপু আরা’ (চন্দনের আলমারি), মহাফেজখানা, ‘সন্নিধি ভাষ্যকুরুলু’, বেঙ্কটেশ্বরের হুন্ডি ও বিশ্বকসেনের আসন অবস্থিত।

আনন্দ-নিলয়ম্‌ ও গর্ভগৃহ

তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে প্রধান উপাস্য দেবতা বেঙ্কটেশ্বরের বিগ্রহ ও কয়েকটি ছোটো মূর্তি রয়েছে মন্দিরের গর্ভগৃহে। স্বর্ণদ্বার দিয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে হয়। বঙ্গারুবাকিলি ও গর্ভগৃহের মধ্যে আরও দুটি দরজা রয়েছে। তীর্থযাত্রীদের গর্ভগৃহের ভিতরে ও ‘কুলশেখরপদী’ পথের ভিতরে আসতে দেওয়া হয় না।

মন্দিরের গর্ভগৃহের উপরে অবস্থিত নির্মিত প্রধান গোপুরমটির নাম আনন্দ-নিলয়ম্‌-বিমানম্‌। এটি একটি তিন-তলা গোপুরম। এই চূড়ায় একটিমাত্র কলস স্থাপিত রয়েছে। এই গোপুরমটি গিল্‌টি করা রুপোর মাতে মোড়া এবং একটি সোনার পাত্র দ্বারা আবৃত। এই গোপুরমে অনেক দেবমূর্তি খোদিত রয়েছে। তার মধ্যে বেঙ্কটেশ্বরের মূর্তিটি ‘বিমান-বেঙ্কটেশ্বর’ নামে পরিচিত। এটিকে গর্ভগৃহের মূর্তিটির যথাযথ প্রতিমূর্তি মনে করা হয়।

মন্দিরের দেবমূর্তিসমূহ

বেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা 
তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরের গর্ভগৃহের একটি প্রতিরূপ। বাঁদিকে শ্রীদেবী ও ভূদেবী সহ মালায়াপ্পা স্বামী, মধ্যস্থলে প্রধান দেবতা বা ‘ধ্রুব বেরাম’ বেঙ্কটেশ্বর, নিচে কেন্দ্রে ভোগ শ্রীনিবাস, ডানদিকে উগ্র শ্রীনিবাস, সীতা ও লক্ষ্মণ সহ রাম এবং কৃষ্ণ-রুক্মিণী।
  1. মূলবিরাট বা ধ্রুব বেরাম্‌ – তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরের গর্ভগৃহে বেঙ্কটেশ্বরের প্রধান বিগ্রহটিকে বলা হয় ‘ধ্রুব বেরাম্‌’। ‘ধ্রুব’ শব্দের অর্থ স্থায়ী এবং ‘বেরাম্‌’ শব্দের অর্থ ‘দেবতা’। এই বিগ্রহটি একটি প্রস্তর-বিগ্রহ। বিগ্রহটি পা থেকে মুকুটের চূড়া অবধি ৮ ফুট (২.৪ মি) লম্বা। বিগ্রহটিতে বেঙ্কটেশ্বরকে দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখা যায়। তার উপরের দুটি হাতে শঙ্খ ও সুদর্শন চক্র এবং নিচের দুটি হাতের মধ্যে একটি হাতে বরদা মুদ্রা ও অপর হাতটি উরুর উপর রাখা। বিগ্রহটি নানা মূল্যবান অলংকারে শোভিত। বিগ্রহের বুকের ডানদিকে লক্ষ্মী ও বাঁদিকে পদ্মাবতীর অবস্থান। এই বিগ্রহটিকে মন্দিরের শক্তির প্রধান উৎস মনে করা হয়।
  2. কৌতুক বেরাম্‌ বা ভোগ শ্রীনিবাস — ৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে পল্লব রানি সামাবাই পেরিনদেবী এই এক ফুট (০.৩ মিটার) উঁচু রুপোর মূর্তিটি মন্দিরকে দান করেছিলেন। প্রতিষ্ঠার পর এটিকে কখনও মন্দিরের বাইরে আনা হয়নি। মূর্তিটির জনপ্রিয় নাম ‘ভোগ শ্রীনিবাস’। কারণ মহাবিরাটের সব জাগতিক সুখ এই মূর্তিটি ভোগ করেন। এই বিগ্রহটিকে প্রতিদিন রাতে একটি সোনার বিছানায় শোয়ানো হয় এবং প্রতি বুধবার এঁর সহস্র কলসাভিষেকম্‌ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। মূর্তিটিকে সর্বদা মূলবিরাটের বাঁপায়ের কাছে একটি পবিত্র ‘সম্বন্ধ ক্রুচে’র দ্বারা মূল বিগ্রহের সঙ্গে যুক্ত করে রাখা হয়। মূর্তিটিকে ভক্তদের থেকে ৪৫ ডিগ্রি কোণ করে রাখা হয়, কারণ এই মূর্তিটির একটি ‘প্রয়োগ’ (সদা ব্যবহারোন্মুখ) চক্র রয়েছে।
  3. স্নাপন বেরাম্‌ বা উগ্র শ্রীনিবাস — এই মূর্তিটি বেঙ্কটেশ্বরের ক্রুদ্ধ রূপের প্রতিরূপ। এটিও গর্ভগৃহে রাখা থাকে। শুধুমাত্র কৈশিকা দ্বাদশী তিথিতে সূর্যোদয়ের পূর্বে একবার বাইরে আনা হয়। ‘স্নাপন’ শব্দের অর্থ স্নান করানো। প্রতিদিন এই মূর্তিটিকে পবিত্র জল, দুধ, দই, ঘি, চন্দন, কুমকুম ইত্যাদি দিয়ে স্নান করানো হয়।
  4. উৎসব বেরাম্‌ বা মালায়াপ্পা স্বামী — ভক্তদের দর্শনের জন্য বেঙ্কটেশ্বরের এই মূর্তিটি বাইরে আনা হয়। এই মূর্তিটিকে মালায়াপ্পাও বলা হয়। এই মূর্তির সঙ্গে এঁর দুই পত্নী শ্রীদেবী ও ভূদেবীও থাকেন। তিরুমালা পর্বতের মালায়াপ্পান কোনাই গুহায় এই মূর্তিগুলি পাওয়া গিয়েছিল। প্রথম দিকে উগ্র শ্রীনিবাসকে উৎসব বেরাম্‌ (শোভাযাত্রায় নির্গত মূর্তি) করা হত। কিন্তু সেই সময় শোভাযাত্রার সময় প্রায়ই বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটত। কথিত আছে, ভক্তেরা সমাধানের জন্য বেঙ্কটেশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলে তিনি স্বপ্নে তিরুমালা পর্বতের গুহায় লুক্কায়িত মূর্তিগুলি খুঁজে বের করার আদেশ দেন। খোঁজা শুরু হয় এবং খুঁজে পাওয়ার পর গ্রামবাসীরা এই মূর্তির নাম রাখেন ‘মালায়াপ্পা’ বা ‘পর্বতের রাজা’। এই মূর্তিগুলি মন্দিরে আনার পর নিত্য কল্যাণোৎসবম্‌, সহস্র দীপালংকার সেবা, অর্জিত ব্রহ্মোৎসবম্‌, নিত্যোৎসবম্‌, দোলোৎসবম্‌ ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে মন্দিরে তীর্থযাত্রীর সমাগম বৃদ্ধি পায়। এই মূর্তিগুলির উদ্দেশ্যে ভক্তেরা কোটি কোটি টাকা দান করেন।
  5. বলি বেরাম্‌ বা কোলুভু শ্রীনিবাস — এই পঞ্চলোহা মূর্তিটি মূল মূর্তির প্রতিরূপ। এই মূর্তিটিকে মন্দিরের সব কাজ ও আচার-অনুষ্ঠানের প্রধান আধিকারিকের প্রতিনিধি মনে করা হয়। এটিকে বলি বেরাম্‌ও বলা হয়। কোলুভু শ্রীনিবাস হলেন মন্দিরের রক্ষাকর্তা দেবতা। এঁকে মন্দিরের অর্থনৈতিক বিষয়ের অধিকর্তাও মনে করা হয়। দৈনিক উপচারগুলি এই মূর্তির প্রতি নিবেদিত হয়। প্রতি বছর জুলাই মাসে হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে দক্ষিণায়ন সংক্রমণের সময় অর্থবর্ষের সমাপ্তি উপলক্ষে মন্দিরে ‘অনিবার অস্থানম্‌’ অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়।

পূজা

নিত্যপূজা

পূজার্চনার ক্ষেত্রে তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে বৈখানস আগম প্রথা অনুসরণ করা হয়। কথিত আছে, ঋষি বিখানস এই আগমের প্রবক্তা এবং তার শিষ্য অত্রি, ভৃগু, মারিচী ও কাশ্যপ এর প্রচারক। হিন্দুধর্মের বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে (যাঁরা বিষ্ণু ও তার অবতারগণকে সর্বোচ্চ ঈশ্বর রূপে পূজা করেন) বৈখানস একটি অন্যতম প্রধান প্রথা। এই প্রথা অনুসারে দিনে বিষ্ণুর ছয় বার পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। এর মধ্যে অন্তত একটি পূজা অবশ্য কর্তব্য। এই পূজাগুলি হল:

  1. প্রত্যুষম্‌ পূজা — সূর্যোদয়ের আগেই শুরু ও শেষ হওয়া পূজা।
  2. প্রাতঃকাল পূজা — সূর্যোদয়ের পরে শুরু ও দ্বিপ্রহরের আগে শেষ হওয়া পূজা।
  3. মধ্যাহ্ন পূজা — মধ্যাহ্নে শুরু ও শেষ হওয়া পূজা।
  4. অপরাহ্ন পূজা — সূর্যাস্তকাল শুরু হলে এই পূজা শুরু হয়।
  5. সন্ধ্যাকাল পূজা — সূর্যাস্তের মধ্যে শুরু ও শেষ হওয়া পূজা।
  6. নিশি পূজা — আকাশ পুরো অন্ধকার হয়ে গেলে এই পূজা করা হয়।

বর্তমানে তিরুমালা মন্দিরে শুধু তিনটি পূজা হয়। এগুলি হল উষাকাল পূজা, মধ্যাহ্ন পূজা ও নিশি পূজা। সব পূজাই বংশ পরম্পরায় বৈখানস পুরোহিতরা করে থাকেন।

দর্শন

দৈনিক ৫০,০০০ থেকে ১০০,০০০ তীর্থযাত্রী তিরুপতি মন্দিরে বেঙ্কটেশ্বরকে দর্শন করতে আসেন। বিশেষ বিশেষ উৎসবে (যেমন ব্রহ্মোৎসবম) এই সংখ্যা ৫০০,০০০ ছাড়িয়ে যায়। এই কারণেই বলা হয়, বিশ্বের যত ধর্মস্থান আছে, তার মধ্যে এই মন্দিরেই জনসমাগম হয় সর্বাধিক। তীর্থযাত্রীদের ভিড় সামাল দিতে তিরুমালা তিরুপতি দেবস্থানম্‌ ১৯৮৩ সালে বৈকুণ্ঠম্‌ লাইন চত্বর নির্মাণ করে। ২০০০ সালে আরও একটি লাইন চত্বর নির্মিত হয়। বৈকুণ্ঠম্‌ লাইন চত্বরে দর্শনার্থীরা দর্শনের সুযোগ না আসা পর্যন্ত বসে অপেক্ষা করতে পারেন। প্রথা অনুসারে, বেঙ্কটেশ্বরকে দর্শনের আগে স্বামী পুষ্করিণীর উত্তর পাড়ে ভূবরাহ স্বামী মন্দির দর্শন তীর্থযাত্রীদের কাছে বাধ্যতামূলক।

মন্দিরের আচার-অনুষ্ঠান

দৈনিক অনুষ্ঠান

মন্দিরের দৈনিক সেবাগুলির মধ্যে রয়েছে সুপ্রভাত সেবা, তোমল সেবা, অর্চনা, কল্যাণোৎসবম্‌, দোলোৎসবম্‌ (উঞ্জল সেবা), অর্জিত ব্রহ্মোৎসবম্‌, অর্জিত বসন্তোৎসবম্‌, সহস্র দীপালংকারণ সেবা ও একান্ত সেবা।

সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান

মন্দিরের সাপ্তাহিক সেবাগুলি হল বিশেষ পূজা (সোমবার),অষ্টদল পাদপদ্মারধনা (মঙ্গলবার),সহস্র কলসাভিষেকম্‌ (বুধবার),তিরুপ্পবদ সেবা (বৃহস্পতিবার),অভিষেকম্‌ ও নিজপদ দর্শনম্‌ (শুক্রবার)। শনি ও রবিবার কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান হয় না।

সাময়িক অনুষ্ঠান

মন্দিরের সাময়িক অনুষ্ঠানগুলি হল জ্যেষ্ঠাভিষেকম্‌, আনিওয়ার অষ্টনাম, পবিত্রোৎসবম্‌ ও কোইল অলবর তিরুমাঞ্জনম্‌।

উৎসব

তিরুমালার বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে বছরের ৩৬৫ দিনে ৪৩৩টি উৎসব পালিত হয়। এই জন্য এই মন্দিরকে বলা হয় ‘নিত্য নিলয়ম পাচ্চা তোরানম্‌’ (যেখানে নিত্যই উৎসব)।

এই মন্দিরের প্রধান উৎসব শ্রীবেঙ্কটেশ্বর ব্রহ্মোৎসবম্‌। অক্টোবর মাসে উদযাপিত এই উৎসবটি চলে নয় দিন ধরে। এই উৎসবে বেঙ্কটেশ্বরের উৎসব-মূর্তি মালায়াপ্পাকে তার দুই পত্নী শ্রীদেবী ও ভূদেবীর সঙ্গে বিভিন্ন বাহনে চাপিয়ে মন্দিরের চারপাশে চারটি রাস্তায় শোভাযাত্রা বের করা হয়। বাহনগুলি হল ‘ধ্বজারোহনম্‌’, ‘পেদ্দা শেষ বাহনম্‌’, ‘চিন্না শেষ বাহনম্‌’, ‘হংস বাহনম্‌’, ‘সিংহ বাহনম্‌’, ‘মুতায়ুপু পান্দিরি বাহনম্‌’, ‘কল্পবৃক্ষ বাহনম্‌’, ‘ষড়ভ ভূপাল বাহনম্‌’, ‘মোহিনী অবতারম্‌’, ‘গরুড় বাহনম্‌’, ‘গজবাহনম্‌’, ‘রথোৎসবম্‌’, ‘অশ্ব বাহনম্‌’ ও ‘চক্র স্নানম্‌’। ব্রহ্মোৎসবমের সময়, বিশেষ করে ‘গরুড় বাহনম্‌’ দেখার জন্য লক্ষাধিক পূণ্যার্থী মন্দিরে আসেন।

বৈকুণ্ঠ একাদশী বৈষ্ণবদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। মনে করা হয়, এই দিন বৈকুণ্ঠ দ্বার খুলে যায়। তিরুমালায় এই উৎসব মহাসমারোহে পালিত হয়। এই এক দিনেই বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে দেড় লক্ষ তীর্থযাত্রী আসেন। তারা গর্ভগৃহের ‘বৈকুণ্ঠ দ্বারম্‌’ নামক দরজাটি প্রদক্ষিণ করেন।

রথসপ্তমী হল এই মন্দিরের অপর একটি উৎসব। ফেব্রুয়ারি মাসে এটি উদযাপিত হয়। এই উৎসব উপলক্ষে মালায়াপ্পাকে সাতটি আলাদা আলাদা বাহনে চড়িয়ে খুব ভোর থেকে রাত্রির শেষ ভাগ পর্যন্ত মন্দিরের চারপাশে ঘোরানো হয়।

অন্যান্য বার্ষিক উৎসবগুলির মধ্যে রামনবমী, জন্মাষ্টমী, উগাডি, তেপ্পোতসবম্‌, শ্রীপদ্মাবতী পরিণয়োৎসবম্‌, পুষ্প যাগম্‌, পুষ্প পাল্লাকি, বসন্তোৎসবম্‌ (মার্চ-এপ্রিল মাস) উল্লেখযোগ্য।

প্রথা

‘প্রসাদম্‌’

বেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা 
তিরুমালার বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে বেঙ্কটেশ্বরকে নিবেদিত লাড্ডু।

তিরুমালার বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে ‘প্রসাদম্‌’ বা প্রসাদ হিসেবে দেবতাকে নিবেদন করা হয় বিখ্যাত ‘তিরুপতি লাড্ডু’। এই লাড্ডুর জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন ট্যাগ রয়েছে। কেবলমাত্র তিরুমালা তিরুপতি দেবস্থানম্‌ই এই লাড্ডু তৈরি বা বিক্রি করতে পারে।

এই মন্দিরে নিবেদিত অন্যান্য প্রসাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘দদ্দোজনম্‌’ (দই-বরফ), ‘পুলিওহোরা’ (তেঁতুল-ভাত), ‘বাদা’ ও ‘চক্কেরা-পোঙ্গালি’ (মিষ্টি পোঙ্গল), ‘নির্যালা-পোঙ্গালি’, ‘আপ্পাম’, পায়স, জিলিপি, ‘মুরকু’, দোসা, ‘সিরা’ (কেশরী) ও ‘মালহোরা’। তীর্থযাত্রীদের রোজ বিনামূল্যে খাবার দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার ‘তিরুপাবদ সেবা’য় নানারকম খাদ্যসামগ্রী নৈবেদ্য হিসেবে উৎসর্গ করা হয়।

মস্তক মুণ্ডন

তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরের একটি বিশেষ প্রথা হল ‘মোক্কু’ (মাথার চুল দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন)। প্রতিদিন প্রায় এক টন চুল মন্দিরে সঞ্চিত হয়। এই সঞ্চিত চুল বছরে কয়েক বার আন্তর্জাতিক বিক্রেতাদের কাছে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। এগুলি কৃত্রিম চুল রোপণ, ও সজ্জাদ্রব্য হিসেবে তারা কিনে নেয়। চুল বিক্রি করে মন্দিরের কোষাগারে বছরে ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সঞ্চিত হয়। হুন্ডি সঞ্চয়ের পরই এটি মন্দিরের দ্বিতীয় বৃহত্তম আয়ের উৎস।

কথিত আছে, রাখাল যখন বেঙ্কটেশ্বরের মাথায় আঘাত করেছিল, তখন তার মাথার একটি অংশের চুল পড়ে গিয়েছিল। নীলাদেবী নামে এক গন্ধর্ব রাজকুমারী সেটি দেখতে পান। তার মনে হয়, বেঙ্কটেশ্বরের এত সুন্দর মুখে কোনো খুঁত থাকা উচিত নয়। তিনি নিজের চুলের একটু অংশ কেটে নিয়ে তার জাদুশক্তির সাহায্যে সেটি বেঙ্কটেশ্বরের মাথায় প্রতিস্থাপন করে দেন। নারীশরীরে চুল একটি সুন্দর সম্পদ। তাই বেঙ্কটেশ্বর নীলাদেবীর এই আত্মত্যাগ দেখে তাকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, তার মন্দিরে আগত প্রত্যেক ভক্ত বেঙ্কটেশ্বরকে নিজেদের মাথার চুল অর্পণ করবেন এবং সেই চুল নীলাদেবী পাবেন। তাই ভক্তেরা বিশ্বাস করেন যে, তারা নীলাদেবীকেই চুল নিবেদন করছেন। উল্লেখ্য, তিরুমালার সাতটি পর্বতের অন্যতম নীলাদ্রি এই নীলাদেবীর নামেই উৎসর্গিত।

‘হুন্ডি’ (দানপাত্র)

কথিত আছে, বেঙ্কটেশ্বরকে নিজের বিবাহের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়েছিল। শেষাদ্রি পর্বতে দিব্য পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য বেঙ্কটেশ্বর কুবের ও দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার কাছ থেকে ১১,৪০০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা ঋণ গ্রহণ করেছিলেন। এই কথা স্মরণ করে ভক্তেরা তিরুপতি বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরের ‘হুন্ডি’তে (দানপাত্র) অর্থ দান করেন। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, ভক্তদের দানের অর্থ দিয়ে বেঙ্কটেশ্বর কুবেরের ঋণ পরিশোধ করছেন। ২২৫,০০০,০০০ টাকা হুন্ডিতে সঞ্চিত হয়। মন্দিরে সোনা দান করেও ভক্তেরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। মন্দির সূত্র থেকে জানা গিয়েছে যে, ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে হুন্ডিতে প্রদত্ত দানের থেকে ৩,০০০ কিলোগ্রাম সোনা ভারতীয় স্টেট ব্যাংকে সঞ্চিত হয়েছে। পূর্বের কয়েক বছরে এই সোনা হুন্ডিতে জমেছিল।

‘তুলাভারম্‌’

‘তুলাভারম্‌’ তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রথা। এই প্রথায় একটি তুলাদণ্ডের একদিকে ভক্ত নিজে বসেন এবং অন্যদিকে তার সমান ওজনের চিনি, তালমিছরি, তুলসীপাতা, কলা, সোনা বা মুদ্রা রাখেন। সেই সব দ্রব্যসামগ্রী বেঙ্কটেশ্বরকে দান করা হয়। ‘তুলাভারম্‌' প্রথায় সাধারণত সদ্যোজাত শিশুদেরই ওজন করা হয়ে থাকে।

সংগীত ও স্তোত্র

তিরুমালা মন্দিরের প্রথম সেবা হল ‘শ্রীবেঙ্কটেশ্বর সুপ্রভাতম্‌’। গর্ভগৃহের ‘শয়ন মণ্ডপমে’ আয়োজিত এই সেবায় ভোরের আগে বেঙ্কটেশ্বরকে যোগনিদ্রা থেকে জাগরণ করানো হয়। এই স্তোত্রটি রচনা করেছিলেন প্রতিবাদী ভয়ংকরম্‌ আন্নাঙ্গচার্য। এই ‘সুপ্রভাতমে’ ৭০টি শ্লোক আছে। শ্লোকগুলি চারটি ভাগে বিন্যস্ত। যেমন: ‘সুপ্রভাতম্‌’ (২৯টি শ্লোক), ‘স্তোত্রম্‌’ (১১টি শ্লোক), ‘প্রপত্তি’ (১৪টি শ্লোক) ও ‘মঙ্গলশাসনম্‌’ (১৬টি শ্লোক)। ধনুর্মাসের সময় ছাড়া সারা বছরই ‘সুপ্রভাতম্‌’ সেবা আচরিত হয়। ধনুর্মাসে গীত হয় অণ্ডাল রচিত ‘তিরুপ্পাবই’।

শ্রীবেঙ্কটেশ্বর সুপ্রভাতমের প্রথম শ্লোকটি নিম্নরূপ:

দেবনাগরী
कौसल्यासुप्रजा राम पूर्वा संध्या प्रवर्तते ।
उत्तिष्ठ नरशार्दूल कर्त्तव्यं दैवमाह्निकम् ॥

বাংলা লিপি
কৌসল্যাসুপ্রজা রাম পূর্বা সন্ধ্যা প্রবর্ততে।
উত্তিষ্ট নরশার্দুল কর্ত্তব্যং দৈবমাহ্নিকম্‌॥

তাল্লাপাকা আন্নামাচার্য বেঙ্কটেশ্বরকে নিয়ে তেলুগু ও সংস্কৃত ভাষায় স্তব রচনা করেছিলেন। তার ‘ব্রহ্ম কাডিগিনা পাদমু’ ও ‘আদিবো আল্লাদিবো শ্রীহরিবাসামু’র মতো কীর্তনগুলি আজও জনপ্রিয়। তাঁর অন্যতম কীর্তন ‘জো অচ্যুতনদ’ প্রতিদিন রাতে মন্দিরে তার বংশধরেদের দ্বারা গীত হয়। আন্নামাচার্যের বংশধরেরা ‘সুপ্রভাতমে’র সময়ও গর্ভগৃহের প্রথম বারান্দায় তাঁর কীর্তনগুলি গান। তারিকোন্ডা বেঙ্কমাম্বা রচিত ‘মুত্যালা হারাতি’ তেলুভু কীর্তনটিও তার বংশধরেরা ‘একান্ত সেবা’র সময় গান। এছাড়া পুরন্দরদাস রচিত কন্নড় কীর্তন ‘দাসন মাদিকো এন্না’ ও ‘নাম্বিদে নিন্না পাদব বেঙ্কটরমন’ এবং ত্যাগরাজা রচিত তেলুগু কীর্তন ‘তেরা তীয়াগারাদা’ ও ‘বেঙ্কটেশ! নিন্নু সেবিমপানু’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গান। দ্বাদশ আলোয়ার কর্তৃক রচিত তামিল বিষ্ণুবন্দনা স্তোত্রসংগ্রহ ‘দিব্য প্রবন্ধমে’ এই মন্দিরের স্তুতি করা হয়েছে। ধনুর্মাসে গীত ‘তিরুপ্পাবই’ এই ‘দিব্য প্রবন্ধমে’রই অংশ।

‘শ্রীবেঙ্কটেশম মানস স্মরামি’, ‘শ্রীবেঙ্কটেশ্বর চরিত্র জ্ঞানামৃতম’ ও ‘গোবিন্দ নামালু’ (বেঙ্কটেশ্বরের অষ্টোত্তর শতনাম) বিশেষ জনপ্রিয় কয়েকটি স্তোত্র।

সপ্তগিরি

তিরুমালার ‘সপ্তগিরি’ বা সাতটি পর্বতকে সপ্তর্ষির প্রতীক মনে করা হয়। এই সাতটি পর্বতকে ‘সপথগিরি’ও বলা হয়ে থাকে। সেই কারণে বেঙ্কটেশ্বরের অপর নাম ‘সপ্তগিরিনিবাস’ (যিনি সাতটি পর্বতে বাস করেন)। উক্ত সাতটি পর্বত হল:

  • বৃষভগিরি — শিবের বাহন নন্দীর পর্বত।
  • আঞ্জনাদ্রি — হনুমানের পর্বত।
  • নীলাদ্রি — নীলাদেবীর পর্বত।
  • গরুড়াদ্রি বা গরুড়াচলম — বিষ্ণুর বাহন গরুড়ের পর্বত।
  • শেষাদ্রি বা শেষাচলম — বিষ্ণুর দাস শেষনাগের পর্বত।
  • নারায়ণাদ্রি — নারায়ণের পর্বত। শ্রীবারি পাদালু এখানে অবস্থিত।
  • বেঙ্কটাদ্রি — বেঙ্কটেশ্বরের পর্বত।

অন্যান্য মন্দিরসমূহ

বরদারাজা মন্দির

বরদারাজা মন্দির হল তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বর মন্দির চত্বরের একটি ছোটো মন্দির। এটি বিষ্ণুর অবতার বরদারাজা স্বামীর মন্দির। এই মন্দিরে কবে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা সঠিক জানা যায় না। এই মন্দিরটি মূল মন্দিরের প্রবেশপথে বেন্দিবাকিলির (রৌপ্যদ্বার) বাঁদিকে বিমানপ্রদক্ষিণমে অবস্থিত। মন্দিরের বিগ্রহটি প্রস্তর-নির্মিত ও পশ্চিমাস্য।

যোগনৃসিংহ মন্দির

যোগনৃসিংহ মন্দিরটি বেঙ্কটেশ্বর মন্দির চত্বরের একটি ছোটো মন্দির। এটি বিষ্ণুর পঞ্চম অবতার নৃসিংহের মন্দির। কথিত আছে, মন্দিরটি ১৩৩০-১৩৬০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ নির্মিত হয়েছিল। এটি মন্দিরের প্রবেশপথে বেন্দিবাকিলির (রৌপ্যদ্বার) ডানদিকে অবস্থিত। এই মন্দিরে নৃসিংহের ধ্যানরত মূর্তিটি পশ্চিমাস্য।

গরুতমন্ত মন্দির

জয়-বিজয়ের বঙ্গারুবকিলির (স্বর্ণদ্বার) ঠিক উল্টোদিকে বেঙ্কটেশ্বরের বাহন গরুড়ের একটি ছোটো মন্দির রয়েছে। এই ছোটো মন্দিরটি গরুড়মণ্ডপমের অংশ। গরুতমন্ত দেবমূর্তিটি ছয় ফুট লম্বা ও পশ্চিমাস্য হয়ে গর্ভদিকে বেঙ্কটেশ্বরের দিকে মুখ করে স্থাপিত।

ভূবরাহ স্বামী মন্দির

ভূবরাহ স্বামী মন্দিরটি বিষ্ণু অবতার বরাহের মন্দির। কথিত আছে, এই মন্দিরটি বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরের চেয়েও প্রাচীনতর। মন্দিরটি স্বামী পুষ্করিণীর উত্তর পাড়ে অবস্থিত। প্রথা অনুসারে, মূল মন্দিরে বেঙ্কটেশ্বরকে নৈবেদ্য নিবেদনের আগে ভূবরাহ স্বামীকে নৈবেদ্য নিবেদি হয় এবং ভক্তদেরও বেঙ্কটেশ্বরকে দর্শন করার আগে ভূবরাহ স্বামীকে দর্শন করতে হয়।

বেদী-আঞ্জনেয় মন্দির

বেদী-আঞ্জনেয় মন্দিরটি হনুমানের মন্দির। অখিলণ্ডমের (যেখানে নারকেল নিবেদিত হয়) কাছে মহাদ্বারমের ঠিক উল্টোদিকে এই মন্দিরটি অবস্থিত। এই মন্দিরে হনুমানের মূর্তিটির দুই হাত বাঁধা অবস্থায় থাকে (তেলুগু: বেদিলু)।

বাকুলামাতা সন্নিধি

বাকুলামাতা হলেন বেঙ্কটেশ্বরের মা। বরদারাজা মন্দিরের কাছেই মূল মন্দিরে তার মন্দিরে তার একটি মূর্তি রয়েছে। এই মূর্তিটি উপবিষ্ট অবস্থার মূর্তি। কিংবদন্তি অনুসারে, তিনি তার পুত্রকে নিবেদিত খাদ্যের রান্নার দেখভাল করেন। এই জন্য বেকুলামাতা সন্নিধি ও শ্রীবারি পোটুর (পাকশালা) মাঝের দেওয়ালে একটি ফুটো রাখা রয়েছে।

কুবের সন্নিধি

বিমানপ্রদক্ষিণমের ভিতর কুবেরের একটি ছোটো মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরটি গর্ভগৃহের ডানদিকে রয়েছে। মন্দিরের প্রধান দেবতা কুবের দক্ষিণাস্য।

রামানুজ মন্দির

বিমানপ্রদক্ষিণমের উত্তর বারান্দার গায়ে লাগোয়া রামানুজের মন্দিরটি অবস্থিত। ১৩শ শতাব্দী নাগাদ নির্মিত এই মন্দিরটি ভাষ্যকার সন্নিধি নামেও পরিচিত।

বিশিষ্ট ভক্ত

রামানুজ (১০১৭-১১৩৭) ছিলেন শ্রী বৈষ্ণবধর্মের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রবক্তা। বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরের পূজাপদ্ধতি ব্যবস্থাপনার কাজ তিনিই করেছিলেন।

বেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা 
পদ-কবিতা পিতামহ তাল্লাপাকা আন্নামাচার্যের (বা আন্নমায়া) মূর্তি। তিনি ছিলেন তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরের প্রধান গায়ক।

তাল্লাপাকা আন্নামাচার্য (বা আন্নামায়া]] (৯ মে, ১৪০৮ – ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৫০৩) ছিলেন তিরুপতি বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরের প্রধান গায়ক ও তেলুগু গীতিকার। তিনি প্রায় ৩৬,০০০ কীর্তন রচনা করেছিলেন। এর মধ্যে অনেকগুলিই ছিল মন্দিরের প্রধান দেবতা বেঙ্কটেশ্বরের স্তুতি। তার কীর্তনের সাংগীতিক শৈলীটি কর্ণাটকী সংগীতকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এগুলি আজও জনপ্রিয়। তাকে তেলুগু ভাষার ‘পদ-কবিতা পিতামহ’ (গীতিকবিতার আদি প্রাণপুরুষ) মনে করা হয়। তার গানগুলি সংকীর্তন ধারার মধ্যে অধ্যাত্মম ও শৃঙ্গার—এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। তার শৃঙ্গার শ্রেণীর গানগুলিতে বেঙ্কটেশ্বর ও আলামেল মাঙ্গার প্রেমকাহিনি বর্ণনার মাধ্যমে বেঙ্কটেশ্বরকে পূজা করা হয়। অন্যদিকে অধ্যাত্মম শ্রেণির গানগুলি বেঙ্কটেশ্বরের ভক্তদের ভক্তি বর্ণনা করে।

পুরন্দর দাস (জন্ম ১৪৮৪) কর্ণাটকী সংগীতের ‘পিতামহ’ নামে পরিচিত। তিনি বেঙ্কটেশ্বরকে নিয়ে অনেক গান রচনা করেছিলেন। তাকে ‘নারদাংশ’ বা নারদের অবতার মনে করা হয়। তার রচিত গানগুলি অধিকাংশই কন্নড় ভাষায়। তবে তিনি অনেকগুলি সংস্কৃত গানও রচনা করেছিলেন। বেঙ্কটেশ্বর সম্পর্কে তার কয়েকটি বিখ্যাত গান হল ‘বেঙ্কটাচল নিলয়ম’ (ড়াগ সিন্ধুভৈরবী), ‘বেঙ্কটেশ দয়া মাদো’ (রাগ আনন্দভৈরবী), ‘ওড়ি বারায়া বৈকুণ্ঠপতি’ (রাগ ভৈরবী), ‘শরণু বেঙ্কটরমণ’ (রাগ ভৈরবী), ‘তিরুপতি বেঙ্কটরমণ’ (রাগ সাভেরি), ‘তিরুপতি বেঙ্কটরমণ’ (রাগ খরহরপ্রিয়া) ইত্যাদি।

তারিকোন্ডা বেঙ্কটাম্বা (জন্ম ১৭৩০) ছিলেন একজন মহিলা কবি ও ১৮শ শতাব্দীতে বেঙ্কটেশ্বরের একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি তেলুগু ভাষায় অনেক কবিতা ও গান রচনা করেছিলেন। তার রচনাগুলির মধ্যে ‘তারিকোন্ডা নৃসিংহ শতকম’, তিনটি ‘যক্ষগণম-নৃসিংহ বিলাস কথা’, ‘শিব নাটকম’ ও ‘বালকৃষ্ণ নাটকম’; এবং ‘রাজয়োগামৃতসারম’, একটি ‘দ্বিপদ কাব্যম’, ‘বিষ্ণু পারিজাতম’, ‘চেঞ্চু নাটকম’, ‘রুক্মিণী নাটকম’ ও ‘জলক্রীড়া বিলাসম’ ও ‘মুক্তি কণ্ঠী বিলাসম’ (সবকটি যক্ষগণম), ‘গোপী নাটকম’ (গোল্লা-কলাপম-যক্ষগণম), ‘রাম পরিণয়ম’, ‘শ্রীভাগবতম’, ‘শ্রীকৃষ্ণমঞ্জরী’, ‘তত্ব কীর্তনালু’ ও ‘বাশিষ্ঠ রামায়ণম’ (দ্বিপদ), ‘শ্রীবেঙ্কটেশ্বর মাহাত্ম্যম’ (পদ্য প্রবন্ধম) এবং ‘অষ্টাঙ্গযোগসারম’ (পদ্যকৃতি)।

ককরলা ত্যাগব্রাহ্মণ (৪ মে, ১৭৬৭ – ৬ জানুয়ারি, ১৮৪৭) ছিলেন কর্ণাটকী সংগীতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকার। তিনি ত্যাগায়া বা ত্যাগরাজর নামেও পরিচিত ছিলেন। ত্যাগরাজা সহস্রাধিক ভক্তিগীতি রচনা করেছিলেন। এগুলির অধিকাংশই রামের বন্দনাগীতি। এগুলির মধ্যে অনেকগুলি আজও জনপ্রিয়। তার রচনাগুলির মধ্যে পাঁচটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এগুলিকে ‘পঞ্চরত্ন কৃতি’ বলা হয়। বেঙ্কটেশ্বর বন্দনায় তিনি রচনা করেন ‘তেরা তীয়াগারাদা’, ‘বেঙ্কটেশ! নিন্নু সেবিমপানু’ ইত্যাদি গান।

ধর্মীয় গুরুত্ব

তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বর মন্দির বিষ্ণুর আটটি ‘স্বয়ম্ভু ক্ষেত্রে’র অন্যতম। এখানে বিষ্ণুর প্রধান বিগ্রহ মানুষের সৃষ্ট নয় বলেই ভক্তরা বিশ্বাস করেন। অন্য সাতটি স্বয়ম্ভু ক্ষেত্র হল: শ্রীরঙ্গম রঙ্গনাথস্বামী মন্দির, ভূবরাহ স্বামী মন্দির ও বনমামালাই পেরুমল মন্দির (দক্ষিণ ভারত) এবং শালিগ্রাম, নৈমিষারণ্য, পুষ্করবদ্রীনাথ মন্দির (উত্তর ভারত)।

৭ম-৯ম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে আলোয়ার কবিদের রচনা নালাইরা দিব্য প্রবন্ধম গ্রন্থমালায় এই মন্দিরের স্তুতি করা হয়েছে। আলোয়াররা ‘পেরুমলে’র (বিষ্ণু) বিভিন্ন রূপের স্তবগান লিখেছিলেন। এই গ্রন্থমালায় মন্দিরটিকে বিষ্ণুর ১০৮টি ‘দিব্যদেশমে’র অন্যতম বলা হয়েছে। অনেক আচার্যই বেঙ্কটেশ্বরের বিভিন্ন রূপ বর্ণনা করে গান লিখেছেন।

নিকটবর্তী মন্দিরসমূহ

তিরুমালার কাছে অনেকগুলি প্রাচীন মন্দির আছে। তিরুপতি থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে তিরুচানুরে বেঙ্কটেশ্বরের পত্নী পদ্মাবতীর মন্দির অবস্থিত। তিরুমালা থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে কালহস্তীতে শিবের ‘বায়ু’ প্রকৃতির মন্দির শ্রীকালহস্তীশ্বর মন্দির অবস্থিত। তিরুপতি থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরে কানিপক্কম শহরে বিনায়কের শ্রীবরসিদ্ধি বিনায়ক মন্দির অবস্থিত। এই মন্দিরটি ১০ম শতাব্দীতে নির্মিত। এগুলি ছাড়াও তিরুপতি শহরে গোবিন্দরাজা মন্দির, কল্যাণ বেঙ্কটেশ্বর মন্দির, কোন্ডারাম মন্দির, কপিল তীর্থম অবস্থিত।

বেঙ্কটেশ্বরের অন্যান্য মন্দির

ভারতে

বিদেশে

টীকা

বহিঃসংযোগ

Tags:

বেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা কিংবদন্তিবেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা ইতিহাসবেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা মন্দির প্রশাসনবেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা স্থাপত্যবেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা মন্দিরের দেবমূর্তিসমূহবেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা পূজাবেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা মন্দিরের আচার-অনুষ্ঠানবেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা উৎসববেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা প্রথাবেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা সংগীত ও স্তোত্রবেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা সপ্তগিরিবেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা অন্যান্য মন্দিরসমূহবেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা বিশিষ্ট ভক্তবেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা ধর্মীয় গুরুত্ববেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা নিকটবর্তী মন্দিরসমূহবেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বরের অন্যান্য মন্দিরবেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা টীকাবেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা তথ্যসূত্রবেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালা বহিঃসংযোগবেঙ্কটেশ্বর মন্দির, তিরুমালাঅন্ধ্রপ্রদেশঅবতারকলি যুগচিত্তুর জেলাতিরুপতিবিষ্ণুবেঙ্কটেশ্বরবৈকুণ্ঠভারতভারতের রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলহিন্দু দেবদেবীহিন্দুধর্ম

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

বাংলা বাগধারার তালিকাপিপীলিকা (অনুসন্ধান ইঞ্জিন)রামায়ণইয়াজুজ মাজুজতায়াম্মুমআংকর বাটচ্যাটজিপিটিপাখিবাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহের তালিকানৈশকালীন নির্গমন২০২৩ তুরস্ক–সিরিয়া ভূমিকম্পসতীদাহসেজদার আয়াততেজস্ক্রিয়তাহিমালয় পর্বতমালামার্কিন যুক্তরাষ্ট্রমহাভারতের চরিত্র তালিকাইস্তিগফারআব্দুল কাদের জিলানীজাতীয় সংসদের স্পিকারদের তালিকাস্বরধ্বনিআসরের নামাজমহাবিস্ফোরণ তত্ত্বভারতীয় জনতা পার্টিডেঙ্গু জ্বরনিমএশিয়াবাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরদের তালিকাবেগম রোকেয়াডিএনএফাতিমাউইকিপ্রজাতিললিকনবাংলার ইতিহাসরাসায়নিক বিক্রিয়াস্বত্ববিলোপ নীতিশর্করাকুমিল্লা জেলাবাংলার নবজাগরণসূর্যমামুনুর রশীদসালাতুত তাসবীহপারদআলীবাংলাদেশ সেনাবাহিনীসূরা কাওসারইউসুফসাঁওতাল বিদ্রোহবঙ্গভঙ্গ (১৯০৫)খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরইন্দিরা গান্ধীবিশ্ব দিবস তালিকাএইচআইভি/এইডসজাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়জাতীয় স্মৃতিসৌধবাংলা সাহিত্যভরিবৃহস্পতি গ্রহফ্রান্সের ষোড়শ লুইঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানবাংলাদেশের মেডিকেল কলেজসমূহের তালিকাঘূর্ণিঝড়শুক্রাণুবিজ্ঞানকালিদাসজননীতিজনতা ব্যাংক লিমিটেডরোজাইশার নামাজবাস্তব সত্যহ্যাশট্যাগজবাবুধ গ্রহগেরিনা ফ্রি ফায়ারদক্ষিণ এশিয়াব্যঞ্জনবর্ণনাইট্রোজেন🡆 More