১৯৫০-এর পূর্ব পাকিস্তান দাঙ্গা বলতে ১৯৫০ সালের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমানে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের চালিত হত্যাকাণ্ডকে বোঝায়। এসময় পাকিস্তানি পুলিশ,প্যারা মিলিটারি বাহিনী বাঙালি হিন্দুদের ওপর হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন,অপহরণ, ধর্ষণ চালায়। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস জুড়ে এই দাঙ্গা অব্যাহত থাকে। অনেক হিন্দু বাঙালী পূর্ববঙ্গ থেকে প্রাণ হাতে পালিয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন।
এই নিবন্ধটি এমনভাবে লেখা হয়েছে যে মনে হচ্ছে এটি একটি ব্যক্তিগত ভাবনা বা মতামত সম্বলিত রচনা এবং হয়তো নিবন্ধটির পরিচ্ছন্নকরণ প্রয়োজন। (ফেব্রুয়ারি ২০১৯) |
এই নিবন্ধটিতে অ-উইকিপিডিয়াসুলভ শব্দ রয়েছে: এবং রয়েছে অস্পষ্ট বাক্যাংশ যা প্রায়শই পক্ষপাতমূলক বা যাচাই করা যায় না এমন তথ্যের সাথে থাকে। (ফেব্রুয়ারি ২০১৯) |
এই নিবন্ধটির বর্ণনা ভঙ্গি উইকিপিডিয়ার বিশ্বকোষীয় বর্ণনা ভঙ্গি প্রতিফলিত করেনি। এই ব্যাপারে নির্দিষ্ট আলোচনা আলাপ পাতায় পাওয়া যেতে পারে। নির্দেশনা পেতে সঠিক নিবন্ধ লেখার নির্দেশনা দেখুন। (মার্চ ২০১৮) |
১৯৫০-এর পূর্ব পাকিস্তান দাঙ্গা | |
---|---|
স্থান | পূর্ব পাকিস্তান |
তারিখ | ফেব্রুয়ারি-মার্চ, ১৯৫০ |
লক্ষ্য | বাঙালি হিন্দু |
হামলার ধরন | গণহত্যা, জোরপূর্বক ধর্মান্তর, লুটপাট, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ |
হামলাকারী দল | পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ, আনসার, পাকিস্তান সেনাবাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, স্থানীয় মুসলিম জনগোষ্ঠী |
কারণ | ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, মুসলিম জনগোষ্ঠী দ্বারা হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ |
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে ভারত এবং পাকিস্তান নামক দুটি দেশে পরিনত হয়। ব্রিটিশ ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান। অবিভক্ত বাংলা প্রদেশে জনসংখ্যার দিক দিয়ে মুসলিমরা হিন্দুদের চেয়ে সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে ছিল। কিন্তু অবিভক্ত বাংলারও বিভাজন হয়; মুসলিমগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) যুক্ত হয় পাকিস্তানের সাথে এবং হিন্দু গরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ যুক্ত হয় ভারতের সাথে। আসাম প্রদেশের অন্তর্গত বৃহত্তর সিলেট গণভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়। ১৯৪১ সালের আদমশুমারি অনুসারে পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যার ২৪.৫% অমুসলিম, যাদের অধিকাংশ বাঙালি হিন্দু। আবার পশ্চিমবঙ্গের ৩০.২%ছিল মুসলিম এবং বাকিরা সবাই ছিল হিন্দু।
দেশ বিভাগের পুরো দশক জুড়ে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগ জাতিগত ভাবে হিন্দুদের নির্মূলীকরণের সাক্ষী হয়ে ওঠে। দেশবিভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে অনিবার্য করে তোলার জন্য ১৯৪০ এর দশকে এই হিন্দু নির্মূলীকরণের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। ১৯৪৬ এর শেষ ভাগে পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) নোয়াখালী এবং ত্রিপুরা জেলার বাঙালী হিন্দুরা ধারাবাহিক ভাবে নির্মম গনহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরকরণের শিকার হয় মুসলিমদের দ্বারা, যা নোয়াখালী দাঙ্গা নামে পরিচিত। দেশবিভাগের একমাসের মধ্যেই ঢাকাতে জন্মাষ্টমী শোভাযাত্রায় মুসলিমরা আক্রমণ করে। ১৯৪৮ সালে বিখ্যাত ধামরাই রথযাত্রা এবং জন্মাষ্টমী শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৪৯ সালে সমগ্র ঢাকা অঞ্চলে বাঙ্গালী হিন্দুদের সব চেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার বিরুদ্ধে পোস্টার লাগানো হয়। এজন্য দুর্গাপূজার আয়তন এবং সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে হ্রাস পায়। বিজয়া দশমীর দিনে শত শত হিন্দু বাড়ি ঘরে অগ্নি সংযোগ করে মুসলিমরা। ফলে কমপক্ষে ৭৫০ টি হিন্দু পরিবারকে খোলা আকাশের নিচে নেমে আসতে হয়। প্রেস ট্রাস্ট অব ইণ্ডিয়া বা পিটিআই (PTI) এর প্রতিনিধি সন্তোষ চট্টোপাধ্যায়কে কোন রকম অভিযোগপত্র ছাড়াই ১৯৪৯ সালের ২৫ নভেম্বরে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং একমাস জেলে বন্দী করে রাখে।
১৯৪৯ সালের আগস্ট মাস থেকে সমগ্র পূর্ব বাংলা জুড়ে অমুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর নৃশংস বর্বরতা শুরু করে দেয় স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়; যা প্রায় তিন মাস জুড়ে চলতে থাকে। আগস্ট মাসে সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার এবং বড়লেখা পুলিশ স্টেশনের আওতাধীন এলাকার নিরীহ হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর স্থানীয় মুসলিম অধিবাসীরা পুলিশ এবং আনসার বাহিনীর সহযোগিতায় আক্রমণ শুরু করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর লুটপাট করা হয়,গুঁড়িয়ে দেয়া হয় এবং আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। হিন্দু গ্রামবাসীদেরকে লাঞ্ছিত করা হয় এবং হত্যা করা হয়। অনেক হিন্দু মেয়েকে এসময় পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা ধর্ষণ করে। এর কিছুদিন পরেই বরিশাল জেলার ভাণ্ডারিয়া গ্রামের হিন্দুরা আক্রান্ত হয়।রাজশাহী বিভাগের একজন পাদ্রী ফাদার থমাস ক্যাটানিও রিপোর্ট করেন যে, সেখানকার সাঁওতাল গ্রামের অধিবাসীরা আক্রান্ত হয়েছে ,তাদেরকে আটক করা হয়েছে এবং সাঁওতাল নারীদেরকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ডিসেম্বরের ১০ তারিখে উন্মত্ত মুসলিম জনতা রাজশাহীর পুঠিয়া রাজবাড়িতে ও আশপাশের বাড়ি-ঘরে হামলা চালিয়ে সম্পদ লুটপাট করে এবং সে সব বাড়িঘর দখল করে নেয়।
১৯৪৯ সালের ২০ ডিসেম্বরে তৎকালীন খুলনা জেলার বাগেরহাট উপজেলার মোল্লাহাট পুলিশ স্টেশনের আওতাধীন জয়দেব বর্মের বাড়ীতে কম্যুনিস্ট সদস্য লুকিয়ে আছে এই অভিযোগ করে শেষরাতে চারজন পুলিশ কনস্টেবল অভিযান চালায়। কিন্তু জয়দেবের বাড়ীতে কোন কম্যুনিস্ট সদস্যকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ সদস্যরা তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে চেষ্টা করে। তার স্ত্রী চিৎকার শুরু করলে জয়দেব বর্ম এবং তার আত্মীয়রা ক্ষিপ্ত হয়ে দু’জন পুলিশ কনস্টেবলের উপর চড়াও হয় এবং ঘটনাক্রমে একজন পুলিশ কনস্টেবল সেখানেই মারা যায়। বাকি দু’জন পুলিশ বিপদ ঘণ্টা বাজিয়ে দিলে পাশের প্রতিবেশীরা এসে তাদের উদ্ধার করে। পরের দিন জেলা পুলিশ সুপারিনটেনড সশস্ত্র পুলিশ কন্টিনজেন্ট এবং আনসার বাহিনী সহযোগে কালশিরা ও এর আশেপাশের হিন্দু গ্রামগুলোতে নির্দয় ভাবে আক্রমণ শুরু করে। তারা আশেপাশের গ্রামগুলোর মুসলিম অধিবাসীদেরকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর এবং সম্পত্তি লুটপাটে উৎসাহ দিতে থাকে। তারা হিন্দুদেরকে নির্দয়ভাবে হত্যা করতে শুরু করে এবং হিন্দু পুরুষ-মহিলাদেরকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের পবিত্র প্রতিমা, ছবি ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং হিন্দু মন্দিরগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়। ঐ গ্রামগুলোর ৩৫০টি বাড়ির সবগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয়। তিনটি মাত্র ঘর অবশিষ্ট ছিল। হিন্দুদের গবাদি পশু, নৌকা সব কিছু জোর করে ছিনিয়ে নেয়া হয়। মাত্র এক মাসের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে খুলনার ৩০,০০০ হিন্দু প্রাণের ভয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহী জেলার নওয়াবগঞ্জ সাবডিভিশনের একটি পুলিশ স্টেশন হল নাচোল পুলিশ স্টেশন। দেশভাগের পূর্বে নওয়াবগঞ্জ ছিল বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের(ভারতের) মালদা জেলার অন্তর্গত। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পরে নওয়াবগঞ্জ রাজশাহী জেলার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আর বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত হয়। নাচোল পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত এলাকা ছিল অমুসলিম প্রধান। এখানকার বেশিরভাগ অধিবাসী ছিল সাঁওতাল এবং বাঙ্গালী হিন্দু যাদের মধ্যে প্রধান ছিল ক্ষত্রিয়, ভুঁইদাস এবং কৈবর্ত সম্প্রদায়। দেশভাগের পরপরই সদ্য জন্ম নেয়া পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি তেভাগা আন্দোলনকে দমন করতে পৈশাচিক বর্বরতা এবং বর্ণনাতীত নৃশংসতার ঘৃণ্য পথ বেছে নেয়। কিন্তু নাচোলে তখনও এই আন্দোলন সক্রিয় ছিল আত্মগোপনে থাকা কিছু ব্যক্তির নেতৃত্বে। ১৯৪৯ সালের শরতকালে আন্দোলনের মাধ্যমে তেভাগা প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫ জানুয়ারি, ১৯৫০ সালে নাচোল পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন চণ্ডীপুর গ্রামের সাঁওতাল অধিবাসীরা পুলিস স্টেশনের সামনে বিক্ষোভ শুরু করে কারণ পুলিশ বাহিনী বিনা কারণে একজন সাঁওতাল আদিবাসীকে আটক করে। কিন্তু পুলিশ ঐ জনসমাবেশের ওপর গুলি চালালে সাঁওতাল আদিবাসীরা সহিংস হয়ে ওঠে এবং পুলিশের সাথে তাদের হানাহানি শুরু হয়। এতে ঘটনা স্থলে পাঁচ জন পুলিশ বাহিনীর সদস্য মারা যায়। এই ঘটনার ফলশ্রুতিতে ৭ জানুয়ারি তারিখে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ২,০০০ সদস্যের একটি সেনাবাহিনীর কন্টিনজেন্ট প্রেরণ করে এবং এর সাথে সশস্ত্র পুলিশ ও আনসার বাহিনী যুক্ত হয়। এই সশস্ত্র বাহিনী বারটি গ্রাম সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়, চণ্ডীপুরগামী গ্রামবাসীদেরকে ধরে ধরে হত্যা করে। চণ্ডীপুরের পুরুষ সদস্যদেরকে তারা হত্যা করে আর মহিলাদেরকে ধর্ষণ করে। তাদের বসতভিটা পুড়িয়ে ছাই করে ফেলে। শতশত সাঁওতাল এবং হিন্দুদেরকে এভাবে হত্যা করা হয়। রোহানপুরের তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ইলা মিত্র সহ আরও শতাধিক দরিদ্র কৃষককে গ্রেফতার করা হয়। নাচোল পুলিশ স্টেশনে নিয়ে তাদের উপর নৃশংস অত্যাচার চালানো হয় বাকি নেতাদের নাম জানার জন্য। পুলিশের এই বর্বর অত্যাচারে সেখানেই প্রায় ৭০-১০০ জন কৃষক মারা যায়। ইলা মিত্রকে নওয়াবগঞ্জ পুলিশ স্টেশনে হস্তান্তরের আগে টানা চার দিন ধরে পাশবিক শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।
ফেব্রুয়ারি মাসের ২ তারিখে তৎকালীন নোয়াখালী জেলার ফেনী উপজেলাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ শুরু করে মুসলিমরা, যদিও এর আগেই ঢাকাতে নৃশংসতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। একজন হিন্দুকে হত্যা করা হয়,আরও নয়জনকে মারাত্মক ভাবে জখম করা হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের কমপক্ষে নয়টি দোকান লুটপাট করা হয়।
১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য মুখ্যসচিব পূর্ব পাকিস্তানের প্রদেশ মুখ্যসচিব আজিজ আহমেদের সাথে একটি বৈঠকের জন্য ঢাকায় আসেন। ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০ টায় যখন আলোচনার অগ্রগতি হচ্ছিল ঠিক তখনই সচিবালয়ে রক্তমাখা কাপড় পরিহিত একজন মহিলাকে হাজির করা হয়। গুজব রটানো হয়,এই মহিলাকে কোলকাতায় ধর্ষণ করা হয়েছে। সচিবালয়ের কর্মচারী এবং কর্মকর্তারা তৎক্ষণাৎ কর্মবিরতির ডাক দিয়ে একটি মিছিল বের করে, যেখান থেকে হিন্দু বিদ্বেষী স্লোগান দেয়া হয়। তারা মিছিল নিয়ে নবাবপুরের দিকে অগ্রসর হয় এবং আরও অনেকে ওই মিছিলে যোগ দেয়। তৎকালীন ভিক্টোরিয়া পার্কে (বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্ক) এসে তাদের মিছিল শেষ হয়। দুপুর ১২ টার দিকে পার্কে আসা মিছিল থেকে বক্তারা হিংস্র হিন্দু বিদ্বেষী বক্তব্য প্রদান করে যাদের মধ্যে অনেকেই ছিল সচিবালয়ের কর্মকর্তা। দুপুর ১টার দিকে মিছিল এবং বক্তব্য প্রদান শেষ হবার পরপরই মুসলিমরা হিন্দু বাড়ি-ঘর ও দোকানপাট-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট করতে শুরু করে এবং লুটপাট শেষে অগুন ধরিয়ে দেয় সেগুলো। যেখানেই হিন্দুদেরকে পাওয়া যাচ্ছিল সেখানেই তাদেরকে হত্যা করতে শুরু করে মুসলিমরা। বিকেলের মধ্যেই ঢাকার ৯০% হিন্দু দোকান এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট করা হয় এবং সেগুলোর অধিকাংশ আগুন লাগিয়ে ছাই করে ফেলা হয়। হিন্দু মালিকানাধীন স্বর্ণালংকারের দোকান গুলোতে পুলিশের উপস্থিতেই লুটপাট চালায় মুসলিমরা। মাত্র সাত ঘণ্টার বীভৎস হত্যা, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগের তাণ্ডবেই ৫০,০০০ হিন্দু বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে। প্রেস ট্রাস্ট অব ইণ্ডিয়ার রিপোর্ট অনুসারে, সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় পড়েছিল বনগ্রাম এবং মকিম লেনের হিন্দু অধিবাসীরা। এই দুই জনবসতির প্রতিটি বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনার জন্য নির্মিত পবিত্র মন্দির গুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়।তাজউদ্দীন আহমেদ দুপুর ১ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেন এবং হিন্দুদের উপর মুসলিমদের চালানো অমানবিক বর্বর নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের কথা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন। তিনি ঢাকার নবাবপুর, সদরঘাট, পাটুয়াটুলি, ইসলামপুর, দিগবাজার, ইংলিশ রোড, বংশাল এবং চকবাজার ঘুরে দেখেন। ১২ ফেব্রুয়ারি তারিখে ভারতগামী ৬০ জন যাত্রীকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে আক্রমণ করে মুসলিমরা।তেজগাঁও বিমানবন্দরে আসা প্রত্যেক অমুসলিম যাত্রীকে ছুরি দিয়ে কোপানো হয়।
ঢাকতে হিন্দুদের উপর তিনদিন ব্যাপী গনহত্যা চালানোর পরে গ্রামাঞ্চল গুলোতে যেমন বিক্রমপুর, লৌহজং-এ হত্যাযজ্ঞ শুরু করে মুসলিমরা। ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে শিমুলিয়া বাজারের হিন্দু দোকানে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে তারা। ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত লৌহজং এবং দিঘালিতে হিন্দুদের উপর চালানো ১৫ টি ছুরিকাঘাতের রিপোর্ট আসে। ২৮ ফেব্রিয়ারি তারিখে সম্পূর্ণ দিঘালি বাজার আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা হয়। কালীগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন পারুল্লা গ্রামের সব হিন্দু বাড়ি লুট করা হয়। খোসলা,গজারিয়া, কারার চর, চর সিন্দুর, পলাশ, সদরচর গ্রামগুলোর প্রতিটি হিন্দু বাড়ি লুটপাট করে মুসলিমরা। ভারত সরকারের সুত্র থেকে জানা যায়, প্রথম দু’দিনের মধ্যেই নৃশংসতার শিকার কমপক্ষে ২০০ জন হতভাগ্য হিন্দুর মৃতদেহ পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা হয়। সূত্র থেকে আরও জানা যায় যে, ৮০,০০০ হতভাগ্য হিন্দু (যাদের মধ্যে ৫০,০০০ ঢাকার) জীবন বাঁচাতে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে চলে যায়।
পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের প্রেস নোট অনুসারে দুই অজ্ঞাত পরিচয়ের যুবক ১৩ই ফেব্রুয়ারি দুপুর হতে উত্তেজনাপূর্ণ গুজব ছড়াতে শুরু করে বরিশাল শহর জুড়ে। ফলে বরিশালের দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়। আরও একটি গুজব ছড়ানো হয় যে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও তার ভগ্নিপতিকে কোলকাতায় খুন করা হয়েছে। সন্ধ্যা নেমে আসতেই কমপক্ষে আট জায়গাতে অগ্নি সংযোগ করা হয়। ত্রিশটি বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেওয়া হয় এবং কমপক্ষে দশ জন আগুনে দগ্ধ হয়। পরস্থিতির আরও অবনতি হতে শুরু করে যখন ১৬ই ডিসেম্বরে বরিশাল জেলার অন্তর্গত গৌরনদী, ঝালকাঠি, নলছিটি সাব-ডিভিশন গুলোতে নির্বিচারে হিন্দুদের উপর হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ শুরু করা হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নিস্ক্রিয় করে রাখা হয়। বরিশাল জেলার আগরপুর ইউনিয়নের ব্রাহ্মণদিয়া গ্রামে কয়েক হাজার হিন্দু আশ্রয় নেয়। বরিশালের এ দাঙ্গার বিরুদ্ধে দাড়িয়েছিলেন বরিশাল জেলা মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি এবং আগরপুর ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট আলতাফউদ্দীন মোহাম্মদ। তিনি তার এলাকার হিন্দুদের রক্ষা করতে তার নিজ বাড়িতে ও শুভাকাংখীদের কাছে আশ্রয় দেন। তিনি কিছুসংখ্যক গ্রামবাসী নিয়ে দাঙ্গা প্রতিরোধে অবতীর্ণ হন এবং নিজেই বন্দুক হাতে আশ্রয়প্রার্থীদের প্রহরায় নিযুক্ত হন। ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে দাঙ্গাকারীরা দল বেঁধে আক্রমণ করতে আসে। আলতাফউদ্দীন তাদের নিরস্ত করতে ফাঁকা গুলি ছোড়েন। দুর্বৃত্তেরা দূর থেকে তাকে লক্ষ করে বল্লম ছোড়ে। আলতাফউদ্দীন তাতে বিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে তারা তাকে হত্যা করে।
তাঁর আত্মাহুতিতে দাঙ্গা প্রতিরোধ করতে অনেকে এগিয়ে আসে এবং পরদিন বরিশালের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে এক সশস্ত্র পুলিশ-বাহিনী ওই গ্রামে এসে দাঙ্গা দমন করতে থেকে যায়। আলতাফউদ্দীনের আত্মত্যাগের ফলে সেদিন বহু প্রাণ রক্ষা পেয়েছিল। তার জীবনদান নিয়ে কবি জসীমউদ্দীন একটি মর্মস্পর্শী কবিতা লেখেন। ১৯৫১ সালে বরিশালে আলতাফ উদ্দীন স্মরণসভায় যোগ দিয়ে টাঙাইল এর রণদাপ্রসাদ সাহা রায় বাহাদুর তাঁর স্মৃতিরক্ষায় ৩৫ হাজার টাকা দান করেন এবং আরো ৭০ হাজার টাকা দানের প্রতিশ্রুতি দেন। আগরপুরে আলতাফউদ্দীন-প্রতিষ্ঠিত মডেল একাডেমীর নাম পরিবর্তন করে শহীদ আলতাফউদ্দীন মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউশন করা হয় এবং সরকার তার পরিবারের সাহায্যার্থে ৫০ বিঘা খাস জমি প্রদান করে।
নির্যাতনের বীভৎসতা সহ্য করতে না পেরে বরিশালের নৌ বন্দর এলাকা মুলাদী পুলিশ স্টেশনে শত শত হিন্দু এসে আশ্রয় গ্রহণ করে।কিন্তু নিজেদের এলাকা থেকে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নেয়া হতভাগ্য হিন্দুদেরকে পুলিশ স্টেশন কম্পাউণ্ডের মধ্যেই নির্মম ভাবে হত্যা করে আশেপাশের মুসলিমরা। এই ঘটনাটা মুলাদি হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। একজন হিন্দু স্কুলশিক্ষককে তারই ছাত্ররা জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে কাবাব তৈরি করে এবং জলন্ত আগুনের চারপাশে তারা নৃত্য করে হত্যা উদযাপন করে। বাবুগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত মাধবপাশা গ্রামে প্রায় তিনশ হিন্দুকে ধাওয়া করে আটক করে মুসলিমরা।এরপরে তাদেরকে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে রাম দা দিয়ে মাথা কেটে নেয় তারা। মাধবপাশা জমিদার বাড়ীতে ২০০ হিন্দুকে হত্যা করা হয় এবং আরও ৪০ জন মারাত্মক ভাবে আহত হয়।
ভোলা শহর থেকে মেঘনা তীরবর্তী ইলিশা স্টিমারঘাট প্রায় ৭ কি.মি. দূরে অবস্থিত। বরিশাল-চট্টগ্রাম জলপথে এই স্টিমার ঘাট পার হয়ে যেতে হয়।১৯৫০ সালের ১৬ ডিসেম্বরে, রয়েল স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির এস.এস.সীতাকুণ্ড চট্টগ্রাম যাবার পথে ইলিশাঘাটে নোঙ্গর করে। স্টিমারের নাবিকদল হিন্দু যাত্রীদের কাছ থেকে সর্বস্ব হাতিয়ে নিয়ে যায়। আনুমানিক রাত ৮টার দিকে উন্মত্ত মুসলিমরা স্টিমারের হিন্দু যাত্রীদের উপর চড়াও হয়,যদিও তখন স্টিমার ঘাটে নোঙ্গরকৃত অবস্থায় ছিল।তারা নিরস্ত্র হিন্দু যাত্রীদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং মৃতদেহ গুলো নদীতে নিক্ষেপ করে।কমপক্ষে ৩০ জন হিন্দু সেদিন নিহত হয় এবং ভাগ্যক্রমে তিন জন হিন্দু আহত অবস্থায় বেঁচে যায়।
বরিশালের সে সময়কার মুসলিম প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে,বরিশালে বেশ কয়েক হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হয় এবং ২,০০০ হিন্দুর আর কোন হদিস পাওয়া যায়নি। গবেষক শুভশ্রী ঘোষের মতে, বরিশাল জেলায় কমপক্ষে ২,৫০০ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়। তথ্যচিত্র নির্মাতা সুপ্রিয় সেন ধারণা করেন, ৬৫০,০০০ জন হিন্দু বরিশাল থেকে ভারতে পালিয়ে যায় এবং ওই শরণার্থীরা তাদের যাত্রা পথেও হত্যা,ধর্ষণ,অপহরণ ও লুটপাটের শিকার হয়।
১২ই ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে হিন্দু গণহত্যা শুরু হয়। ফজলুল কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে আনসার বাহিনী হিন্দুদের কচুকাটা করতে শুরু করে। হিন্দুপাড়াগুলো দাউদাউ করে জ্বলছিল। চাটগাঁ, নোয়াপাড়া, চৌধুরী হাট, পটিয়া, বোয়ালখালী, সীতাকুন্ডয় হিন্দুদের কচুকাটা করা হয়। পাহাড়তলীতে ট্রেন থামিয়ে ট্রেনের সমস্ত হিন্দু যাত্রীদের হত্যা করা হয়। পূর্ব বাংলার গণপরিষদের সদস্য নেলী সেনগুপ্ত পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানকে চট্টগ্রামের হিন্দু গণহত্যা সম্পর্কে চিঠি লেখেন।
চট্টগ্রামে চারজন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ব্যক্তিকে কুপিয়ে আহত করা হয়। যাদের মধ্যে একজন ছিলেন পুলিশ ইনস্পেক্টর। এছাড়া বেশ কিছু বৌদ্ধমঠ ধ্বংস করে দেয় মুসলিমরা।ফটিকছড়ি পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন বেশ কিছু বৌদ্ধ পরিবারের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয় মুসলিমরা।রাউজান পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত লাম্বুরহাটের বৌদ্ধ জমিদার বাড়িটি পুড়িয়ে ছাই করে দেয় মুসলিমরা। এর ফলে প্রচুর সংখ্যক ভীতসন্ত্রস্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ জীবন বাঁচাতে ভারতের লুসাই পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখে চট্টগ্রাম শহরে গণহত্যা শুরু হয়।সীতাকুণ্ডে মহাশিবরাত্রি উপলক্ষে যে সকল হিন্দু তীর্থযাত্রী সমাবেত হয়েছিল তাদের উপর মুসলিম জনতা আক্রমণ করে। এটি সীতাকুন্ড গণহত্যা নামে পরিচিত।
এইসব পোগরোমের পর পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ চাটগাঁ যান। স্বাধীনতা সংগ্রামী সঞ্জীব প্রসাদ সেন তাঁকে সমস্ত জায়গা ঘুরিয়ে দেখানো। আরো দুই স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনোদ বিহারী চৌধুরী ও বীরেন্দ্র পাল চৌধুরীর সাথে মিলে মৃত হিন্দু ও বৌদ্ধদের তালিকা তৈরি করেন।
১০ই ফেব্রুয়ারী নোয়াখালী জেলার হিন্দুদের ওপর হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। ১৩ই ফেব্রুয়ারি বিকাল বেলায় প্রকাশ্য দিবালোকে ফেনী জেলার হিন্দুদের উপর পাশবিক বর্বরতা চালানো হয়; যদিও মাত্র ২০০ ইয়ার্ডের(৬০০ ফুট) মধ্যে ফেনীর এস.ডি.ও পুলিশ স্টেশন ও আদালত অবস্থিত ছিল। ফেনীর তৎকালীন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলো যেমন মাস্টারপাড়া, উকিলপাড়া, ডাক্তারপাড়া, সহদেবপুর, বারাহীপুর, সুলতানপুরের হিন্দুদের উপর মুসলিমরা আক্রমণ করে এবং তাদের বসতভিটে জ্বালিয়ে দেয়। গুরুদাস কর নামের হিন্দুসম্প্রদায়ের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে মুসলিমরা হত্যা করে। ফেনী শহরের হিন্দুদের উপর নির্মম তাণ্ডব চালানোর পর তা ছড়িয়ে ফেনী এবং ছাগলনাইয়া পুলিশ স্টেশন এলাকার গ্রামগুলোতে যেখানে মুলত হিন্দু নাথ সম্প্রদায়ের অধিবাসীরা বসবাস করত। হিন্দুপ্রধান বাঁশপাড়া, রামপুর, মধুপুর, শ্রীচন্দ্রপুর, বাশিকপুর, চাকবস্তা, শিবপুর, বালিগঞ্জ ইত্যাদি গ্রামগুলোকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। বিভিন্নসূত্রে জানা যায় কমপক্ষে ৪৫ জন নিরীহ হিন্দুকে হত্যা করে মুসলিমরা এবং ২০৫টা বাড়ি পোড়ানোর পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুটপাট করে তারা।
হিন্দু মেয়েদেরকে মুসলিমরা অপহরণ করে এবং অনেককে জোরপূর্বক বিয়ে করে। হরেন্দ্রনাথ করের মেয়ে মিলা করকে সুলতান মিয়াঁ নামক একজন সিভিল সাপ্লাই কন্ট্রাক্টর অপহরণ করে এবং জোর করে বিয়ে করে। অপহরণের আগে মিলা করের বাবা, ঠাকুরদাদা এবং তার ছানাকে তার সামনেই জবাই করে মুসলিম জনতা। বারিক মিয়াঁ নামের একজন সম্মানিত ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলে রহমত আলী, রেণুবালা নামের একজন বিবাহিত মেয়েকে জোরকরে বিয়ে করে।
২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলতে থাকা বিরামহীন ধ্বংসযজ্ঞে প্রায় ৪৫০০ নিরীহ হিন্দু ফেনী সরকারী কলেজ স্থাপন করা রিফুউজি ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণ করে। আরও ২৫০০ হিন্দু প্রাণের ভয়ে নোয়াখালী জেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়। যেসব হিন্দুরা ভারতের ত্রিপুরায় পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে, রাস্তাতেই তাদের সর্বস্ব লুট করে নেয় মুসলিমরা। অনেক হিন্দু মেয়ে ও শিশু চাঁদপুর, আখাউড়া রেলস্টেশনে আশ্রয় নেয়। পুলিশ, আনসার ও তৌহিদি জনতা তাদেরকে আগরতলা কিংবা কোলকাতায় পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখান করে। অমৃতবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বেলোনিয়াতে পালিয়ে এসে প্রায় ৫,০০০ শরণার্থী জীবন রক্ষা করে।
সিলেটে অসহায় হিন্দুদের ওপর চালানো বর্বর গণহত্যা, গণধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের বীভৎসতা এক দীর্ঘস্থায়ী রূপ লাভ করে। ২০৩টে হিন্দুগ্রাম সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে ফেলে মুসলিমরা এবং ৮০০টা হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে ফেলে তারা। ধামাই, বারাধামি, পুবঘাট, বরইতলি গ্রামের ৫০০ টি মনিপুরী পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয় মুসলিম আক্রমণের ফলে।
সিলেটে গণভোটের সময় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো হয় যে, হিন্দুরা যেহেতু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে তাই তারা পাকিস্তানের শত্রু। ১৯৫০শের ৬ই ফেব্রুয়ারি বাজ্ঞে ট্রাইব্যুনাল (Bagge Tribunal) রায় ঘোষণা করে। সিলেটের মুসলিমরা আশা করেছিল আসামের করিমগঞ্জও পাকিস্তানের অংশ হবে কিন্তু তা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। সিলেট বার এ্যাসোসিয়েশনের কিছু আইনজীবী এবং করিমগঞ্জের কিছু মোক্তার হুমকি দেয় সেখানে তারা ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করবে। ১০ই ফেব্রুয়ারি মুসলিমরা সিলেটের প্রাণকেন্দ্র বন্দরবাজারে সুবিশাল একটি পোস্টার টাঙায়। লাঠি এবং অস্ত্র হাতে হিন্দুরা একজন মুসলিমের গলায় দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এমন একটি ছবি ওই পোস্টারে আঁকা ছিল যার শিরোনাম ছিল : হিন্দুস্থানের মুসলমানদের ওপর হিন্দুদের নির্যাতন। লামডিং (আসামের একটা শহর) এবং কোলকাতায় মুসলিমদের রক্তের নদী প্রবাহিত হচ্ছে-এমন গুজব ছড়ানো হয়। স্থানীয় মুসলিমরা খুব আগ্রহ সহকারে এই পোস্টার দেখত এবং কিছু অতি উৎসাহী এর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার শপথ নেয়। ১১ই ফেব্রুয়ারি গোবিন্দ পার্কে আয়োজিত র্যালিতে হিন্দুর রক্তের জন্য হুঙ্কার ছাড়ে মুসলিমরা। এর মাঝেই গুজব ছড়ানো হয় কোলকাতায় এ কে ফজলুল হককে হত্যা করা হয়েছে। ফলে সিলেটের অবস্থা খুব দ্রুত অবনতির দিকে যেতে থাকে। ১৩ই ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব বাংলার মুখ্য সচিবদের নেয়া যৌথ সিদ্ধান্ত অনুসারে, সিলেটে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এর মাঝেই পৃথ্বীশ দাস নামে একজন হিন্দু যুবককে জিন্দাবাজারে ছুরি দিয়ে কোপানো হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি গুজব ছড়ানো হয় আসামের করিমগঞ্জে মুসলিমদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। আইনজীবীদের একটি সমাবেশে সিলেটের ডেপুটি কমিশনার তার বক্তব্যে ইচ্ছে করে উল্লেখ করেন, করিমগঞ্জে ৫,০০০ মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে এবং সেখানকার বিশাল সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠী সিলেটে আশ্রয়ের জন্য এসেছে। সেদিনই সন্ধ্যায় মতি দাস নামক একজন হিন্দুকে জালালপুরের কাছে হত্যা করা হয়। তিনজন মনিপুরীকে কোপানো হয়, যাদের মধ্যে দু’জন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
১৪ই ফেব্রুয়ারির বিকেলে লামাবাজার নামের এক বিপণীকেন্দ্র মুসলিমরা লুট করে। ১৫ই ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই গ্রামাঞ্চলে লুটপাট এবং হত্যা শুরু হয়। সকাল নটায় মূর্তি নামক গ্রামে আক্রান্ত হয়। হাজার হাজার মুসলিম হিন্দুবিদ্বেষী স্লোগান সহকারে সেনাপতি পরিবারের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। পরিবারের সদস্যদেরকে পিটিয়ে বাড়ি ঘর লুট করে মুসলিমরা। উপাসনালয়ের পবিত্র ছবি ও মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং পরিবারের সকল সদস্যদেরকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মান্তরিত করে। এরপর মুসলিমরা আজমতপুর, দাসপাড়া, নাসিয়াঞ্জি এবং মহেশপুর গ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে। পরেরদিন মুসলিমরা পুনারায় মূর্তি গ্রামে যায় এবং সেনাপতি পরিবারের কাছ থেকে জোরপূর্বক একটি লিখিত বিবৃতি আদায় করে যেখানে লেখা ছিল সেনাপতি পরিবারের সদস্যরা স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়েছে। রাত ৮টায় সিলেট থেকে মাত্র ছয় মাইল দূরে নওগ্রামের গুরুচরণ ধরের পরিবারের উপর আক্রমণ করা হয়। পরের দিন সকাল ৭টায় ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মুসলিমরা গ্রামটি ঘিরে ফেলে। কমকরে ১,৫০০ হিন্দু প্রাণভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পাশের জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে। মুসলিমরা সম্পূর্ণ গ্রাম ধরে লুটপাট ও অগ্নি সংযোগ করে এবং সকল পারিবারিক মন্দির, উপাসনালয় ও পবিত্র তুলসীমঞ্চ গুলো ধ্বংস করে ফেলে। পাশের গ্রাম মন্মথপুরের মহেন্দ্র চন্দ্র দে, কামাকান্ত ধর, অশ্বিনী কুমার দে’র বাড়িসহ সকল হিন্দুবাড়ি লুট করে। তারা অশ্বিনী কুমার দে’র এক মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরের দিন ধর্ষিত, বিকৃত, জ্ঞানশূন্য অবস্থায় হতভাগ্য মেয়েটির দেহ বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়। ১৫ই ফেব্রুয়ারির রাতে মুসলিমরা ঢাকা দক্ষিণের ভরত দত্তের দুজন অবিবাহিত মেয়েকে ধর্ষণ করে। ১৮ই ফেব্রুয়ারি সকাল বেলায় চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় তাদেরকে ফেরত দেয়া হয়। তাদের পরিবার পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে গেলে, পুলিশ তাদেরকে আদালতের বাইরে মিমাংসার জন্য ১,০০০ রূপী দিতে বলে। সিলেট সদর পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় সব গ্রামেই অসংখ্য মেয়েকে এভাবে ধর্ষণ করে মুসলিমরা।
১৫ই ফেব্রুয়ারি গঙ্গাজল গ্রামের দীনেন্দ্র চন্দ্র দেব পুরকায়স্থের বাড়ি লুট হয় এবং মুসলিম দুষ্কৃতকারীরে তা দখল করে নেয়। সকাল ৯ টায় বাহুবল(পূর্বে করিমগঞ্জের একটি সাব-ডিভিশন ছিল)পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন সিলানি গ্রামে আক্রমণ চালানো হয়। সেখানে হিন্দু বিদ্বেষী স্লোগান দেয়া হয় এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। অনেক হিন্দু প্রাণ বাঁচাতে পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নেয় এবং যারা পালাতে পারেনি তাদেরকে ধর্মান্তরিত করা হয়। আর যারা ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকার করে তাদেরকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। ঢাকাদক্ষিণ এবং কাচুয়ারি থেকে অনেক প্রখ্যাত বাউন পরিবারের মেয়েদের জোরপূর্বক অপহরণ করে মুসলিমরা। হবিগঞ্জ সাব-ডিভিশনের চুনারঘাট পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার কেতন দাস, অশ্বিনী নাথ, বীরেন্দ্র নাথ সহ নাম না জানা আরও অনেক হিন্দু পরিবারের সকল সদস্যদেরকে ঘৃণ্য উপায়ে ধর্মান্তর করে মুসলিমরা। ফেঞ্জুগঞ্জের একটি স্টিমার কোম্পানি লুট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। ইলাসপুরে পুলিন দে নামক একজন হিন্দুকে হত্যা করা হয়। ফেঞ্জুগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত মাজিগাঁও এলাকার অম্বিকা কবিরাজ ও মাখন সেনের নিবাস লুট করে পুড়িয়ে দেয় মুসলিমরা। বালাগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত রুকানপুর গ্রামের দিগেন্দ্র সেন, গোপেশ সেন এবং শিব চরণ দাসের বসত বাড়ি লুট করা হয় এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা নির্মম প্রহারের শিকার হয়। মাধুরাই এবং কাঁঠালখই এলাকার হিন্দুদেরকেও প্রহার করা হয় এবং তারা জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের শিকার হয়। গোলাপগঞ্জ পুলিশস্টেশনের ফুলসাইন গ্রামের বৈকুণ্ঠ রায় এবং রাসবিহারী রায়ের বাড়িও লুট হয়। বিশ্বনাথ পুলিশ স্টেশনের দণ্ডপাণিপুরের হিন্দুরাও ভয়ঙ্কর লুটপাটের শিকার হয়। হিন্দুদের কাছে পবিত্র গরু জবাই করে তাদেরকে সেটির মাংস খাওয়ানো হয় জোর করে আর সবাইকে ইসলাম ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়। টুকেরকান্দি গ্রামের ঘোষ বাড়ি লুট করে মুসলিমরা। যোগেন্দ্র ঘোষকে নিষ্ঠুর ভাবে খুন করা হয় এবং অনেক হিন্দুকে কুপিয়ে আহত করা হয়। সিজেরকাছ নামক এলাকার পাল, চৌধুরী সহ সকল হিন্দু ব্রাহ্মণ বাড়ি লুটপাট করা হয় এবং সবাইকে ধর্মান্তরিত করা হয়। বিমল স্মৃতিতীর্থ নামে একজন সজ্জন হিন্দু পণ্ডিত ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। তার পবিত্র পৈতে ছিঁড়ে ফেলে, তাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে উপর্যুপরি কোপানো হয়। ব্রাহ্মণদের মাথার টিকি টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয় এবং উপাসনার মন্দির ও মূর্তি গুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়।
১৬ই ফেব্রুয়ারি মুসলিমদের ৩০০জনের একটা দল আখরা নামের গ্রামে আক্রমণ করে। গ্রামের মন্দিরের পুরোহিত পালিয়ে গেলে তারা সকল ছবি ও মূর্তি ধ্বংস করে। এরপর তারা হরিপদ চৌধুরী ও বিমল ভট্টাচার্যের বসত বাড়ি সহ পুরো গ্রামের সব হিন্দু বাড়ি ঘর লুট করে। ১৭ই ফেব্রুয়ারি মুসলিম গুণ্ডারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে হিন্দুদেরকে আক্রমণ করে। তারা ব্রাহ্মণদের পৈতে টেনে ছিঁড়ে ফেলে, পা দিয়ে মাড়িয়ে, জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করে। সুনাইতা এবং কুর্মা গ্রামের হিন্দু মেয়েদের ওপরও চালানো হয় বীভৎস নির্যাতন। তাদের সিঁথির সিঁদুর পা দিয়ে মাড়িয়ে মুছে দেয়া হয় এবং হাতের শাঁখাপলা ভেঙ্গে ফেলা হয়। রাজগঞ্জ আখরা গ্রামের নীর ভট্ট এবং রাম চন্দ্র ভট্টের বাড়ি লুট করে মুসলিমরা। ১৭ই ফেব্রুয়ারি ৫০০-৬০০ মুসলিমের একটা দল ছাতক পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত লোকেশ্বর গ্রামে আক্রমণ করে। সেখানে হিন্দুদের বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের বাড়িঘর লুট করে তারা এবং দু’জনকে নির্মম ভাবে পিটিয়ে আহত করে। এখানেও তারা ব্রাহ্মণদের পবিত্র পৈতা ছিঁড়ে ফেলে এবং মাথায় রাখা চুলের শিখা বা টিকি কেটে দেয়। তাদেরকেও জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়। মারকুল নামের একটা গ্রাম পুরোপুরি লুট করা হয় এবং গ্রামের সকল অধিবাসীদেরকে মুসলমান বানিয়ে দেয়া হয়। ১৯শে ফেব্রুয়ারি জকিগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের আওতাধীন সদরপুর গ্রামে আক্রমণ করে মুসলিমরা। শুকলাল নামের এক চাঁড়ালের বাড়ি লুট করে তারা। তার ভাই পুলিশ স্টেশনে অভিযোগ করতে গেলে পুলিশ তাকে বেয়নেট দিয়ে কুপিয়ে জখম করে এবং পা দিয়ে লাথি মেরে পুলিশ স্টেশন থেকে তাড়িয়ে দেয়। রাতের আঁধারে গ্রামের হিন্দুরা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সাঁতার কেটে নদী পার হয়। পারগ্রামের চাঁড়াল বাড়িগুলো সব মুসলিমরা লুট করে এবং দখল করে নেয়।
২৮শে ফেব্রুয়ারির কোলকাতাগামী আসাম মেইল ট্রেনে জঘন্যভাবে আক্রমণ করে মুসলিমরা। ওই ২৮ তারিখেই আবারও রাজশাহী জেলার হিন্দুদের উপর নির্দয় আক্রমণ শুরু করে তারা। তানোর, নাচোল, গোমস্তাপুর পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন গ্রাম্যএলাকা গুলোতে বৃহৎ পরিসরে বীভৎস হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ শুরু করা হয়। হিন্দুদের ঘরবাড়ি জোর করে দখল করে নেয় মুসলিমরা। হিন্দু মহিলাদেরকে গণধর্ষণ করে তারা। নির্যাতনের বীভৎসতা সহ্য করতে না পেরে অনেক হিন্দু নরনারী ভারতের মালদহ জেলায় পালিয়ে যায়। হিন্দু শরণার্থীরা যখন ভারতে পালিয়ে যেতে শুরু করে তখন তাদের যাত্রাপথে সকল প্রকার নির্যাতন করতে শুরু করে ওত পেতে থাকা সশস্ত্র বাহিনী। এমন কোন প্রকার নির্যাতন অবশিষ্ট ছিল না যা হিন্দু শরণার্থী যাত্রীদের উপর করা হয়নি। এই বিপদগ্রস্ত হিন্দু জনগোষ্ঠীর জন্য আরও নিদারুন পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায় পাকিস্তান আনসার বাহিনী। তারা বিভিন্ন অজুহাতে হিন্দু মহিলাদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করত। ১৭ মার্চ তারিখে ভারতের নিকটবর্তী বালুরঘাট অতিক্রম করার সময়ে সাঁওতাল শরণার্থীদের উপর পাকিস্তান পুলিশ ও আনসার বাহিনী নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে। ১৭ জন সাঁওতালকে নির্মম ভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং আরও ১৪ জন মারত্মকভাবে জখম হয়। ভারতের বালুরঘাট সীমান্তের নিকটে হরিহরপুর গ্রামের ৪০ টি হিন্দু পরিবারকে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী উচ্ছেদ করে এবং তাদের আবাসস্থল থেকে তাড়িয়ে দেয়। তারা ওই পরিবারগুলোর বাড়িঘরের ঢেউটিন খুলে নিয়ে যায়। এছাড়া ঘরে মজুদ থাকা ধান-চাল,শস্যদানা,পাট এবং ঘরের অন্যান্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি লুট করে নিয়ে যায়। জাহানপুর গ্রামের হিন্দু শরণার্থীদের নিকটে থাকা সোনার গহনা লুট করে মুসলিমরা। ফার্সিপাড়াতে পশ্চিম দিনাজপুর এবং রাজশাহী জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারিনটেনডেণ্টস গণ বৈঠক করেন। বৈঠকে তারা সিদ্ধান্ত নেন, পাকিস্তান অথরিটি বাঙ্গালী হিন্দু, সাঁওতাল এবং উপজাতিদের দমনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকবে।এজন্য বিপুল সংখ্যক বালোচ সৈন্য বালুরঘাট সীমান্তের কাছে নিয়োগ করা হয়।
তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর ও কিশোরগঞ্জ সাব-ডিসট্রিক্টে ১১ ফেব্রিয়ারি থেকে গণহত্যা শুরু হয় এবং সমানতালে চলতে থাকে ১৫ ফেব্রিয়ারি পর্যন্ত।শেরপুরের আশেপাশের বিভিন্ন হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম যেমন লক্ষনপুর,মুচেরের চর,চর শেরপুর ঝাঁকাটা,ভতসনা,সাপমারি প্রভৃতি গ্রামের হিন্দুদের উপর নির্বিচারে হামলা শুরু হয়।হিন্দুদের বাড়িঘর লুটপাট করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আটকাপাড়া,ফিরোজপুর, বাড্ডা সহ অন্যান্য গ্রামের হিন্দুদেরও একই পরিণতি বরণ করতে হয়। জুমপুর নামক গ্রামের তারক সাহার পরিবারের তিনজন সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যার পর তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে ছাই করে ফেলা হয়।
১২ ফেব্রুয়রি তারিখে,কুমিল্লা-ময়মনসিংহ রুটের আখাউড়া ও ভৈরববাজারের মধ্যকার যাত্রাপথের সকল হিন্দু যাত্রীদের খুঁজে খুঁজে পাশবিক উপায়ে হত্যা করে মুসলিমরা।লন্ডন ইকোনোমিস্ট এবং ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকার একজন সাংবাদিক তায়া জিঙ্কিন রিপোর্ট করেন,আশুগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহগামী একটি ট্রেন মেঘনা নদীর উপর নির্মিত ভৈরব সেতুতে থামাতে বাধ্য করে উন্মত্ত মুসলিম জনতা।সশস্ত্র মুসলিম জনতা সেতুর উভয় পাশ দিয়ে আক্রমণ করে।যে সকল হতভাগ্য হিন্দু যাত্রী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সাতার কেটে তীরে উঠে নিজের জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করেছিল তাদেরকে ইটপাটকেল দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলা হয় এবং অনেক যাত্রীকে নদীতে চুবিয়ে হত্যা করা হয়।পিয়েরে ডিলানি নামক একজন প্রত্যক্ষদর্শী বরাতে জানা যায়,সেদিন কমপক্ষে ২,০০০ হিন্দুকে নির্মম ভাবে হত্যা করে মুসলিমরা। একই দিনে ভৈরববাজার ও কিশোরগঞ্জের মধ্যবর্তী সরাচর নামক রেলস্টেশনে হিন্দু যাত্রীদেরকে ধরে ধরে হত্যা করা হয়।
১০ই মার্চ থেকেই সরকারী আনসার বাহিনীর সদস্যদের নেতৃত্বে মুসলিমরা হিন্দুদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলতে শুরু করে। ঝিনাইদহ সাব-ডিভিশনে হিন্দুদেরকে তাদের বাড়ি ঘর থেকে উচ্ছেদ করা হয় এবং সে সব বাড়িঘর মুসলিমরা দখল করে নেয়। তেঘারি নামক একটি গ্রামের সকল হিন্দু প্রাণ বাঁচাতে কোলকাতায় পাড়ি জমায়। কিন্তু যাত্রাপথেও তারা নিস্তার পায়নি। তাদের সঙ্গে থাকা সকল দ্রব্যসামগ্রী আনসার বাহিনী এবং মুসলিমরা লুট করে নেয়। ১৯শে মার্চ মহেশপুর পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত জিঞ্জিরা গ্রাম থেকে ৪০০ আর্ত হিন্দু শরণার্থী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার হাঁসখালী পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন হাজারখাল গ্রামে এসে পৌঁছায়। কিন্তু যখন তারা ইছামতি নদী পার হচ্ছিল তখন তিনজন পাকিস্তানি সীমান্তরক্ষী তাদের উপর গুলি বর্ষণ করে এবং কমপক্ষে একজন ব্যক্তি তখন নিহত হন।
গণহত্যা চলাকালীন পূর্ব বঙ্গ আইন পরিষদ ও বরিশাল জেলার সদস্য (এম.এল.এ) এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীন্দ্রনাথ সেনকে বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট একটি বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে বলেন, যেখানে লেখা ছিল বরিশাল জেলা অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ এবং পরিপূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু চাপ উপেক্ষা করে সতীন্দ্রনাথ সেন ওই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন। ফলশ্রুতিতে ১৫ই ফেব্রুয়ারি 307 সি.সি.পি ও বি.এস.পি.ও 1946 ধারায় তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং এক জন সাধারন কয়েদি হিসেবে জেল-হাজতে পাঠানো হয়। ১৮ই ফেব্রুয়ারি তিনি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে বরিশালের প্রকৃত অবস্থা জানিয়ে একটি চিঠি লেখেন। পূর্ববঙ্গের আইনসভার সিলেট জেলার সদস্য (এম.এল.এ) সুরেশ চন্দ্র বিশ্বাস একটি জনসভায় গণহত্যা এবং হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগের নিন্দা করলে তাকেও ১১ মার্চে গ্রেফতার করা হয়। জেলে পাঠানোর আগে তাকে সবার সামনে হাতকড়া পড়িয়ে রাস্তা দিয়ে টানতে টানতে নির্মমভাবে পেটানো হয়। তার বিরুদ্ধে অগ্নিসংযোগের একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে জেলে বন্দী করে রাখা হয়। ১৬ই মার্চে পাঁচ জন হিন্দুসদস্য সহ সাত জনের একটি বেসরকারি তদন্ত দল, যারা কালশিরা গণহত্যা নিয়ে তদন্ত করছিলেন, তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়।তারা কালশিরা গনহত্যার কারণ ও বিস্তৃতিসহ একটি তদন্ত প্রতিবেদন করতে সক্ষম হন যা ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ২৩ মার্চে,৭২ বছর বয়স্ক অশতিপর বৃদ্ধ কুলাউড়ার জমিদার মোহিনীমোহন কর এবং প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা কৃপেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য সহ ৩০ জন হিন্দু নেতাকে সিলেটের মৌলভীবাজার বাজার থেকে গ্রেফতার করা হয়।
ফেব্রুয়ারি মাসে নোয়াখালীর ফেনী সাব-ডিভিশনের ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম প্রতিনিধির উপর কয়েকবার হামলা করা হয়।প্রেস ট্রাস্ট অব ইণ্ডিয়া বা পিটিআই(PTI) এর প্রতিনিধি যদুগোলাপ দত্তের ছোট ভাই ডাঃধীরেন্দ্র কুমার দত্তকে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৫০ সালের ২ মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহ্রু পার্লামেন্ট অধিবেশনের সময় স্বীকার করে নেন যে,পিটিআই সহ সকল ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের পূর্ব-পাকিস্তান হতে সংবাদ প্রেরণে বাধা প্রদান করা হচ্ছে।
পূর্ব-বাংলা থেকে পালিয়ে আসা হিন্দুরা পশ্চিম-বাংলা, আসাম এবং ত্রিপুরা সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। কালশিরা গণহত্যার পর পূর্ববাংলার অসংখ্য হিন্দু শরণার্থী হয়ে পশ্চিম-বাংলায় পাড়ি জমায়। হাজার হাজার হিন্দু শরণার্থী রেলওয়ে স্টেশন, স্টিমার ঘাট এবং ঢাকা বিমানবন্দরে ভিড় করে। ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় শরণার্থীদের ভারতে আনার গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। ভিড় করা উদ্বাস্তুদের ঢাকা বিমানবন্দর থেকে আনার জন্য তিনি ১৬টি নিয়মিত বিমানের ব্যবস্থা করেন। বরিশাল ও ফরিদপুর থেকে শরণার্থীদের আনার জন্য তিনি আরো ১৫টি বড় যাত্রীবাহী স্টিমারের ব্যবস্থা করেন। আনুমানিক ৭৫,০০০ হিন্দু শরণার্থীকে ১৯৫০ সালের মার্চে পূর্ব-বাংলা থেকে পশ্চিম-বাংলার বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় দেয়া হয়। ১৯৫০এর মার্চ মাসে কমপক্ষে ২,০০,০০০ শরণার্থী ত্রিপুরায় এসে পৌঁছায়। আনুমানিক ১,১০,০০০ শরণার্থীকে ২ এপ্রিল,১৯৫০ পর্যন্ত সিলেট থেকে আসামের করিমগঞ্জ জেলায় নিয়ে আসা হয় । ১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসে চারটি স্টিমারে করে ২,৫০০ হিন্দু শরণার্থী বরিশাল থেকে হাওড়ার সালিমারে এসে পৌঁছায়। তখনও উদ্বাস্তু হয়ে প্রায় ২০,০০০ শরণার্থী বরিশালে অপেক্ষার দিন গুনছিল। ১২ এপ্রিল, ১৯৫০ পর্যন্ত প্রায় ১,২০,০০০ শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম-দিনাজপুর জেলায় এসে আশ্রয় নেয়। অর্থাৎ ১৯৫০ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া গণহত্যার পর ৫,০০,০০০ এর বেশি শরণার্থী পশ্চিম-বাংলায় এসে জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়।
ঢাকার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে হিন্দু শিক্ষার্থীর সংখ্যা | |||||||
বিদ্যালয় | ছাত্র/ছাত্রী | জানুয়ারী ১৯৫০ | ডিসেম্বর ১৯৫০ | ||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
প্রিয়নাথ হাই স্কুল | ছাত্র | ১৮৭ | ৯ | ||||
পোগোজ স্কুল | ছাত্র | ৫৮০ | ৫০ | ||||
কে.এল. জুবলি স্কুল | ছাত্র | ৭১৯ | ৫২ | ||||
গেণ্ডারিয়া হাই স্কুল | ছাত্র | ২৪৫ | ১০ | ||||
ইস্ট বেঙ্গল হাই স্কুল | ছাত্র | ২০৪ | ১৬ | ||||
নবকুমার ইন্সটিটিউট | ছাত্র | ৫১ | ৫ | ||||
নারী শিক্ষা মন্দির | ছাত্রী | ২৭৫ | ৪ | ||||
বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয় | ছাত্রী | ৬০৬ | ২ | ||||
আনন্দময়ী বালিকা বিদ্যালয় | ছাত্রী | ৭৫ | ৫ | ||||
গেণ্ডারিয়া বালিকা বিদ্যালয় | ছাত্রী | ২২৭ | ১০ |
মোটের উপর শরণার্থীর সংখ্যা দশ লক্ষের অধিক। ১৯৫০ সালের ৪ এপ্রিলে বিধান চন্দ্র রায় আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা দেন যে ,তখন পর্যন্ত প্রায় ২০ লক্ষ শরণার্থী ইতমধ্যে ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর মতে ৩৫ লক্ষ হিন্দু শরণার্থী ১৯৫০ সালে ভারতে পালিয়ে আসে। গবেষক এ রায় এর মতে, ৫,০০,০০০(পাঁচ লক্ষ) হিন্দুকে ঐ গণহত্যায় হত্যা করা হয় এবং৪৫ লক্ষ হিন্দু প্রাণ বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে আসে। ঠিক একই সময়ে আরও প্রায় ১০ লক্ষ পাকিস্তানি হিন্দু তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু থেকে শরণার্থী হয়ে ভারতে পালিয়ে আসে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার এই ঘৃণ্য গনহত্যার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবাদ করে পাকিস্তান সরকারের কাছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু কোলকাতার বেশ কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন ৬ মার্চ এবং ১৬ মার্চ তারিখে। তিনি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের নিকট এই অমানবিক নৃশংসতা বন্ধের আহবান জানান।
এই নৃশংস এবং ব্যাপক মাত্রার গনহত্যার ফলাফল হিসেবে পূর্ববাংলা বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিশাল সংখ্যক নিপীড়িত এবং আর্ত বাঙ্গালী হিন্দু শরণার্থী নিজের আবাসভূমি ছেড়ে ভারতের বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ,আসাম এবং ত্রিপুরাতে আশ্রয় নেয়।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article ১৯৫০-এর পূর্ব পাকিস্তান দাঙ্গা, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.