চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম (চাটগাঁইয়া: চাটগাঁও) বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর ও বাণিজ্যিক রাজধানী। শহরটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী কর্ণফুলী নদীর তীরে চট্টগ্রাম জেলায় অবস্থিত। এটি চট্টগ্রাম বিভাগ এবং জেলার প্রশাসনিক আসন। বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত পাহাড়, সমুদ্র এবং উপত্যকায় ঘেরা চট্টগ্রাম শহর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যে প্রাচ্যের রাণী হিসেবে বিখ্যাত। এটি বঙ্গোপসাগরের ব্যস্ততম সমুদ্রবন্দর। ২০২২ সালে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনসংখ্যা ছিল ৫২ লাখেরও বেশি। শহরটি অনেক বড় স্থানীয় ব্যবসার আবাসস্থল, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

চট্টগ্রাম
মহানগরী
ডাকনাম: জ্বালনধারা, চাটিগাঁও, চাটগাঁ, ইসলামাবাদ, চট্টলা বন্দরনগরী বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী
চট্টগ্রাম বাংলাদেশ-এ অবস্থিত
চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম বিভাগ-এ অবস্থিত
চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম এশিয়া-এ অবস্থিত
চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম
স্থানাঙ্ক: ২২°২০′০৬″ উত্তর ৯১°৪৯′৫৭″ পূর্ব / ২২.৩৩৫০০° উত্তর ৯১.৮৩২৫০° পূর্ব / 22.33500; 91.83250
দেশচট্টগ্রাম বাংলাদেশ
বিভাগচট্টগ্রাম বিভাগ
জেলাচট্টগ্রাম জেলা
প্রতিষ্ঠা১৩৪০; ৬৮৪ বছর আগে (1340)
শহরের মর্যাদা প্রাপ্তি২২ জুন ১৮৬৩
সরকার
 • ধরনমেয়র - কাউন্সিলর
 • শাসকচট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন
 • মেয়ররেজাউল করিম চৌধুরী
 • পুলিশ কমিশনারকৃষ্ণপদ রায়, বিপিএম, পিপিএম
আয়তন
 • মহানগরী১৬৮.০৭ বর্গকিমি (৬৪.৮৯ বর্গমাইল)
 • পৌর এলাকা২৭২.০৩ বর্গকিমি (১০৫.০৩ বর্গমাইল)
 • মহানগর৬৫৫.৭৪ বর্গকিমি (২৫৩.১৮ বর্গমাইল)
জনসংখ্যা (২০২২)
 • মহানগরী৮৭,২০,০০০
 • জনঘনত্ব৩২,০০৮/বর্গকিমি (৮২,৯০০/বর্গমাইল)
 • পৌর এলাকা৭০,০০,০০০
 • মহানগর৮২,৫৪,০০০
 • ভাষাচাটগাঁইয়া এবং বাংলা
বিশেষণচাঁটগাঁইয়া, চাটগাঁমী, চাঁডি, চাড়িগ্রাই
সময় অঞ্চলবিএসটি (ইউটিসি+৬)
ডাক কোড৪০০০, ৪১০০, ৪২xx
পুলিশচট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরশাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর
ওয়েবসাইটচট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন

শতাব্দী ধরে কার্যকরী প্রাকৃতিক বন্দর সহ বিশ্বের প্রাচীনতম বন্দরগুলির মধ্যে চট্টগ্রাম প্রাচীন গ্রিক এবং রোমান মানচিত্রে টলেমির বিশ্ব মানচিত্রে উপস্থিত ছিল। এটি রেশম পথের দক্ষিণ ভাগে অবস্থিত ছিল। নবম শতাব্দীতে, আব্বাসীয় খিলাফতের বণিকরা চট্টগ্রামে একটি ব্যবসায়িক পোস্ট স্থাপন করছিল। ১৪শ শতাব্দীতে বাংলার মুসলিমরা বন্দরটি জয় করে। এটি দিল্লী সালতানাত, বাংলা সালতানাত এবং মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে একটি রাজকীয় টাকশালের স্থান ছিল। ১৫ এবং ১৭ শতকের মধ্যে, চট্টগ্রাম আরাকানের প্রশাসনিক, সাহিত্যিক, বাণিজ্যিক এবং সামুদ্রিক কার্যক্রমের একটি কেন্দ্র ছিল, বঙ্গোপসাগরের পূর্ব উপকূল বরাবর একটি সংকীর্ণ ভূখণ্ড হিসেবে ৩৫০০ বছর ধরে শক্তিশালী বাঙালি প্রভাবের অধীনে ছিল। ১৬শ শতাব্দীতে, বন্দরটি একটি পর্তুগিজ বাণিজ্য পোস্টে পরিণত হয়েছিল এবং জোয়াও ডি ব্যারোস এটিকে "বাংলা রাজ্যের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং ধনী শহর" হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। ১৬৬৬ সালে মুঘল সাম্রাজ্য চট্টগ্রাম থেকে পর্তুগিজ এবং আরাকানিদের বিতাড়িত করে।

বাংলার বাকি এলাকার মতো ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৯৩ সালে চট্টগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ১৮৮৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দর পুনর্গঠিত হয় এবং ব্রিটিশ বার্মার সাথে এর ব্যস্ততম শিপিং লিঙ্ক ছিল। ১৯২৮ সালে, চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ ভারতের একটি "প্রধান বন্দর" ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, চট্টগ্রাম বার্মা অভিযানে নিয়োজিত মিত্রবাহিনীর ঘাঁটি ছিল। বন্দর শহরটি ১৯৪০-এর দশকে, বিশেষ করে ব্রিটিশ ভারতের বিভক্তির পরে প্রসারিত এবং শিল্পায়িত হতে শুরু করে। শহরটি ছিল আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে এবং পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ের ঐতিহাসিক টার্মিনাস। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, চট্টগ্রাম ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার স্থান। বন্দর নগরটি বাংলাদেশে ভারী শিল্প, রসদ এবং উৎপাদনের বৃদ্ধি থেকে উপকৃত হয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে এখানে ট্রেড ইউনিয়নবাদ শক্তিশালী ছিল।

চট্টগ্রাম বাংলাদেশের জিডিপির ১২%, শিল্প উৎপাদনের ৪০%, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৮০% এবং কর রাজস্বের ৫০% অবদান রাখে। বন্দর নগরে দেশের বহু প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম কোম্পানিগুলির প্রধান কার্যালয় আবস্থিত। চট্টগ্রাম বন্দর দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ব্যস্ততম বন্দর। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বিমান ঘাঁটি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গ্যারিসন এবং বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের প্রধান ঘাঁটি সহ বৃহত্তম ঘাঁটি চট্টগ্রামে অবস্থিত। বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রামে অবস্থিত। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ ৭০০টিরও বেশি তালিকাভুক্ত কোম্পানি সহ বাংলাদেশের জমজ শেয়ার বাজারগুলির মধ্যে একটি। চট্টগ্রাম চা নিলাম হল একটি পণ্য বিনিময় প্রক্রিয়া যা বাংলাদেশী চা নিয়ে কাজ করে। সিইপিজেড এবং কেইপিজেড হল বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ সহ প্রধান শিল্প অঞ্চল। শহরটি অভ্যন্তরীণ এবং বহিরাগত ফ্লাইটের জন্য শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দ্বারা পরিবেশিত হয়। বাঙালি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রামে বাংলাদেশের শহরগুলোর মধ্যে উচ্চ মাত্রার ধর্মীয় ও জাতিগত বৈচিত্র্য রয়েছে। সংখ্যালঘুদের মধ্যে রয়েছে বাঙালি হিন্দু, বাঙালি খ্রিস্টান, বাঙালি বৌদ্ধ, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরি, গারো এবং অন্যান্য।

ব্যুৎপত্তি

চট্টগ্রামের ব্যুৎপত্তি অনিশ্চিত। একটি ব্যাখ্যার কৃতিত্ব প্রথম আরব ব্যবসায়ীদের শাত ঘাংঘ (আরবি: شط غنغ) শব্দসমূহের সমন্বয়ের জন্য, যেখানে শাত অর্থ "ব-দ্বীপ" এবং ঘাং অর্থ গঙ্গা। আরাকানি ইতিহাসে বলা হয়েছে যে সু-লা-তাইং তসন্দায়া (সুলা তাইং চন্দ্র) নামে একজন রাজা বাংলা জয় করার পর, স্থানটিতে ট্রফি/স্মৃতিস্বরূপ একটি পাথরের স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন, যেহেতু এই স্থানটিকে জয়ের সীমা হিসাবে Tst-ta-gaung বলা হয়। এই আরাকানি রাজা ৩১১ আরাকান সালে, ৯৫২ খ্রিস্টাব্দের সাথে মিল রেখে, আরাকানে সিংহাসনে আরোহণ করেন। দুই বছর পরে তিনি এই স্থানটি জয় করেন। শিলালিপিযুক্ত এই পাথরের স্তম্ভটিতে লেখা ছিল সিট-তা-গাউং, যার অর্থ 'যুদ্ধ করা অনুচিত', যেটি কোনো মিথ হতে পারে না। যাইহোক, শহরের স্থানীয় নাম (বাংলা বা চাটগাঁইয়া) চাটগা, যা একটি অপভ্রংশ চাটগাঁও বা চাটিগাঁও থেকে আগত, এবং আনুষ্ঠানিকভাবে চট্টগ্রাম শব্দটি "চট্ট (সম্ভবত একটি বর্ণ বা উপজাতি) গ্রাম বা শহর" অর্থ বহন করে। অতএব, বাংলা নাম চট্টগ্রাম, চীনা সা-তি-কিয়াং, চেহ-তি.গান এবং ইউরোপীয় চিটাগং আরাকানি সেট-তা-গাং নামের বিকৃত সংস্করণ।

বন্দর নগরটি ইতিহাসে বিভিন্ন নামে পরিচিত, যার মধ্যে রয়েছে চাটিগাঁও, চাটগাঁ, চাতগাঁও, শ্যাৎগাঙ্গ, চৈত্যগ্রাম, চাটিগাম, চট্টগ্রাম, ইসলামাবাদ, চট্টল, চট্টলা, শ্রীচট্টল, চিতাগঞ্জ, চিৎ-তৌৎ-গৌং, সপ্তগ্রাম, জাটিগ্রাম, চার্টিগান চতকাঁও, চৈত্যভূমি, রোসাং, জ্বালনধারা এবং পোর্টো গ্র্যান্ডে দে বেঙ্গালা

নাম

চট্টগ্রাম শব্দে, "-গ্রাম" প্রত্যয় রয়েছে। একটি কিংবদন্তি আনুসারে ইসলামের প্রসারে নামটি উল্লেখ করা হয়েছে যখন একজন মুসলিম শহরের একটি পাহাড়ের চূড়ায় একটি চাটি (বাতি) জ্বালিয়ে মানুষের জন্য আজান দিতেন। শহরটির নতুন নামকরণ করা হয় ইসলামাবাদ (ইসলামের শহর) এবং মুঘল আমলে পুরানো শহরে ব্যবহার করা অব্যাহত রয়েছে।

মাণিক্য রাজার ছোট মাছ ধরার গ্রাম ছিল চট্টগ্রাম। "চটি" মানে "প্রদীপ" আর "গাম" মানে "ভালো"। পর্তুগিজরা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এখানে আসে এবং তারা ত্রিপুরার রাজার কাছে কিছু জমি চেয়ে নেয়। এবং ত্রিপুরার রাজা ব্যবসার উদ্দেশ্যে পর্তুগিজদের কিছু জমি প্রদান করে।

চট্টগ্রাম বারো আউলিয়ার দেশ (বারো সুফি সাধকের দেশ) নামেও পরিচিত।

ইতিহাস

চট্টগ্রাম 
চট্টগ্রামের স্কাইলাইন

সীতাকুণ্ড এলাকায় পাওয়া প্রস্তরীভূত অস্ত্র এবং বিভিন্ন মানবসৃষ্ট প্রস্তর খণ্ড থেকে ধারণা করা হয় যে, এ অঞ্চলে নব্যপ্রস্তর যুগে অস্ট্রো-এশীয়াটিক জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। তবে, অচিরে মঙ্গোলদের দ্বারা তারা বিতাড়িত হয়। লিখিত ইতিহাসে সম্ভবত প্রথম উল্লেখ গ্রিক ভৌগোলিক প্লিনির লিখিত পেরিপ্লাস। সেখানে ক্রিস নামে যে স্থানের বর্ণনা রয়েছে ঐতিহাসিক নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতে সেটি বর্তমানের সন্দ্বীপ। ঐতিহাসিক ল্যাসেনের ধারণা সেখানে উল্লিখিত পেন্টাপোলিশ আসলে চট্টগ্রামেরই আদিনাম। মৌর্য সাম্রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি নিশ্চিত নয় তবে পূর্ব নোয়াখালির শিলুয়াতে মৌর্য যুগের ব্রাহ্মী লিপিতে একটি মূর্তির পাদলিপি পাওয়া গেছে।

তিব্বতের বৌদ্ধ ঐতিহাসিক লামা তারানাথের একটি গ্রন্থে চন্দ্রবংশের শাসনামলের কথা দেখা যায় যার রাজধানী ছিল চট্টগ্রাম। এর উল্লেখ আরাকানের সিথাং মন্দিরের শিলালিপিতেও আছে। তারানাথের গ্রন্থে দশম শতকে গোপীনাথ চন্দ্র নামের রাজার কথা রয়েছে।। সে সময় আরব বণিকদের চট্টগ্রামে আগমন ঘটে। আরব ভূগোলবিদদের বর্ণনার ‘সমুন্দর’ নামের বন্দরটি যে আসলে চট্টগ্রাম বন্দর তা নিয়ে এখন ঐতিহাসিকরা মোটামুটি নিশ্চিত। সে সময় পালবংশের রাজা ছিলেন ধর্মপাল। পাল বংশের পর এ অঞ্চলে একাধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের সৃষ্টি হয়।

৯৫৩ সালে আরাকানের চন্দ্রবংশীয় রাজা সু-লা‌-তাইং-সন্দয়া চট্টগ্রাম অভিযানে আসলেও কোন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি বেশি দূর অগ্রসর না হয়ে একটি স্তম্ভ তৈরি করেন। এটির গায়ে লেখা হয় ‘চেৎ-ত-গৌঙ্গ’ যার অর্থ ‘যুদ্ধ করা অনুচিৎ’। সে থেকে এ এলাকাটি চৈত্তগৌং হয়ে যায় বলে লেখা হয়েছে আরাকানি পুঁথি ‘রাজাওয়াং’-এ। এ চৈত্তগৌং থেকে কালক্রমে চাটিগ্রাম, চাটগাঁ, চট্টগ্রাম, চিটাগাং ইত্যাদি বানানের চল হয়েছে।

চন্দ্রবংশের পর লালবংশ এবং এরপর কয়েকজন রাজার কথা কিছু ঐতিহাসিক উল্লেখ করলেও ঐতিহাসিক শিহাবুদ্দিন তালিশের মতে ১৩৩৮ সালে সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের‌ চট্টগ্রাম বিজয়ের আগ পর্যন্ত ইতিহাস অস্পষ্ট। এ বিজয়ের ফলে চট্টগ্রাম স্বাধীন সোনারগাঁও রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। সে সময়ে প্রায় ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম আসেন বিখ্যাত মুর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা। তিনি লিখেছেন - “বাংলাদেশের যে শহরে আমরা প্রবেশ করলাম তা হল সোদকাওয়াঙ (চট্টগ্রাম)। এটি মহাসমুদ্রের তীরে অবস্থিত একটি বিরাট শহর, এরই কাছে গঙ্গা নদী- যেখানে হিন্দুরা তীর্থ করেন এবং যমুনা নদী একসঙ্গে মিলেছে এবং সেখান থেকে প্রবাহিত হয়ে তারা সমুদ্রে পড়েছে। গঙ্গা নদীর তীরে অসংখ্য জাহাজ ছিল, সেইগুলি দিয়ে তারা লখনৌতির লোকেদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। ...আমি সোদওয়াঙ ত্যাগ করে কামরু (কামরূপ) পর্বতমালার দিকে রওনা হলাম।”

১৩৫২‌-১৩৫৩ সালে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের পুত্র ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহকে হত্যা করে বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাংলার মসনদ দখল করলে চট্টগ্রামও তার করতলগত হয়। তার সময়ে চট্টগ্রাম বাংলার প্রধান বন্দর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পর হিন্দুরাজা গণেশ ও তার বংশধররা চট্টগ্রাম শাসন করেন। এরপরে বাংলায় হাবশি বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৪৯২ সালে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বাংলার সুলতান হন। চট্টগ্রামের দখল নিয়ে তাকে ১৪১৩-১৪১৭ সাল পর্যন্ত ত্রিপুরার রাজা ধনমানিকের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত রাজা ধনমানিকের মৃত্যুর পর হোসেন শাহের রাজত্ব উত্তর আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তার সময়ে উত্তর চট্টগ্রামের নায়েব পরবগল খানের পুত্র ছুটি খানের পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রীকর নন্দী মহাভারতের একটি পর্বের বঙ্গানুবাদ করেন।

পর্তুগিজদের আগমন ও বন্দরের কর্তৃত্ব লাভ

১৫১৭ সাল থেকে পর্তুগিজরা চট্টগ্রামে আসতে শুরু করে। বাণিজ্যের চেয়ে তাদের মধ্যে জলদস্যুতার বিষয়টি প্রবল ছিল। বাংলার সুলতান প্রবলভাবে তাদের দমনের চেষ্টা করেন। কিন্তু এ সময় আফগান শাসক শের শাহ বাংলা আক্রমণ করবেন শুনে ভীত হয়ে গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ পর্তুগিজদের সহায়তা কামনা করেন। তখন সামরিক সহায়তার বিনিময়ে ১৫৩৭ সালে পর্তুগিজরা চট্টগ্রামে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করে। একই সঙ্গে তাদেরকে বন্দর এলাকার শুল্ক আদায়ের অধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। ১৫৩৮ সালে শের শাহের সেনাপতি চট্টগ্রাম দখল করেন। তবে ১৫৮০ সাল পর্যন্ত আফগান শাসনামলে সবসময় ত্রিপুরা আর আরাকানিদের সঙ্গে যুদ্ধ চলেছে।

আরাকানি শাসন

চট্টগ্রাম 
১৮২০এর দশকে জাহাজ নোঙ্গর করছে চট্টগ্রাম বন্দরে

১৫৮১ সাল থেকে ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম সম্পূর্ণভাবে আরাকানের রাজাদের অধীনে শাসিত হয়। তবে পর্তুগিজ জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য এ সময় খুবই বৃদ্ধি পায়। বাধ্য হয়ে আরাকান রাজা ১৬০৩ ও ১৬০৭ সালে শক্ত হাতে পর্তুগিজদের দমন করেন। ১৬০৭ সালেই ফরাসি পরিব্রাজক ডি লাভাল চট্টগ্রাম সফর করেন। তবে সে সময় পর্তুগিজ জলদস্যু গঞ্জালেস সন্দ্বীপ দখল করে রেখেছিলেন। পর্তুগিজ মিশনারি পাদ্রি ম্যানরিক ১৬৩০-১৬৩৪ সময়কালে চট্টগ্রামে উপস্থিতকালে চট্টগ্রাম শাসক আলামেনের প্রশংসা করে যান। ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম মুঘলদের হস্তগত হয়।

চট্টগ্রামে আরাকানি শাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম আরাকানিদের কাছ থেকে অনেক কিছুই গ্রহণ করে। জমির পরিমাণে মঘী কানির ব্যবহার এখনো চট্টগ্রামে রয়েছে। মঘী সনের ব্যবহারও দীর্ঘদিন প্রচলিত ছিল। সে সময়ে আরাকানে মুসলিম জনবসতি বাড়ে। আরকান রাজসভায় মহাকবি আলাওল, দৌলত কাজী এবং কোরেশী মাগণ ঠাকুর এর মতো বাংলা কবিদের সাধনা আর পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে বাংলা সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি হয়। পদ্মাবতী আলাওলের অন্যতম কাব্য।

মুঘল শাসনামল

১৬৬৬ সালে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানকে চট্টগ্রাম দখলের নির্দেশ দেন। সুবেদারের পুত্র উমেদ খানের নেতৃত্বে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় আরাকানিদের পরাজিত করেন এবং আরাকানি দুর্গ দখল করেন। যথারীতি পর্তুগিজরা আরাকানিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে মুঘলদের পক্ষ নেয়। মুঘল সেনাপতি উমেদ খান চট্টগ্রামের প্রথম ফৌজদারের দায়িত্ব পান। শুরু হয় চট্টগ্রামে মুঘল শাসন। তবে মুঘলদের শাসনামলের পুরোটা সময় আরাকানিরা চট্টগ্রাম অধিকারের চেষ্টা চালায়। টমাস প্রাট নামে এক ইংরেজ আরাকানিদের সঙ্গে যোগ দিয়ে মুঘলদের পরাজিত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কোলকাতার গোড়াপত্তনকারী ইংরেজ জব চার্নকও ১৬৮৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দখলের ব্যর্থ অভিযান চালান। ১৬৮৮ সালে ক্যাপ্টেন হিথেরও অনুরূপ অভিযান সফল হয় নি। ১৬৭০ ও ১৭১০ সালে আরাকানিরা চট্টগ্রামের সীমান্তে ব্যর্থ হয়।

নবাবি শাসনামল

১৭২৫ সালে প্রায় ৩০ হাজার মগ সৈন্য চট্টগ্রামে ঢুকে পড়ে চট্টগ্রামবাসীকে বিপদাপন্ন করে তোলে। তবে শেষ পর্যন্ত বাংলার নবাব তাদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। এই সময় বাংলার নবাবদের কারণে ইংরেজরা চট্টগ্রাম বন্দর কোনভাবেই দখল করতে পারেনি। বাংলার নবাবরা পার্বত্য এলাকার অধিবাসীদের সঙ্গে, বিশেষ করে চাকমা সম্প্রদায়ের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে সদ্ভাব বজায় রাখেন।

পলাশীর যুদ্ধ ও ইংরেজদের কাছে চট্টগ্রাম হস্তান্তর

চট্টগ্রাম 
১৯৪৪ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর নাবিক

পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর ইংরেজরা চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য নবাব মীর জাফরের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। তবে, মীর জাফর কোনভাবেই ইংরেজদের চট্টগ্রাম বন্দরের কর্তৃত্ব দিতে রাজি হন নি। ফলে, ইংরেজরা তাকে সরিয়ে মীর কাশিমকে বাংলার নবাব বানানোর ষড়যন্ত্র করে। ১৭৬১ সালে মীর জাফরকে অপসারণ করে মীর কাশিম বাংলার নবাব হয়ে ইংরেজদের বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম হস্তান্তরিত করেন। চট্টগ্রামের শেষ ফৌজদার রেজা খান সরকারিভাবে চট্টগ্রামের শাসন প্রথম ইংরেজ চিফ ভেরেলস্ট-এর হাতে সমর্পণ করেন। শুরু হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন।

কোম্পানির শাসনামলে চট্টগ্রামবাসীর ওপর করারোপ দিনে দিনে বাড়তে থাকে। তবে ১৮৫৭ সালের আগে চাকমাদের বিদ্রোহ আর সন্দ্বীপের জমিদার আবু তোরাপের বিদ্রোহ ছাড়া ইংরেজ কোম্পানিকে তেমন একটা কঠিন সময় পার করতে হয়নি। সন্দ্বীপের জমিদার আবু তোরাপ কৃষকদের সংগঠিত করে ইংরেজদের প্রতিরোধ করেন। কিন্তু ১৭৭৬ সালে হরিষপুরের যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হলে সন্দ্বীপের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। অন্যদিকে ১৭৭৬ থেকে ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত চাকমারা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সম্মুখ সমরে চাকমাদের কাবু করতে না পেরে ইংরেজরা তাদের বিরুদ্ধে কঠিন অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে শেষ পর্যন্ত চাকমাদের কাবু করে।

ইংরেজরা আন্দরকিল্লা জামে মসজিদকে গোলাবারুদের গুদামে পরিণত করলে চট্টগ্রামবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মসজিদের জন্য নবাবি আমলে প্রদত্ত লাখেরাজ জমি ১৮৩৮ সালের জরিপের সময় বাজেয়াপ্ত করা হয়। পরে চট্টগ্রামের জমিদার খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ খান কলিকাতায় গিয়ে গভর্নরের কাছে আবেদন করে এটি উদ্ধার করার ব্যবস্থা করেন।

সিপাহি বিপ্লবে চট্টগ্রাম

১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের সময় পুরো ভারতবর্ষের বিদ্রোহের ঢেউ চট্টগ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে। ৩৪তম বেঙ্গল পদাতিক রেজিমেন্টের ২য়, ৩য় ও ৪র্থ কোম্পানীগুলি তখন চট্টগ্রামে মোতায়েন ছিল। ১৮ নভেম্বর রাতে উল্লিখিত তিনটি কোম্পানী হাবিলদার রজব আলীর নেতৃত্বে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তারা ব্রিটিশ জেলখানায় আক্রমণ করে সকল বন্দীকে মুক্ত করে। সিপাহী জামাল খান ছিলেন রজব আলীর অন্যতম সহযোগী। সিপাহিরা ৩টি সরকারি হাতি, গোলাবারুদ ও প্রয়োজনীয় অন্যান্ন রসদ নিয়ে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে। তারা পার্বত্য ত্রিপুরার সীমান্ত পথ ধরে এগিয়ে সিলেট ও কাছাড়ে পৌঁছে। স্বাধীনতাকামী হিসেবে ত্রিপুরা রাজের সমর্থন কামনা করেন কিন্তু ত্রিপুরা রাজ ইংরেজদের হয়ে তাদের বাঁধা দেন। একই অবস্থা হয় আরো বিভিন্ন যায়গায়। এভাবে বিভিন্ন স্থানে লড়াই করতে গিয়ে একসময় রসদের অভাবে বিদ্রোহীরা শক্তিহীন হয়ে পড়ে। শেষে ১৮৫৮ সালের ৯ জানুয়ারি সিলেটের মনিপুরে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে এক লড়াই-এই বিদ্রোহের অবসান হয়।

প্রশাসন

নগর প্রশাসন

চট্টগ্রাম 
নগর ভবন

১৮৬৩ সালের ২২শে জুন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি'র যাত্রা শুরু। তবে এর প্রশাসন ও কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৮ জন কমিশনার সমন্বয়ে পরিষদ গঠন করা হয় ১৮৬৪ সালে। ঐসময়ে চট্টগ্রাম শহরের সাড়ে চার বর্গমাইল এলাকা মিউনিসিপ্যালিটির আওতাধীন ছিল। প্রথমে ৪টি ওয়ার্ড থাকলেও ১৯১১ সালে ৫টি ওয়ার্ড সৃষ্টি করা হয়। চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি ১৯৮২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সিটি কর্পোরেশনে রুপান্তরিত হয়। বর্তমানে ওয়ার্ড সংখ্যা ৪১টি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় পৌর এলাকা পরিচালনার করে। এর নেতৃত্বে আছেন চট্টগ্রামের মেয়র। চট্টগ্রাম শহর এলাকা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন-এর অধীনস্থ। শহরবাসীদের সরাসরি ভোটে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এবং ওয়ার্ড কমিশনারগণ নির্বাচিত হন। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ফেব্রুয়ারি ২০২১ অনুযায়ী, বর্তমান মেয়র হলেন আওয়ামী লীগ নেতা রেজাউল করিম চৌধুরী। সিটি কর্পোরেশনের ম্যান্ডেট মৌলিক নাগরিক পরিষেবাগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ, তবে, চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের অন্যতম পরিচ্ছন্ন এবং সবচেয়ে পরিবেশ-বান্ধব শহর রাখার জন্য চসিকের কৃতিত্ব রয়েছে৷ চসিকের রাজস্বের প্রধান উৎস হল মিউনিসিপ্যাল ট্যাক্স এবং কনজারভেন্সি চার্জ। নগরীর নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের।

জেলা ও দায়রা জজ বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে স্থানীয় বিচার বিভাগের প্রধান। বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত ঔপনিবেশিক আমলের চট্টগ্রাম আদালত ভবনে অবস্থিত।বাংলাদেশ সরকারের অংশ হিসাবে জেলা প্রশাসক এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় প্রশাসনের প্রধান। শহরের আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য নিযুক্ত রয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ। এর সদর দপ্তর দামপাড়ায় অবস্থিত। পাশাপাশি রয়েছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-৭।

বেসামরিক প্রশাসন

চট্টগ্রাম 
চট্টগ্রামে নৌ ঘাঁটি বানৌজা ঈসা খান

চট্টগ্রাম বঙ্গোপসাগরে উপকূলে অবস্থিত কৌশলগতভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বন্দর। চট্টগ্রাম নৌ অঞ্চল হল বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি এবং অধিকাংশ বাংলাদেশী যুদ্ধজাহাজের মাতৃবন্দর। বাংলাদেশ নেভাল একাডেমি এবং নৌবাহিনীর অভিজাত বিশেষ বাহিনী- স্পেশাল ওয়ারফেয়ার ডাইভিং অ্যান্ড স্যালভেজ (সোয়াডস) এই শহরে অবস্থিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪তম পদাতিক ডিভিশন চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থিত, এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনী চট্টগ্রামে বিএএফ জহুরুল হক বিমান ঘাঁটির রক্ষণাবেক্ষণ করে। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি, দেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এই শহরে আবস্থিত।

কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্ব

১৮৬০-এর দশকে, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে মার্কিন কনস্যুলেট-জেনারেল চট্টগ্রামে একটি কনস্যুলার এজেন্সি অন্তর্ভুক্ত করে। বর্তমানে, চট্টগ্রামে ভারতের একটি সহকারী হাইকমিশন এবং রাশিয়ার কনস্যুলেট জেনারেলের কার্যালয় রয়েছে। এছাড়াও শহরে তুরস্ক, জাপান, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ইতালি এবং ফিলিপাইনের অনারারি কনস্যুলেট রয়েছে।

ভূগোল

ভূসংস্থান

বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্বে ২০°৩৫’ থেকে ২২°৫৯’ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°২৭’থেকে ৯২°২২’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ বরাবর এর অবস্থান। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের উপকূলীয় পাদদেশকে বিস্তৃত করে। কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম শহর সহ ব্যবসায় জেলা দক্ষিণ তীর ধরে বয়ে চলেছে। নদীটি বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে এবং ১২ কিলোমিটার মোহনা পর্যন্ত চট্টগ্রাম মুল শহর বিস্তুৃত। চট্টগ্রামের উত্তরে সিলেট বিভাগ এবং ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম রাজ্য এবং মেঘনা নদী, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ভারতের মিজোরাম রাজ্য, ত্রিপুরা ও মায়ানমার এবং পশ্চিমে মেঘনা নদী, ঢাকা ও বরিশাল বিভাগ। এছাড়াও চট্টগ্রামের পূর্বে পার্বত্য জেলাসমূহ এবং দক্ষিণে কক্সবাজার জেলা রয়েছে। চট্টগ্রাম শহর উত্তরে ফৌজদারহাট, দক্ষিণে কালুরঘাট এবং পূর্বে হাটহাজারী পর্যন্ত বিস্তৃত।

বাটালি পাহাড় শহরের মধ্যকার সর্বোচ্চ স্থান, যার উচ্চতা ৮৫.৩ মিটার (২৮০ ফু)। চট্টগ্রামে অনেক হ্রদ ও জলাধার রয়েছে যেগুলোর আনেকগুলি মুঘল শাসনামলে তৈরি হয়েছিল। ১৯২৪ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের একটি প্রকৌশলী দল এখানে ফয়েজ লেক খনন করেছিল।

বাস্তুসংস্থানসংক্রান্ত পশ্চাদভূমি

চট্টগ্রাম তার সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের জন্য পরিচিত। বাংলাদেশের ৬,০০০টি ফুলের গাছের মধ্যে ২,০০০ টিরও বেশি এই অঞ্চলে জন্মে। এর পাহাড় এবং জঙ্গল জলপ্রপাত, দ্রুত প্রবাহিত নদীর স্রোত এবং হাতির ভাণ্ডারে ভরা। পূর্বে, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়ি এই তিনটি পার্বত্য জেলার অবস্থান, যেখানে রয়েছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতমালা।

পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত চট্টগ্রামের প্রধান সমুদ্রসীমায়, শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার (৮.৭ মা) পশ্চিমে অবস্থিত।

আবহাওয়া ও জলবায়ু

দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত চট্টগ্রামেও ছয় ঋতু দেখা যায়। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি এ অঞ্চলে শীতকাল, মার্চ, এপ্রিল, মে-তে গ্রীষ্মকাল দেখা যায়। জুন, জুলাই, আগস্ট পর্যন্ত বর্ষাকাল। তবে ইদানীং আবহাওয়ার কিছুটা পরিবর্তন দেখা যায়।

কোপেন জলবায়ু শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী চট্টগ্রামে ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ু (অ্যাম) বিদ্যমান।

চট্টগ্রাম উত্তর ভারত মহাসাগরের ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। চট্টগ্রামে আঘাত হানা সবচেয়ে মারাত্মক ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় ছিল ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়, যার ফলে প্রায় ১৩৮,০০০ জন নিহত এবং ১০ মিলিয়নের মতো গৃহহীন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল।

মাস জানু ফেব্রু মার্চ এপ্রিল মে জুন জুলাই আগস্ট সেপ্টে অক্টো নভে ডিসে বছর
সর্বোচ্চ রেকর্ড °সে (°ফা) ৩১.৭
(৮৯.১)
৩৩.৯
(৯৩.০)
৩৭.২
(৯৯.০)
৩৮.৯
(১০২.০)
৩৬.৭
(৯৮.১)
৩৬.৭
(৯৮.১)
৩৪.৪
(৯৩.৯)
৩৩.৯
(৯৩.০)
৩৫.০
(৯৫.০)
৩৪.৪
(৯৩.৯)
৩৪.৯
(৯৪.৮)
৩১.১
(৮৮.০)
৩৮.৯
(১০২.০)
সর্বোচ্চ গড় °সে (°ফা) ২৬.০
(৭৮.৮)
২৮.৩
(৮২.৯)
৩০.৮
(৮৭.৪)
৩১.৯
(৮৯.৪)
৩২.৪
(৯০.৩)
৩১.৭
(৮৯.১)
৩১.০
(৮৭.৮)
৩১.৪
(৮৮.৫)
৩১.৮
(৮৯.২)
৩১.৭
(৮৯.১)
৩০.০
(৮৬.০)
২৭.২
(৮১.০)
৩০.৪
(৮৬.৭)
দৈনিক গড় °সে (°ফা) ১৯.৮
(৬৭.৬)
২২.৩
(৭২.১)
২৫.৭
(৭৮.৩)
২৭.৯
(৮২.২)
২৮.৬
(৮৩.৫)
২৮.৪
(৮৩.১)
২৭.৯
(৮২.২)
২৮.১
(৮২.৬)
২৮.৩
(৮২.৯)
২৭.৭
(৮১.৯)
২৪.৯
(৭৬.৮)
২১.২
(৭০.২)
২৫.৯
(৭৮.৬)
সর্বনিম্ন গড় °সে (°ফা) ১৪.০
(৫৭.২)
১৬.৩
(৬১.৩)
২০.৫
(৬৮.৯)
২৩.৬
(৭৪.৫)
২৪.৯
(৭৬.৮)
২৫.৪
(৭৭.৭)
২৫.২
(৭৭.৪)
২৫.৩
(৭৭.৫)
২৫.২
(৭৭.৪)
২৪.১
(৭৫.৪)
২০.৩
(৬৮.৫)
১৫.৮
(৬০.৪)
২১.৭
(৭১.১)
সর্বনিম্ন রেকর্ড °সে (°ফা) ৫.২
(৪১.৪)
৬.৬
(৪৩.৯)
১০.২
(৫০.৪)
১৩.৬
(৫৬.৫)
১৪.৩
(৫৭.৭)
১৮.১
(৬৪.৬)
১৯.৪
(৬৬.৯)
১৯.৯
(৬৭.৮)
১৭.২
(৬৩.০)
১২.৭
(৫৪.৯)
১০.০
(৫০.০)
৭.৫
(৪৫.৫)
৫.২
(৪১.৪)
অধঃক্ষেপণের গড় মিমি (ইঞ্চি) ৭.৩
(০.২৯)
২৫.০
(০.৯৮)
৫৫.৫
(২.১৯)
১৩৬.৪
(৫.৩৭)
৩১৪.০
(১২.৩৬)
৫৯১.৩
(২৩.২৮)
৭৩৫.৬
(২৮.৯৬)
৫১৩.৯
(২০.২৩)
২৩৯.৩
(৯.৪২)
১৯৭.৮
(৭.৭৯)
৫৯.৫
(২.৩৪)
১৪.১
(০.৫৬)
২,৮৮৯.৭
(১১৩.৭৭)
অধঃক্ষেপণ দিনগুলির গড় ১৩ ১৬ ১৯ ১৭ ১৩ ১০৪
আপেক্ষিক আদ্রতার গড় (%) ৭৩ ৭০ ৭৪ ৭৭ ৭৯ ৮৩ ৮৫ ৮৫ ৮৩ ৮১ ৭৮ ৭৫ ৭৯
মাসিক সূর্যালোক ঘণ্টার গড় ২৬৪.১ ২৪৪.৩ ২৭৬.৪ ২৪২.৭ ২২৭.২ ১১৬.৭ ১০৫.১ ১২৪.৪ ১৬৬.৭ ২১৮.২ ২৪১.৩ ২৪৫.৫ ২,৪৭২.৬
উৎস ১: বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর
উৎস ২: বিশ্ব বায়োক্লাইমেটিক শ্রেণীবিভাগ প্রক্রিয়া (চূড়ান্ত),জার্মান আবহাওয়া পরিষেবা (সূর্য, ১৯৬১-১৯৯০)


জনসংখ্যা

জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ এর তথ্যমতে, চট্টগ্রাম শহরের জনসংখ্যা ১ কোটি ১১ লক্ষ ৭৫ হাজার ২৬ জন এবং নারী ও পুরুষের সংখ্যা যথাক্রমে ৫৫ লক্ষ ৭৭ হাজার ১৬৮ জন ও ৫৫ লক্ষ ৯৬ হাজার ৮২১ জন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতাধিন এলাকার জনসংখ্যা ৩২ লক্ষ ২৭ হাজার ২৪৬ জন। যেখানে নারী ও পুরুষের সংখ্যা যথাক্রমে ১৫ লক্ষ ৫৩ হাজার ২৫২ জন ও ১৬ লক্ষ ৭৩ হাজার ৬২৭ জন।

বাংলায় সুলতানি ও মুঘল শাসনামলে চট্টগ্রামের জাতিগোষ্ঠীর একটি বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়। সপ্তম শতাব্দীর প্রথমদিকে মুসলিম অভিবাসন শুরু হয়েছিল এবং মধ্যযুগীয় সময়ে উল্লেখযোগ্য মুসলিম জনবসতি গড়ে উঠেছিল। পারস্য ও আরব থেকে আগত মুসলিম ব্যবসায়ী, শাসক এবং প্রচারকরা প্রথমদিকে মুসলমান বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং তাদের বংশধররা এই শহরের বর্তমান মুসলিম জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ। শহরে ইসমাইলিস এবং যাযাবর শিয়া সহ অপেক্ষাকৃত ধনী এবং অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবিত শিয়া মুসলিম সম্প্রদায় রয়েছে। এই শহরে অনেক জাতিগত সংখ্যালঘুও রয়েছে, বিশেষত চাকমা, রাখাইন এবং ত্রিপুরী সহ চট্টগ্রাম বিভাগের সীমান্তবর্তী পাহাড়ের উপজাতি গোষ্ঠীর সদস্য; এবং তার পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থীও রয়েছে। বড়ুয়া নামে পরিচিত এ অঞ্চলের বাংলাভাষী থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা চট্টগ্রামের অন্যতম প্রাচীন সম্প্রদায় এবং বাংলাদেশের বৌদ্ধধর্মের সর্বশেষ অবশেষ। প্রায়শই ফিরিঙ্গি নামে পরিচিত, পর্তুগিজ জনগোষ্ঠীর বংশোদ্ভূত চট্টগ্রামের প্রাচীন ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়, যারা পাথরঘাটা পুরনো পর্তুগিজ ছিটমহলে বাস করেন। এখানে একটি ছোট্ট উর্দুভাষী বিহারি সম্প্রদায়ও রয়েছে, যারা বিহারি কলোনি নামে পরিচিত জাতিগত ছিটমহলে বসবাস করে।

দক্ষিণ এশীয়ার অন্যান্য প্রধান নগর কেন্দ্রগুলির মতো, এ মহানগরেরও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ অঞ্চল থেকে শহরাঞ্চলমুখি মানুষের ঢলের ফলস্বরূপ চট্টগ্রামের বস্তিগুলোর অবিচ্ছিন্নভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের দারিদ্র্য বিমোচনের প্রকাশনার তথ্য অনুসারে, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১,৮১৪ টি বস্তি রয়েছে, যাতে প্রায় ১৮০,০০০ বস্তিবাসী বসবাস করে, যা রাজধানী ঢাকার পরে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বস্তিবাসীরা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রায়শই উচ্ছেদের মুখোমুখি হন এবং তাদের সরকারি জমিতে অবৈধ আবাসনের জন্য অভিযুক্ত করা হয়।

অর্থনীতি

চট্টগ্রাম 
চট্টগ্রাম বন্দর
২০১৪ সালে চট্টগ্রামে শীর্ষস্থানীয়
সর্বজনীনভাবে ব্যবসা করা কোম্পানি

যমুনা অয়েল কোম্পানি
বিএসআরএম
পদ্মা অয়েল কোম্পানী
পিএইচপি
মেঘনা পেট্রোলিয়াম
জিপিএইচ ইস্পাত
আরামিট সিমেন্ট
ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড
আরএসআরএম
হাক্কানি গ্রুপ
সূত্র:
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ

বাংলাদেশের জাতীয় জিডিপি-তের চট্টগ্রামের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। বন্দর নগরীটি দেশের অর্থনীতিতে ১২% অবদান রাখে। চট্টগ্রাম বাংলাদেশের শিল্প উৎপাদনের ৪০%, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৮০% এবং সরকারি রাজস্বের ৫০% অবদান রাখে। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে ৭০০ টিরও বেশি তালিকাভুক্ত কোম্পানি রয়েছে, ২০১৫ সালের জুন মাসে যার বাজার মূলধন ছিল $৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই শহরটি দেশের বহু প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম কর্পোরেশনগুলির প্রধান কার্যালয় অবস্থিত। ২০১১ সালে মুম্বই বন্দর এবং কলম্বো বন্দরের পরে চট্টগ্রাম বন্দর দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় বন্দর হিসেবে বার্ষিক ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য পরিচালনা করে। বন্দরটি মেরিটাইম সিল্ক রোডের অংশ যা চীনা উপকূল থেকে সুয়েজ খাল হয়ে ভূমধ্যসাগরে এবং মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের সাথে রেল সংযোগ সহ ত্রিয়েস্তের উচ্চ আড্রিয়াটিক অঞ্চলে চলাচল করে।

চট্টগ্রাম 
আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা

আগ্রাবাদ শহরের প্রধান কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক এলাকা। চট্টগ্রামে প্রধান বাংলাদেশী কোম্পানিগুলোর সদর দফতরের মধ্যে রয়েছে এম. এম. ইস্পাহানি লিমিটেড, বিএসআরএম, এ কে খান এন্ড কোম্পানি, পিএইচপি গ্রুপ, জেমস ফিনলে, হাবিব গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ, সিমার্ক গ্রুপ, কেডিএস গ্রুপ এবং টি কে গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর প্রধান কার্যালয়ের মধ্যে রয়েছে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ, যমুনা অয়েল কোম্পানি, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন এবং পদ্মা অয়েল কোম্পানি। ২০১০ সালে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলকে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ম্যাগাজিন, ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট, বিশ্বের অন্যতম প্রধান বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসাবে স্থান দিয়েছে। অন্যান্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে কর্ণফুলী ইপিজেড এবং কোরিয়ান ইপিজেড। শহরের প্রধান শিল্প খাতের মধ্যে রয়েছে পেট্রোলিয়াম, ইস্পাত, জাহাজ নির্মাণ, রাসায়নিক, ফার্মাসিউটিক্যালস, বস্ত্র, পাট, চামড়াজাত পণ্য, উদ্ভিজ্জ তেল শোধনাগার, গ্লাস উত্পাদন, ইলেকট্রনিক্স এবং মোটর যানবাহন। বাংলাদেশ চায়ের দাম নির্ধারণ করে চট্টগ্রাম চা নিলাম। ইস্টার্ন রিফাইনারি বাংলাদেশের বৃহত্তম তেল শোধনাগার চট্টগ্রামে অবস্থিত। গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন ১৯৬৭ সাল থেকে চট্টগ্রামে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড একটি শীর্ষস্থানীয় বাংলাদেশি জাহাজ নির্মাতা এবং মাঝারি আকারের সমুদ্রগামী জাহাজের রপ্তানিকারক। ২০১১-১২ সালে, চট্টগ্রাম প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত কর্ণফুলী পেপার মিল চট্টগ্রামে অবস্থিত।

চট্টগ্রামে পরিচালিত আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে এইচএসবিসি, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, সিটিব্যাংক এনএ এবং হাবিব ব্যাংক লিমিটেড। বৈচিত্র্যময় শিল্প ভিত্তি এবং সমুদ্রবন্দরের কারণে চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হয়। উত্তর-পূর্ব ভারত, বার্মা, নেপাল, ভুটান এবং দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের নিকটবর্তী হওয়ায় বন্দর শহরটির একটি বৈশ্বিক আর্থিক কেন্দ্র এবং আঞ্চলিক ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসাবে বিকাশের উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে।

পরিবহন

চট্টগ্রামের পরিবহন রাজধানী ঢাকার মতোই। মহানগর জুড়ে বড় বড় সড়ক ও রাস্তা রয়েছে। এখানে বিভিন্ন বাস ব্যবস্থা এবং ট্যাক্সি পরিষেবা রয়েছে, সেইসাথে ছোট 'বেবি' বা 'সিএনজি' ট্যাক্সি রয়েছে, যা তিনচাকা-গঠিত মোটর যান। পাঠাও এবং উবারের মতো স্থানীয় ও বিদেশি রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো এই শহরে সেবা প্রদান করছে। ঐতিহ্যবাহী ম্যানুয়াল রিকশাও আছে, যেগুলো খুবই সাধারণ এবং সহজলভ্য।

বিমান চলাচল

চট্টগ্রাম 
শাহ আমানত বিমানবন্দরের অভ্যন্তর

দক্ষিণ পতেঙ্গায় অবস্থিত শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (আইএটিএ: সিজিপি, আইসিএও: ভিজিইজি), চট্টগ্রামের একমাত্র বিমানবন্দর। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। বিমানবন্দরটি বার্ষিক ১.৫ মিলিয়ন যাত্রী এবং ৬,০০০ টন কার্গো পরিচালনা করতে সক্ষম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম এয়ারফিল্ড নামে পরিচিত, বিমানবন্দরটি ১৯৪৪-৪৫ সালের বার্মা অভিযানের সময় ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি এয়ার ফোর্সের দশম বিমান বাহিনী একটি সাপ্লাই পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশী বিমানবন্দরে পরিণত হয়। আন্তর্জাতিক পরিষেবাগুলি আরব উপদ্বীপের প্রধান শহরগুলির পাশাপাশি ভারতীয় শহর কলকাতায় উড়ে যায়। বর্তমানে, মধ্যপ্রাচ্যের বিমান পরিবহন সংস্থা যেমন এয়ার এরাবিয়া, ফ্লাইদুবাই, জাজিরা এয়ারওয়েজ, ওমান এয়ার এবং সালামএয়ার বাংলাদেশের বিমান পরিবহন সংস্থাসমূহের সাথে এই গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করে। সকল বাংলাদেশি এয়ারলাইন্স ঢাকায় নিয়মিত অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনা করে। বিমানবন্দরটি পূর্বে এমএ হান্নান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নামে পরিচিত ছিল কিন্তু সরকার কর্তৃক ২০০৫ সালের ২ এপ্রিল সুফি সাধক শাহ আমানতের নামে নামকরণ করা হয়।

রেল

চট্টগ্রাম 
চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের টার্মিনাল

রেলপথেও চট্টগ্রাম যাওয়া যায়। এই শহরে একটি মিটারগেজে রেলস্টেশন রয়েছে, যেটি বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্ব অংশ, যার সদর দপ্তরও শহরের মধ্যেই অবস্থিত। স্টেশন রোডে এবং পাহাড়তলী থানায় দুটি প্রধান রেলস্টেশন রয়েছে।

স্টেশন রোডে এবং পাহাড়তলীতে শহরের দুটি প্রধান রেলস্টেশন রয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, সিলেট, কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও জামালপুর জেলার ট্রেন পাওয়া যায়। ২০১৩ সালে যানজট কমাতে এবং শহরের অভ্যন্তরে যাত্রীদের জন্য উন্নত গণপরিবহন পরিষেবা নিশ্চিত করার জন্য চট্টগ্রাম চক্ররেল চালু করা হয়েছিল। রেলওয়েতে ৩০০ জন যাত্রী বহন ক্ষমতা সহ উচ্চ-গতির ডেমু ট্রেন রয়েছে। এই ডেমু ট্রেনগুলি চট্টগ্রাম-লাকসাম রুটেও যাতায়াত করে যা শহরকে কুমিল্লার সাথে সংযুক্ত করে।

রাস্তা

চট্টগ্রাম 
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে একটি ম্যান এসই ডাবল ডেকার বাস

জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) চট্টগ্রামের যানজট নিরসনের লক্ষ্যে কিছু পরিবহনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই পরিকল্পনার আওতায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে চউক কয়েচকটি ফ্লাইওভার নির্মাণ ও নগরীর মধ্যে বিদ্যমান সড়কগুলো নামমাত্র প্রশস্ত করেছে। এছাড়াও আরও কিছু প্রধান এক্সপ্রেসওয়ে এবং ফ্লাইওভার নির্মাণাধীন রয়েছে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড, যা চট্টগ্রাম শহরের উপকূল বরাবর চলে যাবে। এই রিং রোডে পাঁচটি ফিডার রোড সহ একটি মেরিন ড্রাইভ রয়েছে এবং এটি উপকূলের বাঁধ মজবুত করার জন্যও কেজ করবে বলা হয়। চট্টগ্রামের উত্তর ও দক্ষিণ অংশের মধ্যে আরও ভালো যোগাযোগ নিশ্চিত করার জন্য কর্তৃপক্ষ কর্ণফুলী নদীর মধ্য দিয়ে ৯.৩ কিলোমিটার (৫.৮ মা) ডুবো এক্সপ্রেসওয়ে টানেল নির্মাণ করেছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ডুবো টানেল।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, একটি প্রধান ধমনী জাতীয় মহাসড়ক, যেটি দেশের অন্যান্য অংশ থেকে মোটর গাড়ির মাধ্যমে শহরে প্রবেশের একমাত্র উপায়। এটি একটি জনাকীর্ণ এবং বিপজ্জনক মহাসড়ক হিসাবে বিবেচিত হয়। এই মহাসড়কটি এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের এএইচ৪১ রুটেরও অংশ। এটিকে ৪ লেনে উন্নীত করা হয়েছে। এন১০৬ (চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি মহাসড়ক) হল আরেকটি প্রধান জাতীয় মহাসড়ক যা পার্বত্য চট্টগ্রামকে শহরের সাথে সংযুক্ত করে।

    বাদশাহ মিয়া চৌধুরী সড়ক

বাদশাহ মিয়া চৌধুরী সড়ক বা বাদশা মিয়া চৌধুরী সড়ক চট্টগ্রাম শহরের মেহেদীবাগ এলাকায় অবস্থিত একটি সড়ক। চট্টগ্রামের তৎকালীন সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী বাদশা মিয়া চৌধুরীর নামে এ সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট, এবং চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি এ সড়কে অবস্থিত।

শিক্ষা

চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ভারতের অন্যান্য স্থানের মতো ধর্ম ভিত্তিক তিন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। আরবি নির্ভর মুসলমানদের জন্য মক্তব-মাদ্রাসা, সংস্কৃত ভাষা নির্ভর হিন্দুদের জন্য টোল-পাঠশালা‌-চতুষ্পাঠী এবং বৌদ্ধদের জন্য কেয়াং বা বিহার। সে সময় রাষ্ট্রাচারের ভাষা ছিল ফার্সি। ফলে হিন্দুদের অনেকে ফার্সি ভাষা শিখতেন। আবার রাষ্ট্র পরিচালনা এবং জনসংযোগের জন্য মুসলিম আলেমদের সংস্কৃত জানাটা ছিল দরকারি। এ সকল প্রতিষ্ঠানে হাতে লেখা বই ব্যবহৃত হতো। ইংরেজদের নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার আগ পর্যন্ত এই তিন ধারাই ছিল চট্টগ্রামের শিক্ষার মূল বৈশিষ্ট্য।

১৭৬০ সালে কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠত হলেও ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের কোন উদ্যোগ দেখা যায় নি, সমগ্র ভারত বর্ষে। ১৭৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা মাদ্রাসা ছাড়া শিক্ষা বিস্তারে কোম্পানির আর কোন উদ্যোগ ছিল না। ১৮১৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতে শিক্ষা বিস্তারের জন্য আইন পাশ করে। এর পর ভারতের বিভিন্ন স্থানে মিশনারী স্কুলের সংখ্যা বাড়ে তবে ১৮৩৬ এর আগে চট্টগ্রামে সে মাপের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে নি। ১৮৩৬ সালে জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন চট্টগ্রাম জেলা স্কুল নামে প্রথম ইংরেজি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান চালু করে। এলাকার খ্রীস্টান মিশনারীরা ১৮৪১ সালে সেন্ট প্লাসিড্‌স হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

১৮৪৪ সালে ভারতের বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ রাজকার্যে নিয়োগ পাওয়ার জন্য ইংরেজি জানা আবশ্যক ঘোষণা করলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ে। ১৮৫৬ ও ১৮৭১ সালে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হলেও সেগুলো ছিল স্বল্পস্থায়ী। ১৮৬০ খ্রীস্টাব্দে মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুল প্রতিষ্ঠত হয়। ১৮৮৫ সালে শেখ‌-ই-চাটগাম কাজেম আলী চিটাগাং ইংলিশ স্কুল নামে একটি মধ্য ইংরেজি স্কুল (অর্থাৎ ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৮ সালে এটি হাই স্কুলে উন্নীত হয়।

বর্তমান সময়ে আরো অনেক স্কুল চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে

  • সিডিএ পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ
  • সাউথ ইস্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ

সাহিত্য এবং সংস্কৃতি

সাহিত্য

চট্টগ্রামে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ শুরু হয় ষোড়শ শতকে। সে সময়কার চট্টগ্রামের শাসক পরাগল খাঁ এবং তার পুত্র ছুটি খাঁর সভা কবি ছিলেন কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রীকর নন্দী। কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বের একটি সংক্ষিপ্ত বাংলা অনুবাদ করেন। আর শ্রীকর নন্দী জৈমিনি সংহিতা অবলম্বনে অশ্বমেধ পর্বের বিস্তারিত অনুবাদ করেন।

সংস্কৃতি

চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। জানা ইতিহাসের শুরু থেকে চট্টগ্রামে আরাকানী মঘীদের প্রভাব লক্ষনীয়। ফলে গ্রামীণ সংস্কৃতিতেও এর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। সে সময় এখানকার রাজারা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হওয়ায় তার প্রভাবও যথেষ্ট। সুলতানি, আফগান এবং মোগল আমলেও আরাকানীদের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই ছিল। ফলে শেষ পর্যন্ত মঘীদের প্রভাব বিলুপ্ত হয়নি। এছাড়া চট্টগ্রামের মানুষ আতিথেয়তার জন্য দেশ বিখ্যাত।

চট্টগ্রামের বর্তমান সংস্কৃতির উন্মেষ হয় ১৭৯৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর। এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে সামাজিক ধানোৎপাদন ও বণ্টনে পদ্ধতিগত আমূল পরিবর্তন হয়। অন্যান্য স্থানের মতো চট্টগ্রামেও একটি নতুন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। নতুন এরই ফাঁকে ইংরেজরা প্রচলনা করে ইংরেজি শিক্ষা। মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করে।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের ইতিহাস সমৃদ্ধ। একাধারে নন্দীত গায়ক, সুরকার ও গীতিকার এম এন আখতার এর হাতে গড়া শেফালী ঘোষ এবং শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবকে বলা হয় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সম্রাট ও সম্রাজ্ঞি। আর অসংখ্য আঞ্চলিক গান ও মাইজভান্ডারী গান এর রচয়িতা আবদুল গফুর হালী বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে গীত দরিয়া বা গানের সাগর নামে পরিচিত। আঞ্চলিক গান, মাইজভান্ডারী গান ও কবিয়াল গান চট্টগ্রামের অন্যতম ঐতিহ্য। কবিয়াল রমেশ শীল একজন বিখ্যাত কিংবদন্তি শিল্পী। জনপ্রিয় ব্যান্ড সোলস, এল আর বি, রেঁনেসা, নগরবাউল এর জন্ম চট্টগ্রাম থেকেই। আইয়ুব বাচ্চু, কুমার বিশ্বজিৎ, রবি চৌধুরী, নকীব খান, পার্থ বডুয়া, সন্দিপন, নাসিম আলি খান, মিলা ইসলাম চট্টগ্রামের সন্তান। নৃত্যে চট্টগ্রামের ইতিহাস মনে রখার মত। রুনু বিশ্বাস জাতীয় পর্যায়ে বিখ্যাত নৃত্যগুরু। চট্টগ্রামের বিখ্যাত সাংস্কৃতিক সংগঠন হল দৃষ্টি চট্টগ্রাম, বোধন আবৃত্তি পরিষদ, প্রমা, "অঙ্গন" চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, আলাউদ্দিন ললিতকলা একাডেমি, প্রাপন একাডেমি, উদিচি, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, ফু্লকি, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থা, রক্তকরবী, আর্য সঙ্গীত, সঙ্গীত পরিষদ। মডেল তারকা নোবেল, মৌটুসি, পূর্ণিমা,শ্রাবস্তীর চট্টগ্রামে জন্ম। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় জেলা শিল্পকলা একাডেমি, মুসলিম হল, থিয়েটার ইন্সটিটিউটে।

চিত্তবিনোদন

খাদ্য

চট্টগ্রামের মানুষ ভোজন রসিক হিসেবে পরিচিত। তারা যেমন নিজেরা খেতে পছন্দ করেন, তেমনি অতিথি আপ্যায়নেও সেরা। চট্টগ্রামের মেজবান হচ্ছে তার বড় উদাহরণ। শুঁটকি, মধুভাত, বেলা বিস্কুট, বাকরখানি, লক্ষিশাক,গরুর গোস্ত ভুনা, পেলন ডাল, কালাভুনা, বিরিয়ানি, মেজবানি মাংস, আফলাতুন হালুয়া, তাল পিঠা, নোনা ইলিশ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খাদ্য।

মেজবান

মেজবান চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় ভোজন উৎসব। যেকোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামে মেজবান আয়োজন করা হয়ে থাকে। এইধরণের আয়োজনে ৫ শতাধিক মানুষকে আপ্যায়ন করা হয়ে থাকে। মূলত গরম ভাত, গরুর মাংস, মুগ বা ছোলার ডালে মেশানো মাংস, গরুর নলা থাকে মেজবানের প্রধান মেন্যু। ১৫০০ শতকে কবি বিজয় গুপ্তের পদ্মপূরাণ কাব্যগ্রন্থে এই উৎসবের তথ্য পাওয়া যায়। ১৬০০ শতকে সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ কাব্যগ্রন্থে ভোজন অর্থে 'মেজোয়ানি' শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ফারসি শব্দ মেজবান অর্থ অতিথি আপ্যায়নকারী, মেজবানি অর্থ আতিথেয়তা।

যোগাযোগ ও গণমাধ্যম

চট্টগ্রাম 
বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্র

চট্টগ্রাম ভিত্তিক বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, বাণিজ্যিক পত্রিকাসহ বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়ে থাকে। দৈনিক সংবাদপত্রের মধ্যে দৈনিক আজাদী, দৈনিক পূর্বকোণ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ, দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য। উল্লেখযোগ্য সাপ্তাহিকের মধ্যে রয়েছে চট্টলা, জ্যোতি, সুলতান, চট্টগ্রাম দর্পণ এবং মাসিক সংশোধনী, পুরবী, মুকুলিকা এবং সিমন্তো। চট্টগ্রামের একমাত্র প্রেস কাউন্সিল চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব, যেটি ১৯৬২ সালে গঠিত হয়েছিল। সরকারি মালিকানাধীন বাংলাদেশ টেলিভিশন, পাহাড়তলীতে তাদের চট্টগ্রাম কেন্দ্র পরিচালনা করে থাকে। বাংলাদেশ বেতারের চট্টগ্রাম ট্রান্সমিশন কেন্দ্রের মূল স্টুডিও আগ্রাবাদে অবস্থিত. এছাড়া কালুরঘাটে একটি বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র রয়েছে। পাশাপাশি চট্টগ্রামে বাংলাদেশের প্রায় সব টেলিভিশন ও রেডিওর কভারেজ রয়েছে। বেসরকারি এফএম রেডিও রেডিও ফুর্তি এবং রেডিও টুডের চট্টগ্রাম সম্প্রচার কেন্দ্র রয়েছে।

টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, জার্নাল, সঙ্গীত এবং বই সহ বাংলাদেশের জনপ্রিয় সংস্কৃতির সব দিক থেকে চট্টগ্রামকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রখ্যাত বলিউড চলচ্চিত্র পরিচালক আশুতোষ গোয়ারিকর ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম বিদ্রোহের উপর ভিত্তি করে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন, যার নাম খেলে হাম জি জান সে, যেটিতে অভিষেক বচ্চন প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।

পরিসেবাসমূহ

চট্টগ্রাম 
ট্টগ্রাম ওয়াসার মোহরা পানিশোধনাগার প্রকল্প

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দক্ষিণাঞ্চল নগরবাসীকে বিদ্যুৎ সরবরাহের করে থাকে। শহরের মোট বিদ্যুৎ খরচ প্রায় ১০০০ মেগাওয়াট। যদিও পুরো চট্টগ্রাম নগর ও শহর জুড়ে সঠিকভাবে তা দাঁড়ায় প্রায়১ ৩০০ মেগাওয়াট। এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট আগামী বছর উৎপাদনে যাবে এবং এর উৎপাদন ক্ষমতা হবে ১৩২০ মেগাওয়াট, এবং এটি চট্টগ্রাম শহরকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে তৈরি করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগ দ্বারা অগ্নি নির্বাপণ সেবা প্রদান করা হয়। চট্টগ্রাম ওয়াসা শহরে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা পরিচালনা করে থাকে। প্রাথমিকভাবে কর্ণফুলী নদী থেকে পানি উত্তোলন করা হয় এবং তারপর মোহরা পরিশোধন কেন্দ্রে তা পরিশোধিত করা হয়।

চট্টগ্রামে গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি, টেলিটক এবং এয়ারটেল সহ দেশের সকল প্রধান মোবাইল অপারেটর দ্বারা পরিবেশিত ব্যাপক জিএসএম এবং সিডিএমএ কভারেজ রয়েছে। যদিও, ল্যান্ডলাইন টেলিফোন পরিষেবা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) পাশাপাশি কিছু বেসরকারি অপারেটরের মাধ্যমে প্রদান করা হয়। বিটিসিএল ৪জি পরিষেবা প্রদানকারী বাংলালায়ন এবং কিউবি সহ কিছু ব্যক্তিগত আইএসপি-এর সাথে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবাও প্রদান করে।

স্বাস্থ্য

চট্টগ্রাম 
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চট্টগ্রামের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত হাসপাতাল। ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল শহরের প্রাচীনতম হাসপাতাল। শহরের অন্যান্য সরকার পরিচালিত চিকিৎসা কেন্দ্রগুলির মধ্যে রয়েছে পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, টিবি হাসপাতাল, সংক্রামক রোগ হাসপাতাল, ডায়াবেটিক হাসপাতাল, মা ও শিশু হাসপাতাল এবং পুলিশ হাসপাতাল।

নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে এভারকেয়ার হাসপাতাল, ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল, ন্যাশনাল হাসপাতাল, পার্ক ভিউ হাসপাতাল, ম্যাক্স হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনসিস, মেট্রোপলিটন হাসপাতাল, মাউন্ট হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতাল, শেভরন ক্লিনিক, সার্জিস্কোপ হাসপাতাল, সিএসসিআর, সেন্টার পয়েন্ট হাসপাতাল প্রভৃতি।

এছাড়াও চট্টগ্রামের খুলশিতে এস এ কাদেরী টিচিং ভেটেরিনারি হাসপাতাল নামে একটি পশু হাসপাতাল রয়েছে।

ক্রীড়া

চট্টগ্রাম 
জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম

বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মতো চট্টগ্রামে বিভিন্ন জনপ্রিয় খেলা যেমন ফুটবল, ক্রিকেট, বিলিয়ার্ড, টেবিল টেনিস, অ্যাথলেটিক্স, সকার, দাবা, বাস্কেটবল, হকি, কাবাডি, ভলিবল ইত্যাদি প্রচলিত রয়েছে। ব্যাডমিন্টনও একটি অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। চট্টগ্রামের ঐতিহাসিকগণ অবশ্য বেশ কিছু প্রাচীন খেলার কথা উল্লেখ করে থাকেন। এর মধ্যে রয়েছে বলীখেলা, গরুর লড়াই. তুম্বুরু, চুঁয়াখেলা, ঘাডুঘাডু, টুনি ভাইয়র টুনি, তৈইক্যা চুরি, হাতগুত্তি, কইল্যা, কড়ি, নাউট্টা চড়াই, ডাংগুলি, নৌকা বাইচ ইত্যাদি। এর মধ্যে জব্বারের বলীখেলার কারণে বলীখেলা, কুস্তি এবং নৌকা বাইচ এখনও চালু আছে। গ্রামাঞ্চলে বৈচি, ডাংগুলি এখনো দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে, অন্যগুলোর তেমন কোন প্রচলন দেখা যায় না।

জাতীয় পর্যায়ে চট্টগ্রামের খেলোয়াড়দের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। দেশের বাইরে থেকে সুনাম আনার ক্ষেত্রেও চট্টগ্রামের ক্রীড়াবিদদের অবদান উল্লেখযোগ্য। আইসিসি ট্রফি জেতা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দলনেতা ছিলেন আকরাম খান। কমনওয়েলথ গেমস থেকে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম স্বর্ণপদক অর্জনকারী চট্টগ্রামের শুটার আতিকুর রহমান।

চট্টগ্রামের স্প্রিন্টার মোশাররফ হোসেন শামীম জাতীয় পর্যায়ে পরপর ৭ বার ১০০ মিটার স্প্রিন্টে চ্যাম্পিয়ন হোন। এ কারণে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ দল যখন প্রথম বিশ্ব অলিম্পিকে অংশ নেয় তখন মোশাররফ হোসেন শামীম বাংলাদেশের পক্ষে একমাত্র ক্রীড়াবিদ ছিলেন।

চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গণের মূল কেন্দ্র চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়াম। চট্টগ্রামের প্রধান ক্রীড়া সংগঠন চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া পরিষদের প্রধান কার্যালয় এই স্টেডিয়ামে। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম দেশের অন্যতম ক্রিকেট স্টেডিয়াম। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে চট্টগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করছে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স।

ভগিনী শহর

আরও দেখুন

পাদটীকা

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Tags:

চট্টগ্রাম ব্যুৎপত্তিচট্টগ্রাম নামচট্টগ্রাম ইতিহাসচট্টগ্রাম প্রশাসনচট্টগ্রাম ভূগোলচট্টগ্রাম জনসংখ্যাচট্টগ্রাম অর্থনীতিচট্টগ্রাম পরিবহনচট্টগ্রাম শিক্ষাচট্টগ্রাম সাহিত্য এবং সংস্কৃতিচট্টগ্রাম চিত্তবিনোদনচট্টগ্রাম খাদ্যচট্টগ্রাম যোগাযোগ ও গণমাধ্যমচট্টগ্রাম পরিসেবাসমূহচট্টগ্রাম স্বাস্থ্যচট্টগ্রাম ক্রীড়াচট্টগ্রাম ভগিনী শহরচট্টগ্রাম আরও দেখুনচট্টগ্রাম পাদটীকাচট্টগ্রাম তথ্যসূত্রচট্টগ্রাম বহিঃসংযোগচট্টগ্রামউপত্যকাকর্ণফুলী নদীচট্টগ্রাম জেলাচট্টগ্রাম বিভাগচাটগাঁইয়া ভাষাপার্বত্য চট্টগ্রামপাহাড়বঙ্গোপসাগরবাংলাদেশের অর্থনীতিসমুদ্র

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

পলাশীর যুদ্ধজায়েদ খান (বাংলাদেশী অভিনেতা)আন্দ্রে রাসেলআবুল কাশেম ফজলুল হকবাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, ২০২৩মুহাম্মাদের সন্তানগণদর্শনডিপজলএল ক্লাসিকো১৮৫৭ সিপাহি বিদ্রোহধরিত্রী দিবসলক্ষ্মীপুর জেলাকৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকম্পিউটার কিবোর্ডভারত বিভাজনইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনচুম্বকরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন (১৮৬১–১৯০১)রামকৃষ্ণ পরমহংসসংস্কৃত ভাষাহোমিওপ্যাথিশিবনারায়ণ দাসরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঅশ্বত্থজোয়ার-ভাটাআসসালামু আলাইকুমশব্দ (ব্যাকরণ)চিরস্থায়ী বন্দোবস্তবাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডদৈনিক ইত্তেফাকবিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সপাবনা জেলাইসলাম ও হস্তমৈথুনবাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিদের তালিকাবর্তমান (দৈনিক পত্রিকা)হার্নিয়াবিরাট কোহলিআইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপবাঙালি মুসলিমদের পদবিসমূহআয়িশারক্তের গ্রুপপারমাণবিক ভরের ভিত্তিতে মৌলসমূহের তালিকাইব্রাহিম (নবী)কিশোরগঞ্জ জেলাবেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশশরীয়তপুর জেলামীর মশাররফ হোসেনব্যষ্টিক অর্থনীতিমেয়েনেতৃত্বআইয়ামে জাহেলিয়াসুকান্ত ভট্টাচার্যবেল (ফল)স্পিন (পদার্থবিজ্ঞান)রঙের তালিকাফরাসি বিপ্লবলিঙ্গ উত্থান ত্রুটিমুসলিম বিশ্বচুয়াডাঙ্গা জেলাসোনালী ব্যাংক পিএলসিমমতা বন্দ্যোপাধ্যায়চাঁদবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভোটবাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিবুড়িমারী এক্সপ্রেসবাংলাদেশের বিভাগসমূহশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়পশ্চিমবঙ্গের জেলাবেনজীর আহমেদটাইটানিকবিদ্যালয়শনি গ্রহমহাদেশরমনদীপ সিং (ভারতীয় ক্রিকেটার)আয়তন অনুযায়ী ভারতের রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলসমূহের তালিকাবিজ্ঞাপন🡆 More