দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য (সংস্কৃত: चन्द्रगुप्त विक्रमादित्य) (রাজত্বকাল: ৩৭৫ খ্রিষ্টাব্দ-৪১৫ খ্রিষ্টাব্দ) একজন শক্তিশালী গুপ্ত সম্রাট ছিলেন। গুপ্ত বংশের যে কয়েকজন রাজা গুপ্ত সাম্রাজ্য স্থাপন ও বিস্তার ও সংগঠনের জন্য কাজ করেছেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত তাদের মধ্যে অন্যতম। তার শাসনকালে গুপ্ত সাম্রাজ্য সর্বাধিক বিস্তৃত হয় এবং প্রাচীন ভারতের কলা, ভাস্কর্য ও স্থাপত্য শিল্প এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছায়। তার শাসনকালকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। পিতা সমুদ্রগুপ্তের মতোই তিনি যেমন ভারতের বিভিন্ন রাজপরিবারের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়ে তাদের সমর্থনলাভে সচেষ্ট ছিলেন, আবার ঠিক তেমনই আক্রমণাত্মক নীতি অবলম্বন করে তার সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (বিক্রমাদিত্য) | |
---|---|
গুপ্ত সম্রাট | |
রাজত্ব | ৩৭৫-৪১৫ খ্রিস্টাব্দ |
পূর্বসূরি | রামগুপ্ত |
উত্তরসূরি | প্রথম কুমারগুপ্ত |
দাম্পত্য সঙ্গী | ধ্রুবস্বামিণী |
বংশধর | প্রথম কুমারগুপ্ত গোবিন্দগুপ্ত প্রভাবতীগুপ্ত |
প্রাসাদ | গুপ্ত রাজবংশ |
পিতা | সমুদ্রগুপ্ত |
মাতা | দত্ত দেবী |
ধর্ম | হিন্দু ধর্ম |
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে সিলভিয়ান লেভি রামচন্দ্র ও গুণচন্দ্র নামক দুই জৈন লেখক দ্বারা রচিত নাট্যদর্পণ নামক একটি সংস্কৃত গ্রন্থ থেকে বিশাখদত্ত রচিত দেবীচন্দ্রগুপ্ত নামক একটি সংস্কৃত নাটকের ছয়টি শ্লোক প্রকাশ করেন। এই বছরই একাদশ শতাব্দীর মালবের রাজা ভোজ রচিত শৃঙ্গারপ্রকাশ ও সরস্বতীকণ্ঠাভরণ নামক দুইটি গ্রন্থ থেকে দেবীচন্দ্রগুপ্ত নাটকের তিনটি শ্লোক আবিষ্কৃত হয়।:১৫৩,১৫৪ ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম অমোঘবর্ষের সঞ্জন তাম্রলিপির একটি শ্লোক ও বাণভট্ট রচিত হর্ষচরিতের একটি ছোট টীকা থেকে দেবীচন্দ্রগুপ্ত নাটক সম্বন্ধে আরো কিছু তথ্য উদ্ধার করেন। এই সকল শ্লোক একত্র করে দেবীচন্দ্রগুপ্ত নাটকের বক্তব্য বোঝা সম্ভব হয়েছে।
দেবীচন্দ্রগুপ্ত নাটক থেকে জানা যায় যে, গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র রামগুপ্ত সিংহাসনে আরোহণ করেন ও তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের বাগদত্তা ধ্রুবস্বামিণীকে বলপূর্বক বিবাহ করেন। পশ্চিমী ক্ষত্রপদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর পশ্চিমী ক্ষত্রপ শাসক তৃতীয় রুদ্রসিংহের দাবি মেনে রামগুপ্ত ধ্রুবস্বামিণীকে তার নিকট সমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নেন।:১৫৩-১৫৯ এই ঘটনায় ক্রুদ্ধ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত নিজে রাণী ধ্রুবস্বামিণীর ছদ্মবেশে তৃতীয় রুদ্রসিংহের নিকট যান ও তাকে হত্যা করেন। ফলে, পশ্চিমী ক্ষত্রপ রাজ্য গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। পরে তিনি রামগুপ্তকেও হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করেন ও ধ্রুবস্বামিণীকে বিবাহ করেন।
যদিও ঐতিহাসিকেরা বিশাখদত্ত বর্ণিত এই ঘটনার সত্যতা সম্বন্ধে নিশ্চিত নন। কিন্তু প্রথম কুমারগুপ্তের বিলসাদ স্তম্ভলিপিতে মহাদেবী ধ্রুবদেবী এবং বৈশালীর টেরাকোটা শীলমোহরে মহাদেবী ধ্রুবস্বামিণীর উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া বিদিশায় আবিষ্কৃত কিছু তাম্র মুদ্রা ও লিপিতে রামগুপ্তের উল্লেখ রয়েছে।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত নাগ বংশীয় রাজা কুবেরনাগের কন্যাকে বিবাহ করেন। তার কন্যা প্রভাবতীগুপ্তর সঙ্গে বাকাটক রাজবংশের দ্বিতীয় রুদ্রসেনের বিবাহ হয়। অল্পকাল রাজত্বের পরেই দ্বিতীয় রুদ্রসেনের মৃত্যুর হলে প্রভাবতীগুপ্ত তার দুই নাবালক পুত্র দিবাকরসেন ও দামোদরসেনের অভিভাবক ও রাজপ্রতিনিধি হয়ে কুড়ি বছর রাজ্যভার সামলান। এই সময় এই রাজ্য বস্তুতঃ গুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসনতন্ত্রের অংশ হয়ে যায়।
কালিদাস তার রঘুবংশ গ্রন্থে বলেছেন যে, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত একুশটি রাজ্য অধিকার করতে সক্ষম হন। পূর্ব ও পশ্চিম ভারত অধিকারের পরে তিনি উত্তর ভারতে পশ্চিম ও পূর্ব অক্ষু উপত্যকার পারসিক, হুন, কম্বোজ জনজাতিদের পরাস্ত করেন। এরপর তিনি হিমালয়ের কিন্নর, কিরাত প্রভৃতি জাতিদের পরাস্ত করেন। ক্ষেমেন্দ্র তার বৃহৎকথামঞ্জরী গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, বিক্রমাদিত্য শক, ম্লেচ্ছ, কম্বোজ, যবন, তুষার, পারসিক, হুন প্রভৃতি বর্বর জাতিদের হত্যা করে পৃথিবীকে ভারমুক্ত করেছিলেন। শকদের পরাস্ত করে তিনি শকারি উপাধি গ্রহণ করেন।
দিল্লির কুতুব মিনার চত্বরে অবস্থিত লৌহস্তম্ভের গায়ে প্রাচীনতম লেখটি ব্রাহ্মী লিপিতে সংস্কৃত ভাষায় উৎকীর্ণ রয়েছে।:১৭৭ এই লেখ অনুসারে জানা যায়, এই স্তম্ভ বিষ্ণুর সম্মানে স্থাপিত হয়েছিল। এই লিপিতে চন্দ্র নামক এক রাজার সাহস ও গুণাবলী বর্নিত রয়েছে। লেখটির চরিত্র বিশ্লেষণ করে স্থির করা হয়েছে, যে এই লেখটি গুপ্ত যুগের এবং রাজা চন্দ্র ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত একই ব্যক্তি। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে পণ্ডিত বাঁকে রায় লেখটির বক্তব্য বিশ্লেষণ করেন। তার বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় রাজা চন্দ্র বঙ্গ দেশে যুদ্ধ করেন ও সপ্ত সিন্ধু অতিক্রম করে বাহ্লীক দেশ অধিকার করেন। এই স্তম্ভটি তার মৃত্যুর পর বিষ্ণুর সম্মানার্থে বিষ্ণুপদগিরিতে স্থাপিত হয়। উদয়গিরি গুহাসমূহ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং গুপ্ত যুগের বিষ্ণু উপাসনার জন্য পরিচিত বলে বিষ্ণুপদগিরি প্রকৃতপক্ষে এই স্থান বলেই মনে করা হয়েছে ঠিকই, তবুও ঐতিহাসিকদের মতে স্তম্ভটির প্রকৃত প্রথম অবস্থান সম্পর্কে বিতর্ক রয়েছে।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রাগুলির অধিকাংশ বিহার ও বাংলা থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে হুগলি জেলার মাধবপুর গ্রাম থেকে তীর-ধনুক হাতে রাজমূর্তি যুক্ত পাঁচটি স্বর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়। ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে মুজফফরপুর জেলার হাজীপুর গ্রামে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের নামাঙ্কিত তিন ধরনের স্বর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়। এক ধরনের মুদ্রায় ছাতার তলায় দন্ডায়মান রাজমূর্তি, অপর এক ধরনের মুদ্রায় তীর-ধনুক হাতে রাজমূর্তি এবং তৃতীয় ধরনের মুদ্রায় সিংহ শিকাররত রাজমূর্তি রয়েছে। গয়া থেকে শূল হাতে রাজমূর্তি যুক্ত একটি স্বর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়। কালীঘাট থেকে এই ধরনের একটি স্বর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়, যা ওয়ারেন হেস্টিংস ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেন, যা বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে। ভাগলপুর জেলার সুলতানগঞ্জের নিকটে অবস্থিত একটি বৌদ্ধ স্তূপ উৎখননের সময় পশ্চিমী ক্ষত্রপ তৃতীয় রুদ্রসিংহের রৌপ্যমুদ্রার সাথে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের নামাঙ্কিত একটি রৌপ্যমুদ্রা এবং যশোহর জেলার মহম্মদপুর গ্রামেও বেশ কয়েকটি রৌপ্য মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়। পাটলিপুত্র উৎখননের সময় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের নামাঙ্কিত কয়েকটি তাম্র মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত | ||
রাজত্বকাল শিরোনাম | ||
---|---|---|
পূর্বসূরী রামগুপ্ত | গুপ্ত রাজবংশ ৩৭৫-৪১৫ | উত্তরসূরী প্রথম কুমারগুপ্ত |
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.