দন্তবিজ্ঞান

দন্তবিজ্ঞান বা দন্ত্যচিকিৎসা হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি শাখা। মুখগহ্বর, বিশেষত দন্ত্যবিন্যাস, মৌখিক শ্লৈষ্মিক ঝিল্লী এবং মুখ ও চোয়াল সংলগ্ন অথবা সম্পর্কিত বিভিন্ন গঠন বা কলা নিয়ে অধ্যয়ন, রোগ নির্ণয়, প্রতিকার ও রোগের চিকিৎসার অন্তর্ভুক্ত। যদিও সাধারণ মানুষের কাছে কেবল দাঁত সম্পর্কিত কিন্তু দন্ত্যচিকিৎসার পরিধি শুধু দাঁতেই সীমাবদ্ধ নয় বরং করোটি ও মুখের অন্যান্য গঠন আবার চোয়াল ও ললাটের সংলগ্ন গঠনের অন্তর্ভুক্ত। দন্ত্যচিকিৎসা শব্দটি এসেছে দন্তলোজি থেকে। প্রাচীন গ্রিক শব্দ ὀδούς (odoús অর্থাৎ দাঁত) - দাঁতের গঠন, ক্রমবিকাশ ও অস্বাভাবিকতার শিক্ষা দন্তলোজি। বিষয়বস্তুর সাদৃশ্যের কারণে কোন কোন জায়গায় দন্ত্যচিকিৎসা এবং মৌখিক চিকিৎসাশাস্ত্র (মুখের বিভিন্ন সমস্যা ও রোগের শিক্ষা) দুই নামই ব্যবহৃত হয়।

দন্তবিজ্ঞান
সহায়কের সাহায্যে একজন দন্ত্যচিকিৎসক রোগীর চিকিৎসা করছেন।
পেশা
নাম
  • দন্ত্যচিকিৎসক
  • দন্ত্য শল্যচিকিৎসক* চিকিৎসক
পেশার ধরন
পেশা
প্রায়োগিক ক্ষেত্র
স্বাস্থ্যসেবা এবং শল্যচিকিৎসা
বিবরণ
যোগ্যতা
  • বিশ্লেষণমূলক দক্ষতা
  • যোগাযোগ এবং আন্তঃব্যক্তিগত দক্ষতা
  • কারুনৈপুণ্য
  • সমালোচক মনোভাব
  • সহমর্মিতা
  • হস্তগত কুশলীতা
  • পেশাদারি
  • দলগত কাজ
কর্মক্ষেত্র
  • Private practices
  • Primary care clinics
  • Hospitals
সম্পর্কিত পেশা
  • Physician
  • dental assistant
  • dental technician
  • various dental specialists
দন্তবিজ্ঞান
একজন দন্ত্য চিকিৎসক এবং সহায়ক আক্কেল দাঁত উত্তোলন করছেন।
দন্তবিজ্ঞান
একটি ইসদন্তের প্রস্থচ্ছেদ।

সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য 'দন্ত্যচিকিৎসা' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দাঁতের চিকিৎসা মুলত একজন দন্ত্যচিকিৎসক এবং তার সাহায্যকারীরাই (সহায়ক, যন্ত্রবিদ, থেরাপিস্ট ও অন্যান্য) করে থাকেন। বেশিরভাগ দন্ত্যচিকিৎসক ব্যক্তিগতভাবেই কাজ করে থাকেন তবে অনেকে দাঁতের হাসপাতালে অথবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও (জেলখানা, সেনাঘাটি) কাজ করেন। হরপ্পা সভ্যতা থেকে পাওয়া দেহাবশেষে ৯০০০ বছর পূর্বেও দাঁতে ছিদ্র করার প্রমাণ মিলেছে। ধারণা করা হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রথম বিশেষ কাজ ছিল দাঁতের শল্যচিকিৎসা

দন্ত্য চিকিৎসা

দন্ত্যচিকিৎসা মুলত মুখগহ্বর সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে চর্চা করে। অন্যান্য আর্থ-সামাজিক গোষ্ঠির তুলনায় সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য মুখগহ্বরের রোগগুলোই গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা কারণ হল এর অধিকতর ব্যাপ্তি এবং বিশ্ব জোড়া প্রাদুর্ভাব।

দাঁতের বেশিরভাগ চিকিৎসা করা হয় দুইটি অত্যন্ত প্রচলিত মৌখিক রোগের প্রতিরোধ বা প্রতিকারের জন্য এগুলো হল দাঁতের ক্ষয়রোগ আর মাড়ির অসুখ বা পায়েরিয়া। সাধারণ চিকিৎসাগুলো হল দাঁতের পুন: প্রতিষ্ঠা, উৎপাটন বা দাঁতের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ, দাঁত স্কেলিং অথবা রুট ক্যানাল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সকল দন্ত্য চিকিৎসকদের কমপক্ষে তিন বছর অস্নাতক পড়াশুনা করতে হয় তবে প্রায় সকলেই একটি স্নাতক ডিগ্রী সম্পন্ন করে থাকেন। চার বছরের দন্ত্য বিদ্যালয়ে অধ্যয়নের পর তাদের "ডক্টর অব ডেন্টাল সার্জারি" (ডিডিএস) বা "ডক্টর অব ডেন্টাল মেডিসিন" (ডিএমডি) উপাধি দেয়া হয়। তবে আরো জটিল চিকিৎসা যেমন বেদনানাশক ঔষধের ব্যবহার, মুখ ও চোয়ালের অস্ত্রপচার এবং দাঁত স্থাপন করতে দন্ত্যচিকিৎসকদের আরও পড়াশুনা এবং যোগ্যতার প্রয়োজন হয়ে থাকে। তাদের সাধারণ প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই তারা বেশিরভাগ দন্ত্য সেবা দিতে পারে যেমন স্কেলিং, রুট ক্যানাল, দাঁত উত্তোলন এছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষা যেমন এক্স-রে ও রোগ নির্ণয়। এছাড়া দন্ত্যচিকিৎসকেরা বিভিন্ন ওষুধও নির্ধারন করে দিতে পারেন যেমন অ্যান্টিবায়োটিক, বেধনা নাশক অথবা রোগীর ব্যবস্থপনার জন্য অন্য যেকোন ওষুধ।

এছাড়া দন্ত্যচিকিৎসকেরা মৌখিক রোগ রোধের জন্য নিয়মিত, বছরে দুইবার দাঁতের মূল্যায়ন ও বিশেষজ্ঞ দ্বারা দাঁত পরিষ্কার করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। মুখগহ্বরের অবস্থা অন্য বিভিন্ন শারীরিক রোগের লক্ষণ নির্দেশ করতে পারে যেমন বহুমূত্ররোগ, কর্কটরোগ বা অস্টিওপরোসিস। কিছু গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে যে মাড়ির অসুখ, বহুমূত্ররোগ, হৃদরোগ এবং নির্ধারিত সময়ের পূর্বে জন্মের মত অসুখের ঝুঁকির সাথে সম্পর্কিত।

শিক্ষা ও অনুজ্ঞাপত্র

ডাঃ জন এম. হ্যারিস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহায়ো রাজ্যে সর্বপ্রথম দন্ত্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং দন্ত্যচিকিৎসাকে চিকিৎসা পেশার স্বীকৃতি দেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৮২৮ সালে এটি চালু হয় এবং বর্তমানে এটি একটি দন্ত্য জাদুঘর। প্রথম দন্ত্য কলেজ চালু হয় ১৮৪০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরীল্যান্ড রাজ্যে।

গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে বিভিন্ন দেশ থেকে পাশ করা বা একই দেশের অন্য কলেজ থেকে পাশ করা দন্ত্যচিকিৎসকদের একই রোগের চিকিৎসার সিদ্ধান্ত ভিন্ন হয়। যেমন ইসরায়েল এর দন্ত্যচিকিৎসকেরা অধিকতর ক্ষেত্রে আক্কেল দাঁত উত্তোলনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন লাতিন আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান দের দন্ত্যচিকিৎসকদের তুলনায় ।

যুক্তরাজ্যে, ১৮৭৮ সালের ব্রিটিশ ডেন্টিস্ট অ্যাক্ট এবং ১৮৭৯ এর ডেন্টিস্ট রেজিস্টার শুধুমাত্র যোগ্যতাসম্পন্ন এবং নিবন্ধভুক্ত ব্যক্তিদের দন্ত্যচিকিৎসক বা দন্ত্য শল্যচিকিৎসক পদবি ব্যবহার করার অনুমতি দেয়। তবে অন্যরা আইনত নিজেদের "দন্ত্যবিশেষজ্ঞ" বা "দন্ত্যপরামর্শদাতা" বলতে পারবেন। ১৯২১-এর ডেন্টিস্ট অ্যাক্টের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে দন্ত্যচিকিৎসার অনুশীলন চালু হয় যা অনুযায়ী দন্ত্যচিকিৎসা অনুশীলনকারী সকলকে নিবন্ধন করতে হবে। ১৮৮০-এ স্যার জন টমসকে সভাপতি করে গঠিত 'ব্রিটিশ ডেন্টাল এসোসিয়েশন' দন্ত্যচিকিৎসকদের অবৈধ অনুশীলন বন্ধে বড় ভূমিকা পালন করে।

কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, ব্রাজিল, চিলি, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডাতে দন্ত্যচিকিৎসক হতে হলে ডক্টর অব ডেন্টাল সার্জারি (ডিডিএস) বা ডক্টর অব ডেন্টাল মেডিসিন (ডিডিএম) ডিগ্রীপ্রাপ্ত হতে হবে তবেই তিনি দন্ত্যচিকিৎসা অনুশীলন করার যোগ্য বিবেচিত হবেন। এটি যুক্তরাজ্য এবং ব্রিটিশ প্রজাতন্ত্রের দেশগুলোর ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারির (বিডিএস, বিডেন্ট, বিসিএইচডি, বিডিএসসি) সমতুল্য। অধিকাংশ পশ্চিমা দেশে, যোগয়তাসম্পন্ন দন্ত্য চিকিৎসক হতে একজনকে কমপক্ষে ৪ বছরের স্নাতকোত্তর অধ্যয়ন করতে হয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচ বছরের অধ্যয়ন প্রয়োজন। দন্ত্যচিকিৎসা অনুশীলনের আগে একজন দন্ত্য চিকিৎসককে সাধারণত পাঁচ থেকে আট বছরের মত অধ্যয়ন করতে হয়। যদিও বাধ্যতামূলক নয় তবে অনেক দন্ত্যচিকিৎসক ডেন্টাল ডিগ্রী লাভের পর সুনির্দিষ্ট দন্ত্যসেবার উপর ইন্টার্নশীপ করে থাকেন।

বিশিষ্টতা

কিছু দন্ত্যচিকিৎসক তাদের প্রাথমিক ডিগ্রী অর্জনের পর আরো প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য। তবে স্থানভেদে নির্ভর করে দন্ত্য নিবন্ধনকারীরা কোন বিষয়গুলো গ্রহণ করবেন। যেমনঃ

  • দন্ত্য গণস্বাস্থ্য- মৌখিক স্বাস্থ্যের রোগবিস্তার-সংক্রান্ত এবং সামাজিক স্বাস্ত্যনীতি এই শিক্ষার অন্তর্গত।
  • রক্ষনশীল দন্ত্যচিকিত্সা- ক্ষয়প্রাপ্ত অথবা বিনা ক্ষয়ে আঘাত প্রাপ্ত দাঁতকে পুনঃরুদ্ধার করার শিল্প বা বিজ্ঞান এই শিক্ষার অংশবিশেষ। যদি রূট ক্যানাল করা হয় তাহলে তা এন্ডোডন্টিক্স। ভারতে এই বিশেষ ডিগ্রী দেয়া হয়।
  • এন্ডোডন্টিক্স- রুট ক্যানাল চিকিৎসা এবং দন্ত্য মজ্জার অসুখ নিয়ে অধ্যয়ন।
  • আইনঘটিত দন্ত্যবিজ্ঞান আইনের জন্য দন্ত্য প্রমাণ সংগ্রহ ও তার ব্যবহার। যেকোন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বা দন্ত্যচিকিৎসায় প্রশিক্ষণ নেয়া দন্ত্যচিকিৎসক এই কাজ করতে পারেন। আইনঘটিত দন্ত্যবিজ্ঞানের কাজ হল প্রাথমিক দলিল রচনা ও পরিচয় যাচাই করা।
  • বৃদ্ধদের দন্ত্যচিকিৎসা- বয়স্কদের বার্ধক্যজনিত কারণের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন অসুখের শনাক্তকরণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধ এই দন্ত্যসেবার আওতাভুক্ত।
  • মুখ ও চোয়ালের রোগবিদ্যা- মুখ ও চোয়াল সম্পর্কিত রোগগুলি নিয়ে অধ্যয়ন, শনাক্তকরণ ও মাঝে মাঝে তার প্রতিকার নির্ণয় করা।
  • মুখ ও চোয়ালের তেজস্ক্রিয়তাবিদ্যা- মুখ ও চোয়ালের রোগের তেজস্ক্রিয় ব্যাখ্যা।
  • মুখ ও চোয়ালের অস্ত্রপচার- দাঁত উত্তোলন, স্থাপন এবং মুখ ও চোয়ালের অস্ত্রপচার। মুখ ও চোয়ালের অস্ত্রপচারের প্রসার পরিবর্তনশীল।
  • মৌখিক জীববিদ্যা- দাঁত ও মুখের জীববিদ্যার গবেষণা।
  • মৌখিক ইম্প্যান্টোলোজী- ডেন্টাল ইম্প্যান্টের মাধ্যমে উত্তোলনকৃত দাঁত প্রতিস্থাপনের কলা বা বিজ্ঞান।
  • মৌখিক ঔষধ- মৌখিক ও শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীর রোগের মূল্যায়ন এবং শনাক্তকরণ।
  • অর্থোডন্টিক্স- দাঁত সোজা করা এবং মুখ ও চোয়ালের সামান্য আকার পরিবর্তন।
  • শিশুদের দন্ত্যচিকিৎসা- শিশুদের জন্য এই দন্ত্যসেবা।
  • পেরিওডোন্টলজী- দাঁতের আশেপাশের বা দাঁতের সাহায্যকারী গঠনগুলোর রোগের চর্চা ও প্রতিকার।
  • প্রস্থডোন্টিক্স- কৃত্রিম দাঁতের প্রতিস্থাপন। কেউ কেউ মুখের অন্যান্য অসম্পূর্ন গঠন যেমন চোখ, নাক ও কানের কৃত্রিম প্রতিস্থাপন নিয়েও প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন।
  • বিশেষ প্রয়োজনীদের দন্ত্যচিকিৎসা- জন্মগতভাবে বা পরবর্তীতে প্রাপ্ত অক্ষম ব্যক্তিদের দন্ত্যসেবা।
  • পশুদের দন্ত্যচিকিৎসা- পশু চিকিৎসার বিশেষরূপ। দন্ত্যসেবার এই অংশ পশুদের দন্ত্য চিকিৎসা নিশ্চিত করে।

ইতিহাস

প্রাক-কৃষি সমাজে দাঁতের ক্ষয় কম ছিল, ১০,০০০ বছর পূর্বে কৃষি সমাজের বিস্তারের সাথে সাথে দাঁতের দাঁতের ক্ষয়ের হার বাড়তে থাকে। জানামতে প্রাচীনতম দন্ত্য চিকিৎসার নিদর্শন পাওয়া গেছে ১৩,৮২০ থেকে ১৪,১৬০ বছর আগের। ইটালিতে শক্ত পাথরের ন্যায় যন্ত্র দিয়ে একটি ক্ষতিপ্রাপ্ত দাঁত আংশিক পরিষ্কার করা হয়। ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বের হরপ্পা সভ্যতা থেকে দন্ত্য চিকিৎসার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল। মেহেরগড়-এর এক জায়গায় দাঁত সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানে ধনুকের ন্যায় যন্ত্রের ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রাচীন দন্ত্যচিকিৎসা পর্যালোচনা করে দেখা যায় তা নির্ভরযোগ্য এবং কার্যকর ছিল। ৬৫০০ বছর পূর্বে স্লোভেনিয়া-তে সর্বপ্রথম দাঁতের ফিলিং হিসেবে মৌমাছে থেকে প্রাপ্ত মোমের ব্যবহার আবিষ্কৃত হয়।

দন্তবিজ্ঞান 
দন্ত্য চিকিৎসকের কাছে কৃষক, জোহান লিস, আনু. ১৬১৬-১৭

প্রাচীন সুমেরীয়- মতে দাঁতের ক্ষয়রোগের কারণ হিসেবে দাঁতের পোকা-কে দায়ী করা হয়। প্রাচীন ভারত, মিশর, জাপানচীন-এও এই ধারণার প্রমাণ পাওয়া যায়। এমনকি ১৪ শতাব্দীর শল্যচিকিৎসকও দাঁতের পোকার কারণে দাঁতের ক্ষয়রোগ হয় এই ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন।

প্রাচীন মিশর- এর বহু পেপিরাসে দাঁতব্যথা, ক্ষয়প্রাপ্ত দাঁত এবং আলগা দাঁতের চিকিৎসার উপায় বর্ণিত আছে। ১৭ শতাব্দিতে লিখিত এডউইন স্মিথ পেপিরাস-এ স্থানচ্যুত ও ভাঙ্গা চোয়ালের চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা রয়েছে যেখানে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ বছরের পান্ডুলিপির প্রতিফলন পাওয়া যায়। ১৮ শতাব্দীতে হামুরাবীর নিয়মাবলী-তে দুইবার শাস্তি হিসেবে দাঁত উত্তোলনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে । প্রাচীন মিশর এবং গ্রীক-রোমানদের দেহবশেষ পরীক্ষা করে কৃত্রিম দাঁত তৈরীর প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গিয়েছে। তবে তা নান্দনিক কারণেও করা হয়ে থাকতে পারে।

প্রাচীন গ্রিক পণ্ডিত হিপোক্রেটিসএরিস্টটল দাঁত ওঠার আদর্শ নমুনা, ক্ষয়প্রাপ্ত দাঁত ও মাড়ির অসুখ ও সাঁড়াশি যন্ত্রবিশেষের ব্যবহারে দাঁত উত্তোলন, তারের ব্যবহারে আলগা দাঁত ও চোয়াল স্থিতিশীল করার মত দন্ত্যচিকিৎসা নিয়ে লেখেন। প্রাচীন মিশরের প্রথম দন্ত্য চিকিৎসক উপাধি দেয়া হয় হাসি-রে কে। মিশরীয়রা প্রতিস্থাপিত দাঁতগুলোকে সোনার তার দিয়ে বেঁধে রাখতেন। রোমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের লেখন কর্নেলিয়াস সেলসাস বিস্তারিরভাবে দাঁতের রোগ ও তার প্রতিকারের উপায় নিয়ে লিখেন। ৬৫৯ সালে চীনা চিকিৎসক সু কুং প্রথম দন্ত্যমিশ্রনের(Dental amalgams) উল্লেখ করেন তাং রাজবংশ-এর চিকিৎসাবিজ্ঞানের লেখনিতে, যা জার্মানিতে ১৫২৮ সাথে প্রকাশিত হয়।

ইতিহাসগতভাবে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা হিসেবে দাঁত উত্তোলন করানো হত। মধ্যযুগে এমনকি ১৯ শতাব্দিতেও দন্ত্য চিকিৎসাকে আলাদা পেশা হিসেবে বিবেচনা হত না এবং সাধারণ নাপিত বা অন্য চিকিৎসকরা দন্ত্যচিকিৎসা এর প্রক্রিয়াগুলো করে থাকতেন। নাপিতেরা সাধারণত দাঁত উত্তোলনের কাজ করতেন যা পরবর্তীতে ব্যথা ও দীর্ঘমেয়াদি দাঁতের অসুখে পরিণত হত। ১৪ শতাব্দিতে গাই-দে-কোলিয়াক দন্ত্য পেলিক্যান্(Dental pelican) উদ্ভাবন করেন যা পেলিক্যান পাখির ঠোঁটের দেখতে মত ছিল এবং সেটি ১৮ শতাব্দি পর্যন্ত দাঁত উত্তোলনের কাজে ব্যবহৃত হত। দন্ত্য চাবি(Dental key) দিয়ে এর প্রতিস্থাপন করা হয় যা পরবর্তিতে ২০ শতাব্দিতে এসে আধুনিক সাঁড়াশি(forceps) দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়।

শুধুমাত্র দন্ত্যচিকিৎসা নিয়ে রচিত প্রথম বইটি প্রকাশিত হয় ১৫৩০ সালে। প্রথম দন্ত্যচিকিৎসা নিয়ে রচিত পাঠ্যপুস্তকটিক নাম ছিল অপারেশন ফর দ্যা টিথ যার লেখক ছিলেন চার্লস অ্যালেন এবং এটি ১৬৮৫ সালে প্রাকাশিত হয়েছিল।

যুক্তরাজ্যে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত দন্ত্যচিকিৎসা দাতাদের কোন আনুষ্ঠানিক যোগ্যতা ছিল না, ১৯২১ সালে গিয়ে শুধুমাত্র যোগ্যতাসম্পন্নদের দন্ত্যচিকিৎসা চর্চা করার অনুমতি দেয়া হয়। ১৯৭৯ সালের একটি জাতীয় কমিশনের রিপোর্টে আসে যে, ১৯২১ সালের তুলনায় প্রতি ১০,০০০ নাগরিকের জন্য প্রায় দ্বিগুন নিবন্ধভুক্ত দন্ত্যচিকিৎসক রয়েছে।

আধুনিক দন্ত্যচিকিৎসা

দন্তবিজ্ঞান 
দাঁত পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত অণুবীক্ষণ যন্ত্র, আনু. ১৯০০ সাল

১৬৫০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে আধুনিক দন্ত্যচিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি হয়। ইংরেজ চিকিৎসক থমাস ব্রাউন তার বন্ধুর কাছে লেখা চিঠি(A Letter to a Friend- প্রায় ১৬৫৬ সালে প্রাকাশিত ১৬৯০ সালে)-তে স্বভাবসুলভ হাস্যরসের সাথে দাঁত নিয়ে তার পর্যালোচনা তুলে ধরেনঃ

“মিশরীয় যেই মমিগুলা দেখেছি, তাদের মুখ খোলা ছিল, এবং কিছুটা হাঁ করা, যেটা তাদের দাঁত পর্যবেক্ষণ করার ভাল সুযোগ তৈরী করে দিয়েছিল, সেখানে কোন কমতি বা ক্ষয় খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না, এবং তারমানে মিশরে কেউ অস্ত্রপচার চর্চা করতেন না তবে রোগগুলোর আলাদাভাবে চিকিৎসা করতেন, অর্থাৎ সেখানে শুধু দাঁত উত্তোলনকারী হওয়াটা অলাভজনক পেশা হত তবে রাজা পাইরাসের দাঁত উত্তোলনকারী হওয়ার চেয়ে ভাল হত কারণ তার মাথায় মাত্র দু টোই দাঁত ছিল।”

ফ্রেঞ্চ শল্যচিকিৎসক পেরি ফকার্ডকে বলা হয় আধুনিক দন্ত্যচিকিৎসার জনক। সেকালে ১৭ শতাব্দীর শেষদিকে এবং ১৮ শতাব্দীর শুরুতে অস্ত্রপচারের যন্ত্রের সল্পতা সত্ত্বেও ফকার্ড অত্যন্ত দক্ষ শল্যচিকিৎসক ছিলেন। তিনি প্রায়ই নাপিত, জহুরি ও ঘড়ি বানানোর লোকদের দেখে দন্ত্যচিকিৎসার জন্য যন্ত্র বানাতেন। তিনি দাঁতের গর্তের জন্য ফিলিং ব্যবহার শুরু করেন। তিনি নিশ্চিত করেন যে চিনি থেকে উৎপন্ন অম্ল যেমন চিঞ্চাম্ন দাঁতের ক্ষয়ের কারণ এবং এও ধারণা করেন যে এর কারণে পরবর্তীতে দাঁত ও মাড়ির পাশে অর্বুদ (tumor) দেখা দিতে পারে।

দন্তবিজ্ঞান 
দন্ত্য ইম্প্যান্টের রেডিওগ্রাফিক চিত্র, তৈরী ১৯৭৮

ফকার্ড কৃত্রিম দাঁত স্থাপনের অগ্রদূত এবং তিনি হারানো দাঁত প্রতিস্থাপনের বিভিন্ন উপায়ও আবিষ্কার করেন। তিনি প্রস্তাব দেন যে হাতির দাঁত বা হাড় দিয়ে বিকল্প বানানো যায়। তিনি দন্ত্যবন্ধনীও (Dental braces) আবিষ্কার করেন, যদিও প্রাথমিকভাবে সেগুলো সোনার তৈরী ছিল। তিনি আবিষ্কার করেন যে তারের অবস্থান অনুযায়ী দাঁতের অবস্থান ঠিক হবে। লিলেন বা সিল্কের সুতা দিয়ে বন্ধনীগুলো বাঁধা হত। তার আবিষ্কারগুলো ১৭২৮ সালে Le chirurgien dentiste or The Surgeon Dentist (দাঁতের শল্যচিকিৎসক) নামক প্রাকাশনার মাধ্যমে পৃথিবীর সামনে আসে। ফ্রেঞ্চ সেই লেখার অন্তর্ভুক্ত ছিল মৌলিক দন্ত্যসংস্থানবিদ্যা ও তার কাজ, দাঁতের গঠন এবং দাঁত পুনঃপ্রতিস্থাপনের বিভিন্ন উপায় এবং তিনি দক্ষতার সাথে অন্যান্য শল্যচিকিৎসার সাথে দন্ত্যচিকিৎসার পার্থক্য প্রতিষ্ঠা করেন।

দন্তবিজ্ঞান 
একটি আধুনিক দন্ত্য চিকিৎসকের চেয়ার

ফকার্ডের পরে অত্যন্ত দ্রুত দন্ত্যচিকিৎসার পড়াশুনার অগ্রগতি ঘটে। ইংরেজ শল্যচিকিৎসক জন হান্টার দুইটি গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করেন মানুষের দাঁতের প্রকৃত ইতিহাস (১৭৭১) এবং দাঁতের রোগের ব্যবহারিক শাস্ত্র (১৭৭৮)। ১৭৬৩ সালে তিনি লন্ডনের দন্ত্যচিকিৎসক জেমস স্পেন্সের সাথে মিলে কিছুদিন কাজ করেন। তিনি একজনের দাঁত আরেকজনের দাঁতে প্রতিস্থাপনের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তিনি অনুধাবন করেন যে প্রাথমিকভাবে দাতার দাঁত সতেজ হলে এবং গ্রাহকের দাঁতের গঠনের সাথে মিলে গেলে এরকম করা সম্ভব। অভ্যন্তরীন অঙ্গ প্রতিস্থাপনে এখনও এই নীতি ব্যভার ক্রয়া হয়। হান্টার বেশ কিছু অস্ত্রপচার পরিচালনা করেন তার মধ্যে তিনি দাঁত প্রতিস্থাপনের চেষ্টাও করেন। যদিও দাতার দাঁত কখনও গ্রাহকের মাড়ির সাথে ঠিকমত সংযুক্ত হত না। হান্টারের এক রোগী জানান যে তার ছয় বছর ধরে তার তিনটি দাঁত কাজ করেছিল যা তখনকার সময়ে অনেক বড় প্রাপ্তি।

আরও অগ্রগতি হয় ১৯ শতাব্দীতে এসে এবং দন্ত্যচিকিৎসা একটি সফল পেশা হিসেবে চিহ্নিত হয়। ১৯ শতাব্দীর শেষের দিকে এই পেশাকে সরকারি নিয়মের আওতায় আনা হয়। যুক্তরাজ্যে ১৮৭৮ সালে ডেন্টিস্ট অ্যাক্ট পাশ হয় এবং ১৮৭৯ সালে ব্রিটিশ ডেন্টিস্ট এসোসিয়েশন গঠিত হয়। একই সালে ফ্রান্সিস ব্রোডি ইমল্যাক রয়্যাল কলেজ অফ সার্জনের সভাপতি নির্বাচিত হন যিনি দন্ত্যচিকিৎসক ছিলেন। তার এই সম্মান প্রথমবার দন্ত্যচিকিৎসাকে অন্যান্য যেকোন শল্যচিকিৎসার সমান মর্যাদা দান করে।

অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত রোগীগণ

জন্মগত অস্বাভাবিকতা যেমন চিড় তালু ও হাইপোডনসিয়ার রোগীরা, মুখে আঘাতপ্রাপ্ত বা মাথা ও ঘাড়ের কর্কটরোগে আক্রান্তরা অগ্রাধিকারের দাবিদার। দলগতভাবে দন্ত্য হাসপাতালে এসব রোগের চিকিৎসা ক্রয়া হয়। অন্যান্যরা হলেন তৃতীয় পেষক দাঁতের সমস্যা, চিরস্থায়ি দাঁতের বিছিন্ন হওয়া আবার ধূমপায়ী মুখগহ্বরের আলসারের রোগীরা। দন্তচিকিৎসার মূল বিভাগসমূহ

১. কনজারভেটিভ ডেন্টিস্ট্রি এন্ড এন্ডোডন্টিক্স

২. প্রোস্থোডন্টিক্স

৩. ওরাল এন্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারী

৪. পেডোডন্টিক্স

৫. অর্থোডন্টিক্স

৬. পেরিওডন্টোলজি এন্ড ওরাল মেডিসিন

আরও দেখুন

টীকা

তথ্যসূত্র

This article uses material from the Wikipedia বাংলা article দন্তবিজ্ঞান, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.

Tags:

দন্তবিজ্ঞান দন্ত্য চিকিৎসাদন্তবিজ্ঞান শিক্ষা ও অনুজ্ঞাপত্রদন্তবিজ্ঞান বিশিষ্টতাদন্তবিজ্ঞান ইতিহাসদন্তবিজ্ঞান আধুনিক দন্ত্যচিকিৎসাদন্তবিজ্ঞান আরও দেখুনদন্তবিজ্ঞান টীকাদন্তবিজ্ঞান তথ্যসূত্রদন্তবিজ্ঞান বহিঃসংযোগদন্তবিজ্ঞান

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

পিনাকী ভট্টাচার্যমহাভারতগোপাল ভাঁড়আরবি ভাষাসূরা নাসইতালিপর্যায় সারণিচৈতন্য মহাপ্রভুরচিন রবীন্দ্রবাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধনীসমূহনামাজের নিয়মাবলীদোলযাত্রাথ্যালাসেমিয়াপানিপথের প্রথম যুদ্ধউত্তম কুমারসূরা কাফিরুনবদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবাদের তালিকাকপালকুণ্ডলাযৌনাসনমঙ্গল গ্রহপ্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরসাইবার অপরাধচট্টগ্রাম বিভাগস্বামী স্মরণানন্দবাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলবীর শ্রেষ্ঠমমতা বন্দ্যোপাধ্যায়তথ্যঅ্যান্টিবায়োটিকবাংলা সংখ্যা পদ্ধতিলিঙ্গ উত্থান ত্রুটিকৃষ্ণজহির রায়হানবাংলাদেশ আওয়ামী লীগআবুল কাশেম ফজলুল হকপর্তুগাল জাতীয় ফুটবল দলকোণইসলামের পঞ্চস্তম্ভপল্লী সঞ্চয় ব্যাংকঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনহজ্জডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রপিঁয়াজশাহ জাহানআওরঙ্গজেবপুনরুত্থান পার্বণতৃণমূল কংগ্রেসগুগলজাপানস্পিন (পদার্থবিজ্ঞান)রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন (১৮৬১–১৯০১)খালেদা জিয়াদারুল উলুম দেওবন্দপশ্চিমবঙ্গে ভারতের সাধারণ নির্বাচন, ২০২৪স্পেন জাতীয় ফুটবল দলভাষা আন্দোলন দিবস২০২৩–২৪ ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগলোহিত রক্তকণিকামুহাম্মাদলুয়ান্ডাকার্বন ডাই অক্সাইডইহুদি ধর্মকোস্টা রিকাকাবালগইনমৌলিক পদার্থের তালিকাপ্যারাডক্সিক্যাল সাজিদধর্মীয় জনসংখ্যার তালিকাটাঙ্গাইল জেলাযোগাযোগবাংলা ব্যঞ্জনবর্ণ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপপৃথিবীফিফা বিশ্বকাপ ফাইনালের তালিকাকার্তিক (দেবতা)সংযুক্ত আরব আমিরাতকারাগারের রোজনামচাভিসা🡆 More