ড্রাম বা পটহ একপ্রকার বাদ্যযন্ত্র। হর্নবসেল-স্যাকস শ্রেনীকরন পদ্ধতি অনুসারে এটি একপ্রকার মেমব্রানোফোন। ড্রামের গঠন পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, এতে অন্তত একটি আবরন রয়েছে, যা ড্রামহেড বা ড্রামস্কিন নামে পরিচিত। এটি একটি খোলসের চারিধারে বিস্তৃত এবং বাদকের হাতের সাহায্যে অথবা ড্রামস্টিকের সাহায্যে এতে আঘাত করা হয়। এর ফলে শব্দ উৎপন্ন হয়। সাধারনত ড্রামের নিচের প্রান্তে একটি রেসোনেন্স হেড থাকে যা ড্রামহেডের তুলনায় কম পিচে টিউন করা থাকে। ড্রাম ব্যবহার করে শব্দ উৎপন্ন করতে আরও বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে, যেমন থাম রোল। ড্রাম বিশ্বের প্রাচীনতম এবং সর্বাধিক বিস্তৃত বাদ্যযন্ত্র, এবং এর গঠন হাজার বছর ধরে অপরিবর্তিত আছে।
ড্রাম এককভাবে বাজানো যেতে পারে, "জেম্বের" মত কিছু ড্রাম সবসময়ই এভাবে বাজানো হয়। অন্যক্ষেত্রে সাধারনত একজন বাদকের দ্বারা দুই বা ততোধিক একত্রে বাজানো হয়, যেমন বোঙ্গো ড্রাম এবং টিমপানি। কিছুসংখ্যক ড্রাম একসাথে মৌলিক আধুনিক ড্রাম কিট গঠন করে।
ড্রাম সাধারনত হাত বা এক/একাধিক কাঠির সাহায্যে বাড়ি দিয়ে বাজানো হয়। অনেক ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে ড্রামের একপ্রকার প্রতীকি ব্যবহার রয়েছে এবং বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। সংগীত নিরামইয়ে ড্রাম ব্যবহার করা হয়, কারণ এগুলা সহজেই বাজানো যায়।
প্রচলিত সংগীত এবং "জ্যাজ" এ, ড্রাম দ্বারা সাধারনত ড্রাম কিট অথবা একসেট ড্রাম বোঝানো হয়। এবং ড্রামার দ্বারা ড্রামবাদক কে নির্দেশ করে।
ড্রাম কিছু স্থানে পবিত্র ধর্মীয় মর্যাদা লাভ করেছে। বুরুন্ডিতে "কারয়েন্ডা" ড্রাম রাজার শক্তির প্রতীক।
খোলকের বাইরে সবক্ষেত্রেই একটি খোলা অংশ থাকে যার উপরে ড্রামহেড টানা হয়, কিন্তু খোলকের আকার বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। পশ্চিমা সংগীত জগতে ড্রামের আকার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিলিন্ডার আকৃতি। তবে টিম্পানিতে গোল আকারের খোলক ব্যবহার হয়। অন্যান্য আকারের মধ্যে রয়েছে কাঠামো আকৃতি (যেমন টার বা বোধরান), লম্বা কোন (যেমন বোঙ্গো ড্রাম, আশিকো), ডিম্বাকৃতি (যেমন জেম্বে) এবং আচ্ছাদন যুক্ত (টকিং ড্রাম).
সিলিন্ডার আকৃতির ড্রাম সাধারনত একদিকে খোলা হয় (যেমনটি টিমবেল ড্রামের ক্ষেত্রে ঘটে), অথবা ড্রামের দুটি ডড়ামহেডও থাকতে পারে। এক ড্রামহেডযুক্ত ড্রামে খোলা প্রান্তে একটি চামড়া টানটান অবস্থায় থাকে। দুই ড্রামহেডযুক্ত ড্রামে দুইটি ড্রামহেডের মাঝে মধ্যবর্তী স্থানে একটি ছিদ্র থাকে। এর ফলে একটি অনুনাদ প্রকোষ্ঠ তৈরি হয়। ব্যাতিক্রম হিসেবে আফ্রিকান স্লিট ড্রামের কথা উল্লেখ করা যায়, যা গুড়ি ড্রাম নামেও পরিচিত। এটি কাঠের গুড়ি দিয়ে বানানো হয়। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে স্টিলের তৈরি ড্রাম প্রচলিত। দুই ড্রামহেডযুক্ত ড্রামে একগুচ্ছ তার দ্বারা উপরের ড্রামহেড, নিচের ড্রামহেড, অথবা দুইটি ড্রামহেডকেই একসাথে যুক্ত করা হয়। এই তারগুলা স্নেয়ার নামে পরিচিত।
আধুনিক ব্যান্ড ও অর্কেস্ট্রাইয় ব্যবহৃত ড্রামে ড্রামহেড ড্রামের খোলা অংশের উপরে স্থাপন করা হয় যা একটি "কাউন্টারহুপ" (অথবা "রিম") দ্বারা ড্রামের সাথে যুক্ত থাকে। এর সাথে কয়েকটি টিউনিং স্ক্রু বা "টেনশন দন্ড" যুক্ত থাকে। টেনশন দন্ড নিয়ন্ত্রণ করে ড্রামহেডের টানটান ভাব হ্রাস-বৃদ্ধি করা যায়। বেশিরভাগ ড্রামে ছয় হতে দশটি টেনশন দন্ড থাকে। ড্রামের সৃষ্ট শব্দ অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করে— ড্রামের আকার, খোলকের আকৃতি ও পুরূত্ব, খোলকে ব্যবহৃত উপাদান, কাউন্টারহুপে ব্যবহৃত উপাদান, ড্রামহেডে ব্যবহৃত উপাদান, ড্রামহেডের টানটান অবস্থা, ড্রামের অবস্থান ইত্যাদি।
টেনশন দন্ডের আবিষ্কারের পুর্বে, ড্রামের চামড়া দড়ির সাহায্যে আটকানো ও নিয়ন্ত্রণ করা হতো। জেম্বের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হতো। ইউই ড্রামে দড়ি ও পেগের সাহায্যে ড্রামহেড সংযুক্ত করা হয়। এই পদ্ধতিগুলা আধুনিক যুগে কদাচিৎ ব্যবহৃত হয়, তবে সামরিক বাহিনীর রেজিমেন্টাল মার্চে দেখা যায়। এই দড়িগুলা আরও ধক্ত করে টকিং ড্রামের ড্রামহেড আরও টানটান করা যায়। একই পদ্ধতিতে তবলার চাকতিতে আঘাত করে সুর মেলানো হয়। অর্কেস্ট্রার টিমপানি ড্রাম এর সাথে সংযুক্ত ফুট প্যাডেল দ্বারা দ্রুত সঠিক স্বরে টিউন করা যায়।
ড্রাম হতে সৃষ্ট শব্দ বেশকিছু বিষয়ের উপর নির্ভরশীল, যেমন ড্রামের আকার, খোলকের আকৃতি ও পুরূত্ব, খোলকে ব্যবহৃত উপাদান, কাউন্টারহুপে ব্যবহৃত উপাদান, ড্রামহেডে ব্যবহৃত উপাদান, ড্রামহেডের টানটান অবস্থা, ড্রামের অবস্থান ইত্যাদি। বিভিন্নপ্রকার ড্রামের শব্দের ব্যবহার সংগীতে রয়েছে। উদাহরণস্বরুপ আধুনিক টম-টম ড্রামের কথা উল্লেখ করা যায়। একজন জ্যাজ ড্রামার উচ্চ পিচযুক্ত, অনুনাদী ও স্বল্পশব্দের ড্রাম ব্যবহার করতে পছন্দ করে, অন্যদিকে একজন রক ড্রামার নিম্নপিচযুক্ত, শুষ্ক ও জোরালো শব্দযুক্ত ড্রাম পছন্দ করে। যেহেতু পৃথক পৃথক সংগীত শিল্পী পৃথকরকম ড্রামের শব্দ পছন্দ করে, সেহেতু তাদের ব্যবহৃত ড্রামও পৃথকরুপে নির্মিত।
ড্রামের শব্দ কেমন হবে তা সবথেকে বেশি নির্ভর করে ড্রামহেডের উপর। বিভিন্নপ্রকার ড্রামহেডের নিজস্ব ব্যবহার আছে ও আলাদারকম শব্দ সৃষ্টি করে। দ্বি-স্তরী ড্রামহেড উচ্চ স্বরের শব্দ শব্দকে শোষন করে এজন্য তারা অপেক্ষাকৃত ভারী ও উচ্চস্বরে বাজনার জন্য উপযুক্ত। সাদা বর্নের ড্রামহেড ড্রামের বাড়তি শব্দ শুষে নেয় ও ও পিচ বিভক্তি রোধ করে। ড্রামহেডে রুপার বা কালো বিন্দুর উপস্থিতি পিচ বিভক্তি আরও প্রতিরোধ করে। ড্রামহেডের প্রান্তে শব্দ-বলয় বিভক্তি রোধ করে। জ্যাজ ড্রামাররা মোটা ড্রামহেড ব্যবহার পরিহার করেন এবং পাতলা ড্রামহেডে ব্যবহার করেন। অপরদিকে রক ড্রামাররা মোটা ও স্তরযুক্ত ড্রামহেড পছন্দ করেন।
দ্বিতীয় সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা ড্রামের শব্দকে প্রভাবিত করে তা হলো খোলকের সাথে ড্রামহেডের সংযুক্তি। হুপটি ড্রামহেড ও খোলকের চারিদিকে স্থাপন করা হয়। টেনশন দন্ডের সাহায্যে ড্রামহেডের টেনশন নিয়ন্ত্রণ করা যায়। টানটান ড্রামহেডের ক্ষেত্রে ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধি পায়, যার ফলে পিচ বৃদ্ধি পায় ও শব্দ কম জোরালো হয়।
খোকলের প্রকারভেদও ড্রামের শব্দে প্রভাব ফেলে। এর কারণ ড্রামের খোলকের ভেতর প্রতিশব্দ সৃষ্টি করে। সুতরাং ড্রামের খোলকের দ্বারা শব্দ জোরালো বা ক্ষীন করা যায়। উৎপন্ন শব্দের প্রকৃতিও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। খোলকের ব্যাস বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে শব্দের পিচ কমতে থাকে। এবং খোলকের গভীরতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শব্দ আরও জোরালো হয়। খোলকের পুরূত্বও শব্দের জোরালো হওয়ার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করে। অধিক পুরূ ড্রামের খোলকে জোরালো শব্দ সৃষ্টি হয়। মেহগনি কাঠের খোলক স্বল্প পিচের ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধি করে ও উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সিকে অপরিবর্তিত রাখে। খোলক নির্বাচন করার ক্ষেত্রে, জ্যাজ ড্রামাররা কম পুরূ মেপল কাঠের খোলক ও রক ড্রামাররা ওধিক পুরূ বার্চ কাঠের খোলককে অগ্রাধিকার দেন।
ড্রামের উৎপত্তি প্রাচীন মিসরে খ্রীষ্টপুর্ব ৪০০০ অব্দে। কুমিরের চামড়ার তৈরি ড্রাম খ্রীষ্টপুর্ব ৫৫০০–২৩৫০ অব্দের প্রাচীন চৈনিক সভ্যতার নিদর্শন। সাহিত্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিভিন্ন ধর্মীয় আচারে ড্রামের ব্যবহার প্রচলিত ছিলো।
ব্রোঞ্জের তৈরি ডং সন ড্রাম ভিয়েতনামের উত্তরের ব্রোঞ্জযুগের ডং সান সভ্যতার নিদর্শন। এর মধ্যে রয়েছে আলংকৃত গক লু ড্রাম।
ম্যাকাকুই বানর বিভিন্ন বস্তুকে ড্রামরুপে ব্যবহার করে এবং এসমইয় তাদের মগজে চিন্তার প্রকৃতির সাথে ভাষা ব্যবহারের প্রকৃতির সাদৃশ্য রয়েছে। এ থেকে ধারণা করা হয় এ বানরেরা ড্রামকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। এছাড়াও বিভিন্ন বানর বুকের ছাতিতে আঘাত করে অথবা হাততালি দিয়ে ড্রামের ন্যায় শব্দ উৎপন্ন করে, এবং ক্যাঙ্গারু ইদুর তাদের থাবা দিয়ে মাটিতে আঘাত করে একইপ্রকার শব্দ উৎপন্ন করে।
ড্রামের ব্যবহার শুধু বাদ্যযন্ত্র হিসেবেই নয়, দুরবর্তী স্থানে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেও এর ব্যবহার রয়েছে। আফ্রিকের কথাবলা ড্রামগুলো বিভিন্ন ভাষার স্বরের অনুকরনে ব্যবহৃত হয়। শ্রীলংকার প্রাচীন ইতিহাসে ২৫০০ বছর পূর্ব হতেই ড্রামের ব্যবহার বহুল প্রচলিত ছিলো। সমাজের বিভিন্ন স্তরে যোগাযোগের জন্য ড্রাম ব্যবহার হতো।
ড্রামের সাহায্যে উদ্দেশ্যমুলকভাবে বিনোদন, আত্মিক বিকাশ ও যোগাযোগ সম্পন্ন হয়। বিভিন্ন সমাজে ড্রামের আত্মিক বা ধর্মীয় ব্যবহার আছে, এবং ড্রামের তালকে অনেক সময় কোনপ্রকার ভাষা বা প্রার্থনার সাথে তুলনা করা হয়। হাজার হাজার বছর ধরে ড্রামের বাজনা শিল্পের পর্যায়ে উন্নিত হয়েছে। সাধারনভাবে ধারণা করা হয় যে ড্রাম বাজনা হতেই অন্যসকল সংগীতের উৎপত্তি। সংগীতের ভাবধারাকে এটি বৃহৎ গোষ্ঠির কাছে পৌছে দেয়।
চৈনিক সৈন্যরা সৈন্যদের মানসিক শক্তি যোগাতে, কুচকাওয়াজ নিয়ন্ত্রণে ও নির্দেশনা প্রদানে "টাইগু" ড্রাম ব্যবহার করতো। উদাহরণস্বরূপ, চি এবং লু এর মধ্যে খ্রীষ্টপুর্ব ৬৮৪ অব্দে সংঘটিত যুদ্ধে ড্রামের প্রভাবে সৈনিকের মনোবল বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ উদাহরণ আছে। সুইস ভাড়াটে সেনাবাহিনীর ফিফ এবং ড্রাম কোর একপ্রকার স্নেয়ার ড্রাম ব্যবহার করতো। এগুলো ফিতার সাহায্যে বাদকের কাধে যুক্ত থাকতো। এই বাদ্যযন্ত্রের জন্যই ইংরেজি শব্দ "ড্রাম" এর আবির্ভাব হয়। একইভাবে, ইংরেজ গৃহযুদ্ধের সময় ছোট অফিসাররা নির্দেশনা পরিবহনের জন্য রোপ-টেনশন ড্রামের সাজায্য নিতো। ড্রামের সাহায্যে যুদ্ধের দামামার মাঝেও যোগাযোগ রক্ষা করা যেতো। এইসব ড্রাম সাধারনত ড্রামারের কাধের সাথে ঝোলানো থাকতো এবং দুইটি ড্রামস্টিক দিয়ে বাজানো হতো। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন রেজিমেন্ট ও কোম্পানির পৃথক ড্রামের তাল ছিলো যা শুধু তারাই শুনে বুঝতে পারতো। মধ্য ১৯শ শতক হতে স্কটিশ মিলিটারি তাদের উচ্চভুমির রেজিমেন্টে পাইপ ব্যান্ডের ব্যবহার শুরু করে।
কলম্বিয়ান পুর্ববর্তী সময়ে অ্যাজটেক জাতির লোকেরা ড্রামের সাহায্যে যোদ্ধাদের সংকেত দিতো। নাহুয়াত ভাষায় ড্রামকে "হুয়েহুয়েত" নামে ডাকা হয়।
ঋকবেদে একাধিক জায়গায় "দুনধুবি" বা যুদ্ধের ড্রামের কথা উল্লেখ আছে। আর্য গোষ্ঠিরা ড্রামের শব্দ এবং ঋকবেদের ষষ্ঠ পাঠ ও অর্থব বেদ অনুসারে "ড্রামের সাথে হুঙ্কার" নামক হুঙ্কার দিতে দিতে যুদ্ধে অগ্রসর হতো।
|
|
|
|
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article ড্রাম, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.