গদ্য হলো মানুষের কথ্য ভাষার লেখ্যরূপ। এর বিপরীত হলো পদ্য বা কাব্য। গদ্যের প্রাথমিক ব্যবহার চিঠিপত্র লেখায়, দলিল-দস্তাবেজ প্রণয়নে এবং ধর্মীয় গ্রন্থাদি রচনায়। বাংলা পদ্যের ইতিহাস শুরু হয়েছে চর্যাপদ থেকে; কিন্তু গদ্যের ইতিহাস ততটা প্রাচীন নয়। গদ্যের চারিত্র্য নির্ভর করে শব্দের ব্যবহার এবং বাক্যে পদ (শব্দ) স্থাপনার ক্রমের ওপর। আধুনিক যুগে গদ্যের প্রধান দুটি ব্যবহার হলো কথাসাহিত্য এবং প্রবন্ধ। আঠারো শতকে বাঙ্গালা গদ্যের বিকাশ সূচীত হয়েছিল একটি সরল কাঠামো নিয়ে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বাল্মীকির জয়-এর আলোচনা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শুরু করেছিলেন এই ভাবে :
বঙ্গদর্শনে যে সকল প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, পুনর্মুদ্রিত হইলে তাহা বঙ্গদর্শনে সমালোচিত হইয়া থাকে না। ‘বাল্মীকির জয়’ কিয়দংশে বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হইয়াছিল কিন্তু গ্রন্থের অধিকাংশই বঙ্গদর্শনে বাহির হয় নাই। উহার যে অংশ প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহাও বিশেষরূপে পরিবর্তিত হইয়া পুনর্মুদ্রিত হইয়াছে। এ অবস্থায় আমরা সমালোচ্য গ্রন্থ বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হইয়াছিল বলিয়া স্বীকার করিতে পারি না। অতএব পাঠক যদি অনুমতি করেন, তবে ইহার সমালোচনায় প্রবৃত্ত হই। সম্পাদকের অনুমতি পাইয়াছি।’
লক্ষ্যণীয় যে, এখানে বাক্যের দৈর্ঘ্য সীমিত। সীমিত দৈর্ঘের বাক্য ধারণ করেছে এক-একটি সাধারণ বক্তব্য। বাক্যপ্রকরণের এই অবক্র চারিত্র্য আধুনিক বাংলা গদ্যের প্রাণপুরুষ প্রমথ চৌধুরীর রচনাতেও অব্যাহত থেকেছে।
চিঠিপত্র লেখা এবং দলিল-দস্তাবেজ লেখার প্রয়োজনে বাংলা গদ্যের সূত্রপাত। দলিল-দস্তাবেজ ইত্যাদি সংস্কৃতি ও পার্সি - এই দুই ভাষার প্রভাবে পরিকীর্ণ। আদি সাহিত্যিক গদ্যে কথ্যভাষার প্রতিফলন সুস্পষ্ট। পর্তুগীজ ধর্মপ্রচারক মানোএল দা আস্সুম্পসাঁউ-এর রচনা রীতি বাংলা গদ্যের অন্যতম আদি নিদর্শন। ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত কৃপার শাস্ত্রের অর্থ ভেদ গ্রন্থ থেকে নিম্নরূপ উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। লক্ষ্যণীয় এই অংশে বৃহত্তর ঢাকা এলাকার কথ্য ভাষা প্রতিফলিতঃ–
ফ্লান্দিয়া দেশে এক সিপাই বড় তেজোবন্ত আছিল। লড়াই করিতে করিতে বড় নাম তাহার হইল, এবং রাজায় তাহারে অনেক ধন দিলেন। ধন পাইয়া তাহার পিতামাতার ঘরে গেল। তাহার দেশে রাত্রে পৌঁছিল। তাহার এক বইন আছিল ; তাহার পন্থে লাগাল পাইল ; ভাইয়ে বইনরে চিনিল, তাহারে বইনে না চিনিল। তখন সে বইনেরে কহিল, "তুমি কী আমারে চিন?" "না, ঠাকুর" বইনে কহিল। সে কহিল,"আমি তোমার ভাই।" ভাইয়ের নাম শুনিয়া উনি বড় প্রীত হইল। ভাইয়ে ঘরের খবর লইল, জিজ্ঞাস করিল, "আমারদিগের পিতামাতা কেমন আছেন?" বইনে কহিল, "কুশল।" দুইজনে কথাবার্তা কহিল।
প্যারীচাঁদ মিত্র রচিত আলালের ঘরে দুলাল বাঙালা ভাষায় রচিত আদি গদ্যসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এটি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এই গ্রন্থের ভাষা 'আলাল ভাষা' নামে পরিচিত। এই গ্রন্থে কথ্যরূপী গদ্য একটি পৃথক লেখ্য রূপে উন্নীত হয়।
রবিবারে কুঠিওয়ালারা বড়ো ঢিলে দেন-হচ্ছে হবে-খাচ্ছি খাব-বলিয়া অনেক বেলায় স্নান- আহার করেন- তাহার পরে কেহ বা বড়ে টেপেন- কেহ বা তাস পেটেন-কেহ বা মাছ ধরেন- কেহ বা তবলায় চাঁটিদেন-কেহ বা সেতার লইয়া পিড়িং পিড়িং করেন- কেহ বা শয়নে পদ্মনাভ ভালো বুঝেন- কেহ বা বেড়াতে যান- কেহ বা বহি পড়েন। কিন্তু পড়াশুনা অথবা সৎ কথায় আলোচনা অতি অল্প হইয়া থাকে। হয়তো মিথ্যা গালগল্প কিংবা দলাদলির ঘোঁট, কি শম্ভু তিনটা কাঁঠাল খাইয়াছে এই প্রকার কথাতেই কাল ক্ষেপণ হয়। বালীর বেণীবাবুর অন্য প্রকার বিবেচনা ছিল। এদেশের লোকদিগের সংস্কার এই যে স্কুলে পড়া শেষ হইলে লেখাপড়া শেষ হইল। কিন্তু এ বড়ো ভ্রম, আজন্ম মরণ পর্যন্ত সাধনা করিলেও বিদ্যার কূল পাওয়া যায় না, বিদ্যা চর্চা যত হয় ততই জ্ঞান বৃদ্ধি হইতে পারে। বেণীবাবু এ বিষয় ভালো বুঝিতেন এবং তদনুসারে চলিতেন। তিনি প্রাতঃকালে উঠিয়া আপনার গৃহকর্ম সকল দেখিয়া পুস্তক লইয়া বিদ্যানুশীলন করিতেছিলেন। ইতিমধ্যে চোদ্দ বৎসরের একটি বালক-গলায় মাদুলি-কানে মাকড়ি, হাতে বালা ও বাজু, সম্মুখে আসিয়া ঢিপ করিয়া একটি গড় করিল। বেণীবাবু এক মনে পুস্তক দেখিতেছিলেন বালকের জুতার শব্দে চম্কিয়া উঠিয়া দেখিয়া বলিলেন, ‘এসো বাবা মতিলাল এসো- বাটির সব ভালো তো ?’ মতিলাল বসিয়া সকল কুশল সমাচার বলিল। বেণীবাবু কহিলেন- অদ্য রাত্রে এখানে থাকো কল্য প্রাতে তোমাকে কলিকাতায় লইয়া স্কুলে ভর্তি করিয়া দিব। ক্ষণেক কাল পরে মতিলাল জলযোগ করিয়া দেখিল অনেক বেলা আছে। চঞ্চল স্বভাব- এক স্থানে কিছু কাল বসিতে দারুণ ক্লেশ বোধ হয়- এজন্য আস্তে আস্তে উঠিয়া বাটীর চতুর্দিকে দাঁদুড়ে বেড়াইতে লাগিল- কখন ঢেঁস্কেলের ঢেঁকিতে পা দিতেছে- কখন বা ছাতের উপর গিয়া দুপদুপ করিতেছে-কখন বা পথিকদিগকে ইঁট-পাটকেল মারিয়া পিট্টান দিতেছে ; এইরূপে দুপ-দাপ করিয়া বালী প্রদক্ষিণ করিতে লাগিল-কাহারো বাগানে ফুল ছেঁড়ে-কাহারো গাছের ফল পাড়ে-কাহারো মট্কার উপর উঠিয়া লাফায়- কাহারো জলের কলসি ভাঙিয়া দেয়।
বাংলা গদ্য শুরুতে ছিল সংস্কৃতি গদ্যের চালে রচিত যার প্রমাণ বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ। প্রমথ চৌধুরী বাংলা গদ্যকে একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘরোয়া’র আলোচনা থেকে প্রমথ চৌধুরীর গদ্যরীতির সুস্পষ্ট পরিচয়ে মেলে। তিনি লিখেছেন :
‘শ্রীযুক্ত অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরোয়া’ পড়লুম। চমৎকার বই। ঘরোয়া মানে ঠাকুর পরিবারের ঘরের কথা। . . . অবনীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র, এবং স্বগুণে স্বনামধন্য, সুতরাং তাঁর কোনও পরিচয় দেওয়া অনাবশ্যক। তিনি চিত্রবিদ্যায় একজন আর্টিস্ট বলে দেশে বিদেশে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জ্জন করেছেন। কিন্তু এ পুস্তকে তিনি নিজের কৃতিত্ব বিষয়ে কোনও কথা উল্লেখ করেন নি। তিনি ঠাকুর পরিবারের ঘরোয়া কথা বলেছেন। পূর্ব্বে বলেছি এ-পুস্তক ঠাকুর পরিবারের ইতিহাস নয়, তাই বলে উপন্যাসও নয়।’
এ গদ্যকাঠমোর চারিত্র্য ঋজু এবং প্রাঞ্জল। অনেকটাই মুখের ভাষার কাছাকাছি যদিও তাতে প্রকাশক্ষমতা হ্রাস পায় নি।
পরিচয়-এর কার্তিক ১৩৩৮ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জগদীশ গুপ্তের লঘু-গুরু গ্রন্থটি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। আলোচনার বিস্তারে রবীন্দ্রনাথ কেবল লঘু-গুরুর মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকেন নি, সাহিত্যেও মান-মর্যাদা নিয়েও দু’চারটি কথা বলেছেন :
‘সাহিত্যে সম্মানের অধিকার বহির্নির্দিষ্ট শ্রেণী নিয়ে নয়, অন্তর্নিহিত চরিত্র নিয়ে। অর্থাৎ, পৈতে নিয়ে নয়, গুণ নিয়ে। আধুনিক একদল লেখক পণ করেছেন তাঁরা পুরাতনের অনুবৃত্তি করবেন না। কোনোকালেই অনুবৃত্তি করাটা ভালো নয়, এ কথা মানতেই হবে। নরসংহিতাসম্মত ফোঁটা-তিলকটা, আধুনিকতাও গতানুগতিক হয়ে ওঠে। সেটার অনুবৃত্তিও দুর্বলতা। চন্দনের তিলক যখন চলতি ছিল, তখন অধিকাংশ লেখা চন্দনের তিলকধারী হ’য়ে সাহিত্যে মান পেতে চাইত। পঙ্কের তিলকই যদি সাহিত্যসমাজে চলতি হয়ে ওঠে, তা হলে পঙ্কের বাজারও দেখতে দেখতে চড়ে যায়।’
লক্ষ্যণীয় যে, যে রবীন্দ্র-গদ্য মননশীলতায় ঋদ্ধ ; তথাপি তাঁর ভাষার গাঁথুনিতে তেমন কোন জটিলতা পরিদৃষ্ট হয় না। রবীন্দ্রনাথ স্বীয় চিন্তা-চেতনাকে বোধগম্য ক’রে প্রকাশ করার সুললিত একটি ভঙ্গী বেছে নিয়েছিলেন।
পত্র-পত্রিকার পাতা ঘেঁটে দেখা যায় সমসাময়িককালে কবি-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার তাঁর গদ্যে জটিল বাক্যরীতিকে অবলম্বন করেছিলেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসটির আলোচনায় এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ মেলে। এর স্ব-পক্ষে দীর্ঘ উদ্ধৃতির বিকল্প নেই। এ আলোচনায় মোহিতলাল লিখেছেন :
‘এই যে তারাশঙ্কর, ইনিই যখন জীবনের শিল্পরূপ নির্মাণ করেন, যেমন তাঁহার গল্পগুলিতে করিয়াছেন, তখন যে তাহাতে একটা সম্পূর্ণ নূতন ধরনের রসসৃষ্টি হইবে, ইহাই তো স্বাভাবিক। সে রস বাস্তবের রসই বটে, কিন্তু তাহার অন্তরালে একটা নির্মম অনাসক্ত তান্ত্রিক-দৃষ্টি আছে; সেই দৃষ্টি যখন নর-নারীর হৃদয়মধ্যেও উঁকি দিয়াছে তখন তাহা খাঁটি আর্টিস্টের নির্মমতায় পরিণত হইয়া, সর্বসংস্কারমুক্তির যে-আনন্দ সেই আনন্দের রস-সৃষ্টি করিয়াছে। ইহাই তারাশঙ্করের আর্ট, আমি তাহাকে একরূপ তান্ত্রিক রস-প্রেরণা বলিয়াছি; ইহার স্থূল দৃষ্টান্ত হিসাবে, তাঁহার গল্পে নর-নারীর প্রেম ও প্রেম-বিকারগুলি স্মরণ করিয়া বলি সেই প্রেমে নীতি-দুর্নীতির সংস্কার নাই, আছে কেবল প্রত্যেক চরিত্রে সেই প্রবৃত্তির রক্তগত সংস্কার।’
লক্ষ্য করা যেতে পারে যে, মোহিতলাল মজুমদার একটি বাক্যের ভেতরে একাধিক অনুবাক্যকে ধারণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। ফলে বাক্য কেবল দীর্ঘায়িত হয়নি, তার গঠনে জটিলতা অনুপ্রবেশ করেছে। তিনি বিশেষ ক’রে মূল বাক্যের জরায়ুতে যতি-চিহ্ন-চিহ্নিত নতুন বাক্য জুড়ে দিয়ে বক্তব্যকে সংহত রূপ দেয়ার প্রয়াস পেয়েছেন। ঊনবিংশ শতকের শেষপাদে বা বিংশ শতকের প্রথমাংশে কা’র হাতে বাংলা গদ্য সাহিত্যে প্রথম এরূপ বাক্যকাঠামো প্রবর্তিত হয়েছিল তা নিরূপণ করার অপেক্ষা রাখে। তবে নিঃসংকোচে বলা চলে যে, এর ফলে বাংলা গদ্যের আঙ্গিক ও স্বাদ বহুলাংশে বদলে গিয়েছিল। অন্যদিকে গদ্য লাভ করেছিল বক্তব্য প্রকাশের গভীরতর শক্তি ও বিস্তৃত অবকাশ। জীবনানন্দের গদ্য এই ঘরানারই উচ্চতর বিকাশ। তাঁর গদ্যভাষাতেও লক্ষ্য করা যায় অনুরূপ দীর্ঘ বাক্যে বহুতর বক্তব্য ধারণের প্রয়াস। অত্যূক্তি হবে না যে এভাবেই বাংলায় প্রবন্ধের যথোপযুক্ত একটি গদ্যভাষার প্রবর্তনা হয়েছিল। কিন্তু জীবনানন্দের রূপবন্ধ ও জটিলতা কেবল বাক্যপ্রকরণ রীতির মধ্যে সূত্রাবদ্ধ নয়, তাঁর শব্দব্যবহার রীতিও অনন্যসাধারণ। শব্দচয়নে তিনি অক্লেশে তৎসম শব্দের আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর ব্যবহৃত সমসাবদ্ধ পদগুলো গদ্যের প্রকাশক্ষমতাকে বিস্তৃত করেছে। তায়র কবিতার তথা থেকে একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারেঃ
. . . আমি বলতে চাই না যে কাব্যের সঙ্গে জীবনের কোনো সম্বন্ধ নেই; সম্বন্ধ রয়েছে, কিন্তু প্রসিদ্ধ প্রকটভাবে নেই। কবিতা ও জীবন একই জিনিসেরই দুই রকম উৎসারণ; জীবন বলতে আমরা সচরাচর যা বুঝি তার ভিতর বাস্তব নামে আমরা সাধারণত যা জানি তা রয়েছে, কিন্তু এই অসংলগ্ন অব্যবস্থিত জীবনের দিকে তাকিয়ে কবির কল্পনা-প্রতিভা কিংবা মানুষের ইমাজিনেশন সম্পূর্ণভাবে তৃপ্ত হয় না; কিন্তু কবিতা সৃষ্টি করে কবির বিবেক সান্ত্বনা পায়, তার কল্পনা-মনীষা শান্তি বোধ করে, পাঠকের ইমাজিনেশন তৃপ্তি পায়। কিন্তু সাধারণত বাস্তব বলতে আমরা যা বুঝি তার সম্পূর্ণ পুণর্গঠন তবুও কাব্যের ভিতর থাকে না; আমরা এক নতুন প্রদেশে প্রবেশ করেছি। পৃথিবীর সমস্ত জল ছেড়ে দিয়ে যদি এক নতুন জলের কল্পনা করা যায় কিংবা পৃথিবীর সমস্ত দীপ ছেড়ে দিয়ে এক নতুন প্রদীপের কল্পনা করা যায়, তাহলে পৃথিবীর এই দিন, রাত্রি, মানুষ ও তার আকাঙ্খা এবং সৃষ্টির সমস্ত ধুলো সমস্ত কঙ্কাল ও সমস্ত নক্ষত্রকে ছেড়ে দিয়ে এক নতুন ব্যবহারের কল্পনা করা যেতে পারে। যা কাব্য;- অথচ জীবনের সঙ্গে যার গোপনীয় সুড়ঙ্গলালিত সর্ম্পূর্র্ণ সম্বন্ধ; সম্বন্ধের ধুসরতা ও নূতনতা। সৃষ্টির ভিতর মাঝে মাঝে এমন শব্দ শোনা যায়, এমন বর্ণ দেখা যায়, এমন আঘ্রাণ পাওয়া যায়, এমন মানুষের বা এমন অমানবীয় সংঘাত লাভ করা যা কিংবা প্রভূত বেদনার সঙ্গে পরিচয় হয়, যে মনে হয় এই সমস্ত জিনিসই অনেকদিন থেকে প্রতিফলিত হয়ে কোথাও যেন ছিল; এবং ভঙ্গুর হয়ে নয়, সংহত হয়ে, আরো অনেকদিন পর্যন্ত, হয়তো মানুষের সভ্যতার শেষ জাফরান রৌদ্রলোক পর্যন্ত, কোথাও যেন রয়ে যাবে; এই সবের অপরূপ উদগীরণ ভিতর এসে হৃদয়ে অনুভূতির জন্ম হয়, নীহারিকা যেমন নক্ষত্রের আকার ধারণ করতে থাকে তেমনি বস্তু-সঙ্গতির প্রসব হতে থাকে যেন হৃদয়ের ভিতরে; এবং সেই প্রতিফলিত অনুচ্চারিত দেশ ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে ওঠে যেন, সুরের জন্ম হয়; এই বস্তু ও সুরের পরিণয় শুধু নয়, কোনো কোনো মানুষের কল্পনামনীষার ভিতর তাদের একাত্মতা ঘটে, কাব্য জন্ম লাভ করে।’
জীবনানন্দ দাশ একই বাক্যে ধারণ করেছেন বক্তব্যের নিহিতার্থ ও তার শর্ত; একই বাক্যে রয়েছে বক্তব্য ও তার বিশেষায়িত টীকা। একটি বাক্যের একদিকে রয়েছে মূল বক্তব্য অন্যদিকে রয়েছে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা। পূর্ণ বাক্য শেষে পূর্ণ যতি’র পরিবর্তে জীবনানন্দ দাশ অর্ধ-যতি ব্যবহার ক’রে যুক্ত করেছেন আরেকটি পূর্ণ বাক্য; ফলে বাক্যের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেয়েছে, অনুপ্রবেশ করেছে জটিলতা। সন্দেহ নেই এর ফলে ভাষার নির্মলতা হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু অন্য দিকে তাঁর গদ্যভঙ্গীতে প্রোথিত হয়েছে সুললিত দার্ঢ্য যা গভীর ও সূক্ষ্ম চিন্তাসূত্রকে ধারণ করতে সক্ষম। এই গদ্য রীতির সঙ্গে ইয়োরোপীয় প্রবন্ধ সাহিত্যের গদ্যরীতির সাযুজ্য পরিলক্ষিত হয়। তথাপি লক্ষ্যণীয় যে, জীবনানন্দে তাঁর গদ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বাক্যে-পদ-স্থাপনার রীতি অনুসরণ করেছেন। বস্তুতঃ তার মূল অবদান একই বাক্যের কাঠামোতে যুক্তিসম্মত বিবিধ বাক্য, অনুবাক্য ও বাক্যাংশের সমাবেশ। ফলে ভাষার লৌকিক রীতি পরিত্যাক্ত হয়েছে; প্রণীত হয়েছে এমন একটি বাক্যকাঠামো যাতে একই বাক্যে একটি জটিল অথচ পূর্ণাঙ্গ চিন্তাসূত্র স্থান লাভ করেছে। লৌকিক ভাষায় বক্তব্য প্রকাশের যে পরম্পরা আমরা লক্ষ্য করি, জীবনানন্দের গদ্যভাষা তার বিপরীতে প্রবাহিত হয়েছে। লৌকিক ভাষার স্বভাবী শিথিলতা দূরীভূত ক’রে জীবনানন্দ দাশ বাংলা গদ্যকে দিয়েছেন গভীর মননশীল বক্তব্য প্রকাশের অপরিমেয় শক্তি।
এই নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এটিকে সম্প্রসারিত করে উইকিপিডিয়াকে সাহায্য করতে পারেন। |
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article গদ্য, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.