মইনুদ্দিন চিশতী

সুলতান-উল-হিন্দ খাজা মইনুদ্দিন চিশতী ( উর্দু / ফার্সি : خواجہ معین الدین چشتی; আরবি: خواجة معين الدين الششتى ) ছিলেন একজন পারসিক সুন্নি মুসলিম প্রচারক, সৈয়দ, তপস্বী, ধর্মীয় পণ্ডিত, দার্শনিক, সুফি সাধক ও সিস্তানের রহস্যবাদী, যিনি তার শেষ জীবনে ১৩ শতকের প্রথম দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে বসতি স্থাপন করেন। সেখানে তিনি সুন্নি রহস্যবাদের বিখ্যাত চিশতিয়া তরিকা প্রচার করেন। ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১২৩৬ সালে পরলোকগমন করেন। তিনি গরিবে নেওয়াজ ( غریب نواز ) নামেও পরিচিত। মইনুদ্দিন চিশতীই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম চিশতী ধারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত করেন এবং তিনি ভারতে চিশতী ধারার মাধ্যমেই আধ্যাত্মিক সিলসিলাকে এমনভাবে পরিচিত করেন যে, তা গোটা ভারতে ছড়িয়ে যায় এবং পরবর্তীতে তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারী; যেমন: কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী, বাবা ফরিদ, নিজামুদ্দিন আউলিয়া প্রমুখ ভারতের ইতিহাসে এই সুফি ধারাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান।

খাজা মইনুদ্দিন চিশতী
معین الدین چشتی
মইনুদ্দিন চিশতী
ভারতের আজমীরে মইনুদ্দিন চিশতীর দরগাহ
অন্য নামআতায়ে রাসূল, খাজা গরিব নেওয়াজ, সুলতান উল হিন্দ, নুকতায়ে এশক ওয়া উলুম, আহলে সামা, বুরহানুল আশেকীন, সাহেবে নজরে কিমিয়া, শাম্মায়ে চিশতিয়া, সদরুল আউলিয়া, রওশন জমীর
ব্যক্তিগত তথ্য
জন্ম১৪ রজব ৫৩৬ হিজরি
১২ ফেব্রুয়ারি ১১৪২
মৃত্যু৬ রজব ৬৩৩ হিজরি
১৬ মার্চ ১২৩৬(1236-03-16) (বয়স ৯৩–৯৪)
সমাধিস্থলআজমির শরীফ দরগাহ
ধর্মইসলাম
উদ্ভবইসলামী স্বর্ণযুগ
আখ্যাসুন্নি
ব্যবহারশাস্ত্রহানাফি
ধর্মীয় মতবিশ্বাসমাতুরিদি
তরিকাচিশতি
অন্য নামআতায়ে রাসূল, খাজা গরিব নেওয়াজ, সুলতান উল হিন্দ, নুকতায়ে এশক ওয়া উলুম, আহলে সামা, বুরহানুল আশেকীন, সাহেবে নজরে কিমিয়া, শাম্মায়ে চিশতিয়া, সদরুল আউলিয়া, রওশন জমীর
মুসলিম নেতা
ভিত্তিকআজমের, উত্তর ভারত
কাজের মেয়াদদ্বাদশ শতাব্দীর শেষদিক ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমদিক
পূর্বসূরীউসমান হারুনী
উত্তরসূরীকুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী সোহরাব হোসেন খান চিশতী (অনন্ত মৈত্রী)
পদসুফিবাদ

প্রারম্ভিক জীবন ও নেপথ্য

ধারণা করা হয়, খাজা মইনুদ্দিন চিশতী ৫৩৭ হিজরী/১১৪২ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব পারস্যের সিস্তান রাজ্যের সানজারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পারস্যে বেড়ে উঠেন। পনেরো বছর বয়সে তার পিতা-মাতা মৃত্যুবরণ করেন। তার পিতার নাম গিয়াসউদ্দিন এবং মাতার নাম বিবি উম্মালওয়ারা (ওরফে বিবি মাহে-নূর), ছিলেন সৈয়দ বা মুহাম্মদ (দ.)-এর বংশধর, তার নাতি হাসান এবং হোসাইনের মাধ্যমে। তিনি তার পিতার কাছ থেকে একটি বাতচক্র (উইন্ডমিল) ও একটি ফলের বাগান উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন। কিংবদন্তি অনুসারে, একদিন তিনি তার ফলবাগানে জল দিচ্ছিলেন তখন তার ফলবাগানে আসেন বিখ্যাত সুফি শেখ ইবরাহিম কুন্দুজী (কুন্দুজী নামটি জন্মস্থান কুন্দুজ থেকে এসেছে)। যুবক মইনুদ্দিন তটস্থ হয়ে যান এবং কুন্দুজীকে কিছু ফল দিয়ে আপ্যায়ন করেন। এর প্রতিদানস্বরূপ কুন্দুজী মইনুদ্দিনকে এক টুকরা রুটি দেন ও তা খেতে বলেন। এর পর তিনি তার সম্পত্তি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র গরীবদের মাঝে বিতরণ করে দেন। এরপর তিনি বিশ্বের মায়া ত্যাগ করে জ্ঞানার্জন ও উচ্চ শিক্ষার জন্য বুখারার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।তিনি বুখারা এবং সমরকন্দের সেমিনারিতে ভর্তি হন এবং (সম্ভবত) মুহাম্মদ আল-বুখারি (মৃত্যু ৮৭০) এবং আবু মনসুর আল-মাতুরিদি (মৃত্যু ৯৪৪) এর মাজার পরিদর্শন করেন, যা ইসলামি বিশ্বের ব্যাপকভাবে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব।

ইরাক ভ্রমণের সময়, নিশাপুর জেলায়, তিনি বিখ্যাত সুন্নি রহস্যবাদী খাজা উসমান-এর সাথে দেখা করেছিলেন, যিনি তাকে দীক্ষা দিয়েছিলেন।বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তার আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শকের সাথে পরবর্তী অঞ্চল থেকে অঞ্চলে ভ্রমণে, মঈনুদ্দিন সেই সময়কালে তার নিজস্ব স্বাধীন আধ্যাত্মিক ভ্রমণও চালিয়ে যান। তার স্বাধীন বিচরণে মঈনুদ্দিন সেই যুগের অনেক উল্লেখযোগ্য সুন্নি রহস্যবাদীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন, যার মধ্যে ছিলেন আবদুল কাদের জিলানী (মৃত্যু ১১৬৬) এবং নাজমুদ্দিন কুবরা (মৃত্যু ১২২১), পাশাপাশি নাজিব আল-দীন আবদ-আল-কাহির সোহরাওয়ার্দী, আবু সাঈদ তাবরিজি, এবং আবদ আল-ওয়াহিদ গজনবীও ছিলেন, যাদের সবাই সুন্নি ঐতিহ্যের সবচেয়ে সম্মানিত সুফি সাধক ছিলেন।

দক্ষিণ এশিয়ায়

ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দক্ষিণ এশিয়ায় পৌঁছে মঈনুদ্দিন বিখ্যাত সুন্নি রহস্যবাদী এবং আইনজ্ঞ আলী হুজভিরি (মৃত্যু ১০৭২) এর মাজারে ধ্যান করার জন্য প্রথম লাহোরে যান।

সুফি দীক্ষা

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী বোখারা থেকে নিশাপুরে আসেন। সেখানে চিশতীয়া তরীকার অপর প্রসিদ্ধ সুফি সাধক খাজা উসমান হারুনীর নিকট মুরীদ হন/শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার সেবায় ২০ বছর একাগ্রভাবে নিয়োজিত ছিলেন। পরে উসমান হারুনী তাকে খিলাফত বা সুফি প্রতিনিধিত্ব প্রদান করেন।

ভ্রমণ

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী বহু দেশ ভ্রমণ করেন। তৎকালীন বিভিন্ন জ্ঞানী, গুণী, পণ্ডিত, দার্শনিকসহ অসংখ্য সুফি সাধকের সাথে সাক্ষাত করেন বলে নানা গ্রন্থে তথ্য পাওয়া যায়। তিনি ইরাকের বাগদাদে আবদুল কাদির জিলানীর সাহচর্যে ৫৭ দিন অবস্থান করেন। তার জীবনীতে বর্ণিত আছে যে, এ সময় আব্দুল কাদির জিলানী তাকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন, ইরাকের দায়িত্ব শায়েক শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীকে আর হিন্দুস্থানের দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হলো। তিনি আরব হতে ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান হয়ে প্রথমে লাহোর পরে দিল্লী হয়ে আজমিরে বসতি স্থাপন করেন।

ধর্ম প্রচার

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে কিংবদন্তিতুল্য একজন ঐতিহাসিক সুফি ব্যক্তিত্ব। তিনি স্বীয় পীর উসমান হারুনীর নির্দেশে ভারতে আগমন করে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং তারই মাধ্যমে বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। তার বিখ্যাত একটি গ্রন্থ হল "আনিসুল আরওয়াহ"।

আধ্যাত্মিক ধারা

মইনুদ্দিন চিশতী 

তার আধ্যাত্মিক ধারা ঐতিহ্যগতভাবে নিম্নরূপ:

  1. মুহাম্মদ
  2. আলী বিন আবি তালিব (মৃত্যু ৬৬১)
  3. হাসান আল-বসরী (মৃত্যু ৭২৮)
  4. আব্দুল ওয়াহিদ বিন যায়েদ (মৃত্যু ৭৮৬)
  5. আল-ফুযাইল বিন ʿইয়াদ (মৃত্যু ৮০৩)
  6. ইব্রাহিম ইবনে আদহাম আল-বলখী (মৃত্যু ৭৮৩)
  7. হুজাইফা আল-মার'শি (মৃত্যু ৮৯০)
  8. আবু হুবায়রা আল-বসরী (মৃত্যু ৯০০)
  9. খাজা মুমশাদ উলু আল দিনাওয়ারী (মৃত্যু ৯১১)
  10. আবু ইসহাক শামী (মৃত্যু ৯৪১)
  11. আবু আহমদ আবদাল চিশতি (মৃত্যু ৯৬৬)
  12. আবু মুহাম্মদ চিশতী (মৃত্যু ১০২০)
  13. আবু ইউসুফ ইবনে সামান মুহাম্মদ সামআন চিশতী (মৃত্যু ১০৬৭)
  14. মওদুদ চিশতী (মৃত্যু ১১৩৩)
  15. শরীফ জান্দানি (মৃত্যু ১২১৫)
  16. উসমান হারুনী (মৃত্যু ১২২০)
  17. খাজা সোহরাব হোসেন খান চিশতী (অনন্ত মৈত্রী) খাজা বাবার “সত্তা” আধ্যাত্মিক প্রেম-প্রেমিক শিষ্য।

খেলাফত প্রদান

তিনি কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকীকে খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করে সিলসিলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন।

তিনি সুফি মোঃ সোহরাব হোসেন খান চিশতী (অনন্ত মৈত্রী’কে) আধ্যাত্মিক খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করে সিলসিলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন।

মৃত্যু

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী ৬৩৩ হিজরীর ৫ রজব দিবাগত রাত অর্থাৎ ৬ রজব শুক্রবার ইন্তিকাল করেন।

প্রতিবছর ১লা রজব হতে ৬ রজব পর্যন্ত আজমির শরীফে তার সমাধিস্থলে ওরস অনুষ্ঠিত হয়। নানা ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হতে সমবেত হয়।

চিত্রশালা

মইনুদ্দিন চিশতী 
খাজা মইনুদ্দীন চিশতীর মধ্যবয়সের একটি চিত্র

তথ্যসূত্র

উদ্ধৃতি

গ্রন্থপঞ্জি

বহিঃসংযোগ

মইনুদ্দিন চিশতী  উইকিমিডিয়া কমন্সে মইনুদ্দিন চিশতী সম্পর্কিত মিডিয়া দেখুন।

Tags:

মইনুদ্দিন চিশতী প্রারম্ভিক জীবন ও নেপথ্যমইনুদ্দিন চিশতী দক্ষিণ এশিয়ায়মইনুদ্দিন চিশতী সুফি দীক্ষামইনুদ্দিন চিশতী ভ্রমণমইনুদ্দিন চিশতী ধর্ম প্রচারমইনুদ্দিন চিশতী আধ্যাত্মিক ধারামইনুদ্দিন চিশতী খেলাফত প্রদানমইনুদ্দিন চিশতী মৃত্যুমইনুদ্দিন চিশতী চিত্রশালামইনুদ্দিন চিশতী তথ্যসূত্রমইনুদ্দিন চিশতী বহিঃসংযোগমইনুদ্দিন চিশতীUrdu Languageআরবি ভাষাওলামাকুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীচিশতিয়া তরিকাদার্শনিকনিজামুদ্দিন আউলিয়াপারসিক জাতিফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকারফার্সি ভাষাভারতভারতীয় উপমহাদেশমুসলিমরহস্যবাদসুন্নিসৈয়দ

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

জবাবর্ডার গার্ড বাংলাদেশলালনপরমাণুদৈনিক যুগান্তরখাদ্যইহুদি ধর্মবাংলাদেশের সংবিধাননারী খৎনাউসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতানদের তালিকাডায়াজিপামআগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাজাতীয় সংসদ ভবনসূরা কাফিরুনটেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাঈসাধর্ষণসাংগ্রাইঅ্যামিনো অ্যাসিডআন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বরশিদ চৌধুরীগজলকোষ বিভাজনএল নিনোবন্ধুত্বরং (বর্ণ)ইংরেজি ভাষাবাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগচৈতন্য মহাপ্রভুভারতীয় সংসদরবীন্দ্রজয়ন্তীজাতীয় সংসদবাংলাদেশ গণপরিষদশেখ মুজিবুর রহমানদুষ্মন্ত চামিরাকালিদাসময়মনসিংহ২০২৪ কোপা আমেরিকাভারতীয় জনতা পার্টিময়ূরী (অভিনেত্রী)বাংলাদেশের বিমানবন্দরের তালিকাযোগাসনপরিভাষাসমকামিতাপায়ুসঙ্গমগ্রীষ্মসুলতান সুলাইমানইসলামে যৌনতাআব্বাসীয় খিলাফতনারায়ণ সান্যালপাগলা মসজিদসূরা ইখলাসবাউল সঙ্গীতউপজেলা পরিষদবাসকউজবেকিস্তানইউরোপীয় ইউনিয়নপর্যায় সারণিব্যাঙবাংলাদেশের প্রশাসনিক অঞ্চলবিশ্ব পরিবেশ দিবসঅকাল বীর্যপাতবাস্তুতন্ত্ররঙের তালিকাপ্রথম উসমানআর্জেন্টিনা–ব্রাজিল ফুটবল প্রতিদ্বন্দ্বিতারবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমাইটোসিসইউরোদুধবাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল২০২২–২৩ নিউজিল্যান্ড পুরুষ ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফর (এপ্রিল ২০২৩)পূরণবাচক সংখ্যা (ভাষাতত্ত্ব)বিটিএসবাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীদের তালিকা🡆 More