সুফিবাদ: ইসলামী আধ্যাত্মবাদ

সুফিবাদ বা তাসাউফ , (আরবি: الْتَّصَوُّف‎, ব্যক্তিবাচক বিশেষ্য: صُوفِيّ‎, সুফি, مُتَصَوِّف‎ মুতাসাউওয়াফ) যাকে বিভিন্নভাবে ইসলামী আধ্যাত্মবাদ অতীন্দ্রিয়বাদ বা রহস্যবাদ, ইসলামের অন্তর্নিহিত রূপ, ইসলামের অন্তর্গত আধ্যাত্মিকতার অদৃশ্য অনুভূতি হিসেবেও সংজ্ঞায়িত করা হয়, তা হল ইসলামে আধ্যাত্মবাদ, যা নির্দিষ্ট মূল্যবোধ, আচার-প্রথা চর্চা, মূলনীতি দ্বারা বিশেষায়িত, যা ইসলামের ইতিহাসের খুব প্রাথমিক দিকে শুরু হয়েছিল, এবং এটি ইসলামের আধ্যাত্মিক চর্চার প্রধান অভিব্যক্তি ও কেন্দ্রীয় স্বচ্ছতাকে তুলে ধরে। সুফিবাদের চর্চাকারীদের সুফি বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে (আরবি বহুবচন: صُوفِيَّة‎ সুফিয়াহ; صُوفِيُّون‎ সুফিয়ুন; مُتَصَوُّفََة‎ মুতাসায়িফাহ; مُتَصَوُّفُون‎ মুতাসায়িফুন)। ইসলামে তাসাউফের আরেকটি সমার্থক ধারণা হল তাজকিয়া (تزكية)।

ঐতিহাসিকভাবে, সুফিগণ প্রায়শই বিভিন্ন তরিকা বা ধারার অনুসারী - এমন কিছু ধর্মসভা যা কোন মহান শিক্ষাগুরুকে কেন্দ্র করে গঠিত, যাদের ওয়ালী বলে আখ্যায়িত করা হয়, এবং তারা আনুসারীদের সঙ্গে ইসলামী নবী মুহাম্মাদ(সাঃ)-এর সিলসিলা স্থাপন করেন। এই তরিকাগুলো জাওয়াবিয়া, খানকা বা তেক্কে নামক কোন নির্দিষ্ট স্থানে মজলিস নামক আধ্যাত্মিক বৈঠকে মিলিত হয় তারা ইহসানের (ইবাদতের পূর্নাঙ্গতা) জন্য সংগ্রাম করে, যা একটি হাদীসে বিস্তারিত বর্ণিত আছে: "ইহসান হল এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত কর যে, তুমি তাকে দেখছো, অথবা তুমি তাকে না দেখলেও নিশ্চয়ই তিনি তোমাকে দেখছেন।" সূফিগণ মুহাম্মদ (সাঃ) -কে আল-ইনসান আল-কামিল (প্রথম ব্যক্তি যিনি আল্লাহর নৈতিকতাকে পরিপূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করেছেন) বলে আখ্যায়িত করে থাকে, এবং তাঁকে নেতা ও প্রধান আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক হিসেবে দেখে।

সকল সূফি তরিকা মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছ থেকে পাওয়া তাদের অধিকাংশ অনুশাসন তার চাচাতো ভাই ও জামাতা আলীর বরাতে গ্রহণ করে থাকে, এবং তাকে উল্লেখযোগ্য আলাদা ও বিশেষ ব্যক্তি মনে করে।

যদিও প্রাচীন ও আধুনিক সূফিদের সিংহভাগই ছিল সুন্নি ইসলামের অনুসারী, মধ্যযুগের শেষভাগে শিয়া ইসলাম পরিমন্ডলের ভেতরেও কিছু সুফি ধারার বিকাশ ঘটে। যদিও সুফিগণ কট্টর রীতিনীতির বিরোধী, তারপরও তারা ইসলামী আইন কঠোরভাবে মেনে চলে এবং তারা ইসলামী ফিকহ ও ধর্মতত্ত্বের বিভিন্ন ধারার অন্তর্ভুক্ত।

সুফিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তাদের সন্ন্যাসবাদ, বিশেষত যিকির নামক আল্লাহকে স্মরণ চর্চার সাথে তাদের ঐকান্তিক সম্পর্ক, যা তারা প্রায় সময় সালাতের পর করে থাকে। প্রারম্ভিক উমাইয়া খিলাফতের (৬৬১-৭৫০) জাগতিক দুর্বলতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াস্বরুপ তারা মুসলিমের মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য হারে অনুসারী লাভ করে এবং এক সহস্রবছর সময়ের মধ্যে বহু মহাদেশ ও সংস্কৃতিতে তারা বিস্তৃতিলাভ করে, প্রাথমিকভাবে আরবি ভাষায় এবং পরবর্তীতে ফারসি, তুর্কি ও উর্দু ভাষায় অন্যান্যদের মাঝে তাদের বিশ্বাসের প্রচার ও প্রসার করে। সুফিগণ তাদের ধর্মপ্রচার ও শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে মুসলিম সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। উইলিয়াম চিট্টিকের মতে, "বিস্তৃত পরিসর হতে দেখলে, সুফিবাদকে ইসলামী বিশ্বাস ও চর্চার অন্দরসজ্জা ও প্রগাঢ়তার কার্যক্রম হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে।"

আধুনিক সময়ে সুফি তরিকাগুলোর সংখ্যা ব্যাপকহারে হ্রাস পাওয়া এবং সুফিবাদের কিছু দিক নিয়ে আধুনিকতাবাদী চিন্তাবিদ ও রক্ষণশীল সালাফিবাদীদের সমালোচনা সত্ত্বেও, সুফিবাদ ইসলামী বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে, এবং পাশাপাশি পাশ্চাত্যের আধ্যাত্মিকতার বিভিন্ন রূপকেও প্রভাবিত করেছে।

সংজ্ঞা

সুফিবাদ হচ্ছে ইসলামের আধ্যাত্মিক-তাপসদের মরমীবাদ। এটি কোন সম্প্রদায় নয়, বরঞ্চ এটিকে ইসলামিক শিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয় যা মানুষের স্বীয় অভ্যন্তরীণ পরিশুদ্ধতার সাথে সম্পর্কযুক্ত। আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়। সুফিবাদের মূল বিষয় হল, আপন নফসের সঙ্গে, নিজ প্রাণের সাথে, নিজের জীবাত্মার সাথে, শয়তানের সাথে জিহাদ করে তার থেকে মুক্ত হয়ে এ জড় জগৎ থেকে মুক্তি পাওয়া।[মৌলিক গবেষণা?] আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন হল এই মতবাদের মর্মকথা। সুফিবাদে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আধ্যাত্মিক ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যামে জানার প্রচেষ্টা করা হয়। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন] আল-গাজ্জালি এর মতে, আল্লাহর ব্যতীত অপর মন্দ সবকিছু থেকে আত্মাকে পবিত্র করে সর্বদা আল্লাহর আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহুতে নিমগ্ন হওয়ার নামই সুফিবাদ বলে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ‘সুফ অর্থ পশম আর তাসাওউফের অর্থ পশমী বস্ত্রে পরিধানের অভ্যাস (লাব্‌সু’স-সুফ) - অতঃপর মরমীতত্ত্বের সাধনায় কারও জীবনকে নিয়োজিত করার কাজকে বলা হয় তাসাওউফ। যিনি নিজেকে এইরূপ সাধনায় সমর্পিত করেন ইসলামের পরিভাষায় তিনি সুফি নামে অভিহিত হন।’ ইসলামি পরিভাষায় সুফিবাদকে তাসাওউফ বলা হয়, যার অর্থ আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞান। তাসাওউফ বা সুফিবাদ বলতে আত্মার পরিশুদ্ধির সাধনাকে বুঝায়। সুফীরা দাবি করে যে, আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করা) এবং ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়িভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া) লাভ করা যায়। তাসাওউফ দর্শন অনুযায়ী আল্লাহ-প্রাপ্তির সাধনাকে 'তরিকত' বলা হয়। বলা হয়, তরিকত সাধনায় মুর্শিদ বা পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন। সেই পথ হলো ফানা ফিশ্‌শাইখ, ফানা ফিররাসুল ও ফানাফিল্লাহ। ফানাফিল্লাহ হওয়ার পর বাকাবিল্লাহ লাভ হয়। বাকাবিল্লাহ অর্জিত হলে সুফি দর্শন অনুযায়ী সুফি আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ শক্তিতে শক্তিমান হন। তখন সুফির অন্তরে সার্বক্ষণিক শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে। সুফিগণের মতে, মুহাম্মাদ স্বয়ং সুফিদর্শনের প্রবর্তক। এর সপক্ষে সুফিগণ মুহাম্মাদ এর একটি হাদিস উল্লেখ করেন যা হল, "সাবধান! প্রত্যেক রাজা -বাদশাহর একটি সংরক্ষিত এলাকা আছে। আর আল্লাহর সংরক্ষিত এলাকা হচ্ছে তাঁর হারামকৃত বিষয়াদি। সাবধান! নিশ্চয়ই শরীরের মধ্যে একটি মাংসপিণ্ড আছে; যখন তা ঠিক থাকে তখন সমস্ত শরীর ঠিক থাকে, আর যখন তা নষ্ট হয়ে যায় তখন গোটা দেহ নষ্ট হয়ে যায় -এটা হচ্ছে কলব (হৃৎপিণ্ড)।" সার্বক্ষণিক আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে কল্‌বকে কলুষমুক্ত করে আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন এবং যারা তার ভালোবাসা লাভ করেছেন, তাদের তরিকা বা পথ অনুসরণ করে "ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ অর্জন করা" সুফিবাদের উদ্দেশ্য।

সুফিবাদের সমর্থক ও বিরোধীদের দ্বারা ইসলামিক সাহিত্যে আরবি শব্দ সুফি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। শাস্ত্রীয় সূফী গ্রন্থসমূহে, যা কুরআন ও সুন্নাহর (ইসলামী নবী মুহাম্মদের আদর্শ শিক্ষা ও অনুশীলন) নির্দিষ্ট শিক্ষা ও অনুশীলনের উপর জোর দিয়েছে, তাসাউফের সংজ্ঞা পাওয়া যায় যেখানে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক লক্ষ্য বর্ণিত হয়েছে এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য এটি শিক্ষণ সরঞ্জাম হিসাবে কাজ করে।আরো অনেক শব্দ রয়েছে যেগুলো বিশেষ আধ্যাত্মিক গুণাবলী ও ভূমিকাকে বর্ণনা করে তার পরিবর্তে ব্যবহারিক অর্থে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে।

অধুনাকালের কিছু পণ্ডিত সুফিবাদকে অন্য রকমভাবেও সংজ্ঞা দিয়ে থাকেন যেমন "ইসলামী বিশ্বাস ও অনুশীলনের তীব্রতা" এবং "নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক আদর্শ উপলব্ধি প্রক্রিয়া"। আঠারো শতকে ইউরোপীয় ভাষায় সুফিবাদ শব্দটি চালু করেন মূলত প্রাচ্যবিদ পণ্ডিতরা যারা এটিকে ইসলামের নির্জীব একেশ্বরবাদের বিপরীতে একটি বুদ্ধিজীবী মতবাদ ও সাহিত্য ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচনা করেন। আধুনিককালের পান্ডুলিপিগুলোতে এই শব্দটি সুফিদের সাথে সম্পর্কিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ঘটনাগুলির বিস্তৃত বর্ণনা করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।

শব্দতত্ত্ব

সুফি শব্দটির দুইটি ব্যুৎপত্তি পাওয়া যায়। সাধারণভাবে, শব্দটির আভিধানিক অর্থ ṣafā (صفاء) এর থেকে এসেছে, যার আরবি অর্থ বিশুদ্ধতা বা পবিত্রতা বা শুদ্ধতা বা পাপশূণ্যতা, এ প্রসঙ্গে তাসাউফের অনুরূপ ইসলামের আরেকটি ধারণা বিবেচিত হয়ে থাকে যা তাজকিয়া (تزكية, অর্থ : আত্মশুদ্ধি) নামে পরিচিত, যা সুফিবাদেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আরেকটি আরবি মূল পাওয়া যায়, যা পশম, ṣūf (صُوف), শব্দটি থেকে সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। পশম ছিল তৎকালীন মুসলিম তাপসদের সাধারণ পোশাক। সুফি আল-রুধাবারি এই দুইটি মূলকে একত্রিত করেছেন যিনি বলেন, "সুফি হলেন সে ব্যক্তি যিনি সর্বোচ্চ পরিশুদ্ধ অবস্থায় পশমী বস্ত্র পরিধান করেন।" তবে আল-কুশাইরি এবং ইবনে খালদুন উভয়ই ভাষাগত ভিত্তিতে সউফ ছাড়া অন্যান্য অর্থের সম্ভাবনার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মুসলিম পণ্ডিতরা একমত হয়েছেন যে, "সউফ" (ṣūf) বা পশম হল "সুফি" শব্দটির সম্ভাব্য মূল। আবার অনেকের মতে সুফি শব্দটি এসেছে আসহাবে সুফফা থেকে, আশ্রয়হীন সাহাবীদের একটি দল, যাদের নবী মুহাম্মদ মসজিদে নববীর প্রাঙ্গনে সুফফা নামক স্থানে থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন, তারা সেখানে নবী মুহাম্মদ কে সাহচার্য দিতেন এবং সেখানে যিকির করতেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুপরিচিত সাহাবা ছিলেন আবু হুরাইরা। কেউ কেউ আল-মসজিদ-নবাবিতে বসে থাকা ঐ সহাবাদের প্রথম সুফি হিসেবে বিবেচনা করেন। আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া তার হিন্দুসিয়াত ওয়া তাসুর গ্রন্থে বলেন, কামেল মোস্তফা আল-শাইবি ও আব্দুল্লাহ নমসুক পৃথক গ্রন্থে বলেন যে প্রথম যেই ব্যক্তি সুফি শব্দটি ব্যবহার করেন, তার নাম আবু হাশেম আল কুফী (দ্বিতীয় হিজরি শতক), এবং ইবনে তাইমিয়া তার মাজমুয়াল ফাতওয়া গ্রন্থে বলেন, বসরা ছিল সেসময় সুফিবাদের একটি কেন্দ্র।

অনেকের মতে গ্রিক শব্দ sophos বা জ্ঞান, theosophy বা ধর্মতত্ত্ব, philosophy বা দর্শন থেকে থেকে সুফি শব্দটি এসেছে, কিন্তু নিকোলসন এই মতটি প্রত্যাখ্যান করেছেন কারণ ফিলোসোফির আরবি রুপান্তর ফালসাফাতে সীন ব্যবহার করা হয়েছে, সোয়াদ নয়, কিন্তু সুফি ও তাসাউফ শব্দ দুটিতে সোয়াদ বর্ণটি ব্যবহার করা হয়েছে।

আবার অনেকের মতে সুফি শব্দটি এসেছে আসহাবে সুফফা থেকে, আশ্রয়হীন সাহাবীদের একটি দল, যাদের নবী মুহাম্মদ মসজিদে নববীর প্রাঙ্গনে সুফফা নামক স্থানে থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন, তারা সেখানে নবী মুহাম্মদ কে সাহচার্য দিতেন এবং উসামা বিন সাবিতের অধীনে কুরআন ও সুন্নাহর অধ্যয়ন চর্চা করতেন।

তাসাউফ বনাম সুফিবাদ

ঐতিহাসিকভাবে, মুসলমানরা সুফিদের আধ্যাত্মিক সাধনাকে প্রকাশ করার জন্য তাসাউফ শব্দটি ব্যবহার করত। ঐতিহাসিক সুফিদের মতে, তাসাউফ ইসলামের একটি বিশেষ রূপ যা ইসলামিক শরীয়াহ আইন এর অনুরূপ। তাদের মতে, বিশ্বের সকল প্রকার মন্দ এবং গর্হিত কাজ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শরীয়াহ এই বিশ্বকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। তারা মনে করেন, তাসাউফ ইসলামের অবিচ্ছেদ্য এবং ইসলামিক বিশ্বাস এবং অনুশীলনের অপরিহার্য অংশ। কার্ল এর্নস্ট এর মতে, সুফিবাদ শব্দটি কোন ইসলামিক গ্রন্থ বা কোন সুফিদের কাছ থেকে আসেনি। তার মতে শব্দটি এসেছে প্রাচ্যের ভাষা বিষয়ক ব্রিটিশ গবেষকদের থেকে। ইসলামিক সভ্যতায় (ইসলামিক আধ্যাত্বিকতা) তারা যে মনোমুগ্ধকর বিষয় উপলব্ধি করেন এবং তৎকালীন যুক্তরাজ্যে ইসলাম সম্বন্ধে নেতিবাচক ধারণা বা বিশ্বাস বিরাজ করছিল তার মধ্যে কৃত্রিম পার্থক্য সৃষ্টি করতে তারা সুফিবাদ শব্দটি ব্যবহার করেন। তবে তাসাউফ বা সুফি শব্দ দুটি কোরআন ও হাদীসের কোথাও পাওয়া যায় না।

ইতিহাস

উৎস

সুফিবাদ: সংজ্ঞা, শব্দতত্ত্ব, ইতিহাস 
অনেকেই আলীকে 'সুফিবাদের জনক" বলে মনে করে থাকেন।

কার্ল ডব্লিউ. আর্নস্ট এর মতে, সুফিবাদের প্রাচীনতম ব্যক্তিত্ব স্বয়ং মুহাম্মদ (সা.) এবং তার সাহাবীগণ। সুফি তরিকাগুলোর ভিত্তি হল "বায়াত" (بَيْعَة বাইআত, مُبَايَعَة মুবাই'আত "অঙ্গীকার, চুক্তি, শপথনামা") যে শপথ সাহাবারা মুহাম্মদ (সা.) এর কাছে করতেন। মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি মাধ্যমে সাহাবাগণ আল্লাহর কাজে নিজেদের নিয়োগ করতেন।

নিশ্চয় যারা আপনার (মুহাম্মাদ-এর কাছে বাই’আত করে তারা তো আল্লাহরই হাতে বাই’আত করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর। তারপর যে তা ভঙ্গ করে, তা ভঙ্গ করার পরিণাম বর্তাবে তারই উপর এবং যে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে, তবে তিনি অবশ্যই তাকে মহাপুরস্কার দেন। — [কুরআনের অনুবাদ, ৪৮:১০]

সুফিগণ বিশ্বাস করে যে, কোন বৈধ সুফি শাইখের (পীর) নিকট বাইয়াত বা শপথ নেওয়ার মাধ্যমে কোন ব্যক্তি মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট আনুগত্যের শপথ করে; ফলে, প্রার্থী ও মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যে সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুহাম্মাদ এর মাধ্যমে সুফিগণ আল্লাহ সম্পর্কে জানে, আল্লাহকে বোঝে এবং আল্লাহর সাথে সংযোগ স্থাপন করে। আলী হলেন সাহাবাদের মধ্যে প্রধান ব্যক্তি যিনি সরাসরি মুহাম্মাদ-এর নিকট আনুগত্যের শপথ (বায়াত) পাঠ করেন, এবং সুফিগণ আলীর মাধ্যমেই এই শপথকে বজায় রাখেন, যেন মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন ও তার সাথে সংযোগ স্থাপন সম্ভব হয়। এমন একটি ধারণা হাদিস থেকে বোঝা যায়, যাকে সুফিগণ সহীহ বলে মনে করেন, যেখানে মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, "আমি জ্ঞানের শহর আর আলী তার দরজা"। আলি হুজ্যিরির ন্যায় প্রসিদ্ধ সুফিগণ আলীকে তাসাউফের অনেক উচ্চ পদমর্যাদার অধিকারী বলে মনে করেন। উপরন্তু, জুনায়েদ আল বোগদাদী আলীকে তাসাউফের রীতিরেওয়াজের শাইখ বলে গণ্য করেছেন।

ইতিহাসবেত্তা জোনাথন এ.সি. ব্রাউন লিখেছেন, মুহাম্মাদ এর জীবদ্দশায়, কিছু সাহাবা অন্যান্য সাহাবার চেয়ে "প্রবল ভক্তি, পুন্যময় নিরাসক্তি ও আল্লাহর রহস্যে"র প্রতি অধিক ঝোঁকবিশিষ্ট ছিলেন, এমনকি ইসলামে যা বলা হয়েছে তারচেয়েও বেশি, উদাহরণস্বরূপ আবু যর গিফারী। হাসান বসরী নামক একজন তাবেঈকে "অন্তর-বিশুদ্ধকরণ-বিজ্ঞানে"র "স্থপতি" বলে বিবেচনা করা হয়।

অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে, কিছু লোক মত দেন যে, সুফিবাদের উৎস হল বৌদ্ধ সন্ন্যাসবাদ, খ্রিস্টান ভবিষ্যদ্বাণী, ভারতীয় জাদুবিদ্যা এবং খোরাসানে উদ্ভূত পারস্য ধর্মের মূল।

সুফিবাদের অনুশীলনকারীরা মনে করেন যে সুফিবাদের বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে কার্যকরভাবে এটি ইসলামের অভ্যন্তরীণকরণের চেয়ে বেশি কিছু ছিলনা। এক দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি সরাসরি কুরআন থেকে এসেছে, যা ক্রমাগতভাবে তেলোয়াত, ধ্যান ও অভিজ্ঞতা লাভ করার মাধ্যমে সুফিবাদের উৎস এবং তার বিকাশে লাভ করেছে। অন্যান্য অনুশীলনকারীরা মনে করেন, সুফিবাদ হলো মুহাম্মদ (সা.) এর দেখানো পথে অনুকরণের মাধ্যম, যার মাধ্যমে পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার সংযোগ শক্তিশালী হয়।

ইসলামের মৌলিক বিষয় হিসেবে অবস্থান তৈরি

মতবাদ হিসেবে ক্রমঃবিকাশ

প্রভাব বিস্তার

আধুনিক যুগ

শিক্ষা

সুফিবাদ ও ইসলামী আইন

ঐতিহ্যবাহী ইসলামী চিন্তাধারা ও সুফিবাদ

নব্য-সুফিবাদ

তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি

জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় অবদান

সুফিদের আত্মত্যাগী চর্চা

যিকির

মুরাকাবা

সুফি চক্রঘুর্নন

ইসলামিক ছ্যামা (সংগীত)

দরবেশগণ

জিয়ারত

কেরামত

নির্যাতন

সুফিদের ও সুফিবাদের উপর নির্যাতনের অন্তর্ভুক্ত হল সুফি মাজার ও মসজিদগুলোকে ধ্বংস করা, তরিকাগুলোকে দমন করা, ও অধাকংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এর অনুসারীদের প্রতি বৈষম্য। ১৯২৫ সালে তুর্কি সুফিগণ নতুন ধর্মনিরপেক্ষ অধ্যাদেশের বিরোধিতা করায় তুর্কি গনপ্রজাতন্ত্রী সরকার সকল সুফি তরিকাকে নিষিদ্ধ করে, এবং তাদের প্রাতিষ্ঠানিকগুলো উচ্ছেদ করে।

২০১৭ সালের নভেম্বরে সিনাইয়ের একটি মসজিদে হামলায় অন্ততপক্ষে ৩০৫ জন নিহত ও ১০০রও বেশি লোক আহত হয়।

প্রধান সূফি তরিকাসমূহ

তরিকা শব্দটি সুফিবাদের একটি গোষ্ঠী বা বর্গের জন্য, বিশেষ করে আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং হাকিকত (চূড়ান্ত সত্য) সন্ধানের লক্ষ্যে আধ্যাত্মিক অনুশীলনের জন্য ব্যবহৃত হয়। সাধারণত তরিকায় একজন মুর্শিদ (পীর বা পথ প্রদর্শক) রয়েছে যিনি নেতা বা আধ্যাত্মিক পরিচালকের ভূমিকা পালন করেন। তরিকার অনুসারীরা মুরিদীন (একবচন মুরিদ) নামে পরিচিত, যার অর্থ "অভিলাষী", যেমন "ঈশ্বরকে জানার এবং ঈশ্বরকে ভালবাসার জ্ঞান কামনা"। সুফিবাদ উৎকর্ষ লাভ করে পারস্যে। সেখানকার প্রখ্যাত সুফি-দরবেশ, কবি-সাহিত্যিক এবং দার্শনিকগণ নানা শাস্ত্র, কাব্য ও ব্যাখ্যা-পুস্তক রচনা করে এই দর্শনকে সাধারণের নিকট জনপ্রিয় করে তোলেন। কালক্রমে বিখ্যাত ওলিদের অবলম্বন করে নানা তুরুক বা তরিকা গড়ে ওঠে। সেগুলির মধ্যে কয়েকটি প্রধান তরিকা সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে:

কাদেরিয়া তরিকা

কাদেরিয়া তরিকা পৃথিবীর প্রাচীনতম সুফি তরিকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। আবদুল কাদের জিলানির (১০৭৭-১১৬৬) নাম থেকে এই তরিকার নামকরণ করা হয়েছে। জিলান ইরানের একটি প্রদেশের নাম এবং এর অধিবাসীদের জিলানী বলা হয়ে থাকে। এই তরিকা ইসলামি বিশ্বে সর্বাধিক বিস্তৃততম সুফি তরিকাগুলো একটি এবং মধ্য এশিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক, বলকান এবং পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকার বেশিরভাগ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে এই তরিকার অনুসারী রয়েছে। ইসলামের মূলধারার বাইরে কাদেরিয়া তরিকা কোন বিশেষ মতবাদ বা শিক্ষা গড়ে তোলেনি। এই তরিকার অনুসারীরা ইসলামের মৌলিক নীতিগুলিতে বিশ্বাস করে, কিন্তু আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সেই নীতিগুলোকে তারা ব্যাখ্যা করে।

চিশতিয়া তরিকা

চিশতিয়া ত্বরিকা (ফার্সি: چشتیہ) বর্তমান আফগানিস্তানের হেরাতের উত্তর দিকে প্রায় ৯৫ মাইল দূরের ক্ষুদ্র শহর চিশতে ৯৩০ সালের দিকে এই তরিকার উদ্ভব হয়। তরিকাটি প্রতিষ্ঠাতা হলেন (খাজা) আবু ইশক শামি। লেভ্যান্টে ফিরে আসার পূর্বে, স্থানীয় আমীর (খাজা) আবু আহমাদ আবদালের (মৃত্যু ৯৬৬) পুত্রকে বায়াত করান, তাকে সুফিতত্ত্বের উপর প্রশিক্ষণ দেন এবং খেলাফত (আধ্যাত্মিক প্রতিনিধিত্ব) দান করেন। আবু আহমদের বংশধরদের, তারা চিশতিয়া নামেও পরিচিত, নেতৃত্বে চিশতিয়া তরিকা একটি অঞ্চলভিত্তিক তরিকা হিসেবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।এই তরিকায় ভালবাসা, সহিষ্ণুতা ও উদারতার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। ১২ শতকের মধ্যভাগে মইনুদ্দিন চিশতি লাহোর ও আজমিরে এই তরিকা আনয়ন করেন। চিশতি তরিকার প্রতিষ্ঠাতা আবু ইশক শামির পর তিনি এই ধারার অষ্টম ব্যক্তি। বর্তমানে এই তরিকার বেশ কিছু শাখা রয়েছে।

নকশবন্দি তরিকা

নকশবন্দি তরিকা হল ইসলামের প্রধান সুফি তরিকাগুলোর একটি। পূর্বে এ তরিকা সিদ্দিকিয়া নামে পরিচিত ছিল, কারণ এই তরিকার ধারা পেছনের দিকে আবু বকরের মাধ্যমে মুহাম্মাদ (সা.) এর সাথে সম্পর্কিত করে। অনেকেই এই তরিকাকে "শান্ত" তরিকা হিসেবে বিবেচনা করে থাকে, কারণ এই তরিকায় জিকির (স্রষ্ঠাকে স্মরণ করা) নীরবভাবে করা হয়ে থাকে যদিও অন্য তরিকাগুলোতে উচ্চস্বরে বা হালকা উচ্চস্বরে জিকির করা হয়ে থাকে। "নকশবন্দি" শব্দটি (نقشبندی) ফার্সি শব্দ, এই তরিকার প্রতিষ্ঠাতা বাহা-উদ-দিন নকশবন্দ বুখারীর নাম থেকে গৃহীত হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন যে নকশবন্দ শব্দটির অর্থ "চিত্রকরের সাথে সম্পর্কিত", আবার অনেকে মনে করেন এর অর্থ "চিত্রকর" এর পরিবর্তে "আদর্শ প্রণেতা" এবং "নকশবন্দ" শব্দটির অর্থ "আদর্শ সংস্কারক" হিসেবে ব্যাখ্যা করে।

মুজাদ্দিদিয়া তরিকা

শায়খ আহমদ সিরহিন্দ মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহ এর প্রতিষ্ঠিত তরিকাকে মুজাদ্দিদিয়া তরিকা বলা হয়। এটি মুলত বাহা-উদ-দিন নকশবন্দ বুখারী রহ. এর নকশবন্দিয়া তরিকার একটি গুরত্বপূর্ণ সংস্করণ। তাই একে নকশবন্দিয়া-মুজাদ্দিদিয়া তরিকাও বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক ইত্যাদি দেশে নকশবন্দিয়া মুজাদ্দিয়া তরিকার প্রচলন বেশি। তবে সকল মুসলিম দেশেই এই তরিকার অনুসারি দেখা যায়। বাংলাদেশে এই তরিকার সফল প্রচারক হযরত খাজা ইউনুস আলী এনায়েতপুরী।

মুহম্মদিয়া তরিকা

সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী রহ এই তরিকার ইমাম। এই তরিকা মুলত নকশবদ্দিয়া-মুজাদ্দিয়া তরিকা একটি শাখা। বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক দরবার শরীফ এই ছিলছিলার অনুসারি। ফুরফুরা, ছরছিনা, রাজারবাগ, ফরায়েজিকান্দি, সোনাকান্দা ইত্যাদি দরবার শরীফ এই ছিলছিলার অন্তর্ভূক্ত।

উম্মিয়া তরিকা

সমসাময়িক কালে প্রতিষ্ঠিত একটি তরিকা। এটি নকশবন্দিয়া-মুজাদ্দিয়া তরিকার সর্বশেষ সংষ্করণ। এতে তাসাউফ চর্চাকে অনেক সহজ করা হয়েছে।

বেকতাশিয়া তরিকা

তেরো শতকে ইসলামী সুফি সাধক বেকতাশ ভেলি বেকতাশি তরিকা প্রতিষ্ঠা করেন। পনের শতকে তরিকাটির প্রাথমিক পর্যায়ে হুরুফি আলী আল-আলা কর্তৃক ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল এবং ষোল শতকে বালিম সুলতান তরিকাটিকে পুর্নগঠন করেন।

মাদারিয়া তরিকা

মাদারিয়া তরিকা উত্তর ভারত, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশ, মেওয়াত অঞ্চল, বিহার, গুজরাত ও বাংলায় জনপ্রিয় এবং একইসাথে নেপালে ও বাংলাদেশেও জনপ্রিয় সুফি তরিকা। প্রচলিত প্রথা ভাঙা, বাহ্যিক ধর্মীয় অনুশীলনের উপর শিথীলতা এবং আত্ম যিকিরের উপর জোর প্রয়োগের করনে সুপরিচিত, এটি প্রখ্যাত সুফি সাধক সৈয়দ বদিউদ্দীন জিন্দা শাহ মাদার (মৃত্যু ১৪৩৩খ্রি:) কর্তৃক প্রবর্তিত সূফি তরিকা এবং উত্তরপ্রদেশের কানপুর জেলার মকানপুরে তার দরবার ( দরগাহ ) কেন্দ্রিক তরিকা। তিনি তেরো শতকে আশরাফ জাহাঙ্গীর সেমনাণী সহ ভারতে আগমন করেন।[১]

সুফিবাদের এই শাখা হজরত আলীর নিকট হইতে হজরত হাসান বসরী মারফত তাঁর শিষ্য খওয়াজা হাবিবে আজমী-এর সহিত সংযোগ সূত্র স্থাপন করে। খওয়াজা হাবিবে আজমীর নিকট হইতে তাঁর শিষ্য/মুরিদ বায়েজিদ বোস্তামী মারফত তৈয়ফুরিয়া প্রবর্তন হয়। তৈয়ফুরিয়া তরিকা থেকে শুরু করে, তাঁর পির বা আধ্যাত্মিক শিক্ষক বায়াজীদ তায়ফুর আল-বোস্তামি কর্তৃক প্রবর্তিত তৈয়ফুরিয়া তরিকা থেকে উৎপত্তি হয়ে মাদারীয়া তরিকা ১৫ থেকে ১৭ শতকের মাঝামাঝি মুগল আমলে বিশেষ গৌরব অর্জন করেছিল এবং শাহ মাদারের শিষ্যদের মাধ্যমে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা, বাংলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে এ নতুন তরিকা ছড়িয়ে পড়ে। বেশিরভাগ সুফি তরিকার মতই এটির প্রতিষ্ঠাতা মাদারের নামে একটি নিস্বাকে যুক্ত করে নির্মিত হয়েছে যা মাদারিয়া তরিকা নামে পরিচিত।

কুবরাইয়া তরিকা

কুবরাইয়া তরিকা তেরো শতকে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান উজবেকিস্তানের বুখারায় তরিকাটি প্রতিষ্ঠা করেন নাজমুদ্দীন কুবরা নামে একজন ইসলামিক সুফি সাধক। ১২২১ সালে মঙ্গোলরা বুখারাকে দখল করে নিয়েছিল, তারা এলাকাটির প্রায় মানুষকেই গণহত্যার মাধ্যমে হত্যা করেছিল। মঙ্গলদের দ্বারা নিহতদের মধ্যে শেখ নাদজম ইদ-দিন কুবরাও ছিলেন।

মেভলেভি বা মৌলভি তরিকা

মেভলেভি বা মৌলভি তরিকা (তুর্কি:Mevlevilik বা Mevleviyye; ফারসি:طریقت مولویه) কোনিয়ার (বর্তমানে তুরষ্কে) একটি সুফি তরিকা। ১৩শ শতাব্দীর কবি, আইনবিদ, ধর্মতাত্ত্বিক, অতীন্দ্রিবাদী ও সুফি জালালউদ্দিন রুমির অনুসারীরা তার মৃত্যুর পর এই তরিকা প্রতিষ্ঠা করেন। পশ্চিমা বিশ্বে এই তরিকার অনুসারীদেরকে ঘূর্ণায়মান দরবেশও বলা হয়।

মুরিদিয়া তরিকা

মুরিদিয়া তরিকা সেনেগাল ও গাম্বিয়ার অত্যন্ত সুপ্রসিদ্ধ সুবৃহৎ ইসলামি সুফি তরিকা। এই তরিকার মূল কেন্দ্র সেনেগালের তওবাতে, শহরটি এই তরিকার একটি তীর্থস্থান। আরবি শব্দ মুরীদ, যার অর্থ ইচ্ছাপোষণকারী, থেকে এই তরিকার নামকরণ করা হয়েছে। ১৮৮৩ সালে আমাদু বাম্বা সেনেগালে মুরিদিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠা করেন। সেনেগালের প্রায় ৪০% মানুষ মুরিদিয়া তরিকার অনুসারী।

রায্যাক্বীয়্যাহ্ তরিকা

রায্যাক্বীয়্যাহ্ তরিকা পৃথিবীর প্রাচীনতম সুফি তরিকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। রায্যাক্ব আলী গিলানীর (১০৯৩-১২০৮খৃঃ) নাম থেকে এই তরিকার নামকরণ করা হয়েছে। গিলান ইরানের একটি প্রদেশের নাম এবং এর অধিবাসীদের গিলানী বলা হয়ে থাকে। এই তরিকা ইসলামি বিশ্বে সর্বাধিক বিস্তৃততম সুফি তরিকাগুলো একটি এবং মধ্য এশিয়া, হিন্দুস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল এবং পূর্ব ও পশ্চিম দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে এই তরিকার অনুসারী রয়েছে। অনেকেই এই তরিকাকে "জালালী" তরিকা হিসেবে বিবেচনা করে থাকে, কারণ এই তরিকায় জিকির (স্রষ্ঠাকে স্মরণ করা) জালালতভাবে করা হয়ে থাকে যদিও অন্যান্য তরিকাগুলোতে উচ্চস্বরে বা হালকা উচ্চস্বরে জিকির করা হয়ে থাকে। ইসলামের মূলধারার বাইরে রায্যাক্বীয়্যাহ্ তরিকা কোন বিশেষ মতবাদ বা শিক্ষা গড়ে তোলেনি। এই তরিকার অনুসারীরা ইসলামের মৌলিক নীতিগুলিতে বিশ্বাস করে, কিন্তু আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সেই নীতিগুলোকে তারা ব্যাখ্যা করে। এই তরিকার বর্তমান মূল কেন্দ্র চট্টগ্রাম জেলার পাহাড়তলী থানার অন্তর্গত দরবারে, শহরটি এই তরিকার একটি তীর্থস্থান।

নি'মাতুল্লাহি তরিকা

নি'মাতুল্লাহি তরিকা পারস্যের সর্বাধিক বিস্তৃত সুফি তরিকার একটি। এটি শাহ নি'মাতুল্লাহ ওয়ালী (মৃত্য ১৩৬৭) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা মা'রুফিয়াহ ধারার উত্তরাধিকার থেকে প্রতিষ্ঠিত এবং রূপান্তরিত হয়েছিল। বর্তমানে এই তরিকার অনেকগুলো উপশাখা রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত ও প্রভাবশালী ড. জাবেদ নূরবখশের বংশধর যিনি ইরানে ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর পশ্চিমা বিশ্বকে এই তরিকার সাথে পরিচয় করান।

সেনুসি তরিকা

সেনুসি একটি ধর্মীয়-রাজনৈতিক সুফি তরিকা যা মুহাম্মদ ইবনে আলী-সেনুসসি কর্তৃক। মিশরীয় উলেমার সমালোচনার কারণে মুহাম্মদ ইবনে আলী-সেনুসি এই তরিকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মূলত মক্কাতে এই আদর্শের সূচনা হয়, তবে ওহাবীদের অত্যধিক চাপের কারণে আস-সেনুসি মক্কা ছেড়ে চলে যান এবং সাইরেইনিকায় বসতি স্থাপন করেন যেখানে তাকে সাদরে গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে ইদ্রিস বিন মুহম্মদ আল-মাহদী আস-সেনুসি সাইরেইনিকার আমির পদে অধিষ্ঠিত হন এবং লিবিয়ার রাজা পর্যন্ত হয়েছিলেন। মুয়াম্মার গাদ্দাফি তার এই রাজতন্ত্র বিলুপ করেন, কিন্তু লিবিয়ার এক তৃতীয়াংশ লোক এখনও নিজেকে সেনুসি বলে দাবি করেন।

শাযিলিয়া তরিকা

Shadhili

শাযিলিয়া তরিকা হল আবুল-হাসান-আশ-শাযিলি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সুফি তরিকা। এই তরিকার মুরিদরা (অনুসারী) প্রায়শ শাযূলিয়া নামে পরিচিত। ফাসিয়া তরিকা, শাযিলিয়া তরিকার একটি শাখা, মক্কার ইমাম আল ফাসি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই তরিকার অসংখ্য অনুসারী সৌদি আরব, মিশর, ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মরিশাস, ইন্দোনেশিয়া এবং অন্যান্য মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলিতে রয়েছে।

সোহরাওয়ার্দিয়া তরিকা

সোহরাওয়ার্দিয়া হল সুফি আবুল নাজিব সোহরাওয়ার্দি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সুফি তরিকা। তার ভাতিজা শাহাব আল-দীন আবু হাফস উমর সোহরাওয়ার্দী দ্বারা বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল।

তিজান্যিয়া তরিকা

তিজান্যিয়া তরিকা শিক্ষা ও সংস্কৃতির উপর গুরুতারোপ করেছে এবং শিষ্যদের মধ্যে একে অপরের সাথে পারষ্পরিক সম্পর্কের উপরের জোর দিয়েছে।

মাইজভাণ্ডারী তরিকা

মাইজভাণ্ডারী তরিকা সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি সুফি তরিকা।এটি বাংলাদেশে সৃষ্ট একমাত্র তরিকা। এই তরিকা মূল নাম তরিকায়ে গাউছিয়া আহমদিয়া মাইজভান্ডারীয়া। এই তরিকা মূল বিষয় হচ্ছে প্রেমের মাধ্যমে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ। সৈয়দ আহমদ উল্লাহ হযরত বড়পীর সৈয়দ আব্দুল কাদের জিলানীর বংশধর ও উক্ত তরিকার খেলাফত প্রাপ্ত সৈয়দ আবু শাহামা মুহাম্মদ ছালেহ আল কাদেরী লাহোরী নিকট বায়েত গ্রহণের মাধ্যমে বেলায়ত অর্জন করেন এবং সৈয়দ দেলওয়ার আলী পাকবাজ এর নিকট হতে এত্তাহাদী কুতুবিয়তের ক্ষমতা অর্জন করেন। বিশ্বের অনেকগুলো দেশে এই তরিকার অনুসারী রয়েছে।এ ত্বরিকার প্রাণপুরুষ গাউছুল আযম শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ(ক) মানবজাতির কল্যাণে সপ্তকর্ম পদ্ধতি তথা উসুলে সাব'য়া প্রদান করে যান। যা তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকারী সৈয়দ দেলাওয়ার হোসাইন মাইজভাণ্ডারী জনসমাজের কল্যাণে বিস্তারিতভাবে তাঁর লেখনিতে লিখে যান।এই সপ্তকর্ম অনুসরণে যে কোন মানুষ প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনে সফল হবে।এমন পদ্ধতি ইতোমধ্যে কোন ত্বরিকায় প্রদান করা হয়েছে বলে মনে হয় না।

এছাড়া মাদারিয়া, আহমদীয়া, কলন্দরিয়া, রাহে ভান্ডার নামে আরও কয়েকটি তরিকার উদ্ভব ঘটে।

য়ার্সী (ওয়ারেছী) তরিকা

মূল নিবন্ধঃ ওয়ার্সী ওয়ারেছী

হযরত হাজী হাফেজ সাইয়্যাদ ওয়ারেছ আলী শাহ্ আল হোসাইনী (রঃ)। তিনি  হযরত সাইয়্যাদ ইমাম হোসাইন (রাঃ) এর ২৬ তম মতান্তরে ২৮ তম বংশধর।তিনি চিশতিয়া ও কাদেরিয়া তরিকার সমন্বয়ে ওয়ারেছী তরিকা প্রবর্তন করেন।  এই তরিকার মূল বাণী সৃষ্টি কর্তার সঙ্গে "ইশক" বা প্রেম।  ভারত উপমহাদেশ সহ বিশ্বের প্রায় ১০ টার মত দেশে তিনি তার তরিকা প্রাচার করে গেছেন। ভারতের উত্তর প্রদেশের বারাবাংকিতে তার মাজার অবস্থিত। তাকে ১৯ শতকের শ্রেষ্ঠ ওলী বলা হয়।

সুফি তরিকাসমূহের সাথে সম্পর্কিত প্রতীকসমূহ

প্রাপ্তি

ইসলামের বাইরে উপলব্ধি

ইহুদিধর্মে প্রভাব

প্রাচ্যের ধর্মসমূহের সাথে সাদৃশ্য

আবু বকর মুহাম্মাদ জাকারিয়া তার হিন্দুসিয়াত ওয়া তাসুর বইতে বলেন, আরব ও পাশ্চাত্য বহু একাডেমিকের মতে, ইবনে আরাবী, জালালুদ্দিন রুমি, বায়োজিদ বোস্তামি, আব্দুল কাদির জিলানি, মনসুর হাল্লাজ সহ আরও বহু প্রাথমিক সময়ের সুফি সাধক ইন্দো ইউরোপীয় অর্থাৎ ভারতীয়, ইরানীয় ও পাশাপাশি গ্রিক ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মদর্শনের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত ছিলেন, এই দাবির পক্ষে যেসব একাডেমিক, তারা হলেন, আল বিরুনি, ইহসান ইলাহী জহির, আনওয়ার আল-জুন্দি, উইলিয়াম জোন্স, আলফ্রেড ক্র্যামার, রোজেন, গোল্ডজিহার, মোরেনো, রবিন হর্টন, মনিকা হর্স্টমান, রেনোল্ড নিকোলসন, রবার্ট চার্লস জাহনার, ইবনে তাইমিয়া, মুহাম্মদ জিয়াউর রহমান আজমী ও আলি জায়ুর।

হিন্দুধর্মের মতো সুফিগণও পুনর্জন্মকে তানাসুখ নামে সমর্থন করে থাকে। আল বিরুনি তার তাহক্বীক মা লিলহিন্দ মিন মাকুলাত মাকুলাত ফী আলিয়াক্বল'আম মারযুলা (ভারতের বক্তব্য নিয়ে সমালোচক গবেষণাঃ যৌক্তিকভাবে গ্রহণীয় নাকি বর্জনীয়) বইয়ে হিন্দুধর্মের কয়েকটি বিষয়ের সঙ্গে সুফিবাদের মিল দেখিয়েছেন, আত্মার সাথে রুহ, তানাসুখের সাথে পুনর্জন্ম, ফানাফিল্লাহর সঙ্গে মোক্ষ, ইত্তিহাদের সাথে জীবাত্মায় পরমাত্মায় মিলন, হুলুলের সাথে নির্বাণ, ওয়াহদাতুল উজুদের সাথে বেদান্ত, সাধনার সঙ্গে মুজাহাদা।

জার্মান বংশোদ্ভূত ভারতবিদ মনিকা বোহ'ম-তেতেলবাখ বা মনিকা হর্স্টম্যান দাবি করেন যে, পাচটি যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করা যায় যে সুফিবাদের উৎস হল ভারত ও হিন্দুধর্ম, যেগুলো হলোঃ প্রথমত, অধিকাংশ প্রাথমিক সুফি ছিল অনারব, যেমন ইব্রাহিম বিন আদহাম, ও শাকিক আল বলখি, বায়েজিদ বোস্তামি, ইয়াহিয়া ইবনে মুয়ায আল-রাযী, দ্বিতীয়ত, সুফিবাদ প্রথম উৎপত্তি ও বিকাশ লাভ করে ভারতের নিকটবর্তী ইরানের বর্তমান খোরাসান (পূর্বনাম পার্থিয়া, যাকে গ্রিকরা ডাকতো আরিয়ানা বা আর্যদের অঞ্চল নামে) প্রদেশে, তৃতীয়ত, ইসলাম আগমনের পূর্বে ইরানের পার্শ্ববর্তী তুর্কিস্তান ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ধর্ম ও সংষ্কৃতির মিলনকেন্দ্র, চতূর্থত, মুসলিমরা নিজেরাই তাদের ধর্মে ভারতীয় প্রভাবের কথা স্বীকার করে, পঞ্চমত, প্রথম সুফিবাদ বা ইসলামী রহস্যবাদ এর অভ্যাস ও পদ্ধতির দিক থেকে ভারতীয় ছিল, কোন কারণ ছাড়াই নিজেকে পূর্ণরূপে সপে দেওয়া এবং নিজেদের সফরকে নির্জনতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য রহস্যবাদকে ব্যবহার করা এবং একে মহিমান্বিত করে তাকে ব্যবহার করা হল মূলত ভারতীয় মতবাদ হতে উৎপন্ন।

ওয়াহদাত আল-উজুদের সূফী ধারণা অদ্বৈত বেদান্তে দাবি করা বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির কাছাকাছি। জিয়াউর রহমান আজমি দাবি করেন, ওয়াহাদাতুল উজুদের উৎপত্তি হিন্দুধর্মের বেদান্ত দর্শন থেকে, যা ইবনে আরাবি ভারত সফরের পর তার মক্কা বিজয় গ্রন্থে লিখেছেন, যা খলীফা আল মামুনের শাসনামলে আরবিতে অনূদিত হয় এবং মনসুর হাল্লাজ অসংখ্যবার ভারত সফরের সময় বিভিন্ন গ্রন্থে এই ধারণার কথা লিখেছেন। ভারত সফরের পর বাগদাদে ফিরে হাল্লাজ ধ্যানরত অবস্থায় বলতেন, أنا الحق("আনাল্ হাক্ক") "আমিই পরম সত্য", যা তিনি নিয়েছিলেন ভারত ভ্রমণের সময় মহাবাক্য দর্শনের একটি বাক্য "অহম ব্রহ্মাস্মি" থেকে।

সুফি ধর্মবিদ মার্টিন লিংস বলেছেন,

রাজকুমার দারা শিকো (মৃত্যু ১৬১৯) ছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহানের সুফি মতাবলম্বী পুত্র। তিনি বলেছিলেন, সুফিবাদ ও হিন্দুদের অদ্বৈত বেদান্তের মধ্যে শুধু পারিভাষিক পার্থক্য ছাড়া বাকি সবই এক।

সুফিবাদের মুরাকাবাকে হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের ধ্যানের সাথে তুলনা করা হয়। গোল্ডজিহার ও নিকোলসন মনে করেন যে, সুফিরা তাদের জুব্বা পরার রীতি বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছে, যাকে সুফিরা ইসলামী নবী মুহাম্মাদের আদর্শ বলে দাবি করে থাকে।

সুফি ইসলামে ফানার ধারণাকে হিন্দুধর্মের সমাধির সাথে তুলনা করা হয়েছে।

বায়েজিদ বোস্তামী ইসলামের সুফি সংস্করণে মোক্ষ ও নির্বাণ তত্ত্বকে বাক্বা নামে আমদানি করেছেন।

হিন্দুধর্মের ভক্তিবাদ, ইন্দো-ইউরোপীয় বৈরাগ্যবাদ ও আঞ্চলিক মুনি, ঋষি, ফকির তথা বাউল দর্শন সুফি মতবাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট।

ভারতে মুসলিম সুফির পাশাপাশি হিন্দু সুফি সাধকগণও বিদ্যমান রয়েছে।

জিয়াউর রহমান আজমী ইসলাম সম্পর্কে হিন্দুদের নেতিবাচক ধারণার কারণ হিসেবে বলেন,

আমার দৃষ্টিতে হিন্দুরা রিসালাতের বাস্তবতা ও তাওহিদের মর্মবাণী না বোঝাটাই মুসলমানদের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব ও বিদ্বেষের মূল কারণ। কেননা, মুসলমানদের মধ্যে যারা হিন্দুত্ব-প্রভাবিত সুফিবাদের সাধনা করেছে, তারা ইসলামের সঠিক আকিদা বিকৃত করে ছেড়েছে—যেসব আকিদা কুরআন সুন্নাহের আলোকে সাহাবি ও তাবেয়িগণ লালন করতেন। আর যে আকিদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল আর তাঁর পথেই চলেছিলেন শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া ও তাঁর পরবর্তী আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ইমামগণ। উপরন্তু এ সুফিগণ ইসলামি আকিদার সঙ্গে মূর্তিপূজার বিশ্বাসের মিশ্রণ ঘটিয়েছে। এর বড় প্রমাণ, ভারতজুড়ে বহু কবরের ওপর নির্মিত সমাধিসমূহ ও এসবকে কেন্দ্র করে সংঘটিত তাওয়াফ, সিজদা ও সাহায্যপ্রার্থনার মতো কুফরি কর্মকাণ্ড। এসব কাজ মূলত হিন্দুরা করে থাকে তাদের মন্দিরকে কেন্দ্র করে। এর পাশাপাশি হিন্দু লেখকদের ইসলাম ও ইসলামি ধর্মবিশ্বাস নিয়ে রটানো মিথ্যাচার ও প্রোপাগান্ডাসমূহও এর জন্য সমানভাবে দায়ী। তারা ব্যাপক মিথ্যাচার ছড়িয়েছে আমাদের ইতিহাস ও রাসুল ﷺ -এর জীবনচরিত নিয়ে। হিন্দু শাস্ত্রের প্রাথমিক একজন শিক্ষার্থী ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি বিরূপ ধারণা নিত্রেই তার অধ্যয়ন শুরু করে। তাই ভারতের মুসলমানদের জন্য উচিত, তাঁদের ধর্মীয় মৌলিক গ্রন্থগুলো স্থানীয় ভাষায় ব্যাপক অনুবাদে প্রয়াসী হওয়া। অন্যদিকে মুসলমানরা প্রায় আট শতক ধরে ভারতবর্ষ শাসন করেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে আল্লাহর বিশেষ তাওফিকপ্রাপ্তদের ছাড়া সাধারণত এমন খুব বেশি শাসকের দেখা মেলেনি, যারা তাদের অধীন হিন্দু জনসাধারণের মধ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিতে কোনো উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বরং পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে দাড়িয়েছিল যখন তাদের উদ্যোগে বেদ, গীতা ও রামায়ণের মতো হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলো আরবি ও ফারসিভাষায় অনূদিত হয়েছিল; যেখানে তারা কুরআন,হাদিস, সিরাত ও ইসলামি ধর্মবিশ্বাসের বিবরণ সংবলিত মৌলিক ও বিশুদ্ধ গ্রন্থাবলি সংস্কৃতসহ অন্যান্য স্থানীয় ভাষায় অনুবাদের ব্যাপারে উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন। এমনকি আজ অবধি হিন্দি ভাষায় কুরআনের নির্ভরযোগ্য বিশুদ্ধ কোনো অনুবাদ রচিত হয়নি। আমি কয়েকটি গ্রন্থাগারে কুরআনের হিন্দি অনুবাদের তথ্য পেয়ে তা পড়ে দেখেছি, যা ততটা সূক্ষ্মতার সঙ্গে। অনুবাদ করা হয়নি। তাই এসবের পুনঃনিরীক্ষণ করা উচিত। সবচেয়ে ভালো হবে আকিদা ও আত্মশুদ্ধির অঙ্গনে সুপরিচিত কোনো আলিমের তত্ত্বাবধানে নতুনভাবে এর অনুবাদ সম্পন্ন করা।

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে

সংগীত

২০০৫ সালে, রবি শেরগিল বুল্লে কি জানা নামে একটি সুফি রক গান প্রকাশ করেন, যা ভারত ও পাকিস্তানের জনপ্রিয় গানের তালিকার শীর্ষ উঠে আসে।

সাহিত্য

তের শতকের ফার্সি ভাষার কবি রুমিকে সুফি জগতের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আল্লামা রুমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক পঠিত কবিদের অনত্যম। রুমির রচনাসমূহ অনুবাদ করে তা প্রকাশে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে কলেম্যান বার্কস।ইরানি শামস তাবারিজির সাথে রুমির আধ্যাত্মিক সর্ম্পক নিয়ে ইলিফ শাফাক দি ফর্টি রুলস অব লাভ নামে একটি উপন্যাসও লিখেন।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ উর্দু ভাষার কবি আল্লামা ইকবাল দি রিকনস্ট্র্যাকশান অব রিলিজিয়াস থট ইন ইসলাম (ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন) নামক ইংরেজি গ্রন্থে সুফিবাদ, দর্শন এবং ইসলাম নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা করেছেন।

চিত্রশালা

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

পাদটীকা

সূত্র তালিকা

বহিঃসংযোগ


Tags:

সুফিবাদ সংজ্ঞাসুফিবাদ শব্দতত্ত্বসুফিবাদ ইতিহাসসুফিবাদ নির্যাতনসুফিবাদ প্রধান সূফি তরিকাসমূহসুফিবাদ সুফি তরিকাসমূহের সাথে সম্পর্কিত প্রতীকসমূহসুফিবাদ প্রাপ্তিসুফিবাদ জনপ্রিয় সংস্কৃতিতেসুফিবাদ চিত্রশালাসুফিবাদ আরও দেখুনসুফিবাদ তথ্যসূত্রসুফিবাদ বহিঃসংযোগসুফিবাদআরবিইসলামতাজকিয়া

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

নিরাপদ যৌনতাশিশ্ন-মুখমৈথুননেপোলিয়ন বোনাপার্টবদরের যুদ্ধলা লিগাতরমুজঅরবরইহনুমান (রামায়ণ)জিএসটি ভর্তি পরীক্ষাপশ্চিমবঙ্গবাংলাদেশ রেলওয়েহামখাদ্যগ্রীষ্মস্ক্যাবিসবাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, ২০২৩আলাউদ্দিন খিলজিএ. পি. জে. আবদুল কালামআর্দ্রতামৌলিক পদার্থের তালিকামরুভূমিরমনদীপ সিং (ভারতীয় ক্রিকেটার)জানাজার নামাজসাদিকা পারভিন পপিপ্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (বাংলাদেশ)বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজসমূহের তালিকাঅশ্বত্থমোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনআবুল কাশেম ফজলুল হকবাস্তুতন্ত্রজলবায়ু পরিবর্তনের রাজনীতিভারতের ইতিহাসদীপু মনিইন্ডিয়ান সুপার লিগএল নিনোবাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রের তালিকাবাংলাদেশের জাতীয় পতাকাগঙ্গা নদীব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাছয় দফা আন্দোলনকুষ্টিয়া জেলাবাংলা একাডেমিআকিজ গ্রুপবাংলাদেশের পোস্ট কোডের তালিকামহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রবল্লাল সেনভারত বিভাজনহযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরবাইসনদারাজপরমাণুযুক্তরাজ্যকাশ্মীরমদিনার সনদশ্রীকৃষ্ণকীর্তনমালয়েশিয়ার ইতিহাসচাহিদার স্থিতিস্থাপকতামার্ক জাকারবার্গফুটবল ক্লাব বার্সেলোনাভীমরাও রামজি আম্বেদকরমিয়ানমাররাজনীতিস্মার্ট বাংলাদেশবীর শ্রেষ্ঠশ্রীলঙ্কাসন্ধিআতাবঙ্গবন্ধু-১নিউটনের গতিসূত্রসমূহব্রিটিশ রাজের ইতিহাসপাণ্ডু রাজার ঢিবিবাংলাদেশের ইউনিয়নমৌলিক পদার্থঢাকা কলেজফেসবুকভাষাইতিহাসজায়েদ খান (বাংলাদেশী অভিনেতা)২০২১–২২ ওয়েস্ট ইন্ডিজ নারী ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফর🡆 More