ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী: দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠী

ত্রিপুরী বা তিপ্রা হলো ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে উদ্ভূত একটি জাতিগোষ্ঠী । তারা উত্তর-পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশের টুইপ্রা/ত্রিপুরা রাজ্যের বাসিন্দা । মাণিক্য রাজবংশের মাধ্যমে ত্রিপুরী জনগণ বহু বছর ধরে ত্রিপুরা রাজ্য শাসন করেছে যতক্ষণ না রাজ্যটি ১৫ অক্টোবর ১৯৪৯ -এ ভারত অধিরাজ্যে যোগ দেয়।

ত্রিপুরী/তিপ্রা জাতি
ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী: ইতিহাস, ভাষা, ধর্ম
ত্রিপুরার রাজকীয় পতাকা
ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী: ইতিহাস, ভাষা, ধর্ম
ঐতিহ্যবাহী পোশাকে ত্রিপুরী মেয়ে
মোট জনসংখ্যা
১২ লাখ (২০১১)
উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অঞ্চল
ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী: ইতিহাস, ভাষা, ধর্ম ভারত১,০১১,২৯৪
           ত্রিপুরা৯৫০,৮৭৫
           মিজোরাম৩২,৬৩৪
           আসাম২২,৮৯০
           মেঘালয়২,৭৩৫
           নাগাল্যান্ড৩৫০
           গুজরাট২৩৯
           মনিপুর২০৮
           জম্মু ও কাশ্মীর১৯০
           রাজস্থান১৬৯
           পশ্চিমবঙ্গ১২০
           মহারাষ্ট্র১১৮
           কর্ণাটক১১৪
ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী: ইতিহাস, ভাষা, ধর্ম বাংলাদেশ১৫৬,৫৭৮ (২০২১)
ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী: ইতিহাস, ভাষা, ধর্ম মায়ানমারঅজানা
ভাষা
ককবরক ভাষা
ধর্ম
সংখ্যাগরিষ্ঠ:
হিন্দুধর্ম
সংখ্যালঘু:
খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম এবং বৌদ্ধধর্ম
সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী

ইতিহাস

১৯০৩-এ ভারতের ভাষা সমীক্ষা রিপোর্ট
ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী: ইতিহাস, ভাষা, ধর্ম 
রিগনাই মহিলাদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক

ত্রিপুরীরা ত্রিপুরার আদিবাসীদের নিজস্ব অনন্য এবং স্বতন্ত্র সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ইতিহাস রয়েছে। তারা দক্ষিণে চট্টগ্রাম বিভাগ পর্যন্ত, পশ্চিমে কুমিল্লানোয়াখালী (ব্রিটিশ আমলে 'সমভূমি টিপরাহ' নামে পরিচিত) এবং যতদূর উত্তরে সিলেট বিভাগ পর্যন্ত (বর্তমান বাংলাদেশে ) তাদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল।) ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশের নিয়ন্ত্রণ না নেওয়া পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম টিপরাহ রাজ্যের অংশ ছিল। ১৫১২ সালে, মুঘলদের পরাজিত করার সময় টিপরারা তাদের আধিপত্যের শীর্ষে ছিল। শাসক রাজবংশটি ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কাল অতিক্রম করেছে এবং ১৮ শতক পর্যন্ত কয়েক শতাব্দী ধরে ত্রিপুরা শাসন করেছে, তারপরে সমতল টিপরা ব্রিটেনের একটি উপনিবেশে পরিণত হয়েছে এবং পার্বত্য টিপেরা একটি স্বাধীন রাজকীয় রাজ্য হিসেবে রয়ে গেছে । ১৪ অক্টোবর ১৯৪৯ সালে, পার্বত্য টিপ্পারা ত্রিপুরা রাজ্য হিসাবে সদ্য স্বাধীন ভারতে একীভূত হয়।

ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে চার ধরনের মত প্রচলিত আছে। প্রথমত, রাজমালাসহ সমসাময়িক গ্রন্থাদি মতে মহাভারত যুগে রাজা যযাতি নামে একজন পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন। রাজা যযাতির অবাধ্য পুত্র দ্রুহ্য পিতা কর্তৃক স্বীয় রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে গঙ্গা ও সাগরের সঙ্গমস্থল ‘সাগর দ্বীপে’ নির্বাসিত হন। রাজা দ্রুহ্যের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দৈত্যরাজ সিংহাসন আরোহণ করেন। মহারাজা দৈত্যের পুত্রের নাম ত্রিপুর। এই রাজা ত্রিবেগ থেকে উত্তর পূর্ব দিকে ধাবিত হয়ে কিরাত রাজ্য অধিকার করেন এবং ত্রিবেগ ও কিরাত জনজাতির মাঝে মহামিলন ঘটান। ত্রিপুর রাজা তাঁর বিজিত রাজ্যের নামকরণ করেন ত্রিপুরা এবং প্রজাদের নামকরণ করেন ত্রিপুর জাতি। দ্বিতীয়ত, ত্রিপুরী ঐতিহাসিকদের অনেকে মনে করেন অতীতে বর্মণক (আরাকান), চট্টল (চট্টগ্রাম) ও কমলাঙ্ক (কুমিল্লা) এই তিনটি প্রদেশ সমন্বয়ে ত্রিপুরা রাজ্য ছিল এবং উল্লিখিত তিনটি প্রদেশে বৃহৎ তিনটি পুর (নগর) ছিল এবং এই থেকে ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি হয়েছিল। তৃতীয়ত, ত্রিপুরীগণের মাতৃভাষার নাম ‘কক বরক’। কক বরকে পানি বা নদীকে বলা হয় ‘তোয়’।

আর মোহনাকে বলে ‘প্রা’। তোয় ওপ্রা শব্দ থেকে ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি। চতুর্থত, বিষ্ণু পুরাণ গ্রন্থে আছে ভারত সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রান্তরে কিরাতের বাস। কামরূপ (আসাম) ও রাক্ষ্যাং (আরাকান) প্রদেশের মধ্যবর্তী ভূ-ভাগকে আর্যরা সুম্ম বা সুহ্ম নামে আখ্যায়িত করেন। টিবেটো বর্মণ শান বংশীয় জনগোষ্ঠী সেখানে শক্তিশালী রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। এই রাজ্যটিই মহাভারত গ্রন্থে ত্রৈপুরা, কখনো বা ত্রৈপুরী নামে আখ্যায়িত হয়। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ৬২০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ভারত ভ্রমণ বিবরণীতে সমুদ্র উপকূলবর্তী সমতট (বঙ্গদেশ) নামক দেশের উত্তর পূর্বে ত-ল-পো-তি (To-lo-po-ti) নামে একটি রাজ্যের উল্লেখ করেছেন, যাকে ত্রিপুরার সমার্থক বলে মনে করা যেতে পারে। নির্ভরশীল তথ্যের অভাবে কোন মতকেই গ্রহণও করা যায় না, আবার বর্জনও করা যায় না। তবে এটা সত্যি যে, ত্রিপুরা একটি অতি পুরনো রাজ্য।

ত্রিপুরীরা নিজেদের চন্দ্রবংশোদ্ভুত ক্ষত্রিয় কুলজাত বলে দাবি করেন। নৃতাত্ত্বিক বিচারে ত্রিপুরা জাতি মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভুত। মঙ্গোলীয়রা প্রায় ৫ হাজার বছর আগে মঙ্গোলিয়া থেকে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে আগমন করেছিল। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর একটি অংশ পরিচিত ছিল বোডো (Bodo) বা বরো (Boro) নামে। পূর্ব ভারতে আর্যদের আগমনের পূর্বে এই বোডো বা বরো জনজাতি এখানে আধিপত্য কায়েম করেছিল। রামায়ণ ও মহাভারত সূত্রে জানা যায় ভারতবর্ষের উত্তর পূর্বাঞ্চল রাজ্যসমূহ বোডো বা বরো জনজাতির নৃপতি কর্তৃক শাসিত হতো। আর্যগণ তাদেরকে কিরাত, দানব ও অসুর নামে আখ্যায়িত করতো। এই বোডো বা বরো জনজাতির একটি শক্তিশালী দল গঙ্গানদী, শীতলক্ষা, ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী নদীর অববাহিকার বিস্তৃর্ণ ভূ-খণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।

ভাষা

ত্রিপুরী লোকেরা ককবরক (ত্রিপুরী নামেও পরিচিত), একটি তিব্বত-বর্মন ভাষাতে কথা বলে। ত্রিপুরী হল ভারতের ত্রিপুরার সরকারি ভাষা। ত্রিপুরায় ত্রিপুরীর উপভাষার দশ লাখের ও বেশি ভাষাভাষী এবং ভারতের মিজোরামআসামে রাজ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রামেফেনীতে কিছু মানুষের কাছে প্রচলিত।

ত্রিপুরীর তিনটি প্রধান উপভাষা রয়েছে, যদিও রাজপরিবারের কেন্দ্রীয় উপভাষা, দেববর্মা (পুরাতন ত্রিপুর), প্রত্যেকের দ্বারা বোঝা একটি মর্যাদাপূর্ণ উপভাষা। এটি শিক্ষা এবং সাহিত্যের জন্য আদর্শ। এটি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম এবং স্নাতক স্তর পর্যন্ত বিষয় হিসাবে পড়ানো হয়।

ঐতিহাসিকভাবে, ত্রিপুরী ভাষাটি ত্রিপুরী লিপিতে লেখা হয়েছিল যা কোলোমা নামে পরিচিত, ত্রিপুরীর প্রাচীনতম লেখাটি খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দী থেকে এবং এটি কোলোমা ভাষায় লেখা হয়েছিল। লিপিটি পূর্ব নাগরী লিপির উপর ভিত্তি করে একটি বর্ণমালা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। বর্তমানে প্রাচীন কোলোমা লিপির পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

পণ্ডিতদের দ্বারা রচিত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ত্রিপুরী ঐতিহাসিক সাহিত্যকর্মগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • "রাজরতনাকর", ত্রিপুরী রাজাদের রাজকীয় ইতিহাস
  • রাজমালা , ত্রিপুরার ত্রিপুরী রাজাদের ইতিহাস

ধর্ম

ত্রিপুরীদের মধ্যে ধর্ম

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, ৯৩.৬০% ত্রিপুরী লোক হিন্দুসিম এবং ত্রিপুরী লোকধর্মের সংমিশ্রণ অনুসরণ করে এবং ৬.৪% ত্রিপুরী জনগণ খ্রিস্টান (অধিকাংশ ব্যাপ্টিস্ট)। ত্রিপুরীর উচাই গোষ্ঠীতে কিছু বৌদ্ধ রয়েছে।

গোষ্ঠীগত সাদৃশ্য

মাণিক্য রাজতন্ত্রের সময় ত্রিপুরী সম্প্রদায় প্রধানত পাঁচটি গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত, যা একসাথে "পঞ্চ ত্রিপুরী" নামে পরিচিত।

প্রধান ত্রিপুরী গোষ্ঠী হল:

  • দেববর্মা (Debbarma)
  • ত্রিপুরা (Tripura)
  • জামাতিয়া (Jamatia)
  • রিয়াং বা ব্রু (Reang/Riang/Bru)
  • নোয়াতিয়া (Noatia)
  • কোলোই (Kalai/Koloi)
  • মুরাসিং (Murasing)
  • রূপিনী (Rupini)
  • উসই/উচই (Usoi/Uchoi)

ঐতিহ্য ও সমাজ

ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী: ইতিহাস, ভাষা, ধর্ম 
রিগনাই মহিলাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক
ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী: ইতিহাস, ভাষা, ধর্ম 
ঐতিহ্যবাহী পোশাকে ত্রিপুরা মেয়েরা

এই আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি স্ব-নিয়ন্ত্রণের ধারণার উপর ভিত্তি করে তাদের ঐতিহ্যগত স্বাধীনতা উপভোগ করে। রাজা এবং প্রজা সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক ছিল ত্রিপুরা-মিসিপের মহারাজা (রাজা) বা লিয়াজোন অফিসার রায় বা সম্প্রদায়ের প্রধান - সরদার গ্রামের প্রধান - ব্যক্তি হিসাবে। আগে ত্রিপুরী ক্ষত্রিয় গোষ্ঠীর মধ্যে শুধুমাত্র দেববর্মা বা টিপরা নৃ-গোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত ছিল । পরবর্তীতে, রাজা তার অঞ্চলের অধীনস্থ জনগণের মধ্যে দয়ার অনুভূতি জাগানোর প্রয়াসে অন্যান্য গোষ্ঠী যেমন রেয়াং , জামাতিয়া এবং নোয়াটিয়াকেও অন্তর্ভুক্ত করেন।

ত্রিপুরী জনগণের একটি সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে যা মূল ভূখণ্ডের ভারতীয়দের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের স্বাতন্ত্র্যসূচক সংস্কৃতি - যেমন তাদের নাচ, সঙ্গীত, উত্সব, সম্প্রদায় বিষয়ক ব্যবস্থাপনা, পোশাক এবং খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে প্রতিফলিত হয় - একটি শক্তিশালী ভিত্তি রয়েছে। ককবরক , আদিবাসী ত্রিপুরীদের ১২টি বৃহত্তম ভাষাগত গোষ্ঠীর লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা এবং ত্রিপুরায় কথিত অন্যান্য উপভাষাগুলি তিব্বত-বর্মন গোষ্ঠীর এবং ভারতে কথিত উপভাষাগুলির থেকে আলাদা। উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের অন্যান্য লোকেদের দ্বারা কথিত কোন প্রভাব নেই।

ত্রিপুরা জাতির সামাজিক কাঠামো পিতৃতান্ত্রিক। পিতাই পরিবারের প্রধান এবং তার অবর্তমানে জ্যেষ্ঠ পুত্র পরিবারের কর্তা হন। এক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রমও দেখা যায়। কোন কোন গোত্রে কন্যা সন্তানদের মাতৃবংশ পরিচয়ে পরিচিত হতে দেখা যায়।

ত্রিপুরাদের জনজীবনে দু’ধরনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রচলিত, যথা দাহক্রিয়া ও শ্রাদ্ধক্রিয়া এবং তারা নারী ও পুরুষের জন্যে দু’ধরনের শ্মশান তৈরি করে থাকে।

বিবাহ

ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী: ইতিহাস, ভাষা, ধর্ম 
ঐতিহ্যবাহী পোশাকে ত্রিপুরী দম্পতি

ত্রিপুরাদের বিয়ে রীতি সাধারণত তিন ধরনের: (১) কাইজারাই কৌচাং বা প্রজাপত্য বিয়ে (২) কাইজালাই বচং বা গন্ধর্ব বিয়ে এবং (৩) কাইজালাই কুসুর বা অসুর বিয়ে। ত্রিপুরী জনজীবনে দুই পদ্ধতিতে বিয়ের অনুষ্ঠানাদি সম্পাদন করা হয়ে থাকে: তান্ত্রিক পদ্ধতি, বৈদিক পদ্ধতি। তান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিয়ে উপলক্ষে দুটি পূজানুষ্ঠান করা হয়ে থাকে। এ দুটি পূজানুষ্ঠানের নাম ‘চুমলাই পূজা’ ও ‘কাথারক পূজা’। ত্রিপুরা সমাজে সকল গোত্রের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক সিদ্ধ। তবে রক্ত সম্পর্কীয় তিন পুরুষের মধ্যে বিবাহ বন্ধন নিষিদ্ধ।

বৈদিক পদ্ধতিতে পুরোহিত সমগ্র বিয়ে কার্যাদি পরিচালনা করে থাকেন। এ পূজানুষ্ঠানের অধিদেবতার নাম ‘প্রজাপতি’ আর এ কারণে ত্রিপুরীদের বিয়ে সম্পর্কিত নিমন্ত্রণ পত্রের উপরে ‘শ্রী শ্রী প্রজাপত্রয়ে নম:’ এই বাক্যটি উৎকীর্ণ থাকে।

বিশেষ কোনো কার্য উপলক্ষে আয়োজিত ভোজানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য আয়োজক কর্তৃক আহবান করাকে ‘নিমন্ত্রণ’ বলে। ত্রিপুরী জনজীবনে নিমন্ত্রণ সংস্কৃতিকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। যে ভোজানুষ্ঠানের সাথে আনন্দ, উচ্ছ্বাস, অনুপ্রেরণা ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে ত্রিপুরা ভাষায় এমন ভোজানুষ্ঠানকে ‘পানা’ বলে। যেমন জন্মবার্ষিকী ও বিবাহঅনুষ্ঠান। আর যে ভোজানুষ্ঠানের সাথে দুঃখ, বেদনা, শোক বিরহ নিহিত রয়েছে এমন ভোজানুষ্ঠানকে ‘সামৌং’ বলে।

উৎসব ও অনুষ্ঠান

লোক নৃত্যে ত্রিপুরাদের রয়েছে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্যের মধ্যে সিমতুং, কাথারক, সাকচরাই, চুমলাই, কেরপূজা, গোমতী, নাইরাং, হাচুকমা, সিবরাই, জুয়াংফা, সাকাল, গড়িয়া, হজাগিরি, লেবাং, মামিতা, ত্রিপুরেশ্বরী, মাইখুলুম, হাবা, খুমকামŠং, অনজালা উল্লেখযোগ্য। ত্রিপুরীদের রয়েছে বৈচিত্র্যমন্ডিত উৎসব ও পূজা পার্বণ। প্রধান উৎসব ও পূজা হলো: বৈসু, কের, গোমতী, সিবরাই, খাচী, হাকা। প্রধান উৎসবের নাম বৈসু। ত্রিপুরাব্দ, মগাব্দ ও বঙ্গাব্দ এই তিনটি বর্ষপঞ্জিকাই সৌরবর্ষ। ত্রিপুরীদের বৈসু উৎসবে যে অনুষ্ঠান করার রীতি রয়েছে তার পুরোটাই প্রকৃতি জগতের রূপ-রসের ব্যঞ্জনায় পুষ্ট। এছাড়া দুর্গা পূজা, কালী পূজা, অশোকতমী এবং চন্দ্রদশা দেবীর পূজা গুরুত্বপূর্ণ উৎসব।

ত্রিপুরীদের জীবন ও জীবিকা, আচার আচরণে গীতি নৃত্য ও বাদন অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে জড়িয়ে আছে। লোকাচারে কোন ত্রিপুরা যখন বিবাহের অনুষ্ঠান করে তখন তাকে অবশ্যই গীতি বাদ্য ও নৃত্য সহকারে অনুষ্ঠান সম্পাদন করতে হয়। এমনকি যখন কোনো ত্রিপুরা জন্মগ্রহণ করে তার আগমনী বার্তাও ঘোষিত হয় শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে। আর যখন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয় তারও সমাপ্তি টানা হয় গীত, বাদ্য ও নৃত্যের মাধ্যমে।

কের শব্দের অর্থ গন্ডি বা বেষ্টনি দেওয়া। প্রতি বছর ত্রিপুরাদের তালতুক মাসের (শকাব্দের শ্রাবণ) কৃষ্ণপক্ষের প্রথম দিনে কের পূজা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ত্রিপুরা জাতি গোমতী নদীকে দুগ্ধ স্রোতরূপী মাতৃনদী হিসাবে শ্রদ্ধা ও পূজা করে থাকে। গোমতী পার্বত্য কন্যা ‘ত্রিপুরা সুন্দরী’ নামে পরিচিত। গোমতী পূজা উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ত্রিপুরাব্দের তালতুং (শকাব্দের জ্যৈষ্ঠ) মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে। ত্রিপুরাব্দের তাল স্নাং (শকাব্দের ফাল্গুন) মাসের উত্তরায়ন চতুর্দশী তিথিতে সিবরাই পূজা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় প্রতিষ্ঠিত আছে চতুর্দশ দেব মন্দির। প্রতি বছর ত্রিপুরাব্দের তালয়ুং (শকাব্দের আষাঢ়) মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে চতুর্দশ দেব মন্দিরে ৭ দিন ব্যাপী তীর্থ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ মন্দিরে যে পূজানুষ্ঠান সম্পাদিত হয় তাই ‘খাচী পূজা’। হাবা পূজা মানে কৃষি পূজা। কৃষি ক্ষেত্র প্রস্তুত করার আগে ধরিত্রীকে আহবান করে পূজা উৎসব করা হয়। এর নাম ‘হাবা পূজা উৎসব’।

অলংকারের ব্যবহার

ত্রিপুরা নারীরা অলংকার প্রিয়। ত্রিপুরা নারীদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের অলংকার সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে- বেংকি, বারা, কুনচি, তাল, খার্চী, অাঁচলী, রাংবাহাতাং, তয়া, ওয়াখুম, সুরাম, সাংগে, নাকে, লŠক, য়াইতাম, চাংখুং, বাতাং, কুংবার, আংতা, তালবাতাং, খানাইসেপ ইত্যাদি। অতীতে ত্রিপুরী নারীদের মতো পুরুষেরাও অলংকার ব্যবহার করতেন।

ক্যালেন্ডার

ত্রিপুরী বর্ষপঞ্জি হলো একটি ঐতিহ্যবাহী সৌরচান্দ্রিক বর্ষপঞ্জি যা ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীরা ব্যবহার করে। এর "তিপ্রা সন", "ত্রিপুরা সন" বা ত্রিপুরাব্দ ১৫ এপ্রিল ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে নির্ধারণ করা হয়েছে যার সূচনা বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের তিন বছর আগে।

ত্রিপুরাব্দের নববর্ষ হল বৈশাখের ১লা তারিখে যা সেই বছরটি লিপ ইয়ার কিনা তার উপর নির্ভর করে কমন এরার ১৪ বা ১৫ এপ্রিলের সাথে মিলে যায়। এর মাসগুলোকে ১৪১৯ বছর আগে ৫১২ শকাব্দে ত্রিপুরের রাজা হামতোর্ফা ওরফে হিমটিফা ওরফে জুঝারুফা এর সূচনা করার সময় থেকে ভারতীয় মাসগুলোর ন্যায় নামকরণ করা হয়েছে।

ত্রিপুরী খেলাধুলা

ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী: ইতিহাস, ভাষা, ধর্ম 
"পাইট" প্রাচীন ত্রিপুরী মস্তিষ্কের একটি খেলা

বিশ্বের অনেক জায়গার মতো ত্রিপুরিতেও ঐতিহ্যবাহী খেলা রয়েছে। ত্রিপুরীর প্রায় সব গোষ্ঠীতেই এটি প্রচলিত। এদেরকে ত্রিপুরী ভাষায় থংমুং বলা হয়।

বাংলাদেশে তিপ্রা

ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী: ইতিহাস, ভাষা, ধর্ম 
ত্রিপুরা জাতির শিশুরা

বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করে। তিন পার্বত্য জেলা ছাড়াও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী সমতল এলাকার কুমিল্লা, সিলেট, বৃহত্তর চট্টগামের বিভিন্ন উপজেলা, রাজবাড়ি, চাঁদপুর, ফরিদপুর ইত্যাদি অঞ্চলেও বর্তমানে বসবাস করে। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে একসময় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী যে সবর্ত্র ছিল ১৮৭২ ও ১৮৮১ সালের আদমশুমারী প্রতিবেদন পরীক্ষা করলে তার প্রমাণ মেলে। ১৮৭২ সালে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মোট সংখ্যা ছিল ১৫,৬৩২ জন যা ১৮৮১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১৮,৫০৯ জনে। বর্তমানে বাংলাদেশে ত্রিপুরাদের জনসংখ্যা অনেকেই মনে করেন দুই লক্ষের কাছাকাছি। তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ত্রিপুরাদের জনসংখ্যা দেড় লক্ষাধিক। বাংলাপিডিয়া মতে, এরা ছিল বর্তমান বারীয় রাজ্য ত্রিপুরার পার্বত্য এলাকার অধিবাসী। পরবর্তীতে এরা নিজ এলাকা ছেড়ে বাংলাদেশের মূলত কুমিল্লা, সিলেট এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বসতি স্থাপন করে৷

উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি

বাংলাদেশী

ভারতীয়

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Tags:

ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ইতিহাসত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ভাষাত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ধর্মত্রিপুরা জনগোষ্ঠী গোষ্ঠীগত সাদৃশ্যত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ঐতিহ্য ও সমাজত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ক্যালেন্ডারত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ত্রিপুরী খেলাধুলাত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে তিপ্রাত্রিপুরা জনগোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্রিপুরা জনগোষ্ঠী আরও দেখুনত্রিপুরা জনগোষ্ঠী তথ্যসূত্রত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বহিঃসংযোগত্রিপুরা জনগোষ্ঠীত্রিপুরা রাজ্যভারত অধিরাজ্য

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

এইচআইভি/এইডসসর্বনামব্যঞ্জনবর্ণইসলাম ও হস্তমৈথুনন্যাটোবিভিন্ন দেশের মুদ্রাসেনেগালপৃথিবীর বায়ুমণ্ডলসন্ধিক্যাসিনোভুটানআলবার্ট আইনস্টাইনরোডেশিয়াবিশ্ব থিয়েটার দিবসবসন্ত উৎসবপূরণবাচক সংখ্যা (ভাষাতত্ত্ব)উপন্যাসমৌলিক পদার্থের তালিকারামকৃষ্ণ পরমহংসপাকিস্তানইতালিবিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমবাংলাদেশের ইউনিয়নের তালিকাঠাকুর অনুকূলচন্দ্রপ্রাণ-আরএফএল গ্রুপচর্যাপদকুরআনের সূরাসমূহের তালিকাকামরুল হাসানবেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশহোলিকা দহনউহুদের যুদ্ধনীলদর্পণহুমায়ূন আহমেদবিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সবাংলাদেশ ছাত্রলীগহরমোনলোকনাথ ব্রহ্মচারীমুসাফিরের নামাজএম এ ওয়াজেদ মিয়াসমকামিতাখন্দকের যুদ্ধবঙ্গভঙ্গ (১৯০৫)বাংলাদেশের উপজেলার তালিকাব্রাজিলশিল্প বিপ্লবপূর্ণ সংখ্যাজনি সিন্সরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরবাংলাদেশের নদীর তালিকাবঙ্গবন্ধু-১গারোবাংলার ইতিহাসময়মনসিংহরমজান (মাস)হামগুগলমুকেশ আম্বানিআমর ইবনে হিশামআহসান হাবীব (কার্টুনিস্ট)নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন, ২০১৯এপেক্সদৈনিক ইত্তেফাকবাংলার শাসকগণফিতরাধর্মীয় জনসংখ্যার তালিকাসিরাজগঞ্জ জেলাহস্তমৈথুনযাকাতের নিসাবশিববৃষ্টিহোমিওপ্যাথিমুহাম্মাদের বংশধারাজাতীয় স্মৃতিসৌধতিলক বর্মাদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধতুরস্কফরাসি বিপ্লবমক্কাপদ্মা নদী🡆 More