তন্তু ফলন গুলো হলো একধরনের মাঠ ফসল, যা তন্তু অর্থাৎ, যে মৌলিক উপকরণ থেকে ঐতিহাসিকভাবে কাগজ, কাপড় এবং দড়ি তৈরি করা হয় তা লাভের জন্য চাষ করা হয়।
তন্তুু ফলগুলোর একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট এই যে, তাদের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ সেলুলোজ থাকে, যা তাদের শক্তি জোগায়। তন্তু রাসায়নিকভাবেও প্রস্তুত করা যেতে পারে। যেমন, ভিসকোস (যা রেয়ন এবং তেলা কাগজ/কাচ-কাগজ প্রস্তত করতে ব্যবহার করতে ব্যবহৃত হয়) তৈরির ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজ্ঞানীগণ যৌগিক উপকরণে এই ফাইবারগুলোর আরো ব্যবহার আবিষ্কারের কাজ শুরু করেছেন। সেলুলোজ উদ্ভিজ ফাইবার শক্তির প্রধার উৎস হওয়ায় বিজ্ঞানীগণ এই সেলুলোজকে নিপূণভাবে ব্যবহার করে অন্যান্য ধরনের ফাইবার তৈরি করতে চাচ্ছেন।
তন্তু ফলগুলো সাধারণত একটি মৌসূমের পর সংগ্রহ করার উপযোগী হয়ে যায়। গাছের সাথে বৈসাদৃশ্যমুলকভাবে এরা সংগৃহীত হওয়া পর্যন্ত অনেক বছর ধরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। যেমন: উড পাল্প এবং লেসবার্ক। বিশেষ ক্ষেত্রবিশেষে তন্তু ফলগুলো প্রায়োগিক ক্রিয়া, পরিবেশগত প্রভাব এবং মূল্যের দিক থেকে কাঠ মন্ডের থেকে উত্তম।
তন্তু ফলগুলো ব্যবহার করে মন্ড তৈরির ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা দেখা যায়। এর মধ্যে একটি হলো ঋতু উপযোগিতা। আবার গাছ বারবার লাগানো গেলেও অনেক মাঠ ফসল বছরে একবারই চাষ করা যায় এবং তাদের অবশ্যই এমনভাবে সংরক্ষণ করতে হয় যাতে তারা অনেক মাসের সময়কালে পচে না যায়। এটি বিবেচনায় রেখে যে, অনেক মন্ড মিলের কয়েক হাজার টন তন্তু প্রতিদিন প্রয়োজন হয়, তাই তন্তু সংরক্ষণ করা এবটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে।
উদ্ভিদবিদ্যা অনুযায়ী, এসব অনেক গাছ থেকে পাওয়া তন্তু সর্বোত্তম তন্তু; যেসব তন্তু গাছগুলোর ফ্লোয়েম টিস্যু থেকে আসে। অন্যান্য মাঠ ফসল তন্তুগুলো হলো শক্ত/পাতা তন্তু (সম্পূর্ণ সংবহনতন্ত্র থেকে পাওয়া যায়) এবং তল তন্তু (গাছের বহিশ্চর্মগত কলাসমূহ পাওয়া যায়।)
কাপজ প্রস্তুতির শিল্পায়নের পূর্বে তন্তুর প্রধান উৎস ছিল ব্যবহৃত কাপড়ের পুনরাবর্তন তন্তু, যেগুলোকে র্যাগস বলা হতো। এই র্যাগগুলো রামিয়ের, শণ, লিনেন, তুলা থেকে পাওয়া যেত। ১৭৭৪ সালে জার্মান আইনজীবী ইয়সটুস ক্লাপরহট পুনরাবর্তন কাগজ থেকে ছাপার কালি অপসারণের একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। আজ এ পদ্ধতিকে বলা হয় ডেইনকিং । ১৮৪৩ সালের কাষ্ঠমন্ডের পরিচিতির পূর্ব পর্যন্ত কাগজ প্রস্তুতি র্যাগ সংগ্রহকের কাছ থেকে প্রাপ্ত র্যাগ থেকে করা হতো।
উৎপাদনমূলক কাজে ব্যবহারের জন্য তন্তুর একটি উৎস পেতে তন্তুগুলো অবশ্যই তন্তুকে উদ্ভিদ থেকে নির্গত করতে হয়।তন্তুর প্রকারভেদ অনুযায়ী এ কাজটি ভাবে করা হয়। সর্বোত্তম তন্তুগুলো রেট্টিংয়ের মাধ্যমে চাষ করা হয়। এ পদ্ধতিতে অণুজীব ব্যবহার করে গাছ থেকে নরম কলাগুলো অপসারণ করা হয় এবং শুধুমাত্র কার্যকরী তন্তুময় পদার্থগুলো রেখে দেওয়া হয়। কঠিন তন্তুগুলো মূলত ডিকোর্টিকেশন এর মাধ্যমে চাষ করা হয়। এ পদ্ধতিতে তন্তুহীন টিস্যুগুলোকে হাতে বা যন্ত্রের সাহায্যে অপসারণ করা হয়। আর তল তন্তু গিনিং এর মাধ্যমে চাষ করা হয়। এ পদ্ধতিতে একটি যন্ত্রের সাহায্যে অন্যান্য উদ্ভিজ উপাদান থেকে তন্তু আলাদা করা হয়।
(কাণ্ড ত্বক তন্তু)
মন্ডের উৎস | তন্তুর দৈর্ঘ্য,মি.মি | তন্তুর ব্যাস µমি |
---|---|---|
কোমল কাঠ | ৩.১ | ৩০ |
শক্ত কাঠ | ১.০ | ১৬ |
গম | ১.৫ | ১৩ |
ধান | ১.৫ | ৯ |
এসপারতো ঘাস | ১.১ | ১০ |
খাগড়া | ১.৫ | ১৩ |
আখের ছিবড়া | ১.৭ | ২০ |
বাঁশ | ২.৭ | ১৪ |
তুলা | ২৫.০ | ২০ |
পাট, মেস্তা, তুলা এবং শনপাট হলো বাংলাদেশের প্রধান তন্তু ফসল। এছাড়াও নারিকেল ছোবড়ার আঁশ. আনারস আঁশ কলাগাছের কান্ডের আঁশ এবং শিমুল তুলার আঁশও এদেশে বহুল ব্যবহৃত। বীজ বপণ ও ফসল তোলার সময় ব্যাতিত এ তন্তু ফলগুলো অল্পবিস্তর প্রায় একইভাবে উৎপাদন করা হয়। এসকল তন্তু-ফসলের চাষাধীন মোট জমি ৯৬৪৯৬৭ একর এবং উৎপাদনের পরিমাণ ৪০৩৪৫৮৯ বেল। ২০০৭—৮ সালে, পাট, তুলা (গ্রীস্মকালীন), তুলা (শীতকালীন) ও শনপাটের চাষের মোট জমি ও উৎপাদনের পরিমাণ:
তন্তুর নাম | চাষাধীন জমি (হে.) | উৎপাদন (বেল) |
---|---|---|
পাট | ৪,৪০,৭০২.৬৬ | ৪৬,২২,০০০ |
তুলা (গ্রীস্মকালীন) | ৩৮,৩১,৯৬৮.৩৫ | ২৬,৯২,০০০ |
তুলা (শীতকালীন) | ৪৯,৯১,৩৯২.৭১ | ১,২৩,৫৭,০০০ |
শণপাট | ৬৭,৫৮২.৫০ | ১,৭৯,০০০ |
পাট বাংলাদেশের সর্বচেয়ে গুরুদ্বপূর্ণ তন্তু ফল। সাদা (Corchorus capsularis) ও তোষা পাট (C. olitorious) নামের দুটি কাণ্ড থেকে লিগনিন যুক্ত বাস্ট-আঁশই মূলত পাট বলে পরিচিত। পাট লবণাক্ত ও পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়া প্রায় সারা দেশে উৎপাদনযোগ্য।
মেস্তার (Hibiscus sabdariffa) মালভেসি (Malvaceae) গোত্রের অন্তর্ভুক্ত একটি তন্তু ফল। মেস্তার আঁশের শরীরবৃত্তীয় ও ভৌত বৈশিষ্টগুলো পাটের আঁশের শরীরবৃত্তীয় ও ভৌত বৈশিষ্টগুলোর মতো ততটা উৎকৃষ্ট না হলেও মেস্তা পাটের চেয়ে অধিক প্রতিকূল পরিবেশে চাষ করা যায়। বাংলাদেশে দুটি জাতের মেস্তা বিদ্যমান, যার একটি হলো শাখাপ্রশাখাযুক্ত, প্রায় ২ মিটার উঁচু, বৃতি মাংসল ও বর্ধিত এবং এর ফল থেকে খাবার উপযোগী জ্যাম, জেলি ইত্যাদি উৎপাদিত হয়। অপরটি লম্বা, খাড়া, শাখাপ্রশাখাবিহীন ও বৃতিধর। লাল ও সবুজ বর্ণের কাণ্ড দেখে দুটিকে খুবই সহজে পৃথক করা যায়। মেস্তার আঁশের গঠন, অঙ্গসংস্থান, ভৌত ও রাসায়নিক উপাদান পাট ও রেকনাফের অনুরূপ এবং এগুলোর মধ্যে আনুপাতিক পার্থক্য বিদ্যমান। মেস্তার বীজে ১৬-২০% তেল থাকে।
তুলা গোসিপিয়াম (Gossypium) উদ্ভিদ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একাধিক প্রজাতির বীজলগ্ন আঁশ দিয়ে গঠিত নরম, সাদা ও তুলতুলে পদার্থ। এটি ব্যবহার করে সূতা, কাপড়, বালিশ ও তোশক ইত্যাদি তৈরি করা হয়। স্থানীয় বস্ত্রশিল্পে ব্যবহৃত তুলার অধিকাংশই আমদানিকৃত কিন্তু বাংলাদেশে প্রায় ২৯,০৫৫ একর জমি থেকে প্রায় ২১,২৯৫ বেল তুলা উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশের প্রধান তুলা উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলো হলো— বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, ঢাকা, টাঙ্গাইল, যশোর, কুষ্টিয়া ও রাজশাহী। তুলাগাছ সাধারণত ১—২ মিটার উচু এবং এটিতে সাদা রঙের ফুল হয়, শুঁটি বা বোল তুলতুলে আঁশে ফুটে উঠলে ফেটে যায়। বোল সংগ্রহের পর তুলা থেকে বীজ ছড়িয়ে এবং পরিষ্কার করে আঁশ আলাদা করা হয়। তুলায় প্রায় ৯৫% সেলুলোজ এবং সামান্য পরিমাণ প্রোটিন, পেক্টিন ও মোম বিদ্যমান। এই আঁশের দৈর্ঘ্য, পুরুত্ব ও অন্যান্য দিক বিবেচনা করে এই আঁশকে বাণিজ্যিকভাবে শ্রেণিবিভক্ত করা হয়। এর আঁশ হালকা, টেকসই ও চকচকে, নানা ধরনের পোশাক, সজ্জা ও অন্যান্য পণ্য তৈরিতে ব্যবহারযোগ্য। এদেশে উৎপাদিত তুলার আঁশের দৈর্ঘ্য মধ্যম থেকে খাটো-মধ্যম ধরনের, যদিও কুমিল্লায় একটি বিশেষ ধরনের খাটো আঁাশের তুলা চাষ করা হয়। তুলার বীজচূর্ণ থেকে প্রাপ্ত তেল থেকে মারজারিন, ভোজ্যতেল, সাবান প্রভৃতি তৈরি করা হয়।
শিমুল তুলা (Bombax species) সারা বাংলাদেশে সহজলোভ্য একটি তন্তু ফল। এটি থেকে সাধারণত বালিশ, তোশক ও দিশলাইয়ের কাঠি ইত্যাদি তৈরি তরা হয়।
শণপাট হলো লেগোমিনোসে উদ্ভিদ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একটি তন্তু ফসল। এটি থেকে মূলত পাকানো সুতা, রশি, কাগজ ও মাছের জাল তৈরি করা হয়ে থাকে। শণগাছের পাতা সবুজ সার হিসেবে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে ব্যবহার হয়। এই আঁশ নরম ও অপেক্ষাকৃত কম লিগনিনযুক্ত। এটি সাধারণত রাজশাহী, রংপুর, যশোর ও বগুড়ায় উৎপাদন করা হয় এবং এটি উৎপাদনের পদ্ধতি পাটের অনুরূপ। এটি দুই মৌসুমেই চাষ করা যায় কলে এটিকে ভাদই-শণ ও রবি-শণ নামেও অভিহিত করা হয়।
নারিকেলের (Cocos nucifera) ছোবড়ার আঁশ থেকে মাদুর, রশি প্রভৃতি তৈরি হয়। এটি একটি উন্নতমানের তন্তু এবং এটি ব্রাশ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে ছাঁকনি, মালচিং ম্যাটসহ ইতাদি ছোবড়ার আঁশ জাতীয় অংশ কৃষিকাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ছোবড়া মাদুর ও রশি প্রস্তুত করার জন্য দেশে কয়েকটি ছোবড়া—শিল্প কারখানাও গড়ে উঠেছে। ছোবড়া থেকে আঁশ আলাদা করতে ছোবড়া লবণাক্ত পানিতে রাখতে হয়। এর ফলে পচনক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়, যার ফলে ছোবড়াটি নরম হয়ে যায়। ছোবড়াটি নরম হওয়ার পর হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে, ধোয়া এবং শুকানোর মাধ্যমে ছোবড়া থেকে আঁশ আলাদা করা যায়। নারিকেল গাছ বাংলাদেশে মূলত দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা, বরিশাল, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে হয়।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article তন্তু ফল, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.