জয়নব বিনতে মুহাম্মাদ (আরবি: زينب بنت محمد) ছিলেন মুহাম্মাদ এবং খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদের জ্যেষ্ঠ কন্যা। খাদিজার বিবাহের ৫ম বছরে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দে জয়নবের জন্ম হয়, এবং ৩০ বছর বয়সে ৮ম হিজরিতে, ৬২৯ খ্রিঃ মৃত্যুবরণ করেন।
জয়নব বিনতে মুহাম্মাদ | |
---|---|
زينب بنت محمد | |
জন্ম | ৫৯৮ খ্রি |
মৃত্যু | মে / জুন ৬২৯ (বয়স ৩১) |
সমাধি | আল-বাকী |
দাম্পত্য সঙ্গী | আবুল আস ইবনে রাবি |
সন্তান | আলী ইবনে জয়নব, উমামা বিনতে আবিল আস |
পিতা-মাতা |
|
আত্মীয় | আলী ইবনে আবু তালিব (ভগিনীপতি এবং জামাতা) |
মুহাম্মাদ আরোপিত মেয়েগণ হল;
জয়নব মুহাম্মাদ(সঃ) এর সন্তানদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ কিনা সেটা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। বংশবিদ্যা বিশারদদের একটি দলের মতে কাসিম প্রথম ও জয়নাব দ্বিতীয় সন্তান। ইবনুল কালবির মতে, জয়নাব প্রথম সন্তান। ইবনে সাদের মতে, জয়নাব মেয়েদের মধ্যে সবার বড়। ইবন হিশাম মুহাম্মাদ(সঃ) সন্তানদের ক্রমধারা এভাবে সাজিয়েছেন প্রথমে বড় ছেলে আল কাসিম, তারপর আত তাইয়িব ও আত তাহির এরপর বড় মেয়ে রুকাইয়া, তারপর জয়নাব তারপর উম্মে কুলসুম এরপর ফাতিমা।
পিতা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস্সাল্লাম নবুওয়াত প্রাপ্তির ১০ বছর পূর্বে, নবী করিম‐এ‐পাক্ রাসূলআল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস্সাল্লাম) যখন ৩০ বছর বয়স এবং মাতা খাদিজার (রাঃ)'র বয়স ৪৫ বছরের সময় জয়নবের জন্ম হয়। যায়নাবের শৈশব সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। মুহাম্মাদের মেয়েদের মধ্যে সর্বপ্রথম যায়নাবের বিয়ে হয়। তখন মুহাম্মাদ নবুয়ত পাননি, তবে ইবনে সা‘দ বলেছেন, মুহাম্মাদ তখন নবুয়ত প্রাপ্ত।
যাই হোক স্বামী আবুল আস ইবন রাবি ছিলেন জয়নাবের খালাতো ভাই। মা খাদিজার আপন ছোট বোন হালা বিনত খুওয়াইলিদের ছেলে। বিয়ের সময় তার মা খাদিজা একটি হার উপহার দিয়েছিলেন।
পিতার নবুয়তের পরে জয়নব তার মায়ের সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন। স্বামী আবুল আস তখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। আবুল আস তার স্ত্রী জয়নাবকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। কিন্তু তিনি পূর্বপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে স্ত্রীর নতুন ধর্ম কবুল করতে রাজী হলেন না। আবার কুরাইশরা তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে মুহাম্মাদের নিকট পাঠিয়ে দিতে চাপ দিলো, একাজেও তিনি রাজি হলেন না। নবুয়াতের ১৩ তম বছরে মুহাম্মাদ মদিনায় হিজরাত করেন, তখন জয়নাব স্বামীর সাথে মক্কায় থেকে যান।
কুরাইশদের সাথে মদিনার মুসলমানদের সামরিক সংঘাত শুরু হলো। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবুল আস কুরাইশদের সাথে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন। বদরে কুরাইশরা শোচনীয় পরাজয় বরণ করলো, তাদের বেশ সৈনিকদের সাথে জয়নবের স্বামী আবুল আসও বন্ধী হলেন। মুহাম্মাদ(সঃ) এর কন্যা জয়নাব স্বামী আবুল আসের মুক্তিপণ স্বরূপ তার মায়ের দেওয়া ঐ হার দিয়ে আমর ইবন রাবিকে মদিনায় লোক পাঠালেন। মুহাম্মাদ(সঃ) এই হারটি দেখে স্ত্রী খাদিজার স্মৃতিচারণ হয়ে বিমর্ষ হয়ে পড়লেন এবং নিজের মুখ একটি পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে ফেললেন। কিছুক্ষণ পর মুহাম্মাদ(সঃ) সাহাবীদের লক্ষ্য করে বললেন, জয়নাব তার স্বামীর মুক্তিপণ হিসেবে এই হারটি পাঠিয়েছে। তোমরা ইচ্ছে করলে তার বন্দীকে ছেড়ে দিতে পার এবং হারটিও তাকে ফেরত দিতে পার, সাহাবীরা রাজী হয়ে হার ফেরত দিয়ে আবুল আসকে মুক্ত করে দিলেন। তবে মুহাম্মাদ(সঃ) আবুল আসের নিকট থেকে এ অঙ্গিকার নিলেন যে, সে মক্কায় ফিরে অনতিবিলম্বে সে জয়নাবকে মদিনায় পাঠিয়ে দিবে।
মুহাম্মাদ জয়নাবকে নেওয়ার জন্য আবুল আসের সঙ্গে যায়েদ ইবনে হারিসাকে পাঠান। মুহাম্মাদ তাকে ‘বাতান’ অথবা ‘জাজত নামক স্থানে অপেক্ষা করতে বলেন। জয়নাব মক্কা থেকে সেখানে পৌছলে তাকে নিয়ে মদিনায় চলে আসতে বলেন। আবুল আস মক্কায় পৌছে জয়নাবকে মদিনা যাবার প্রস্তুতি নিতে বলেন, এ সময় ইসলামের শত্রু হিন্দ বিনত উতবা তাকে সাহায্য করতে চান, এবং বলেন, পুরুষদের শত্রুতা নারীদের উপর প্রভাব ফেলেনা।
জয়নাবের মদীনায় পৌছানো ইতিহাস নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
১। ইবন ইসহাক বলেন, সফরের প্রস্তুতি শেষ হলে জয়নাবের দেবর কিনানা ইবন রাবি একটি উটে করে মদিনার পথে রওনা হলো, কুরাইশরা তাদের ধাওয়া করে মক্কার অদূরে ‘জীতুওয়া’ উপত্যকায় তাদেরকে ধরে ফেললো। কিন্তু দক্ষ তীরন্দাজ কিনানার ক্ষিপ্ত আচরণে তারা পিছপা হলো। এরপর আবু সুফিয়ান ইবন হারব তাকে ফিরে যেতে অনুরোধ করলো, কিনানা অনুরোধ মেনে নিয়ে মক্কায় থেকে গেলো। এরপর সুযোগ বুঝে একরাতে আবুল আসের কথামত জয়নবকে বাতান নামক স্থানে অপেক্ষারত মুহাম্মাদের প্রতিনিধির নিকট পৌঁছে দিলো।
২। তাবারানী উরওয়া ইবন যুবাইর এর বর্ণনা মতে, জয়নব কুরাইশদের দুই ব্যক্তি হাব্বার ইবন আল-আসওয়াদ (খাদিজার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে) ও নাফে ইবনে আব্দুল কায়স অথবা খালিদ ইবনে আবদুল কায়স দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলো। তারা জয়নবের পথ সঙ্গীকে ধরাশয়ী করে জয়নবকে উটের পিঠ থেকে ফেলে দেয়। ফলে তিনি একটি পাথরের উপর ছিটকে পড়লে শরীর ফেটে রক্ত বের হয়ে যায়, এ অবস্থায় তারা জয়নাবকে মক্কায় আবু সুফিয়ানের মাধ্যমে বনু হাশিমের মেয়েদের কাছে সোপর্দ করে। পরে সুস্থ হয়ে জয়নব মদিনায় হিজরত করেন। এমনকি উরওয়া বলেন, উঠের পিঠ থেকে ফেলে দেওয়ার ফলে, তিনি যে আঘাত পান, আমরণ সেখানে ব্যথা অনুভব করতেন এবং সেই ব্যথায় শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেন।
৩। আয়িশা বর্ণনা করেছেন,জয়নাব কিনানার সাথে বের হলো হাব্বার ইবনুল আসওয়াদ জয়নাবের উট লক্ষ্য করে তীর ছুড়ে, জয়নব উটের উপর থেকে পরে গিয়ে আঘাত প্রাপ্ত হন, এবং তার গর্ভে থাকা সন্তানটি নষ্ট হয়ে যায়। অতঃপর বনু হাশিম ও বানু উমাইয়া এই কাজের সমালোচনা করলে, অবশেষে সে হিন্দ বিনতে উতবার তাকে নিজ গৃহে নিয়ে যায় এবং তার সেবা শুশ্রুষা করেন।
৪। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, মুহাম্মাদ যায়দ ইবনে হারিসাকে জয়নবকে মদিনায় আনার দায়িত্ব দিলেন। যায়েদ মক্কার উপকণ্ঠে এসে দেখলেন, এক রাখাল জয়নবের ছাগল চড়াচ্ছে। সে মুহাম্মাদের চিহ্ন খচিত একটি আংটি রাখালকে দিয়ে বললেন, এটি জয়নবের নিকট পৌঁছে দিতে। জয়নব আংটি দেখেই বুঝতে পারলেন, আব্বুর প্রতিনিধি আমাকে নিতে এসেছে। জয়নব রাতের আঁধারে উক্ত স্থানে পৌঁছালে যায়েদ তাকে মদিনায় মুহাম্মাদের নিকট পৌঁছে দেয়।
“ | এসমস্ত ঘটনাকে স্মৃতিচারণ করে মুহাম্মাদ প্রায়ই বলতেন, ‘আমার সবচেয়ে ভালো মেয়েটি আমার জন্য কষ্ট ভোগ করেছে। | ” |
যেহেতু জয়নব ও আবুল আসের মধ্যে গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো, তাই যায়নাবের মদিনায় চলে যাওয়ার পর আবুল আস বেশীর ভাগ সময় খবই বিমর্ষ থাকতেন। এর কয়েক বছর পরে ৬ষ্ঠ হিজরির জমাদিল আওয়াল মাসে তিনি কুরাইশদের ১৭০ উটের একটি বাণিজ্য কাফিলা নিয়ে সিরিয়া যান। ফিরতি পথে যায়দ ইবনে হারিসার নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী দ্বারা আবুল আস আক্রান্ত হয়, কিন্তু তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। আবুল আস তার কাফিলার পরিণতি দেখে মক্কায় না গিয়ে ভীত সন্ত্রস্তভাবে রাতের অন্ধকারে চুপে চুপে মদিনায় প্রবেশ করলেন এবং সোজা যায়নাবের কাছে পৌঁছে আশ্রয় চাইলেন। যায়নাব তাকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিলেন। এরপর মুহাম্মাদ ও তার সাহাবারাও আবুল আসকে নিরাপত্তা দিলো। কিন্তু মুহাম্মাদ তার মেয়েকে বলল, আবুল আস ইসলাম গ্রহণ না করা পর্যন্ত তুমি তার জন্য বৈধ নও। জয়নাব পিতার কাছে আবেদন জানালেন আবুল আসের কাফিলার লোকদের অর্থসম্পদসহ মুক্তিদানের জন্য। মুহাম্মাদ সাহাবাদের সাথে পরামর্শ করে আবুল আসের মালামাল ফেরত দিলেন। এরপরে অবশ্য আবুল আস মক্কায় সবার মালামাল ফেরত দিয়ে এসে ইসলাম কবুল করেন।
মুহাম্মাদ সম্মানের জয়নাবকেও আবুল আসের হাতে সোপর্দ করেন। এখানে নতুন করে বিবাহ বা মোহর ধার্য ছিলোনা। তবে কোন মতে এসেছে নতুনভাবে মিলিত হওয়ার জন্য মোহর ধার্য করা হয়েছিলো।
যায়নাব তার স্বামী আবুল আসের সাথে পুনর্মিলনের পর বেশীদিন বাঁচেনি। এক বছর বা তার চেয়ে কিছু সময় মদিনায় স্বামীর সাথে কাটান। জয়নব মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সময় হাব্বার ইবনে আল আসওয়াদ দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হন, এতে তার গর্ভপাত ঘটে রক্ত ঝরে এবং তিনি দীর্ঘদিন পর্যন্ত রোগে ভুগতে থাকেন। অবশেষে ৮ম হিজরির প্রথম দিকে ইনতিকাল করেন।
উম্মে আয়মান, সাওদা, উম্মে সালামা, ও উম্মু আতিয়া যায়নাবের গোসলের কাজে অংশগ্রহণ করেন। আর স্বয়ং মুহাম্মাদ তার জানাযার নামায পড়ান এবং নিজে কবরে নেমে নিজ হাতে মেয়েকে কবরের মধ্যে শায়িত করেন। মুহাম্মাদ তার নিজের ব্যবহৃত একটি লুঙ্গি প্রতীক হিসাবে জয়নবের কাফনের কাপড়ের মধ্যে দিয়ে দেয়। মুহাম্মাদ তার পূর্বে মৃত্যুবরণকারী উসমান ইবনে মাজউনের পাশে দাফন করার নির্দেশ দেন।
জয়নবের আবুল আসের ঔরসে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে জন্ম দেন। ছেলে আলি ইবনে আবুল আস হিজরতের পূর্বে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। মুহাম্মাদ তাকে নিজের দায়িত্বে নিয়ে প্রতিপালন করতে থাকেন। মক্কা বিজয়ের দিন মুহাম্মাদ যখন মক্কায় প্রবেশ করেন তখন আলি নানার উটের পিঠে সওয়ার ছিলেন। আলি প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পূর্বে পিতা আবুল আসের জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু ইবনে আসাকিরের একটি বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, আলি ইবনে আবুল আস ইয়ারমুক যুদ্ধ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন এবং এই যু্দ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। আর মেয়ে উমামা বিনতে আবুল আস দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন।
জয়নাবের ইনতিকালের অল্প কিছুদিন পর তাঁর স্বামী আবুল আসও ইনতিকাল করেন।বালাজুরী বলেন, ইসলাম গ্রহণের পর তিনি মুহাম্মাদের সাথে কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি এবং ১২ হিজরিতে ইনতিকাল করেন।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article জয়নব বিনতে মুহাম্মাদ, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.