গজল (আরবি: غَزَل গ়্যজ়্যল্/গ্ব্যয্যল্, Hindi-Urdu: ग़ज़ल/غزَل, ফার্সি: غزل) আরব থেকে এর উৎপত্তি হলেও ফার্সি ভাষায় এটি বিশেষ বিকাশ লাভ করে। পরবর্তীতে উর্দু ভাষায় এটি সমধিক জনপ্রিয়তা পায়। আরবি, ফার্সি, পশতু, উর্দু ছাড়াও হিন্দি, পাঞ্জাবী, মারাঠি, বাংলা এমনকি ইংরেজিতেও গজল লেখা হয়। প্রাথমিক দিকে ইমাম গাযালী, মওলানা জালালুদ্দিন রুমী, হাফীজ সীরাজী, ফরিদ উদ্দীন আত্তার, হাকীম শানাঈ প্রমুখ গজল লিখে বেশ নাম করেন। পরবর্তিতে আমির খসরু, মীর তাকী মীর, ইব্রাহীম জক, মীর্জা গালিব, দাগ দেলবী এবং আধুনিক কালে আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, ফিরাক গোরখপুরী গজল লেখক হিসাবে নাম করেন।
এই নিবন্ধটি আরও সহজগম্য করতে, বিষয় অনুসারে অনুচ্ছেদে ভাগ করা উচিত।(সেপ্টেম্বর ২০১৫) |
আরবি শব্দ غزل (গাজল) থেকে গজল শব্দের উৎপত্তি। মূল সিলেবল গা-যা-ল এর আরবীতে তিনটি সম্ভাব্য অর্থ রয়েছে:
কাব্যিক ফর্মটি প্রথম এবং দ্বিতীয় ব্যুৎপত্তিগত শিকড় থেকে এর নামটি এসেছে, একটি বিশেষ অনুবাদে গজল এর অর্থ হল 'আহত হরিণের হাহাকার',যা সম্ভাব্যভাবে অনেক গজলের জন্য সাধারণ অপ্রচলিত প্রেমের থিমের প্রসঙ্গ সরবরাহ করে।
আরবি শব্দ غزل গায'আল [ˈɣazal] উচ্চারিত হয়, অনেকটা ইংরেজি শব্দ 'গুজ্জল'-এর মতো।, কিন্তু জিহ্বা এবং নরম তালু এর মধ্যে একটি সম্পূর্ণ বন্ধ ছাড়াই উচ্চারিত জ' এর সাথে।
গজল হালকা মেজাজের লঘু শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। আবার হালকা-গম্ভীর রসের মিশ্রণে সিক্ত আধ্যাত্মিক গান। গজল প্রেমিক-প্রেমিকার গান হলেও এ গান এমন একটি শৈলী যাতে প্রেম ও ভক্তির অপূর্ব মিলন ঘটেছে। পার্থিব প্রেমের পাশাপাশি গজল গানে আছে অপার্থিব প্রেম, যে প্রেমে স্রষ্টার প্রতি আত্মার আকূতি নিবেদিত। গজল গানে স্রষ্টা আর তার প্রেরিত মহাপুরুষদের প্রতি ভক্তির সঙ্গে মোক্ষ লাভের ইচ্ছা এসে মেলবন্ধন ঘটিয়েছে পার্থিব প্রেমের সঙ্গে।
গজল গান উর্দু ও ফার্সি ভাষায় রচিত এক ধরনের ক্ষুদ্রগীত। আমির খসরু এ গানের স্রষ্টা এবং প্রচারের ক্ষেত্রেও তার অবদান অপরিসীম। তিনি সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজিকে প্রতিরাতে একটি করে গজল শোনাতেন।
গজল গানে কথা বেশি, সুরের প্রাধান্য কম। মূলত হালকা ধরনের গান হলেও সব ধরনের রচনাই এ গানের বিষয়বস্তু হতে পারে। উচ্চভাবপূর্ণ ও গাম্ভীর্যপূর্ণ রচনাও কোন কোন গানে দেখা যায়। এ গানে অনেকগুলো চরণ, কলি বা তুক্ থাকে। প্রথম কলি ‘স্থায়ী’ এবং বাদবাকি কলিগুলো ‘অন্তরা’
গজল ভালো গাইতে হলে ভালো ভাষা-জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। টপ্পা ও ঠুমরির মতো গজল প্রধানত কাফি, পিলু, ঝিঝিট, খাম্বাজ, বারোয়া, ভৈরবী রাগে গাওয়া হয়। গজল গানে একটি বিশেষ আবেদন আছে, তাই এ গান শ্রোতার মনকে রসে আপ্লুত করে তোলে। গজল খুবই জনপ্রিয় গান। সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর, মীর্জা গালিব, দাগ, জওক, আরজু প্রমুখ অনেক কবি অজস্র সুন্দর সুন্দর গজল রচনা করে গেছেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর, সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, নবাব ওয়াজেদ আলী শাহর মতো ইতিহাস-প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের রচিত অনেক গজল গানের সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলা ভাষায় বেশকিছু গজল রচিত হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা গজল রচনায় পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।
‘গজল’ শব্দটি আরবি থেকেই চয়িত। এ শব্দের আক্ষরিক অর্থ, প্রেমিকার সঙ্গে কথোপকথন। গজলের পরিভাষায় উল্লেখ হয়েছে, ‘তারুণ্যের পরিস্থিতি বর্ণনা করুন অথবা প্রেমাস্পদের সঙ্গে সংসর্গের উল্লেখ করুন এবং ভালোবাসার চর্চা করুন কিংবা রমণীর সঙ্গে বাক্যালাপ করুন। তাই পরিভাষায় বর্ণিত বিষয়কে অবলম্বন করে গজল রচিত গানকে ‘প্রণয়-সঙ্গীত’ বলেও চিহ্নিত করা হয়। গজল আবার ‘কাব্য-সঙ্গীত’ নামেও পরিচিত। কারণ গজল গানে শৃঙ্গার রস যেমন মিলন আর বিরহের কথা বলে তেমনি তাতে ভক্তির কথাও উচ্চারিত হয়। দু’ধরনের ভাবের অভিব্যক্তি শৃঙ্গার রসে পরিপূর্ণতা আনে। অন্যদিকে গজল গান রচনায় যে বাণী প্রয়োগ করা হয় তাতে সব ধরনের রসের সমাবেশ দেখা যায়। ফলে গজল গান কাব্যের গুণে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। তাই গজল শৃঙ্গার রসাÍক গান হলেও এক ধরনের ‘কাব্য-সঙ্গীত’।
গজল গানের কলিগুলোর অর্থ প্রায়ই দ্ব্যর্থবোধক। প্রেম যখন পুরুষ বা নারীর প্রতি নিবেদিত হয় তখন সে গজল মানব-প্রেম বা পার্থিব-প্রেম, আবার প্রেম যখন স্রষ্টার উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয় তখন তা আধ্যাত্মিক প্রেম। তাই গজল গান এক ধরনের ‘ভাব-সঙ্গীত’ বলেও পরিচিত।
গজলের আরেকটি রূপও আছে। সে রূপটি অন্য কোন গানে নেই। আবৃত্তি আকারে গজল পরিবেশন। এসব ধর্মই গজল গান শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভুবনে আলাদা জাত হিসেবে গণ্য।
বাংলাদেশে অনেক শিল্পিগোষ্টি বর্তমান শ্রুতি মধুর গজল পরিবেশনা করে থাকে । আমি দেখিনি তোমায় চোখের তারায়[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ] বর্তমান গজল গুলোর মাঝে অন্যতম ।
গজল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এক ব্যতিক্রমধর্মী গান। এ গানের ‘ভাষার কাব্য ভাব, রাগের স্বর বিন্যাস ও তালের ছন্দ মাধুর্য এক অনির্বাচনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে থাকে।’
গজল গানের বাণীতে সুর-মিশ্রণে যেসব বক্তব্য ধরা পড়ে তা অনেকটা এরূপ :
এগুলো হল পার্থিব প্রেমের উপকরণ। অপরদিকে ভগবৎ প্রেমের প্রকাশও রয়েছে গানের বাণীতে। ঈশ্বরের কাছে মান-অভিমান, ঈর্ষা-ঈপ্সা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ও উদ্বেল-উচাটন মূর্ত হয়ে ওঠে গানে।
গজল গানের প্রকৃতি কোমল, ভাবপ্রবণ ও সংবেদনশীল বলে তার পরিধির ক্ষেত্র কিছুটা সীমিত। এ ক্ষেত্রে তিনটি পর্যায় দেখা যায়। যেমন: কাব্যের ক্ষেত্রে, রাগের ক্ষেত্রে এবং তালের ক্ষেত্রে।
গজল গান দু'টো পংক্তি নিয়ে রচিত। প্রতিটি খণ্ডকে ‘শের’ বলা হয়। অনেকগুলো ‘শের’ নিয়ে গজলের অবয়ব। শের কখনও একই বক্তব্য নিয়ে রচিত। আবার এতে কখনও বিভিন্ন বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা দেখা যায়। মূল কথা, গজলের কাব্য ভাবই মুখ্য। ভাষার লালিত্য, শব্দের ঝঙ্কায়, ছন্দের মাধুর্য গজলের বৈশিষ্ট্য। গজলের প্রথম শেরকে স্থায়ী এবং অন্যসব শেরকে ‘অন্তরা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। গজল গানে মূলত কাব্যিক ভাব প্রকাশিত।
রাগের ক্ষেত্রে গজল যে কোন রাগেই গীত হতে পারে। এর জন্য নির্দিষ্ট কোন রাগ নেই। তবে যেসব রাগেই গজল পরিবেশিত হয় সেসব রাগে শৃঙ্গার রস সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। তাই কাফি, পিলু, খাম্বাজ, ভৈরবি প্রভৃতি চটুল রাগের ব্যবহার গজলে বেশি দেখা যায়। তাই বলে দরবারি কানাড়া, মিয়া-কি-মল্লার, বিলাসখানি টোড়ি, চন্দ্রকোষ প্রভৃতি গম্ভীর চালের রাগেও গজল পরিবেশনে কোন বাধা নেই। তবে দ্রুপদ বা খেয়ালের মতো তাল, বাঁট করা হয় না এবং স্থায়ী ছাড়া সবগুলো অন্তরা একই সুরে গাওয়া হয়।
তালের ক্ষেত্রে গজল পরিবেশনের পরিধি কিছুটা সীমিত। কাব্যনির্ভর গান বলে গজলে কোন কঠিন তাল ব্যবহার হয় না। তাতে গজলের কাব্যিকভাবে অন্তরায় সৃষ্টি হয়। তাই স্বল্পমাত্রা আর সরল ছন্দের কাহারবা ও দাদরা তালেই বেশিরভাগ গজল গীত হয়। তালের ক্ষেত্রেও কোন ধরনের কূটলয়কারী বা তেহাই প্রয়োগ করা হয় না এবং গজল প্রধানত মধ্য লয়ে পরিবেশিত হয়।
গজল গান মোটামুটি দুই পক্ষে বিভক্ত: ১. সাহিত্য পক্ষ, ২. সঙ্গীত পক্ষ। সাহিত্য পক্ষে কাব্য মূল ভূমিকা পালন করে। কাব্য আবার দুভাগে বিভক্ত: ১. তগজ্জুল, ২. তসব্বুফ। তগজ্জুল পর্বে মানব জাতির লৌকিক প্রেমের প্রাধান্য থাকে। এবং তসব্বুফ পর্বে থাকে অলৌকিক প্রেমের প্রাধান্য। সে সঙ্গে এ পর্বের আদিতে রহস্যবাদ ও অন্তে অদ্বৈতবাদের সমন্বয় প্রধান গুণ হিসেবে গণ্য। যার ফলে ঈশ্বরের কাছ থেকে ভক্তের পরম প্রাপ্তি ও চরম শান্তি লাভ হয়ে থাকে। গজল গানের সঙ্গীত পক্ষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
এ অংশও দুই ভাগে বিভক্ত: ১. রাগ পর্ব, ২. তাল পর্ব। রাগ পর্বে শৃঙ্গার রসের সহায়ক রাগগুলো গজল গানে ব্যবহৃত হয়। গজল গানে রাগের শুদ্ধতা বজায় থাকে না। কারণ গজলে কাব্য ভাব মুখ্য, রাগ ভাব গৌণ। তাল পর্বে সাধারণত গজল লঘু তালে নিবদ্ধ থাকে। গজল তালে নিবদ্ধ থাকলেও কোন কোন গজল গানকে আদ্যোন্তে অনিবদ্ধভাবে গাইতেও শোনা যায়। গজল মূলত একক কণ্ঠে গীত গান। একজন শিল্পীই গজল গান পরিবেশন করে থাকেন।
গজল গান রচনার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। তার রচিত গজলের বাণী যেন হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে এসেছে এবং শোনা মাত্রই হৃদয় মথিত হয়ে ওঠে। তিনি লিখেছেন :
“আমি নহি কারো নয়নের মনি
নহি কো কারো সুখের খনি
অকেজো শুধু সবার জানি
এক মুঠো ধূলি মাত্র হাতের।
আমি শূন্য যে হায় রূপ যৌবনে
ছেড়ে গেছে প্রেমিকা এক্ষণে
ঝরা পাতার শুষ্ক বাগানে
আছি হয়ে গো বাহার বসন্তের।
কেন কেউ ক’রবে প্রার্থনা
ছড়াবে কেন ফুল ঝরনা
কিংবা প্রদীপ জ্বেলে অর্চনা
সমাধিতে এই চির দুঃখিতের।
আমি নহি তো মন মুগ্ধকারী গীত
এ দুঃখ শুনে কেই বা করে হিত
মম ধ্বনি ভরে বিরক্তে চিত
হাহাকার শুধু হৃদয় ব্যথিতের”
মানব-মানবীর প্রেমে গজল গান যেমন মানুষকে অভিভূত করে তোলে, আধ্যাত্মিক প্রেমেও মানুষের মন উচাটন করে তোলে। গজলের প্রেম-গীতির গীত রসে আপ্লুত হয় দেহ-মন। প্রিয়া-মিলন আর স ষ্টা-মিলনের অমর গাথা হয়ে গজল গানের প্রেম-রসে সিক্ত হবে মানুষের মন অনন্তকাল।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article গজল, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.