আলোক চিত্রানুলিপিকারক

আলোক চিত্রানুলিপিকারক বা আলোক চিত্রানুলিপি যন্ত্র এক ধরনের বৈদ্যুতিক যন্ত্র, যা যেকোনও হস্তলিখিত, মুদ্রিত বা অঙ্কিত উৎসের (নথি, ছবি, নকশা, বই, ইত্যাদি) আলোকচিত্র গ্রহণ ও ধারণ করে এবং এর পরে কাগজ কিংবা পাতলা প্লাস্টিকের পর্দা দিয়ে তৈরী পৃষ্ঠাতে দ্রুত ও কম খরচে ঐ ধারণকৃত আলোকচিত্রের বহুসংখ্যক অনুলিপি (হুবহু নকল বা কপি) উৎপাদন করে। ইংরেজি পরিভাষাতে একে ফটোকপিয়ার বা ফটোকপি মেশিন বলা হয়। উৎপাদিত নকল বা অনুলিপিগুলিকে চিত্রানুলিপি তথা ফটোকপি বলে।

আলোক চিত্রানুলিপিকারক
২০১০ সালের একটি আলোক চিত্রানুলিপিকারক (জিরক্স প্রযুক্তির)

বেশিরভাগ আধুনিক আলোক চিত্রানুলিপিকারক যন্ত্রে জিরোগ্রাফি (Xerography) বা শুষ্ক-চিত্রলিখন নামক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এটিকে স্থিরবৈদ্যুতিক মুদ্রণ (Electrostatic printing)-ও বলা হয়। এই প্রযুক্তিতে "টোনার" নামের শুষ্ক কালির গুঁড়াকে স্থিরবিদ্যুতের মাধ্যমে আকৃষ্ট করা হয় এবং এগুলিকে পরে তাপ, চাপ বা উভয়ের সমন্বয়ে কাগজে ছাপানো হয়। মার্কিন উদ্ভাবক চেস্টার কার্লসন ১৯৩৮ সালে সর্বপ্রথম প্রযুক্তিটি উদ্ভাবন করলেও এটিকে উন্নত করতে আরও ২০ বছর লেগে যায়। নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের রচেস্টার শহরে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র মার্কিন আলোকচিত্রণ প্রযুক্তি কোম্পানি জিরক্স (Xerox) ১৯৫৯ সালে উপর্যুক্ত জিরোগ্রাফি বা শুষ্ক-চিত্রলিখনভিত্তিক প্রথম আলোক চিত্রানুলিপিকারক যন্ত্র বাজারে নিয়ে আসে, যার নাম ছিল জিরক্স ৯১৪ (Xerox 914)। বৈপ্লবিক এই যন্ত্র দিয়ে খুবই সস্তায় এক পৃষ্ঠা অনুলিপি বা নকল (কপি) করা যেত; আগের তুলনায় অনুলিপির খরচ অর্ধেকেরও নিচে নেমে আসে (প্রতি পাতায় খরচ ২৫ সেন্ট থেকে ১০ সেন্টে নেমে আসে)। যন্ত্রটি ১ মিনিটে ৭টি অনুলিপি করতে পারত। জিরক্সের সুবাদে ১৯৬০-এর দশক থেকে নথিপত্র ও দলিলাদি অনুলিপিকরণ প্রক্রিয়াতে বিপ্লবের সৃষ্টি হয়। বর্তমানে বাজারের সিংহভাগ আলোক চিত্রানুলিপিকারক যন্ত্রই জিরক্স কোম্পানির যন্ত্রের সদৃশ। আলোক চিত্রানুলিপিকারক যন্ত্র ২০শ শতকের শেষে এসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ের অবিচ্ছেদ্য একটি সরঞ্জামে পরিণত হয়। কার্যালয়ের বাইরেও আলোক চিত্রানুলিপি সেবা প্রদানকারী অনেক দোকান গড়ে ওঠে যেখানে সাধারণ ব্যক্তি এমনকি কার্যালয়ের কর্মচারীরা চাহিদা অনুযায়ী অনুলিপি করাতে পারে।

ইদানীং ২১শ শতকে এসে চিত্রগ্রহণযন্ত্র বা স্ক্যানার, মুদ্রণযন্ত্র বা প্রিন্টার ও আলোক চিত্রানুলিপিকারক যন্ত্র বা ফটোকপিয়ার - তিন ধরনের যন্ত্র একত্র করে একটি যন্ত্রে পরিণত করা হয়েছে এবং এ ধরনের সমন্বিত যন্ত্র ব্যবহারের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সমন্বিত যন্ত্রের আবির্ভাবের ফলে পুরাতন এক-উদ্দেশ্যের যন্ত্রগুলির দাম অনেক কমে যাওয়ায় এগুলি এখনও অনেক জনপ্রিয়। কারও কারও মতে ভবিষ্যতে মানুষ ফোন, কম্পিউটার বা ট্যাবলেটের পর্দাতেই সবসময় পড়বে এবং আলোক চিত্রানুলিপির প্রয়োজন ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকবে।

আলোক চিত্রানুলিপিকারকের কাজের পদ্ধতি

আলোক চিত্রানুলিপিকারক 
আলোক চিত্রানুলিপিকরণ প্রক্রিয়ার নকশা

প্রথমে ব্যবহারকারী বৈদ্যুতিক সুইচ টিপে যন্ত্রটি চালু করেন। যন্ত্রের উপরের অংশটি হল চিত্রগ্রাহক বা স্ক্যানার। এটির উপরে একটি কব্জালাগানো ঢাকনা থাকে। ঢাকনাটি খুললে নিচে একটি অনুভূমিক কাচের জানালা দেখতে পাওয়া যায়। এরপর যে পৃষ্ঠাটির অনুলিপি বা নকল করতে হবে, সেটিকে উপুড় করে কাচের জানালার উপর স্থাপন করতে হয়। এরপর ঢাকনা বন্ধ করে দিয়ে যন্ত্রের সম্মুখভাগে অবস্থিত নিয়ন্ত্রক অংশে (কন্ট্রোল প্যানেল) চাবি টিপে বা স্পর্শকাতর পর্দায় টিপে নির্দেশ দিলে কাচের জানালার নিচ থেকে উজ্জ্বল আলো পৃষ্ঠাটির উপর এসে পড়ে সেটিকে আলোকিত করে। এর ফলে পৃষ্ঠাটির যে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয়, সেটি একটি পরকলা বা লেন্সের ভেতর দিয়ে অভিক্ষিপ্ত হয়ে সেলিনিয়াম ধাতুর (বা অন্য কোনও আলোকপরিবাহী পদার্থ; Photoconductor) প্রলেপ লাগানো একটি ঘূর্ণায়মান পিপা বা ড্রামের উপর গিয়ে পড়ে। পিপাটির সেলিনিয়াম পৃষ্ঠ স্থিরবিদ্যুৎ দ্বারা ঋণাত্মক আধানে আহিত থাকে। সেলিনিয়ামের একটি বিশেষ ধর্ম হল এই যে এর উপর আলো পড়লে এর বৈদ্যুতিক রোধ হঠাৎ করে কমে যায়। পৃষ্ঠার সাদা অংশ থেকে প্রতিফলিত ও আগত আলো পিপার পৃষ্ঠের যে অংশে পড়ে, সে অংশের রোধ কমে যায় এবং ঋণাত্মক আধান ভূমিতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যায়। অন্যদিকে পৃষ্ঠার কালো অংশ থেকে কোন আলো পিপার পৃষ্ঠে এসে পৌঁছায় না বলে ঐ অংশের রোধের কোনও পরিবর্তন হয় না, ফলে সেটি তখনও ঋণাত্মক আধানে আহিত থাকে। অন্যদিকে টোনার (Toner) তথা বিশেষ কালির গুঁড়াগুলি ধনাত্মক আধানে আহিত থাকে। এগুলি সেলিনিয়ামের ঋণাত্মক আধানগুলির দ্বারা আকৃষ্ট হয়, এবং ঠিক সেইসব জায়গায় পিপার গায়ে লেগে যায়। পিপার পৃষ্ঠে এভাবে মূল পৃষ্ঠার একটি বিপরীতমুখী নকল বা অনুলিপি তৈরি হয়। এখন সাদা কাগজের পৃষ্ঠাকে পিপার কাছে এনে ঘূর্ণায়মান পিপা ঘেঁষে গড়িয়ে দিলে সাদা কাগজে কালিগুলি স্থানান্তরিত হয়ে যায়, কেননা কাগজ পিপার চেয়েও বেশি ঋণাত্মক থাকে। এরপর কালির ছাপ পড়া কাগজের পৃষ্ঠাকে উত্তপ্তকারী বেলন (হিট রোলার বা ফিউজার রোলার; Heat roller বা Fuser roller) এবং চাপপ্রদানকারী বেলনের (প্রেশার রোলার; Pressure roller) মধ্য দিয়ে চালনা করলে পৃষ্ঠার সামনের দিকে অত্যধিক উত্তাপ ও পেছনের দিক থেকে চাপের কারণে কালির গুঁড়া গলে কাগজের গায়ে সামনের দিকে স্থায়ীভাবে আটকে যায়। সবশেষে মুদ্রিত কাগজটি যন্ত্রের বাইরে নির্দিষ্ট একটি ধারণপাত্রে বেরিয়ে এসে জমা হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। মূল প্রমাণপত্র (Master document) একবার চিত্রগ্রহণ হয়ে যাবার পর একাধিক অনুলিপি মুদ্রণ করা যায় এবং একেকটি অনুলিপি মুদ্রণ করতে এক সেকেন্ড বা তারও কম সময়ের দরকার হয়।

তথ্যসূত্র

Tags:

বৈদ্যুতিক যন্ত্র

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

দর্শনচট্টগ্রাম বিভাগএন্দ্রিক ফেলিপেএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রবাংলাদেশী জাতীয় পরিচয় পত্ররোডেশিয়াকম্পিউটার কিবোর্ডপদ্মা নদীউহুদের যুদ্ধশাকিব খানবিড়ালসূর্যগ্রহণলোকনাথ ব্রহ্মচারীআর্জেন্টিনা–ব্রাজিল ফুটবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাবাংলা একাডেমিবিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সরোহিত শর্মাজালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমিশিক্ষাআহল-ই-হাদীসমুম্বই ইন্ডিয়ান্সপিনাকী ভট্টাচার্যকোপা আমেরিকারাগ (সংগীত)ডাচ্-বাংলা ব্যাংক পিএলসিস্বাধীনতা দিবস (ভারত)হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীইসলামে বিবাহচিরস্থায়ী বন্দোবস্তইউরোপীয় দেশগুলো ও অধীনস্থ ভূভাগের তালিকাঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েখালেদা জিয়াকোকা-কোলাঅকাল বীর্যপাতজনগণমন-অধিনায়ক জয় হেপ্রধান ধর্মাবলম্বী গোষ্ঠীসমূহনামাজের সময়সমূহসূরা নাসরইস্তেখারার নামাজসেন্ট মার্টিন দ্বীপসেজদার আয়াতওয়েবসাইটস্পিন (পদার্থবিজ্ঞান)বলপশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থামীর মশাররফ হোসেনবাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মরত জেনারেলদের তালিকাগুগলসিকিমথ্যালাসেমিয়াযুক্তফ্রন্টতক্ষকআসরের নামাজযোনিমুহাম্মাদের বংশধারাপাবনা জেলাউপসর্গ (ব্যাকরণ)করপরমাণুইসলামে যৌনতামহাত্মা গান্ধীরমজান (মাস)টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাবাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধনীসমূহমশাপশ্চিমবঙ্গের জেলাযাকাতইসলামের নবি ও রাসুল২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপকবিতাগ্রাহামের সূত্রএইডেন মার্করামকুরআনরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্মবঙ্গভঙ্গ (১৯০৫)ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সসৈয়দ মুজতবা আলীবাংলা ভাষা🡆 More