রাধাকৃষ্ণ (সংস্কৃত: राधाकृष्ण, আইএএসটি: Rādhā-Kṛṣṇa) হিন্দুধর্মে সম্মিলিতভাবে ঈশ্বরের পুরুষ সত্ত্বা ও প্রকৃতি সত্ত্বার যুগলরূপ। এছাড়াও রাধা বলতে কোন নাম বা চরিত্র মহাভারত বা ভাগবত পুরাণের কোথাও উল্লেখ নেই। রাধা নামের রা শব্দটা রমন শব্দ থেকে এসেছে রমন শব্দের অর্থ হচ্ছে আনন্দ বর্ধনকারী। ধা শব্দটা ধারন থেকে এসেছে যার অর্থ ধারন করা। যিনি আনন্দকে ধারন করে থাকেন তিনিই রাধা, এবং আনন্দ হল শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণের আরেক নাম সচ্চিদানন্দ (সৎ, চিৎ, আনন্দ)। আনন্দ স্বরূপ কৃষ্ণকে যিনি মনের মধ্যে ধারন করে আছেন তিনিই রাধা। নিম্বার্ক ও গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মশাস্ত্রে, কৃষ্ণকে প্রায়শই স্বয়ং ভগবান রূপে উল্লেখ করা হয়, এবং রাধা একজন যুবতী নারী (কৃষ্ণের আনন্দ অংশের হ্লাদিনী শক্তি), একজন গোপিনী যিনি পরম সত্ত্বা কৃষ্ণের (পরমাত্মার প্রতীক) সর্বোত্তম প্রেয়সী। রাধা হল কৃষ্ণের সর্বপ্রিয় আরাধিকা। কৃষ্ণের সঙ্গে, রাধাকে সর্বোচ্চ দেবী হিসাবে স্বীকার করা হয়; কেননা তিনি নিজের প্রেমের মাধ্যমে কৃষ্ণকে নিয়ন্ত্রণ করেন। বিশ্বাস যে, কৃষ্ণ জগৎসংসারকে মোহিত করেন, কিন্তু রাধিকা তাকেও মোহিত করেন। এজন্য তিনি সকলের সর্বোচ্চ দেবী।
রাধাকৃষ্ণ | |
---|---|
দেবনাগরী | राधाकृष्ण |
আবাস | বৃন্দাবন |
সঙ্গী | রাধা |
যদিও ভগবানের এই রূপের আরাধনার অনেক প্রাচীন উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু দ্বাদশ শতাব্দীতে যখন জয়দেব গোস্বামী সুবিখ্যাত কাব্য গীতগোবিন্দ রচনা করলেন, তখন থেকেই দিব্য কৃষ্ণ ও তার ভক্ত রাধার মধ্যেকার আধ্যাত্মিক প্রেমের সম্বন্ধিত বিষয়টি সমগ্র ভারতবর্ষে উদযাপিত হতে শুরু করল। বলা হয় যে, কৃষ্ণ রাধিকার অন্বেষণে রাসনৃত্যের চক্র ছেড়ে দিয়েছিলেন। চৈতন্য সম্প্রদায়ের ভাষ্যমতে, রাধারাণীর নাম ও পরিচয়টি ভাগবত পুরাণে এই ঘটনা বর্ণনাকারী ছন্দোবন্ধে গোপনও রাখা হয়েছে এবং উজাগরও করা হয়েছে। রাধারাণী রাসনৃত্যের অংশীভূত হওয়া সমস্ত গোপিনী তথা দিব্য ব্যক্তিত্বদের মূলসত্ত্বা।
রাধাকৃষ্ণকে কখনোই দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায় না - কৃষ্ণ, বিষ্ণুর অষ্টম অবতার, এবং তার হ্লাদিনী শক্তি ('নাদশক্তি') রাধারূপে; কারণ কৃষ্ণের প্রতি রাধিকার প্রেম এতই দৃঢ়বদ্ধ যে, তারা যুগলে একক মূর্তি পরিগ্রহ করেন। বৃন্দাবনে কৃষ্ণের সর্বদা বামপার্শ্বে দণ্ডায়মানা রাধিকা
শক্তি ও শক্তিমান এর সাধারণ ব্যুৎপত্তি, অর্থাৎ ভগবানের পুরুষ ও স্ত্রী তত্ত্ব বলতে বোঝায়: শক্তি ও শক্তিমান আসলে একই। প্রত্যেক দেবতার নিজের সঙ্গিনী, 'অর্ধাঙ্গিনী' বা শক্তি থাকেন এবং সেই শক্তি ব্যতিরেকে তাকে কখনো-কখনো অপরিহার্য শক্তির সংযোগহীন বলে মনে করা হয়। কৃষ্ণ-উপাসনার যে পরম্পরায় তাকে পুরুষ সত্ত্বা স্বয়ং ভগবান রূপে দেখা হয়ে থাকে, সেই পরম্পরাতেই তার রাধার তথ্যসূত্র ও গুণগরিমা সংযুক্ত, যাকে পরম সত্ত্বা রূপে আরাধনা করা হয়। এই বিষয়টি স্বীকৃত যে, রাধা ও কৃষ্ণের সঙ্গম শক্তির সঙ্গে শক্তিমানের সঙ্গমকে ইঙ্গিত করতে পারে এবং এই দৃষ্টিভঙ্গিটি রক্ষণশীল বৈষ্ণব বা কৃষ্ণধর্মের বাইরে ভালোমতো বর্তমান।
বৈষ্ণব দৃষ্টিকোণ থেকে দৈবী স্ত্রী শক্তি, শক্তির এক দিব্য উৎসকে প্রতিবিম্বিত করে, ঈশ্বর বা শক্তিমান। "সীতার সাথে রাম সম্বন্ধিত, লক্ষ্মীর সাথে নারায়ণ সংযুক্ত; রাধার সাথে তাঁর কৃষ্ণ।" যেহেতু কৃষ্ণকে ঈশ্বরের সমস্ত রূপের উৎস হিসাবে মনে করা হয়, শ্রীরাধিকা, তার সহচরী, সকল শক্তিসমূহের মূল উৎস অথবা সমস্ত দৈবী শক্তির স্ত্রী রূপ।
পরম্পরা অনুসারে, এই আরাধনাকে বোঝার জন্য বিভিন্ন ব্যাখ্যার মধ্যে একটি ব্যক্তিগতবাদের সাধারণ উৎস আছে। বিশেষত চৈতন্যবাদী গৌড়ীয় বৈষ্ণবতত্ত্ব ও মিশন গভীরভাবে "ব্যক্তিনিষ্ঠবাদী", যা কৃষ্ণের সর্বোচ্চতা, রাধা-কৃষ্ণের রূপে চৈতন্য মহাপ্রভুর পরিচয়, ব্যক্তির নিজের বাস্তবিকতা ও নিত্যতা, এবং সর্বপ্রথম ও প্রধানতম ভাবে একজন ব্যক্তির রূপে পরম সত্য ও ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর ঘোষণা করে।
জীব গোস্বামী তার "প্রীতি সন্দর্ভ"-এ বলেছেন যে, প্রত্যেক গোপিনী বিভিন্ন স্তরের মনোভাবের তীব্রতা প্রকাশ করেন, যার মধ্যে রাধারটি সর্বোত্তম।
রামানন্দ রায় তার প্রসিদ্ধ 'সংবাদ'-এ, চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্য রাধাকে বর্ণিত করেছেন এবং অন্যান্য ব্যক্তিত্বদের কাছে চৈতন্যচরিতামৃতের ২.৮.১০০ এর একটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করেছেন, যার পর তিনি বৃন্দাবনের প্রাচীন সময়ে রাধার ভূমিকা বর্ণনা করেছেন।
এই তত্ত্ববিদ্যার কেন্দ্রবিন্দু রস শব্দের সাথে সম্বন্ধিত। এই শব্দের ধর্মসঙ্গত প্রয়োগ প্রাথমিক যুগেই পাওয়া যেতে পারে, নিম্বার্ক বা চৈতন্য সম্প্রদায়ের দু'হাজার বছর আগে, ব্রহ্মসূত্রের একটি বাক্যাংশে যেখানে প্রায়শই পরম্পরাগতভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে: "বস্তুত, ঈশ্বর হলেন রস" (রসো বৈ সঃ)। এই বক্তব্যটি প্রকাশ করে যে, ঈশ্বরই সেই একজন যিনি পরম রস বা আধ্যাত্মিক উৎসাহ, ভাবাবেশের আনন্দ গ্রহণ করেন।
হিন্দু ধর্মের নিম্নলিখিত পরম্পরাগুলিতে রাধা ও কৃষ্ণের পূজা করা হয়:
রাজা গরীব নিবাজ ১৭০৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন এবং তিনি চৈতন্য পরম্পরার বৈষ্ণবশাখায় দীক্ষাগ্রহণ করেন, যারা কৃষ্ণের পূজা সর্বোচ্চ ঈশ্বর স্বয়ং ভগবান রূপে করে থাকে। তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে এই ধর্মের অভ্যাস করেছিলেন। প্রচারক ও তীর্থযাত্রীদের আগমন বিপুল সংখ্যায় ঘটতে থাকে এবং আসামের সাথে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
মণিপুরী বৈষ্ণবগণ কৃষ্ণের পূজা আলাদাভাবে করেন না, বরং রাধা-কৃষ্ণকে একত্রে আরাধনা করেন। বৈষ্ণব মতের প্রসারের সঙ্গে রাধা ও কৃষ্ণের পূজা মণিপুরে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। সেখানকার প্রতিটি গ্রামে একটি ঠাকুর-ঘাট ও একটি মন্দির বিদ্যমান।। রাস ও অন্যান্য নৃত্য প্রায়শই আঞ্চলিক লোক ও ধার্মিক পরম্পরার এক বিশেষত্ব, উদাহরণস্বরূপ, একজন মহিলা নর্তকী একই নাটিকায় কৃষ্ণ ও তার সহচরী রাধা, উভয়ের চরিত্রেই অভিনয় করেন।
বৈদিক ও পৌরাণিক সাহিত্যে, রাধা ও এই ধাতুর অন্য রূপ >রাধ-এর অর্থ হল 'পূর্ণতা', 'সফলতা' এবং কখনো-কখনো 'বৈভব'। সফলতার দেবতা ইন্দ্রকে রাধাস্পতি রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। ভাগ্যের দেবতার রূপে মহাবিষ্ণুর সূত্রে এবং জয়দেব দ্বারা জয় জয়দেব হরে রূপে স্বতন্ত্রভাবে প্রযুক্ত - বিজয়ী হরি ও রাধাস্পতি, সবাইকেই ক্ষেত্রবিশেষে অনেকবার দেখা গেছে। রাধা শব্দটি অথর্ববেদ, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ও তৈত্তিরীয় সংহিতায় প্রাপ্ত হয়।
যসস্তিলক চম্পুকাব্য (৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দ), জয়দেবের সময়ের আগে থেকেই রাধা ও কৃষ্ণকে ভালোভাবে গ্রন্থিত করেছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ও পদ্মপুরাণ-এ রাধার বেশ কয়েকটি বিস্মৃত তথ্যসূত্র আধারিত রয়েছে।
গৌড়ীয় বৈষ্ণব, নামের মাধ্যমেই বোধগম্য, সাধারণভাবে বাংলার ভূখণ্ডকে নির্দেশ করে। প্রারম্ভিক বাংলা সাহিত্যে এই বিবরণের এবং রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমভাব বিকশিত হওয়ার বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়। বরং একথা বিশ্বাস করা হয় যে, জয়দেব গোস্বামীর কাব্য গীতগোবিন্দে তার নায়িকার উৎস সংস্কৃত সাহিত্যে একটি প্রহেলিকা হয়ে আছে। একইসঙ্গে গীতগোবিন্দের আগের কাব্যকৃতি সম্বন্ধেও উৎকৃষ্ট আকারের লিখিত তথ্যসূত্র বর্তমান রয়েছে, যার সংখ্যা প্রায় ২০। রাধার চরিত্র সংস্কৃত সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি রহস্যপূর্ণ; তার বর্ণন প্রাকৃত বা সংস্কৃত কাব্যে শুধুমাত্র কিছু নির্বাচিত ছন্দপ্রয়োগে, কিছু শিলালিপি ও ব্যাকরণে, কবিতা ও নাটকে করা হৃযেছে। জয়দের তার তথ্যসূত্র সংগ্রহ করে ১২শ শতাব্দীতে ভাবাবিষ্ট ভক্তিতে মথিত একটি উৎকৃষ্ট কাব্য রচনা করেন এবং এই কাব্য থেকেই প্রসূত হওয়া এক বিশাল আন্দোলন বিশিষ্টরূপে বাংলার ভূখণ্ডে শুরু হয়।
বড়ু চণ্ডীদাস আদি-মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে উল্লেখনীয়; তার বিরচিত কাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর সময়-তারিখ এখনো অনুত্তরিত, যদিও এই সাহিত্যকর্ম বাংলার সাহিত্যে ও ধর্মে "গোপিনী রাধার উদ্দেশ্যে ভগবান কৃষ্ণের প্রেম"-এর জনপ্রিয় কাহিনীর চিত্ররূপের এক অনন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রারম্ভিক সাক্ষ্য। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর ৪১২ টি গীতিপদকে তেরো খণ্ডে বিভক্ত করা হয়, যা রাধা-কৃষ্ণের পৌরাণিক চক্রের মর্মকথাকে প্রদর্শিত করে এবং এর অনেকগুলি ভিন্ন রূপের উৎকৃষ্ট তুলনাত্মক সামগ্রী প্রদান করে। পাণ্ডুলিপি থেকে স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত যে, এই গানসমূহ এমনই গান ছিল যেগুলি গাওয়ার জন্য বিশেষ রাগ-এর আবশ্যকতা ছিল। গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অর্থবহ এই গ্রন্থের প্রামাণ্যতা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে।
চৈতন্যবাদী বৈষ্ণব মতের এই বঙ্গীয় পরম্পরায় আধ্যাত্মিক স্থিতি এবং রাধা-উপাসনা কৃষ্ণদাস কবিরাজকৃত চৈতন্যচরিতামৃত-এ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়, যেখানে তিনি ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দে চৈতন্য মহাপ্রভুর দেহাবসানের পর বৃন্দাবনের চৈতন্যবাদী ভক্তদের মধ্যে পরিব্যাপ্ত থাকা মতবাদকে পরিবেশিত করেছিলেন। বিশ্বাস করা হয় যে, রাধারূপে কৃষ্ণকে প্রেম নিবেদনের কিরকম অনুভূতি হয়ে থাকে, তা আস্বাদনের জন্য স্বয়ং কৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভুর অবয়বে অবতারধারণ করেন। আর কৃষ্ণকে আমোদিত করার জন্য রাধা (চৈতন্যরূপে প্রকটিত) যা করে থাকেন তা হল সেই আনন্দরূপের নামোচ্চারণ।
গোপাল ভট্ট গোস্বামী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্বয়ং-প্রকট এক বিগ্রহমূর্তিকে রাধারমণ বলা হয়, যাকে বিস্ময়পূর্ণভাবে কেবল কৃষ্ণের রূপেই নয় বরং রাধা-কৃষ্ণের রূপে দেখা হয়ে থাকে। আর বৃন্দাবনের কেন্দ্রে অবস্থিত তার মন্দিরে পূজার্চনা সতত দৈনন্দিন এক ক্রিয়া, যার মধ্যে সারাদিনের বেশকিছু নির্ধারিত কার্য রয়েছে, এবং যার লক্ষ্য তাত্ত্বিক ও প্রত্যন্তভাবে থেকেও রাধা ও কৃষ্ণের সঙ্গে প্রত্যক্ষরূপে উপস্থিত ও সংযুক্ত থাকার সম্ভাবনা আকাঙ্ক্ষা করা।
নিম্বার্ক সম্প্রদায়, রুদ্র সম্প্রদায়ের মতই, অন্ততপক্ষে দ্বাদশ শতাব্দীর সময় থেকে শুরু করে এককভাবে বা তার সহচরী রাধার সাথে বালক কৃষ্ণের পূজা করে থাকেন। নিম্বার্ক অনুযায়ী, রাধা বিষ্ণু-কৃষ্ণের শাশ্বত সঙ্গী ছিলেন এবং এমনও মত আছে যে, তিনি তার প্রেমিক কৃষ্ণের পত্নী হয়েছিলেন (যদিও স্পষ্ট করে কোন বক্তব্য নেই)। এটি মনে রাখা দরকার যে, নিম্বার্ক এই সাহিত্যের প্রকল্পিত অনৈতিক নিহিতার্থ থেকে রাধাকে উদ্ধার করেন এবং তাকে সেই গরিমা প্রদান করেন যা অন্য কোথাও তাকে দেওয়া হয়নি।
নিম্বার্ক দ্বারা স্থাপিত নিম্বার্ক সম্প্রদায় হল চারটি বাস্তবিক বৈষ্ণব পরম্পরার মধ্যে একটি। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে মথুরা ও বৃন্দাবনের ধ্বংসের কারণে সাক্ষ্যের অভাব এই বোঝায় যে, এই পরম্পরার প্রকৃত সন-তারিখ ও উৎস রহস্যের অতলে নিমজ্জিত এবং অনুসন্ধানের প্রতীক্ষারত।
সত্যানন্দ জোসেফ, অধ্যাপক বিহারী জোশী, অধ্যাপক এম. এম. অগ্রবাল প্রমুখ পণ্ডিতরা নিম্বার্ককে অন্ততপক্ষে শঙ্করাচার্যের (তিনিই প্রথম আচার্য ছিলেন যিনি রাধা ও কৃষ্ণের উপাসনা সখীভাব উপাসনা-পদ্ধতিতে করতেন) সমসাময়িক বা তার আবির্ভাবের পূর্ববর্তী সময়ের বলে মনে করেন। তার বেদান্ত কামধেনু দশশ্লোকীতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে:-
"অঙ্গে তু বামে বৃষভানুজম্ মুদা বিরাজমানম্ অনুরূপসৌভাগম্। সখীসহস্রেহ পরিসেবিতাম্ সদা স্মরেম্ দেবীম্ সকলেষ্টকামদাম।" শ্লোক ৬।
পরমেশ্বরের শরীরের বামভাগে শ্রীমতী রাধা বিদ্যমান, যিনি হর্ষসহকারে অধিষ্ঠিতা, স্বয়ং পরমেশ্বরের মতই সুন্দর; সহস্র গোপিনী যার সেবা করেন: আমরা সেই সর্বোচ্চ দেবীর ধ্যান করি, যিনি সকল কামনা-বাসনা পূরণ করেন।
এই ভাবনাটি জয়দেব গোস্বামী এবং সেইসময়ের অন্যান্য কবিদের দ্বারা গৃহীত হয়েছিল, যারা সেই অন্তর্নিবিষ্ট সৌন্দর্য ও আনন্দকে চাক্ষুষ করেছিলেন যা এই দর্শনকে নির্মাণ করেছিল।
এই সম্প্রদায়ে, রাধার মাহাত্ম্য শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্যের চেয়ে কম নয়। নিম্বার্কের এই ঘরানায় দুজনেই সংযুক্তভাবে আরাধনার সামগ্রী। নিম্বার্ক বেদান্ত-পারিজাত-সৌরভ নামের ভাষ্যে ব্রহ্মসূত্র-এর অন্যতম প্রথম টিপ্পনীকারদেরও একজন ছিলেন। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকের নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের পরবর্তী আচার্যগণ বৃন্দাবনে এই দিব্য যুগ্মসত্ত্বার উপর আরো সাহিত্যের রচনা করেন। জয়দেবের বড় ধর্ম-ভাই স্বামী শ্রীভট্ট জয়দেবের মতই সঙ্গীতময় পরিবেশনার ধ্রুপদী শৈলীর জন্য যুগল শতক রচনা করেন, কিন্তু সংস্কৃতে কাব্য রচনাকারী জয়দেবের বিপরীতে স্বামী শ্রীভট্টের রচনাসমূহ ব্রজ ভাষায় (হিন্দির এক স্থানীয় রূপ যা সকল ব্রজবাসী বুঝতে পারতেন) লিখিত। বস্তুত, এই পরম্পরার বাকী আচার্যগণ ব্রজভাষাতেই লিখেছিলেন; কিন্তু যদিও এই আচার্যবৃন্দ বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামীর থেকে কয়েক শতাব্দী প্রাচীন ছিলেন, তবুও আধুনিক সময়ে এই ভাষার অল্প প্রসারের কারণে গবেষণা খুব কম পরিমাণে হয়েছে।
যেকোনো প্রকারেই, নিম্বার্ক সম্প্রদায়ে উপাসনার একমাত্র সামগ্রী সংযুক্ত দিব্যদম্পতি রাধা-কৃষ্ণ। পঞ্চদশ শতাব্দীর জগদ্গুরু স্বামী শ্রী হরিব্যাস দেবাচার্য লিখিত মহাবাণী অনুসারে
"রাধামকৃষ্ণস্বরূপম্ বৈ, কৃষ্ণম্ রাধাস্বরূপিনম্; কলাত্মানম্ নিকুঞ্জস্থং গুরুরূপম্ সদা ভজে"
আমি নিরন্তর রাধার গুণগান করি যিনি কৃষ্ণ ছাড়া অন্য কেউ নন, এবং শ্রীকৃষ্ণ রাধা ছাড়া অন্য কেউ নন, যাদের সম্মিলন কামবীজ দ্বারা প্রকাশ করা হয় এবং যারা অনন্তকাল নিকুঞ্জ গোলোক বৃন্দাবনের নিবাসী।
রাধা-কৃষ্ণের দর্শনে নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের অবদান অস্বীকার করা যায় না, যেহেতু এই দর্শন ও তত্ত্ববিদ্যা এখান থেকেই আরম্ভ হয়েছিল।
স্বামীনারায়ণ সম্প্রদায়ে রাধা-কৃষ্ণ দেবের একটি বিশেষ স্থান আছে, কারণ স্বামীনারায়ণ নিজেই তার রচনা শিক্ষাপত্রীতে রাধা-কৃষ্ণের উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও, তিনি নিজে রাধা-কৃষ্ণকে দেবতা রূপে স্থাপনা করতে মন্দিরসমূহ নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন। স্বামীনারায়ণ "ব্যাখ্যা করেন যে, কৃষ্ণ বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত হন। যখন তিনি রাধার সঙ্গে থাকেন, তখন তাঁকে রাধা-কৃষ্ণ নামে সর্বোচ্চ ঈশ্বর আখ্যা দেওয়া হয়; রুক্মিণীর সঙ্গে থাকার সময়ে তাঁকে লক্ষ্মীনারায়ণ বলা হয়ে থাকে।" এই সম্প্রদায়ে প্রথম মন্দির ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে আমেদাবাদে নির্মিত হয়েছিল, যার কেন্দ্রীয় কক্ষে নরনারায়ণ (অর্জুন ও কৃষ্ণের যুগল রূপ) স্থাপন করা হয়। কক্ষের বাঁ দিকের মন্দিরে রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি রয়েছে।
এই পরম্পরার দর্শন অনুসারে গোপিনী নামে কৃষ্ণের অনেক সহচরী ছিলেন, কিন্তু তাদের মধ্যে রাধাকে সর্বোৎকৃষ্ট ভক্ত বলে গণ্য করা হত। যারা কৃষ্ণের নিকটে আসতে ইচ্ছা করেন, তাদের রাধার মত ভক্তির গুণাবলী বিকশিত করা উচিৎ। এই তত্ত্বানুযায়ী সম্প্রদায়টি গোলোককে এক সর্বোচ্চ স্বর্গ বা আবাসস্থল (বাস্তবে, তাদের কিছু মন্দির যেমন: শ্রী স্বামীনারায়ণ মুম্বাই মন্দিরে স্থাপিত মূর্তি হলেন শ্রী গোলোকবিহারী ও রাধিকাজী) হিসেবে আলাদা রেখেছেন, কারণ শ্রীকৃষ্ণ সেখানে তার গোপিনীদের সঙ্গে লীলাসুখ আস্বাদন করছেন বলে মনে করা হয়, যাঁরা স্বামীনারায়ণ সম্প্রদায়ের মতে সেই গোয়ালিনীবৃন্দ যাঁদের সঙ্গে কৃষ্ণ নৃত্য করেছিলেন; তাদের সাথে শ্রীকৃষ্ণের সম্বন্ধ ভগবানের সাথে ভক্তের প্রতিদান সম্বন্ধের প্রতীক।
চৈতন্যদেবেরও আগে পুষ্টিমার্গ-এর সংস্থাপক বল্লভাচার্য রাধার পূজা করতেন, যেখানে কতিপয় সম্প্রদায়ের মতে, ভক্তের পরিচয় মূলত রাধার সহচরী (সখী) রূপে ঘটে যারা রাধাকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের আয়োজনের জন্য বিশেষ অধিকার প্রাপ্ত হন।
এই পরম্পরার কবিদের মধ্যে (যা রাধাবল্লভী নামেও পরিচিত) একজন ভাস্বর কবি ধ্রুবদাস, যিনি প্রধানত রাধা ও কৃষ্ণের ব্যক্তিগত সম্পর্কের সাথে জড়িত থাকার জন্য উল্লেখনীয়। তার কবিতা চৌরাসীপদ-এ এবং তার অনুগামীদের টিপ্পনীসমূহে, অনন্তলীলার নিরন্তর প্রতিবিম্বনের অদ্বিতীয় উপযোগিতার মননের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়।
আপন বৈষ্ণব সহ-ধর্মবেত্তাদের সাথে রাধাবল্লভীগণ ভাগবত পুরাণ-এর উপর অপার শ্রদ্ধা রাখেন, কিন্তু রাধা ও অন্যান্য গোপিনীদের সঙ্গে সম্বন্ধের পরিধির বাইরের কিছু অন্তরঙ্গতা এই ঘরানার তত্ত্বগত দর্শনে প্রতিফলিত হয় না। জোর দেওয়া হয় সম্পর্কের মিষ্টত্ব বা রসের প্রতি।
কতিপয় হিন্দু বিদ্বান এবং হিন্দু ধর্মের পণ্ডিতের মতানুসারে, একসময় এমন এক স্বর্ণযুগ ছিল যখন হিন্দু ও মুসলিমরা এক সাধারণ সংস্কৃতির নির্মাণ করেছিলেন যার প্রধান কারণ ছিল কিছু মুসলিম শাসক দ্বারা সংস্কৃত এবং সংস্কৃত থেকে ফার্সি ভাষায় অনুবাদের সংরক্ষণ প্রদান, যেখানে মুসলিম নামধারী এমনসব কবি ছিলেন যারা রাধা ও কৃষ্ণের সম্বন্ধেও লেখালিখি করেছিলেন।
বৃন্দাবন ও মথুরাকে রাধা-কৃষ্ণ পূজনের কেন্দ্র হিসাবে গণ্য করা হয়। বৃন্দাবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্দির হল:
মদন-মোহন, গোবিন্দদেব, রাধা-রমণ, রাধা-গোকুলানন্দ, রাধা-দামোদর, বাঁকী-বিহারী, রাধাবল্লভ, যুগলকিশোর, রাধা-গোপীনাথ, রাধা শ্যামসুন্দর, ইসকন মন্দির এবং কৃষ্ণ-বলরাম মন্দির যেখানে রাধা ও কৃষ্ণের পূজা তাদের মূর্তিরূপে করা হয়ে থাকে।
শ্রীরাধা রাসবিহারী অষ্টসখী মন্দির
বৃন্দাবনে, ভগবান কৃষ্ণের "লীলা স্থান" (দিব্য মনোভাব ব্যক্ত করার স্থান), ৮৪ কোষ ব্রজ পরিক্রমাকারী কৃষ্ণভক্তদের অবশ্য গম্য একটি মন্দির। এটিই সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রাচীন ভারতীয় মন্দির যা এই দিব্যযুগল এবং তাদের অষ্টসখীর উদ্দেশ্যে সমর্পিত। এটি শ্রী বাঁকেবিহারী মন্দিরের নিকটে অবস্থিত।
কিংবদন্তি আছে যে, এই মন্দির মথুরা ও বৃন্দাবনে সেই দুটি স্থানের মধ্যে একটি যেখানে ভগবান কৃষ্ণ আপন প্রেয়সী রাধা এবং তার সখীদের সাথে রাসলীলার সময় অন্তরঙ্গভাবে উপস্থিত ছিলেন।
শ্রী রাধাবল্লভ মন্দির বৃন্দাবন
শ্রী রাধাবল্লভ মন্দির বৃন্দাবনের ৭টি বিখ্যাত ঠাকুরের মন্দিরের অন্যতম; এরা হলেন: শ্রী রাধাবল্লভ জী, শ্রী বাঁকেবিহারী জী, শ্রী গোবিন্দদেব জী, শ্রী মদনমোহন জী, শ্রী গোপীনাথ জী, শ্রী রাধারমণ জী এবং শ্রী রাধা-দামোদর জী।
এমন অনেক পরম্পরা আছে যেগুলির মাধ্যমে রাধা-কৃষ্ণের আরাধনা অন্য অনেক দেশে প্রসারিত হয়েছে, তা সে অভিবাসনের দ্বারাই ঘটে থাকুক বা সাধুদের প্রচারাভিযানের দ্বারা।
এমনই একজন অগ্রগণ্য পণ্ডিত, অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ স্বয়ং অনেক কেন্দ্র উন্মোচন করেন, যেখানে তিনি ম্লেচ্ছ থেকে ব্রাহ্মণে রূপান্তরিত ছাত্রছাত্রীদের রাধা-কৃষ্ণের মূর্তির পূজা করার এবং "ঈশ্বরের সেবায় সমর্পিত" হওয়ার শিক্ষা প্রদান করতেন।
শ্রীরাধিকা কৃষ্ণাষ্টক (রাধাষ্টক নামেও পরিচিত) হল একটি ভজন। বলা হয় যে, পাঠক এই নাম জপের দ্বারা রাধার মাধ্যমে কৃষ্ণের সান্নিধ্যলাভ করতে পারেন।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article রাধাকৃষ্ণ, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.