রাণী ভবানী: রাজশাহীর জমিদার

মহারাণী ভবাণী (১৭১৬ - ১৮০২) ইংরেজ শাসনামলে বর্তমান বাংলাদেশের নাটোরের একজন জমিদার ছিলেন। তার পিতা আত্মারাম চৌধুরী এবং মাতা তমাদেবী চৌধুরী রাণী ৷ দান, ধ্যান, শিক্ষা, পানীয় জলের ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, চিকিৎসা ও ধর্মীয় কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তার প্রজারা তাকে ‘মহারাণী’ নামে আখ্যায়িত করে।

রানী ভবানী
নাটোরের রাণী, অর্ধবঙ্গেশ্বরী
পূর্বসূরিরাজা রামকান্ত
জন্ম১৭১৬
ছাতিয়ানগ্রাম, আদমদিঘি, বগুড়া, সুবাহ বাংলা
মৃত্যু৫ই সেপ্টেম্বর, ১৮০২
নাটোর, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত(বর্তমানে রাণী ভবানী: ব্যক্তিগত জীবন, জমিদারী, রানী ভবানীর প্রাসাদ বাংলাদেশ)
দাম্পত্য সঙ্গীরাজা রামকান্ত
পিতাআত্মারাম চৌধুরী
মাতাতমাদেবী চৌধুরী রাণী
ধর্মহিন্দু

ব্যক্তিগত জীবন

রাণী ভবানী: ব্যক্তিগত জীবন, জমিদারী, রানী ভবানীর প্রাসাদ 
ছোট তরফ রাজ প্রাসাদ, রাণী ভবানী রাজবাড়ি

বগুড়া জেলার তৎকালীন আদমদিঘী থানাধীন ছাতিয়ান নামক গ্রামে রানী ভবানী জন্মগ্রহণ করেন। খুব অল্প বয়সেই তৎকালীন নাটোরের জমিদার রাজা রামকান্তের সাথে রানী ভবানীর বিয়ে হয়। তার তিন সন্তানদের মধ্যে (২ ছেলে, ১ মেয়ে ) শুধু তারাসুন্দরী জীবিত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি রামকৃষ্ণকে দত্তক নেন। ১৮০২ সালে রানী ভবানীর মৃত্যুর পর তার দত্তকপুত্র রামকৃষ্ণ রাজ্যভার গ্রহণ করেন। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর রাজবাড়ী বড় তরফ ও ছোট তরফ এ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। রামকৃষ্ণের দুই সন্তান বিশ্বনাথ (বড় তরফ) শিবনাথ (ছোট তরফ) (নাটোর রাজবাড়ীতে দুইটি তরফ আছে বড় তরফ ও ছোট তরফ)।রাজা শিবনাথের পুত্র রাজা আনন্দনাথ।

জমিদারী

১৭৪৮ সালে ১১৫৩ বঙ্গাব্দে রাণী ভবাণীর স্বামী রামকান্ত ইহলোক ত্যাগ করার পর নবাব ‘আলীবর্দি খাঁ’ রাজা রামকান্তের স্ত্রী রাণী ভবানীর ওপর জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। একমাত্র কন্যা তারাকে রেখে ৩২ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। তখনকার দিনে জমিদার হিসাবে একজন মহিলা অত্যন্ত বিরল ছিলেন, কিন্তু রাণী ভবাণী রাজশাহীর বিশাল জমিদার কার্য অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নির্বাহ করেন।

রাণীর শেষ জীবনে তখকার নাটোর রাজ্যের অধীন ভূমির পরিমাণ ছিল ১২ হাজার বর্গ মাইলেরও অধিক। মোট ১৩৯ পরগনার ১৭৪১৯৮৭ টাকা নবাব সরকারের রাজস্ব ধার্য ছিল। ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামকান্ত ১৮ বৎসর বয়সে স্বয়ং রাজ্যভার গ্রহণ করেন। তার সময়ে ১৬৪ পরগনা নাটোর রাজ্যের অধিকারভুক্ত হয়। একজন ইংরেজ লেখক হলওয়েল ধারণা দেন যে জমিদারী এস্টেটের বার্ষিক খাজনা ছিল প্রায় ৭ লক্ষ রুপী এবং বার্ষিক অর্জিত রাজস্ব ছিল প্রায় ১৫ লক্ষ রুপী।

পরবর্তীতে রাণী ভবানী রঘুনাথ লাহরীর সাথে তারার বিয়ে দেন এবং রাণী ভবানী তার জামাতার হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে নবাব সরকার জামাতার নামে জারি করেছিলেন। কিন্তু ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে সেই প্রিয় জামাতার মৃত্যু হওয়ায় আবার তাকে রাজ্যভার গ্রহণ করতে হয় এবং একমাত্র কন্যা তারা বাল্য বিধবা হয়ে তার সাথে বাস করতেন। দত্তক পুত্র রামকৃঞ্চ রায়ের ঔদাসীন্য হলে তার সম্পত্তি নিলাম হয়ে যায়। রাণী ভবানী বিশাল জমিদারীর মালিক হয়েও সাধারণ বিধবার বেশে থাকতেন।

১৭৮৬ সাল পর্যন্ত নাটোর রাজ্য ছিল ভারতবর্ষের মধ্যে বৃহত্তম জমিদারি। তার রাজত্বকালে জমিদারী বর্তমান নাটোর, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুস্টিয়া, যশোর, রংপুর এবং ভারতেপশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। এজন্য তাকে অর্ধবঙ্গেশ্বরী বলা হতো। প্রজা সাধারণের কল্যাণের জন্য রাণী ভবানী সুদীর্ঘ ৫০ বছর দক্ষতার সাথে তিনি বিশাল জমিদারী পরিচালনা করেন।


রানী ভবানীর প্রাসাদ

রাণী ভবানী: ব্যক্তিগত জীবন, জমিদারী, রানী ভবানীর প্রাসাদ 
তারকেশ্বর শিব মন্দির
রাণী ভবানী: ব্যক্তিগত জীবন, জমিদারী, রানী ভবানীর প্রাসাদ 
জলটুঙ্গি পুকুর,নাটোর রাজবাড়ী

রাণী ভবানীর স্মৃতিবিজড়িত মূল ভবনটিই ‘রাণী ভবানীর রাজবাড়ী’ অর্থাৎ ঐতিহ্যবাহী নাটোর রাজবাড়ি। গোটা রাজবাড়িতে ছোট-বড় ৮টি ভবন, ২টি গভীর পুকুর ও ৫টি ছোট পুকুর আছে। প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রবেশমুখে রয়েছে বিশাল একটি পুকুর, সেই পুকুরের শানবাঁধানো ঘাট দেখে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। জলটুঙ্গি, তারকেশ্বর, গোপীনাথ, আনন্দ, ও মহাল নামে রাজবাড়ীর ছোট পুকুরগুলির নাম। রাজবাড়ি ঘিরে আছে দুই স্তরের বেড়চৌকি।

জানা যায় এই বেড়চৌকি রাজবাড়িতে বহিশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করত। অপরূপ কারুকার্যখচিত বিশাল এই রাজবাড়ির মোট আয়তন ১২০ একর।

রাজবাড়ির উল্লেখযোগ্য মন্দিরগুলো হলো- শ্যামসুন্দর মন্দির, আনন্দময়ী কালীবাড়ি মন্দির, তারকেশ্বর শিব মন্দির।

পুরো রাজবাড়ি ঘিরে আছে বিশাল সব গাছ। রয়েছে নানা জাতের ফুলগাছ। পাশেই নবনির্মিত কমিউনিটি সেন্টার। কমিউনিটি সেন্টার ধরে সামনে গেলে তারকেশ্বর মন্দির।  আরেকটু সামনে এগিয়ে ডান দিকে বিশাল মাঠ। মাঠের বিশাল প্রন্তরে দাঁড়ালেই চোখে পড়বে রাজবাড়ির একতলা ভবনটি। এই অংশের নাম ছোট তরফ। এর ঠিক উল্টো দিকে বড় তরফ। যমজ প্রায় বড় তরফের সামনে রয়েছে বিশাল পরিখা ও পুকুর। সামান্য দূরেই রাণি মহলটিতে রাণি ভবানী বাস করতেন। এখন রাণি মহল আছে নামমাত্র। শুধু সাইনবোর্ডে লেখা দেখে চেনা যায়। এখানে একটি অতিথিশালা আছে, নাম মাত্র। তবু ভগ্নপ্রায় অতিথিশালা দেখে সে সময়কার নাটোর রাজার অতিথিসেবার কিছুটা নমুনা পাওয়া যায়। চলতি পথে দেখা গেল ছোট তরফের একটি ভবনের নাম হানি কুইন ভবন।

রাজবাড়ির আঙিনায় রয়েছে বিশাল বিশাল আটটি শিবমন্দির। মন্দিরগুলোতে এখনো রীতি মেনে নিয়মিত পূজা-অর্চনা করা হয়। দৃষ্টিনন্দন এই মন্দিরগুলো আপনাকে মুগ্ধ করবেই। মন্দিরের দেয়ালজুড়ে রয়েছে প্রাচীন টেরাকোটার শিল্পকর্ম। মন্দিরকে ঘিরে আছে একটি শিবমূর্তি, ফণা তোলা সাপের মূর্তি, একজন বাউলের মূর্তিসহ নানা রকমের শৈল্পিক কারুকাজ। ওপরে ওঠার জন্য প্রতিটি ভবনের পাশেই রয়েছে লোহার তৈরি ঘোরানো সিঁড়ি।

উল্লেখযোগ্য কাজ

রাণী ভবানী: ব্যক্তিগত জীবন, জমিদারী, রানী ভবানীর প্রাসাদ 
ধ্বংসপ্রাপ্ত নাটোর রাজবাড়ির মন্দিরের স্মৃতিচিহ্ন

অধিকন্ত্ত, অনাড়ম্বর ব্যক্তিগত জীবনযাপন করার সাথে সাথে রাণী ভবাণীর উদারতা এবং সমাজহিতৈষী মনোভাব তাকে সাধারণ জনগনের মাঝে জনপ্রিয় করে। তিনি বাংলায় শত শত মন্দির, অতিথিশালা এবং রাস্তা নির্মাণ করেন। তিনি প্রজাদের পানীয় জলের কষ্ট দূর করার জন্য অনেকগুলি পুকুরও খনন করেন। তিনি শিক্ষা বিস্তারেও আগ্রহী ছিলেন এবং অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উদারভাবে দান করেন। ১৭৫৩ সালে কাশী অর্থাৎ বেনারসে ভবানীশ্বর শিব ও দুর্গাবাড়ী, দুর্গাকুণ্ড, কুরুক্ষেত্রতলা নামক জলাশয় স্থাপন করেন তিনি।তিনি তারাপীঠ মন্দিরের ও সংস্কার করেন। হাওড়া থেকে কাশী পর্যন্ত রাস্তা নির্মান করেছিলেন যা রানী ভবানী রোড বা বেনারস রোড নামে খ্যাত ছিল। বর্তমানে এটি বোম্বে রোডের অংশ।শুধু তাই নয়।উত্তরবঙ্গের রেল যোগাযোগ বাতায়নে তার ভূমিকা লক্ষনীয় ছিল।

বগুড়া জেলার শেরপুরে অবস্থিত পীঠস্থান ভবানীপুরের মন্দিরসমূহের উন্নয়নে রাণী ভবাণী অনেক অবদান রাখেন। রাণী ভবাণীর নাটোর রাজবাড়ী বাংলাদেশে একটি দর্শনীয় স্থান। দত্তক পুত্র রামকৃষ্ণর হাতে রাজ্যভার দিয়ে তিনি মুর্শিদাবাদ চলে আসেন ও বড়নগরে কন্যাসহ বাস করতে থাকেন। ওয়ারেন হেস্টিংস পরবর্তী কালে জোরপূর্বক তার নাটোর জমিদারি কেড়ে নেন। মুর্শিদাবাদ জেলায় ভাগীরথী নদী তীরবর্তী বড়নগরে তার নির্মিত ১০০ টি শিবমন্দির ছিল। কালের প্রবাহে অল্প কয়েকটি মন্দির টিকে আছে। মন্দিরগাত্রের টেরাকোটা শৈলী আজও দর্শনার্থীকে আকৃষ্ট করে।

মহারাণী ভবানীর পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে জগদিন্দ্রনাথ ছিলেন স্বনামধন্য রাজা। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র যোগিন্দ্রনাথ বড় তরফের রাজা হন। কিন্তু তিনি কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। যোগিন্দ্রনাথের দুই পুত্র একে একে রাজ্যভার নিলেও তাদের নিজেদের সন্তান না থাকায় রাজবংশের পরিসমাপ্তি ঘটে।

মৃত্যু

রাণী ভবানী ১৮০২ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর ৮৬ বছর বয়সে নাটোরে পরলোকগমন করেন।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Tags:

রাণী ভবানী ব্যক্তিগত জীবনরাণী ভবানী জমিদারীরাণী ভবানী রানী ভবানীর প্রাসাদরাণী ভবানী উল্লেখযোগ্য কাজরাণী ভবানী মৃত্যুরাণী ভবানী আরও দেখুনরাণী ভবানী তথ্যসূত্ররাণী ভবানী বহিঃসংযোগরাণী ভবানীজমিদারনাটোরের জমিদারগণবাংলাদেশ১৭১৬

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

যৌনসঙ্গমহোমিওপ্যাথিআইনজীবীইউরোপসজীব ওয়াজেদশিবাজীবাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকাশ্রীবিজয়া এয়ার ফ্লাইট ১৮২সেশেলস জাতীয় ফুটবল দলমহাদেশ অনুযায়ী সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং নির্ভরশীল অঞ্চলসমূহের তালিকাজয়নুল আবেদিনদর্শনইব্রাহিম (নবী)রফিকুন নবীমহেরা জমিদার বাড়িবাংলাদেশের ইউনিয়নবিজয় দিবস (বাংলাদেশ)পাখিঢাকাসিপাহি বিদ্রোহ ১৮৫৭তরমুজবাংলাদেশ নৌবাহিনীপৃথিবীর ইতিহাসবাংলাদেশের ডেন্টাল কলেজসমূহের তালিকাআবুল আ'লা মওদুদীপরীমনিপহেলা বৈশাখডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডঋগ্বেদক্রোয়েশিয়াচীনবাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহের তালিকাশিবতাকওয়ানামের ভিত্তিতে মৌলসমূহের তালিকাবাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলস্মার্ট বাংলাদেশসূরা কাওসারমুসাফিরের নামাজচট্টগ্রাম বিভাগখাদ্যচট্টগ্রামপৃথিবীর বায়ুমণ্ডল২০২২-এ ইউক্রেনে রুশ আক্রমণঈদুল ফিতররক্তের গ্রুপউসমানীয় সাম্রাজ্যবাংলা বাগধারার তালিকাবিকাশভারতীয় জনতা পার্টিহরে কৃষ্ণ (মন্ত্র)চিকিৎসকআয়নিকরণ শক্তিআওরঙ্গজেবএশিয়ামুজিবনগর সরকারবাংলাদেশের স্থল বন্দরসমূহের তালিকাইহুদি ধর্মপিরামিডরাধাচিঠিপেশীপশ্চিমবঙ্গবিটিএসইহুদিফিফা বিশ্বকাপ ফাইনালের তালিকাশাকিব খানরাশিয়ায় ইসলামনেলসন ম্যান্ডেলাসাইবার অপরাধছারপোকাদক্ষিণ কোরিয়াকম্পিউটার কিবোর্ডস্কটল্যান্ডনীল বিদ্রোহজাকির নায়েকজাযাকাল্লাহক্লিওপেট্রা🡆 More