মার্কের সুসমাচার

সাধু মার্ক লিখিত সুসমাচার (গ্রিক: Εὐαγγέλιον κατὰ Μᾶρκον ; সংক্ষেপে মার্কলিখিত সুসমাচার বা মার্ক) হল চারটি প্রামাণ্য সুসমাচার এবং তিনটি ঐক্যমূলক সুসমাচারের মধ্যে দ্বিতীয়। নূতন নিয়মের এই পুস্তকে বাপ্তিস্মদাতা যোহন কর্তৃক যিশুর বাপ্তিস্ম থেকে শুরু করে মৃত্যুর পূর্বাবধি তাঁর যাজকবৃত্তি, যিশুর সমাধি ও তাঁর শূন্য সমাধিকক্ষ আবিষ্কারের কথা বর্ণিত হয়েছে। মার্কলিখিত সুসমাচারে যিশুর অলৌকিক জন্মবৃত্তান্ত বা তাঁর দিব্য প্রাক্-অস্তিত্বমূলক মতবাদ আলোচিত হয়নি। এমনকি এই পুস্তকের প্রামাণ্য সমাপ্তি অধ্যায়ে (মার্ক ১৬) যিশুর পুনরুত্থান-পরবর্তী বিবরণও দেওয়া হয়নি। এই সুসমাচারে যিশুকে একজন কর্মী পুরুষ, প্রেত-অপসারণকারী, আরোগ্যদানকারী ও অলৌকিক কার্যসম্পাদনাকারীর পাশাপাশি মানবপুত্র হিসেবেও চিত্রিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, যিশু তাঁর মসিহ-সত্ত্বা গোপন রেখেছিলেন। এমনকি তাঁর শিষ্যরাও তাঁকে বুঝতে সক্ষম হননি। মসিহের নিয়তি দুঃখভোগী ভৃত্যের অনুরূপ হবে – এই মর্মে কৃত একটি ভবিষ্যদ্বাণী সফল করতেই এই ঘটনা ঘটেছিল। এই সুসমাচারের প্রামাণ্য সংস্করণটির শেষ অংশে রয়েছে যিশুর শূন্য সমাধিকক্ষ আবিষ্কার। এই ঘটনাটিকে গালিলে পুনরায় যিশুর সাক্ষাৎলাভের একটি প্রতিশ্রুতি এবং যিশুর পুনরুত্থানের সুসংবাদ প্রচারের একটি অলক্ষিত নির্দেশিকা মনে করা হয়।

অধিকাংশ গবেষকের মতে, মার্কলিখিত সুসমাচারটির রচনাকাল ৬৫-৭৫ খ্রিস্টাব্দ। প্রথাগতভাবে প্রেরিত শিষ্য পিতরের সঙ্গী সুসমাচার-প্রচারক মার্ককে এই সুসমাচারটির রচয়িতা মনে করা হয়। তবে বেশিরভাগ গবেষকই এই মত প্রত্যাখ্যান করেন। আদি খ্রিস্টানরা সম্ভবত গ্রন্থটির সঙ্গে একজন কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তির নাম যুক্ত করতে চেয়েছিলেন বলে মার্কের নাম এই সুসমাচারের সঙ্গে যুক্ত করেন এবং তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে এই গ্রন্থটি এমন একজন লেখকের দ্বারা রচিত যিনি অলৌকিক কাহিনিসমূহের সংকলন, বিতর্কমূলক কাহিনিসমূহ, নীতিগর্ভ রূপক-কাহিনিসমূহ এবং যিশুর যন্ত্রণাভোগ ও মৃত্যু-সংক্রান্ত কাহিনি সহ বিভিন্ন সূত্র নিয়ে কর্মরত ছিলেন। প্রথাগতভাবে প্রামাণ্য খ্রিস্টীয় শাস্ত্রে এই পুস্তকটির স্থান ছিল দ্বিতীয় অথবা ক্ষেত্রবিশেষে চতুর্থ। মথিলিখিত সুসমাচারটিকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সুসমাচার এবং মার্কলিখিত সুসমাচারটিকে মথিলিখিত সুসমাচারের একটি অধস্তন সংক্ষেপায়ন মনে করা হত। তদনুসারে যিশু সম্পর্কে চার্চের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি মুখ্যত মথিলিখিত সুসমাচার, গৌণত যোহনলিখিত সুসমাচার এবং কেবলমাত্র অতি সামান্য ক্ষেত্রেই মার্কলিখিত সুসমাচার থেকে গৃহীত হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতেই প্রথম মার্কলিখিত সুসমাচারটিকে চারটি প্রামাণ্য সুসমাচারের মধ্যে আদিতম এবং মথিলিখিত ও লূকলিখিত সুসমাচার দু’টির অন্যতম উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়। মার্কীয় পূর্ববর্তিতার তত্ত্বটি (অর্থাৎ মার্কলিখিত সুসমাচারটি সর্বাগ্রে রচিত) বর্তমান কালে অধিকাংশ গবেষকই মেনে নিয়েছেন এবং ত্রাণকর্তা প্রভু অথচ দুঃখভোগী ঈশ্বরপুত্র-রূপে যিশুর ধারণাটি প্রকাশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের আখ্যানকৌশল অবলম্বনের জন্য এই গ্রন্থের লেখককে একজন শিল্পী ও ধর্মতত্ত্ববিদ হিসেবে নতুন স্বীকৃতিও দান করেছেন।

রচনাকৌশল, বর্গ ও প্রেক্ষাপট

মার্কের সুসমাচার 
মন্টানা অঙ্কিত সাধু মার্ক
মার্কের সুসমাচার 
দুই-সূত্র তত্ত্ব: অধিকাংশ গবেষকই এই বিষয়ে একমত যে মার্কলিখিত সুসমাচারটিই প্রথম রচিত সুসমাচার এবং মথিলিখিত ও লূকলিখিত সুসমাচারের লেখকগণ এই সুসমাচার এবং কিউ সূত্র নামে পরিচিত একটি দ্বিতীয় নথি থেকে উপাদান সংগ্রহ করে নিজেদের সুসমাচারগুলি রচনা করেন।

গ্রন্থপ্রণয়ন ও বর্গ

সাধু মার্ক লিখিত সুসমাচারের লেখকের নাম জানা যায় না। অধিকাংশ গবেষকের মতে এই পুস্তকটির রচনাকাল ৬৫-৭৫ খ্রিস্টাব্দ। এক অ-ইহুদি পাঠকবর্গের উদ্দেশ্যে গ্রিক ভাষায় পুস্তকটি রচিত হয়। রচনাস্থল সম্ভবত রোম। তবে গালীল, আন্তিয়খিয়া (রোমান সাম্রাজ্যের তৃতীয় বৃহত্তম নগরী, উত্তর সিরিয়ায় অবস্থিত) ও দক্ষিণ সিরিয়ার নামও এই পুস্তকের রচনার স্থান হিসেবে অনুমান করা হয়ে থাকে। আদি খ্রিস্টীয় প্রথায় পুস্তকটিকে প্রভু যীশুর প্রেরিত শিষ্যদের কার্যবিবরণী পুস্তকে উল্লিখিত যোহন মার্কের রচনা বলে মনে করা হলেও গবেষকেরা সাধারণত সেই ধারণাকে এক কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বের নামের সঙ্গে পুস্তকটিকে যুক্ত করার প্রয়াস বলে প্রত্যাখ্যান করে থাকেন। পুস্তকটির রচয়িতা বিভিন্ন ধরনের পূর্ববর্তী সূত্র থেকে এই পুস্তকের উপাদান সংগ্রহ করেছেন। এই সূত্রগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ববিষয়ক কাহিনিসমূহ (মার্ক ২:১-৩:৬), মহাপ্রলয়-বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী (১৩:১-৩৭) এবং উক্তি-সংকলনসমূহ (যদিও টমাস লিখিত সুসমাচার নয় এবং সম্ভবত কিউ সূত্রও নয়) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

আধুনিক গবেষকেরা এই বিষয়ে একমত যে সুসমাচারগুলি হল প্রাচীন বায়োস অর্থাৎ প্রাচীন জীবনীসাহিত্য বর্গের একটি উপবর্গ। প্রাচীন জীবনীসাহিত্যে বিষতবস্তুর খ্যাতি প্রচার ও স্মৃতিরক্ষার্থে পাঠকদের কাছে উদাহরণ তুলে ধরা হত এবং সেই রচনার মধ্যে নীতিবাক্য, অলংকার, প্রচারণা ও কেরিগমা (ধর্মোপদেশ) যুক্ত করা হত।

ঐক্যমূলক সমস্যা

মার্কের সুসমাচার 
সুসমাচার-প্রচারক মার্ক, ষোড়শ শতাব্দীর রাশিয়ান চিত্রকলা

মথি, মার্ক ও লূকলিখিত সুসমাচারগুলির মধ্যে একটি লক্ষণীয় সাদৃশ্য বিদ্যমান এবং এই সাদৃশ্যের জন্য তিনটি সুসমাচারের বিষয়বস্তুকে সহজেই সমান্তরালভাবে পাশাপাশি সাজানো যায়। তিন সুসমাচারের উপাদানগুলির মধ্যে আক্ষরিক মিল থাকা সত্ত্বেও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যও রয়েছে। সেই জন্য এগুলির আন্তঃনির্ভরতা নিয়ে একাধিক তত্ত্বের উদ্ভব ঘটেছে। এই সমস্যাটিকে ঐক্যমূলক সমস্যা নামে চিহ্নিত করা হয়। অধিকাংশ গবেষকই স্বীকার করেন যে, মার্কলিখিত সুসমাচারটিই প্রথম লিখিত সুসমাচার (মার্কীয় পূর্ববর্তিতা) এবং এই সুসমাচারটি ব্যবহৃত হয়েছে মথিলিখিত ও লূকলিখিত সুসমাচারের অন্যতম উৎসসূত্র হিসেবে। শেষোক্ত দুই সুসমাচারের লেখকগণ কাহিনি ও ঘটনার ক্রমবিন্যাসের কেবল মাত্র সেই সকল ক্ষেত্রেই একমত হয়েছেন যে ক্ষেত্রগুলিতে তাঁরা মার্কলিখিত সুসমাচারটির সঙ্গে একমত ছিলেন।

ঐতিহাসিকতা

১৯৫০ সাল থেকে গবেষকেরা এই বিষয়ে ক্রমশই একমত হচ্ছেন যে, ইতিহাসকে বর্ণনা করা মার্কলিখিত সুসমাচারের রচয়িতার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল না; তিনি চেয়েছিলেন একটি বার্তা ঘোষণা করতে। এই সুসমাচারটির মাধ্যমে ঐতিহাসিক যিশুকে পুনর্নির্মাণ করা যায় বলে যে ধারণাটি প্রচলিত ছিল, বিংশ শতাব্দীতে সেই ধারণার উপর দু’টি আঘাত নেমে আসে। প্রথমে উইলিয়াম রেডে দৃঢ়ভাবে এই মত প্রকাশ করেন যে, মার্কলিখিত সুসমাচারে উল্লিখিত "মসিহ-সত্ত্বা গোপন"-সংক্রান্ত ধারণাটি ঐতিহাসিক যিশুর প্রতিচ্ছবি নয়, বরং তা আদি খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর উদ্ভাবিত। এরপর ১৯১৯ সালে কার্ল লুডউইগ স্মিট এই সুসমাচারের ঐতিহাসিক ভিত্তিটিকে আরও দুর্বল করে দিয়ে বলেন যে, এটির বিভিন্ন পর্বের মধ্যে যে যোগসূত্রগুলি বিদ্যমান তা লেখক কর্তৃক উদ্ভাবিত এবং সেই কারণে এই সুসমাচারটিকে যিশুর যাজকবৃত্তির কালপঞ্জি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য সহায়িকা হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। দুই গবেষকের দাবিই বর্তমানকালে বহুলভাবে স্বীকৃত। যদিও যিশুর জীবন ও যাজকবৃত্তির সামগ্রিক বিবরণের ক্ষেত্রে চারটি প্রামাণ্য সুসমাচারের মধ্যে এই সুসমাচারটিকে এখনও সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য মনে করা হয়।

প্রেক্ষাপট

মার্কের সুসমাচার 
সাধু মার্ক লিখিত সুসমাচারের কেফালাইয়াগুলির (অধ্যায়) তালিকা, সাধু মথি লিখিত সুসমাচারের কোলোফোনের পরে এবং সাধু মার্ক লিখিত সুসমাচারের পাঠ্যাংশের পূর্বে সন্নিহিত, কোডেক্স আলেকজান্দ্রিনাস (৪০০-৪৪০ খ্রিস্টাব্দ) থেকে।

পাদটীকা

তথ্যসূত্র

সূত্রনির্দেশ

গ্রন্থপঞ্জি

আরও পড়ুন

বহিঃসংযোগ

    সাধু মার্ক লিখিত সুসমাচারের অনলাইন অনুবাদ
    সম্পর্কিত নিবন্ধ
মার্কের সুসমাচার
ঐক্যমূলক সুসমাচার
পূর্বসূরী
মথিলিখিত
সুসমাচার
নূতন নিয়ম
বাইবেলের পুস্তকসমূহ
উত্তরসূরী
লূকলিখিত
সুসমাচার

টেমপ্লেট:Gospel of Luke

Tags:

মার্কের সুসমাচার রচনাকৌশল, বর্গ ও প্রেক্ষাপটমার্কের সুসমাচার পাদটীকামার্কের সুসমাচার তথ্যসূত্রমার্কের সুসমাচার আরও পড়ুনমার্কের সুসমাচার বহিঃসংযোগমার্কের সুসমাচারগ্রিক ভাষানূতন নিয়মবাপ্তিস্মদাতা যোহনমসিহমানবপুত্রমার্ক ১৬যিশুযিশুর কুমারীগর্ভে জন্মযিশুর পুনরুত্থান

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

ওয়ালটন গ্রুপহাদিসপ্লাস্টিক দূষণবীর উত্তমমারমাবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধআর্দ্রতাউত্তর চব্বিশ পরগনা জেলাফরাসি বিপ্লবরাহুল গান্ধীমহাত্মা গান্ধীদারাজআবুল খায়ের গ্রুপবিদায় হজ্জের ভাষণউদ্ভিদকোষচর্যাপদঢাকা বিভাগ২০২২–২৩ নিউজিল্যান্ড পুরুষ ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফর (এপ্রিল ২০২৩)রাজীব গান্ধীভারতের রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলসমূহমহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলআন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসআসামবাংলাদেশ ব্যাংকসিন্ধু সভ্যতাসৌদি আরবঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরচিরস্থায়ী বন্দোবস্তমোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনপশ্চিমবঙ্গ মধ্য শিক্ষা পর্ষদমুসাফিরের নামাজ৬৯ (যৌনাসন)অর্শরোগভারতের সংবিধানবাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিহরে কৃষ্ণ (মন্ত্র)সিয়াচেন হিমবাহবগুড়া জেলাক্রিকেটসরকারি বাঙলা কলেজন্যাটোরাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়বাংলা ভাষাকুরআনমাহিয়া মাহিশাবনূরবাংলাদেশ-ভারত ছিটমহলদৈনিক যুগান্তরবাংলাদেশী জাতীয় পরিচয় পত্রপৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকৃষ্ণগহ্বররাজশাহী বিভাগচৈতন্য মহাপ্রভুপাঞ্জাব কিংসযৌনাসনদিল্লিথ্যালাসেমিয়ামুস্তাফিজুর রহমাননীল বিদ্রোহহানিফ সংকেতকোষ (জীববিজ্ঞান)ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসযৌনসঙ্গমসুনামগঞ্জ জেলাগজলকৃষকরাষ্ট্রবিজ্ঞানঅর্থনীতিবাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেলদ্বাদশ জাতীয় সংসদণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধানহিন্দুধর্মইসলামের নবি ও রাসুলনারী খৎনাহস্তমৈথুনবাংলাদেশের কোম্পানির তালিকা🡆 More