প্রক্ষেপক

প্রক্ষেপক বা প্রক্ষেপণ যন্ত্র (ইংরেজি: Projector) মূলত একটি আলোক প্রযুক্তিগত যন্ত্র যা কোন স্থিরচিত্র বা চলমান চিত্রকে কোন কিছুর উপরে প্রক্ষেপ করে, সাধারণত প্রক্ষেপণ পর্দার উপর। বেশিরভাগ প্রক্ষেপক ছোট স্বচ্ছ লেন্সের ভেতর দিয়ে উজ্জ্বল আলো বের করে চিত্র তৈরি করে থাকে, কিন্তু কিছু নতুন ধরনের প্রক্ষেপক লেজারের সাহায্যে সরাসরি চিত্রকে প্রক্ষেপ করতে পারে। ভার্চুয়েল রেটিনাল ডিসপ্লে বা রেটিনা প্রক্ষেপক হলো এক বিশেষ ধরনের প্রক্ষেপক যা চিত্রকে বাহ্যিক কোন প্রক্ষেপণ পর্দার পরিবর্তে সরাসরি মানুষের চোখের রেটিনাতে প্রক্ষেপ করে।

প্রক্ষেপক
এইসার প্রক্ষেপক,২০১২

বর্তমানে সবচেয়ে ব্যবহৃত প্রক্ষেপক হলো ভিডিও প্রক্ষেপক। ভিডিও প্রক্ষেপক হলো পূর্বের প্রক্ষেপক (যেমন:স্লাইড প্রক্ষেপক এবং ওভারহেড প্রক্ষেপক) এর ডিজিটাল সংস্করণ। পূর্বের এই ধরনের প্রক্ষেপকগুলো মূলত ১৯৯০ এবং ২০০০ এর দিকে ডিজিটাল প্রক্ষেপক দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে, কিন্তু পুরাতন অ্যানালগ প্রক্ষেপকগুলো আজও বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহৃত হয়। সবচেয়ে নতুন ধরনের প্রক্ষেপক হলো হাতে বহনযোগ্য প্রক্ষেপক যা লেজার ও এলইডি-র সাহায্যে চিত্র প্রক্ষেপ করে। এগুলোর দ্বারা প্রক্ষিপ্ত চিত্র পারিপার্শ্বিক আলোর পরিমাণ বেশি হলে দেখতে সমস্যা হয়।

চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহ গুলোতে এক ধরনের প্রক্ষেপক ব্যবহার করা হয় যা চলচ্চিত্র প্রক্ষেপক হিসেবে পরিচিত, বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলো ডিজিটাল চলচ্চিত্র ভিডিও প্রক্ষেপক দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে।

বিভিন্ন ধরনের প্রক্ষেপক

প্রত্যক্ষ প্রবিষ্ট তথ্য

স্থির চিত্র

  • জাদুর আয়না
  • স্টেগানোগ্রাফিক আয়না (বিস্তারিত নিচে দেখুন)
  • জাদুর লন্ঠন
  • বিবর্ধক(সরাসরি দেখার জন্য না, কিন্তু আলোকচিত্র তৈরি করার জন্য)
  • স্লাইড প্রক্ষেপক

চলন্ত চিত্র

  • চলন্ত ঘোড়ার বাতি(বিস্তারিত নিচে দেখুন)
  • চলচ্চিত্র প্রক্ষেপক
  • ভিডিও প্রক্ষেপক
  • হাতে বহনযোগ্য প্রক্ষেপক
  • অসত্য রেটিনা দৃশ্যায়ন (ভার্চুয়াল রেটিনাল ডিসপ্লে)

ইতিহাস

নিচে বর্ণিত প্রক্ষেপকগুলি ছাড়াও আরো বিভিন্ন প্রকার প্রক্ষেপক ছিল, কিন্তু তাদের প্রমাণ খুবই বিরল এবং তাদের বৈশিষ্ট্যের বর্ণনাগুলো অপরিষ্কার। দর্শকরা ছায়ার খেলা ও লন্ঠন প্রক্ষেপণের মাঝে পার্থক্য তৈরি করতে প্রয়োজনীয় বর্ণনা সবসময় উল্লেখ করেনি। অনেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে যা দেখেছিল ও কদাচিৎ দেখেছেল তার প্রকৃতি বুঝতে পারেনি। প্রক্ষেপক অনেক সময় জাদু এমনকি ধর্মীয় কাজেও উপস্থাপন করা হতো, যেখানে প্রক্ষেপককারীরা তাদের গোপনীয়তা বলতে অস্বীকার করে। জোসেফ নীদাম চীনের কিছু সম্ভাব্য প্রক্ষেপণের উদাহরণ তার ১৯৬২ সালের বই সায়েন্স এন্ড সিভিলাইজেশন ইন চাইনা তে উল্লেখ করেছেন।

১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত ইতিহাস

ছায়ার খেলা

পূর্বের ইতিহাসে দেখা যায় প্রথম চিত্রের প্রক্ষেপণ করা হতো আদি ছায়াতত্ত্ব অনুসারে। ছায়ার খেলাতে মূলত কোন প্রক্ষেপণ যন্ত্রের ব্যবহার হতো না, বরং এটিকে প্রক্ষেপক তৈরির প্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এটি এশিয়াতে ছায়া পুতুল খেলাকে আরো পরিমার্জিত রুপ প্রধান করেছে; অপরদিকে ইন্দোনেশিয়া (ওয়েং সম্পর্কিত ৮৪০ সিই পর্যন্ত তথ্য অনুসারে), মালওয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, চীন (১০০০ সিই এর তথ্য অনুসারে), ভারত এবং নেপালে এর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।

ক্যামেরা অবস্কিউরা

প্রক্ষেপক 
ক্যামেরা অবস্কিউরার নীতি: আলোক রশ্মি কোন বস্তু থেকে ছোট ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে একটি উল্টো চিত্র তৈরি করে।
প্রক্ষেপক 
ক্যাসেলগ্র্যান্ডে, বেল্লিনঝোনা তে বালিস্ট্রারিয়া কর্তৃক তৈরি হওয়া প্রাচীন ক্যামেরা অবস্কিউরা চিত্র

ক্যামেরা অবস্কিউরা তে ক্যামেরা ও প্রক্ষেপকের ইতিহাস একই। ক্যামেরা অবস্কিউরা (ল্যাটিন অর্থ "অন্ধকার ঘর") মূলত একটি প্রাকৃতিক আলোকিক ঘটনা যেটি মূলত ঘটে যখন পর্দার (বা অন্যথায় দেয়াল) অপর পাশের কোন দৃশ্যের উল্টো প্রতিবিম্ব ফাঁক এর বিপরীতে কোন পৃষ্ঠে তৈরি করার জন্য চিত্রটিকে পর্দার একটি ছোট ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করানো হয়। এই তত্ত্বটির সবচেয়ে প্রাচীন প্রমাণ হলো আদি চীনের দার্শনিক মোজি (প্রায় ৪৭০ থেকে ৩৯১খ্রি.পূর্ব) এর একটি বর্ণনা। মোজি সঠিকভাবে বর্ণনা করেন যে ক্যামেরা অবস্কিউরার চিত্রগুলো উল্টো হয় কারণ আলো তার উৎস থেকে সরল পথে চলে। ১১শতকে আরবের পদার্থবিদ ইবনে আল-হায়থাম (আলহাজেন) অন্ধকার ঘরের ছোট ফাঁক দিয়ে আসা আলোর উপর গবেষণা করেন এবং বুঝতে পারেন যে ক্ষুদ্রতর ছিদ্র হতে স্পষ্টতর চিত্র তৈরি হয়।

অন্ধকার ঘরের বন্ধ জানালার পর্দায় বা দেয়ালের ফাঁকা জায়গায় লেন্সের ব্যবহারের সন্ধান পাওয়া যায় ১৫৫০ সালের দিকে। ক্যামেরা ও প্রক্ষেপকের সংযুক্ত ইতিহাস মূলত বিভক্ত হয় ১৭শতকের পরবর্তী অর্ধে জাদুর লন্ঠন আবিষ্কারের পর। ক্যামেরা অবস্কিউরা যন্ত্রটি বাক্সের আকারে অঙ্কনের সহযোগী হিসেবে টিকে ছিল এবং ১৯ শতকের প্রথম দশকে এটি আলোকচিত্র ক্যামেরার সাথে মিলিত হয়।

চীনা জাদুর আয়না

চীনা জাদুর আয়না হলো সবচেয়ে প্রাচীন বস্তু যা কোন চিত্র প্রক্ষেপণ করতে পারে। এই ধরনের আয়নার অস্তিত্ত্বের সন্ধান পাওয়া গেছে চীনা হ্যান ডাইনাস্টিতে (২০৬খ্রি.পূর্ব-২৪খ্রিষ্টাব্দ) এবং জাপানেও এদের খোঁজ মিলেছে। এই ধরনের আয়না ব্রোন্জ নির্মিত হতো যেটির পেছনে নকশা খোদাই করা থাকত এবং মসৃণ সম্মুখে পারদ মিশ্রণ থাকত। আয়নার পেছনের নকশাটি প্রক্ষেপকে দেখা যেত যখন মসৃণ সম্মুখে আলো প্রতিফলিত হয়ে দেয়াল বা কোন পৃষ্টে পড়তো। খালি চোখে ঐ পৃষ্ঠে প্রতিফলিত নকশার কোন চিহ্ন দেখা যায় না, কিন্তু কিছুক্ষন পর তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়ার সময় পৃষ্ঠে তরঙ্গ সৃষ্টি হয় এবং এর কারণে আলোর প্রতিফলিত রশ্মি একটি নকশা গঠন করে। অঙ্কন বা লেখা দিয়ে আয়নার পৃষ্ঠে চিত্র প্রক্ষেপন পদ্ধতি হয়তো জাদুর আয়নার সবচেয়ে বিশুদ্ধ প্রাচীন শিল্প, কিন্তু এ বিষয়ে কোন প্রমাণ নেই।

চলন্ত ঘোড়ার বাতি

ঘূর্ণমান লন্ঠন ১০০০সিই এর আগ পর্যন্ত চীনে "চলন্ত ঘোড়ার বাতি"[走馬燈] হিসেবে পরিচিত। বাতিটি মূলত ঘোড়া ও ঘোড়া চালকের ছবি প্রদর্শন করত। চলন্ত ঘোড়ার বাতি মূলত ষড়ভুজাকার, বর্গাকার এবং বৃত্তাকার হয় যেটির ভেতরে কোন এক স্থানে কাটা ছায়ামূর্তি লাগানো থাকতো সাথে উপরে থাকতো কাগজের পাখা, এটি বাতি থেকে বের হয়ে আসা গরম বাতাসের জন্য ঘুরে। ছায়ামূর্তিগুলো লন্ঠনে পাতলা কাগজের পৃষ্ঠে প্রক্ষেপিত হয় এবং একটির পেছনে আরেকটিকে দেখা যায়। কিছু সংস্করণগুলোতে অধিক অঙ্গভঙ্গি দেখানোর জন্য মূর্তির সাথে হাত, পা অথবা মাথা যুক্ত থাকে যেগুলোকে ভেতরের স্তরে লোহার তার দিয়ে যুক্ত করা হয় এবং এগুলো তীর্যকভাবে রাখা লোহার তার দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বেশিরভাগ আধুনিক বৈদ্যুতিক সংস্করণগুলোতে রঙিন স্বচ্ছ তেলা কাগজের সকল ধরনের চরিত্র থাকে যেগুলোকে দেয়ালে প্রক্ষেপ করা হয়, বিশেষত শিশুশালাতে।

জন লোকে একই ধরনের যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে বলেন যদি আমাদের মস্তিষ্কের ধারনাগুলো নির্দিষ্ট সময় পরপর গঠিত হতো, "যেটি লন্ঠনের ভেতর মোমবাতির তাপে চিত্রের ঘুর্ণনের সদৃশ।" একই ধরনের গঠন ইংল্যান্ড ও ইউরোপের কিছু অঞ্চলে বড়দিনের সাজসজ্জা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

১০০০ থেকে ১৫০০ পর্যন্ত

অবতল দর্পণ

অবতল দর্পণ দ্বারা প্রতিফলিত কোন বস্তুর বাস্তব উল্টো চিত্র দর্পণের কেন্দ্র বিন্দুতে আসতে পারে। নির্মাণের ক্ষেত্রে একটির উপরে আরেকটি রাখা দুটি সামনা-সামনি অবতল দর্পণের (অধিবৃত্ত প্রতিফলক) নিচে বস্তুকে রাখা হয়, উপরের দর্পণেরর কেন্দ্রে একটি ফাঁক থাকে, এতে করে ফাঁকা স্থানে প্রতিফলিত চিত্র একটি বিশ্বাসযোগ্য ত্রিমাতৃক আলোকিক বিভ্রম তৈরি করে।

অবতল দর্পণেরর সাহায্যে প্রক্ষেপণের প্রথম প্রমাণ মিলেছে ফ্রান্সের লেখক জিন ডে মান এর রোমান ডে লা রোজ (প্রায় ১২৭৫সাল) বইটিতে। প্রায় ১৪৩০ সালের পূর্বে হোকনে-ফালকো নিবন্ধ থেকে একটি তত্ত্ব দাবি করে যে শিল্পীরা অঙ্কন/চিত্রাঙ্কন এর সাহায্য হিসেবে হয়তো অবতল দর্পণ অথবা প্রতিফলক লেন্স ব্যবহার করতেন যা চিত্রকে ক্যানভাস/বোর্ডে প্রক্ষেপ করে।

এটাও মনে করা হয়ে থাকে যে অনাদিকাল পর্যন্ত ভূত বা ঈশ্বর আগমনের কিছু ঘটনা (অবতল) দর্পণ দ্বারা করা হয়েছিল।

ফনটানার লন্ঠন

প্রায় ১৪২০ হতে গিয়োবান্নি ফনটানার অঙ্কন যেখানে একজন লন্ঠন দিয়ে একটি পাখাযুক্ত দৈত্যকে প্রক্ষেপণ করছে

১৪২০ সালের দিকে ভেনেশিয় পণ্ডিত ও ইঞ্জিনিয়ার গিয়োবান্নি ফনটানা তার যান্ত্রিক যন্ত্রপাতি নিয়ে বই "বেল্লিকোরাম ইনসট্রুমেনটোরাম লিবার" তে একটি অঙ্কন প্রকাশ করেন যেটিতে একজন লোক লন্ঠন দিয়ে একটি দৈত্যের চিত্র প্রক্ষেপ করছিল। ল্যাটিন শব্দ "এপারেনশিয়া নকচারনা এড টেরোরেম ভিডেনশিয়াম" (দর্শকদের ভয় দেখানোর জন্য নিশাচরের আগমন) এর উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে, কিন্তু দুর্বোধ্য অপর লাইনগুলোর অর্থ পরিষ্কার নয়। লন্ঠনে সাধারণভাবে দেখা যায় এটির আলো কুপি বাতি বা মোমবাতি হতে একটি স্বচ্ছ বেলনাকার বাক্স দিয়ে যায় যেটির মাঝে চিত্রকে বৃহৎ আকারে প্রক্ষেপ করার জন্য একটি আকৃতি অঙ্কিত থাকে, তাই ফনটানা তার অঙ্কনে যেমনটি বর্ণনা করেছিলেন এটি ততো পরিষ্কার চিত্র প্রক্ষেপ করতে পারেনা।

সম্ভাব্য ১৫ শতকের চিত্র প্রক্ষেপক

মনে করা হয় ১৪৩৭ সালে ইতালির মানবিক লেখক, শিল্পী, নির্মাতা, কবি, পুরোহিত, ভাষাতত্ত্ববিদ, দার্শনিক এবং সাংকেতিক লিপিকর লিওন বাটিস্তা এলবার্টি একটি ছোট ছিদ্রযুক্ত বন্ধ ছোট বাক্স দিয়ে অঙ্কিত চিত্র প্রক্ষেপ করতেন, তবে এটি অপরিষ্কার যে এটি আসলেই প্রক্ষেপক ছিল নাকি স্বচ্ছ চিত্রযুক্ত এক ধরনের বাক্স যেগুলো পেছন থেকে বিভ্রম করা হতো এবং একটি ছিদ্র দিয়ে দেখানো হতো।

১৫০০ থেকে ১৭০০

১৬ থেকে ১৭ শতক

মনে করা হয় লিওনার্দো দা ভিঞ্চির কাছে একটি প্রক্ষেপক লন্ঠন ছিল- যাতে ছিল ঘনীভূত লেন্স, মোমবাতি ও চিমনি- এটি ১৫১৫ সালের সময়কার একটি ছোট স্কেচের ভিত্তি স্বরূপ ছিল।

হেনরিচ কর্নেলিয়াস আগ্রিপ্পা তার বই থ্রি বুকস অব অকাল্ট ফিলোসোফিতে দাবি করেন চাঁদের রশ্মি ব্যবহার করে এবং এর "প্রতিচ্ছায়াকে বৃদ্ধি করে" চাঁদের পৃষ্ঠে কোন "কৃত্রিম রং করা চিত্র বা লিখিত অক্ষরকে" প্রক্ষেপণ করা সম্ভব। পাইথাগোরাস এই ধরনের কৌশল মাঝেমাঝে প্রদর্শন করতেন।

১৫৮৯ সালে গিয়ামবাটিস্তা ডেল্লা পর্টা প্রক্ষেপক আয়নার প্রাচীন শিল্প সম্পর্কে লিখে তার বই ম্যাগি নাটুরালিস-লিবরি বিগিন্টি প্রকাশ করেন।

ওলন্দাজ আবিষ্কারক কর্নেলিস ড্রেব্বেল, যিনি অণুবীক্ষণযন্ত্র আবিষ্কার করেন, মনে করা হয় তার কাছে একটি প্রক্ষেপক ছিল যেটিকে তিনি জাদুর কাজে ব্যবহার করতেন। ১৬০৮সালের একটি চিঠিতে তিনি বর্ণনা করেন যে, তার করা বিভিন্ন চমৎকার পরিবর্তন ও ভূতকে নিমন্ত্রণ করার ঘটনা তিনি প্রদর্শন করেছিলেন তার নতুন আবিষ্কার করা আলোকবিদ্যার সাহায্যে। এটিতে ছিল দৈত্য যারা মাটি থেকে উঠতো এবং জীবন্তের মতো তার অঙ্গ সঞ্চালন করতো। চিঠিটি তার বন্ধু কনস্টানটিন হায়গেনের নথিতে পাওয়া যায়, যিনি জাদুর লন্ঠন আবিষ্কারক ক্রিশ্চিয়ান হায়গেনের পিতা।

হেলিওস্কোপ

প্রক্ষেপক 
সেইনার হেলিওস্কোপ যেমনটি তাঁর বই রোজা উরসিনা সাইভ সোল (১৬২৬-৩০) এ মুদ্রিত আছে

১৬১২ সালে ইতালীর গণিতবিদ বেনডেত ক্যাসেলি সম্প্রতি আবিষ্কৃত সৌরকলঙ্ককে পর্যবেক্ষণের জন্য দূরবীনের (১৬০৮ সালে আবিষ্কৃত) মাধ্যমে সূর্যের ছবি প্রক্ষেপণের বিষয়টি তার পরামর্শদাতা, ইতালীর জ্যোতির্বিজ্ঞানী, পদার্থবিদ, ইঞ্জিনিয়ার, দার্শনিক এবং গণিতবিদ গ্যালিলিও গ্যালিলির কাছে লিখেন। গ্যালিলি ক্যাসেলির এই পদ্ধতি সম্পর্কে জার্মানির খ্রিস্টান পুরোহিত, পদার্থবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্রিসটোফ সেইনারের কাছে লিখেন।

১৬১২ থেকে অন্তত ১৬৩০ পর্যন্ত ক্রিসটোফ সেইনার সৌরকলঙ্ক নিয়ে গবেষণা করতেন এবং একটি নতুন দূরবীন সংক্রান্ত সৌর প্রক্ষেপক পদ্ধতি নির্মাণ করেন। তিনি এই পদ্ধতিকে বলতেন "হেলিওট্রপি টেলিওস্কোপিসি", যা পরবর্তীতে হয় হেলিওস্কোপ।

আবৃত দর্পণ

প্রক্ষেপক 
কিরচারের ১৬৪৫ সালের বই আর্স ম্যাগ্না লুসিস এট আমব্রে তে দেওয়া আবৃত দর্পণের চিত্র

১৬৪৫সালে জার্মানির খ্রিস্টান পণ্ডিত এথানাসিয়াস কির্চার এর বই আর্স ম্যাগনা লুসিস এট আমব্রে এর প্রথম সংস্করণে তার আবিষ্কার "আবৃত দর্পণ" এর বর্ণনা ছিলঃ এটি মূলত প্রাচীন প্রক্ষেপণ পদ্ধতি যেটিতে রয়েছে একটি ফোকাস লেন্স এবং একটি অবতল দর্পণে বর্ণ ও ছবি অঙ্কিত থাকে যা সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে, এটির মূল লক্ষ্য ছিল অধিক দূরত্বে যোগাযোগ করা। তিনি অধিক দূরত্বে আকার বাড়ানোর ও স্পষ্টতা হ্রাস পাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করেন এবং আশা প্রকাশ করেন যে কেউ হয়তো এটি উন্নত করার কোন পদ্ধতি বের করবে। কিরচারও দর্পণ পৃষ্ঠ হতে জীবন্ত মাছি ও ছায়ার পুতুল প্রক্ষেপ করার পরামর্শ দেন। এই বইটি অনেক পণ্ডিতকে প্রভাবিত ও অনুপ্রাণীত করে, যেমন ক্রিশ্চিয়ান হায়গেন যিনি জাদুর লন্ঠন আবিষ্কার করেছিলেন। অনেক সময় কিরচারকে জাদুর লন্ঠনের আবিষ্কারক হিসেবে কৃতিত্ব দেওয়া হয়, যদিও তার বই আর্স ম্যাগনা লুসিস এট আমব্রেএর ১৬৭১ সালের সংস্করণে কিরচার নিজেই ডেনমার্কের গণিতবিদ থমাস রাসমুসেন ওয়ালগেনস্টেনকে জাদুর লন্ঠনের জন্য কৃতিত্ব দেন, যেটিকে কিরচার তার নিজের প্রক্ষেপণ পদ্ধতির অধিকতর সম্প্রসারণ হিসেবে দেখেছিলেন।

যদিও এথানাসিয়াস কির্চার আবৃত দর্পণকে নিজের আবিষ্কার বলে দাবি করেন এবং লেখেন যে তিনি এই বিষয়ে কোন কিছু পড়েননি, এটা মনে করা হয় যে রামব্রেন্ট এর ১৬৩৫ সালের অঙ্কন বেলসাজ্জারস ফিস্ট আবৃত দর্পণ প্রেক্ষণের উল্ল্যেখ করে যেটিতে ঈশ্বরের হাত একটি নোংরা দর্পণের পৃষ্ঠে হিব্রু বর্ণ লিখছিল।

১৬৫৪ সালে ইতালির খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক মার্টিনো মার্টিনি এর চীন থেকে বেলজিয়াম পর্যন্ত সফরকে প্রদর্শন করার জন্য বেলজিয় খ্রিস্টান গণিতবিদ আন্দ্রে ট্যাকুয়েত কির্চারের পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। অনেক সময় বলা হতো যে মার্টিনি ইউরোপজুড়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য জাদুর লন্ঠন ব্যবহার করতেন যেটি হয়তো তিনি চীন থেকে আমদানি করেছিলেন, কিন্তু কির্চারের পদ্ধতি ব্যবহার ব্যতীত অন্য কোনকিছুর প্রমাণ নেই।

জাদুর লন্ঠন

১৬৫৯সালে ওলন্দাজ বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হায়গেন জাদুর লন্ঠন তৈরি করেছিলেন, যেটিতে একটি অবতল দর্পণ ছিল যাতে যে কাচের উপর চিত্রের প্রক্ষেপ হবে সে কাচ হতে আসা একটি বাতির আলোকে যতটুকু সম্ভব প্রতিফলন ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়, এবং কোন দেয়াল বা পর্দায় প্রক্ষেপ করার জন্য এটি যন্ত্রের সামনের কেন্দ্রস্থ লেন্সে অগ্রগামী হয় (হায়গেনের যন্ত্রে মূলত দুটি অতিরিক্ত লেন্স থাকত)। তিনি তার আবিষ্কার প্রকাশ বা জনসম্মুখে প্রদর্শন করেননি কারণ তিনি ভেবেছিলেন এটি খুবই বাজে ছিল এবং তিনি এটি নিয়ে লজ্জিত ছিলেন।

জাদুর লন্ঠন ১৮ শতক ও ১৯ শতকে বিনোদন ও শিক্ষার জন্য একটি জনপ্রিয় মাধ্যমে পরিনত হয়। এই জনপ্রিয়তার পতন ঘটে ১৮৯০-এ সিনেমার প্রবর্তনের পর। ১৯৫০-এর দশকে স্লাইড প্রক্ষেপকের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত জাদুর আয়না ছিল একটি সাধারন মাধ্যম।

১৭০০ থেকে ১৯০০

সৌর অণুবীক্ষণযন্ত্র

প্রক্ষেপক 
কার্পেন্টার ও ওয়েস্টলে সৌর অণুবীক্ষণযন্ত্রের স্লাইডের উপর "পুরুষ ও নারী, ধূমায়িত গঙ্গা-ফড়িং" (প্রায় ১৮৫০)

মৃত্যুর কিছু বছর পূর্বে ১৭৩৬ সালে পোলিশ-জার্মান-ওলন্দাজ পদার্থবিদ ড্যানিয়েল গ্যাব্রিয়েল ফারহেনহাইট একটি সৌর অণুবীক্ষণযন্ত্র তৈরি করেন, যেটি মূলত যৌগিক অণুবীক্ষণযন্ত্র ও ক্যামেরা অবস্কিউরা প্রক্ষেপকের মিশ্রণ ছিল। কোন স্বচ্ছ বস্তুর পরিষ্কার বিবর্ধিত চিত্র প্রক্ষেপণের জন্য আলোর উৎস হিসেবে এটির উজ্জ্বল সূর্যালোক প্রয়োজন হতো। ফারহেনহাইটের যন্ত্রটি হয়তো জার্মান পদার্থবিদ জোহান নাথানেল লিবারকুন দেখেছিলেন যিনি যন্ত্রটিকে ইংল্যান্ডে উপস্থাপন করেন, যেখানে আলোকবিজ্ঞানী জন কাফ এটিতে স্থায়ী আলোকিক নল ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য আয়না যোগ করে এটিকে উন্নত করেন। ১৭৭৪ সালে ইংরেজ যন্ত্র নির্মাতা বেনজামিন মার্টিন অস্বচ্ছ বস্তুর বিবর্ধিত প্রক্ষেপণের জন্য তার "অস্বচ্ছ সৌর অণুবীক্ষণযন্ত্র" উপস্থাপন করেন। তিনি দাবি করেন এটি "শুধু সকল প্রকার আকারের বস্তুর প্রাকৃতিকক অবস্থাকে বিবর্ধনই করেনা, পাশাপাশি তাদের উপর প্রচুর পরিমাণে সৌর রশ্মি ফেলে যার কারণে খালি চোখের থেকে তাদের সকল রঙ অতি গাঢ় ও স্পষ্ট দেখায়; এবং একটি স্থির পর্দার উপর তাদের অংশগুলো এতটাই প্রসারিত ও আলাদা যে, তাদেরকে শুধু অতি আরামে দেখা যাবে তাই নয়, বরং অনবিজ্ঞ হাতেও এটি অতি সহজে দেখা সম্ভব।"

অস্বচ্ছ প্রক্ষেপক

প্রক্ষেপক 
ফ্রানসয়িস মইগনোর লারট দেস প্রজেকশনস (১৮৭২) এ দেওয়া হেনরি মরটোনের প্রক্ষেপণের চিত্র

সুইজারল্যান্ডের গণিতবিদ, পদার্থবিদ, জ্যোতিরর্বিজ্ঞানী, তার্কিক এবং ইঞ্জিনিয়ার লিওনহার্ড ইউলার ১৭৫৬ সালের দিকে একটি অস্বচ্ছ প্রক্ষেপকের বর্ণনা দেন, যেটি বর্তমানে এপিস্কোপ হিসেবে পরিচিত। এটি অস্বচ্ছ চিত্র ও (ছোট) বস্তুর একটি পরিষ্কার চিত্র প্রক্ষেপণ করতে পারতো। মনে করা হয় ফ্রান্সের বিজ্ঞানী জ্যাকস চার্লস ১৭৮০সালে একই ধরনের "মেগাস্কোপ" তৈরি করেন। তিনি এটি তার বক্তৃতার জন্য ব্যবহার করতেন। ১৮৭২সালে হেনরি মরটন প্রদর্শনিতে অনেক দর্শকের জন্য অস্বচ্ছ প্রক্ষেপক ব্যবহার করেছিলেন, যেমন ফিলাডেলফিয়া অপেরা হাউজে যেখানে ৩৫০০জন লোক বসতে পারত। তার যন্ত্রে কোন ঘনীকরণ যন্ত্র বা প্রতিফলক ছিলনা, কিন্তু বস্তুর কাছে একটি অক্সিহাইড্রোজেন বাতি ছিল যাতে বস্তুর একটি বড় পরিষ্কার চিত্র প্রক্ষেপ করা যায়।

২০ শতক থেকে বর্তমান পর্যন্ত

২০ শতকের শুরুতে ও মাঝে, কম খরচের অপাক প্রক্ষেপকগুলো শিশুদের খেলনা হিসেবে উৎপাদন ও বাজারজাত করা হতো। প্রথমদিকে অপাক প্রক্ষেপকগুলোর আলোর উৎস ছিল লাইমলাইট, যা পরবর্তীকালে বৈদ্যুতিক বাতি ও হ্যালোজেন বাতি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত এপিস্কোপ বাজারজাত করা হয় যা শিল্পীদের একটি বিবর্ধক যন্ত্র হিসেবে কাজ করে এটি কোন পৃষ্ঠে কোন চিত্রকে প্রক্ষেপণ করতে পারে যেমনঃ তৈরিকৃত ক্যানভাস।

১৯৫০-এর শেষে ও ১৯৬০-এর শুরুর দিকে অভারহেড প্রক্ষেপকগুলোর ব্যবহার বিদ্যালয় ও ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়। প্রথম অভারহেড প্রক্ষেপক পুলিশের শনাক্তকরণের কাজে ব্যবহার করা হয়। এটি ৯-ইঞ্চি মঞ্চের ভেতর একটি তেলা কাগজ রোল ব্যবহার করতো যার সাহায্যে মুখমন্ডলের বিবরণ মঞ্চের মাঝে তুলে ধরা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আক্রমণ করার প্রশিক্ষণ হিসেবে ইউএস আর্মি ১৯৪৫সালে সর্বপ্রথম এটি ব্যাপক হারে ব্যবহার করে।

১৯৫০ থেকে ১৯৯০দশকে, ৩৫মিমি ফটোগ্রাফিক পজিটিভ ফিল্ম স্লাইড এর জন্য স্লাইড প্রক্ষেপক ছিল উপস্থাপনা ও বিনোদনের মাধ্যমের জন্য খুবই সাধারণ; পরিবারের সদস্যরা ও বন্ধুরা স্লাইডশো দেখার জন্য বিভিন্ন সময় একত্রিত হতো, বিশেষ করে অবসরে ভ্রমনের সময়।

২০০০এর শুরুতে, স্লাইড ডিজিটাল চিত্র দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।

নোট এবং তথ্যসূত্র

Tags:

প্রক্ষেপক বিভিন্ন ধরনের প্রক্ষেপক ইতিহাসপ্রক্ষেপক ২০ শতক থেকে বর্তমান পর্যন্তপ্রক্ষেপক নোট এবং তথ্যসূত্রপ্রক্ষেপকআলোকবিজ্ঞানইংরেজি ভাষারেটিনা

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রহোমিওপ্যাথিণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধানপশ্চিমবঙ্গবৃষ্টিহাদিসবিভিন্ন ধর্ম ও বিশ্বাসের তালিকাসূরা ফাতিহাচর্যাপদসূরা আর-রাহমানশিববাংলা ভাষায় সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার বিজয়ীদের তালিকাকানাডাগুগলযশোর জেলা২৮ মার্চশাহ জাহানফরাসি বিপ্লবের কারণযৌন খেলনাহরে কৃষ্ণ (মন্ত্র)বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসছাগলমাহিয়া মাহিরবীন্দ্রসঙ্গীতপদার্থবিজ্ঞানজেলেতারাবীহকুরআনের ইতিহাসসাপহুমায়ূন আহমেদপাবনা জেলাবাউল সঙ্গীতশুক্রাণুঋগ্বেদবাংলাদেশের স্থল বন্দরসমূহের তালিকাসুফিয়া কামালবাংলার প্ৰাচীন জনপদসমূহযুক্তফ্রন্টবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়সৈয়দ মুজতবা আলীআর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলতাশাহহুদঢাকা বিভাগচেন্নাই সুপার কিংসবাংলাদেশের কোম্পানির তালিকাআফগানিস্তানপহেলা বৈশাখবিতর নামাজরামমোহন রায়চেক প্রজাতন্ত্রভালোবাসাআংকর বাটসমকামিতাষাট গম্বুজ মসজিদগাঁজা (মাদক)রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়অস্ট্রেলিয়ারুকইয়াহ শারইয়াহমল্লিকা সেনগুপ্তবিবিসি বাংলামসজিদে হারামসোমালিয়াআলহামদুলিল্লাহবাংলাদেশজাযাকাল্লাহকুইচাব্রাহ্মসমাজআলাউদ্দিন খিলজিসহীহ বুখারীমুহাম্মাদের নেতৃত্বে যুদ্ধের তালিকাবিশেষণজাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়জেলা প্রশাসকবুড়িমারী এক্সপ্রেসনাটকইসলাম৬৯ (যৌনাসন)🡆 More