কলিঙ্গের যুদ্ধ: প্রাচীন ভারতে দ্বন্দ্ব

কলিঙ্গ যুদ্ধ খ্রিস্টপূর্ব ২৬১ সালে সংগঠিত হয়, যখন সম্রাট অশোক কলিঙ্গ আক্রমণ করেন। অশোক সিংহাসনে আরহনের বারো বছর পরে এই অভিযান পরিচালনা করেন। কলিঙ্গ যুদ্ধে অসংখ্য জীবনহানির ঘটনায় অশোক মর্মাহত হন এবং বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে অহিংস নীতি প্রচারে মনোনিবেশ করেন। তবে, অশোকের কিছু শিলালিপি ও ইতিহাসবিদ চার্লস অ্যালেন এর মতে, কলিঙ্গ যুদ্ধের কয়েক বছর আগেই সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।

কলিঙ্গ যুদ্ধ
তারিখআনু. ২৬১ – আনু. ২৬০ খ্রিস্টপূর্ব
অবস্থান
কলিঙ্গ, ভারত
ফলাফল নিষ্পত্তিমূলক মৌর্য বিজয়
অধিকৃত
এলাকার
পরিবর্তন
মৌর্য সাম্রাজ্য দ্বারা কলিঙ্গের সংযুক্তি
বিবাদমান পক্ষ
মৌর্য সাম্রাজ্য কলিঙ্গ
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
অশোক রাজা অনন্ত পদ্মনাভন
শক্তি
মোট ৭০,৭০০

৬,০০০ পদাতিক সৈন্যবাহিনী,
১০,০০০ অশ্বারোহী সৈন্য

৭০০ যুদ্ধের হাতি
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
১০,০০০ ৫০,০০০ (অশোকের পরিসংখ্যান)
(সহ বেসামরিক)

কলিঙ্গের যুদ্ধের সঠিক কারণ জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয়, মৌর্য্য সম্রাট অশোকের কোন ভাই কলিঙ্গ রাজ্যে আশ্রয় নেন। তার প্রতিশোধ নেবার জন্য অশোক কলিঙ্গ আক্রমণ করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৫ অব্দে দয়া নদীর নিকটবর্তী ধৌলি পাহাড়ের কাছে মৌর্য্য ও কলিঙ্গ বাহিনীর মধ্যে ভীষণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। দু'দলের প্রচুর হতাহতের মাধ্যমে অশোক কলিঙ্গ জয় করতে সক্ষম হন। এই যুদ্ধে কলিঙ্গ বাহিনীর ১,০০,০০০ সেনা ও মৌর্য বাহিনীর ১০,০০০ সেনা নিহত হয় ও অসংখ্য নর-নারী আহত হয়। যুদ্ধের বীভৎসতা সম্রাট অশোককে বিষাদগ্রস্থ করে তোলে এবং তিনি যুদ্ধের পথত্যাগ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে অহিংসার পথে সাম্রাজ্য পরিচালনের নীতি গ্রহণ করেন।

প্রেক্ষাপট

কলিঙ্গের যুদ্ধ: প্রেক্ষাপট, যুদ্ধের গতিপথ, ফলাফল 
কলিঙ্গ (বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন) এবং মৌর্য সাম্রাজ্য (নীল)। অশোকের দ্বারা আগ্রাসনের আগে।

সম্রাট অশোকের দ্বারা কলিঙ্গ আক্রমণের কারণগুলি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয়ই ছিল। কলিঙ্গ একটি সমৃদ্ধ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল যা শান্তিপূর্ণ এবং দক্ষ শিল্পী ব্যক্তিদের স্থান ছিল। উৎকল নামে পরিচিত, সেই অঞ্চলের জনগণ ভারতবর্ষের মধ্যে প্রথম বাণিজ্যের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপকূলবর্তী অঞ্চলের দেশগুলিতে ভ্রমণ করতেন। এই কারণে, কলিঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর এবং একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী ছিল। তাদের একটি উন্মুক্ত সংস্কৃতি ছিল এবং তার অভিন্ন নাগরিক কোর্ড ব্যবহার করত।

৩২১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সাম্রাজ্যের পতন না হওয়া পর্যন্ত কলিঙ্গ নন্দ সাম্রাজ্যের শাসন অধীন ছিল। অশোকের পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য পূর্বে কলিঙ্গ জয় করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনি সেক্ষেত্র ব্যর্থ হয়েছিলেন। অশোক স্বাধীন সাম্রাজ্য জয় করার জন্য নিজেই নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন বলে অনুমান করেছিলেন যে তিনি সিংহাসনে সুরক্ষিতভাবে প্রতিষ্ঠিত আছেন। কলিঙ্গ হল উপকূলীয় ওড়িশার একটি প্রাচীন নাম।

যুদ্ধের গতিপথ

কলিঙ্গের যুদ্ধ: প্রেক্ষাপট, যুদ্ধের গতিপথ, ফলাফল 
ওড়িশা রাজ্যের ভুবনেশ্বরের নিকট দয়া নদীর তীরের প্রচলিত কলিঙ্গ যুদ্ধক্ষেত্রের একটি দৃশ্য, ধৌলি পাহাড়ের চূড়া থেকে।

অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধ তীব্রতার জন্য বা এর ফলাফলের হিসাবে ভারতের ইতিহাসে কোন যুদ্ধই কলিঙ্গ যুদ্ধে থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। মানব ইতিহাসে কোন যুদ্ধে বিজয়ী ব্যক্তির হৃদয়কে এক নির্মম নিষ্ঠুরতা ও অহংকারী মনভাব থেকে দৃষ্টান্তমূলক ধার্মিকতায় পরিবর্তিত করেছে। বিশ্বের ইতিহাসে শুধুমাত্র কয়েকটি যুদ্ধে খুঁজে পেতে পারে যা এই যুদ্ধের সমতুল্য হতে পারে, তবে ওই যুদ্ধ গুলি কক্ষনই কলিঙ্গ যুদ্ধের থেকে বড় বা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। মানবজাতির রাজনৈতিক ইতিহাস সত্যিই যুদ্ধের একটি ইতিহাস এবং যুদ্ধ শেষে মানবতার ও শান্তি রক্ষার জন্য কলিংয়ের যুদ্ধের মত অন্য কোন যুদ্ধ সফল হতে পাড়েনি।

— রমেশ প্রসাদ মহাপাত্র, ওড়িশার সামরিক ইতিহাস

২৬১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অশোকের রাজত্বের নবম বছরে কলিঙ্গ যুদ্ধ সম্ভবত শুরু হয়। তার পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসনের জন্য রক্তাক্ত যুদ্ধের পর, অশোক কলিঙ্গ জয় লাভে সফল হন - কিন্তু যুদ্ধের বর্বরতার পরিণতিটি অশোকের যুদ্ধ সম্পর্কিত মতামত পাল্টে দেয় যুদ্ধের পর এবং কলিঙ্গ যুদ্ধে জয় লাভ করেও তিনি কোন নতুন যুদ্ধে সম্মতি দেননি।

ফলাফল

অশোক যুদ্ধে রক্তপাত দেখেছেন এবং অনুভব করেছেন যে তিনি ধ্বংসের কারণ। কুলিঙ্গের সমগ্র এলাকা লুঠ করা হয় এবং কলিঙ্গ ধ্বংস হয়ে যায়। অশোকের পরবর্তী কতিপয় শাস্ত্র বলে যে, কলিঙ্গের যুদ্ধে প্রায় ১০০,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল এবং প্রায় সমান সংখ্যক অশোকের সেনাবাহিনী ছিল, যদিও ওড়িয়া জনগণের মধ্যে পৌরাণি কাহিনী অনুযায়ী এবং কলিঙ্গের বংশধরদের দাবি অনুযায়ী এই সংখ্যাগুলি অশোকের দ্বারা অত্যন্ত বেশি অতিরঞ্জিত করা হয়ে ছিল। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, কলিঙ্গ সৈন্যবাহিনী দুইবার ধ্বংস হয়েছিল। হাজার হাজার পুরুষ ও নারীকে নির্বাসিত করা হয়।

ঈশ্বরের প্রিয়তম রাজা, রাজা প্রিয়দর্শী, তাঁর রাজত্বের আট বছর পর কলিঙ্গ জয় করেছিলেন। একশত পঞ্চাশ হাজার জনকে নির্বাসিত করা হয়েছিল, এক লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল এবং আরো অনেকের মৃত্যু হয়েছিল (অন্য কারণে)। কলিঙ্গ জয় করার পর, দয়াময়-দীন-দেবীদের ধর্মের প্রতি একটি দৃঢ় ঝোঁক, ধর্মের প্রতি ভালবাসা এবং ধর্মের শিক্ষার অনুভূতি অনুভব করলো। এখন কলিঙ্গ জয়লাভ করার জন্য ঈশ্বরের প্রিয় রাজা গভীরভাবে অনুতাপ করে।

— অশোক, অশোক স্তম্ভ ক্রম-১৩

অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধের প্রতিক্রিয়াটি অশোকের শিলা লিপিতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কলিঙ্গের যুদ্ধ অশোককে বৌদ্ধ ধর্মবিরোধী থেকে অহিংস (অহিংস) এবং ধার্মিক-বিজয় (ধর্মের মাধ্যমে বিজয়) দ্বারা বাকি জীবনকে উৎসর্গ করতে অনুপ্রানিত করে। কলিঙ্গ বিজয়ী হওয়ার পর, অশোক সাম্রাজ্যের সামরিক সম্প্রসারণ শেষ করেন এবং ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শান্তি, সাদৃশ্য ও সমৃদ্ধির যুগ শুরু করেন। অঞ্চলের মৌখিক ইতিহাস থেকে জানা যায় যুদ্ধের পর বৌদ্ধের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা তৈরি করেছে একটি মহিলা যিনি তার কাছে গিয়ে বলেন, "আপনার যুদ্ধের কারণে আমার বাবা, স্বামী, এবং পুত্রকে আমি হারিয়েছি। এখন আমি কি জন্য জীবিত থাকব?

তথ্যসূত্র

Tags:

কলিঙ্গের যুদ্ধ প্রেক্ষাপটকলিঙ্গের যুদ্ধ যুদ্ধের গতিপথকলিঙ্গের যুদ্ধ ফলাফলকলিঙ্গের যুদ্ধ তথ্যসূত্রকলিঙ্গের যুদ্ধবৌদ্ধ ধর্ম

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

সোমালিয়াকাজলরেখাজনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় (বাংলাদেশ)সরকারি বাঙলা কলেজটাইফয়েড জ্বরপানিপথের প্রথম যুদ্ধচিয়া বীজমুহাম্মাদ ফাতিহচিকিৎসকআকিজ গ্রুপ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনঅস্ট্রেলিয়াদৈনিক যুগান্তরহরে কৃষ্ণ (মন্ত্র)ইব্রাহিম (নবী)নিরোক্যান্সারঅপু বিশ্বাসআনারসচট্টগ্রাম বিভাগআফগানিস্তানকালো জাদুশিশ্ন বর্ধনম্যালেরিয়াজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ইসলাম ও হস্তমৈথুনচট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ইরানফুলবঙ্গবন্ধু-১বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধমাদারীপুর জেলানোয়াখালী জেলামিমি চক্রবর্তীসাতই মার্চের ভাষণস্নায়ুযুদ্ধমিজানুর রহমান আজহারীআসসালামু আলাইকুমউদ্ভিদকোষজওহরলাল নেহেরুমাহিয়া মাহিহিট স্ট্রোকবিসিএস পরীক্ষাপ্রেমালুশিক্ষাঅমর সিং চমকিলাগ্রীষ্মতানজিন তিশাবেনজীর আহমেদসম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিদৈনিক ইনকিলাবভূমি পরিমাপআব্বাসীয় স্থাপত্যরাজশাহীশাকিব খানবাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শকমঙ্গল গ্রহরক্তবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলমুতাওয়াক্কিলইউরোপবাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরদের তালিকাষড়রিপুআসমানী কিতাবহিন্দুধর্মের ইতিহাসমাহরামহারুনুর রশিদরঙের তালিকাবাল্যবিবাহকাজী নজরুল ইসলামউপন্যাসবিভিন্ন ধর্ম ও বিশ্বাসের তালিকাপাকিস্তানরুমানা মঞ্জুরজ্ঞান২০২২–২৩ নিউজিল্যান্ড পুরুষ ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফর (ডিসেম্বর ২০২২)শিবলী সাদিক🡆 More