পার্বত্য চট্টগ্রাম সংঘাত বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সৃষ্ট একটি রাজনৈতিক সংঘাতরূপে পরিচিত। বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও তার সশস্ত্র উগ্র অঙ্গ-সংগঠন শান্তি বাহিনীর মধ্যে এ সংঘাতের সৃষ্টি হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজাতির স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায়ের প্রেক্ষিতে এ সংঘাত ঘটে। ১৯৭৭ সালে সামরিক শাসনামলে সামরিক বাহিনীর সাথে শান্তি বাহিনী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্ব পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২০ বছর এ সংঘাত চলমান ছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সংঘাত | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
১৯৯৪ সালে শান্তি বাহিনীর ক্যাম্প | |||||||
| |||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||
বাংলাদেশ (বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী) | পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি মায়ানমার | ||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪তম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি | জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (ওরফে সন্তু লারমা) | ||||||
শক্তি | |||||||
২২,৬৩২ (জুন, ১৯৯১ মোতাবেক) সেনাবাহিনী-১০,৫৭৫ বিডিআর-৬,৭৬৭ পুলিশ-৩,৫০৫ এপিবিএন-১,৭৮৫ | ২,০০০-৪৭,০০০ | ||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||
৪৪ (১৯৭৯-১৯৯৭) (সরকারী তথ্য মোতাবেক) ৫০০ (শান্তিবাহিনীর তথ্যমতে) | ৯৮০০ (১৯৭৯-৩০ নভেম্বর, ১৯৯১) সম্মুখ যুদ্ধে নিহত-৫৭০০ আহত-১৫,৪৩২ গ্রেফতার-১১,৮৯২ |
এরপরে সশস্ত্র বাহিনী এবং বাংলাদেশের আধাসামরিক বাহিনী তাদের যে সহায়তা করেছিল সেগুলি গণহত্যা এবং জাতিগত নির্মূল হিসাবে আদিবাসীদের দ্বারা অনুমান করা হয়েছিল। আধা সামরিক বাহিনী বাংলাদেশ আনসারদের দ্বারা গণ-ধর্ষণের খবর পাওয়া গেছে, যদিও এগুলি বিতর্কিত। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অনুসারে জুন ২০১৩ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার শান্তি চুক্তির শর্তাদি বাস্তবায়নে এবং জনগণকে তাদের জমি প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে উদ্বেগ মোকাবেলায় "প্রশংসনীয় অগ্রগতি" করেছে। অ্যামনেস্টির অনুমান যে এখানে বর্তমানে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত জুম্ম পরিবার রয়েছে ৯০০ জন।
এমএন লারমার মৃত্যুর পর সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন শান্তি বাহিনী স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার হাল ধরেন এবং তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে অস্ত্র জমাদানের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করেন। অনেক শান্তি বাহিনীর সদস্য আত্মসমর্পণ না করে প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে গঠিত ইউপিডিএফ সংগঠনে নাম লেখায়।
সামরিক বাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনীর আক্রমণের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গণহত্যা ও নৃজাতিগোষ্ঠী উচ্ছেদ হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। আনসারদেরকে গণ ধর্ষনে সম্পৃক্ততার বিষয়েও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ প্রসঙ্গে মার্ক লেভিন ‘গণহত্যার অন্য ধরন’ নামে আখ্যায়িত করেন। এ আক্রমণকে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে গণ ধর্ষনের সাথে তুলনা করেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, জুন, ২০১৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে জুম্ম জাতিগোষ্ঠীকে তাদের ভূ-খণ্ডে নিরাপদ প্রত্যাবর্তনে কোন ভূমিকা রাখেনি। বর্তমানে প্রায় নব্বই হাজার জুম্ম পরিবার স্থানচ্যুত রয়েছে।
পাকিস্তান শাসনামলে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে এ সংঘাতের সূচনালগ্ন হিসেবে ধরে নেয়া হয়। ১৯৬২ সালে কাপ্তাই বাঁধ অবকাঠামো নির্মাণের ফলে লক্ষাধিক লোক স্থানচ্যুত হন। তাদের স্থানচ্যুতিতে তৎকালীন সরকার কোন গুরুত্ব দেয়নি ও হাজারো পরিবার ভারতে চলে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাকমা রাজনীতিবিদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা স্বায়ত্তশাসন ও ঐ অঞ্চলের জনগণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেবার জন্য দাবী উত্থাপন করেন।
লারমা ও অন্যান্য পার্বত্য আদিবাসীর প্রতিনিধিগণ বাংলাদেশের সংবিধানের খসড়ার বিপক্ষে অবস্থান নেন। তাদের মতে ঐ সংবিধানে নৃজাতিগোষ্ঠীকে স্বীকৃতিসহ অ-মুসলিম ও অ-বাঙ্গালীদের সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। সরকারের নীতি কেবলমাত্র বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষাকে ঘিরে। এছাড়াও বাংলাদেশের সকল নাগরিককে বাঙ্গালী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র আলোচনান্তে জানানো হয় যে, পার্বত্য নৃজাতিগোষ্ঠী বাঙ্গালী হিসেবে পরিচিতি লাভে একমত পোষণ করেছেন। এছাড়াও শেখ মুজিব জানিয়েছেন যে, পার্বত্য এলাকায় মুসলিম বাঙ্গালীদের জোরপূর্বক আবাসনের ফলে স্থানীয় বৌদ্ধ ও সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠী মেনে নিতে পারছে না।
১৯৭৩ সালে লারমা ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) প্রতিষ্ঠা করেন। এ সমিতিতে স্থানীয় আদিবাসী ও উপজাতীয় লোকগণ সংশ্লিষ্ট ছিলেন। পিসিজেএসএসের সশস্ত্র সংগঠন শান্তি বাহিনী সরকারী নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়। শেখ মুজিবের জরুরী শাসনামলে এ সঙ্কটের সূচনা ঘটে। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যানবাহনে প্রথমবারের মতো আক্রমণ করে শান্তি বাহিনী। ভারত সরকার সীমান্তে ঘাঁটি গড়তে শান্তি বাহিনীকে সহায়তা করে।
শান্তি বাহিনী তাদের আক্রমণ পরিচালনার সুবিধার্থে এ অঞ্চলকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে। স্থানীয় অধিবাসীদের জোরপূর্বক সংগঠনে যোগ দিতে বাধ্য করে ও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষণ প্রদান করে। বাঙ্গালী পুলিশ ও সৈনিক, সরকারী কার্যালয়, সরকারী কর্মকর্তা ও এতদাঞ্চলের বাঙ্গালী মুসলিম অধিবাসীদেরকে লক্ষ্য করে আক্রমণ পরিচালনা করতে থাকে। এছাড়াও এ বাহিনীর বিপক্ষে অবস্থানরত যে-কোন আদিবাসী ও সরকারকে সমর্থনদানকারীকেও আক্রমণ করতে দ্বিধাবোধ করেনি।
সরকারী তথ্য মোতাবেক জানা যায় যে, ১৯৮০ থেকে ১৯৯১ সালের মধ্যে ১,১৮০ ব্যক্তি শান্তি বাহিনীর হাতে প্রাণ হারায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশ, বাঙ্গালী মুসলিম বসবাসকারী, শান্তি বাহিনী ও এর সমর্থকেরা নৃজাতিগোষ্ঠী উচ্ছেদসহ মানবাধিকার হরণে সম্পৃক্ত হয়।
বাংলাদেশ দীর্ঘ পনেরো বছর সামরিক শাসনে পরিচালিত হয় ও ১৯৯০ সালে দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসে। এ সময়কালে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় রাখাইন সম্প্রদায়ের উপর বেশকিছু সহিংসতা পরিচালিত হয়। এতে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ও বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় অবস্থানকারী লোকজন সম্পৃক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। ১৯৮০ বাঙ্গালী মুসলিম ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ককজলি গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে ৩০০জনকে হত্যা করে চলে যায়। ৩ মার্চ আরো একটি গণহত্যা পরিচালিত হয়। নিরাপত্তা বাহিনী তিন থেকে চার হাজার লোককে হত্যা করে। ২৫ মার্চ, ১৯৮১ তারিখে অবস্থানকারী লোকজন ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা আক্রমণ চালায় ও মাটিরাঙ্গায় পাঁচশত জনকে হত্যা করে। ১৯৮৬ সালে পাচারিতে, ১৯৮৯ সালে লঙ্গুদুতে ৪০জন আদিবাসীকে হত্যা করা হয় ও ১৩,০০০ জন ভারতে শরণার্থী হিসেবে চলে যায়।
প্রতিবেদনে প্রকাশ পায় যে, ১৯৯২ সালে লোগাংয়ে শতশত লোক হত্যা করা হয় যাতে জীবন্ত পুড়ে ফেলাসহ আত্মরক্ষার্থে পালিয়ে যাবার সময় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রস্তাব পাস করে যাতে বাংলাদেশ সরকারকে পার্বত্য এলাকায় সামরিক বাহিনীকে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়। ১৯৯৩ সালে ছাত্র আন্দোলনে বসতি স্থাপনকারী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আক্রমণ করে। এরপর নানিয়াচরের গণহত্যায় ১০০ লোককে হত্যা করা হয়। জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি অগণিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো প্রতিবেদন আকারে তুলে ধরেন।
হিসেব করে দেখা গেছে যে, ১৯৭১ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার জুম্ম মহিলা ধর্ষণের শিকারে পরিণত হয়েছেন। ১৯৯৫ সালে এক হিসেবে দেখা যায়, ধর্ষণের অধিকাংশই ঘটেছে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সালের মধ্যে যাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পর্ক ছিল। তন্মধ্যে ৪০ শতাংশ ধর্ষণই গৌণ ছিল। ২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ২৭ শতাংশ ধর্ষণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বাঙ্গালী মুুসলিমদের সম্পৃক্ততা ছিল। কবিতা চাকমা ও গ্লেন হিলের ভাষ্য মোতাবেক দেখা যায়, জুম্ম মহিলাদের উপর যৌন নির্যাতন নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনার পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এ সংঘাতের সময় জুম্ম ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন, ধর্ষণ, নির্যাতন, গণহারে গ্রেফতার, কারাগারে নিক্ষেপ, অপহরণ করে যুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে যায়।
ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীল অবস্থা চলার প্রেক্ষিতে এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে বাংলাদেশ সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ঐ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক চাহিদা পূরণকল্পে একজন সেনাবাহিনীর জেনারেলের নিয়ন্ত্রণে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংস্থা গঠন করেন। কিন্তু সরকারের এ পদক্ষেপ জনপ্রিয়তা পায়নি। বিভিন্নভাবে অপপ্রচার রটানো ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধাচরণ এর অন্যতম প্রধান কারণ। সরকার ১৯৬২ সালে সৃষ্ট কাপ্তাই বাঁধের প্রেক্ষিতে প্রায় এক লক্ষ বাস্তুচ্যুত অধিবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবী পূরণে ব্যর্থ হয়। বাস্তুচ্যুত অধিবাসীরা ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করেনি ও চল্লিশ সহস্রাধিক চাকমা উপজাতি ভারতে চলে যায়।
শান্তি চুক্তির সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের বিষয়গুলো প্রক্রিয়াধীন থাকলেও এ অঞ্চলটি সামরিকবাহিনীর সম্প্রসারণ ও অভিবাসন প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। গণহারে গ্রেফতার, হত্যা, ধর্ষণের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। এছাড়াও, মানবাধিকার কর্মীদেরকে নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত করাসহ গ্রেফতার করা হচ্ছে। ২৬ আগস্ট, ২০০৩ তারিখে প্রকাশিত এশিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটসের প্রতিবেদনে জানা যায়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী উপজাতি পরিকল্পনা করে একযোগে দশটি গ্রামে আক্রমণ পরিচালনা করে। শতশত লোক বাস্তুচ্যুত হয়। হিসেব করে দেখা গেছে, দশজন সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণের শিকারে পরিণত হয়েছেন। এছাড়াও, দাদির কাছ থেকে নয়মাসের শিশুকে ছিনিয়ে নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হত্যা করে। জুম্ম জনগোষ্ঠী সাংবিধানিক কোন স্বীকৃতি পায়নি ও তাদেরকে অনগ্রসরমান জনগোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article পার্বত্য চট্টগ্রাম সংঘাত, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.