পান্তা ভাত: ঐতিহ্যবাহী বাঙালি / অসমীয়া খাবার

পান্তা ভাত গ্রামীণ বাঙালি জনগোষ্ঠীর একটি জনপ্রিয় খাবার। নৈশভোজের জন্য রান্না করা ভাত বেঁচে গেলে সংরক্ষণের জন্য জলে ভিজিয়ে রাখা হয়। পরদিন এই জলে ভিজিয়ে রাখা ভাত খাওয়া হয়। যাকে পান্তা ভাত বলা হয়। গ্রামীণ বাংলায় পান্তা ভাত সকালের খাবার হিসাবে খাওয়া হয়। সাধারণত লবণ, কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়া হয় ‌। অনেকেই আবার আলু ভর্তা,বেগুন ভর্তা,ডাল ভর্তা,শুটকি ভর্তা, সরিষার তেল, শুকনা মরিচ পোড়া ইত্যাদি সহযোগে পান্তা ভাত খেয়ে থাকেন। যা পান্তা ভাতের স্বাদ বৃদ্ধি করে।

পান্তা ভাত
পান্তা ভাত: ইতিহাস, ঐতিহ্যে পান্তা ভাত, তৈরি প্রণালী
পান্তা-ইলিশ — ইলিশ মাছের সাথে পান্তা ভাত ও শুঁটকি মাছ ভর্তা, আঁচার, ডাল ভর্তা, আলু ভর্তা, কাঁচা মরিচ, এবং পেঁয়াজ কুঁচির সংমিশ্রণের এই খাদ্যটি পয়লা বৈশাখ তথা নববর্ষের জনপ্রিয় খাদ্য।
প্রকারসকালের খাবার
উৎপত্তিস্থলবাংলাদেশ
ভারত(পশ্চিম বঙ্গ,অসম, ত্রিপুরা)
অঞ্চল বা রাজ্যগ্রামীণ মানুষ
প্রধান উপকরণভাত, জল
ভিন্নতাপাখাল, Poitabhat

ইতিহাস

গরম ভাতের মতোই পান্তা (পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় বলেই পান্তা) ভাত বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতির অঙ্গ। রাতে রান্না করা বাড়তি ভাত সংরক্ষণের জন্য জলে ভিজিয়ে রাখলে তা খানিকটা গাঁজিয়ে ওঠে। সেটাই পান্তা ভাত। বাংলার চাষির কাছে পান্তা কেবল সকালবেলার জলখাবার নয়, অনেক সময় তা দিনের প্রধান আহার। কাঁচামরিচ বা শুকনো মরিচ পোড়া, কাঁচা পেঁয়াজ, সরষের তেল আর লবণ দিয়ে মেখে পান্তা ভাত অতি উপাদেয়। শাক ভাজা, ডালের বড়া, মাছ ভাজা বা তরকারি দিয়েও পান্তা খাওয়া হয়। পান্তা ভাতের তরল অংশকে বলে আমানি। আলাদা করে আমানি খাওয়ারও চল আছে। কাঞ্জী হলো পান্তা ভাত বা পান্তা ভাতের জল।

চণ্ডীমঙ্গলে ব্যাধপত্নী গর্ভবতী নিদয়ার গরম ভাত ফেলে পান্তা আর আমানি খেতে ভালো লাগছে;

পাঁচ মাসে নিদয়ার না রুচে ওদন। ছয় মাসে কাঞ্জী করঞ্জায় মন।

বৈষ্ণবরা রাধাকৃষ্ণকে পান্তা ভাতের ভোগ দেন। জ্যৈষ্ঠ মাস জুড়ে পান্তা ভাত, দই, চিনি, কলমি শাক ভাজা আর দুই রকমের ব্যঞ্জন সহযোগে যে ভোগ দেওয়া হয় তার আনুষ্ঠানিক নাম পাকাল ভাত। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশে পান্তা ভাতের সঙ্গে শুঁটকি মাছের ঝাল ঝাল ভর্তা খাওয়ার চল আছে। এ ছাড়া নববর্ষের উৎসবে ঢাকা এবং বাংলাদেশের অন্যান্য শহরে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার চল রয়েছে। বাংলাদেশে পান্তা-ইলিশকে বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতির ধারা হিসেবে দেখা হয়।

যদিও পান্তা ভাতের ইতিহাস আনুমানিক দুই হাজার বছরের পুরনো তবে ইসলামিক ঐতিহাসিকরা এটিকে মুঘল শাসনের সাথে যুক্ত করতে দ্বিধাবোধ করেন নি। উদাহরন হিসাবে গোলাম রাব্বানীর লেখা ধরা যেতে পারে। মুঘল শাসনামলে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা মুক্ত অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো, আগত দর্শক শ্রোতাগণ ঐতিহ্যবাহী পান্তাভাত খেতো। বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে শহুরে বাঙালী বাংলা নববর্ষকে ঘটা করে উদ্‌যাপন শুরু করে। এই দিন বাঙালিয়ানার প্রতীক হিসেবে ভাজা ইলিশ মাছ সহযোগে পান্তা ভাত খাওয়া রেওয়াজে পরিণত হয়।

ঐতিহ্যে পান্তা ভাত

পান্তা ভাত হলো বাঙালির জনপ্রিয় খাবার যা দুই হাজার বছরের পুরানো রীতি যা আজও পালন করা হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে পান্তা উৎসবের মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার সংস্কৃতি চালু ও পরিব্যাপ্ত হয়েছে।

তৈরি প্রণালী

নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাতকে জলে প্রায় এক রাত ডুবিয়ে রাখলেই তা পান্তায় পরিণত হয়। ভাত মূলত পুরোটাই শর্করা (Carbohydrate)। ভাতে জল দিয়ে রাখলে বিভিন্ন গাজনকারি (Fermentation) ব্যাক্টেরিয়া (Bacteria) বা ইস্ট (Yeast) শর্করা ভেঙ্গে ইথানল ও ল্যাকটিক এসিড তৈরি করে। এই ইথানলই পান্তাভাতের ভিন্ন রকম স্বাদের জন্য দায়ী। পান্তা ভাত মূলত ভাত সংরক্ষণের একটি পদ্ধতি। ভাত বেশিক্ষণ রেখে দিলে তা পচে খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। কিন্তু জল দিয়ে রাখলে গাজনকারি ব্যাক্টেরিয়া সেখানে ল্যাকটিক এসিড তৈরি করে যার ফলে পান্তা ভাতের অম্লত্ব বেড়ে যায় (pH কমে)। তখন পচনকারি ও অন্যান্য ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক ভাত নষ্ট করতে পারে না।

৮-১০ ঘণ্টা পরে পান্তা ভাত তৈরী হয়। কোন প্রকার সংক্রমন এড়াতে খাবারের পাত্রটি সতর্কতার সংগে ঢেকে রাখতে হবে। সকাল বেলা পান্তাভাত লবণ, লেবু, লঙ্কা এবং কাটা পেঁয়াজ দিয়ে খাওয়া হয়। খাওয়ার সময় জল আলাদা করা হয় অনেকসময়। অনেকে পান্তাভাতের সঙ্গে ভোজ্য তেল ব্যবহার করে।

গবেষণা

পান্তা ভাতে থাকা পুষ্টিকর পদার্থগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে। এর আয়রন দেহের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ায়। ক্যালসিয়াম শরীরের হাড়কে শক্ত করে। ম্যাগনেসিয়াম শরীরে নিঃসৃত এনজাইমকে সক্রিয় করতে সাহায্য করে। পান্তা ভাতে প্রচুর পরিমাণে বিটা-সিটোস্টেরল, কেম্পেস্টেরোলের মতো মেটাবলাইটস রয়েছে যা শরীরকে প্রদাহ থেকে রক্ষা করে। এসব কোলেস্টোরেল কমাতেও সাহায্য করে। এতে থাকা আইসোরহ্যামনেটিন-সেভেন-গ্লুকোসাইড ফ্ল্যাভোনয়েডের মতো মেটাবলাইটস ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। এর ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

১২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ভাতের ফারমেন্টেশন হলে সেখানে অ্যালকোহলের উপাদান তৈরি হয় এবং সেই পান্তা ভাত খাওয়ার পর শরীর ম্যাজ ম্যাজ করে ও ঘুম পেতে পারে। পান্তা ভাত যদি পরিষ্কার পাত্রে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে তৈরি করা না হয়, তাহলে সেখানে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া তৈরি হতে পারে। সেই ভাত খেলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়বে।

তথ্যসূত্র

Tags:

পান্তা ভাত ইতিহাসপান্তা ভাত ঐতিহ্যে পান্তা ভাত তৈরি প্রণালীপান্তা ভাত গবেষণাপান্তা ভাত তথ্যসূত্রপান্তা ভাত

🔥 Trending searches on Wiki বাংলা:

লক্ষ্মীবাংলা ভাষা আন্দোলনমাটিবঙ্গবন্ধু-২বিন্দুচিরস্থায়ী বন্দোবস্তইমাম বুখারীপ্রথম ওরহানমাইকেল মধুসূদন দত্তইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজিসানি লিওনওয়ালটন গ্রুপসুভাষচন্দ্র বসু২০২২ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জিম্বাবুয়ে সফরটাঙ্গাইল জেলাসানরাইজার্স হায়দ্রাবাদআকিজ গ্রুপমিমি চক্রবর্তীঢাকা মেট্রোরেলজয়নুল আবেদিনমানব দেহফরিদপুর জেলাব্রাজিলবঙ্গভঙ্গ (১৯০৫)উদ্ভিদপেপসিখুলনাবাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরস্নায়ুযুদ্ধব্যাকটেরিয়াবাংলাদেশ রেলওয়েসার্বজনীন পেনশনলোকসভা কেন্দ্রের তালিকাব্রিটিশ রাজের ইতিহাসভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনফুলসাহাবিদের তালিকাইসতিসকার নামাজচন্দ্রযান-৩কারামান বেয়লিকসমকামিতাঋগ্বেদপৃথিবীর বায়ুমণ্ডলযাকাতভালোবাসাব্যঞ্জনবর্ণআশারায়ে মুবাশশারাপর্তুগিজ ভারতটাইফয়েড জ্বরবাংলার ইতিহাসইউরোপীয় দেশগুলো ও অধীনস্থ ভূভাগের তালিকাজরায়ুজান্নাতুল ফেরদৌস পিয়াপশ্চিমবঙ্গের নদনদীর তালিকাআবু হানিফাবাংলাদেশের ইতিহাসপুলিশভৌগোলিক নির্দেশকবিশ্বায়নলিওনেল মেসিভারতের ইতিহাসপর্তুগিজ সাম্রাজ্যইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সআরব্য রজনীম্যালেরিয়াথাইল্যান্ডগ্রীষ্মমুতাওয়াক্কিলনেপালযোহরের নামাজবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টরসমূহটিকটকহিট স্ট্রোকজসীম উদ্‌দীনবারমাকিতাহসান রহমান খানবাগদাদ অবরোধ (১২৫৮)জন্ডিসপায়ুসঙ্গম🡆 More