নদিয়া রাজপরিবার বা নবদ্বীপ রাজবংশ ভট্টনারায়ণ নামক ব্রাহ্মণের বংশজাত বলে দাবি করে, যিনি বাংলার রাজা আদিশূর কর্তৃক বিশুদ্ধতার (কৌলিক) আচরণে নির্বাচিত হয়েছিলেন। নদিয়া রাজপরিবার বাংলার অন্যতম হিন্দু রাজপরিবার, যারা ৩৫ প্রজন্ম ধরে এখানে বসবাস করছেন। বাংলায় ব্রিটিশ রাজ শুরু হওয়ার পর থেকে নদিয়ার রাজারা বংশপরম্পরায় মহারাজা বাহাদুর উপাধি ধারণ করেন।
নদিয়া রাজপরিবারকে নবদ্বীপ রাজবংশ বলে অভিহিত করার কিছু কারণ আছে। মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে নবদ্বীপ ছিল একটি প্রতিনিধি স্থানীয় জনপদ। এটি ছিল কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের অধীনস্থ একটি অগ্রগণ্য নগর। এখানকার পণ্ডিতবর্গেরা তাদের তীক্ষ্ণ ধীশক্তির খ্যাতিতে গগন স্পর্শ করেছিল। এই রাজপরিবার নবদ্বীপের পণ্ডিতবর্গকে আলাদা মর্যাদা দিত। নবদ্বীপের পণ্ডিত সমাজ রাজা রামকৃষ্ণকে নবদ্বীপাধিপতি উপাধি প্রদান করেন। তখন থেকেই এই বংশের রাজারা প্রাগুক্ত উপাধিটি সাদরে গ্রহণ করতেন। এই কারণে এই রাজপরিবারকে নবদ্বীপ রাজবংশ বলা হয়।
নদিয়া রাজবংশের আদি পুরুষ ভবানন্দ মজুমদার তিনি এই রাজবংশের সূচনা করেন। তাঁর বংশধররা 'রাজা' উপাধি ধারণ করে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত নদিয়া শাসন করেন। জানা যায়, ভবানন্দ প্রতাপাদিত্যের (বারো ভুইঞাদের অন্যতম) রাজধানীতে প্রবেশের গুপ্ত পথ দেখিয়ে এবং প্রয়োজনীয় রসদ দিয়ে তিনি দিল্লির শাসক জাহাঙ্গীরের সেনাপতি মানসিংহকে সাহায্য করেছিলেন; তাই জাহাঙ্গীর তাঁর এই কাজে খুশি হয়ে ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে ফরমান জারি করে ভবানন্দকে মহৎপুর, নদিয়া, মারূপদহ, লেপা, সুলতানপুর, কাশিমপুর, বয়শা, মশুণ্ডা প্রভৃতি ১৪ টি পরগনা সনদসূত্রে দেন। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাংলার নবাব ইসমাইল খাঁ ভবানন্দের বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে কানুনগো পদে নিযুক্ত করেন এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তাঁর জন্য সনদ ও মজুমদার উপাধি এনে দেন। ১৬৩১ সালে ভবানন্দ সম্রাটের কাছ থেকে ফরমানের মাধ্যমে বৃহৎ জমিদারি লাভ করেন।
রাঘব দিগনগরে ২০,০০০ টাকা ব্যয়ে ১৪২৩ হাত × ৪২০ হাত ক্ষেত্রবিশিষ্ট দীঘি খনন করান। দীঘির পূর্বদিকে সুবৃহৎ ঘাট, সুন্দর অট্টালিকা ও দুটি মন্দির (চারচালা ও বাংলা মন্দিরের সাদৃশ্যে সুনিপুণ পোড়ামাটির কাজযুক্ত) নির্মান করান। মন্দিরের দেওয়ালে উৎকীর্ণ লিপি অনুসারে, ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মন্দিরে রাঘবেশ্বর শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন।
শিবনিবাসে তিনটি মন্দিরে তিনি রাজরাজেশ্বর, রাজ্ঞীশ্বর ও রামচন্দ্র নামে তিনটি দেবমূর্তি স্থাপন করেন।
ভবানন্দ নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ থানার মাটিয়ারিতে নদিয়ারাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীতে রাঘবপুত্র নদিয়ারাজ রুদ্র রায় তাঁর তৎকালীন নদিয়া রাজ্যের মধ্যবর্তী স্থানে নবদ্বীপ ও শান্তিপুরের নিকট জনপদ 'রেউই ' গ্রামে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। রেউই-তে সেসময় অনেক গোপনবসতি ছিল এবং তাদের আরাধ্য দেবতা ছিলেন ভগবান কৃষ্ণ। একারণে, রুদ্র রায় রেউই-এর নাম রাখেন কৃষ্ণনগর।
রাজা রুদ্র রায় অনেক জনহিতকর কাজ করেছিলেন; দিল্লির সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে কয়েকটি পরগনা দান করেন। রুদ্র রায় বাদশা আলমগীরের কাছ থেকে গয়েশপুর, হোসেনপুর, বাগমারী প্রভৃতি বড় পরগনার জমিদারি পান এবং কৃষ্ণনগরের রাজভবনের ওপর 'কাঙরা' (যা সেসময় উচ্চ রাজকীয় সম্মানের প্রতিভূ ছিল) নির্মাণের অনুমতি পান। তিনি প্রথম স্থপতিদের এনে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির কাছারি, কেল্লা, পূজোর দালান, নাচঘর, চক, নহবৎখানা প্রভৃতি নির্মাণ করান। মাটিয়ারিতে রুদ্রের পিতা রাঘব রায় পুত্রের নামে 'রুদ্রেশ্বর শিবমন্দির' স্থাপন করিয়েছিলেন।
নদিয়ার রাজবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। পিতা রঘুরাম রায়ের মৃত্যুর পর মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজা হন। বিদ্বান, প্রজাপালক ও সংস্কৃতিবান ছিলেন। তাঁর গঙ্গাবাসের প্রাসাদ ছিল নদিয়ার এক ক্রোশ পূর্বে শ্রীনগরে। তাঁর রাজত্বকালে রাজ্যে বিস্তার ও বিপুল সমৃদ্ধি ঘটে। তাঁর রাজত্বকাল নানা ঘটনায় পূর্ণ। পলাশীর যুদ্ধ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর,বর্গী হামলা ইত্যাদি তারই আমলে হয়। তার সময় বাংলায় শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, সংগীতের বিকাশ ঘটেছিল। বিভিন্ন প্রতিভাবান মানুষ তার পৃষ্ঠপোষকতায় রাজসভা অলংকৃত করেন। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রকে তিনি মাসিক ৪০ টাকা বেতনে সভাকবি নিযুক্ত করেন।
সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম কৃষ্ণচন্দ্রকে প্রথমে 'মহারাজা' ও পরে লর্ড ক্লাইভের সুপারিশে 'মহারাজেন্দ্র বাহাদুর' উপাধিতে ভূষিত করেন। পলাশীর যুদ্ধের পর লর্ড ক্লাইভ তাঁকে পাঁচটি কামান উপহার দিয়েছিলেন।
কৃষ্ণচন্দ্র প্রায় কুড়ি লক্ষ টাকা ব্যয় করে অগ্নিহোত্র ও বাজপেয় যজ্ঞ করেছিলেন৷ ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে কাশীনাথের 'কালী সপর্যাবিধি' গ্রন্থে প্রথম কালীপূজার বিধি উল্লিখিত হওয়ার পর তাঁর আদেশে নদিয়ায় ব্যাপকভাবে দীপান্বিতা শ্যামাপূজার প্রচলন ঘটে৷ তাঁর আমলে নদিয়ায় প্রায় ১০,০০০ কালীমূর্তির পূজা হত। পরবর্তীকালে, তাঁর পৌত্র ঈশানচন্দ্র হাজার-হাজার মণ নৈবেদ্য, বস্ত্রখণ্ড ও উপাচারে মাতৃপূজার আড়ম্বর করেছিলেন।
কৃষ্ণচন্দ্রের বৃদ্ধাবস্থায় কলকাতার বিখ্যাত রাজা নবকৃষ্ণ দেব নদিয়ার অগ্রদ্বীপের জাগ্রত গোপীনাথ বিগ্রহ অপহরণ করে নৌকাযোগে কলকাতার রাজবাড়িতে নিয়ে যান। লর্ড ক্লাইভের মধ্যস্থতার ফলে মূর্তিটি শেষে কৃষ্ণচন্দ্রের হস্তগত হয়।
১৭৮২ খ্রিস্টাব্দের ২২ আষাঢ় মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র পরলোকগমন করেন।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article নদিয়া রাজপরিবার, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.