জয়নুল আবেদিন (২৯ ডিসেম্বর ১৯১৪ - ২৮ মে ১৯৭৬) বিংশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত বাঙালি চিত্রশিল্পী । তিনি বাংলাদেশের আধুনিক শিল্প আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন । যেটি শুরু হয়েছিল গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অফ আর্টস এন্ড ক্রাফ্টস স্থাপনের মাধ্যমে । এই যাত্রায় তাঁর সঙ্গী ছিলেন আনোয়ারুল হক, সফিউদ্দিন আহমেদ,শফিকুল আমীন, কামরুল হাসান প্রমুখ শিল্পী । শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ । তাঁর শৈল্পিক দূরদর্শিতায় ও নেতৃত্বে আমাদের দেশের শিল্পশিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে । এই জন্য তাঁকে শিল্পাচার্য উপাধি দেওয়া হয় । তার বিখ্যাত চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালা, মই দেয়া, সংগ্রাম, সাঁওতাল রমণী, ঝড়, কাক, বিদ্রোহী ইত্যাদি। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে গ্রামবাংলার উৎসব নিয়ে আঁকেন তার বিখ্যাত ৬৫ ফুট দীর্ঘ ছবি নবান্ন। শিল্পের মহান শিক্ষক উপাধিতে সম্মানিত করেছিল । তিনি ছিলেন বাংলাদেশে সংঘটিত আধুনিক শিল্পী আন্দোলনের পথপ্রদর্শক এবং বাংলাদেশ একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা অর্জনের পরপরই সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাকে বাংলাদেশী আধুনিক শিল্পকলার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন।
জয়নুল আবেদিন | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ২৮ মে ১৯৭৬ | (বয়স ৬১)
জাতীয়তা | বাংলাদেশি |
নাগরিকত্ব | ব্রিটিশ ভারতীয় (১৯১৪-১৯৪৭) পাকিস্তানি (১৯৪৭-১৯৭১) বাংলাদেশি (১৯৭১-১৯৭৬) |
পেশা | শিক্ষকতা |
পরিচিতির কারণ | চিত্রশিল্পী |
পুরস্কার | স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৭৭) |
জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহুকুমার কেন্দুয়াতে (বর্তমান নেত্রকোনা) জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পুলিশের দারোগা (সাব-ইন্সপেক্টর), মা জয়নাবুন্নেছা ছিলেন গৃহিনী। নয় ভাইবোনের মধ্যে জয়নুল আবেদিন ছিলেন সবার বড়। পড়াশোনায় হাতেখড়ি পরিবারের অভ্যন্তরীণ পরিমণ্ডলেই।
খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি ছবি আঁকতে পছন্দ করতেন। পাখির বাসা, পাখি, মাছ, গরু-ছাগল, ফুল-ফল এঁকে মা-বাবাকে দেখাতেন। ছেলেবেলা থেকেই শিল্পকলার প্রতি তার গভীর আগ্রহ ছিল। মাত্র ষোল বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি বন্ধুদের সাথে কলকাতায় গিয়েছিলেন শুধু গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য। কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস ঘুরে আসার পর সাধারণ পড়াশোনায় জয়নুল আবেদিনের মন বসছিল না। তাই ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগেই স্কুলের পড়ালেখা বাদ দিয়ে কলকাতায় চলে যান এবং মায়ের অনুসমর্থনে গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস-এ ভর্তি হন। তাঁর মা জয়নুল আবেদিনের আগ্রহ দেখে নিজের গলার হার বিক্রি করে ছেলেকে কলকাতার তখনকার আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে সাহায্য করেন। জয়নুল আবেদিন ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে পড়েন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক (ডিগ্রি) অর্জন করেন।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে দুটি দেশের সৃষ্টি হয় যথা ভারত ও পাকিস্তান। পূর্ববঙ্গ নতুন নাম লাভ করে পূর্ব পাকিস্তান যা পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পূর্ববঙ্গের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের পুরোধা ব্যক্তিত্ব জয়নুল আবেদিন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে একটি চিত্রকলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুভূত হয়। জয়নুল আবেদিনের উদ্যোগে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে পুরান ঢাকার জনসন রোডের ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের একটি জীর্ণ কক্ষে গভর্নমেন্ট আর্ট ইন্সটিটিউট স্থাপিত হয়। সূচনায় এর ছাত্র সংখ্যা ছিল মাত্র ১৮। জয়নুল আবেদিন ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম শিক্ষক। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে এই আর্ট ইন্সটিটিউট সেগুনবাগিচার একটি বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে আর্ট ইন্সটিটিউটটি শাহবাগে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে এটি একটি প্রথম শ্রেণির সরকারি কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং এর নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পর একই প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়’। তিনি ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জয়নুল আবেদিনের আগ্রহে ও পরিকল্পনায় সরকার ১৯৭৫-এ নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে লোকশিল্প জাদুঘর ও ময়মনসিংহে জয়নুল সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করে।
জয়নুল আবেদিন ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। এ ছাড়াও তার বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলো হল: ১৯৫৭-এ নৌকা, ১৯৫৯-এ সংগ্রাম, ১৯৭১-এ বীর মুক্তিযোদ্ধা, ম্যাডোনা প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।তার দীর্ঘ দুটি স্ক্রল ১৯৬৯-এ অঙ্কিত ‘নবান্ন’ এবং ১৯৭৪-এ অঙ্কিত ‘মনপুরা-৭০’ জননন্দিত দুটি শিল্পকর্ম। তিনি চিত্রাঙ্কনের চেয়ে চিত্রশিক্ষা প্রসারের ওপর অনেক বেশি সময় ব্যয় করেছেন। অনুমান করা হয় তার চিত্রকর্মের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংগৃহীত তার শিল্পকর্মের সংখ্যা ৮০৭। বেঙ্গল ফাউন্ডেশানের সংগ্রহে আরও প্রায় পাঁচশত চিত্রকর্ম সংরক্ষিত আছে। তার পরিবারের কাছে এখনও চার শতাধিক চিত্রকর্ম সংরক্ষিত। ময়মনসিংহের সংগ্রহশালায় রক্ষিত চিত্রকর্মের সংখ্যা ৬২।
এছাড়া পাকিস্তানের বিভিন্ন সংগ্রহশালায় তার বিপুল পরিমাণ চিত্রকর্ম সংরক্ষিত আছে।
জয়নুল আবেদিন ব্যক্তিগত জীবনে জাহানারা আবেদিনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। তাদের তিন সন্তান। মৈনুল আবেদিন, খায়রুল আবেদিন ও সারোয়ার আবেদিন।
পূর্ববঙ্গে তথা বাংলাদেশে চিত্রশিল্প বিষয়ক শিক্ষার প্রসারে আমৃত্যু প্রচেষ্টার জন্য জনসাধারণ্যে তিনি শিল্পাচার্য অভিধা লাভ করেন। বাংলাদেশের চিত্রকরদের মধ্যে তিনি শিল্পগুরু বিবেচিত। তার নামে চারুকলা অনুষদে একটি গ্যালারি রয়েছে। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ৩৫ সংখ্যক গ্যালারীটিতে শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন চিত্রশালা হিসাবে সজ্জিত করে।
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন কর্তৃক ৯ জুলাই, ২০০৯ বুধ গ্রহের একটি জ্বালামুখ তার মানবসভ্যতায় মানবিক মূল্যবোধ ও উপলদ্ধিকে গভীরতর করার প্রেক্ষিতে আবেদিন জ্বালামুখ নামে নামকরণ করা হয়। তার জন্মদিন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উৎসব হয় ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালায় (আর্ট গ্যালারি) শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
বিশ্বের প্রাচীনতম ও সর্ববৃহৎ ব্রিটিশ নিলামকারী প্রতিষ্ঠান বনহামসে তার স্কেচ বিক্রয় হয়। তিনি ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সবচেয়ে বড় খেতাব হেলাল-ই-ইমতিয়াজ,১৯৬৮ সালে ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্রদের তরফ থেকে 'শিল্পার্চায' উপাধি এবং ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে জাতীয় অধ্যাপক (বাংলাদেশ) সম্মান লাভ করেন।
তার ১০৫ তম জন্মদিনে গুগল ডুডল ফিচার করে সম্মননা করে।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রাইড অফ পারফরম্যান্স পুরস্কার প্রদান করেন চিত্রাঙ্কন এ উল্লেখযোগ্য অবদান এর জন্য।বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করেন।
জয়নুল আবেদিন ১৯৭৬ সালের ২৮ মে মৃত্যুবরণ করেন। চারুকলা ইনস্টিটিউটে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। তার আঁকা শেষ ছবি- " দুই মুখ"।
নিউইয়র্কে ১৮ মার্চ ২০২৪ তারিখে এক নিলামে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের দুইটি চিত্রকর্ম রেকর্ড দামে বিক্রি হয়েছে। ‘সাঁওতাল দম্পতি’ নামের একটি চিত্রকর্ম তিন লাখ ৮১ হাজার মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়েছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা চার কোটি ১৭ লাখ সাড়ে ছয় হাজার টাকা। নিলামে বাংলাদেশের কোনো শিল্পীর শিল্পকর্মের জন্য এটিই সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রি হওয়ার রেকর্ড বলে জানিয়েছেন শিল্পবোদ্ধারা। দ্বিতীয় পেইন্টিংটি বিক্রি হয় দুই লাখ ৭৯ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার বা তিন কোটি ছয় লাখ টাকার কিছু বেশি। এর আগে ২০১৮ সালে নিউইয়র্কে জয়নুল আবেদিনের সাঁওতাল সিরিজের আরেকটি চিত্রকর্ম নিলামে বাংলাদেশি মুদ্রায় দেড় কোটি টাকায় বিক্রি হয়।
This article uses material from the Wikipedia বাংলা article জয়নুল আবেদিন, which is released under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 3.0 license ("CC BY-SA 3.0"); additional terms may apply (view authors). বিষয়বস্তু সিসি বাই-এসএ ৪.০-এর আওতায় প্রকাশিত যদি না অন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। Images, videos and audio are available under their respective licenses.
®Wikipedia is a registered trademark of the Wiki Foundation, Inc. Wiki বাংলা (DUHOCTRUNGQUOC.VN) is an independent company and has no affiliation with Wiki Foundation.